সপ্তবিংশ অধ্যায় – দৈনন্দিন প্রলয় কথন
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মন্বন্তর শব্দে মনুর অধিকার-কাল বোধ হয়, অর্থাৎ এক একজন মনু, যতদিন প্রজাপালন করেন, ততদিন তাহারই নামে মন্বন্তর প্রচলিত হয়, ইহা শুনা আছে। ১
একসপ্ততি দৈবযুগে এক এক মন্বন্তর; চতুর্দশ মন্বন্তরে এক কল্প; এই কল্পই বিধাতার দিন। ২।
ব্রহ্মার দিনাবসানে, জগতে অত্যন্ত উৎপাত হইতে থাকে; মহামায়া যোগনিদ্রা, ব্রহ্মাকে আশ্রয় করেন। ৩
সেই লোকপিতামহ ব্রহ্মাও অমিততেজা বিষ্ণুর নাভি-কমলে প্রবিষ্ট হইয়া সুখে নিদ্রা যান। ৪
অনন্তর বিষ্ণু, স্বয়ং ত্রৈলোক্যসংহর্তা রুদ্ররূপী হইয়া পূর্বের ন্যায় সমস্ত ভুবনমণ্ডল বিনষ্ট করিতে থাকেন। ৫
তিনি যেমন মহাপ্রলয়কালে, বায়ু-বহ্নি-সাহায্যে সমস্ত দগ্ধ করেন, সেইরূপ দৈনন্দিন প্রলয়েও ত্রিলোক দাহ করেন। ৬
ত্রৈলোক্য দাহ-কালে করাল-কৃশানু-তাপ-পীড়িত মহর্লোকনিবাসিগণ, তাপার্ত হইয়া জন-লোকে গমন করেন। ৭
অনন্তর, রুদ্র, নানাবর্ণ ঘোর-গর্জন প্রলয়কালীন জলদ-জাল দ্বারা মহাবৃষ্টি করাইয়া ধ্রুবলোক পর্যন্ত ব্যাপী উত্তুঙ্গ-তরঙ্গাকুল জলরাশিদ্বারা ভুবনমণ্ডল পরিপূর্ণ করেন এবং সেই পরমেশ্বর, ত্রৈলোক্যকে নিজ জঠরাভ্যন্তরে রাখিয়া নাগপৰ্যঙ্কে শয়ন করেন। ৮-১০
সেই জগৎপতি নারায়ণ, ব্রহ্মাকে নাভিকমলে রাখিয়া এবং ত্রৈলোক্য দাহ করিয়া লক্ষ্মী সমভিব্যাহারে নাগপৰ্যঙ্কে শয়ন করেন। ১১
যখন কালানলে সমস্ত ভুবনমণ্ডল দগ্ধ হয় এবং ত্রৈলোক্যগ্রাসে পরিতৃপ্ত পরমেশ্বর যোগনিদ্রার বশবর্তী হন, তখন অনন্ত, পৃথিবী ছাড়িয়া তাহার নিকটে গমন করেন। ১২-১৩
অনন্ত, ত্যাগ করিলে পৃথিবী ক্ষণমধ্যে অধোগত হইতে হইতে কুৰ্ম্ম-পৃষ্ঠে পতিত হইয়া যেন খণ্ড-বিখণ্ড হইয়া পড়ে। ১৪
তখন, কুৰ্ম্ম, পদ-নিকর-দ্বারা ব্রহ্মাণ্ড-নিম্ন অবলম্বনপূর্বক জলোপরি ভাসমান দোদুল্যমান পৃথিবীকে পৃষ্ঠোপরি ধারণ করেন। ১৫
“এই পৃথিবী ব্ৰহ্মাণ্ডখণ্ডে পতিত হইলে একেবারে চূর্ণ হইয়া যাইবে” ভাবিয়া কুৰ্ম্মরূপী নারায়ণ তাহাকে ধারণ করেন। ১৬
পৃথিবী, চঞ্চল-জলরাশিসংসর্গে দোদুল্যমান হইলে কূৰ্ম্ম, বহুতর ব্রহ্মাণ্ড ধারণ-ক্ষম নিজ-পৃষ্ঠকে বিস্তৃত করেন। ১৭
যথায় ক্ষীরোদ সমুদ্রে নারায়ণ, লক্ষ্মীসমভিব্যাহারে নিদ্রাভিলাষী শেষ নামক পরমেশ্বর মহাবল অনন্ত, তথায় যাইয়া ত্রৈলোক্য-গ্রাসতৃপ্ত সেই পরমেশ্বরকে মধ্যম ফণা দ্বারা ধারণ করেণ; পূর্ব-ফণা পদ্মাকারে উর্ধ্বে বিস্তৃত করিয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করেন। ১৮-১৯
দক্ষিণ-ফণা তাহার উপাধান করিয়া দেন; উত্তর-ফণা তাহার পাদোপধান করেন। ২০
মহাবল অনন্তরূপী বিষ্ণু, পশ্চিম-ফণাকে তালবৃন্ত করিয়া নিদ্রাভিলাষী দেবদেবকে স্বয়ং ব্যজন করেন। ২১
তিনি নারায়ণের শঙ্খ, চক্র, নন্দকখড়্গ, তুণীর-দ্বয় এবং গরুড়কে, ঈশান ফণার দ্বারা ধারণ করেন। ২২
আর গদা, পদ্ম, শার্ঙ্গধনু এবং অন্য সমুদয় অস্ত্র শস্ত্র আগ্নেয়-ফণা দ্বারা ধারণ করেন। ২৩
অনন্ত, এইরূপে নিজদেহকে নারায়ণের শয্যা করিয়া এবং জলমগ্না পৃথিবীর উপর অধো-দেহ স্থাপন করিয়া আপনারই শরীরান্তর জগৎ-কারণ-কারণ জগদ্বীজ নিত্যানন্দ বেদময় ব্ৰহ্মণ্য জগৎ-কারণ-কর্তা। তৎকালে নারায়ণের নাভি-কমলে ব্রহ্মা ও জঠরাভ্যন্তরে ত্রৈলোক্য বিরাজিত থাকে। ২৪-২৭
ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানাধিপতি পরাবরগতি সপরিচ্ছদ লক্ষ্মী-সহচর নারায়ণকে মস্তকে ধারণ করেন। ২৮
অব্যয় নারায়ণ, ব্ৰহ্ম দিবসের সম-পরিমাণ সন্ধ্যাসহ রাত্রি এইরূপে শয়ন করিয়া অতিবাহিত করেন। ২৯
এই প্রলয়-ব্ৰহ্মার প্রতি দিনান্তেই হয় বলিয়া পুরাবেতৃগণ ইহাকে “দৈনন্দিন” প্রলয় বলিয়া থাকেন। ৩০
রজনী অতীত হইলে, লোকপিতামহ ব্রহ্মা, ইহ জগতে পুনরায় সৃষ্টি করিবার জন্য নিদ্রা ত্যাগ করিয়া উত্থিত হন। ৩১
ত্রিভুবনকে জলরাশিপূর্ণ ও পুরুষোত্তমকে শয়ান দেখিয়া-ব্রহ্মা, মহামায়া নারায়ণের অঙ্গ-সংস্থিতা বৈষ্ণবী মায়া জগন্ময়ী যোগ নিদ্রাকে স্তব করিতে লাগিলেন। ৩২
নির্বিকারা চিৎশক্তি পরম ব্রহ্মরূপিণী মহামায়া সনাতনী যোগনিদ্রাকে আমি প্রণাম করি। ৩৩
দেবি। তুমি যোগিগণের তত্ত্ববিদ্যা, তুমি গতি, তুমি স্তুতি, তুমি সৃষ্টি, তুমি স্থিতি; তুমি আহা-স্বধা, তুমি সঙ্গীতরূপা। ৩৪
তুমি সাম গীতি, তুমি নীতি, তুমি লজ্জা, তুমি লক্ষ্মী, তুমি সরস্বতী; হে ঈশ্বরি। তুমিই যোগনিদ্রা, মহানিদ্রা ও মোহনিদ্রা। ৩৫
তুমি কান্তি, তুমি সর্বশক্তি, তুমি বিষ্ণুমূর্তি, তুমিই শিবা; তুমি সর্বলোক ধাত্রী, তুমিই প্রাণিগণের অবিদ্যা। ৩৬
হে দেবি! তুমি ব্ৰহ্মাণ্ড-ধারিণী আধারশক্তি; তুমিই সৰ্বজগতের ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি। ৩৭
তুমি সাবিত্রী, তুমি গায়ত্রী, তুমি সৌম্যা, তুমি ভীষণা, আবার তুমিই অতি শোভনা, তুমি নারায়ণের নিত্যসিসৃক্ষা, তুমি সুষুপ্সা, তুমিই সুষুপ্তি। ৩৮
হে পরমেশ্বরি। তুমি, লজ্জা-পুষ্টি-ক্ষমা-শান্তি-ধৃতি; তুমি পৃথিবীরূপে সচরাচর ভুবনমণ্ডল ধারণ করিতেছ। ৩৯
তুমি জল, তুমি জলের কারণ; তুমি সৰ্বাভ্যন্তরচারিণী; তুমি স্তুতি, তুমি স্তবের যোগ্য, তুমি স্তুতিকারিণী, আবার তুমিই স্তুতিশক্তি। ৪০
আমি তোমাকে কি স্তব করিব? হে পরমেশ্বরি। প্রসন্ন হও; হে জগদম্বে। তোমার পায়ে পড়ি, নারায়ণকে জাগাইয়া দেও ৪১
ব্ৰহ্মা, লোকধাত্রী মহামায়ার এইরূপ স্তব করিলে তিনি, নারায়ণকে চক্ষু মুখ, নাসিকা, বাহু এবং হৃদয় হইতে নির্গত হইলেন। ৪২
রজোগুণময়ী মূৰ্ত্তি অবলম্বনপূর্বক ব্রহ্মার নয়নপথে অবস্থিত হইলেন। ৪৩
অনন্তর, নারায়ণ, যোগনিদ্রা কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া ক্ষণমধ্যে ভুজঙ্গশয্যা হইতে গাত্রোখান করিলেন ও সৃষ্টি করিতে উদ্যত হইলেন। ৪৪
অনন্তর, তিনি জলমগ্না পৃথিবীকে বরাহরূপে উদ্ধৃত করিয়া অবিলম্বে জল রাশির উপরিভাগে স্থাপন করেন। ৪৫
পৃথিবী সেই জলরাশির উপরে বৃহৎ নৌকার ন্যায় অবস্থিত হয়, বিস্তৃত দেহ বলিয়া ডুবিয়া যায় না। ৪৬
অনন্তর, নারায়ণ, পৃথিবীতে আসিয়া নিজ মায়াবলে সমস্ত জলরাশি অপসারণপূর্বক প্রাণিগণের স্থিতির জন্য নিজেই সচেষ্ট হন। ৪৭
অনন্তও পূর্ববৎ পৃথিবীতলে গিয়া কুর্মোপরি অবস্থিত হইয়া পৃথিবী ধারণ করেন। ৪৮
অনন্তর, সৰ্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মা, সমস্ত প্রজাপতিগণকে উৎপাদন করিয়া জগৎ সৃষ্টি করিয়া থাকেন। ৪৯
ব্রহ্মা বা দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ, যখন যে সৃষ্টি করেন, তখন তাহাই পরমেশ্বরের ইচ্ছাসম্ভূত। ৫০
হে দ্বিজবরগণ! ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি প্রবৃত্ত প্রজা স্রষ্টাদিগের প্রতি পরমব্রহ্ম-স্বরূপ ভগবান্ প্রকৃতি, পৃথিব্যাদি পঞ্চভূত, পুরুষ এবং মহদাদি প্রকৃতির অনুগ্রহ জন্মে। ৪১-৫২
পুরুষগণ, মহাভূতসমূহ, প্রধান-পুরুষ, ব্ৰহ্ম, কাল এবং মহদাদি প্রকৃতির অধিষ্ঠান হেতু স্থাবর অথবা জঙ্গম, স্থির অথবা নশ্বর যাহাদের উৎপত্তি হয়, সে সকলেতেই পরম-পুরুষ কারণসমূহে অধিষ্ঠান করেন। ৫৩-৫৪
ভগবান্ হরি, মহাদেবকে যে প্রকারে কল্পাত্ত সম্বন্ধীয় সৃষ্টি এবং সংহার দর্শন করাইয়াছিলেন, আমি তাহা বিশেষরূপে তোমাদের নিকট বর্ণন করিলাম। ৫৫
ভগবান্ মহাদেবকে যেরূপে জগৎ-প্রপঞ্চের অসারতা দর্শন করাইয়াছেন, সম্প্রতি সেই বিষয় বর্ণন করিতেছি, হে দ্বিজগণ! তাহা শ্রবণ কর। ৫৬
সপ্তবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ২৭