কালেক্টর, সিভিল সার্জেন আর এলাকার মোর্চা
এক রকমের বেখাপ্পা আদালত হয় যাদের বলে এলাকার মোর্চা (Local Juntee) বা মহকুমা ওয়াকফ (muhakimah ooukaf)। এই মোর্চার কাজ কীভাবে চলে তা খুব কম লোকেরই জানা আর সুপ্রিম কোর্টের মতোই এই মোর্চা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শুনলে মনে হবে এটা তো আর পাঁচটা আদালতেরই মতো আর তার দরকারও আছে। সরকারের দখল করা জমির হেপাজত করবে বলেই এই আদালত বানানো হয়। তা ছাড়াও এর আরেকটা কাজ ছিল মজহাবের১ নামে দান করা কোনও সম্পত্তি যাতে বেহাত না হয় তা দেখা। জেলার কালেক্টর আর সিভিল সার্জেনরা হত এই মোর্চাগুলোর মাথা। সরকারি ফরমান ছিল চাইলে তারা তাদের পছন্দ মাফিক লোকেদের এই আদালতের কাজে বহাল করতে পারবে। ডাক্তার সাহেবদের কেন এই কাজে বাছা হল তা আমার জানা নেই। হয়রানির এই কাজে কোনও মজুরি ছিল না। শহরের তমাম বজ্জাতরা তা সে যে মজহবেরই হোক না কেন দৌলতমন্দ কোনও পড়শির সঙ্গে হুজ্জত করতে চাইলে দাখিল করত একটা সওয়াল। তাতে দস্তখত থাকত খায়ের-খাঁ-ই-সরকার (Khyr-khwah-i-sircar) এর। নালিশ, সেই দৌলতমন্দের জমি আর মাকান হচ্ছে সিয়াসতের নুজুল (nuzool) আমানত। আদমি সমজদার হলে ঝটপট খয়ের খাঁ-দের সঙ্গে রফা করে নিত। না হলে শুরু হত এক আজব তাকতের খিলাফ লড়াই। এই খয়ের খাঁ-দের মর্জি হলে যখন খুশি এলান করতে পারত যে আধা শহর হল তাদেরই দখলে আবার চাইলে তারা আদত জমির মালিকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে করতে পারত মামলাও। এরকম কোনও মামলা দায়ের হলে আদালতের তা-না-না দেখার মতো। কারও জানা নেই সেই আদালত কোথায়-কবে বসবে। স্রেফ পয়গম্বরই বলতে পারেন কবে ফয়সালা হবে মামলার। যেমন ঢিমে তালে চলে কাজকারবার তাতে সুপ্রিম কোর্টের কানুনি ইনসাফের ধারাটার আর কোনও মানে থাকে না।
সব দেখে শুনে একজনের কথা মনে পড়ে। তিনি হলেন জনাব অগাস্টাস ব্রুক। বহুদিন হল তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে। কিন্তু লোকে এখনও তাঁর গল্প করে। জনাব ব্রুক ছিলেন গভর্নর জেনারেলের আমিন। এ ছাড়াও প্রভিনশিয়াল কোর্ট অব অ্যাপিল-এর চিফ জজ। একবার এক মামলার বহর দেখে তিনি তো গেলেন ঘাবড়ে। মামলাবাজ দুই তরফের সঙ্গেই ছিল তাঁর জান পহচান। তিনি বুঝেছিলেন এই মামলা চালিয়ে যাওয়া মানে স্রেফ হয়রানি। তাই তিনি তলব করলেন দুই তরফকেই। বললেন, “বোলো বাবাজান! আব মে মুকদ্দমা কো গোরখানা মে ভেজতা হুঁ” (bhulla Babajan! ub myee mokuddumma ko ghourkhana men bhejta hoon)। শোনো বাবাজানেরা, আমি এই মুকদ্দমা এবার আমার তদবির দপ্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা আর কী করে সেলাম ঠুকে কামরা ছাড়ল। এই ভেবেই তারা খুশ যে মামলাটা তো ঠেকানো গেছে! এরপর আর খুব বেশি কিছু হওয়ার ছিল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আদালতের দলিল দস্তাবেজ থেকে বাদ হয়ে গেল সেই মামলা। এলাকার মোর্চার শুনানি আর ফয়সালার ধরনটাও এই রকমই।
এলাকা মোর্চা অনেক সময় চায় কিছু ভাল কাজ করতে। কিন্তু সেই খোয়াহিশ কখনওই পূরণ হয় না। তারা কিছু করার আগেই জানা যায় কোনও এক তরফ আদালতের ডিক্রি হাসিল করে বসে আছে। একটা খাস জমি বা সম্পত্তির হক নাকি বেশক আম আদমির। তাই তা হাত ফেরতা হবে না। এক দৌলতমন্দ বরাত দিলেন মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা (suraee) তৈরির। নিজের নাম রোশন করতে এলান করা হল সেটা খয়রাতি। সেই লোকের এন্তেকাল হলে তার পোতার হল বেহাল দশা। পাওনাদারেরা আদালতের ডিক্রি পেলে মালুম হল সেই সরাইটাও নাকি তারই তালুকাত। বিক্রি হয়ে গেল সরাই। নতুন মালিক এবার ভাড়াটিয়াদের (Bhutearahas) কাছ থেকে চেয়ে বসল তার কিরায়া। বছর ভর চলতে লাগল কিরায়া উশুল। সেই সময় এক জবরদস্ত হাকিম বহাল হলেন। তিনি কিছুটা গরিব পরওয়ার (ghureeb purwar)। নিজের কাম কাজে ওয়াকিবহাল, তিনি জোর দিলেন কী করে এলাকার সরাই, মসজিদ, দেওয়াল, ইঁদারা আর যা যা কিছু আম আদমির মালিকানা সেসব বজ্জাতদের কব্জা থেকে ছাড়িয়ে আনা যায়। তাঁর কথায়, আলবাত এসবের মালিক হল আম আদমি। কোনও রকমেই তা হাতফেরতা হতে পারে না। সরকার তো বেদখল ঠেকাতেই এলাকা মোর্চা মঞ্জুর করে। কিন্তু তিরিশ বছর ধরে দখলদারি চলেছে। দখলদারদের উৎখাত করার পুরো চেষ্টাটাই হল বরবাদ। তাই দেওয়ানি আদালতকে এলাকা মোর্চার খিলাফ ফয়সালা করতে হল।
এক রেস্তোদার হিন্দু, এন্তেকালের সময় তার তামাম মালিকানা লিখে রেখে গিয়েছিল হিন্দু সমাজের উন্নতির জন্য। সেই কাজ যে তদারক করবে বাছাই করা হয় তেমন একজন লোক। পঞ্চাশ বছর পার হলে এক খায়ের খাঁ এলাকা মোর্চার কাছে আর্জি পেশ করল সে নাকি ওইসব তালুকাতের আদত মালিক। তার ফরিয়াদ, তছরুপ হয়েছে তহবিল আর হাত বদল হয়েছে মালিকানা। শুরু হল এক লম্বা কার্রবাই। দায়ের হল মোকদ্দমা। আখেরে জিত হাসিল করল সরকার। বাকি জমি জায়গা যা বেদখল হয়নি এল তাদের হেপাজতে। যে লোকের উপর ছিল তদারকির ভার এবার তার ওয়ারিশরা বলতে লাগল তারা চায় হেপাজতের কাজটা করতে। দখলদারের হাত থেকে জমি হাসিল আর সিংহের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে আনা একই কথা। যারা তদারকি করতে চায় তাদের বলা হল আদালতে যাও। যারা তদারকি করতে চায় তারা বেশক তহবিল তছরুপ করেছিল। তাই আদালত সরকারের তরফেই ফয়সালা শোনাল। জরুর আপনারা জানতে চাইবেন কী করে তহবিল তছরুপ হল? আমার কথা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে আমি ইসলামের নামে শপথ করে বলতে পারি সেই জায়দাদ পান্ডা, ঘাটিয়া, পূজারি আর সব ব্রাহ্মণদের খাওয়াতেই খরচ হয়ে যায়। এলাকা মোর্চার হুকুমে হর রোজ এদের ডাল-রুটি-ঘি-ভাত খয়রাতি করা হত। বেশ কিছু তালুক থেকে আবার মিলত আনাজ-ফল-ফুল। সে সব জিনিস দেউল (dewuls) গুলোতে মূর্তির সামনে ভোগ চড়ানো হত। আমি দেখে তাজ্জব বনে যাই, কোথায় গেলেন সেই সাহেবান আলিসানেরা যাঁরা বলেন, ইসলাম ধর্ম হচ্ছে কট্টর আর হিন্দুদের বুতপরস্তির (boot-purustee) সামনে জবান বন্ধ! সরকারের বেনামদারেরা সরাসরি এখানে পুতুল পুজোয় মদত দিচ্ছে! আমার যদি তেমন তাকত থাকত তা হলে ওই টাকায় আমি একটা মসজিদ খাড়া করতাম। কমসে কম নিজেকে তো তখন মুতওল্লি (mootuwullee) ভাবা যেত। এই কাজটা করতে পারলে মিলে যেত পয়গম্বরের মেহেরবানিও। তা যখন হওয়ার নয় তখন এই বলে নিজেকে তসল্লি দিতাম, যারা পুতুল পুজো করে আর যারা তাদের মদত দেয় আখেরে সবাই যাবে দোজখে।
আমি আগেও আপনাদের বলেছি যে কাশীর মতো বড় আর দৌলতমন্দ শহরে কোনও রেস্তোদার আদমির যখন এন্তেকাল হয় তখন দেখবেন না যে তার কোনও ওয়ারিশন বা ওয়াসিয়াতনামা নেই। কারণ সেটাই হচ্ছে রেওয়াজ। কোনও দরদি হয়তো সওয়াল করল, বাবু ফৌলনার (Fullanah) যেহেতু কোনও ওয়ারিশ নেই আর তিনি কোনও ওয়াসিয়াতনামাও করে যাননি তাই সরকারের কাজ হবে তাঁর জায়দাদের দখল নেওয়া। তখন জরুর দেখা যাবে কেউ না কেউ বখশিশনামা (Bukshisnama) হাতে খাড়া। সেই বখশিশনামা লিয়াকতের (liyaquat) সঙ্গে রেজিস্ট্রি করা, সাক্ষীও আছে। তাই জায়দাদের সেই হচ্ছে আদত হকদার। সাক্ষীদের তলব করা হলে তারা শপথ নিয়ে বলবে, বখশিশনামায় যা যা লেখা আছে সব ঠিক। সরকার তখন বেয়াকুব! আর সেই বজ্জাতটা সবাইকে বুদ্ধু বানিয়ে দখল করবে সম্পত্তি। দেখবেন গোঁসাই আর মহান্তদের কখনও ওয়াসিয়তনামা ছাড়া এন্তেকাল হয় না। তার জায়গায় কোনও পছন্দমাফিক চ্যালা বা ছোকরা ওয়ারিশ হিসাবে বসে যায়।
সরকারকে বুদ্ধু বানানো হর রোজ চলতেই থাকে আর যারা ওই কাজগুলো করে তারা নিজেদের ভাবে খুব বাহাদুর। আসল কেরামতি দেখবেন একটা কোনও সম্পত্তি নিয়ে দু’-তিন জন ওয়ারিশ খাড়া হলে। সবাই দাখিল করেছে রেজিস্ট্রি করা আসল ডিড। দেখাও এবার নিজের দম! হর তরফ তখন ইন্তেজার করে আরেক তরফ কী ভুল করে। মামলা রুজু হবে Forma Pauperies বা মুফলিস আদালতের ধারা মোতাবেক। যেখানে স্ট্যাম্প মাশুল বা উকিলের মজুরি কবুল করতে হয় না। কিন্তু দেখা যাবে হতচ্ছাড়া মিনসেদের যতরকম আজুরা হয় সবই দিতে হচ্ছে। হাজার হাজার টাকা খরচ হওয়ার পর মেলে ডিক্রি। এবার ডিক্রি যে পেল সে দেখে একটা দামড়িও (dumree) আর উশুল করা যাচ্ছে না। কানুন যাঁরা বানিয়েছেন তাঁরা চান সবাই যাতে ইনসাফ পায়। তাই Forma Pauperies-র মতো বন্দোবস্ত চালু হয়েছে। এতে আবার স্ট্যাম্প মাশুলের খুব বড় লোকসান। কোনও কানাকড়ি না ঠেকিয়েও একজন মুফলিস ওয়ারিশ বলে দশ লাখ টাকার সম্পত্তি দাবি করতে পারে। উল্টো দিকে যে ফরিয়াদি মামলা রুজু করেছে তাকে খরচ করতে হবে হাজার হাজার টাকা।
১. মজহাব: ধর্মসম্প্রদায়, দলগত