সময় বারটা পঁচিশ।
দুটি ট্যান্সপোর্ট হেলিকপ্টার ফোর্টনকের ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে।
জেনারেল র্যাবি নিজেই এসেছে। তাঁর সঙ্গে এক শ সতের জনের একটি সুসজ্জিত কমান্ডো দল। হেলিকপ্টার দুবার নামার মতো ভঙ্গি করেও ওপরে উঠে গেল। র্যাবি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। জেনারেল ডোফার ধারণা যদি সত্যি হয়, তা হলে হেলিকপ্টার নিয়ে নাম হবে একটা বড় ধরনের বোকামি। সরাসরি বাঘের মুখে পড়ে যাওয়া। তার চেয়ে আকাশে থাকা ভালো।
ফোর্টনকের সাঁইত্রিশ মাইল উত্তরে প্যারাট্রুপার নামানো হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা এসে পড়কে। ব্যস্ততার কিছু নেই। জেনারেল র্যাবির চোখে ফিল্ড টেলিস্কোপ। ফিল্ড টেলিস্কোপে দেখা যাচ্ছে বিরান জনভূমি। এর মানেও সে বুঝতে পারছে না। র্যাবি হেলিকপ্টার-পাইলটের পেছনে বসে ছিল। পাইলটের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারছ?
পাইলট মাথা না ঘুরিয়ে বলল, একটা জিনিসই বুঝতে পারছি। সেটা হচ্ছে, ফোর্টনকে কেউ নেই।
ঘাপটি মেরে বসে আছে হয়তো।
তা থাকতে পারে।
তুমি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে আছ তো?
তা আছি।
দশ মিনিটের মাথায় প্যারাট্রুপাররা ফোর্টনকে ঢুকল। গ্রাউন্ড থেকে জানানো হল, অল ক্লিয়ার। জেনারেল র্যাবিকে নিয়ে হেলিকপ্টার নেমে এল।
জেনারেল র্যাবি প্রথম যে-কথাটি বলল, তা হচ্ছে, এ তো দেখি ভয়াবহ অবস্থা! এরা করেছে কী!
ফোর্টনক মোটামুটি একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যেখানে-সেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে। ফ্যামিলি কোয়ার্টারগুলি থেকে মহিলা এবং শিশুদের কান্ন শোনা যাচ্ছে। জেনারেল র্যাবি কঠিন গলায় বলল, ফোর্টনকে কেউ নেই, এ-সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হবার পর আমাকে জানাও, আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
প্রতিটি ঘর দেখা হয়েছে স্যার।
ভালো কথা। এক শ ভাগ অ্যালার্ট থাকতে হবে। বাঙ্কারগুলিতে পজিশন নাও।
নেওয়া হয়েছে স্যার।
চমৎকার!
ফ্যামিলি কোয়ার্টারে যারা আছে, তাদের নিয়ে এস। তাদের কাছ থেকে শুনি, কী হয়েছে। আর ডেডবডিগুলির একটা ব্যবস্থা কর। কজন মারা গেছে, তাদের লিস্ট তৈরি করতে হবে।
লিস্ট করা হচ্ছে স্যার।
ভেরি গুড। ওয়্যারলেস অপারেটরকে বল—জেনারেল ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে, আমি কথা বলব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
শোন, জেনারেল ডোফার সঙ্গে কথা বলার আগে আমি মাওয়ার স্ত্রী এবং কন্যার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আশা করি তারা সুস্থ আছে।
আমি এক্ষুনি খোঁজ নিচ্ছি স্যার।
প্যারাট্রুপার বাহিনীর কমান্ডার কে?
কর্নেল ফাতা।
সে কোথায়? আমার কাছে কি ইতমধ্যেই তার রিপোর্ট করার কথা নয়?
স্যার, আমি ওঁকে খবর দিচ্ছি।
জেনারেল র্যাবি বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকাল, আর ঠিক তখনি ভয়াবহ বিস্ফোরণ হল। ফোর্টনকের গুদামঘরটি বিস্ফোরণের চাপে কয়েক ফুট শূন্যে উঠে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে গুড়িয়ে পড়ল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে একসাথে গর্জে উঠল বেশ কিছু এলএমজি র্যাবি শুধু বলল, কি হচ্ছে? এর বেশি কিছু বলতে পারল না। কারণ, তার কথা শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটেছে। মাথার ওপরে বিম-দেওয়া উঁচু ছাদ খুলে আসছে।
প্যারাট্রুপার দলের অধিনায়ক কর্নেল ফাতা ফোর্টনকের সর্বদক্ষিণের বাংকারে বসে অনুসন্ধানী দল কীভাবে পাঠানো হবে তা ঠিকঠাক করছিল। তার মুখে চুরুট। বিস্ফোরণের পরপর সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, খুব বড় রকমের বোকামি হয়েছে। খুবই বড় ধরনের বোকামি।
কী বোকামি হয়েছে তা বলার মতো অবসর হল না। তিন ইঞ্চি মর্টারের একটি গোলা এসে পড়ল। নিখুঁত নিশানা, যার থেকে অনুমান করা যায়, বাংকারগুলির পজিশনমতে মটারের গোলা ছোঁড়া হচ্ছে। প্রতিটি বাংকার আক্রান্ত হবে।
পরবর্তী কুড়ি মিনিটে যা ঘটল তার নাম হতবুদ্ধি সৈন্যবাহিনীর রিফ্লেক্স অ্যাকশানজনিত বিশৃঙ্খলা।
ওরা ভেতর থেকে আক্রান্ত হয়েছে, এটা বুঝতে বেশ কিছু সময় নষ্ট হল। বাংকারের নিরাপদ আশ্রয়ে যারা ছিল, তারা ভেতরের দিকে গুলি করবে কি করবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তারা ক্রল করে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে যাবে। কিন্তু আক্রমণের কোনো কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল দূরপাল্লার জন্যে উপযুক্ত। প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি তাদের ছিল না। বিপক্ষ দলের জনবল সম্পর্কেও একটি ভুল ধারণা তৈরি হল, যা মানসিকভাবে তাদের কাবু করে ফেলল।
শুধু হেলিকপ্টার দুটির পাশে দাঁড়ানো দশজনের একটি ইউনিট মাথা ঠাণ্ডা রাখল। মুহূর্তের মধ্যে তারা দুটি লাইট মেশিনগান বসিয়ে ফেলল। যে-ভুলটা সবাই করেছে—পাগলের মত নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, তা তারা করল না। কভার নেবার চেষ্টা করতে লাগল।
রবিনসন তার দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশকে রেখেছিল হেলিকপ্টার দখলের জন্যে। তারা তা করতে পারল না। হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনী রবিনসনের দলকে কাছ-ঘেঁষতে দিল না। রবিনসনের দল যা করতে পারল তা হচ্ছে, রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে দুটি হেলিকপ্টারের একটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া।
ফোর্টনকের সর্বত্রই আগুন জ্বলছে। রবিনসন হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনীর নজর ঢাকবার জন্যে একটি স্মোক বোম ব্যবহার করেছে। সেই ঘন কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। বাইরের বাংকারগুলি থেকে এইচএমজির গুলিবর্ষণের কান-ফাটানো আওয়াজ। তারা গুলি চালাচ্ছে বাইরে। যে-কোনো মুহূর্তে বাইরে থেকে আক্রমণ হবে, এটাই তাদের গুলিবর্ষণের কারণ।
হতভম্ব জেলারেল র্যাবি চরর মধ্যে ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করল। ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, বড় রকমের ফাঁদে পড়ে গেছি স্যার।
ডোফা শুকনো গলায় বললেন, কি ব্যাপার?
ফকনারের দল ভেতর থেকে আমাদের আক্রমণ করেছ। আশঙ্কা করছি, বাইরে থেকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকেও আক্রমণ হবে।
এখন কি আক্রমণ বন্ধ?
জ্বি। কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কি?
এখনো পুরো রিপোর্ট পাই নি। তবে অবস্থা বেশি ভালো না। বলা যেতে পারে খুবই খারাপ অবস্থা।
তুমি জেনারেল না-হয়ে একটা ছাগল হলে ভালো হত।
আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।
পরিস্থিতি তোমার পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রবেশ করানো হবে।
জেনারেল ডোফা ওয়্যারলেস রিসিভার নামিয়ে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন।
র্যাবির কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির পুরো বিবরণ পাওয়ার পরপরই জেনারেল ডোফা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠালেন। তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল প্রায় এক ঘন্টা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাঁদের বিরাট বিপর্যয়ের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। হাসিমুখে কথা বলেন।
জেনারেল ডোফাও তাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখে যে-কথাটি শেষ মুহূর্তে বললেন, তার সরল অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর দুটি শয়তান তৈরি করেছেন। দুটির একটি হচ্ছে, যে আদমকে গন্ধম ফল খাইয়েছে—আর অন্যটি হচ্ছে, মার্কিন সরকার।
রাষ্ট্রদূত সেই কথায় প্রাণখুলে হাসল। মধুর স্বরে বলল, আপনি খুবই রসিক। তবে ভয় নেই, আমরা আপনার পেছনে আছি।
ডোফা হাসিমুখে বললেন, শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে সমস্যা কি, জানেন? সমস্যা হচ্ছে, আপনারা একই সঙ্গে দু-তিন জনের পেছনে থাকেন। এই মুহূর্তে হয়তো-বা অন্য একজন জেনারেলের পেছনেও আছেন, আবার কে জানে। হয়তো ফকনারের পেছনেও আছেন।
আপনি খুবই রসিক ব্যক্তি।
ঠিক ধরেছেন, খুবই রসিক।
দুপুরে ডোফা তাঁর স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম করে নদীতে সাঁতার কাটতে গেলেন। তার জন্যে একটি ক্যাবিনেট মিটিং করতে হল। এখন আর কোনো কিছুতেই মন বসছে না।
নদীর পাড়ে টিভি ক্যামেরাম্যান, সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যচিত্রের গাড়ি এবং বেশ কজন পত্রিকার ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে। আগামীদিনের পত্রিকায় ডোফার সাঁতারের ছবি ছাপা হবে। খবরের ধরন কী হবে, তথ্য মন্ত্রণালয় তাও জানিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে তা লেখা হয়ে গেছে। ফটোকপি করা হচ্ছে। ডোফার অনুমতি পেলেই সাংবাদিকদের হাতে-হাতে দিয়ে দেওয়া হবে।
উসসি নদীতে ডোফা
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজ হঠাৎ উসসি নদীতে সাঁতার কাটার জন্যে উপস্থিত হন। জনগণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে তাঁদের মাঝখানে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন। তাঁরা তুমুল হর্ষধ্বনি দিতে থাকেন। মহামান্য প্রেসিডেন্ট নদীর পারে দণ্ডায়মান জনগণকে তাঁর সঙ্গে সাঁতারের আমন্ত্রণ জানান। এই আহ্বানে তাঁদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাঁতার কাটতে-কাটতেই তাঁদের ব্যক্তিগত কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং তাঁদের আশ্বাস দেন যে, অদূর ভবিষ্যতে উসসি নদীতে বাঁধ দেবার ব্যবস্থা সরকার করবে, যাতে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় উসসি নদীর দুপাশের মানুষকে আর কষ্ট না-করতে হয়।
তথ্যচিত্রের কর্মীরা বড়-বড় রিফ্লেক্টর ফিট করছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সূর্য বারবার মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ভালো ছবি তোলা খুব সহজ হবে না। টিভি ক্ররা ক্যামেরা নিয়ে নৌকায় উঠে গেছে। অপেক্ষা করছে–কখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি নদীতে নামবেন।
ডোফা শেষ মুহূর্তে নদীতে নামার পরিকল্পনা বাতিল করলেন। তবু সবাই নদীর পারে অপেক্ষা করতে লাগল, যদি আবার ফিরে আসেন। কিছুই বলা যায় না, আসতেও ত পারেন।