ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক আবদুল মজিদের ছাত্রীমহলে ভাল সুনাম আছে। ইনি ভাল পড়ান। ক্লাস ফাঁকি দেন না। ছাত্রীদের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করেন না। ছাত্রীদের যখন পড়া জিজ্ঞেস করেন, তাদের চোখের দিকে তাকিয়েই করেন, কখনো তাদের বুকের উপর চোখ রেখে করেন না।
ছাত্রীরা আবদুল মজিদ সাহেবের কাব্যপ্রতিভার কিছু জানে না। দুৰ্দান্ত এই আধুনিক কবি, যাঁর একটি কবিতার নাম–
(ইশ্বর)১/৩ x (মৃত্যু)২/৩ = ০
প্রকাশিত হবার পর যে মোটামুটি হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে ছাত্রীরা অজ্ঞ।
ছাত্রীদের এই সম্মানিত শিক্ষক প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাজ আদায় করতে যান। কারণ তিনি থাকেন ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িতে। ওয়াদুদ সাহেব গার্লস কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এই অঞ্চলের ধনবান এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি। ওয়াদুদ সাহেবের নেক নজর লাভ করা ভাগ্যের কথা। আবদুল মজিদ তা লাভ করেছে। ওয়াদুদ সাহেব মজিদকে থাকার জন্যে নিজের বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। মজিদের জন্যে তার বাড়ির ভেতর থেকে খাবার পাঠানো হয়। বিনিময়ে মজিদকে ওয়াদুদ সাহেবের তৃতীয়া কন্যা জাহেদা খাতুনকে ঘন্টাদুই করে পড়াতে হয়। জাহেদা খাতুন। এই বৎসর ইন্টারমিডিয়েট দেবে। সে পড়াশোনায় ভাল। এসএসসি-তে স্টার পেয়েছে। ইটারমিডিয়েটেও ভাল করবে।
জাহেদা খাতুন দেখতেও সুন্দর। কাটা কাটা চোখ-মুখ। মাথা ভর্তি চুল। স্যারের কাছে পড়তে যখন আসে তখন বেশ সেজোগুজে আসে। যেমন–চোখে কাজল থাকে। মেয়েটি খুবই শান্ত, চোখ তুলে তাকায় না বললেই হয়। আবদুল মজিদ যখন বলে–বুঝতে পারছ? জাহেদা তখন এত দ্রুত মাথা নাড়ে যে, মাজদের মনে হয় মেয়েটার মাথা বোধহয় শরীর থেকে ছিড়ে পড়ে যাবে। তার একেকবার বলতে ইচ্ছে করে–জাহেদা, এ রকম করে মাথা ঝাকিও না। মাথা ঘােড় থেকে খুলে পড়ে যাবে। তুমি কন্ধকাটা হয়ে যাবে। মজিদ বলে না, কারণ তার ধারণা মেয়েটা রসিকতা বুঝবে না। এই জাতীয় কোন কথা বললে কেঁদে-টেদে একটা কাণ্ড করবে। মূর্তির মত একটা মেয়েকে পড়াতে ভাল লাগার কথা না, কিন্তু মজিদের ভাল লাগে।
শুক্রবার ছুটির দিন। জাহেদা শুক্রবারে পড়তে আসে না। এইদিন বিকেলের পর থেকে মজিদের খুব অস্থির লাগে। নিজের উপর রাগ লাগতে থাকে। যদিও রাগ লাগার কোনই কারণ নেই। সাপ্তাহিক ছুটি তো থাকবেই। একদিন পড়তে না এলে কি হয়? শুক্রবার ছাড়াও মেয়েটা অন্যান্য দিন হঠাৎ হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই পড়তে আসে না। মজিদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ভেতর বাড়ি থেকে মেটাসোটা একটি কাজের মেয়ে এসে বলে, রাঙ্গা আফা আইজ পড়ত না।
মজিদ গম্ভীর মুখে বলে, আচ্ছা। বলার পরেও সে নিজের চেয়ারে বসে থাকে। তার উঠে যেতে ইচ্ছো করে না। পরীক্ষার আগে আগে এরকম কামাই দেবার মানে কি? একদিন সে জাহেদাকে বলল–
শোন জাহেদা, কোন কারণ ছাড়া হুট করে পড়া বন্ধ করবে না। পরীক্ষা ঘাড়ের উপর চলে এসেছে। এই সময় পড়া বন্ধ করবে না। মনে থাকবে?
জাহেদা তার স্বভাবমত প্রবল বেগে মাথা বঁকিয়েছে।
শুক্রবারে তুমি আস না এটাও ঠিক না। আমি তো আর অফিস খুলে বসিনি যে শুক্রবারে অফিস ছুটি। আমি যখন আছি তখন তোমার পড়তে আসার সমস্যা কি? এরপর থেকে শুক্রবারেও আসবে।
জাহেদা আবার মাথা নেড়েছে। তার সেই বিখ্যাত মাথা নাড়া। মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে যাবে।
জাহেদা শুক্রবারে পড়তে আসেনি। শুধু শুধুই মজিদ অপেক্ষা করেছে। শেষে মেজাজ এত খারাপ হয়েছে যে, রাতে যখন নসু। নামে কাজের ছেলেটা ভাত নিয়ে এসেছে তখন বলেছে–ভাত নিয়ে যাও। ভাত খাব না।
নসু বলেছে, খাইবেন না ক্যান?
শরীর ভাল না। মনে হয় জ্বর।
রুটিপিঠা খাইবেন?
কিছুই খাব না। তুমি এইসব নিয়ে যাও তো।
নসূ টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে গেল। মজিদের ক্ষীণ সন্দেহ হল, জ্বরের কথা শুনে হয়ত জাহেদা তাকে দেখতে আসবে। দেখতে আসাটাই স্বাভাবিক। সে তার শিক্ষক। যথেষ্ট যত্ন নিয়ে তাকে সে পড়াচ্ছে। সেই শিক্ষকের শরীর খারাপ, জ্বর। জ্বর বেশি বলেই রাতের খাবার খায়নি। এ রকম অবস্থায় সাধারণ ভদ্রতা হচ্ছে ছাত্রীর এসে খোঁজ নেয়া।
মজিদ গরমের মধ্যেই একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিল। জাহেদা যদি এসে দেখে সে হাফ শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছে তাহলে সে কি ভাববে?
জাহেদা দেখতে এল না। শুধু তাই না, পরের দিন পড়তে এসে একবারও জিজ্ঞেস করল না–স্যার, আপনার শরীর এখন কেমন?
মেয়েটা যদি কথাবার্তা বলতো তাহলে অনেক মজা করা যেত। মজিদ কয়েক লাইন কবিতা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলত–
জাহেদা–কবিতাটা মন দিয়ে পড়ে আমাকে বল অর্থ কি?
জাহেদা মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, আমি পারব না। স্যার।
না পড়েই বললে পারব না। এটা তো ঠিক না। আগে পড়, খুব মন দিয়ে পড়।
জানি না ওপাশে কে আছে।
হেসে হেসে কি কথা সে কয়?
দাঁড়ায় না পায় শুধু ভয়।
কবিতাটার তো স্যার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
মন দিয়ে পড়ছ না। মন দিয়ে পড়লেই বুঝতে।
হাজারো মন দিয়ে পড়লেও কিছু বুঝব না। আপনি বুঝিয়ে দিন।
প্রতিটি বাক্যের প্রথম অক্ষরটা নিয়ে দেখা কি হয়? প্রথম বাক্যের প্রথম অক্ষর জা, দ্বিতীয়টার হে, তৃতীয়টার দা। কি হল?
আপনার মাথা হল।
স্যারের সঙ্গে এ আবার কি ধরনের কথা?
স্যারেরই বা কি ধরনের কোণ্ড। ছাত্রীকে নিয়ে কবিতা লেখা! তাও যদি ঠিকমত হত। দাঁড়ায় বানান হল চন্দ্রবিন্দু দিয়ে–তাহলে নামটা হয় জাহেদাঁ। মনে হচ্ছে ভূতের নাম।
তোমার নামটা এরকম যে সুন্দর কবিতা হয় না।
তাহলে আমাকে আপনার পড়ানো দরকার নেই। এমন কাউকে পড়ান যার নাম দিয়ে সুন্দর কবিতা হয়।
জাহেদা ঝটি করে উঠে দাঁড়াল। মজিদ হাত ধরে তাকে বসাতে গেল। শক্ত করে হাত ধরতে গিয়ে কাঁচের চুড়ি একটা ভেঙে গেল। গল গল করে রক্ত পড়তে লাগল। মজিদ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ইশ! হাত কেটেছে!
জাহেদা বলল, হাত কাটুক। কিন্তু আমার চুড়িটা যে ভেঙেছে তার কি হবে? এত শখ করে কাচের সবুজ চুড়ি কিনেছি। আপনি কি জানেন–সবুজ চুড়ি পাওয়া যায় না? আপনি কি কিনে দিবেন। সবুজ চুড়ি?
এইসব হাস্যকর পরিকল্পনা মজিদ কেন করে সে জানে না। জাহেদা হাতে কাচের চুড়ি পরে না। তার হাত ধরার কলম্পিনাটা তো ভয়াবহ। একবার জাহেদার হাত থেকে কলম নেবার সময় হাতে হাত লেগে গিয়েছিল। এতে জাহেদা যেভাবে চমকে উঠে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তা দেখে মজিদর প্রায় দুদিন মন খারাপ ছিল। এরপর থেকে কলমের দরকার হলে সে বলে, জাহেদা, কলামটা দাও তো। জাহেদা কলম দেয়। তবে হাতে দেয় না, তার সামনে টেবিলে নামিয়ে রাখে। তখন মজিদের নিজেকে খুব তুচ্ছ, খুব ক্ষুদ্র মনে হয়–ইচ্ছে করে ওয়াদুদ সাহেবকে বলে, আপনার নৈঃশব্দদ্বতী কন্যাকে আমি পড়াব না। তার জন্যে অন্য মাস্টার রাখুন। সবচে ভাল হয় যদি মাস্টারের বয়স ৮০-র উপরে হয় এবং মাস্টার সাহেবের দুটা হাত হয় কাঠের।
এই জাতীয় কথা কখনো বলা হয় না। মজিদ সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে–কখন আসবে জাহেদা। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসবে চেয়ারে, পরবর্তী দেড় ঘণ্টা সেই মাথা সে আর উঁচু করবে না।
মজিদ তার ছাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করছিল। জাহেদা আসতে দেরি করছে। মজিদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল— আজ আবার কোন কারণে সে আসা বাদ দেবে না। তো? কাজের মেয়েটা এসে বলবে না তো–রাঙ্গা আফা আইজ পড়ব না।
না, তা হবে না। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মজিদ পায়ের শব্দে কাউকে চিনতে পারে না–শুধু একজনকে পারে। এটাও কি খুব আশ্চর্য ব্যাপার না? বাংলাদেশের দশ কোটি মানুষ হেঁটে গেলে সে বলতে পারবেনা কে হেঁটে যাচ্ছে–শুধু জাহেদা হেঁটে গেলে বলতে পারবে। এই আশ্চর্য ব্যাপারটা কোনদিন মেয়েটি জানবে না–এই ট্রাজেডির কোন তুলনা হয়?
জাহেদা চেয়ারে এসে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নসু। এসে বলল, ঢাকা থাইক্যা আফনের দুই বন্ধু আসছে–নাম বলছে সাজ্জাদ আর আতাহার।
দুজনই মজিদের অতি প্রিয়জন। অনেক দিন সে তাদের দেখে না, আনন্দে মজিদের লাফিয়ে উঠা উচিত। কিন্তু মজিদের মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। তার ইচ্ছা করল সে চিৎকার করে বলে–এদের চলে যেতে বল! এদের আমি চিনি না।
মজিদ জাহেদার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আমি পড়াব না। কাল বেশি করে পড়াব। কেমন?
নৈঃশব্দদ্বতী কথা বলল না, শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
সাজ্জাদ। বলল, কিরে মজিদ, তোকে এ রকম লাগছে কেন?
কি রকম লাগছে?
তোর কি যেন হয়েছে–তোর মধ্যে ঘর-জামাই ঘর-জামাই ভাব চলে এসেছে।
মজিদ হাসল। তবে ঠিকমত হাসতেও পারল না। হাসিটা কেমন যেন ঠোঁটের কোণায় ঝুলে রইল।
সাজ্জাদ বলল, বোকার হাসি কবে থেকে শিখলি? ও মাই গড়! কি অদ্ভূত করে হাসছিস! হয়েছে কি?
কি আবার হবে?
ঝেড়ে কোশ তো। ঝেড়ে কাশ।
কফ থাকলে তবে না ঝেড়ে কাশব–কফ নেই।
সাজ্জাদ আতাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, আতাহার, বল তো ঠিক করে ওকে
কেমন লাগছে?
ওকে গৃহস্থের মত লাগছে।
মজিদ আবারো হাসল। সে এখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। তবে বন্ধুদের দেখে এখন আনন্দ হচ্ছে। রক্তে পুরানো স্মৃতি জেগে উঠেছে। একে বোধ হয় বলে রক্ত উজানে যাওয়া।
মজিদ বলল, তোদের পরিকল্পনা কি?
সাজ্জাদ বলল, তোকে নিয়ে ফুল-মুন দেখব।
আজ ফুল-মুন না-কি?
আতাহার বলল, আজ ফুল-মুন নাকি তাও জানিস না? তোর হয়েছে কি? তুই কি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিস?
উহুঁ।
অবশ্যই ছেড়ে দিয়েছিস। তোকে দেখেই মনে হচ্ছে তুই বর্তমানে মফস্বলি অধ্যাপক। আজ রাতের জন্যে অধ্যাপকী খোলসটা ঝেড়ে ফেলে দে।
মজিদ শংকিত গলায় বলল, ঝেড়ে ফেলে কি করব?
সাজ্জাদ বলল, আমরা ত্রিমূর্তি বোহেমিয়ান জীবনে ফিরে যাব। তোদের এখানে ব্রথেল আছে না?
মজিদ আঁতকে উঠে বলল, কি সর্বনাশের কথা!
আছে কিনা সেটা বল।
আছে তো নিশ্চয়ই। তবে কোথায় তা জানি না।
সাজ্জাদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ওদের কয়েকটাকে ধরে এনে চল নদীর পাড়ে চলে যাই। চাঁদের আলোয় ধেই ধেই করে নোচানাচি করব।
পাগলের মত কথা বলিস না তো।
পাগলের মত কথা মানে? আজ রাতটা হবে নাইট অব দ্য পোয়েটস।
এখানে এসব সম্ভব না।
অবশ্যই সম্ভব। ইমপসিবল ইজ দ্যা ওয়ার্ড ফাউন্ড ওনলি ইন দ্যা ডিকশনারি অব ফুলস। তুই তো বোকা না। তোদের এখানে নদী আছে?
হুঁ।
ছোট না বড়?
ছোট। তবে এখন ভাল পানি আছে।
একসেলেন্ট। বজরা ভাড়া পাওয়া যাবে?
জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে ব্রথেলের মেয়েদের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর কর।
মেয়ে ছাড়া নাইট অব দ্যা পোয়েটস হবে কি ভাবে? এ বাড়ির কোন মেয়ের সঙ্গে ভাব-টাব হয়নি? ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিয়ে চল।
মজিদ হড়বড় করে বলল, ওয়াদুদ সাহেবের কোন মেয়ে নেই। উনার দুই ছেলে। দোস্ত আরেকটা কথা, এই বাড়িতে কোন মদ খাওয়া-খাওয়ি হবে না। এরা অসম্ভব রকম কনজারভেটিভ।
সাজ্জাদ বলল, আমাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেই ব্লগ কেটে ফেলবে?
প্রায় সে রকম। জোন-শুনে তুই এই জায়গায় পড়ে আছিস? ব্যাপারটা কি? তুই ঝেড়ে কাশ তো সোনামণি।
সোনামণি ঝেড়ে কাশতে পারল না। সে চাচ্ছে দ্রুত বন্ধুদের নিয়ে বের হয়ে পড়তে। মাগরিবের নামাজের পর ওয়াদুদ সাহেবের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। মজিদ চাচ্ছে না তার বন্ধুদের সঙ্গে ওয়াদুদ সাহেবের দেখা হোক। সাজ্জাদের মুড ভাল থাকলে অসম্ভব ভদ্র ব্যবহার করবে। ওয়াদুদ সাহেব তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। মু্ড খারাপ থাকলে সে ওয়াদুদ সাহেবকেই হাসিমুখে বলবে, স্যার, কিছু মনে করবেন না–আপনাদের এখানকার ব্রথেলটা কোন দিকে?
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়–এই প্ৰবচন সত্য প্রমাণ করার জন্যেই–ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে সবার দেখা হয়ে গেল। মজিদ চাপা আতংক নিয়ে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। সাজ্জাদের এসএসসি এবং অনার্সের রেজাল্টের কথা বলতে ভুলল না। ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনারা এই সন্ধ্যাবেলা যাচ্ছেন কোথায়? বিশ্রাম করেন। খাওয়া-দাওয়া করেন।
সাজ্জাদ বলল, স্যার, আমরা গ্রামের জোছনা দেখতে এসেছি। রাতে খাওয়া-দাওয়া করব না।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন না মানে? জোছনা খেয়ে পেট ভরে?
ঠিকমত খেতে পারলে জোছনা খেয়েও পেট ভরে। বেশিরভাগ মানুষ জোছনা খাওয়ার টেকনিক জানে না।
ওয়াদুদ সাহেব বিস্মিত হয়ে মজিদের দিকে তাকালেন। মজিদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমরা চলে আসব। রাত একটু বেশি হবে কিন্তু চলে আসব।
যাচ্ছ কোথায়?
ওয়াদুদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, নদীর পাড়ে মানুষ হাঁটে? নদীর পাড় হল পায়খানা করার জায়গা।
সাজ্জাদ বলতে যাচ্ছিল–আমরা পায়ে গুং মাখার জন্যেই ঐদিকে যাচ্ছি। অনেকদিন পায়ে গু মাখা হয় না। মজিদের করুণ মুখ দেখে বলল, স্যার, আমরা খুব সাবধানে হাঁটব। আমার নাক কুকুরের নাকের মত। এক মাইল দূর থেকে গন্ধ পাই।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনারা জোছনা দেখতে চান তো আমার একটা খামার বাড়ির মত আছে, সেখানে চলে যান না। সুন্দর বাগান আছে, টিনের একটা ঘর আছে, পাশ দিয়ে নদী গেছে। ইচ্ছা করলে নদীর পাড় ধরে হাঁটতেও পারেন।
সাজ্জাদ বা আতাহার কিছু বলার আগেই–মজিদ হড়বড় করে বলল, জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
নসুকে বলে দেই, নসু। তোমাদের নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
বেশি দেরি করবেন না। চলে আসবেন। একসঙ্গে খানা খাব।
আবারো মজিদ হড়বড় করে বলল, জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
সাজ্জাদ। বলল, স্যার, আপনি খেয়ে নেবেন। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন না। আমাদের খাওয়া ঢেকে রাখলেই হবে। আমরা কখন ফিরি ঠিক নেই। মজিদের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা। পেট ভর্তি গল্প জমা হয়ে আছে।
বেশি দেরি না করাই ভাল।
রাত গভীর না হলে জোছনা ফুট না। জোছনা ফোঁটার জন্যে একটু দেরি স্যার হবেই।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনি আমাকে স্যার স্যার বলছেন কেন?
আপনার আপত্তি থাকলে আর বলব না। চাচা ডাকব। চাচা, আমরা তাহলে যাই।
ওয়াদুদ সাহেব আরো হকচকিয়ে গেলেন।
গ্রামের চাঁদ শহরের চেয়ে কি আগে ওঠে? রাত বেশি হয়নি, এর মধ্যেই আকাশে বিশাল এক চাঁদ। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সাজ্জাদ বলল, জোছনার অবস্থাটা দেখেছিস?
সে কোন জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না
আসিবে না কখনো প্ৰভাতে
আতাহার বলল, বল দেখি কার লাইন?
আতাহার বলল, জী দাশ বাবুর লাইন।
এই কবিতার শেষ লাইন বলতে পারবি?
না।
মজিদ পারবে। কি রে মজিদ, তুই পারবি না?
মজিদ বিরস গলায় বলল, শেষ লাইন হচ্ছে–
অশ্বখের শাখা ঐ দুলিতেছে, আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
একসেলেন্ট। কবিতাটার মজাটা কোথায় জনিস? আলো আসছে, ভোর হয়ে আসছে–এই দুঃখে কবি বিষন্ন। এখানেই কবির সঙ্গে আমার মিল। আমিও অন্ধকারের কবি।
মজিদ বলল, আমাদের এখন উঠা দরকার।
সাজ্জাদ বলল, এই কবিতাটা কেমন দেখ তো–
আকাশে চাঁদের আলো–উঠোনে চাঁদের আলো–নীলাভ চাঁদের আলো
এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক–অশথে ঘুঘুর ডাক–হৃদের ঘুঘুর যে ডাক
নরম ঘুঘুর ডাক আজ।
এই কবিতায় আমি একটা ভুল করেছি–ইচ্ছা করে করেছি। ভুলের জন্যে মাত্রায় গণ্ডগোল হয় গেছে। বল দেখি আতাহার ভুলটা কি?
আতাহার বলল, আমরা জোছনা দেখতে এসেছি, না কবিতার পরীক্ষা দিতে এসেছি?
সাজ্জাদ বলল, মজিদ, তুই বল। তুই পারবি।
মজিদ বলল, অশ্বত্থে হবে না, শব্দটা অশথে। জীবনানন্দ ইচ্ছে করে ভুল বানান ব্যবহার করেছেন।
একসেলেন্ট। তোর মত একজন কবি গ্রামে এসে গৃহপালিত কুকুর হয়ে গেলি–এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা নেই। আমি এসেছি তোকে উদ্ধার করতে।
আমাকে উদ্ধার করতে হবে মা
সাজ্জাদ ব্যাগ খুলে পেটমোটা একটা বোতল বের করল। মজিদ আঁতকে উঠে বলল, অসম্ভব, মদ খেয়ে ঐ বাড়িতে যেতেই পারব না।
সাজ্জাদ বলল, ঐ বাড়িতে যাবার দরকার কি? কোন দরকার নেই। আমরা সারারাত জোছনা দেখব। পায়ে গু মাখব। ভোরবেলা সুবোধ বালকের মত ঢাকা চলে যাব।
মজিদ বলল, পাগলের মত কথা বললেই হল? আমাকে গলা টিপে ধরলেও আমি এক ফোঁটা মদ খাব না।
এটা মদ না।
মদ না তো কি?
সিদ্ধির সরবত। পেস্তা বাদাম, ধুতরার পাতা দিয়ে অনেক ঝামেলা করে ঢাকা থেকে বানিয়ে এনেছি। নিধুবাবু নামের জনৈক এক্সপট বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি কালীপূজা ছাড়া সিদ্ধির সরবত বানান না। আমার বিশেষ অনুরোধ এবং বিশেষ অর্থ ব্যয়ের কারণে বানিয়েছেন। এই সিদ্ধির সরবত খাইয়ে–আজ তোর সিদ্ধিলাভ ঘটাব।
মজিদ বলল, অসম্ভব!
আতাহার বলল, ও খেতে চাচ্ছে না, ওকে জোর করে খাওয়ানোর দরকার কি?
সাজ্জাদ বলল, আচ্ছা থাক, আমি একাই খাব। আমি এই জোছনা পুরোপুরি অনুভব করতে চাই।
সাজ্জাদ বোতল থেকে ঢকা চক করে অনেকখানি মুখে ঢািলল। মুখ মুছে বলল, তোরা গান শুনবি?
কেউ হ্যাঁ বা না বলার আগেই সাজ্জাদ। গান ধরল–
বাউলা কে বানাইল রে?
হাসন রাজারে বাউল কে বানাইল রে?
কিছু কিছু মানুষ বাউলা হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। কে তাদের বাউল বানায়? সে কে? কে?
টলমলে জোছনায় এই গান বাউলা শ্রেণীর মানুষদের বড়ই কাবু করে। বিচিত্র উপায়ে এই গান তাদের রক্তে ঢুকে যায়। এক সময় রক্তের লোহিত রক্তকণিকারাও গানে অংশগ্রহণ করে। তখন মানসিক সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
মজিদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখি বোতলাটা। সে হাড়হড় করে অনেকখানি মুখে ঢেলে দিল। তারপর বোতলটা হাতে হাতে ঘুরতে থাকল। এই তিন যুবকের জন্যে চাঁদ অনেকখানি নিচে নেমে এল। সে তার জোছনাকে আরো তীব্র এবং একই সঙ্গে আরো কোমল করল।
মজিদ বলল, জোছনায় গোসল করলে কেমন হয়? গায়ের সব ময়লা জোছনায় ধুয়ে ফেলি। কি বলিস?
বাকি দুজন জবাব দিল না। মজিদ তার শার্ট-পেন্ট খুলে ফেলে পুরোপুরি নগ্ন হল। জোছনা সারা গায়ে ডলে ডলে স্নান শুরু করল।
রাত বাড়তে থাকল। সিদ্ধির সরবত তিন যুবককে অন্য জগতে নিয়ে গেল। যে জগতের সঙ্গে পৃথিবীর কোন যোগ নেই।
ওয়াদুদ সাহেব নসুকে সঙ্গে নিয়ে রাত দুটার দিকে তাদের খোঁজে এলেন। মফস্বলের মানুষ সব সময় হাতে টর্চ রাখে। তীব্র চাঁদের আলোতেও তারা টর্চ-হাতে চলাফেরা করে। ওয়াদুদ সাহেব টর্চের আলো ফেলে ডাকলেন, মজিদ! মজিদ!
মজিদ খিক খিক করে হাসল।
সেই হাসির শব্দে যে কেউ আতংকগ্ৰস্ত হবে। তিনিও হলেন। তিনি ভীত গলায় বললেন, মজিদ, কি হয়েছে?
মজিদ বলল, কিছু হয় নাই। আমার কিছু হয় নাই। কিছু হয় নাই।
বলেই সে ঝোপের আড়াল থেকে বের হল। হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগল ওয়াদুদ সাহেবের দিকে।
চাঁদের আলোয় নগ্ন একজন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে–এই ভয়ংকর দৃশ্য তিনি দেখলেন। নসু। দেখল। নসু বিড় বিড় করে কি যেন বলল। ওয়াদুদ সাহেবও বললেন। মজিদ আবারো খিকখিক শব্দ করে হাসল। পশুর গোংগানির মত শব্দ করে হাসতে তার খুব ভাল লাগছে।
নেত্রকোনা গার্লস কলেজ থেকে মজিদকে ছাটাই করা হয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বরখাস্তের চিঠিতে লিখেছেন–Your service is no longer required. চিঠিতে কোন কারণ দর্শনো হয়নি। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মজিদকে তার নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় বলেছেন–বেসরকারি কলেজের চাকরি আর কারখানার মজুরের চাকরি এক রকম। মালিকের মজির উপর চাকরি। বুঝলেন ভাইসাহেব, আমাকে যে রকম লিখতে বলেছেন। আমি লিখেছি। আপনার মত একজন ভাল শিক্ষক চলে যাচ্ছে। আফসোসের ব্যাপার।
মজিদ বলল, না, ঠিক আছে।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, রুটি-রুজির মালিক আল্লাহ পাক। আপনি এইটা শুধু মনে রাখবেন। মানুষ রুটি-রুজির ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। যা করার করেন উপরওয়ালা।
জ্বি।
এখন বলেন তো দেখি মজিদ ভাই ব্যাপারটা কি? ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে আপনার গণ্ডগোলটা কি নিয়ে? আমাকে বলা আর গাছকে বলা এক কথা। কাকপক্ষী জানবে না। বলেন দেখি ব্যাপারটা কি?
মজিদ বলল, ব্যাপার কিছু না।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, আমাকে ইন কনফিডেনেস বলতে পারেন। একটা কানাঘুসা শুনছি–সমস্যাটা না-কি ওয়াদুদ সাহেবের মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের না-কি ঝামেলা হয়ে গেছে–রোজ সকালে বমি-টমি হচ্ছে?
ছিঃ ছিঃ, কি যে বলেন! সমস্যাটা–সম্পূর্ণই আমার, আমি বন্ধুদের সঙ্গে সিদ্ধির সরবত খেয়ে নানান পাগলামি করেছি। ওয়াদুদ সাহেব দেখেছেন।
সিদ্ধির সরবত?
হ্যাঁ–স্ট্রং হেলোসিনেটিং ড্রাগ।
ও।
নেংটো হয়ে নাচানাচি করেছি–হাসাহাসি করেছি।
নেংটো হয়ে নাচানাচি?
জ্বি।
সোবাহানাল্লাহ, কি বলেন? আমরা আরো উল্টা কথা শুনেছি। আমরা শুনেছি…।
আপনারা কি শুনেছেন তা আমি শুনতে চাচ্ছি না। বিদায় হচ্ছি। আপনারা ভাল থাকবেন।
নেংটো হয়ে সত্যি নাচানাচি করেছেন নাকি রে ভাই?
হ্যাঁ সত্যি করেছি।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ তো বটেই।
তাহলে এখন ঢাকা চলে যাচ্ছেন?
জ্বি।
পথে পথে নেংটো নাচ নাচব, বেশ্যার দালাল হব, কবিতা লেখব…
প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। মজিদ নামের অতি ভদ্র, অতি বিনীত মানুষটা আজ কি ধরনের কথা বলছে? এ রকম একটা মাথা-খারাপ মানুষ মেয়েদের কলেজে এতদিন মাস্টারি করেছে? ভাবাই যায় না। এই লোককে তো অনেক আগেই পাগলা গারদে লোহার চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা উচিত ছিল।
মজিদের জিনিসপত্র ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িতে। সে ঢাকা থেকে আসার সময় একটা সুটকেস নিয়ে এসেছিল। এখন অল্প অল্প অনেক কিছু হয়েছে। লেপ, তোষক, কম্বাবল, চাদর, বালিশ। এইসব নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। এখানে আসার সময় একটা সুটকেস নিয়ে এসেছিল, একটা সুটকেস নিয়েই তার ফিরে যাওয়া উচিত। সন্ন্যাসীরা বলেন–আসছি নেংটা, যামু নেংটা। পৃথিবীতে আমরা নগ্ন হয়ে আসি, পৃথিবী থেকে ফিরেও যাই নগ্ন হয়ে।
মজিদ সুটকেস গুছালো–কয়েকটা শার্ট-পেন্ট আর এক তোড়া কাগজ, যার সাদা শরীরে কবিতা লেখা হয়েছে। সবই প্রেমের কবিতা। জনৈকা নৈঃশব্দদ্বতীকে নিয়ে লেখা। তার এই জীবনের সঞ্চয়। লেপ, তোষক, কাঁথা বালিশ পড়ে থাকুক। এইগুলি কোণ সঞ্চয় নয়।
যাবার আগে নৈঃশব্দবতীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। তাকে সহজ, গলায় যদি বলা যেত–
শোন নৈঃশব্দবতী, তুমি থেকে সুখে।
তুমি থেকে চন্দ্ৰ-শাদা দুধের সায়রে।।
কিছুই বলা যাবে না। যাবার আগে দেখা হবে না। মজিদের গলার কাছে দলা পাকাতে লাগল। দুঃখের এই অনুভূতি তার শৈশবে হত। আর কখনো হয়নি। আবারো অনেক অনেকদিন পরে হল। কি হাস্যকর ব্যাপার! বায়বীয় দুঃখ জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়। গলার কাছে এসে আটকে থাকে।
গোছগাছে সাহায্য করার জন্যে নসু। এসেছে। দড়িদাড়া নিয়ে সে প্রবল উৎসাহে তোষক বাঁধতে শুরু করেছে। মজিদ বলল, নসু, এইসব আমি নেব না।
নসু অবাক হয়ে বলল, নিবেন না?
না।
এইগুলো কি করবেন?
তুমি নিয়ে যাও।
আমি নিয়ে যাব?
হ্যাঁ–লেপ-তোষক, বিছানা-বালিশ সব নিয়ে যাও। আর শোন, তুমি জাহেদাকে বলবে সে যেন ভালমত পড়ে।
জ্বি আচ্ছা।
বলবে কিন্তু মনে করে।
অবশ্যই বলব। এখন বইল্যা আসি?
না, এখন বলতে হবে না। আমি চলে যাবার পরে বলবে।
জে আইচ্ছা।
আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে নসু?
অবশ্যই খাওয়াব। পানি খাওয়ামুনা এইটা কেমন কথা?
নসু পানি আনতে গেল। মজিদ সিগারেট ধরাল। এই বাড়িতে তার শেষ সিগারেট। সিগারেটের ছাই ফেলে সে চলে যাবে। উইড়া যায়রে বনের পক্ষী পইড়া থাকে মায়া।
উইড়া যাবে আবদুল মজিদ,
পইড়া থাকবে ছাই।
পানি নেন।
মজিদ চমকে তাকাল। পানির গ্লাস নিয়ে নসু। আসেনি, এসেছে জাহেদা। সে অন্যান্য দিনের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে মজিদের চোখের দিকে। পানির গ্লাসও ঠিক করে টেবিলে নামিয়ে রাখল না। গ্রাস হাতে নিয়েই সে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ পানির গ্রাস তার হাত থেকেই নিতে হবে।
কেমন আছ জাহেদা?
ভাল।
জাহেদার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। আশ্চর্য! মেয়েটার চোখ এত সুন্দর।
পানি নিন। কতক্ষণ গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকব?
মজিদ পানির গ্লাস নিল। তার তৃষ্ণা চলে গেছে। তারপরেও এক চুমুকে পানির গ্লাস শেষ করল। জাহেদা বলল, স্যার, বাবা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে তা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
এইসব আর করবেন না।
না, আর কোনদিন করব না।
আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করুন।
মজিদ বিস্মিত হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। কি বলছে এই মেয়ে?
জাহেদার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। মেয়েরা তাদের অশ্রু অন্যদের দেখাতে চায় না, প্রিয়জনদের তো কখনোই না। কিন্তু জাহেদা তার চোখ নিচু করছে না। সে তাকিয়েই আছে।
আপনি কোথাও যাবেন না। এই বাড়িতেই থাকবেন। আমি বাবাকে বলেছি।
বাবা তোমার কথা শুনবে?
হ্যাঁ শুনবে। কই, আপনি তো আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করছেন না।
মজিদ হাত বাড়াতেই নৈঃশব্দবতী তাকে জড়িয়ে ধরল। এ কি অদ্ভূত কাণ্ড! দরজা খোলা, জানালা খোলা, লোকজন আসা-যাওয়া করছেন। নৈঃশব্দবতী কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
মজিদ তার খাটে বসে আছে। তার হাতে একগাদা কাগজ। তার সারা জীবনে লেখা প্রতিটি কবিতা এই কাগজের তাড়ায় লেখা আছে। মজিদ বসে বসে কাগজগুলি ছিঁড়ে কুচি কুচি করছে। একটি প্রিয় জিনিস পেতে হলে অন্য একটি প্রিয় জিনিস ছাড়তে হয়। সে আজ থেকে কবিতা ছাড়ল। কবিতাকে তার আর প্রয়োজন নেই।