২৭ আগস্ট, শুক্রবার ১৯৭১
খাওয়ার টেবিল ঘিরে সবাই বসেছে–বদি, আলম, কাজী, স্বপন, চুলু, রুমী, জামী, মাসুম। শুধু শরীফ নেই, তার আজ ডি.সি.জি, আর-এ লাঞ্চের দাওয়াত। টেবিলের ওপর সাজানো পোলাও, কাবাব, চপ, রোস্ট, কোর্মা, পটল-ভাজি, সালাদ। রুমীর আবদারে আজ এই ভোজের আয়োজন। সবাই খেতে খেতে গত পরশুর কথাই আলোচনা করছে। গাড়িটা আলমরা ভূতের গলিতে একটা বাড়ির সামনের ভোলা লনে পার্ক করে রেখে এসেছে। বৃষ্টি পড়ছিল বলে রাস্তায় লোক ছিল না, ফলে ওদের কেউ দেখে নি। রিকশাও ছিল না, বৃষ্টির মধ্যেই বেশ খানিকটা হেঁটে হাতিরপুল বাজার পর্যন্ত এসে তারপর রিকশা পায়।
কানে এল আলম রুমীকে বলছে, উঃ! খুব সময়ে তুই কাচ ভেঙে গুলি করেছিলি, নইলে কেউই বাঁচতাম না আমরা।
রুমীও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আর তুইও অমন চালাকি করে গ্রীন রোডের সিগনাল দিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে না ছুটলে ওদের হাতে ঠিক ধরা পড়ে যেতাম। থ্যাংকস ফর টেকিং দ্য রাইট ডিসিশান অ্যাট দ্য রাইট মোমেন্ট।
বদি হাসতে হাসতে বলল, চাচী, এই দুর্দান্ত সাহসী ছেলে দুটোকে খুব ভালো করে খাইয়ে দ্যান তো। ওদের জন্যই আজ আমরা জানে বেঁচে পালিয়ে আসতে পেরেছি।
আমি বললাম, সাহসী তোমরা সবাই। তোমাদের রিফ্লেক্স নিখুঁত। অপূর্ব তোমাদের টিমওয়ার্ক। তোমরা সবাই দুর্দান্ত।
কাজী আফসোস করে বলল, জুয়েলটার বড় মন খারাপ। সে আমাদের আজকের অ্যাকশনে থাকতে পারল না। আগে কতগুলো অ্যাকশনে সে ছিল। চল আলম, আজ ওরে দেখতে যাই।
জুয়েল আছে আলমদের বাড়িতে, ওর বোনেদের হেফাজতে।
খাওয়া শেষ হলেও গল্প শেষ হতে চায় না। দেয়ালে ঝোলানো কোকিল ঘড়ির কোকিলটা তার ছোট্ট ঘরের দরজা খুলে মুখ বের করে চারবার কুকুটুকু করে ডাকল।
বাইরে পোর্চে গাড়ি থামার শব্দ পাওয়া গেল। গাড়ির দরজা খোলার শব্দের সঙ্গে তিন-চারজনের গলার স্বর। ওরা সবাই চকিত হয়ে একই সঙ্গে কথা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল এবং পায়ের আগার ওপর ভর দিয়ে নিঃশব্দে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।
জামী গিয়ে দরজা খুলল। আমিও পিছুপিছু গেলাম বসার ঘরে। শরীফের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন দাদাভাই, মোর্তুজা, ফকির। ঢুকেই মোর্তুজা চোখ বড় বড় করে বলে উঠলেন, শুনেছেন ভাবী কি কাণ্ড? পরশু সন্ধ্যা রাতে ১৮ নম্বর রোডে বিচ্ছুরা এক সাংঘাতিক অ্যাকশন করেছে। এক ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির সামনে আট-দশটা এম.পি.কে মেরে দিয়ে চলে গেছে। তারপর পাঁচ নম্বর রোডের মোড়ে আরেক সাংঘাতিক কাণ্ড। ঐ রাতেই আরেকদল বিছু একটা জীপে গুলি মেরে একেবারে উল্টে দিয়েছে। জীপে যারা ছিল, সবাই মারা গেছে।
আমাকেও চোখ বড় বড় করতে হল, বলেন কি? এই রকম বেপরোয়া কাণ্ড কারখানা? ওদের সাহস আছে বলতে হয়! কি করে যে করে। কারাই বা করে? কোথায় থাকে বিচ্ছগুলো? ধরা পড়েছে নাকি কেউ?
না ভাবী, কাউকেই ধরতে পারা যায় নি। ওরা কি মানুষ, না জীন? চোখের সামনে দিয়ে নাকি উধাও? সারা শহরে একেবারে হুলস্থুল পড়ে গেছে।
ফকির খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে বলল, সারা শহরে কি যে হচ্ছে আজকাল। যখন-তখন আসাদগেটে, মোহাম্মদপুরে, গুলিস্তান, নবাবপুরে সবখানে গাড়ি, বাস, চাকা ফেটে উল্টে যাচ্ছে। আজ সকালে দেখি কার্জন হলের কোণের চৌমাথায় বাংলা একাডেমির দিকের যে চৌমাথাটা ওই খানের আয়ল্যান্ডটার পাশে এক ডবল ডেকার উল্টে পড়ে আছে। বারো চোদ্দজন বিহারি, রাজাকার, মিলিশিয়া ওটাকে তুলে সারাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
জামী আস্তে করে বলল, ডবল ওরিয়েন্টাল বাম।
ফকির চমকে বলল, কি বললে বাবা?
কিছু না চাচা। মাথা ধরেছিল। ওরিয়েন্টাল বাম দিয়েছিলাম। ছাড়ে নি, উল্টো মাথাধরা বেড়ে গেছে।