২৭। নতুন জীবন

২৭। নতুন জীবন

দিনের তৃতীয় প্রহরে সেশেনুর জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋষভ। ইরতেনসেনু তার কোলে পরম যত্নে ধরে রয়েছে শ্বেতপুষ্পের কিশলয়টিকে, সেটিকে একটি নরম কাপড়ে মোড়া রয়েছে। বাকারির ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঋষভের সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুন্তবাসী গুহামন্দিরে পৌঁছায়। বাকারির বিষের প্রভাবে তারা তখনও কিছুটা আচ্ছন্ন।

কামারুর ভয়াল চিৎকার তাদের কানে এসে পৌঁছেছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাদের। সেই শব্দ লক্ষ করে গুহামন্দিরে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগেনি আর। মন্দিরের মেঝেতে তারা দেখেছিল কামারুর রক্তমাখা পায়ের ছাপ, যে ছাপ এসে শেষ হয়েছিল হ্রদের ধারে। এত শত বছর ধরে যে ওই অদ্ভুত দর্শন জন্তুটি হ্রদের গভীরে রয়েছে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সিন্দুদেবীর গুহা মন্দিরের অতন্দ্র প্রহরী এই কামারু কি তাহলে অমর?

তবে এই দানব যে তার কর্তব্যে অবিচল তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান যে এই পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান করতে পারে না তা বুঝেছে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু। রত্নটিকে সিন্ধুদেবীর গর্ভে স্থাপন করে তাদের বন্ধন মুক্ত করে ঋষভ। তাদের কাছ থেকে রাত্রির ভয়ঙ্কর ঘটনার বর্ণনা সে শোনে। সব শোনার পর ঋষভ বলেছিল, ‘আপনি সৌমির এই পরিচয়ে আজ আমার মনে কোন ঘৃণার উদ্রেক হচ্ছে না। আপনার জন্যই আজ সিন্ধুদেবীর গর্ভরত্নটি আবার সম্পূর্ণ হতে পারল।’

‘না, এই সম্মানপ্রাপ্তির অধিকার আমার নেই। যার জন্য এই হারিয়ে যাওয়া টুকরো দুটি আবার ফিরে এল সিন্ধুদেবীর কাছে, সে আমার বন্ধু উপল।’

সেনেনমুতের খুনের ঘটনা অগস্ত্য ঋষভকে বলেনি। উপল একটি পাপের স্খলনের জন্য অন্য একটি পাপ করেছিল, তার মূল্য তাকে নিজের প্রাণ দিয়ে চোকাতে হল। কিন্তু অগস্ত্য চেয়েছিল উপল তার শেষ সম্মানটুকু পাক। উপলের দেহটিকে সমাহিত করা হল শ্বেতপুষ্পের সেই বৃক্ষের নীচে যাকে অগস্ত্য স্বপ্নে দেখেছিল। শেষবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আগে অগস্ত্য দেখেছিল উপলের রক্তাক্ত শরীরটিকে। বিধাতার খেলা বড় অদ্ভুত। দেবী সিন্ধু হয়তো যাত্রার আগেই এই যাত্রার পরিণতি দেখিয়েছিলেন অগস্ত্যকে।

‘এবারে আমাকে বিদায় নিতে হবে।

বলল ঋষভ। সে ইরতেনসেনু এবং অগস্ত্যর দিকে তাকাল।

‘সেশেনুর অরণ্যের বাইরে যাওয়ার কোন অনুমতি আমাদের নেই। গর্ভরত্নটিকে রক্ষা করার জন্য পুন্ত নগরী অজ্ঞাতবাসেই থেকে যাবে অনন্তকাল ধরে। অবশ্য তাতে আমাদের কোন খেদ নেই। সিন্ধুদেবীকে এই অরণ্যের মাঝে রক্ষা করে চলব আমরা। নীলনদের জল কখনও শুকিয়ে যাবে না। অমর, অক্ষয় হবে মিশরীয় সভ্যতা। বাকিটা পথ তোমাদের একাই পাড়ি দিতে হবে। আমি এবার চলি। অনিকাদেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় হয়ে আসছে। তোমাদের বাকি পথের যাত্রা নিরাপদ হোক এই কামনা করি। সিন্ধুদেবী তোমাদের মঙ্গল করুন।’

অগস্ত্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেশেনুর ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল ঋষভ। বেশ কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে নুবিয়দের একটি গ্রামকে। সেখানে পৌঁছে ফারাও হাতসেপসুতের সম্পুটটিকে দেখালে নুবিয়রা ইরতেনসেনুদের সাহায্য করবে থীবসে পৌঁছতে।

সেশেনুর অরণ্য আর দূরবর্তী নুবিয়দের গ্রামের মাঝে রয়েছে একটি বৃহৎ চারণ ক্ষেত্র। লম্বা লম্বা নলিঘাসে ভরা সেই জমিটি। তার উপর দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু। বিকালের নরম সূর্যের আলো তাদের পিঠের উপরে এসে পড়ছিল। অগস্ত্যর বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে পিছন থেকে উপলের গলার আওয়াজ শুনতে পাবে। পিছনে ফিরে সে দেখবে হাসি মুখে ছুটে এসে উপল তার কাঁধে হাত রাখল।

কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়। তার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সাক্ষী সহচরটি এখন চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছে শ্বেতপুষ্পের গাছের নীচে। আর কোনদিন সমুদ্রে ভাসবে না সিন্ধুযান, আর কোনদিন কেউ অগস্ত্যকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করবে না।

‘এই পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে কেবল তুমি রইলে ইরতেনসেনু।’ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল অগস্ত্য। সে তাকিয়ে রয়েছে ইরতেনসের দিকে। সেই দৃষ্টিতে রয়েছে স্বজন হারানোর বেদনা, একাকীত্বের ভয়।

‘আমার পৃথিবীও তুমিই অগস্ত্য। পিতার মৃত্যু হয়েছে। মিশর আমার আপন দেশ নয়, পুন্তেও আমি আর কোনওদিন ফিরে আসব না।’

নিজের ডান হাতটি বাড়িয়ে ইরতেনসেনুর বাম হাতটি এবার ধরল অগস্ত্য। ধীর স্বরে বলল, ‘এই হাত আর ছেড়ো না কখনও। আমৃত্যু ধরে রেখো।’

‘রাখব। কথা দিলাম।’

বিকালের সূর্যকে সাক্ষী রেখে দুই নারী পুরুষ এরপর আলিঙ্গনে বদ্ধ হল। তাদের দুটি ওষ্ঠের মিলন হল। সেই চুম্বন যেন স্থায়ী হল অনন্তকাল ধরে। তারা উভয়েই তাদের পৃথিবীতে একা। কিন্তু তারা রয়েছে একে অপরের জন্য। মহামান্যা হাথোর, মহাশক্তিশালী সিন্ধুদেবীর আশীর্বাদ তাদের উপরে বর্ষিত হয়ে চলবে, তাদের অগোচরে। একদিন তারাও আর বেঁচে থাকবে না। তখন হয়তো ইতিহাস তাদের মনে রাখবে, পুরাণ তাদের গল্প বলবে।

পৃথিবীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান হয়তো আরও বলশালী হবে, তার আলোয় আলোকিত হবে মানবসভ্যতা, অথবা তার অন্ধকার হয়তো তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। তবু তারই মাঝে এই পৃথিবীর মানুষ তার সত্য-অর্ধসত্য-মিথ্যায় খুঁজে চলবে ঈশ্বরকে।

অনন্তকাল ধরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *