২৬-৩০. পুজো এসে গেল

হুড়মুড়িয়ে পুজো এসে গেল।

মহালয়ার পর থেকে উড়ো মেঘে বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে মাঝে। ব্যাপারি পশারিদের মাথায় হাত, পুজোর বাজার একটু জমলেই বৃষ্টি ধেয়ে আসে। চতুর্থীর দিন থেকে আকাশ সাফ হয়েছে, গরম ভাবও কমে গেছে অনেকটা।

অষ্টমীর দিন সকালে তিতিরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কন্দর্প। প্রতিবারের মতো উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখবে, কেষ্টপুরে জয়শ্রীর বাড়ি যাবে, মানিকতলায় তিতিরের মামার বাড়িতেও ঘুরে আসবে একবার। এবার সঙ্গে আরও একটা কাজ আছে কন্দর্পর, সেটাও সারবে।

কেষ্টপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে দশটা বেজে গেল। শংকর বাড়ি নেই, কোন এক পাম্প মালিকের বাড়ির দুর্গাপুজোতে গেছে, সন্ধেয় ফিরবে।

কন্দর্প মনে মনে একটু খুশিই হল। শংকর থাকলে এমন বকবক শুরু করে! গল্প মানে শুধুই আত্মপ্রচার। কাকে কী ভাবে ঠকিয়েছে, অফিসের কোন লোককে কী ভাবে নির্বোধ প্রতিপন্ন করেছে, গভর্নমেন্টের কোন অফিসারকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়েছে, এই সব বারফাট্টাই। নিজেকে অবিরাম বুদ্ধিমান প্রতিপন্ন করতে চায় যে লোক, তার সঙ্গ কি বেশিক্ষণ ভাল লাগে? মুস্তাফি কি কম ধূর্ত, তা বলে কি তার সব সময়ে এরকম হামবড়া ভাব আছে?

শংকর নয়, আজ কন্দর্প ঝান্টুর হাতে ধরা পড়ে গেল। ছোটমামাকে পেয়েই তার সমস্যার ঝাঁপি খুলে বসেছে ঝান্টু। ক্লাব তাকে এখন সাইড-লাইনে বসিয়ে রেখেছে! দু-পাঁচ হাজার টাকা ঠেকাবে বলেছিল, এখনও উচ্চবাচ্য করছে না! হাঁটুতে জোর চোট লেগেছে একটা, মালাইচাকি হঠাৎ হঠাৎ ঘুরে যায়, সারবে কি চোটটা! এরিয়ানের এক কর্মকর্তা তাদের ক্লাবে খেলার জন্য একসময়ে টোপ দিয়েছিল, এখন সে ঝান্টুকে একদম পাত্তা দিতে চায় না! ক্লাব ক্যান্টিনে প্র্যাকটিসের পর রোজ তাকে বুড়ি মুরগির স্টু দেওয়া হয়! রোজ রোজ বুড়ি মুরগি খেলে ঝান্টুর কি অকালবার্ধক্য এসে যাবে না!

কন্দর্পর কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। ঝান্টুর কথায় এক ধরনের শিশুসুলভ সারল্য আছে বটে, কিন্তু এত নির্বুদ্ধিতা হজম করা কঠিন। কন্দর্প ঠাট্টার সুরে বলল, – তোর জীবনে দেখছি বেদনা ছাড়া আর কিছুই নেই। তা হ্যাঁ রে, অষ্টমীর দিন সকালে বাড়িতে বসে বসে শুধুই সানাই বাজিয়ে যাবি? একটু প্যান্ডেলে গিয়ে বোস না। এখন কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে আসছে অঞ্জলি দিতে।

তিতির অনাবিল হাসছিল। সেদিকে চোখ পড়তে ঝান্টু লাল, বাবা প্যান্ডেলে বেশি যেতে বারণ করেছে।

-আশ্চর্য! কেন রে?

বাবা এবার পুজোর ভাইস প্রেসিডেন্ট তো। আমি সব সময়ে প্যান্ডেলে থাকলে বাবার প্রেস্টিজে লাগবে।

–আইব্বাস! শংকরদা ভাইস প্রেসিডেন্ট! জয়শ্রীর দিকে ঘুরল কন্দর্প, কত খসল?

–সে ওই জানে ও কত দিয়েছে। জয়শ্রী গর্বিত মুখে উত্তরটা এড়িয়ে গেল। আলতো ধমক দিল ঝান্টুকে, তোর কি ফুটবল ছাড়া পৃথিবীতে আর কথা নেই? অন্য গল্প কর।

তিতির বলল, – না গো পিসি, ঝান্টুদার মুখে ফুটবলের কথা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। তুই বল রে ঝান্টুদা।

কন্দর্প উঠে দাঁড়াল, তুই তা হলে শোন বসে বসে। আমি একটা চক্কর মেরে আসি।

অষ্টমীর সকাল বেশ রমরম করছে। পাশেই প্যান্ডেল, জোর গান বাজছে মাইকে। পুরনো দিনের আধুনিক গান। হঠাৎ হঠাৎ হেমন্ত-মান্নাকে রুখে দিয়ে পাড়ার অধিবাসীদের অষ্টমী পুজোর অঞ্জলি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে একটি ছেলে। গলা তার আবেগে থরথর, কিন্তু উচ্চারণটি বড় বদখত। বড্ড বেশি দন্ত-স-এর আধিক্য কানে লাগছিল কন্দর্পর।

ইদানীং এদিকটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। পাঁচ বছর আগেও জয়শ্রীরা যখন এখানে বাড়ি করে, তখনও অনেক ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন চারদিকে অজস্র নতুন নতুন বাড়ি। চারতলা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িও উঠেছে প্রচুর। দেখে বোঝাই যায় না বিশ-পঁচিশ বছর আগে এসব অঞ্চলে দিনদুপুরে শেয়াল ডাকত।

কন্দর্প বারান্দায় বেরিয়ে পাড়াটা দেখছিল। জয়শ্রী পাশে এসে বলল, — যাবি কোথায় এখন?

কাছেই। বাগুইআটিতে।

বন্ধুর বাড়ি?

কন্দর্প আলতো ঘাড় নাড়ল, হুম।

–ফিলম লাইনের বন্ধু?

–কেন, ফিলম লাইন ছাড়া আমার বন্ধু থাকতে নেই? কন্দর্প হেসে ফেলল, প্রফেশনের লোকরা বন্ধু হয় না।

জয়শ্রী বলল– ফিরছিস কখন? দুপুরে খেয়ে যাবি তো? আমি অঞ্জলিটা দিয়ে এসে রান্না বসাচ্ছি।

–দুর, তোদের তো আজ নিরিমিষ। কন্দর্প নাক কুঁচকোল, বচ্ছরকার দিনে নিরামিষ খাওয়া আমার পোয় না।

একদিন নয় গরিব দিদির বাড়ি নিরামিষই খেলি।

গরিবই বটে। কন্দর্প মনে মনে হাসল। বারোশো স্কোয়ার ফিটের বাড়ি বানিয়েছে, মেঝেতে মোজাইক পিছলোচ্ছে, দুটো ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, কালার টিভি, ভি সি আর, গাড়ি কিনে রাস্তায় চরাচ্ছে, এখন বোধ হয় নিজেকে গরিব বলতে আরামই পায় দিদি। বিয়ের পর পর যখন মনোহরপুকুরের আধা বস্তিতে থাকত, নুন আনতে পান্তা ফুরোত, তখন কিন্তু দিদি মুখ ফুটে নিজেকে গরিব বলতে পারত না। দারিদ্র্য তখন সর্বাঙ্গ দিয়ে ফুটে বেরোত কিনা! এখন শংকরদা টাকার মুখ দেখেছে, এখন নিজেকে গরিব বলে দিদি যদি সুখ পায় তো ভাল কথা। কিন্তু রুচিটা এরকম হয়ে গেল কেন? বাড়ি করেছে পয়সা খরচ করে, কিন্তু কোনও ছিরিছাঁদ নেই। ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মতো পর পর ঘর, অলিগলি প্যাসেজ, প্রতিটি ঘরে বিসদৃশ কিছু লফট, জানলার মাথায় মোটা মোটা সিমেন্টের লতাপাতা! রঙগুলোও অসহ্য। বসার ঘরের দেওয়াল ক্যাটকেটে সবুজ, বাকি দুটো ঘর গাঢ় গোলাপি। দরজা জানলা গ্রিল সবই বিশ্রী ধরনের হলুদ। ভাগ্যিস ছাদ থেকে একটা মাধবীলতা ঝুলিয়েছে গ্রিলে, নাহলে বাইরে থেকে বারান্দাটার দিকে তাকানো যেত না।

বাড়ি তো বাইরের জিনিস, দিদির দিকেই কি আর তাকানো যায়! রায়বাড়ির সেই ছিপছিপে মেয়ে এখন কী নিটোল পৃথুলা রমণী! ভাবা যায় ওই মহিলা বউদির চেয়েও ছোট!

কন্দর্প হেলমেট হাতে নিল। সানগ্লাস চড়াল চোখে। একটু ঝুঁকে বলল, তা গরিব দিদির আজ মেনু কী?

–খিচুড়ি, গাওয়া ঘি, তিন রকমের ভাজা, চচ্চড়ি, খেজুরের চাটনি, মিষ্টি। তোর শংকরদা কাল বড়বাজার থেকে খুব ভাল মিষ্টি নিয়ে এসেছে। কী স্বাদ! মুখে দিলেই গলে যায়।

কন্দর্প ভুরু নাচাল, কোনও পেট্রল পাম্পঅলার থেকে বাগিয়ে এনেছে বুঝি?

–না রে, কিনে এনেছে।

কন্দর্প বিশ্বাস করল না। শংকরদা যা চিজ, নিজের পয়সায় বড়বাজার থেকে মিষ্টি কিনবে! আত্মীয়-স্বজন কে না জানে পাম্পে পাম্পে কিসব কারসাজি করে বেড়ায় শংকরদা। পাম্পঅলাদের তেল-ফেল চুরি করতে সাহায্য করে বোধ হয়। তার থেকেই নাকি শংকরদার এত রমরমা। ঠাটবাট দেখে যে কেউ ভাববে শংকরদা বুঝি অয়েল কোম্পানির কোনও ঘ্যামা অফিসার। আসলে যে মিস্ত্রি তা কে বলবে!

কন্দর্প গাল ছড়িয়ে হাসল, –বলছিস পয়সা দিয়ে কিনেছে? ঝাড়া মাল নয়?

না রে বাবা না। তোদের আবার বেশি বেশি। বছরে একদিনও কি কিছু কেনে না? জয়শ্রী আহত হয়েছে, তোরা তোদের শংকরদার বাইরেটাই দেখলি, ভেতরটা দেখলি না।

–আহা চটিস কেন? আমি তো ঠাট্টা করছি। তুই আজকাল মজাও বুঝিস না।

–তুই ঠাট্টা করছিস, সবাই করে না। তোদের সঙ্গে দাদার ঝামেলা হল, সকলে ধরে নিল তোর শংকরদাই বুঝি দাদাকে নাচিয়েছে। বাবা তো সেদিন আমার কথা কিছু বুঝতেই চাইল না। ভাবল, জামাই বুঝি বাড়ির জন্য ছোঁক ছোঁক করছে।

–আহ, বাবার কথা থাক না। নিধিরাম কি কোনও কথা সোজাভাবে নেয়? তার কথা সব ধরতে গেলে অ্যাদ্দিনে আমাদের পুরো বাড়ি পাগলাগারদে ঢুকে যেত।

–সে তোরা বোঝ। জয়শ্রীর ঠোঁট ফুলছে, আমার কিন্তু খুব মনে লেগেছে। কী খারাপ কথা আমি বলেছিলাম বাবাকে? শুধু বলেছিলাম, তুমি কবে আছ কবে নেই, তুমি যাওয়ার আগে ছেলেদের একটা বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাও। ফ্ল্যাটবাড়ি তুলে ভাইয়ে ভাইয়ে যদি আলাদা হতে চায় হোক, তুমি কেন আপত্তি করছ? এতে আমার কি স্বার্থ ছিল রে? শুনে রাখ চাঁদু, তোর শংকরদা যেমনই হোক নিজের পায়ে দাঁড়ানো মানুষ। সে ও বাড়ির ইট পর্যন্ত ছুঁতে চায় না। আমরা কি ভিখিরি?

মেয়েরা যে কোন কথা থেকে কোথায় চলে যায়! অশোক মুস্তাফির সঙ্গে সঙ্গত করার থেকেও এদের তালে তাল মেলানো অনেক বেশি কঠিন। যে লাইনেই কথা শুরু করো, ঠিক গরুর রচনায় ঢুকে যাবে।

কন্দর্প কাঁচুমাচু মুখে বলল, মাইরি দিদি, অষ্টমীর সকালটা এমন গুলিয়ে দিস না।

–হ্যাঁ, তোদেরই পুজো আছে, আমার পুজো নেই! বাবাকে পরশু পুজোর জামাকাপড় দিতে গেলাম, বাবা হাসিমুখে কথা পর্যন্ত বলল না। ভাল করে ভেবে দ্যাখ তো, আমি বাপের বাড়ির থেকে কী পেয়েছি? আমাকে যদি ঘটাপটা করে বিয়ে দিতে হত, কত খরচা হত বাবার? মার চল্লিশ ভরি সোনা ছিল, কভরি মেয়ের কপালে জুটেছে? সাকুল্যে পাঁচ-ছ ভরিও না। বাবারই খালি অভিমান থাকবে, আমার থাকতে পারে না?

কন্দর্প আবার ঘড়ি দেখল। এ তো মহা গেরো হল! যে জন্য তেল পুড়িয়ে এত দূর আসা, সেটাই কি মাটি হবে নাকি?

জয়শ্রী ফোঁচ করে নাক টানল, – আমার কথা শোনার তোর সময় নেই, না রে?

কন্দর্প হতাশ, বল না বাবা। কান তো পেতেই রেখেছি।

কী আর বলব। বাবা নয় বুড়ো মানুষ, কিন্তু বউদি? তারও তো আমি চক্ষুশূল।

–যাহ, তুই আবার সবই বাড়াস।

–কিছু বাড়াই না। আমার সঙ্গে বউদির আজকাল ব্যবহারটা দেখেছিস? ছাড়া ছাড়া। যখন আমাদের হা-ঘরে দশা ছিল, তখন খুব দয়া দেখিয়ে নাম কিনত। এখন ভগবান আমাদের দিকে একটু মুখ তুলে চেয়েছেন, ওমনি গায়ে জ্বালা ধরছে। মেজবউদির কথা তো আমি ধরিই না। সে অনেক পরে সংসারে এসেছে। তা ছাড়া তার বাপের বাড়ি বড়লোক, তার অনেক দেমাক। কিন্তু মেজদার ছেলেটা কি আমার কেউ নয়? তাকে কখনও ভুলেও নিয়ে আসে আমার বাড়িতে? এই যে তুই আজ তিতিরকে নিয়ে এলি, অ্যাটমকেও কি তোর সঙ্গে একটু পাঠাতে পারত না?

–অ্যাটম এখন বাড়িতে কোথায়! সে পুজোতে তো মামার বাড়ি গেছে।

জানি, জানি, সব জানি। এমনি যেন কত আসে। মেজদা তো ভুলেই গেছে, মেজদার একটা বোন আছে। জয়শ্রী মাথা দোলাল, সব তোলা থাকছে। সব সুদে আসলে পুষিয়ে দেব।

কন্দর্প শব্দ করে হেসে উঠল, তুই এক কাজ কর দিদি। তুই তো আজ ফ্যামিলির কাউকেই ছাড়বি না, তুই বরং সবার ওপর যা যা ক্ষোভ রাগ দুঃখ আছে সব একটা কাগজে লিখে রাখ। আমি আজ ও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্লেস করে দেব। নামটা কী দেওয়া যায় বল তো? অভাগিনীর মর্মবেদনা?

জয়শ্রী দু-এক মুহূর্ত ভাইয়ের দিকে ছলছল তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল, তুই হলি গিয়ে সব থেকে বজ্জাত। তুইও তলে তলে কিছু কম যাস না। ভান করিস যেন কিছুতে নেই, ওদিকে আবার…

-সাকসেসফুল আর কই হই রে দিদি? চোট পেয়ে যাই। কন্দর্প বাইরে বেরিয়ে স্কুটারে স্টার্ট দিল, খিচুড়িটা জম্পেশ করে বানা। ওতে আবার চোখের জলটল ফেলিস না। তার আগে তোর অঞ্জলিটা দিয়ে আয়, মন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

আজ রোদ বেশ জেল্লা মেরেছে। দারুণ ড্রেস দিয়েছে শহরটাও। পুজোর কদিন কলকাতা যেন একেবারে পটের বিবিটি হয়ে যায়। সকালেও রাস্তায় লোকজনের কমতি নেই। ছেলে বুড়ো সবারই প্রায় নতুন সাজ। আর মেয়েরা, তারা তো এখন অপ্সরী।

ভি আই পি রোডের বিশাল চওড়া রাস্তায় এসে পড়ল কন্দর্প। এ রাস্তায় গাড়িঘোড়া বড্ড জোরে চলে। কন্দর্প চলেছে ধার ঘেঁষে। টুক টুক করে। দিদির কথাগুলো ভাববে না ভাববে না করেও কন্দর্প ঠিক তাড়াতে পারছিল না মন থেকে। শংকরদা বাড়ির ইট ছুঁতে চায় না। কে বলছে? দিদি! কত কি শোনা বাকি এখনও! এমনিতে দিদিটা হ্যালহেলে ঝ্যালঝেলে। হাউহাউ করে কথা বলছে, সব সময়ে শো করার চেষ্টা করছে নিজেদের, ধ্যাবড়া সিঁদুর পরে পতিপুত্রের মঙ্গল কামনায় বছরে আটচল্লিশটা উপোস করছে, নিয়মিত সিনেমা দেখে রুমাল ভেজাচ্ছে ডজন ডজন, কিন্তু আসল ব্যাপারে ঠিক সেয়ানা। কেমন কায়দা করে কি পায়নি তার হিসেব দেখিয়ে দিল। নিধিরাম সটকালে নির্ঘাত নিজের ভাগের জন্য হামলা করবে। আরে বাবা, শংকর বাঁড়ুজ্জের সঙ্গে যখন চম্পট দিয়েছিলি, তখন এসব মুদিখানার হিসেব মাথায় ছিল না? নাহ, শংকরদার ট্রেনিং ভাল। দুজনে একটা নিখুঁত ইউনিট হয়ে গেছে। হেভি প্রেম দুজনের।

কবেই বা ছিল না? পুরনো একটা ছবি মনে পড়ে গেল কন্দর্পর। বাবা মেয়েকে একা বেরোতে দেয় না, চাঁদুকে নিয়ে লেকে এসেছে জয়ি। লেকের পাড়ে অপেক্ষা করছে শংকরদা। ইঞ্জিনের মতো সিগারেটের ধোঁয়া বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। ভাইয়ের হাত ছেড়ে জয়ি দৌড়ে গিয়ে তার হাত জড়িয়ে ধরল। দুজনে হাতে হাত বেঁধে চোখ থেকে চোখে তরঙ্গ পাঠাচ্ছে। হঠাৎ চাঁদুর দিকে চোখ পড়তেই শংকর এগিয়ে এল, — চাঁদু, তুমি গোটা লেকটা একদমে কবার দৌড়ে ঘুরতে পারবে?

চাঁদু বুক ফোলাল, পাঁচবার।

আমার মনে হয় তুমি পারবে না। হাঁফিয়ে যাবে।

–যদি পারি? চাঁদুর আঁতে লেগেছে।

ঝালমুড়ি খাওয়াব।

ঝালমুড়ি, তাই সই। সাঁ করে দৌড় শুরু করল চাঁদু। পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে। হাঁফাচ্ছে। কুকুরের মতো। পাঁচ পাক শেষ করে খুঁজছে জয়ি-শংকরকে। নেই। তারা তখন ঝোপের আড়ালে। ঝোপ থেকে আচমকা শংকরের চাষাড়ে হাত বেরিয়ে এল। ঝালমুড়ির ঠোঙা সমেত। একা একা বেঞ্চিতে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছে চাঁদু। কী ঝাল বাপস! টস টস জল গড়াচ্ছে চোখ বেয়ে। বিশ হাত দূরে, ঝোপের আড়ালে তখন যুগল হাসির আওয়াজ। উম আম নানারকম শব্দ। ভয়ে চাঁদু ঘাড় ঘোরাতে পারছে না, লেকের জলের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক।

বাগুইআটির মোড়ে এসে কন্দর্প স্কুটার ঘোরাল। কী মূর্খই না সে ছিল তখন! তাও রক্ষে, বাবা জানতে পারেনি চাঁদুই ছিল জয়ির প্রেমের পাহারাদার। জানলে নির্ঘাত বড়ঘরের দেওয়ালে চামড়া ঝুলত চাঁদুর।

নিজের মনে হাসতে হাসতে তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে এসে থামল কন্দর্প। পুজোর দিন, হাতে করে একটু মিষ্টি নিয়ে এলে কি ভাল হত? থাক। পকেটের মোড়কটায় কন্দর্প একবার হাত বুলিয়ে নিল। হেলমেট খুলল ধীরেসুস্থে। সানগ্লাসটাও।

মধুমিতা আছে তো বাড়িতে?

.

দীপঙ্করের মেয়েটা দেখতে বেশ হয়েছে। এক মাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পুতুল পুতুল মুখ, টুকটুকে রঙ। গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে কথা বলে পাকা বুড়ির মতন। তবে বড় রোগা। ফড়িংয়ের মতো। মেয়েটা ভোগেও খুব। গত মাসে কন্দর্প যেদিন এসেছিল, সেদিনও খুব কাশছিল মউ।

আজ অবশ্য মউ বেশ তরতাজা। কলকল করে চলেছে কন্দর্পের সঙ্গে। নতুন জামা জুতো বারতিনেক দেখানো হয়ে গেল। ফিতে ক্লিপও। এখন চলছে কটা ঠাকুর দেখেছে তার বিস্তারিত বিবরণ।

কন্দর্প জিজ্ঞাসা করল, — কোন ঠাকুরটা সব থেকে ভাল লাগল তোমার?

মউ এক মুহূর্ত ভেবে ঠোঁট ওল্টাল, একটাও ভাল না। শুধু অসুরগুলো ভাল।

-কেন?

বা রে, মা দুর্গার দশ হাতের সঙ্গে ওরা শুধু দু-হাতে লড়াই করছে যে। মা দুর্গার সঙ্গে তো আরও অনেকে আছে, অসুরের সঙ্গে কে আছে বলো?

এভাবে তো কখনও ভাবেনি কন্দর্প! মউ-এর গাল টিপে বলল, – খুব ভাল বলেছ। আমারও অসুরকেই বেশি পছন্দ। অসুর কত বড় বীর!

মউ চোখ পিটপিট করল, বীর মানে কী গো কাকু?

–যার খুউব সাহস। যে খুউব লড়াই করতে পারে।

–আর লড়াই করে হেরে যায়, তাই তো? অসুরের মতো?

কন্দর্প পলকের জন্য কেঁপে গেল। আলগা শ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, কখনও কখনও হারেও বইকি।

মধুমিতা চা এনেছে। সঙ্গে প্লেটে দুটো ছোট ছোট সন্দেশ। কাপ প্লেট কন্দর্পর সামনে রেখে বলল, বীর শব্দটা আমার ভাল লাগে না।

কন্দর্প থতমত, – কেন?

বীররা বড় দাম্ভিক আর ভোগী হয়।

–এটা ঠিক বললে না। ভীষ্ম কি বীর নয়? সেও কি দাম্ভিক? ভোগী?

-দাম্ভিক তো বটেই। ভোগীও। অম্বার মতো মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে, দাম্ভিক নয়? আর ভোগ? ইন্দ্রিয় জয়ের নেশাটাও তো এক ধরনের ভোগ কন্দর্পদা। আমি কি পারি, না পারি, সেটা লোককে জাহির করার সুখভোগ। সত্য পালনের দোহাই পাড়ার মধ্যে বাহাদুরি আছে ঠিকই, অহঙ্কারও কম নেই।

তর্ক করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কন্দর্পর। চা খেতে খেতে অপাঙ্গে দেখছিল মধুমিতাকে। মাখন রঙের শাড়ি পরেছে মধুমিতা। পানপাতা মুখ, টিকোলো নাক, ছোট্ট কপাল, টানা চোখ, সবই যেন নিখুঁতভাবে গড়েছে কোনও অদৃশ্য কারিগর। দীপঙ্করটা কী হতভাগা! কী করে মরতে পারল!

কন্দর্প খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল, তোমার জন্য একটা খবর ছিল।

কী?

–এবার বোধহয় তোমার একটা কিছু হয়ে যাবে। আমার এক দাদার কথা বলেছিলাম না তোমাকে? ঠিক দাদা নয়, দাদার মতো। ডাক্তার। উনি একটা নার্সিংহোম খুলছেন। কালীপুজোর পর পরই। পুজোর আগেই চালু হওয়ার কথা ছিল, কয়েকটা ঝামেলায় পড়ে হয়নি…

আমি নার্সিংহোমে কী কাজ করব?

–অফিস জব। আমি শুভাশিসদার সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা তোমাকে রিসেপশনিস্ট হিসেবে নেবে। সঙ্গে কিছু অফিসের কাজও করতে হবে। এই যেমন পেশেন্টদের রেজিস্টার মেনটেইন করা, টুকটাক বিল ভাউচার তৈরি করা। টেলিফোন-টোনও অ্যাটেন্ড করতে হবে। প্রথম দিকে অবশ্য খুব বেশি দেবে না, বড় জোর সাত-আটশ। পরে নার্সিংহোম জমে গেলে… কি, করবে তো?

করব না কেন? তবে টিকব কদিন কে জনে! মধুমিতার স্বর নিস্পৃহ।

-না, না, এখানে তোমার অসুবিধে হবে না। শুভাশিসদা একদম অন্য ধরনের লোক। জেনুইন জেন্টলম্যান।

–জেনুইন জেন্টলম্যান! বলছেন?

পাতলা ঠোঁট দুটো অল্প বেঁকে গেছে মধুমিতার। কন্দর্প একটু কুঁকড়ে গেল। মাঝে কন্দর্পের সুপারিশে একটা চাকরি পেয়েছিল মধুমিতা। কন্দর্পর স্কুলের বন্ধুর চেনা ছোট্ট অ্যাড এজেন্সিতে। বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করার কাজ। সেখানে কাজ করতে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রায় কোম্পানিই সন্ধের পর আসতে বলে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার মালিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা এতাল-বেতাল বকে যায়, তারপর খুবই সভ্যভব্য ভাবে হোটেল রেস্টুরেন্টে ডিনারের আমন্ত্রণ জানায়। দু-একবার মরিয়া হয়ে গিয়েছিল মধুমিতা। খাবারের অর্ডার দিয়েই তারা মধুমিতার আঙুল নিয়ে খেলতে শুরু করে, রঙিন পানীয় পেটে পড়লে তো কথাই নেই। সোজাসুজি প্রস্তাব আসতে থাকে তখন। লেটস হ্যাভ এ রাইড। ঘেন্নায় অপমানে বসকে বলতে গিয়েছিল। সে পরিষ্কার বলে দিল, মধুমিতার যেটা অ্যাসেট, সেই রূপটাকে ব্যবহার করার জন্যই চাকরি দেওয়া হয়েছে তাকে। বেহুলাপনা করার জন্য নয়। সেই চাকরি ছেড়েই কন্দর্পের বাড়িতে দৌড়েছিল মধুমিতা। ভাগ্যিস বউদিকে কিছু বলে ফেলেনি সেদিন!

মউ খাটের তলা থেকে পুতুলের বাক্স টেনে বসেছে। নিজের মনে বকবক করতে করতে সাজাচ্ছে মেয়ে পুতুলকে। সেদিকে চোখ রেখে মধুমিতা বলল, আপনি কথাটাকে অন্যভাবে নেবেন না কন্দর্পদা। আপনার কী দোষ? আপনি তো আর জেনে বুঝে ওখানে পাঠাননি আমাকে।

কন্দর্পও দেখছে মউকে। বলল, — তাও আমার তো একটা দায় থেকেই যায়।

কিচ্ছু থাকে না। লোকজন খারাপ হলে আপনি কী করবেন? মধুমিতা হঠাৎ যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। নিচু স্বরে বলল, এই যে রোজ সকালে পোস্ট অফিসে যাই, এন এস সি করে দু-চার পয়সা রোজগার করি, সেখানেই কি আমি কম মন্দ লোক দেখি? কেউ ফর্ম ফিল আপ করার সময়ে ইচ্ছে করে গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে, একটু আধটু ছুঁয়ে নেয়। বুড়ো পোস্টমাস্টারটা পর্যন্ত বিনা কারণে সামনে বসিয়ে রাখে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেদিন ইউনিট ট্রাস্ট করাতে একজন বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেল, গিয়ে দেখি বাড়ি বেবাক ফাঁকা। বউ মেয়ে সব বেড়াতে গেছে। ভদ্রলোক খালি ফ্রিজ খুলে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ায়, মিষ্টি খাওয়ায়! কাজের কথা পাড়তে গেলেই বলে, ওসব পরে হবেখন, এসো না একটু গল্প করি। আমার স্বামী মারা গেছে শুনে ভদ্রলোকের কী দুঃখ! প্রায় কেঁদে ফেলে! শেষে কী বলল জানেন? আমার টাকা জমিয়ে রেখে কি হবে? আর তুমিই বা ক পয়সা কমিশন পাবে? তার থেকে অনেক বেশি টাকা উনি আমাকে…! বিধবা মানে কি বেওয়ারিশ কন্দর্পদা? যার ইচ্ছে হবে একটু করে ঠুকরে নেবে?

মধুমিতার স্বর ভিজে এসেছে। কন্দর্পর নার্ভাস লাগছিল। অস্বস্তি ভাব কাটাতে ঘরের চারদিকে চোখ ঘোরাচ্ছিল বারবার। সাধারণত শোওয়ার ঘরে এসে বসে না সে। আজ মউ টেনে এনেছে। ফ্ল্যাটটা খুব বেশি পুরনো নয়, কিন্তু নতুন নতুন ভাবটা যেন চলে গেছে। সেই প্রথম দেখা চাকচিক্য আর নেই। বড় মলিন, বড্ড মলিন এখন।

কন্দর্প ঘড়ঘড়ে স্বরে প্রশ্ন করল, তোমাদের ফ্ল্যাটের লোন আর কত বাকি?

–পনেরো-ষোলো হাজার মতো।

–ওই ইনসিওরেন্সের টাকা থেকেই দিয়ে যাচ্ছ?

-হুঁ। সে ঘটিও তো প্রায় খালি হয়ে এল। এখন আপনার বন্ধুর কটা পি এফ আর গ্র্যাচুয়িটির সুদের টাকাই যা ভরসা। চিট ফান্ডটাও যদি না উঠে যেত, তাহলে হয়তো দু-চার পয়সা কিছু আসত হাতে।

–ছাড়ো তো, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কন্দর্প চাঙা করতে চাইল মধুমিতাকে। হয়তো বা নিজেকেও। মুখে হাসি এনে বলল, পুজোর দিন সকালে কেউ এত মন খারাপ করে?

–মন খারাপ আমার আর হয় না কন্দর্পদা। ভয় পাই।

–কীসের ভয়? বাঘভাল্লুকের? তোমাকে কপ করে খেয়ে নেবে? ফুঃ। কন্দর্প হাসিতে জোর আনল, — মউ দেখেছিস, তোর মাটা কী ভীতু!

মউ ভুরু কুঁচকে মধুমিতার দিকে তাকাল, — মার সাহস নেই, আমি জানি। মা বীর নয়।

হা হা করে হেসে উঠল কন্দর্প। মধুমিতার মুখ চোখও একটু উজ্জ্বল হয়েছে। বলল, অত দূর থেকে আসছেন, আজকে দুপুরে আমাদের এখান থেকে দুটো খেয়ে যান না।

–ওরেব্বাস, কোতল হয়ে যাব। আমি কি শুধু তোমার এখানে এসেছি নাকি? ভাইঝিকে আমার দিদির বাড়িতে গ্যারেজ করে রেখে এসেছি। কেষ্টপুরে। ওখানে দিদি খিচুড়ি রান্না করে বসে আছে। না খেলে ফাটাফাটি হয়ে যাবে। এমনিই আজ একটু তলতলে হয়ে আছে দিদি।

-কেন?

–ওই সাংসারিক ঢেঁকুচকুচ খেলা আর কি। কখনও এ উঠছে ও নামছে, কখনও ও উঠছে এ নামছে। আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপার হেভি জটিল। তুমি বুঝবে না।

মধুমিতা কী বুঝল কে জানে, কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে, আপনার ভাইঝিকে এখানে আনলেন না কেন?

–আনব একদিন। ও আজ পিসির বাড়িতে জমে গেছে।

-ভাইঝি মানে আপনার যে বউদিকে দেখেছিলাম, তার মেয়ে তো?

–হ্যাঁ। বড়দার মেয়ে। পৃথিবীতে যাদের ওপর আমার একটু একটু উইকনেস আছে, তিতির ইজ ওয়ান অফ দেম।

মধুমিতা হেসে উঠল– আপনার উইকনেস-লিস্ট মনে হচ্ছে খুব ছোট্ট?

–ছোটই বলা যায়। আমি বেসিকালি লোকটা বেশ কঞ্জুস।

মউ পুট করে প্রশ্ন করল, কঞ্জুস মানে কী কাকু?

কৃপণ। যে কাউকে কিছু দেয় না।

 –তুমিও বুঝি কাউকে কিছু দাও না?

–দিই। শুধু মউসোনাকে দিই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সন্তর্পণে মোড়কটা খোলার চেষ্টা করল কন্দর্প। শুধু মিল্ক চকোলেটটাই বার করতে চেয়েছিল, পারফিউমের শিশিটাও অবাধ্যতা করে বেরিয়ে এল বাইরে। মাটিতে গড়িয়ে গেল।

শিশিটাই বেরোল, নাকি কন্দর্পর কোনও গোপন ইচ্ছে ছিটকে গেল মেঝেতে?

মধুমিতা সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়েছে শিশিটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, বাহ। এ তো বিদেশি পারফিউম! নামটাও দারুণ! পয়জন! কার জন্য কিনেছেন? বিশেষ কেউ?

কন্দর্প জোরে জোরে দুদিকে মাথা নাড়ল, না না, তেমন কারুর জন্য নয়। এমনিই দেখে ভাল লাগল, কিনে ফেললাম। তুমি নেবে?

–আমি! আমি পারফিউম নিয়ে কী করব?

মাখবে। কন্দর্প ঘামছে– পারফিউম মাখা তো খারাপ কিছু নয়। নাও না। মধুমিতার চোখ তীক্ষ্ণ হয়েছে, সত্যিই আপনি কারুর কথা ভেবে কেনেননি?

–অত বলতে পারব না। এ কথা বলতে পারি, খারাপ মনে কিনিনি। তোমার না নিতে ইচ্ছে করলে নিয়ো না।

মধুমিতা খুলছে শিশিটা। গন্ধ শুঁকল। সহসা খানিকটা সুগন্ধী স্প্রে করেছে কন্দর্পর সাদা পাঞ্জাবিতে। নিজের শাড়িতেও লাগাল।

কন্দর্পর মনে হল হঠাৎ ক্যামেরার সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কেউ। হাজার হাজার কিলোওয়াট আলো একসঙ্গে মুখে এসে পড়ল। ঝলসে দিচ্ছে চামড়া। হাত পা সব মুহূর্তে আড়ষ্ট।

কন্দর্প নড়ে ওঠার আগেই শব্দটা শুনতে পেল। দরজার বাইরে। প্রায় অদৃশ্য এক পায়ের শব্দ।

.

২৭.

বিনতা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন, তুমি! তুমি কখন এলে?

বাইরে পায়ের শব্দ পেয়েই কন্দর্প উঠে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্কুচিতভাবে বলল, –এই খানিকক্ষণ। মধুমিতাকে একটা চাকরির খবর দিতে এসেছিলাম।

বিনতার হাতে সন্দেশের বাক্স, দু-চারটে গাঁদা-দোপাটির পাপড়ি লেগে আছে বাক্সের গায়ে। মউয়ের মাথায় বাক্সটা ঠেকিয়ে নিয়ে জোরে জোরে বাতাস শুঁকলেন মধুমিতা, –এত সেন্ট কে মেখেছে? তুমি?

কন্দর্প আমতা আমতা করল, না…মানে..আমি….

–খুব কড়া গন্ধ তো! এ বুঝি তোমার ফিলম লাইনের অভ্যেস?

 মধুমিতার মা কন্দর্পকে অপছন্দ করেন তা নয়, তবে মাঝে মাঝে এরকম তির্যক ভঙ্গিতে কথা বলেন। কন্দর্প তো এ বাড়িতে বেশ কয়েকবার এল, কোনওদিন কি তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ পাওয়া গেছে? ফিলম লাইনের লোক ছাড়া আর কেউ কি কড়া পারফিউম মাখে না?

কন্দর্পকে উত্তর দিতে হল না। মউ ঝুপ করে বলে উঠল, কাকু তো সেন্ট মেখে আসেনি। কাকু মাকে একটা সেন্ট দিল, সেটাই তো মা কাকুর গায়ে লাগিয়ে দিল।

–অ। তাই বলো। বিনতার মুখ চকিতে গম্ভীর। খর চোখে একবার কন্দর্পকে দেখলেন, একবার মধুমিতাকে। তারপর ধমকের সুরে মেয়েকে বললেন, কটা বাজে খেয়াল আছে? মউকে এখনও চান করাসনি যে বড়?

–কিছু বেলা হয়নি। ঠিক সময়েই করাব।

হুঁহ, তোমার আর সময় হয়েছে!

আমি কন্দর্পদার সঙ্গে একটা দরকারি কথা বলছি মা। মধুমিতার স্বরে অস্বস্তি। বিরক্তিও। ভার মুখে বলল, –শুনলে তো কন্দর্পদা একটা চাকরির খবর এনেছে।

–অরুণ তো তোকে একটা চাকরি করে দেবে বলে গেল।

করে দেবে বলেনি। বলেছে চেষ্টা করবে।

–অরুণ যখন বলেছে, কিছু একটা করবেই।

ছাড়ো তো। কে কত করবে সব জানা হয়ে গেছে। বাড়ি এলে সবাই ওরকম মুখে বলে যায়। সামনে দেখলে দরদ উথলে ওঠে, আড়াল হলেই ভুলে মেরে দেয়। আমার অবস্থা কী সুপ্রিয়াদি অরুণ জামাইবাবুরা জানে না? কমবার আমি ভিখিরির মতো ওদের বাড়ি গেছি?

তোর আবার মান বেশি। আত্মীয়-স্বজনের কাছেই তো গেছিস, এতে ভিখিরি হওয়ার কি আছে?

–দুঃসময়ে কিছু চাইতে গেলে আত্মীয়রা ভিখিরিই ভাবে মা। চকিত উত্তেজনায় মধুমিতার নাকের পাটা লাল হয়ে উঠেছে, আত্মীয়-স্বজনদের থেকে পর ভাল। কন্দর্পদার চেষ্টায় তাও যা হোক একটা কাজ জুটেছিল।

–সে কাজ তো তোমার কপালে টেকেনি বাছা।

কন্দর্পর সামনেই ঘরের আবহাওয়া ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। মা মেয়ের চাপান-উতোরের মাঝে কন্দৰ্পর বোধ হয় এখন নাক গলানো উচিত নয়। একটু যেন অনভিপ্রেতও লাগছে নিজেকে। তবু কন্দর্প ফস করে বলে ফেলল, এবারের চাকরি টিকবে মাসিমা। চাকরিটা খুব ভাল।

–ভাল হলেই ভাল। বিনতা এক ঝলক জরিপ করলেন কন্দর্পকে, আমার আজকাল মন থেকে বিশ্বাসটা বড় কমে যাচ্ছে বাবা।

বিনতা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কন্দর্প কী করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না। কেমন যেন ছোট লাগছে নিজেকে। কেন যে মিছিমিছি পারফিউম কেনার ভূত চাপল মাথায়!

দু-চার সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কন্দর্প বলল, আমি এবার যাই।

মধুমিতার মুখ থমথম করছে। বলল, না, আপনি এখন যাবেন না। আর একটু বসুন।

কন্দর্পর ন যযৌ ন তস্থৌ দশা। ঢোঁক গিলে বলল, অনেক বেলা হয়ে গেছে। তোমরা চান-খাওয়া করবে… দিদিও বসে আছে…

–তা হোক, তবু বসুন।

–কেন জোর করছ মধুমিতা?

–না বসলে আমি কিন্তু মনে করব পারফিউমটা আপনি ভাল মনে আনেননি।

কন্দর্প করুণ মুখে বলল, আমি কিন্তু সত্যিই খারাপ মনে আনিনি। ভাবলাম পুজোর দিন, চারদিকে এত হইচই আনন্দ, হাতে করে একটা উপহার নিয়েই যাই। এখন আমার কাজকর্মও ভাল চলছে…। আমি কি আগে কখনও এভাবে কিছু এনেছি?

–আমিও তো তাই ভাবতে চাই। মা কেন অন্যরকম ভাববে?

কন্দর্প হেসে সহজ হওয়ার চেষ্টা করল, মাসিমার কথায় আমি কিছু মনে করিনি।

–সে আপনার মহানুভবতা। আমি হলে করতাম। হয়তো এ বাড়ির ছায়াও মাড়াতাম না কোনওদিন।

–আহ্, তুমি ওভাবে নিচ্ছ কেন? তোমাকে নিয়ে মাসিমার তো ভাবনাচিন্তা থাকবেই। এটাই তো স্বাভাবিক।

পারফিউমের শিশি আলতো করে ড্রয়ারে রাখল মধুমিতা। মউ খাটের ধারে পুতুলের সংসার নিয়ে ভারি ব্যস্ত, সেদিকে স্থির তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। যেন দেখছে, অথচ দেখছে না। আনমনে বলল, মার অবস্থা আমি বুঝি কন্দর্পদা। কিন্তু বেশি ভাবনাচিন্তা কি মানুষের মনকে ছোটও করে দেয়?

–ছোট করে দেয় না, ভীতু করে দেয়।

–না কন্দর্পদা, মা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মধুমিতা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, চাকরিটা পেলাম, বাইরে বেরোচ্ছি, একটু তো ভাল পোশাক-আশাক পরতেই হয়, মার তাতেও আপত্তি। কেন বিধবা মেয়ে এত সেজেগুজে অফিস যাবে! কেন ভাল শাড়ি পরবে! কেন টিপ লাগাবে! তাও তো মা জানে না চাকরিটা কী ছিল আমার। পাঁচ জায়গায় ঘুরে ঘুরে দশ রকম লোকের সঙ্গে…

কন্দর্পর মুখ আবার কালো হয়ে গেল। অপরাধী মুখে বলল, আমি সরি মধুমিতা। মনোতোষ তোমাকে ওর অফিসে চাকরি না দিয়ে ওরকম একটা অ্যাড এজেন্সিতে পাঠিয়ে দেবে আমি বুঝতে পারিনি।

নাহ্, আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না। মধুমিতার মুখে বহুক্ষণ পর এক টুকরো হাসি ফুটেছে। পুজোর দিনের হাসি নয়, ম্লান হাসি, কিন্তু ভারি স্বচ্ছ। হাসিটা মুখে রেখেই বলল, –অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে কেন বারবার চাপিয়ে নিতে চান বলুন তো? আপনার বন্ধু আপনার সম্পর্কে ঠিকই বলত।

–কী বলত দীপু?

–সে আপনার শুনে কাজ নেই।

স্টুপিড, গাধা, এইসব বলত তো?

 –ও সব বলবে কেন? আপনার কি নিজেকে খুব বোকা মনে হয়?

কন্দর্প মনে মনে বলল, হয় তো বটেই। না হলে কি আর ওই ভাল্লুক মুস্তাফিটার সঙ্গে পাইক বরকন্দাজের মতো ঘুরে বেড়াই! লোকটা তাকে কী না বলে, তবু তার মুখে লাথি কষিয়ে কন্দর্প চলে আসতে পারে কই! একটুখানি ভবিষ্যতের টোপে যে লোক মুস্তাফির লেজনাড়া মংগ্রেল বনে যায়, সে এক বিশ্ব আকাট ছাড়া আর কি!

কন্দর্প পাঞ্জাবির বোতাম নিয়ে নাড়াচাড়া করল, নিজেকে বোকা ভাবতে কার আর ভাল লাগে! আসলে বলছিলাম এই জন্য, দীপুটা তো খুব চালাকচতুর ছেলে ছিল।

–কে যে চালাকচতুর, আর কে যে বোকা! মধুমিতা মৃদু মাথা নাড়ল, আপনার বন্ধু তো এত গুছোনো ছিল, এত হিসেবি, পাঁচ বছর পর কী হবে, দশ বছর পর কী হবে, বিশ বছর পর কী হবে, সব নখদর্পণে ছিল। নিজে কোথায় পৌঁছবে, সংসারের চেহারা কেমন হবে, সমস্ত ছবির মতো দেখতে পেত। অথচ ঘাড়ের কাছে যে মৃত্যু এসে থাবা নাড়ছে, লোকটা তা বুঝতেই পারল না! একে আপনি চালাক বলবেন?

কন্দর্পর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল। মস্তিষ্কের গোড়ায় ধোঁয়া পৌঁছলে একটু ভাল লাগত এখন। পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখেও হাত সরিয়ে নিল কন্দর্প। দীপঙ্করটার ভীষণ সিগারেটের নেশা ছিল, ঘর জুড়ে ছড়িয়ে রাখত শৌখিন ছাইদান। মাছ, পাখি, আরও কত জন্তুজানোয়ারের আকারের। আজকাল আর একটাও ছাইদান দেখতে পায় না কন্দর্প, মধুমিতা সব সরিয়ে ফেলেছে। কন্দর্প বললে কি মধুমিতা বার করে দেবে না একটা? দেবে। কিন্তু চাইতে বড় অস্বস্তি হয় কন্দর্পর।

মধুমিতা খাটের ধারটাতে বসেছে। আপন মনে বলল, ভাবতে গেলে কত কীই যে অদ্ভুত লাগে! আমার একটু শরীর খারাপ হলে, মেয়ের একটু গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করলে, পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠত মানুষটা। আর মজা দেখুন, নিজের শরীরেই যে একটা কিডনি নেই, তা লোকটা জানতই না!

–ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্টাল ঘটনা মধুমিতা। হয়তো খুঁজলে দেখা যাবে আমাদেরও অনেক কিছুই নেই।

–হয়তো।

কন্দর্প একটু হালকা করতে চাইল মধুমিতাকে। হেসে বলল, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে। আমার সম্পর্কে দীপু কী বলত তোমাকে?

–আপনি তো মহা নাছোড়বান্দা! বললাম না শুনে কাজ নেই!

 –বেশ। বোলোনা হবে।

রাগ করেন কেন? আপনার বন্ধু আপনাকে কমপ্লিমেন্টই দিত। আপনার সঙ্গে তার খুব যোগাযোগ ছিল না, তবে আপনার কথা বলত মাঝে মাঝেই। বলত, আপনার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। আস্থা রাখা যায়। অসুখের সময়েও বলেছিল, বিপদে পড়লে কন্দর্পকে ডেকো। ও কিছু না কিছু করবেই। মধুমিতা চোখ বুজল, শেষের দিকে বোধ হয় বুঝতে পারত আর বাঁচবে না।

কন্দর্পর ঠিক মাথায় ঢুকল না কথাটা। দীপঙ্কর কেন বলেছিল তার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়? কলেজে দীপঙ্কর মোটেই তেমন প্রাণের বন্ধু ছিল না, বরং কন্দর্পর থেকে জ্যোতি বিজন শ্যামলদের সঙ্গে দীপঙ্করের অনেক বেশি মাখামাখি ছিল। হ্যাঁ, পার্ট টু পরীক্ষার সময়ে দীপঙ্করকে খুব সাহায্য করেছিল কন্দর্প। পরীক্ষার হলে। একটাও প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারছে না দীপঙ্কর, দরদর ঘামছে, ইনভিজিলেটারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বারবার নিজের খাতা দীপঙ্করের সামনে মেলে ধরেছিল কন্দর্প। শুধু এইটুকুর জন্যই সে দীপঙ্করের বিশ্বাসের পাত্র হয়ে গেল?

মধুমিতাই বা কথাটা বলল কেন আজ? কোনও গুঢ় কারণ আছে কি?

কন্দর্প মনমরা হয়ে বলল, তুমি কিন্তু দীপু মারা যাওয়ার পর আমাকে খবরও দাওনি মধুমিতা। অসুখের সময়েও….

–তখন কি আমি আমার মধ্যে ছিলাম কন্দর্পদা? শ্বশুরবাড়ির লোকরা একরকম বলছে, বাপের বাড়ির লোকরা আর এক বলছে, আমার তখন মাথাই কাজ করত না।

কন্দর্প নিচু গলায় প্রশ্ন করল, দীপুর দাদা খোঁজখবর নিতে আসছে?

–আসে। ন মাসে ছ মাসে। এই তো বহুকাল পর মহালয়ার দিন এসেছিল। ভাসুর জা দুজনে এসে মউকে খেলনা জামাকাপড় দিয়ে গেল। ব্যস, কর্তব্য শেষ।

–সেই প্রস্তাবটা নিয়ে দীপুর দাদা আর কথা তোলে কোনও?

 –কোনটা বলুন তো? ও আচ্ছা, ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে ওদের সংসারে গিয়ে থাকা? ও হবে না।

–প্ল্যানটা কিন্তু ভাল ছিল। ফ্ল্যাটের ভাড়া থেকে তোমার লোনও শোধ হয়ে যেত, রাখা টাকায় হাত দিতে হত না…

যা হবে না, তা আর আমি ভাবি না কন্দর্পদা। আত্মীয়স্বজন আসবে, আহা উঁহু করবে, কিন্তু দায়িত্ব কেউ নেবে না। আমি সার বুঝে গেছি। নিজের দাদারাই কেউ এগিয়ে এল না! এক ওই মাই যা…।

–সেই মার ওপর তুমি রাগ করো! এ তোমার ভারি অন্যায়।

ভেতর থেকে বিনতা ডাকছেন মেয়েকে, মধুমিতা উঠে গেল। কন্দর্প জানলার ধারে গিয়ে ঝুঁকে একবার দেখল বাইরেটা। ঢাক বাজছে, ঢাকের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে। পাড়ার ছেলেরা পুজোর প্রসাদ বিলি করতে বেরিয়েছে বোধ হয়। বেলা অনেক হল। ঢাকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই বাতাসে কান পাতল কন্দর্প। বিনতা কেন ডাকলেন মধুমিতাকে!

মধুমিতা ফিরতেই কন্দর্প বলল, আমি তাহলে এবার আসি?

–আবার কবে আসছেন?

 –শুভাশিসদার সঙ্গে আর একবার কথা বলে নিই।

কালীপুজোর দিন থেকেই তো নার্সিংহোমটা শুরু হচ্ছে, তাই না?

–উঁহু, কালীপুজোর পর। তার আগে তোমাকে তো একবার শুভাশিসদার সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দিতে হবে।

–আপনি আমার সঙ্গে যাবেন তো?

 –কেন, আমি অ্যাড্রেস দিলে তুমি গিয়ে দেখা করতে পারবে না?

–পারব। তবু আপনি গেলে…

–ঠিক আছে, যাব।

কথা বলতে বলতে কন্দর্প ফ্ল্যাটের দরজায় এসেছে। বিনতা রান্নাঘরে ছিলেন, একবার উঁকি দিয়েই আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। তড়িৎ গতিতে।

মউও খেলা ফেলে ছুটে এসেছে দরজায়, তার গাল ভর্তি মিল্ক চকোলেটের দাগ। কন্দর্পের হাঁটু ধরে টানল মউ, আবার কিন্তু এসো কাকু। আমার খুব ভাল লাগবে।

কন্দর্প আলগা আঙুল চালাল মেয়েটার চুলে, খুব ভাল লাগবে?

এক দিকে মাথা পুরো হেলিয়ে দিল মউ, হুঁউউ। তুমি খুব ভাল। আবার কিন্তু চকোলেট এনো। বলতে বলতে মউয়ের মুখে সলজ্জ হাসি, মার জন্যও সেন্ট এনো কিন্তু।

মউয়ের কথায় একটুও আধো আধো ভাব নেই, একদম স্পষ্ট উচ্চারণ। সাংসারিক দুর্যোগ শিশুদের বুঝি তাড়াতাড়ি বড় করে দেয়। কন্দর্প একবার আড়চোখে মধুমিতার দিকে তাকাল।

মধুমিতা ঠোঁট টিপে হাসছে। মেয়ের মাথায় আলগা চাটি মারল, -থাক, নিজে লোভী হয়েছ, লোভী থাকো। মার হয়ে আর ওকালতি করতে হবে না।

ঠোঁট টিপে হাসলে মধুমিতার গালে একটা ছোট্ট টোল পড়ে। কেন যে পড়ে! কন্দর্প দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।

মধুমিতাদের ফ্ল্যাটবাড়ির উল্টোদিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি পড়ে আছে। জমিতে বালির স্তূপ, ইটের পাঁজা। পুজোর পরেই বোধ হয় বাড়ি উঠবে। জায়গাটার এক কোণে এখনও ঘন আগাছার ঝোপ। কালচে সবুজ ঝোপ ফুঁড়ে কোত্থেকে একটা মাত্র কাশগাছ মাথা ঠেলে উঠেছে, দুলছে হাওয়ায়। সাদা ফুল তার রোদ্দুরে ঝিকমিক। জংলা ঝোপের মাঝে ওইটুকু সাদা যে কী অপরূপ!

বিনতার অসন্তোষ মন থেকে মুছে যাচ্ছিল কন্দর্পর। ওই কাশফুল শুধু সুন্দর নয়, যেন এক পবিত্ৰ বিষাদ। ওকে একাই মানায়।

কন্দর্প দিদির বাড়ি ফিরে দেখল তিতির নেই, ঝান্টুর সঙ্গে কাছেই কোনও ঠাকুর দেখতে গেছে। বিনা বাক্যব্যয়ে খাবার থালায় বসে গেল কন্দর্প। পেট ঠেসে খেয়ে অলসভাবে গড়াচ্ছিল বিছানায়, জয়শ্রী আবার খুলে বসেছে অভিযোগের ঝাঁপি। বিনবিন করে বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে।

কন্দর্প ঘুমিয়ে পড়ল।

 ঘুম ভাঙল তিতিরের ঠেলায়, ও ছোটকা, ফিরতে হবে না? ধড়মড় উঠে বসে চোখ কচলাল কন্দর্প, কোথায় আছে বুঝে নিতে তাকাল চারদিকে। হাই তুলতে তুলতে বলল, কটা বাজে রে?

চারটে বেজে গেছে।

–তা হলে তো এখনও রোদ্দুর আছে। আর একটু শুয়ে নিই।

 –একদম নয়, ওঠো বলছি। আমাকে বাগবাজার, কুমোরটুলি দেখাবে না?

 –আর কত দেখবি? সবই তো এক।

–ঠিক আছে বেশ, ঠাকুর না হয় নাই দেখলাম। মানিকতলায় যাবে তো?

যাব। তাড়া কিসের?

–তোমার তাড়া নেই, আমার আছে। দাদু দিদার সঙ্গে দেখা করে তাড়াতাড়ি পাড়ায় ফিরতে হবে।

–কেন, তোর কি বয়ফ্রেন্ড হয়েছে নাকি? পুজোয় তোকে নিয়ে ফুচকা খাবে? নাগরদোলা চড়বে?

আজ্ঞে না স্যার। আমার স্কুলের বন্ধুরা আসবে।

 –কোন স্কুল? চ্যাপেলবাড়ি, না অফিসবাড়ি?

–আমার স্কুল। দেবস্মিতা আসবে, অনিতা আসবে, হিয়া ঝুলন আসবে..

ব্যস, ব্যস, ব্যস। পুরো একটা লেডিজ গ্যাঙ বানিয়ে ফেলেছিস? রাস্তাঘাটে ছেলেদের তাড়া করবি নাকি?

করতেও পারি। ছেলেরা যা বাঁদর হয়। জানো, ঝুলনের পেছনে একটা ছেলে…..

থামলি কেন? রিপোর্টটা দে।

–না, দেব না। তুমি ওঠো তো। এবার কিন্তু আমি চিমটি কাটব। ও পিসি, বলো না ছোটকাকে উঠতে।

কাকা ভাইঝির খুনসুটি দেখে জয়শ্রী হেসে বাঁচে না, ওরে চাঁদু, আমাদের তিতিরটাও কেমন দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, অ্যাঁ?

—হ্যাঁ, এখন কথা লুকোতেও শিখে গেছে।

জয়শ্রী বলল, তোর মনে আছে, সেই যে আমরা হাসপাতালে দেখতে গেলাম তিতিরকে? একটা কাচের ঘরে ওকে রাখা হয়েছিল?

–খুব মনে আছে। তোরা সব আলোচনা করছিলি… প্রিম্যাচিওর বেবি…নেংটি ইঁদুরের মতো চেহারা হবে…বাঁচানো যাবে, কি যাবে না…।

–তিতির কিন্তু আমাদের ভারি অবাক করে দিয়েছিল। আগে আগে হয়ে গেলে কি হবে, কী নাদুসনুদুস হয়েছিল বল? টুকটুকে গোলাপি রঙ, এক্কেবারে ফুলের মতো। তবে মাথায় একদম চুল ছিল না।

চুল ছিল না কি রে! বল পুরো টাক। টেকো মেয়ে দেখে বউদির সে কী মন খারাপ! কোলেই নিতে চাইত না। টেকো নাতনি দিনরাত ঠাকুরমার কোলে ওয়া ওয়া কাঁদছে। নেহাত টাকে গোবর ঘষে পরে চুল গজাল!

এবার সত্যি সত্যি কটাস করে কন্দর্পকে চিমটি কেটেছে তিতির, ফুড়ুক করে উড়ে গেছে পাশের ঘরে। সাজছে। কন্দর্পও চুলটুল আঁচড়ে ঝটিতি তৈরি হয়ে নিল। প্যান্ডেলে ঝান্টুকে টা টা করে কাকা ভাইঝি রওনা দিল স্কুটারে। মানিকতলার বুড়ি ছুঁয়ে যখন ঢাকুরিয়া পৌঁছল, কলকাতা তখন আলোয় আলোময়।

কন্দর্পদের পাড়ার পুজোটি বিশাল। কোনওবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আদলে প্যান্ডেল হয়, কোনওবার মীনাক্ষী টেম্পল। এবার তারা বানিয়েছে আংকোরভাটের মন্দির। সেই দেখতে স্রোতের মতো মানুষ ধেয়ে আসছে ঢাকুরিয়ায়। শহরের মানুষ। শহরতলির মানুষ। গ্রামের মানুষ। হেঁটে। বাসে। ট্রেনে।

ঢাকুরিয়া ব্রিজ থেকে বাড়িটুকু পোঁছতে কন্দর্পর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। এত ভিড়! এত ভিড়! মানুষের পায়ের চাপে কলকাতার না পাতালপ্রবেশ হয়! ও, আজ আর কন্দর্প কোথাও বেরোচ্ছে না। স্বয়ং মা দুর্গা এসে ডাকলেও নয়।

তিতির বন্ধুদের প্রতীক্ষায় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেছে, কন্দর্প একাই ঢুকল বাড়িতে।

বড় ঘরে জয়মোহনের কজন লেকের বন্ধু এসেছেন, জয়মোহন গল্প করছেন তাঁদের সঙ্গে। সামনে ফাঁকা চায়ের কাপ, জোর গজল্লা চলছে বুড়োদের। পুজোর পরেই ভোটের দামামা বাজবে, তাই নিয়ে এখনই সকলে উত্তেজিত। মাঝে মাঝে চাটনির মতো স্ত্রী পুত্রবধুদের নিন্দাও ঢালাও বিলি হচ্ছে আড্ডায়। কন্দর্প মনে মনে হাসল, বাবার এখন মেজাজ কদিন শরিফ থাকবে।

ক্লান্ত কন্দর্প নিজের ঘর খুলছিল, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল। সুদীপ নামছে। ড্রেস মেরেছে খুব। নির্ঘাত শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই দুই ভাই অর্ধ-পরিচিতের মতো হাসল।

কন্দর্পকে পেরিয়ে গিয়েও হঠাৎ ঘুরে এল সুদীপ, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, তোর একটা ফোন এসেছিল।

কার ফোন? কন্দর্প সামান্য কেঁপে গেল। শালা অশোক মুস্তাফিটা আবার ডেকে পাঠাল না তো! বলছিল সারা রাত আজ কোথায় যেন আসর জমাবে! মুস্তাফির কাছ থেকে ফোন শুনলে মেজদাই বা কী ভেবে বসে…!

সুদীপ বলল, এক ভদ্রমহিলার ফোন। তুই বোধ হয় তাদের বাড়ি সকালবেলা গেছিলি, মানিব্যাগ ফেলে এসেছিস।

দ্রুত পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল কন্দর্প, হ্যাঁ, তাই তো!

–কোন ঘোরে থাকিস? সকালে ফেলে এসেছিস, এখনও খেয়াল নেই? সুদীপ দু পা এগিয়ে আবার দাঁড়াল, সকালে তিতিরকে নিয়ে জয়ির বাড়ি গিয়েছিলি না?

–হ্যাঁ। ওখান থেকেই…

–ও। সুদীপ কি যেন একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। চলে গেল।

 ঘরে ঢুকে আবার পকেটে হাত দিল কন্দর্প। কখন পড়ল মানিব্যাগটা? পারফিউম বার করার সময়? নাকি যখন পকেটে সিগারেট হাতড়াচ্ছিল, তখনই…?

ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি আলনায় পরিপাটি করে ঝুলিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিল কন্দর্প। টান টান শুয়ে পড়ল বিছানায়। মানিব্যাগে মধুমিতার একটা ছবি আছে, মধুমিতাই দিয়েছিল বায়োডাটার সঙ্গে, ছবিটা চোখে পড়লে মধুমিতা কিছু মনে করবে না তো? আর মধুমিতার মা যদি পার্সটা ঘাঁটে…! ধুস, যত সব ফালতু দুশ্চিন্তা। বাড়িতে অন্যের ফেলে যাওয়া মানিব্যাগ কেউ মোটেই ঘেঁটে দেখে না। তবু যদি দেখে? ধুস, দেখলে দেখবে। কন্দর্পর তো এখন আর কিছু করার নেই!

মানিব্যাগের চিন্তাটাকে জোর করে তাড়াতে চাইছে কন্দর্প, মানিব্যাগই ঘুরে ফিরে আসছে মাথায়। পিছন পিছন লাইন বেঁধে চলে আসছে অন্যরাও। মধুমিতার মা… মধুমিতা… মউ… চকোলেট… পারফিউম… পাঞ্জাবিতে ছিটিয়ে দেওয়া এক ঝলক সুগন্ধ…. মধুমিতার মা’র ভ্রূকুটি… মধুমিতার কঠোর অনুনয়… দীপঙ্করের নাকি খুব বিশ্বাস ছিল কন্দর্পর ওপর… একটা কাশগাছ সাদা ফুল নিয়ে একা একা দুলছে হাওয়ায়… দুলছে.. একা…।

কন্দর্প অলসভাবে উঠে বসল। আলো জ্বেলে বিছানায় নিয়ে এল সেতারটাকে। বহুকাল বাজানো হয়নি, সেতারের গায়ে ধুলো জমেছে যত্ন করে মুছল কন্দর্প।

বাইরে চাকভাঙা মৌমাছির কলরব। কলকাতা এখন উৎসবে মাতোয়ারা। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষোভ বেদনা নৈরাশ্য আজ ঢেকে গেছে প্রমোদের উন্মাদনায়।

কন্দর্প আঙুলে মেজরাফ লাগাল। সুর তুলছে সেতারে। ইমনকল্যাণ।

.

২৮.

পুজো শেষ হতেই হঠাৎ যেন পৃথিবীটা কেমন বদলে যায়। যে দিনটাকে এতদিন বিশাল মনে হত, সেই দিন যেন আচমকাই ছোট হয়ে যায় অনেকটা। বিকেল ফুরোতে না-ফুরোতেই ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। পুজো তো মাত্র কটা দিন, তবু তার মধ্যেই কোত্থেকে একটা হিম হিম ভাব এসে যায় বাতাসে। ভোরের দিকে রাস্তাঘাট বাড়িঘর সব কেমন অল্প অল্প আবছা। তিতিরের মনটাও কেমন ভারী হয়ে যায় এ সময়ে। ভারী, না শূন্য! শহর জুড়ে যত্রতত্র বিশাল বিশাল প্যান্ডেলের হাড়গোড় পড়ে আছে, দেখলেই তিতিরের বুক বড় হু হু করতে থাকে। কদিন আগেই কত কী ছিল, এখন আর কিচ্ছুটি নেই। অত আলো অত গান আনন্দ উচ্ছ্বস হঠাই এক হাহাকার মাত্র।

আরও একটা পুজো চলে গেল!

পুজোর কদিন আগে থেকেই বুকের ভেতর এক আশ্চর্য ধুকপুকুনি শুরু হয়েছিল তিতিরের। এবার পুজোটা হয়তো একটু অন্যরকম হবে। হয়তো এমন কিছু ঘটবে সে কল্পনাও করতে পারেনি কখনও। হয়তো ইট কাঠ পাথর পিচরাস্তা থেকে এক তুমুল আনন্দের বিচ্ছুরণ ঘটবে, রোদ্দুর আরও সোনালি হয়ে যাবে, সবুজ গাছপালা বুঝি বা হয়ে উঠবে আরও মায়াময়।

প্রতি বছরই তিতির ভাবে এরকম, কিন্তু বাস্তবে এসব কিছুই হয় না। রোদ্দুর বড় চড়া লাগে, মাইক আর ঢাকে তালা লেগে যায় কানে। এক আধদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে ফুচকা ভেলপুরি নাগরদোলা, বড় জোর লাইন লাগিয়ে কোনও রেস্টুরেন্ট, বাড়িতে একটু-আধটু ভালমন্দ রান্না, সন্ধেবেলা ঝলমল আলোর স্রোতে বিবশ হয়ে ভেসে বেড়ানো, সবই প্রায় যান্ত্রিক নিয়মে বাঁধা। নিজের মনে পুজো আসে, নিজের মনেই চলে যায়। আর পুজো ফুরোলেই মনে হয় এবার পুজো বড় ম্যাড়মেড়ে কাটল, এর থেকে আগের পুজোটা বুঝি ঢের ভাল ছিল।

কেন এমন হয়? এবার তো পুজোর দিনগুলো তেমন মন্দ কাটেনি তিতিরের! হিয়া আসেনি, তবে দেবস্মিতা ঝুলন অনিতারা সবাই এসেছিল। পিসির বাড়ি থেকে ফিরে অষ্টমীর সন্ধেটা তো দিব্যি কাটল তাদের সঙ্গে! ঝুলনের বয়ফ্রেন্ড অর্ণবও এসেছিল এবার, সে বেশ দাদাসুলভ ভঙ্গিতে সকলকে নিয়ে ঘুরেছে এদিক ওদিক, অদ্ভুত অদ্ভুত রঙ্গরসিকতা করে হাসিয়ে মেরেছে তিতিরদের। নবমীর দিনও, কথা নেই বার্তা নেই, নতুন স্কুলের বন্ধুরা এসে হাজির। মিতেশ সম্রাট পাঞ্চালী তৃণা। সঙ্গে কুলজিৎ আর তাদের বাড়ির ইয়া ঢাউশ জিপ। এসেই তিতিরকে নিয়ে টানাটানি, চল চল চল, ঝুলনকে তুলব। তারপর কোথায় না চরকি মারা হল সারাদিন! বেহালা গড়িয়া পার্কসার্কাস শ্যামবাজার গঙ্গার ধার সর্বত্র। সম্রাট এক বিচিত্ৰদৰ্শন বেতের টুপি পরেছে, তাতে আবার ময়ুরের পালক গোঁজা! কুলজিৎ তালপাতার ভেঁপু কিনে বাচ্চাদের মতো বাজিয়ে চলেছে অবিরাম! চলন্ত গাড়িতে কোরাসে গান চলছে একটানা, কেউ একটু থামলেই নতুন স্কুলের প্রমীলা ম্যাডামকে নকল করে নেকু নেকু সুরে ধমক দিচ্ছে ঝুলন! সেই মুহূর্তে তিতিরের মনে হচ্ছিল এত খুশির দিন জীবনে বোধ হয় আর কখনও আসেনি। অথচ পুজো যেতেই মুহূর্তগুলো কোথায় যে উবে গেল! পুজোর কটা দিন এখন শুধুই বিবর্ণ স্মৃতি। বড় ফিকে, ভারি একঘেয়ে।

তিতির আনমনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাল। ফুলহীন গাছটাকেও বড় নিরানন্দ দেখাচ্ছে। এখন। পড়ন্ত সূর্যের আলোতেও যেন ঝিমোচ্ছে গাছটা। ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে।

কী রে তিতির, কী ভাবছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

 তিতির চমকে তাকাল। কাকিমা। লক্ষ্মীপুজো কাটিয়ে কাল রাত্রেই কাকিমা বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে। একটু আগেও ঘুমচ্ছিল অ্যাটমের পাশে, চোখ দুটো টোপা টোপা।

রুনা তিতিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। টুক করে পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলাটা একবার দেখে নিল। বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে কায়দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, রুনাকে দেখেই তার হাবভাব দারুণ অন্যমনস্ক।

রুনা ফিক করে হাসল, ছেলেটার দেখছি তোকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে!

পলকের জন্য চোখ তুলেই তিতির মুখ ঘুরিয়ে নিল। উদাসীন স্বরে বলল, পাড়াটা কী তাড়াতাড়ি বদলে গেল, তাই না কাকিমা?

রুনা বড় হাই তুলল, হুঁ, পর পর কতগুলো বাড়ি ভাঙা পড়ল। দত্তদের বাড়ি, গুপ্তদের বাড়ি, সান্যালদের বাড়ি….

–পুরনো বাড়িগুলোই ভাল ছিল।

–কেন?

তিতির ঠিক উত্তর খুঁজে পেল না। সব ভাল লাগার কি কারণ থাকে?

রুনা বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, সান্যালদের বাড়িটা কী ছিল ভাব। ঝরঝরে অন্ধপুরী। স্যাঁতসেঁতে আনহেলদি ঘর, আলো ঢুকত না… দেখিসনি ও বাড়ির লোকগুলো সূর্যের আলো না পেয়ে কেমন সাদা ইঁদুরের মতো ফ্যাকাসে মেরে গেছিল!

তিতির বিষণ্ণ হাসল। বুঝতে পারছে কাকিমার কথা কোন দিকে যাচ্ছে। বলল, তা হলে তো আমাদের বাড়িতেও দাদু ছোটকার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া উচিত।

–চাঁদু তো এমনিই ফ্যাকাসে।

–যাহ, ছোটকা ফর্সা। টকটকে ফর্সা।

–ওই হল। পুরুষমানুষ বেশি ফর্সা হলে ফ্যাকাসে ফ্যাকাসেই লাগে। রুনা উল্টো দিকের নতুন বাড়িটার দিকে আঙুল দেখাল–ফ্ল্যাটগুলো কত সুন্দর হয়েছে দ্যাখ, কত রোদ বাতাস ঢুকছে..

–ঘরগুলো কিন্তু বড্ড ছোট হয়ে গেছে গো।

–বেশি বড় ঘর দিয়ে হবেটা কী? আগের মানুষদের সবেতেই একটু বাড়াবাড়ি ছিল। যতটা দরকার ততটাই তো ভাল।

কি জানি বাবা, ছোট ঘরে থাকতে হবে ভাবলে আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। বড় ঘরে কত আরাম করে থাকা যায়।

রুনা আবার হাই তুলল। একটুখানি কটমট করে যেন দেখলও তিতিরকে। তারপর রাস্তায় চোখ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল পাশে।

তিতিরের আর বারান্দায় দাঁড়াতেও ভাল লাগছিল না। কাকিমা আবার এক্ষুনি কী কথা শুরু করে! তবে এই মুহূর্তে সরে যাওয়াটাও ভাল দেখায় না।

আরও মিনিট দু-চার সিঁটিয়ে থেকে সন্তর্পণে সরে এল তিতির। ঘরে ফিরে একবার উত্তরের জানলায় দাঁড়াল, একবার পুবের জানলায়। একটা গল্পের বই নিয়ে বিছানায় শুয়েও উঠে পড়ল। ভাল লাগছে না। বাড়িতেই থাকতে ইচ্ছে করছে না।

দোতলাটা বড় বেশি নিস্তব্ধ এখন। ইন্দ্রাণী আদিত্য বাড়ি নেই, বাপ্পাও ঘুমোচ্ছ ভোঁস ভোঁস। প্রেস চললে নির্জনতারও একটা শব্দ থাকে, এখন তাও নেই। দুর্লভ দেশ থেকেই ফেরেনি এখনও। এই নিস্তব্ধতা অবশ্য থাকবে না বেশিক্ষণ, তিতির জানে। অ্যাটম উঠলেই গোটা দোতলা মুখর হয়ে যাবে। কিছুটা অ্যাটামের চিৎকারে, কিছুটা রুনার।

তিতির নাইটি ছেড়ে রানি রঙের নতুন সালোয়ার কামিজটা পরে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল উল্টে বেণী বাঁধল সযত্নে, ছোট্ট একটা লাল টিপ কপালে লাগাল, ড্রয়ার থেকে মার লিপস্টিক বার করে আলতো বোলাল ঠোঁটে। আয়নায় তিতিরের পূর্ণ প্রতিবিম্ব সুন্দর থেকে সুন্দরতর হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি ফেলে ভ্রূকুটি হানল কয়েকবার। নিজের মনে বলে উঠল, বাহ তিতির, তোকে তো বেশ দেখাচ্ছে!

আয়নার তিতির অমনিই নড়েচড়ে উঠেছে, এঁএঁহ, একদম নার্সিসাসফুল হয়ে উঠলি যে।

তিতির ভুরু কোঁচকাল, কেন, আমি দেখতে খারাপ?

আয়নার তিতির মুখ বেঁকাল, হয়েছে হয়েছে। ড্রেস মারা তো হল, কিন্তু এখন যাবেটা কোথায়?

–দেখি। কোথাও একটা যাব।

ঝুলনের বাড়ি গিয়ে লাভ নেই। ছুটির বিকেলে ঝুলন বাড়ি বসে থাকার মেয়ে নয়।

–সে কি আমি জানি না?

–হিয়ার বাড়ি যাবে ভাবছ কি?

–গেলে হয়। হিয়াটা অষ্টমীর দিন এল না…

–হিয়ার এখন অনেক নতুন নতুন বন্ধু, তাদের সঙ্গে বেরিয়েছিল হয়তো!

–অসম্ভব। হিয়া সেরকম মেয়েই নয়। নির্ঘাত শরীর খারাপ হয়েছিল। অন্য কিছুও ঘটে থাকতে পারে।

ওসব সান্ত্বনার কথা।

–মোটেই না। তুমি চুপ করো।

তিতির আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল। জানলা চারটে পরিপাটি বন্ধ করে, দরজা আলগা টেনে, সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়েও কি ভেবে পাশের ঘরে এল। বাপ্পা চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছে, জোরে জোরে ঠেলল তাকে, অ্যাই দাদা, আমি একটু বেরোচ্ছি।

বাপ্পা বিরক্ত মুখে চোখ কচলাল, বেরো না, আমাকে খোঁচাচ্ছিস কেন?

–আমার হয়তো ফিরতে সাতটা আটটা হবে। মা শেফালিমাসির বাড়ি গেছে, এসে যদি খোঁজ করে তো একটু বলে দিস।

বাপ্পা শুনল কিনা বোঝাই গেল না। পিছন ফিরে শুয়েছে।

তিতির ঠোঁট ওল্টাল। জাহাজ জাহাজ করে দাদাটার মাথা একেবারে বিগড়ে গেছে, তিতিরের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না ভাল করে। সারা দিন শুধু টেপ চালিয়ে গান শুনছে, নয় ঘুমোচ্ছে। বাড়ি থেকেও খুব কম বেরোয় আজকাল। লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে বিষ্ণুপ্রিয়াদি এল বাড়িতে, তাকে ভেতরে বসতেও বলল না, দুটো-চারটে কথা বলে দরজা থেকেই ভাগিয়ে দিল। কেন এমন করছে দাদা!

সূর্য ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপারে নেমে গেছে। পশ্চিম আকাশে গোলাপি আভা, মাথার ওপর আকাশ প্রায় বর্ণহীন। কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ কানা ভাঙা থালার মতো ফুটে আছে আকাশে। দীপ্তিহীন, দ্যুতিহীন, অদ্ভুত এক ধূসর চাঁদ।

হিয়ার ঠাকুমা দরজা খুলতেই ঢিপ করে তাঁকে একটা প্রণাম করল তিতির, কেমন আছ ঠাকুমা?

হিয়ার ঠাকুমা তিতিরকে জড়িয়ে ধরলেন, আয় আয়। কতদিন পর দেখলাম তোকে! এদিকের রাস্তা ভুলেই গেছিস নাকি রে?

তিতির লাজুক হাসল, না না, ভুলব কেন? আসলে স্কুল আরম্ভ হতেই এমন পড়ার চাপ… হিয়ার সঙ্গেও স্কুলেই দেখা হয়ে যায়…

বুঝেছি বুঝেছি। বন্ধুই আসল, ঠাকুমাটা কেউ নয়!

তিতির অপ্রস্তুত মুখে অবস্থাটা সামাল দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ভেতর থেকে একটা সমবেত হাসির আওয়াজ শুনে থমকে গেছে।

হিয়ার ঠাকুমা চোখ ঘুরিয়ে বললেন, যা, ভেতরে যা। তোর বন্ধুর ঘরে আজ জোর আড্ডা বসেছে।

তিতির হিয়ার ঘরে ঢুকে আমূল নাড়া খেয়ে গেল। টোটো বসে আছে হিয়ার খাটে। পাশে হিয়া। সঙ্গে আরও তিনটে ছেলেমেয়ে। হিয়াদের ক্লাসেরই। তিতিরের মুখচেনা।

তিতিরকে দেখেই হিয়া লাফিয়ে নেমেছে বিছানা থেকে, ওমা তুই! ভালই হয়েছে এসেছিস। ভাবছিলাম আজকালের মধ্যেই তোর কাছে যাব।

তিতির কিছু একটা বলতে চাইল, কিছুতেই শব্দ ফুটল না গলায়।

–তুই আমার ওপর খুব রেগে আছিস, না? হিয়া দরজায় এসে হাত ধরল তিতিরের, বিশ্বাস কর, অষ্টমীর দিন আমি যেতাম। বলতে বলতে হঠাৎ গলা নামিয়েছে হিয়া। প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে অনেক ব্যাপার। তোকে পরে বলব।

তিতিরের একটুও কৌতূহল হচ্ছিল না। শুধু শুনল কথাটা।

আড়ষ্টভাবে একটা বেতের চেয়ারে বসল তিতির। জিভে তালু ভিজিয়ে আরও আড়ষ্টভাবে টোটোর দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। অথবা হাসল না, অজান্তেই ফাঁক হয়ে গেছে ঠোঁট।

টোটো হাসিটাকে আমলই দিল না। হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে কী ঠিক হল? প্রোগ্রাম ফাইনাল?

হিয়া ঘরের বাইরে যাচ্ছিল, দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, অঞ্জন আর পিউ যাবে কি না জানি না, আমি যাচ্ছি। সৌমিকও যাচ্ছে।

অঞ্জন নামের ছেলেটি তড়িঘড়ি বলে উঠল, না না, আমরাও যাব। কি রে পিউ, দু দিনের জন্য হলে যেতে পারবি না?

পিউয়ের চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভীষণ চিন্তিত মুখে ভুরুতে একরাশ ভাঁজ ফেলে সে বলল, দেখি, কাল জানাব। কবে যেন যাওয়া হচ্ছে?

টোটো বলল, ফ্রাইডে ভোরে বেরোচ্ছি। আইদার সানডে নাইটে ফিরে আসব, নইলে সোমবার।

কতক্ষণ লাগবে রে যেতে?

বললাম তো বাসে গেলে ঘণ্টা তিন-চার।

–এতজন গেলে প্রবলেম হবে না?

কত বার বলব, আমাদের বাড়িতে সাফিসিয়েন্ট জায়গা আছে! টোটো সামান্য খিঁচিয়ে উঠল, –যেতে হয় চল, অত কোয়েশ্চেন করিস না।

তিতির ঠিক বুঝতে পারছিল না কোথায় যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে টোটোদের। শুধু টের পাচ্ছে সে আসার পর হিয়াদের আড্ডাতে যেন একটু ছন্দপতন হয়েছে। সে কি হংস মধ্যে বক যথা হয়ে গেল?

হিয়া যেন তিতিরের অবস্থাটা বুঝতে পারল। টুক করে একবার ভেতর থেকে ঘুরে এসে বলল, কি রে তিতির, তুই যাবি নাকি আমাদের সঙ্গে? আমরা সবাই মিলে রাজর্ষিদের দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি।

তিতির প্রাণপণে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল, মাধবপুর?

–ওমা, তুই গ্রামটার নাম জানিস?

জানি। আরও অনেক কিছু জানি।

কী রকম?

–যেমন ধর, মাধবপুরে রাজর্ষির দাদু ঠাকুমা থাকেন, কাকা কাকিমা থাকেন, একতলা দোতলা মিলিয়ে ছটা ঘর আছে, বাগান আছে, পুকুর আছে…। তিতির সপ্রতিভতা বাড়িয়েই চলেছে। টোটোর দিকে টেরচা চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল, কী, আমি ভুল বলেছি?

টোটো নিরুত্তর।

তিতির আর একটু উচ্ছল হল, –আরও বলব? রাজর্ষির দাদু দিদা এখন মাধবপুরে আছেন। জলপাইগুড়ি থেকে এসে পুজোর সময়ে রাজর্ষিদের বাড়িতেই ছিলেন, একাদশীর দিন মাধবপুরে গেছেন।

সৌমিক আর পিউ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, তুমি এত কথা জানলে কী করে?

তিতিরের মুখে রহস্যের হাসি। দেখছে টোটোকে।

হিয়াও ফিকফিক হাসছে, বুঝতে পারছিস না তোরা? ও তো রাজর্ষির রিলেটিভ, তাই না রে রাজর্ষি?

টোটো হিয়ার দিকে তাকাল না। তিতিরের দিকেও না। সৌমিক পিউদের দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, না নাহ। রিলেটিভ ফিলেটিভ কিছু না। আমার বাবা ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। মাঝেমধ্যে ওদের বাড়ি যায়। মনে হয় বাবার মুখ থেকেই শুনেছে।

কথাটা তীক্ষ্ণ কাঁটা হয়ে ফুটল তিতিরের বুকে। টোটো ভালমতোই জানে ডাক্তার আঙ্কল মোটেই তিতিরদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান নয়, ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। জেনেশুনেও টোটো হঠাৎ মিথ্যে বলল কেন? তাও আবার ওরকম ব্যঙ্গের সুরে?

তিতিরের মুখে আঁধার নামল। হিয়া অতশত লক্ষ করেনি, হালকা গলায় বলল, কি রে, যাবি তুই আমাদের সঙ্গে? চল না।

মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখতে চাইল তিতির। মাথা নেড়ে বলল– না রে, আমি যেতে পারব। তোরাই যা।

হিয়া আর জোরাজুরি করল না। শুক্রবার কখন বেরোবে, কোন পথে যাবে, সঙ্গে কী কী নেবে তাই নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে আবার। সৌমিক আরেকবার জেনে নিল গ্রামে গিয়ে মাঠে পটি করতে হবে কিনা। মাধবপুরের বাড়িতে টিভিও আছে জেনে টিনা বিস্ময় প্রকাশ করল, আশ্বস্তও হল। পুকুরে স্নান করতে সুইমিং কসটিউম লাগবে কিনা জেনে নিল অঞ্জন। প্রাথমিক বিরক্তি কাটিয়ে হাসি হাসি মুখে সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে টোটো।

কয়েক মিনিট মুখ কালো করে পাথরের মতো বসে রইল তিতির। যেন ঘরের ভেতর অচেনা পাখিরা দুর্বোধ্য ভাষায় কিচির-মিচির করছে।

খানিক পরে উঠে পড়ল, আমি আজ চলি রে হিয়া।

হিয়া হাঁ হাঁ করে উঠল, এক্ষুনি যাবি কি রে? ঠাম্মা মাংসের চপ তৈরি করছে।

তিতির জোর করে হাসল, শরীরটা আজ ভাল নেই রে। এখন যাই, আরেক দিন এসে ঠাকুমার হাতের চপ খেয়ে যাব।

ঠাম্মা কিন্তু খুব রাগ করবে।

 –আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। আমি ঠাকুমাকে বুঝিয়ে বলে যাচ্ছি।

অন্ধকার নেমে গেছে। বাস স্টপে না দাঁড়িয়ে রাস্তা ধরে সোজা হাঁটছিল তিতির। ঘাড় গুঁজে। পাশ দিয়ে পথচারীদের আনাগোনা, রাস্তা বেয়ে বাস রিকশা ছুটে যাচ্ছে, কোনওদিকে দৃষ্টি নেই তিতিরের। চতুর্দিক ধোঁয়াটে, জমাট বাষ্পের পর্দায় ঢাকা।

হাঁটতে হাঁটতে আলগোছে চোখ মুছল তিতির। রাশি রাশি কীট যেন অবিরাম দংশন করে চলেছে তাকে। অথচ রক্ত ঝরছে না। টোটোর সঙ্গে দেখা হলেই টোটো তাকে উপেক্ষা করে, অপমান করে, তবু কেন টোটোর ওপর ক্রুদ্ধ হতে পারে না তিতির? এই টোটোই কি ছোটবেলায় নিজের সব খেলনা অবলীলায় দিয়ে দিত তিতিরকে? এখন কেন তিতিরকে এত অপছন্দ টোটোর? ডাক্তার আঙ্কল তিতিরদের বাড়ি আসে বলে রাগ? নাকি ডাক্তার আঙ্কল তিতিরকে ভালবাসে বলে হিংসে?

তিতির মাথা নিচু করে রাস্তা পার হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা মোটর সাইকেল তার গায়ের কাছে এসে থেমেছে, হাই!

কে রে বাবা! তিতির ছিটকে সরে গেল। পরের লহমাতেই চিনতে পেরেছে ছেলেটাকে। ঝুলনের সেই অনুসরণকারী প্রেমিক।

ছেলেটা মোটর সাইকেল থামিয়েছে, তবে স্টার্ট বন্ধ করেনি। গর্জনরত যন্ত্রবাহনের পিঠে বসেই প্রশ্ন ছুঁড়ল, তুমি এদিকে কোথায়?

তিতির জবাব দিল না। হাঁটছে।

মোটর সাইকেলও এগোচ্ছে টিকটিক, তোমার নাম তো তিতির, তাই না?

হাঁটার গতি বাড়াল তিতির।

মোটর সাইকেল এগোচ্ছে একইভাবে, –তোমার বন্ধুর ব্যাপার কী বলো তো? কদিন ধরে দেখছি না?

তিতির ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল, আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন কেন?

বিরক্ত তো করিনি! এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ তোমাকে দেখতে পেলাম, তাই জিজ্ঞেস করছি।

–মিথ্যে কথা। আপনি আমাকে ফলো করে আসছেন। উত্তেজনায় মুখচোরা তিতিরেরও গলা চড়ে গেল, আমি দেখেছি আপনি আমার স্কুলের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকেন। যেদিন ঝুলন আসে না, সেদিনও। কালকেও আপনি আমাদের বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ছেলেটা নার্ভাসভাবে হাসছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে চারদিক। রাস্তায় জনস্রোত এখন ভালই, দু-একজন ঘুরে ঘুরে দেখছেও এদিকে, তবে আজকাল আর কেউ তেমন খুচরো ঝামেলায় মাথা গলাতে চায় না। মজা দেখে, কিন্তু এগিয়ে আসার সাহস নেই, ইচ্ছেও নেই।

তিতিরের আজ এত সাহস এল কোত্থেকে! ভেতরের অভিমানই কি ভয়বোধ তুচ্ছ করে দিল তার! এক পা এক পা করে তিতির ছেলেটার দিকে এগোল। একদম সামনে এসে বলল, আপনি আমার দিকে ওভাবে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকেন কেন? আমার বন্ধুর সঙ্গে সুবিধে হচ্ছে না বলে এখন আমার পেছনে লাগার মতলব?

ছেলেটার মুখচোখ পুরো বদলে গেছে। স্মার্টভাবের আর চিহ্নমাত্র নেই, তোতলাচ্ছে রীতিমতো, আমি তো তোমার বন্ধুর পেছনে ঘুরি না! ওদের পাড়ায় আমার এক আত্মীয় থাকে, যাই মাঝে মাঝে….

–ফের মিথ্যে কথা? তিতির চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চিৎকারটা গিলে নিল। মোটর সাইকেলের ঠিক পিছনে টোটো! টোটোই তো।

কয়েক সেকেন্ড চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল তিতির। টোটো হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে যে! তাও একা!

টোটো অবাক চোখে তিতিরদের দেখছিল। তিতিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ট্রাউজারের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে এল, এনি প্রবলেম?

কী সর্দারি ভঙ্গি! কী কর্তারি মেজাজ!

পলকে কী যে হয়ে গেল তিতিরের। দুম করে রক্ত চড়ে গেল মাথায়। পরে তিতির বহুবার ঠাণ্ডা মাথায় খতিয়ে দেখেছে, সেদিন যদি সে হঠাৎ ক্রোধে অন্ধ না হয়ে যেত, তা হলে হয়তো অনেক কম জটিলতা আসত জীবনে। সুকান্ত নামের ছেলেটার অস্তিত্বই থাকত না!

তিতির আগুন চোখে ঝলসাল টোটোকে, –তোমার এখানে কী চাই? হঠাৎ এসে নাক গলাচ্ছ কেন?

টোটো থমকাল সামান্য, চোখ ঘুরিয়ে এক ঝলক জরিপ করল ছেলেটাকে। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, –মনে হল ডিসটার্ব করছে তোমাকে!

–তুমি দেখছি মনে হওয়া দিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলো। তোমার সব মনে হওয়া ঠিক নয়। ও আমার বন্ধু।

–এই মাত্র তুমি চেঁচাচ্ছিলে না?

–না। আমরা কথা বলছিলাম। বলেই মোটর সাইকেল ঘেঁষে দাঁড়াল তিতির। ছোটকার স্কুটারে চড়ার অভ্যস্ত কায়দায় মোটর সাইকেলের ব্যাকসিটে লাফিয়ে উঠে বসল। তার আকস্মিক রূঢ়তায় টোটোর পাংশু হয়ে যাওয়া মুখ চোখে পড়ল দু-এক সেকেন্ড। মুখটাকে আরও পাংশু করে দিয়ে ছেলেটা যেন তার কত কালের চেনা এমন ভঙ্গিতে বলল, – চলো চলো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এ যে মেঘ না চাইতেই জল! খুশিতে উড়ে যাচ্ছে যন্ত্রযান। সাঁ সাঁ বাতাস কাটছে। উৎফুল্ল যুবক অনর্গল কথা ভাসিয়ে চলেছে হাওয়ায়। কোনও শব্দ কোনও কথাই তিতিরের মগজে পোঁছচ্ছিল না। শুধু মাত্র নিজের হৃদযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। ঢকাং। ঢকাং। কেউ যেন অতিকায় হাতুড়ি পিটছে এক ফাঁকা লোহার স্তম্ভে।

যাদবপুর স্টেশনের কাছে এসে তিতিরের খানিকটা চেতনা ফিরল। এ কার সঙ্গে যাচ্ছে সে! কোথায় যাচ্ছে! কেন যাচ্ছে!

তিতির চিৎকার করে উঠল, থামো।

মোটর সাইকেল মন্থর হল, কী হল তোমার? বেশ তো যাচ্ছি। ভয় লাগলে আমার কাঁধটা চেপে ধরো।

তিতিরের গায়ে যেন ছ্যাঁকা লাগল, না। আমি নামব।

–এখানে কেন নামবে? তুমি তো ঢাকুরিয়ায় থাকো! আমি তোমাকে পাড়ার মুখে ছেড়ে দিয়ে আসব।

না। আমি এখানেই নামব। তীক্ষ্ণ গলায় ফুঁসে উঠল তিতির। সেই তীক্ষ্ণতা এত তীব্র, যে বেশ থতমত খেয়েছে যুবক।

মোটর সাইকেল থামল।

নেমেই হনহন করে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল তিতির, সুকান্ত পিছন থেকে ডাকল, আবার কবে দেখা হচ্ছে?

তিতির ফিরেও তাকাল না। তাকালে দেখত সুকান্তর চোখের মণি জ্বলছে আর নিবছে। জোনাকির মতো।

.

২৯.

একপাল হাঁস প্রথম অভ্যর্থনা জানাল টোটোদের। নেচে কুঁদে সমবেত আগমন সঙ্গীত গেয়ে তারা মুখর করে তুলল শিবসুন্দরের বাড়ি। টোটোর বন্ধুরা বিমোহিত। সৌমিক উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠল, লাভলি। লাভলি। হিয়া হাঁটু ভেঙে বাও করল হাঁসেদের, গ্ল্যাড টু মিট ইউ স্যারস।

টোটো হিয়ার কানে কানে বলল, স্যার নয়, ম্যাডাম বল। এদের সব ডিম পাড়ার জন্য রাখা হয়েছে।

শিবসুন্দর টোটোদের দেখে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। বললেন, তোমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? এসো, ভেতরে এসো।

ছেলেমেয়েরা ঢিপ ঢিপ প্রণাম করল শিবসুন্দরকে। মুহূর্তে শিবসুন্দরের বাড়ি সরগরম। পুকুর উঠোন সবজি বাগানে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে টোটোর বন্ধুরা।

অলকা টুকির হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। টোটোকে ডেকে বলল, তোমাদের জন্য তোমার কাকা আমাদের পাশের ঘরটা রেডি করে রেখে গেছে। আর মেয়েরা থাকবে দোতলায়, বড় ঘরে। কি, অসুবিধে হবে?

–নট অ্যাট অল। টোটো খুশিতে কাঁধ ঝাঁকাল, দাদাই দিদুন কোন ঘরে আছে?

–ওদের নিয়ে ভাবতে হবে না, ওঁরা দোতলাতেই থাকবেন। মাঝের ঘরে।

টোটো খানিকটা নিশ্চিন্ত হল। দাদাই দিদুন এখন মাধবপুরে রয়েছেন, তার ওপর সে চারটে বন্ধু নিয়ে আসছে, থাকার কোনও সমস্যা হবে কিনা তা নিয়ে একটু ভাবনা তো ছিলই। হালকা ছলে একবারই বন্ধুদের যাওয়ার কথা বলেছিল, শুনেই সকলে লাফাতে শুরু করবে কে জানত! আর একবার নাচিয়ে টোটো তাদের হতাশই বা করে কী করে!

একতলায় টোটোদের জন্য বরাদ্দ ঘরে পর পর তিনটে নেয়ারের খাটিয়া পাতা। ঢুকেই জুতোসুষ্ঠু পায়ে সেই খাটিয়ায় গড়াগড়ি খাচ্ছে অঞ্জন আর সৌমিক।

শিবসুন্দরের সঙ্গে হিয়া পিউকে নিয়ে দোতলায় এল টোটো। অর্ধবৃত্তাকার বড় ঘরটির দরজা খুলে শিবসুন্দর বললেন, কি, পছন্দ হয়!

–পছন্দ হয় মানে? হিয়া পিউ জোড়া পেন্ডুলামের মতো ঘাড় নাড়ছে, একসেলেন্ট। এত বড় ঘর, বিশাল বিশাল জানলা, বাইরে তাকালেই অমন টলটলে পুকুর…! পুকুরে ওটা কী ফুল দাদু? শালুক?

উঁহু। পদ্ম।

–ওমা তাই! পিউ শিহরিত, আমি কক্ষনও এভাবে পদ্মফুল ফুটে থাকতে দেখিনি। কী কিউট!

টোটো হাসি মুখে বলল, শুধু পদ্মফুলের শোভা দেখলে হবে? চানটান করবি না?

শিবসুন্দর বললেন, দাঁড়া, আগে একটু জিরিয়ে নে সবাই। হাতমুখ ধো, তোর কাকিমা জলখাবার তৈরি করছে খেয়ে নে… কোন সকালে বেরিয়েছিস…

–জলখাবার! এখন! পিউ প্রায় আঁতকে উঠল।

–কেন, তোমরা জলখাবার খাবে না?

–না দাদু। আমাদের ট্যাঙ্কি একদম ফুল। তারকেশ্বর স্টেশনে পেট পুরে সিঙাড়া কচুরি জিলিপি খেয়ে নিয়েছি।

–তা বললে তো হবে না ভাই, এখন একটু খেতেই হবে। তোমাদের কাকিমাটি নইলে ছাড়বে না।

হিয়া পিউ অসহায় মুখে টোটোর দিকে তাকাল। টোটো বন্ধুদের হয়ে আর্জি জানানোর আগেই শিবসুন্দর টোটোর কাঁধে হাত রেখেছেন, তুফান আর তোর দাদাই পোলট্রি থেকে মুরগি আনতে গেছে। ফিরলে তবে রান্না বসবে। এখন ট্যাঙ্কিতে আরেকটু ফুয়েল না নিলে অত বেলা অবধি টানবি কী করে?

শিবসুন্দরের ফুয়েল বলার কায়দায় হিয়া পিউ হিহি করে হেসে উঠেছে।

ছন্দার মা স্মৃতিকণা স্নানে গিয়েছিলেন, দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, কি রে, তোরা এসে গেছিস?

শিবসুন্দর স্মৃতিকণাকে বললেন, আসুন বেয়ান, এবার আপনি এদের একটু কম্পানি দিন। নীচে কয়েকটা পেশেন্ট বসিয়ে রেখে এসেছি, ঝটপট দেখে নিই গিয়ে।

শিবসুন্দর চলে গেছেন। স্মৃতিকণা ভারী শরীর গুছিয়ে খাটে বসলেন, মেয়ে দুটো এত ঘেমে নেয়ে গেল কী করে রে?

পিউ বলল, বাবাহ, বাস থেকে নেমে এতটা রাস্তা হাঁটা কি মুখের কথা! কতবার রাজর্ষিকে বললাম একটা ভ্যান রিকশা নে। কখনও ভ্যান রিকশায় চড়িনি, বেশ মজা করতে করতে আসা যেত। রাজর্ষি রাজিই হল না। খালি বলে, বেশি দূর নয়, হাঁট। এই তো সামনে, ওই তো গাছটার পর।

অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসেছে পিউ। টোটো লজ্জা পাচ্ছিল। বরাবর সে গাড়িতেই মাধবপুর এসেছে, বাস রাস্তা থেকে হাঁটাপথ যে কতখানি তার আন্দাজই ছিল না। গাঁয়ের লোকরা নাকি একটা কথা বলে। ডালভাঙা ক্রোশ। গাছের একটা ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করো, ডালটা যেখানে পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে, সেখানেই পূর্ণ হবে এক ক্রোশ পথ। বাস রাস্তা থেকে মাধবপুরের দূরত্ব নির্ঘাত ওই ডালভাঙা ক্রোশ।

টোটো অপ্রতিভ মুখে বলল, কি রে হিয়া, হাঁটতে খারাপ লেগেছে?

–একটুও না। আমার তো বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল। দু পাশে কেমন ধানক্ষেত, হলুদ ধানগাছ নুয়ে নুয়ে পড়ছে, কত গাছপালা, রোদ্দুরও কত নরম…!

স্মৃতিকণা বললেন, আজ তাত অনেক কম। কাল রাতে যা জোর একচোট বৃষ্টি হল!

 পিউ বলল, আমরা থাকতে থাকতে আবার বৃষ্টি হলে খুব মজা হয়। আমি কক্ষনও গ্রামের বৃষ্টি দেখিনি।

–গ্রামের বৃষ্টি আকাশ থেকেই পড়ে রে। পিউকে ভেংচে বেরিয়ে এল টোটো।

মা বাবাকে ছাড়া মাধবপুরে আসা টোটোর এই প্রথম। কাল রাতেও মা গাঁইগুই করছিল খুব। এতটা রাস্তা টোটোরা কী করে নিজেরা নিজেরা যাবে! তাও আবার গাড়ি ছাড়া! ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায় টোটোর। মা তাকে ভাবেটা কী? এখনও দুধের দাঁত না ওঠা হামাটানা শিশু? সারাক্ষণ শুধু ছেলে ছেলে ছেলে! অষ্টপ্রহর এই চাপ কাঁহাতক সহ্য করা যায়! বাবাকে তুমি কবজা করতে পারোনি, তাই বলে সারাক্ষণ টোটোর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে যাবে! মাকে ভালবাসে বলে মার পায়ে দাসখত লিখে দিতে হবে টোটোকে! তার কোনও স্বাধীন ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই!

সিঁড়ির পাশে মনোরমার ঘর। দরজা টেনে ভেজানো। সন্তর্পণে দরজা ঠেলে উঁকি দিল টোটো। বিছানায় মিশে বিছানারই অংশ হয়ে শুয়ে আছেন মনোরমা। কেন যে এরকম জড়পদার্থের মতো বেঁচে থাকা? ওই মনোরমাকে দেখে টোটোর হৃদয়ে কোনওই উত্তাপ জাগে না, আবেগও আসে না, শুধু বুকটা অকারণে ঢিপঢিপ করতে থাকে। সেই ছোটবেলা থেকেই।

ওই মহিলা তার বাবার মা!

 কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থেকে দরজাটা আবার টেনে দিল টোটো। নীচে নেমে দেখল ভেতর দাওয়ায় মাদুরে বসে জম্পেশ করে লুচি তরকারি সাঁটাচ্ছে অঞ্জন।

টোটোও পা ছড়িয়ে বসল মাদুরে, সৌমিকটা কোথায়?

–একটা ছড়ি নিয়ে হাঁস তাড়া করতে বেরিয়েছে।

খাবে না?

সব কটা হাঁসকে পুকুরে নামিয়ে তারপরে খাবে। টোটো ভুরু নাচাল, ওই হাঁসগুলোর নাম জানিস?

–হাঁসের আবার নাম কি! হাঁস ইজ হাঁস। পাতিহাঁস। রাজহাঁস। অবশ্য আরেকটা হাঁসও আছে। ডোনাল্ড ডাক।

–নো স্যার। এগুলোকে বলে খাকি ক্যাম্বেল।

ঢপ মারিস না। হাঁসের নাম খাকি ক্যাম্বেল! আমি জানি না বলে তুই যা খুশি উল্টোপাল্টা পড়িয়ে দিবি?

অলকা টোটোর খাবার নিয়ে এসেছে। বলল, তোমার মেয়েবন্ধুরা নীচে এল না?

অঞ্জন বিদঘুটে শব্দ করল গলায়, ইইই, ওদের মেয়েবন্ধু বলবেন না। ওরা হেভি চটে যায়।

 অলকা বিস্মিত হল, কী বলব তা হলে?

–শুধু বন্ধু বলুন। গেছো বন্ধু বলুন। বাঁদরি-টাদরি বললেও আপত্তি করবে না। কিন্তু মেয়েবন্ধু বললেই ফায়ার হয়ে যাবে।

–কেন?

টোটোর সঙ্গে চোখাচোখি করে গাল ছড়িয়ে হাসল অঞ্জন, সে ওরাই জানে।

টুকি মার পিছু পিছু এসে টোটোদের মাঝখানে বসে পড়েছে। দুজনের প্লেটের দিকে আশান্বিত চোখে তাকাচ্ছে। লুচির কোণা ভেঙে তার মুখে গুঁজে দিল টোটো।

অলকা হালকা ধমক দিল মেয়েকে, — টুকি, তুমি ভীষণ লোভী হয়েছ। ভাত খাওয়ার নামটি নেই, অন্যরা কেউ কিছু খেলেই..

টোটো চোখ বড় করে তাকাল টুকির দিকে, এমা, তুই হেংলু হয়েছিস?

টুকি দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়ল।

–দেখেছিস তো তোর মা কেমন মিথ্যে মিথ্যে দোষ দেয় তোকে? টোটো টুকির গাল টিপল, –বোনটা আমার হেভি মিষ্টি হয়েছে। ঠিক একটা সুগারকিউব।

টুকি আধো আধো বুলিতে বলল, না, আচকিলিম।

–ও কে। আইসক্রিম। চকালেট বার।

 অঞ্জনও এক টুকরো লুচি পুরে দিল টুকির মুখে, উঁহু, ও একটা স্ট্রবেরি।

 টোটো বলল, আরেকটু বড় হ টুকি, তোকে আমি কলকাতায় নিয়ে চলে যাব।

অলকা হাসল, – নিয়ে গিয়ে?

–ওখানেই স্কুলে ভর্তি করে দেব।

–আর আমি বুঝি মেয়ে ছেড়ে একা একা থাকব?

টোটো চুপ করে গেল। ইচ্ছে করলেই কি টুকিকে নিয়ে যেতে পারবে টোটো? এখানকার কেউই কলকাতায় গিয়ে থাকতে চায় না। দাদু তো থাকেই না, তুফানকাকা কাকিমাও ক্কচিৎ কখনও এক রাত আটকে গেলে হাঁসফাঁস করতে থাকে। কিসের এত টান বাপু মাধবপুরের? সবজিবাগান! পুকুর! বাড়ি! হাঁস! কী? নাকি ওই মহিলার দায়? বেচারা টুকিকেও এই গাঁয়ে পচে মরতে হবে। টোটো তো বাপু একটানা বেশি দিন মাধবপুরে এসে থাকতেই পারে না। দুদিনের জন্য এল, হইহই। হল, বেড়ানো হল ব্যস, ওইটুকুই যথেষ্ট।

অলকা রান্নাঘর থেকে আরও দুটো করে লুচি এনে দিল অঞ্জন টোটোকে। জিজ্ঞাসা করল, –দিদি এখন কেমন আছে টোটো?

–মা? ঠিকই তো আছে।

–অপারেশন কবে হবে কিছু ঠিক হল?

কে জানে! বলতে পারব না।

অলকা আর কথা বাড়াল। টোটোও না। মার পেটে কিসব অপারেশান-টপারেশান করাতে হবে, তাই নিয়ে রোজই বাবার সঙ্গে এখন খিটিমিটি লাগছে মার। বাবা বলছে, করিয়ে নাও। মার জেদ, করাবে না। দাদাই দিদুন যে কদিন ছিল, সে কদিন যা সিজফায়ার চলেছে। এখন আবার শুরু হয়ে গেছে বক্সিং। তুমি চাও আমি অপারেশান টেবিলে মরে যাই! আমি মরে গেলে তোমার সুখের রাস্তা পরিষ্কার হয়! মা যে কেন হঠাৎ এত বেশি হিস্টিরিক হয়ে উঠল? আগে তো এতটা ছিল না! নাকি ছিল? টোটোই ঠিক সেভাবে বুঝতে পারেনি! অপারেশানটা করিয়ে নিলে যদি শরীরের কষ্ট কমে যায় তবে তো সেটা করিয়ে নেওয়াই উচিত।

নিজেকে কষ্ট দিতে কেন যে এত ভালবাসে মা?

সিঁড়িতে ফটাস ফটাস শব্দ। হাওয়াই চটির। হিয়া আর পিউ নামছে। দুজনেই সালোয়ার কামিজ পাল্টে লঙ স্কার্ট পরে নিয়েছে। পিউর কানে ওয়াকম্যান। সিঁড়ির শেষ তিনটে ধাপ এক লাফে পার হল পিউ। মাদুরে বসে টুকিকে নিয়ে পড়েছে। চটকাচ্ছে মেয়েটাকে। ওয়াকম্যান কানে লাগিয়েই।

হিয়া সবজি বাগানের দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। বাগান এখন ফাঁকা ফাঁকা। কিন্ডার গার্টেনের বাচ্চাদের মতো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুলকপি টোম্যাটো আর বেগুনের চারারা। না, দাঁড়িয়েও নেই, কাল রাতের বৃষ্টিতে তারা প্রায় ধরাশায়ী।

পা দোলাতে দোলাতে হিয়া জিজ্ঞাসা করল, — এই রাজর্ষি, এদের মধ্যে কোনগুলো ফুলকপির চারা রে?

টোটোও কোনও গাছ চেনে না। আন্দাজে এক দিকে হাত দেখাল।

অলকা ঝিকঝিক হাসছে, ওগুলো কপি হবে কেন? ওগুলো তো বেগুনচারা।

–ওই হল। ওকে চেনালেই বা কত চিনবে! টোটো পাশ কাটাতে চাইল। প্রাজ্ঞ মুখ করে প্রশ্ন করল, আগেরবার এসে ইয়া বড় একটা কুমড়ো দেখেছিলাম, এবার যে কুমড়ো দেখছি না। কাকিমা?

কুমড়ো আর লাগাচ্ছি না। জমিটা তো ছোট, অন্য গাছের বড্ড ক্ষতি হয়ে যায়।

 –তাও তো বটে। টোটো ঘাড় নাড়ল।

 হিয়া মুখ ঘুরিয়ে টোটোকে দেখছিল। টোটোর অজ্ঞতা ধরে ফেলে হাসছে ফিকফিক। টোটো। অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

.

আটটা হাঁস ক্ষুদে নৌবহরের মতো টহল দিচ্ছে গোটা পুকুর। পদ্মফুলের কাছে এসে হঠাৎ হঠাৎ মুখ ডোবাচ্ছে জলে, কুশলী খেলোয়াড়ের মতো পুরো শরীর পাক খাইয়ে সোজা করছে, আবার সাঁ সাঁ সরে যাচ্ছে পুকুরের কোণে কোণে। এক ধূর্ত মাছরাঙা জলতলের খুব কাছ দিয়ে বিফলভাবে উড়ে চলে গেল। তার লেজের ছোঁয়ায় ঠিকরে উঠল কয়েক বিন্দু জল।

দুটো হাঁস জলে নামেনি। এখনও তাদের কঞ্চি নিয়ে ধাওয়া করে চলেছে সৌমিক।

টোটো চেঁচিয়ে ডাকল, এই সৌমিক, হচ্ছেটা কি? খাবার যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল!

দাঁড়া, এই দুটোকে আগে জলে পাঠাই।

কঞ্চিটা আমাকে দে, আমি নামিয়ে দিচ্ছি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘামভেজা মুখে টোটোকে কঞ্চি ছুঁড়ে দিল সৌমিক, ঠিক আছে, তুইই ট্রাই কর।  

হাঁস দুটোকে দেখতে মজা লাগছিল টোটোর। কেমন ধূসর রঙ, তুলতুলে শরীর, কিন্তু ভারি পরিণত হাবভার! ঠিক যেন তার দিদুনটি। একই রকম দুলে দুলে হাঁটা।

কঞ্চি হাতে হাঁস দুটোর পিছনে হাঁটছে টোটো। হাঁসেদের ভুক্ষেপ নেই, টোটো কাছে গেলে তারা একটু দ্রুত ছোটে, আবার হাঁটে। ঢিকুর ঢিকুর।

টোটো বেশ খেলা পেয়ে গেল। চরকি মেরে চলেছে গোটা পুকুর, ক্রমাগত চেঁচাচ্ছে, এই নাব নাব নাব।

হিয়া পিউ অঞ্জন গলা মিলিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, বাক আপ রাজর্ষি। বাক আপ।

টোটো ছুটতে শুরু করেছে। ছুটছে। ছুটছে।

 দুটো হাঁসই অত্যন্ত ঠ্যাঁটা। অবিরাম তাড়া খেয়েও জলে নামার কোনও লক্ষণ নেই তাদের, পাড় ধরে দৌড়চ্ছে দুলে দুলে। টোটো খুব কাছে গিয়ে পড়লে হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাচ্ছে টোটোর দিকে, টোটোর কঞ্চি অগ্রাহ্য করে তেড়ে আসছে দু-চার পা, কর্কশ গলায় অভিশাপ দিচ্ছে টোটোকে। তাদের প্রতিরোধে পিছিয়ে যাচ্ছে টোটো, তাই দেখে কোরাসে হাসছে হংসযুগল। হেসে লুটিয়ে পড়ছে টোটোর বন্ধুরাও।

টোটোর জেদ চেপে যাচ্ছিল। টোটোদেরই হাঁস টোটোকে বেইজ্জত করছে! তাও কিনা বন্ধুদের সামনে!

চোয়াল কষে আবার লেগে পড়েছে টোটো। একটা হাঁসকে প্রায় নাগালে পেয়ে কঞ্চি ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিল, সুড়ৎ করে কয়েক পা উড়ে গেল বদমাইশটা। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারল না টোটো। পড়ে গেছে মাটিতে।

বন্ধুরা দৌড়ে এল। কেউ ধরার আগে টোটো নিজেই উঠে বসেছে। হিয়া আলতো চাপড়ে পিঠ থেকে ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছিল, টোটো তার হাত সরিয়ে দিল।

পিউ উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করল, লাগেনি তো?

 রোষকষায়িত চোখে তাকাল টোটো, জবাব দিল না।

বন্ধুরা ঝুপঝাপ বসে পড়েছে পাশে। চুপচাপ খানিকক্ষণ।

টোটোর অস্বস্তি হচ্ছিল। অপমান ঢেকে হাসার চেষ্টা করল, হাঁসের মাংস খেতে খুব ভাল, তাই না রে?

–হ্যাঁ, ডাকরোস্ট দারুণ ডিলিশাস।

–একটু হট, এই যা।

হট মানে?

–হট মানে হট। খেলে শরীর গরম হয়।

 –হাঁসের বডিতে কি ফ্যাট বেশি থাকে?

না রে, ফাইবার বেশি। ছিবড়ে ছিবড়ে হয়।

একটা বিষয় পেয়েই কথার ফুলঝুরি শুরু হয়ে গেছে। টোটো শুনছিল না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অবাধ্য হাঁসদুটোকে দেখছিল শুধু। বিড়বিড় করে বলল, ওই হাঁস দুটোকে পুড়িয়ে খেলে কেমন হয়?

-যাহ, এগুলো তোদের পোষা হাঁস না!

পোষা বলে কি মাথা কিনে রেখেছে?

হিয়ার মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল, অত সুন্দর দুটো প্রাণীকে তুই মারতে পারবি?

না পারার কি আছে! টোটো নিজের মনে বিড়বিড় করল। টোটোকে যারা অপমান করে, টোটো। তাদের সহজে ক্ষমা করে না।

মোপেডের আওয়াজ হচ্ছে বাইরে। ছন্দার বাবা আর তুফান ফিরল। মুরগি কিনে কেটেকুটে আনতে অনেকটাই বেলা হয়েছে তাদের।

তুফান ডাকছে টোটোদের। বন্ধুদের সঙ্গে উঠোন অবধি এসেও ঝট করে পুকুরপাড়ে ফিরে এল টোটো। খুঁজেপেতে একটা প্রকাণ্ড থান ইট জোগাড় করে হাঁস দুটোর দিকে তাক করে ছুঁড়ল। লাগল না, তবে এস্ত দুই হাঁস ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নেমে গেছে জলে।

টোটোর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটে উঠল। বিজয়ীর হাসি।

.

৩০.

শেষদুপুরে আমগাছ তলায় অন্ত্যক্ষরী খেলার আসর বসেছে।

ছন্দার বাবা কমলেশ আসরের প্রধান উদ্যোক্তা। কমলেশ মানুষটি খুব রসিক, সারাক্ষণ মজার মজার কথা বলছেন। চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গায়, গল্পের ভাঁড়ারটিও তাঁর অফুরন্ত। মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপেই হিয়া পিউকে বশ করে ফেলেছেন তিনি। অঞ্জন সৌমিক খাওয়াদাওয়ার পর একটু ঘুমোনোর তোড়জোড় করছিল, পুকুরে প্রমত্ত জলকেলি করে দুজনেই খুব ক্লান্ত, কমলেশ তাদেরও টেনে এনেছেন গাছতলায়। অলকা স্মৃতিকণা তুফান এমনকী টুকিও আসরে মজুত।

শিবসুন্দর আসেননি। বিশ্রাম নিচ্ছেন ওপরে। মধ্যাহ্নে একটু চোখ না বুজে নিলে বিকেলে কলে বেরোতে অসুবিধে হয় তাঁর। মনোরমাও আজকাল প্রায়শই দুপুরবেলার দিকে জেগে থাকেন, তাঁর পাশে থাকতেই হয় শিবসুন্দরকে।

গানের পর গান চলছে। ক দিয়ে শেষ, ক দিয়ে শুরু। ম দিয়ে শেষ, ম দিয়ে শুরু। সুরে বেসুরে মেতে উঠেছে গাছতলা। কমলেশের পুরনো গানের স্টক দারুণ, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম খাচ্ছে পিউরা। মাঝে মাঝে বানিয়ে বানিয়েও গান গাইছেন কমলেশ, ধরতে পারলে চোট্টামি চোট্টামি করে চেঁচিয়ে উঠছে সবাই।

খেলার আঙিনা থেকে সরে এল টোটো। পুকুরপাড়ে গিয়ে বসেছে। একা হয়ে। ছোট ছোট ইটের কুচি তুলে আনমনে ছুঁড়ছে জলে। তির্যক তরঙ্গ গোল হয়ে হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুকুরে। পদ্মফুল নেচে উঠছে তিরতির। সূর্য সরে যাওয়ার পর জল এখন ছায়াময়। কালো ছায়ামাখা পুষ্করিণী যেন আরও স্বচ্ছ। আরও নিবিড়।

টোটোকে খুঁজতে হিয়া এল পুকুরপাড়ে, কি রে, এখানে এসে বসে পড়েছিস যে?

টোটো ঘাস ছিঁড়ছে, তুইও বোস না।

–খেলবি না?

–ওসব চাইল্ডিশ খেলা আমার ভাল লাগে না।

ইহ, আজকাল বলে কত বড় বড় লোকেরা অন্তাকশরি খেলে! স্কুল কলেজে কম্পিটিশান হচ্ছে, টিভিতে জোর প্রোগ্রাম হচ্ছে…

–হোক গে, ওসব লো আইকিউ গেম। পিউ সৌমিকদের জিজ্ঞেস করে দেখিস, আমি জীবনে ওসব খেলায় থাকি না।

হিয়া পাশে বসল, যাই বল, অন্তাকশারিতে কিন্তু মেমারি শার্প হয়।

–আমার মেমারি যথেষ্ট শার্প। তিন বছর বয়সের ইনসিডেন্ট আমি মনে করতে পারি। গান গেয়ে গেয়ে মেমারিতে শান দেওয়ার আমার দরকার হয় না।

–ইশশ, লেখাপড়ায় ভাল বলে তোর দেখছি খুউব ইগো!

ইগো থাকা কি খারাপ? লাইফে শাইন করতে গেলে ইগো মানুষকে কনফিডেন্স দেয়।

সব কটা হাঁসই এখন ভাসছে পুকুরে। স্থির। যেন নোঙর ফেলা নৌকো। অথবা আরও বেশি স্থির। পটে আঁকা ছবির মতো। অবাধ্য হাঁস দুটোও এখন ছবির অংশ। তাদের পৃথক করে চেনা যায় না আর।

পুকুরে চোখ ফেলে ফিক করে হাসল পিয়া। হাসিটুকু ঠোঁটে টিপে বলল, কী খেলা তোর ভাল লাগে রে রাজর্ষি? ডাক চেজিং?

টেটো গোমড়া হয়ে গেল। চোখ সরু করে একবার দেখল হিয়াকে।

হিয়া একটুক্ষণ নিশ্চুপ। হঠাৎ কোমল স্বরে বলল, –এত সুন্দর পাখিগুলোকে তুই মারতে চাইছিলি?

টোটো হালকা গলায় বলল, —ওরকম বজ্জাতদের মারাই উচিত।

তোর কথা না শুনলেই বুঝি বজ্জাত? ওদের নিজেদের কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই?

–আমি অবাধ্যতা পছন্দ করি না।

সুন্দর কিছু দেখলে তোর মায়া হয় না?

এই বয়সে কোনও কথাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া অসম্ভব! টোটো তর্ক জুড়ে দিল, পৃথিবীতে সব সুন্দরই সুন্দর নয়। অনেক আগলি জিনিসও সুন্দর প্যাকেজে মোড়া থাকে।

ফর এগজাম্পল?

–এগজাম্পল তো চোখের সামনেই ঘোরে। কত লোক দেখবি আপাতদৃষ্টিতে দারুণ সোবার, যে দেখে সেই বলে ওরকম আরেকটা ক্যারেকটার হয় না। কিন্তু একটু লোকটার ভেতরে ঢোক, দেখবি লোকটাকে যত ভাল ভাবছিস তত ভাল মোটেই নয়। রাদার কুৎসিত। কিংবা ধর, তুই কাউকে খুব রেসপেক্ট করিস, ভগবানের থেকেও তাকে সুন্দর মনে হয়, সেই লোকটার কোনও নেগেটিভ সাইড যদি তোর চোখের সামনে চলে আসে, তা হলে কি লোকটাকে তোর অত সুন্দর মনে হবে?

হিয়া হাঁটুতে থুতনি রেখে কি যেন ভাবল একটু। তারপর বলল, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ওই হাঁসেদের সম্পর্ক কী?

–নেইও বটে, আবার আছেও। যেসব অ্যানিমাল বেশি সুন্দর, তারা বেশি পাজি। সেবার রাজস্থানে একটা ময়ূরকে ভালবেসে গায়ে হাত বোলাতে গেলাম, অমনি ঠুকরোতে এল! তারপর ধর, সাপ কি দেখতে খারাপ? চিতা বাঘ? রয়েল বেঙ্গল টাইগার? বরং তুলনায় কুচ্ছিত প্রাণীরা অনেক বেশি ভাল। হাতি গণ্ডার হিপোপটেমাস, এরা প্রত্যেকেই অনেক আন্ডারস্ট্যান্ডেবল।

হিয়া হেসে ফেলল, তোর দেখছি সুন্দরের ওপর একটা অ্যালার্জি আছে। সুন্দর দেখলেই তুই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যাস।

–ঠিক তা নয়। বলতে পারিস খুব কনশাস হয়ে যাই।

–হুম, বুঝলাম।

 –কী বুঝলি?

বুঝলাম সেদিন কেন তুই আমার সুন্দর বন্ধুটার সঙ্গে অমন খারাপ ব্যবহার করেছিলি।

 –কোন বন্ধু?

–তিতির।

–ও। টোটো অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

হিয়া বলল, কত উৎসাহ নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে গেল, তুই…! আমি লক্ষ করেছি স্কুলেও তিতিরের সামনাসামনি পড়ে গেলে তুই ওকে ইগনোর করিস। অথচ তোদের মধ্যে নাকি একটা ফ্যামিলি টাই আছে!

টোটো ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছিল। হিয়া কি একটু বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়ছে না?

হিয়া আবার বলল, –তোর বিহেভিয়ারটা কিন্তু ভারি স্ট্রেঞ্জ! তিতির খুব হার্ট হয়েছে সেদিন।

টোটো রাগটাকে চড়তে দিল না। যতই হোক হিয়া আজ তার অতিথি। মুখ অন্য দিকে রেখেই বলল, –তোর বন্ধু তোকে কিছু বলেছে নাকি?

-নাহ। তিতির কারুর কাছেই কিছু বলার মেয়ে নয়। সেই কবে থেকেই তো দেখছি। এত সফট। এত টেন্ডার। আমরা তো পেকে ঝুনো হয়ে গেছি, ও এখনও কী ইনোসেন্ট! একদম বাচ্চাদের মতো।

হুঁহ। বাচ্চা না আরও কিছু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা লোফার মার্কা ছেলের সঙ্গে লাইনবাজি করছিল…! দেবে নাকি হিয়াকে কথাটা বলে? থাক, তা হলে আবার প্রশ্ন উঠবে সেই বা কেন তিতিরের পিছন পিছন বেরিয়ে এসেছিল সেদিন!

কেন বেরিয়ে এসেছিল টোটো? যে মহিলার জন্য টোটোদের বাড়ির সুখ শান্তি বিপন্ন, তার মেয়েকে তো টোটোর অপমান করাই উচিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে মেয়েটার শুকনো মুখ দেখে কেন যে মন খচখচ করে উঠল! মায়া? শৈশবের বন্ধুত্বের স্মৃতি? কীই বা এমন বন্ধুত্ব ছিল! মা চায় না বলে কবে থেকেই তো তিতির বাপ্পার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ছেড়ে দিয়েছে টোটো। ফোন এল তো বাবাকে ডেকে দিল, ব্যস। বাবার সঙ্গে কি সত্যি কোনও অন্য রকম সম্পর্ক আছে তিতিরের মার? বাবাই বা কেন ওদের বাড়ি যাওয়া ছাড়তে পারে না? মা এত ঝগড়া করা সত্ত্বেও? নাকি মা-ই অহেতুক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত? সহজ সরল সম্পর্ককে অকারণে জটিল করে তুলেছে?

টোটো বুঝতে পারে না। টোটোর মার জন্য কষ্ট হয়। বাবার জন্যও। তবে মা বাবার দেখাদেখি টোটোও এখন মুখে নিখুঁত মুখোশ এঁটে নিতে শিখে গেছে। এক হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত টিনএজারের মুখোশ।

মুখোশটা এঁটে নিয়ে হাসল টোটো, ফালতু বকবক ছাড় তো। আমরা কি এখানে শুধু বাড়িতে বসে থাকার জন্য এসেছি নাকি? বেড়াতে বেরোবি না?

গাছতলায় সমবেত হাসির রোল উঠেছে। জোর চেঁচাচ্ছে সৌমিক আর অঞ্জন। ঝগড়া লেগে গেল নাকি! বাকিরা তা হলে হাসে কেন!

সূর্য দূরে বাঁশঝাড়ের মাথায় নেমে এসেছে। দুপুরের বিশ্রাম সেরে আবার পুরো দমে ওড়াউড়ি শুরু করেছে পাখিরা। একটা মৌটুসি পিছনের সজনে ডাল থেকে সমানে পিকপিক ডেকে চলেছে। নরম উত্তুরে বাতাস বইছে একটা। হালকা ভাবে।

টোটো উঠে দাঁড়াল।

.

তুফান বলল, হবে নাকি খেলাটা?

বন্ধুদের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল টোটো, খেললে হয়। এই, তোরা যাবি রাজবাড়ির দিকে?

রাজবাড়ি নিয়ে তুফানের সঙ্গে এক আজব খেলা চলে টোটোর। মাইন্ড মাইনিং। হৃদয় খনন খেলা। ভাঙা রাজবাড়িটাকে নিয়ে ফি বার একটা করে গল্প ফাঁদতে হয় টোটোকে। তুফানকেও। গল্প মানে বাড়িটার একটা ইতিহাস তৈরি করা। কবে কোন রাজা বাড়িটা নির্মাণ করেছিল, রাজপ্রাসাদে যারা থাকত তারা কেমন ধারার মানুষ ছিল, কেনই বা বাড়িটা পরিত্যক্ত পোড়ো হয়ে গেল, কী করে হল, এই সব। তুফান বলে ওই গল্প থেকেই নাকি ধরা পড়ে কথকের মনের চেহারা। টোটোর ফাঁদা কাহিনী শুনে তুফান এক সময়ে বলত টোটোর মনের ভেতর নাকি এক সন্ন্যাসী লুকিয়ে আছে। এখন বলে টোটো খুব হিসেবি, চতুর। তুফানের বার্নানো উপাখ্যান শুনে টোটোর বরাবরই এক মন্তব্য। তুফানকাকা পাগল। তার গল্পের গরু সর্বদাই গাছে চড়ে থাকে। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের দেখা হয়ে যায়। শশাঙ্কর বউ-এর নাম হয়ে যায় বাসবদত্তা। ওই রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ অলিন্দে ঘোরাফেরা ঘরে হর্ষবর্ধন, গোপন গর্ভগৃহে সভা বসে আলাউদ্দিন খিলজির। সামনের সরু খাল যোজনব্যাপী চওড়া নদী হয়ে যায়, সেই নদীতে মগ পর্তুগিজ জলদস্যুদের দেখতে পায় তুফান।

বন্ধুরা জানে এসব। টোটোই গল্প করেছে। কিন্তু ওই খেলায় মোটেই তাদের উৎসাহ নেই আজ। অঞ্জন হিয়া পিউ মন দিয়ে নিরীক্ষণ করছে তুফানের নতুন মোপেড। অঞ্জন বায়নার সুরে বলল, -কাকা, আমি একটু মোপেড চালাব?

তুফান শশব্যস্ত হয়ে উঠল, নিশ্চয়ই। চালাও না।… তুমি পারবে তো?

–খুব পারব। কলকাতায় বাবার স্কুটারটা তো চালাই।

পুলিশ ধরে না? তোমার তো লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়নি!

–সেভাবে কি চালাই? ওই মাঝে মধ্যে একটু-আধটু….

–দেখো, সাবধানে যেয়ো। খোয়া ফেলা রাস্তা….উঁচু-নিচু….

তুফানের কথা শেষ হওয়ার আগেই অঞ্জন মোপেড চালিয়ে বেরিয়ে গেল। হিয়া পিউ তুফানকে ঘিরে ধরেছে, আমরাও চালানো শিখব কাকা।

–ঠিক আছে, হবেখন। তুফানের তামাটে মুখে অনাবিল হাসি, তোমরা একটা কেলেঙ্কারি না বাধিয়ে ছাড়বে না দেখছি।

–কিছু হবে না। আমরা ঠিক শিখে নেব।

–এক বিকেলেই?

–আজ বিকেল আছে। কাল সারা দিন আছে।

 টোটো মনমরা মুখে দূরের ধ্বংসস্তূপটাকে দেখছিল। সৌমিককে বলল, খেললেই পারতিস। দারুণ সাইকোলজিকাল গেম।

ধুস। সৌমিক খানিক তফাতে দাঁড়ানো তুফানকে দেখে নিল। মিচকি হেসে টোটোর কানের কাছে ফিসফিস করল, ওই রকম পোড়ো বাড়িতে বসে কী করতে মজা লাগে বল তো?

কী?

হাতের ইশারায় বোতল দেখাল সৌমিক, এইটা। হেভি জমে।

টোটো সন্দিগ্ধ হল, তুই ওসব এনেছিস নাকি?

সৌমিক চোখ টিপল, –তোর তুফানকাকাকে, ভাগা না। ….ক্যান বিয়ার আছে একটা।….বাবার।….ঝেঁপে এনেছি।

কক্ষনও না। টোটোর গলা চড়ে গেল, তোদের কতবার করে বলেছিলাম না মাধবপুরে এসব চলবে না?

–খেপে গেলি তো? শয়তানি হাসি হেসে টোটোর কাঁধ জড়িয়ে ধরল সৌমিক, –তোর একটুও সেন্স অফ হিউমার নেই। আরে, ঠাট্টা করছি রে।

বাজে ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।

টোটো গুম। সৌমিক সব পারে। গত বছর দার্জিলিং-এ এক্সকারশানে যাওয়ার সময়ে ট্রেনে যা করেছিল! বোতল-ফোতল কিনে….ট্রেনের টয়লেটে বারবার গিয়ে…ভাগ্যিস স্যাররা টের পাননি। টোটোও অবশ্য চুমুক মেরেছিল একটু। তা বলে দাদুর এখানে এসে….!

টোটোর রাগ রইল না বেশিক্ষণ। বন্ধুরা তার অবুঝ নয়। ঠাকুমাকে নিয়ে কোনও অশোভন কৌতূহল দেখায়নি, ঘরে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারেনি, এটাও তো টোটোর বোঝা উচিত।  

অঞ্জন ফিরছে না এখনও। পুরো এলাকা চক্কর মারছে বোধ হয়। তুফানের সঙ্গে শ্মশানের দিকে এগোল টোটোরা। গ্রামে আসার প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেছে বন্ধুদের, মাধবপুরের কিছু দেখেই তারা আর তেমন রোমাঞ্চিত হচ্ছে না। বিখ্যাত শ্মশানটি দেখেও না। শ্মশান ঘিরে যেসব কিংবদন্তি আছে সেসব শুনেও না। একমাত্র হিয়াই সান্ত্বনার মতো টোটোর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখল শিবমন্দির, অশ্বত্থতলা, মড়া পোড়ানোর জায়গা। টোটোর ভাগ্যটাও খারাপ, শ্মশান আজ সাধুবিহীন।

অঞ্জন ফিরল সন্ধে নামিয়ে। হিয়া পিউয়ের আজ মোপেড শেখা হল না।

রাত্রে খেতে বসে শিবসুন্দর জিজ্ঞাসা করলেন, কি, তোমাদের মাধবপুর ভাল লাগছে তো?

 ভেতর বারান্দায় পাত পেড়ে খেতে বসেছে সকলে। সমস্বরে বলে উঠল, ফ্যান্টাসটিক।

–একটু বোধ হয় বেশি বললে। শিবসুন্দর হাসলেন, আমাদের মাধবপুর ফ্যান্টাসটিক লাগার মতো কিছু নয়। এখানে পাহাড় নেই, জঙ্গল নেই, সমুদ্র নেই…

-না না, তা নয়। অঞ্জন ঝটপট বলল, – যে কোনও আউটিংই আমাদের দারুণ লাগে। আমার তো সব দেখা হয়ে গেছে।

–গুড। কাল পারলে রামনগরের দিকে ঘুরে এসো।

–ওদিকে স্পেশাল কিছু আছে?

–পুরনো মন্দির আছে একটা। আর্কিটেকচারটা বেশ ভাল। সাবেকি আটচালা প্যাটার্নের।

-মন্দির-টন্দির আমাদের ভাল লাগবে না দাদু। কাল আমরা এখানেই ঘুরব ফিরব, পুকুরে অনেকক্ষণ ধরে চান করব….

কমলেশ বলে উঠলেন, তোদের দেখে খুব হিংসে হচ্ছে রে। বয়সটা যদি পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর কমিয়ে ফেলতে পারতাম।

টোটো ভুরু নাচাল, কী করতে?

–তোদের মতো একপাল বান্ধবী জুটিয়ে বেড়াতাম।

বান্ধবী তো সঙ্গেই আছে। শিবসুন্দর বললেন।

বান্ধবী! কমলেশ আড়চোখে স্মৃতিকণাকে দেখে নিয়ে ছদ্ম শাস ফেললেন, আপনার বেয়ান বান্ধবী নন, উনি গন্ধমাদন। আমি ওঁকে বয়ে বেড়াই।

স্মৃতিকণা মৃদু ঝামটা দিলেন, গন্ধমাদন কে বইত সেটা খেয়াল আছে?

–আছে বইকি। ভক্ত হনুমান। আমিও তো ভক্ত হনুমানই। বুক চিরে সীতা মায়ের অয়েলপেন্টিংটা দেখিয়ে দেব?

হাসির চোটে সবার বিষম লাগার জোগাড়। শিবসুন্দরও খকখক কাশতে শুরু করেছেন। দু ঢোক জল খেয়ে সামলালেন।

–আপনি পারেনও বটে। কথা বলতে বলতে টোটোর দিকে ফিরলেন শিবসুন্দর, টোটো, তোর দাদাইয়ের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে?

কী ব্যাপারে বলো তো?

–তোর দাদাই দিদুন তো আর মাধবপুরে থাকতে চাইছেন না, তোদের সঙ্গেই চলে যেতে চাইছেন।

–কেন দাদাই, তোমাদের তো কালীপুজোর আগের দিন যাওয়ার কথা!

–না রে ভাই, তোদের সঙ্গে ফিরলে আমার কত সুবিধে। অত বড় একটা লাগেজ ভাগাভাগি করে বওয়া যাবে।

স্মৃতিকণা চোখ পাকালেন, ফের বাজে কথা? না রে টোটো, পুজোয় গিয়ে তোর মাসির বাড়ি একদিনও থাকিনি, ওরা খুব চটে আছে। ওখানে কদিন থেকে, তার বাবার নার্সিংহোম ওপেন হওয়ার পর জলপাইগুড়ি ফিরব। আমাদের সঙ্গে নিয়ে ফিরতে তোদের অসুবিধে হবে?

–কিছু মাত্র না। ইট উইল বি আওয়ার প্লেজার।

খেয়ে উঠে টোটোর বন্ধুদের তারা চেনাচ্ছিলেন কমলেশ। কৃত্তিকা, অভিজিৎ, লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডল, সিকিয়ারস, রোহিণী আরও কত কি।

টোটো তারা চিনছিল না, আকাশ দেখছিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশ ভরে আছে ঘাসফুলে।

 পরদিন সকালে একটা কাণ্ড ঘটে গেল।

টোটোরা দোতলার বড় ঘরে আড্ডা মারছিল, হট্টগোল শুনে নেমে এল নীচে। শিবসুন্দরের চেম্বারে চার পাঁচটা লোক এসেছে, তাদের সঙ্গে জোর বাকবিতণ্ডা চলছে শিবসুন্দরের।

শিবসুন্দর উত্তেজিতভাবে বলছেন, আপনারা ভেবেছেনটা কী? আপনাদের মন্ত্রী আসছে বলে আমাকেও ল্যাঙ ল্যাঙ করে ছুটতে হবে?

একজন মাঝবয়সী লোক প্রতিবাদ করে উঠল, ওভাবে বলছেন কেন ডাক্তারবাবু? আরও তো কত লোককে ডাকা হয়েছে। এটা ঠিক পলিটিকাল মিটিং নয়, লোকাল উন্নতি নিয়ে একটা ফ্রি ডিসকাশান।

–আমাকে উল্টোপাল্টা বোঝাবেন না। ইলেকশানের আগে এসব মিটিংকে কি বলে আমি জানি।

তুফান শিবসুন্দরের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রায় পাহারা দেওয়ার ভঙ্গিতে। সেও বেশ উত্তেজিত, –আপনারা বাবাকে এরকম বারবার উত্যক্ত করছেন কেন? বাবা তো আগেই যাবেন না বলে দিয়েছিলেন।

এক যুবক ধমকে উঠল, আপনি চুপ করুন। যাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে তাঁকেই কথা বলতে দিন।

আলতো ঠেলে তুফানকে সরালেন শিবসুন্দর, আপনারা কী চান বলুন তো? আমি কোনও পার্টির মধ্যেই নেই, থাকবও না, এটা তো আপনারা বুঝেই গেছেন।

পিছন থেকে একজন বলল, আপনি কিন্তু কাল দেবনাথদের বাড়ির মিটিং-এ গেছিলেন ডাক্তারবাবু।

–মিটিংএ যাইনি। দেবনাথের ছেলের জ্বর দেখতে গেছিলাম, তখন ওদের বাড়ি মিটিং চলছিল।

–আমাদের কাছে খবর আছে আপনি মিটিং-এ বসেছিলেন।

–ভুল খবর পেয়েছেন। আমি মিটিং-এর ঘরে বসে প্রেসক্রিপশান লিখছিলাম। শিবসুন্দর বাঁকা হাসলেন, বাই দা বাই, আমি জানতে পারি আপনারা আমাকে কৈফিয়ত তলব করার কে? আমি কি আমার কোনও দরকারে আপনাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি কখনও?

আমাদের প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে কখনও না কখনও দরকার হয় ডাক্তারবাবু। মধ্যবয়সী লোকটির স্বর অতি নীরস।

-ধোপা নাপিত বন্ধ করার ভয় দেখাচ্ছেন নাকি? শিবসুন্দর অট্টহাসি হেসে উঠলেন, ডাক্তারদের সঙ্গে লেগে সুবিধে হয় না। ওয়েল, আপনারা এখন আসুন, আমার পেশেন্টরা বসে আছে। আপনাদের থেকেও ওদের দিকে আমার অ্যাটেনশান দেওয়াটা বেশি জরুরি।

লোকগুলো তবু বেরোয়নি, দাঁড়িয়ে আছে। শিবসুন্দর তাদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে একজন রুগীকে ডাকলেন, কথা বলতে শুরু করলেন তার সঙ্গে। লোকগুলো হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল নিজেদের মধ্যে, তারপর বেরিয়ে গেল।

তুফান মিন মিন করে বলল, এত রেগে যাওয়ার কী দরকার ছিল বাবা? ওরা এখন ঘোঁট পাকাবে…

কমলেশ ঢুকে পড়েছেন চেম্বারে। টোটোরাও।

 কমলেশ উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, মাধবপুরেও এসব শুরু হয়েছে নাকি?

ক্ষণিক উত্তেজনা সামলে নিয়েছেন শিবসুন্দর। স্মিত মুখে বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছেন। এই এরাই আগে কী বিনয়ী ছিল! পাওয়ার করাপ্টস এভরিথিং বেয়াই মশাই।

কমলেশ হাসতে পারলেন না। বললেন, আমি মশাই ভীতু মানুষ। আমি তো বুঝি নীরব থাকাই ভাল। যাবেন বলে দিলেই পারতেন, পরে নয় একটা অজুহাত দেখিয়ে যেতেন না।

নীরবই তো ছিলাম এত দিন। এখন দু পক্ষই বিরক্ত করতে শুরু করেছে। ওই যে দেবনাথের কথা বলে গেল, দেবনাথ নির্ঘাত রটিয়েছে আমি ওদের পার্টিতে জয়েন করছি। এদের সেঁটে দিলাম, এখন আর ওরাও ঘাঁটাতে সাহস পাবে না।

–তবু আমি বলব, চুপ থাকলেই পারতেন। বোবার শত্রু নেই।

–ভুল কথা। নীরবতা ততক্ষণই ভাল যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা সমর্থন বলে না মনে হয়। আপনার রামকৃষ্ণদেবও তো বলেছেন, ছোবল না মারিস, ফোঁস করতে দোষ কী? রুগীর হাতের নাড়ি টিপলেন শিবসুন্দর, কী রে টোটো, তোরাও ওরকম মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা, খেল গিয়ে।

বন্ধুরা দোতলায় ফিরে জোর আলোচনা জুড়েছে। গ্রামেও আজকাল রাজনীতি কেমন প্রবল হয়েছে তাই নিয়ে ঘোর তর্ক। শিবসুন্দরের সাহস দেখেও সকলে অভিভূত।

টোটো ঠিক খুশি হতে পারছিল না। দাদুর জন্য কেমন যেন দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। একটা অসুস্থ মানুষ নিয়ে থাকে দাদু, পাশে তুফানকাকা আর কতটুকুই বা ভরসা?

রাত্রে শিবসুন্দরকে কথাটা বলেই ফেলল টোটো, –তোমার এখানে এসব ঝামেলা হচ্ছে, শুনলে তো বাবা টেনশান শুরু করে দেবে।

শিবসুন্দর হেসে টোটোর মাথায় হাত রাখলেন, –তোর বাবা আমার কথা ভাবে?

–ভাবে বইকি।

–তা হলে বাবাকে এসব বলিস না। চেপে যাস।

–কেন বলব না? নিশ্চয়ই বলব। তুমি এখানে শত্ৰু বাড়াবে….

–আহ টোটো শোন, আমার অ্যাবসেন্সে আমার এগেনস্টে কমপ্লেন করা কি ঠিক? আমি কেস ডিফেন্ডই করতে পারব না।

টোটো এক সেকেন্ড ভেবে বলল, ঠিক আছে, নার্সিংহোম ওপেনিং-এর সময় তো আসছ, তখন তোমার সামনেই বলব।

শিবসুন্দর ধুর্তের মতো হাসলেন, আমি তো তোদের নার্সিংহোম ওপেনিং-এ যাচ্ছি না।

–সে কী কথা। টোটো প্রায় আঁতকে উঠল, বাবা যে ভীষণ দুঃখ পাবে। একটু গিয়ে দাঁড়াবে না?

–কিছু দুঃখ পাবে না। শিবসুন্দর গম্ভীর, –তোর বাবা জানে আমি যাব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *