২৬-৩০. দেখছ কাণ্ডটা

২৬.

দেখছ কাণ্ডটা? ঘরে বাইরে আমার নিন্দা। আমি যেন মহাপাতক। ওর নিষ্ফল ক্ষোভ দেখে মনে মনে হাসে সেকান্দর। মুখে মাস্টারী গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে, শুভ কর্মে ধৈর্য ধর বন্ধু।

নাঃ অসহ্য এই আবহাওয়া। চল বেরিয়ে পড়া যাক আবার, কিছু কাজ তো হবে?

ওরা বেরিয়ে পড়ে। এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম। এ বাজার থেকে সে বাজার। কিন্তু, জাহেদ সরে পড়েছে বলেই বাকুলিয়ার আবহাওয়াটা বদলে যাবে কে বলল ওকে?

যেখানে যেখানে গেল সেখানেও সব কিছু ওর মনোমতো চলছে না। চলল না। ওর সৎ আবেগ ওর সদিচ্ছাটাই সব কিছু নয়। অনেক স্বার্থ অনেক কোন্দল অনেক মনের সংঘর্ষে বিচিত্র জটিল গিঁঠ, সে সব গিঁঠ খোলা শক্ত কাজ, ধৈর্যের কাজ। সে সব স্বার্থ সংঘাতের মীমাংসা হয়ত দুরূহ নয়, কিন্তু কঠিন।

মনটাকে যে একটু হাল্কা আর ঝরঝরে করে আনবে বলে বেরিয়েছিল জাহেদ, সে আর হল না। অনেক জটিল জিজ্ঞাসা যেন এক সাথে মিলে ছেঁকে ধরেছে ওকে। যে বিরাট সমস্যা নিয়ে সদা ব্যাকুল ওর মন, অনেক মানুষের নিত্য দিনের ছোট ছোট অজস্র সব সমস্যা এসে যেন পরাভূত করতে চায় সেই বৃহৎকেই। জীর্ণ ক্লিন্ন ক্ষুদ্র বর্তমানটা যেন আচ্ছন্ন করে দিতে চায় মনের চোখে দেখা উজ্জ্বল বিশাল ভবিষ্যৎকে।

তবু মাইলের পর মাইল হেঁটে, মিটিংয়ে বৈঠকে তর্কের উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে ভালো লাগল ওর।

বাড়ির মানুষগুলোকে যেমন রেখে গেছিল তেমনি রয়েছে ওরা। ওর বিরুদ্ধে নীরব অসহযোগে থমথম ওদের মুখ। সারা দিনেও রাবুর খোঁজ পেল না জাহেদ। কেবলি এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে ওকে। পরিবর্তনের মাঝে শুধু বাঁধাছাদা চলছে। এতটুকু শব্দ নেই, কোলাহল নেই। মনে হয় সবাই মিলে বুঝি কোনো অন্তিম যাত্রায় চলেছে, এ তারই আয়োজন।

দেখছিস মালু? বাড়িটাকে একেবারে কবরখানা বানিয়ে ফেলেছে। সবাই যেন মোর্দা, শুধু গোর দেয়ার বাকী। লা-গা তো একটা গানের জলসা।

আহ্লাদে আটখানা মালু। গানের কথায় ওকে আর পায় কে! এদিক সেদিক ছুটল ও। গনি বয়াতিকে পাওয়া গেল না। মধু গায়েনকে বায়না দিয়ে এল। তালতলির নলিনী সাহা, যন্ত্রের বাজনা বাজায় ভালো তাকেও বলে রাখল মালু। আশেপাশের কোনো কবিয়ালকেই বাদ দিল না ও।

বার মাসে তের পার্বণ, কোন্ যুগে যে সত্যি ছিল কথাটা, বাকুলিয়ার মানুষ জানে না। উৎসবের উপলক্ষে যে কমতি তা নয়, সামর্থ্যের অভাবে উপলক্ষগুলোকে শুধু ছেঁটেই চলেছে ওরা। তাই সৈয়দ বাড়িতে জলসার খবর পেয়ে ওরাও মেতে উঠল।

একটা বড় গোছের চৌকির উপর মঞ্চ বানিয়েছে মালু।

কঞ্চি কেটে কেটে নক্সা বানায় জাহেদ। সেই নক্সার গায়ে গায়ে বুনো লতা বুনো ফুলের অলংকার ঝুলিয়ে সুন্দর করে তুলছে মালুর মঞ্চটা।

জিন্দাবাদ বুঝি আর ভালো লাগছে না?

রাবুর গলা শুনে মাথা তোলে জাহেদ, বলে, এ্যদ্দিনে তা হলে সেধে কথা বললি?

কথাটা বলে সত্যি যেন বেকায়দায় পড়েছে রাবু, মাথাটা নাবিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জাহেদের লতাপাতার অলংকার।

নে হাত লাগা, ওর দিকে কতগুলো নাগকেশর আর কাঁকরল লতা এগিয়ে দেয় জাহেদ।

বাহ্ আমি আর বেকার থাকি কেন? সেকান্দর এসে বসে পড়ে ওদের পাশে।

ওই যে, ওকে একটা কাজ দেখিয়ে দেয় জাহেদ।

বাঁশের ফালিগুলো চাঁছতে চাঁছতে কথাটা পাড়ল সেকান্দর, চলে তো যাচ্ছ, এদিকের ব্যবস্থা কী হবে!

ব্যবস্থা আবার কী। তুমি তো রয়েছই।

উত্তরটা মোটেই মনোমতো হল না সেকান্দরের। ও বলে, এত ঝামেলা একা সামলাব কেমন করে?

কেমন করে বললে তো আর চলবে না এখন। দায়িত্ব নিয়েছ, কাজ চালিয়ে যেতেই হবে।

গজ গজ করে সেকান্দর বলে, আচ্ছা দায় পড়েছে আমার।

এইটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? ওর চোখে চোখ রেখে হঠাৎ শুধাল জাহেদ।

আমার ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিয়ে তুমিই বা সটকে পড়ছ কেন?

সটকে পড়ছি? আহত চোখে তাকায় জাহেদ।

অকস্মাৎ চুপ করে যায় ওরা।

কথায় কথায় কেমন যেন রুক্ষতা এসে গেছে। দুদিকেই মেজাজটা চড়ে গেছে। দিনে দিনে রূঢ়তার সম্মুখীন হয়ে আপন আবেগের সতেজ স্ফূর্তিটা কী হারিয়ে ফেলছে জাহেদ? চমকে উঠে নিজেকেই বুঝি শুধাল ও। সেকান্দরের মুষড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, খামোখাই ঘাবড়াচ্ছ মাস্টার। দুমাস বাদেই তো আমি আসছি আবার। এমনি আসা যাওয়ার মাঝেই থাকব! তবু পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারে না সেকান্দর। ও বোঝে না, ঘরে যার ভর্তি আছে, পুকুরে রয়েছে মাছ সে কেন বিদেশে পড়ে থাকবে। এ নিয়ে বকাঝকিও তো কম হল না জাহেদের সাথে। সেকান্দরের কথাটাকে সেকেল সংকীর্ণতা বলে উড়িয়ে দিয়েছে জাহেদ।

তবু ভালো। সংক্ষেপে বলে কঞ্চি চাঁছায় মন দেয় সেকান্দর।

গলা খাঁকরিয়ে কে যেন আসছে।

ত্রস্তে ঘোমটা টেনে পড়িমরি ছুটে পালায় রাবু। ওর পালানোর পথটির দিকে চেয়ে হেসে দেয় দু বন্ধু।

জমজমাট জলসা বসল।

সারা গ্রামটাই যেন ভেঙে পড়ল।

মালুর ব্যবস্থায়, সাজানোর কায়দায় বাহাদুরি আছে।

শোন, ওকে কাছে ডাকে জাহেদ, তুই খুব বড় রকমের শিল্পী হবি, বলে রাখলাম।

পাশে সেকান্দর মাস্টার। ছাত্রের প্রশংসায় সেও বুঝি খুশি। দুজোড়া খুশি খুশি চোখের নিচে যেন আহ্লাদে গলে যায় মালু। সবাই এসেছে কানকাটা রমজান আর মিঞা বাদে…আরো কেউ বসে আছে কিনা দেখবার জন্য ঘাড়টা উঁচিয়ে তোলে লেকু, কথাটাকে ততক্ষণ ধরে রাখে জিবের ডগায়। হ্যাঁ খতিব সাহেব, কারি সাহেব বাদে, হাফেজ তো দেখি বসে আছে কোণে। কথাটাকে শেষ করে লেকু।

রমজানের নামের সাথে নতুন বিশেষণটা চালু হয়ে গেছে। আর তা নিয়ে বুঝি গবেষণারও অন্ত নেই।

যেই করুক না কেন, নৃশংস বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না এটাকে। কতদিন যে এ সব বর্বর কাজ চলতে থাকবে গ্রামে, আল্লা জানে। হঠাৎ বলল সেকান্দর, লেকুর উপর চোখ রেখে, জাহেদকে উদ্দেশ্য করে লেকুর উপরই বুঝি ওর সন্দেহ।

মুখটা কুঁচকিয়ে অদ্ভুত এক হিংস্রতা ফুটিয়ে তোলে লেকু। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয় সেকান্দর।

হুরমতির ছেঁকাটাও কম নৃশংসতা নয়। আস্তে করে বলে জাহেদ। তা হলে হুরমতির কাণ্ড? বিজলীর মতো ওর মনের উপর দিয়ে দৌড়ে গেল সন্দেহটা। আর আশ্চর্য হল সেকান্দর, হুরমতির দিকেই ওর মনের সমর্থন।

তালতলির নলিনীর বাজনা দিয়ে শুরু হয় আসর। বাজনা শেষে একের পর এক প্রাচীন কিসসার বয়ান অথবা যাত্রার ঢংয়ে অভিনয়। লায়লী মজনু। ইয়ুসুফ জোলেখা। লখিন্দর বেহুলা সবারই জানা কিস্সা। তবু তন্ময় হয়ে শোনে ওরা। চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। কাঁদে। একটু বাদেই হাসে।

এই কান্না আর হাসির মাঝে নিজেদের জরাজীর্ণ জীবনটার কথা ক্ষণিকের জন্য একেবারেই ভুলে যায় ওরা। মঞ্চের নায়কনায়িকাদের জন্য উদ্বিগ্ন হয় ওদের মন, অধীর উৎকণ্ঠায় প্রতীক্ষা করে অপ্রত্যাশিত কোনো শুভ আর সুন্দর সমাপ্তির। এ মন বুঝি শুধু ওদের নয়, এ মন সর্বকালের দর্শকের মন।

লম্বা কাহিনী ধরেছে মধু গায়েন। তুর পাহাড়ে মুসা নবীর জ্যোতি দর্শনের সেই অতি প্রাচীন কাহিনী। বয়ানের বাহাদুরিতে লোকগুলোকে বুঝি সেই আদ্যিকালের তুর পাহাড়ে টেনে নিয়ে যায় মধু গায়েন।

আর এই লোকগুলোকেই বুঝি হ্যাঁচকা টানে একবারে আজকের দিনটায় নিয়ে এল মালু-বাকুলিয়ার মালু বয়াতি। এখন ওটাই তার বহুল পরিচিতি।

ভীরু ভীরু লজ্জা মাখানো হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মালু। মাথায় ওর রঙিন গামছা। পিরানের উপর প্যাঁচিয়ে আর একটি গামছায় কোমরটাকে বেশ শক্ত আর চিকন করে বেঁধে নিয়েছে মালু। এক পাশে গোল হয়ে বসেছে দোহারের দল। নাচের ঢংয়ে একটু কুঁজো হয়ে কোমর বেঁকিয়ে চটপটি ফাটার মতো দু আঙ্গুলের আওয়াজ তোলে মালু। প্রত্যুত্তরে তালি বাজিয়ে কাঁসার থালায় তাল ঠুকে, দোতারাটা কাঁপিয়ে সাড়া দেয় দোহারের দল। ধুয়ো ধরে ওরা! মাগো দাও চরণ, মাগো দাও চরণ।

মাটিই বুঝি মা। মায়ের বন্দনা গেয়ে শুরু হয় বয়াতির গান। বাকুলিয়ার গান। বাকুলিয়ার ইতিহাস নিয়ে গান বানিয়েছে মালু। বড়দের মুখেই ও শুনেছে কাহিনীটা। সেই শোনা কাহিনী শব্দে গেঁথেছে নিজের মতো করে।

বাকুলিয়ার বড় মিঞা
ও সে মস্ত মরদ
মাগো তোমার লাইগা হইছে কয়েদ
ও সে মস্ত মরদ

আরে মিটিং হইল, ওয়াজ হইল কত নসিয়ত
কাইন্দা কাইন্দা মিঞা কহে
দীন গেল দেশ গেল, গেল খেলাফত
 গোলামীর জিঞ্জিরে কানছে যে মোর ভারত
হায় গেল সে খেলাফত
কানদে যে মোর ভারত
 দাও চরণ, মাগো দাও চরণ।

এংরাজের পেয়াদা আইল, দারোগা আইল
আইল কত লাঠি বরকন্দাজ
তফাত রহো নাসারা ফেরেব্বাজ
বাঘের সনে মিঞা হাঁকিল
আরে সে হুংকারে দুনিয়া কাঁপিল
মাগো দুনিয়া কাঁপিল।

হাওদা উঠিল, পাগড়ি বান্ধিল
মস্ত মরদ সোয়ার হইল।
সোনার চাঁন ঘরে থুইয়া
আহা দালান কোঠা সোনা দানা
হাতের ময়লা ফেলিয়া
মিঞা চলিল।
কী হইল, কী হইল?
মিঞা গেল জেয়লে।
মাগো দাও চরণ।
হায়রে গেল সব
তালুকমুলুক রবরোয়াব
লাঠে চড়ে জমিদারী
হাতি ঘোড়ার সানদারী
কাইন্দা কাইন্দা ঘরের বিবি অন্দ যে হয়,
তবু মিঞার মন গলে না, আহা মন গলে না।
মিঞা কহে, কওমের তরে দিল যে বাইন্ধেছি
জান দিব তো মান দিব না,
আহা জান দিবে তো মান দিবে না।

আরে জেয়াল খানায় সোনার দেহ কালা হইল
দুষ্ট ব্যারামে কলিজার খুন খাইল
জেয়ল থেইকা গাজী আইসা
শহীদ যে হয়
আর সতীনারী স্বামীর সনে আখেরাতে
চইলে যে যায়।
আহা চইলে যে যায়।

অধম মালেকে কয়
দেশের লাইগা
কোরবান যে হয়
সে তো মরে না
গোর আজাবে তারে ধরে না
আহা সে যে বাঁইচা রয়
সাত সুরুজে তাহারই বন্দনা গায়।
আহা সে তো মরে না।
দাও চরণ মাগো দাও চরণ।

গানটা শেষ করেই মালু টিপ করে পায়ের ধুলো নিল ওর মাস্টার আর জাহেদের। হাত ধরে যে ওকে ঠেকাবে সেই অবসরটুকুও পেল না ওরা। কদমবুচি সেরে ততক্ষণে মঞ্চে ফিরে গেছে মালু। দোসরা পালাটা ধরেছে।

হায় হায় এই কী কপাল
মিঞা সৈয়দ দেশ ছাড়িল এই কী কপাল।
কলিকালের খেলা আর কত দেখবি বল
সেই যে মিঞা ছিল গাজী হইল শহীদ
তার পোলারা দেশ যে ছাইড়া
নাসারা কমিনার নফর সাজিছে
হায় মিঞা-সৈয়দ দেশ ছাড়িছে।

আরে দিনে-দিনে কী হইল
রমজান আলী সুদ খাইল
খুলিল হারামের কারবার,
সাজে আল্লা পরস্ত ইমানদার
হায় এই কী কপাল।

হুরমতিরে ছেঁকা দিল
করে না কেহ ন্যায্য বিচার,
কারি পড়ে তোবা সোবানাল্লা
খতিব বলে দোররা লাগাও বিছমিল্লা।
আহা করে না কেহ ন্যায্য বিচার
হায় এই কী কপাল।

আরে মিঞার ব্যাটা মিঞা,
সে কিনা গেরামের মা বাপ,
হার্মাদ সেজে খাজনা দেয় না মাপ
নোটিশ পাইয়া গাঁয়ের চাষা গোনে পরমাদ
কসির হইল দেশান্তরী লেকু হয় যে বরবাদ
আরে মিঞা বড় হার্মাদ
তবে আরও শোন কালের কথা
ষাইটি বছরের ভণ্ড পীর
খায়েস চাপে কুমারী নারীর
কিন্তুক মিয়ার নাতি যারে বলো পেয়ারা জাহেদ।
ও সে কিলকনি আর গুঁতা দিয়া মিটায় পীরের সাধ
হায় এই কী কপাল।

গানটা শেষ করতে পারে না মালু। চিকের ওপারে মেয়েদের মহলে কী যেন চেঁচামেচি। তারপর চাপা উত্তেজনার উদ্বিগ্ন স্বর।

আম্বরি মূৰ্ছা গেছে। কেন, কী ব্যাপার, সে প্রশ্ন সবার মুখে, কিন্তু জবাব দেবে কে? সবাই হুড়মুড়ি খেয়ে ছুটছে আম্বরির দিকে।

জলসা ভেঙে যায়।

হুরমতি আর লেকু আম্বরিকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে যায়।

তৃতীয় দিন তালা পড়ল সৈয়দ বাড়ির বড় দালানে।

চতুর্থ দিন মারা গেল আম্বরি। ওর কাঠির মতো শীর্ণ মৃত দেহটাকে গ্রামের কবরখানায় গোর দিয়ে দিন দুই গুম হয়ে কাটায় লেকু। তার পর মেয়ে ভুনিকে কোনো জ্ঞাতি বাড়িতে রেখে নিরুদ্দেশ হল।

২৭.

দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল।

কোথা থেকে কোথায় ছিটকে পড়ল মালু।

এক একটি বছর যায় আর ওকে যেন একূল থেকে ওকূলে আছড়ে ফেলে যায়। ও যেন ওই বড় খালে ভেসে যাওয়া ছিন্নমূল কোনো গাছের শাখা। এ পার থেকে সে পার, এ নদী ছেড়ে অন্য নদী, শুধু ভেসেই চলেছে। আজব এই দুনিয়াটা। এ দুনিয়ার কেরামতির বুঝি শেষ নেই।

প্রথম তিনটে বছর ভালোই কাটল মালুর। স্কুল আর লেখাপড়া। আপন মনে যখন খুশি গান গাওয়া।

তিনটে ক্লাসেই ভালো নম্বর পেয়ে পাস করল মালু। আর তাতে ওর চেয়ে মাস্টার সাহেবেরই যেন বেশি খুশি। ওর কাঁধে উৎসাহের হাত রেখে বলল, গত বছরটা বড় গোলমালে গেল। সুলতানের দিকে, তোর দিকে মোটেই নজর দেওয়া যায়নি। এবার থেকে রোজ রাত্রে আমার বাড়ি এসে পড়ে যাবি, কেমন?

কিন্তু নতুন বছরেই সাঙ্গ হল মালুর লেখাপড়ার পর্ব।

আসল কথায় আসবার আগে একটা ভনিতা পাড়ল রমজান : খোশ হও আর বেজার হও, হক কথাটাই বলব। আমি বলি খাও, কিছু করে খাও। মুন্‌শীজীর কথা বাদ দিলাম, তিনি আল্লাবিল্লা করছেন, সে হল নেক কাম, খোদার কাম, আমাদের সকলের কাম। কিন্তু তোমরা?

রমজানের কুঁতকুঁতে চোখে কোন্ অভিসন্ধি? বই বন্ধ করে ওর দিকে তাকায় মালু।

জনপ্রতি যদি আধসেরও ধরি তা হলে দৈনিক একসের করে চাল লাগছে তোমাদের মায়ে-পুতে। তার মানে মাসে তিরিশ বত্রিশ সের, বছরে পাক্কা নয় মণ পাঁচ সের। তেলটা নুনটা না হয় মুনশীজীর মাসোহারা থেকেই গেল। কিন্তু….

এর পর কী বলবে রমজান? রুদ্ধশ্বাসে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে মালু। অবশ্য হুকুমটা মুনিবের। আমি শুধু জানিয়ে দিচ্ছি। তোমরা মায়ে-পুতে এসে খাও মিঞা বাড়ি। তুমি বিবি সাহেবার একটু যাকে বলে খেদমত করবে। আর মালু গরু বাতানটা দেখবে, ফাই-ফরমাশটা খাটবে।

রমজানের কথাটা শেষ না হতেই কেমন ভাঙা গলায় বলে উঠল মালুর মা, মালুর ইস্কুল?

ইস্কুল? যেন আকাশ থেকে পড়ল রমজান। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল : ধাড়ী হয়ে গেছে ছেলে, এখন আবার স্কুল কী গো? কামে লাগিয়ে দাও। কামে লাগিয়ে দাও। তা ছাড়া মায়ে-পুতে কী বসে খাবে তোমরা?

 চুপ করে যায় মালুর মা। যেন গভীর মনোযোগে হাতের আঙ্গুলের মরে যাওয়া চামড়াগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে চলেছেন তিনি। বুঝি দ্রুততর হয় মুন্‌শীজীর তসবি পড়া। শেষবার হজ্জের সময় মক্কা শরীফ থেকে কিনে আনা তসবির পাথরের গোটাগুলো দ্রুত শব্দ তুলে চলেছে ঠক ঠক ঠক।

হাল ছাড়ল না মালুর মা। বলল, সেকান্দর মাস্টার বলে মালু নাকি পড়াশোনায় ভালো।

হো হো হো। হেসে কূল পায় না রমজান। বলে, হাসালে মালুর মা, হাসালে। বলি গরিবের আবার লেখাপড়া কী? লায়েক হয়েছে ছেলে, এখন খাটবে, কাম করবে, রোজগার করবে।… লেখাপড়া কী? হা হা হা।

আরও দ্রুততর হয় মুনশীজীর তসবির শব্দ, ঠক ঠক ঠক।

পরের সম্পত্তি। একটা কুটোও যদি না-হক খরচ হয়, তবে বান্দার কাছে না হলেও আল্লার কাছে তো আমাদের জবাব দিতে হবে? আসলে কর্তব্য আর ঈমানের খাতিরেই যে কাজটা করতে হচ্ছে, এবার সেটাই বুঝিয়ে দেয় রমজান।

হঠাৎ ওর নজর পড়ে মালুর দিকে। চিৎকার করে ওঠে : দেখেছ? দেখেছ? কেমন ঘাড় তেড়া করে তাকাচ্ছে? দাঁড়া, ঘাড় তোর আমি সিদা করে ছাড়ব।

বেরিয়ে যায় মালু।

সেই যে বেরিয়ে এল, বাকুলিয়ায় আর ফেরা হল না ওর। যেমন ছিল গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরনে, তেমনিই বেরিয়ে এসেছে। জামা নেই গায়ে, সঙ্গে নেই বই খাতা। তবু কেন যেন স্কুলের পথটাই ধরল মালু।

সৈয়দ বাড়িতে হক নেই ওদের। ওরা পরাশ্রিত। বসে বসে অন্যের অন্ন ধ্বংস করে চলেছে। এখন কাজ করে খেতে হবে। আর কাজটা কিনা ফেলু মিঞার গাবুর হওয়া? মনের ভেতরটা বুঝি তোলপাড় খেয়ে যায় ওর। সহসা কী এক দুরন্ত ইচ্ছে জাগে ওর মনে এমন কিছু করতে, এমন কোথাও যেতে যা ওকে চিরদিনের জন্য ভুলিয়ে দিবে কানকাটা রমজানের মুখ, ফেলু মিঞার মুখ, ওই সৈয়দ বাড়ি, ওই বাকুলিয়া। সেই দুরন্ত ইচ্ছেটা যেন টগবগিয়ে উঠল ওর শরীরের ভেতর, ওর ধমনীর রক্তে। জোরে জোরে পা ফেলল মালু, দ্রুত পথ কাটল। গা-টা গরম হয়ে ঘাম ঝরাল।

কলকাতা গেলে কী হয়? ধাঁ করে মনে এল কথাটা। কত লোকই তো যায় সেখানে! কামাই রোজগার করে জেব ভর্তি টাকা আর বোঁচকা ভর্তি রকমারি জিনিস নিয়ে ফিরে আসে গ্রামে। তা ছাড়া কোলকাতা যাওয়াটা তো অনেক দিনের সাধ মালুর। সেই যখন থেকে যাব যাব করছে সৈয়দরা তখন থেকে।

সেদিন কী যে খারাপ লেগেছিল মালুর! না মেজো ভাই, না রাবু আপা, একবার সাধল না ওকে, বলল না একবার চল, তুইও চল আমাদের সাথে। শহরে গিয়ে কাজের লোক কী লাগবে না ওদের, রাবুর বা আরিফার? রাবুর কাজগুলো মালুর মতো সুন্দর আর নিখুঁতভাবে অন্য কেউ করতে পারবে না, এটা হলফ করেই বলতে পারে মালু।

সেদিন কী এক চোট খেয়ে মালুর বুকটা যেন চৌচির হয়েছিল। মেজো ভাইদের ট্রেনে তুলে দিয়ে সোজা বাড়িতে ফিরে আসতে পারেনি ও। সেই বুড়ো তেঁতুল গাছটার তলায় বসে চুপি চুপি অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল মালু।

কিগো নতুন বয়াতি? এমন হনহনিয়ে যাও কই?

মুখ তুলে চেয়ে দেখে মালু সমুখেই গনি বয়াতি। সেই জাহেদের মিটিং গুলোতে মালুর গান শোনার পর থেকে ওকে নতুন বয়াতি বলেই ডাকে গনি বয়াতি। তোমার বাড়িই যাচ্ছিলাম, বলল গনি বয়াতি।

কেন? শুধাল মালু আর মনে মনে বলল, ভাগ্যিস পথেই দেখা হয়ে গেল, নিজের বাড়ি বলে কিছু নেই ওর, এ কথাটা না-জানুক গনি বয়াতি।

লাঙ্গল-কোট থেকে একটা বায়না এসেছে। বড় বায়না। ভাবলাম তুমি যদি যাও তবে আমার দলটা বড়…। ইতস্তত করে গনি বয়াতি। ওর হয়ত সন্দেহ, রাজি হবে না মালু।

বেশ, আমি রাজি।

খুশি হয়ে উঠে গনি বয়াতি, বলে কালই যেতে হবে ভাই।

 চলুন, আমি এখুনি যাব আপনার সাথে।

চোখ বড় বড় করে গনি বয়াতি, মালুর স্বরটা স্বাভাবিক নয়। অভিজ্ঞতা দিয়েই জানে গনি বয়াতি, বয়াতিদের ঘোর আসে, সাধন ভজনে মগ্ন পীর আওলিয়াদের যেমন যযবা, বয়াতিদের তেমনি ঘোর। এই ঘোরের সময় ওরা মাতোয়ারা, দুনিয়াদারীটা তখন ভুলে যায় ওরা। চলে যায় অন্য কোনো দুনিয়ায়। মালুর কী সে রকম ঘোরের সময় চলছে?

কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে পথ ভাঙে ওরা।

এক বছর।

দু বছর।

আরও এক বছর প্রায় ধরে ধরে।

গনি বয়াতির দলে নেচে নেচে গান গেয়ে বছরগুলো কেটে যায়। আমির হামজা, সোনাবানের পুরনো কিসসা আজকের মতো করে সাজায় মালু। অভিনয় করে নিজে। নতুন নতুন গান বাঁধে। নতুন নতুন ছড়া বানায়। গনি বয়াতির নামের সীমা নেই। সুবাদ তার এক গাঁ, দু গাঁ এক মৌজা দু মৌজা নয়, শহর ছাড়িয়ে, জিলা ছাড়িয়ে তার নাম-ডাক। সেই গনি বয়াতির সাথে শহর বন্দর গ্রাম, কত জায়গায়ই না ঘুরে বেড়াল মালু।

আর কত হাততালি পেল, কত পেলা কুড়াল।

লোকের মুখে বাহবার অন্ত নেই। সাবাস গনি বয়াতি। যোগ্য সাগরেদ বানিয়েছে বটে। ওস্তাদকেও ছাড়িয়ে যাবে এই ছেলে।

এ এক আজব দুনিয়া। ছোটবেলা থেকে যে বাড়িটায় মানুষ মালু তার সাথে এর অনেক তফাত। এ দুনিয়াটার ঢং, এর বোল আচার নীতি সবই যেন অন্য রকমের। ভালো লেগে যায় মালুর। বাকুলিয়ার কথা মনে পড়ে। কিন্তু যাবার জন্য মনে কোনো সাড়া জাগে না। আর কোলকাতা? দরকার কী তার কোলকাতায় গিয়ে? অমন যে মেজো ভাই, সে-ই যখন সঙ্গে নিল না তখন কলকাতার ধূলোই মাড়াবে না মালু। এক রকম স্থির করে ফেলল ও।

মালু আসার পর থেকে গনি বয়াতির দলটা আরো ফেঁপে উঠল। কত বায়না ফেরত দিতে হয়। কত ডাক শুনেও না শোনার ভান করতে হয়। আর দেখতে না দেখতেই মালু হয়ে দাঁড়াল দলের প্রধান গায়েন।

ঠিক এমনি সময় কেমন যেন বদলে গেল গনি বয়াতির ব্যবহারটা। তামাক সাজাতে বলে গনি বয়াতি। আপত্তি করে না মালু। ওস্তাদের তামাক সাজানোতে অগৌরবের কিছু নেই। হুঁকো বদলাতেও বলে গনি বয়াতি। ভালো না লাগলেও পুরনো পানি ফেলে দিয়ে হুঁকোয় নতুন পানি ভরে দেয়। নলটাও সাফ করে দেয়। ওস্তাদের হুকুম না করতে নেই। ওস্তাদের খেদমতে বিদ্যা আসে, ছোটবেলা থেকেই তো এ কথাটা শুনে আসছে মালু। কিন্তু দিনে দিনে গনি বয়াতির হুকুমের মাত্রাটা বেড়েই চলল। বাড়িতে অথবা বাইরে দল নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায়, গনি বয়াতি যেন ওর জন্য নিত্য নতুন ফরমাশ তৈরি করে চলে। যে কাজের জন্য লোকের অভাব নেই সে কাজটাও মালুকে দিয়েই করাবে, এ বুঝি একটা জিদ হয়ে দাঁড়াল গনি বয়াতির।

তাজ্জব বনে যায় মালু। কেন ওকে সবার সুমুখে ছোট করতে চায়, হেয় করতে চায় গনি বয়াতি? তবে কী ওর নামে কামে ঈর্ষাতুর হয়েছে গনি বয়াতি? দলের ভিতর ওর জনপ্রিয়তা, ওর প্রভাবটা সইতে পারছে না গনি বয়াতি? তাই যদি হবে, তবে ওকে সোজা বিদেয় না দিয়ে অমন বাঁকা পথ নিচ্ছে কেন গনি বয়াতি? মনে মনে কোনো সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয় মালু।

ঝমঝমিয়ে বর্ষা নাবল। নাবল তো নাবলই, থামবার নাম গন্ধ নেই। সে কী বৃষ্টি! গোটা আসমান যেন পানির ঝর্না হয়ে ঝরে পড়ছে, যেন এ ঝরার কখনো শেষ হবে না।

বেরোবার উপায় নেই। বায়েনাদারেরও দেখা নেই। এই বাদলায় কোন্ পাগল জলসা বসাবে। দলের কাজ-কর্ম এক রকম বন্ধ।

গনি বয়াতির বাড়ির বাইরে ছোট একটা ছনের ঘর। সেখানেই বরাবর থেকে আসছে মালু। কবে যে ছন বদলিয়েছিল ঘরটার তার কোনো হিসেব নেই। অন্তত গত তিন বছর যে চালে হাত পড়েনি সেটা তো চোখেই দেখল মালু। ফলে এবারকার বর্ষায় হুড় হুড় করে পানি পড়ছে চালের বড় বড় ফুটো দিয়ে।

এরি মাঝে দু একদিন ফর্সা গেল। মালু বলল, বয়াতি ভাই, চালে নতুন ছানি দাও, নইলে যে মরলাম।

আচ্ছা, বলে চুপ মেরে যায় গনি বয়াতি।

দ্বিতীয় দিনও বলল মালু। সেদিনও ওই আচ্ছা।

বাড়িতে ছন আছে মজুদ। আয়ও তো কম করেনি ওরা গত তিন বছরে। তবু কেন যে এত বখিলিপনা গনি বয়াতির, বুঝতে পারে না মালু। এই ঘোর বর্ষাতেও মেজাজটা তেতে আগুন হয়।

আর একদিন।

সারা সকাল লক্ষ কোটি ঘড়ার মুখ দিয়ে গলগলিয়ে পানি পড়ল, এমনি বৃষ্টির তোড়। হঠাৎ দুপুরের দিকে আকাশটা ফর্সা হয়ে থেমে গেল বৃষ্টিটা। মালু আর গনি বয়াতি দুটো টুল বের করে বসল ওদের বড় ঘরের দাওয়ায়। দে-তো মালু একটু তামাক সাজিয়ে দে, বলল গনি বয়াতি।

আমি তো চাকর নই কারো। এ সব কাম হবে না আমাকে দিয়ে। বেজাহানের মতো কথাটা বলে ফেলল মালু।

বুঝি ভিরমি খেতে খেতে রক্ষা পায় গনি বয়াতি, বলে, আচ্ছা বদদেমাকী ছোকরা তো তুই! এই যে এতটা দিন কাজকর্ম বন্ধ তবু পায়ের উপর পা তুলে দিব্যি খাচ্ছিস আর ঘুমুচ্ছিস। আর একটু তামাক সাজাতে বললাম বলে জাত গেল তোর?

খাওয়ার কথা তোলায় আরো চটে গেল মালু : তা তোমারটা তো খাচ্ছি না। কাজ করেছি, আয় করেছি। সে আয় তো সবই তোমার হাতে, হাত খরচের জন্যও কোনোদিন চেয়েছি একটি পয়সা?

কথাটা এত সত্য যে চট করে মুখ খুলতে বুঝি শরম লাগে গনি বয়াতির। মালুকে এতটা চটানোর হয়ত ইচ্ছেও ছিল না ওর। তবু সত্য কথাটা কার ভালো লাগে? গনি বয়াতিরও ভালো লাগল না।

কিন্তু এই মুহূর্তেই তো উঠে গেছে মালুর মনটা। গনি বয়াতিও ধান চালের হিসেব করল! আর একটা দিনও যদি মালুকে থাকতে হয় গনি বয়াতির বাড়ি তবে সে বুঝি দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে।

আস্সালামুআলাইকুম। উঠে দাঁড়াল মালু। বেরিয়ে এল।

বিমূঢ়ের মতো শুধু চেয়ে থাকল গনি বয়াতি।

কী আশ্চর্য। ওর বেরোবার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল আবহাওয়াটা। ও বের হল, বৃষ্টি আর নাবল না।

দ্বিতীয়বার পথে ভাসল মালু।

কিন্তু, কোথায় যাবে মালু।

সেদিন অপ্রত্যাশিত ভাবেই গনি বয়াতির আশ্রয়টা পেয়ে গেছিল। আজ কোথায় আশ্রয় পাবে?

আকাশ পাতাল ভাবে মালু। যতই রাগ জমুক গনি বয়াতির উপর, তার কাছে কৃতজ্ঞ মালু। তার ওস্তাদি, তার বাহাদুরি সবই সে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে মালুকে। কিন্তু অমন দরাজ যার গলা সে লোকের মনটা কেমন করে অত ছোট হয়?

ভাবতে ভাবতে পথ চলে মালু। উদরাজপুরের হাটে রাত কাটায়। আবার চলে।

কিন্তু, এ কী? হাঁটতে হাঁটতে ও যে তালতলির কাছাকাছি এসে পড়েছে। আর এ কী হয়েছে অঞ্চলটার চেহারা? এ কোন্ দেশ? সুলতানপুর, চাটখিল, এ তো ওর সেই চেনা জানা গ্রাম নয়?

যুদ্ধ লেগেছে, সে খবরটা রাখে মালু। দল নিয়ে এ গাঁ সে গাঁও ঘুরতে ফিরতে যুদ্ধের দু চারটা আলামত যে চোখে পড়েনি ওর তেমন নয়। আসলে যেখানে ডেরা ফেলেছে গোরারা যেখানে ঘাঁটি বসেছে যুদ্ধের সে সব অঞ্চলগুলো ওরা এড়িয়ে চলেছে। কেননা যুদ্ধ শব্দটাই ওদের কাছে বিভীষিকা আর গোরা সৈনিক মূর্তিমান আতঙ্ক।

সুলতানপুর চাটখিলকে বেড় দিয়ে যে রাস্তাটা তালতলিতে গিয়ে পড়েছে সে রাস্তায় পা রেখেই মালু যেন অকস্মাৎ যুদ্ধটার মুখোমুখি দাঁড়াল।

গ্রামের পর গ্রাম নিঃশব্দ নিঝঝুম। বাড়ি ঘরগুলো যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে, জনপ্রাণীর সাড়া নেই কোথাও। একদা তকতকে উঠানগুলোতে শ্যাওলা জমেছে, আগাছার জঙ্গল গজিয়েছে। নৈঃশব্দের পীড়নটা সইতে না পেরে গাছের পাখিরাও বুঝি পালিয়ে গেছে কোনো দূরদেশে।

গোটা অঞ্চলটা সমর দফতরের দখলে। বেসামরিক অধিবাসীদের তুলে দেয়া হয়েছে। যে যেখানে পেরেছে উঠে গেছে ওরা।

রাস্তাটার পূর্ব দিকের চেহারা অন্য রকম। লম্বা লম্বা ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝে ছাড়া ছাড়া বাড়ি। বাসিন্দাদের সরিয়ে সে সব বাড়িতে সৈনিকের ছাউনী পড়েছে। ক্ষেতময় তাঁবুর সারি। দূরে উঁচু ট্রাঙ্ক রোড। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় লরী আর সাঁজোয়া গাড়ির অবিরাম মিছিল চলেছে ট্রাঙ্ক রোড ধরে।

তালতলি এখনো হুকুম দখলের নোটিশ থেকে বেঁচে রয়েছে। যে কোনো দিন যমদূতের মতো এসে যেতে পারে পরোয়ানাটা। তাই প্রায় অর্ধেক গ্রামই ফাঁকা। কিন্তু মানুষের ভিড়ে, বেচাকেনার হৈ হট্টগোলে গম গম তালতলির বাজার। তিন বছর আগে ফেলে যাওয়া সেই বাজারটাকে চট করে চিনে উঠতে পারে না মালু। আড়ে লম্বায় বেড়ে গেছে তার সীমানা আর কত যে ঘর, ছোট ছোট চায়ের দোকান, মনিহারি, বড় বড় গুদাম। তালতলি আর বাজার নয়, যুদ্ধের বাজারে ফেঁপে ওঠা এক বন্দর।

সে বন্দরে মালু যেন এক আগন্তুক। কেউ ওকে চেনে না। সেও চেনে না কাউকে। রজনী ময়রার মিষ্টান্ন ভাণ্ডারটি উঠে গেছে। সেখানে এখন চায়ের স্টল। চা বিস্কুটের প্রতিযোগিতায় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বুঝি হার মেনে পাততাড়ি গুটিয়েছে।

পা-টা টনটন করছে মালুর। হাঁটা যায় না আর। রামদয়ালের বৈঠকখানার মাঠটা পেরিয়ে দীঘির পাড়ে উঠে এল মালু। সেই তালগাছগুলো কোন্ আদ্যিকাল থেকে যেমন দাঁড়িয়ে আছে সজাগ প্রহরীর মতো, তেমনি রয়েছে। তালগাছের পিঠে হেলান দিয়ে বসল মালু। দৃষ্টিটাকে পাঠিয়ে দিল বাকুলিয়ার মানুষের প্রিয় সেই দখিন ক্ষেতের দিকে।

কী এক হল্কা এসে বুঝি ঝলসে দিয়ে যায় মালুর চোখ জোড়া। ধূ ধূ রিক্ততায় যেন হাহাকার তুলছে দখিনের ক্ষেত। এক কণা শস্য নেই। এতটুকু সবুজের চিহ্ন নেই। ওপারে বাকুলিয়া, হলুদ শাড়ির সবুজ পাড়ের মতো তার সবুজ রেখা। বড় খাল বরাবর সময়ের প্রয়োজনে নতুন এক রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাঙ্ক রোডে গিয়ে মিশেছে রাস্তাটা।

মালু যাচ্ছে কোথায়? রিক্ততার হাহাকার ভরা দখিন ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে সে কথাটাই যেন আবার মনে পড়ল মালুর।

তালগাছের একটা ডাল কিসের যেন ঝাঁকনি খেয়ে মড় মড় শব্দে কেঁপে উঠল। চোখ উঁচিয়ে দেখল মালু একটা শকুন উড়ে চলে যাচ্ছে। তার পাখার ঝাপটায় বাবুই পাখির বাসাগুলো ঝড়ের দোলা খেল, একটি বাসা খসে পড়ল মালুর সুমুখে।

হাতে নিয়ে দেখল মালু, বাবুই দম্পতির যুগল চেষ্টায় কী চমৎকার সৃষ্টি। কুটো ছোবলা আর খড়ের নিখুঁত ঘন বিন্যাসে সুন্দর এক কারুকর্ম। খড়কুটো দিয়ে অমন সুন্দর জিনিস মানুষও বুঝি বানাতে পারবে না। কেন যেন বাসাটা নিজের গাঁটরিতে ভরে রাখল মালু।

রানুদি ডাকে।

নামটা শুনেই ধড়ফড়িয়ে উঠল মালু। সুমুখে দাঁড়িয়ে রানুদের বাড়ির চাকরটা।

রানুদি মনে রেখেছে ওকে? না দেখার দূরত্বে অচেনা হয়ে যায়নি মালু? কিন্তু রানুদি ওকে দেখল কখন? বিস্ময়ের চোখে আরও কত কী যেন জিজ্ঞেস করল মালু।

মালুর প্রশ্নগুলো বুঝি আন্দাজ করেই বলল ছেলেটি : দীঘির পাড়ে যখন উঠে আসছ তুমি, আমরা দেখে ফেললাম।

গাঁটরিটা বগলে নিয়ে ওর পিছু পিছু পরিচিত দালানটায় উঠে আসে মালু। রানুদি! অস্ফুটে যেন উচ্চারণ করল মালু। ঢিপ করে একটা প্রণাম রেখে দিল রানুর পায়ের পাতায়।

ষাট ষাট, হয়েছে। আস্তে করে ওর হাত ধরে পাশের চেয়ারটায় ওকে বসিয়ে দিল রানু।

অবাক মানে মালু। রানুর চেয়েও বিঘত খানিক উঁচিয়ে গেছে ও। আর আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে রানুদি। শরৎ রোদের মতো মিষ্টি উজ্জ্বল রানুর মুখ। সে মুখের দিকে এক পলক চেয়েই বুঝল মালু ওকে দেখে সত্যি খুশি হয়েছে রানু।

কিন্তু হঠাৎ কেন যেন গম্ভীর হয়ে গেল রানু, বলল, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?

এ প্রশ্নের আবার কোনো জবাব হয়? কী বলবে মালু!

রানুর গাম্ভীর্যটা কিসের যেন পূর্বাভাস। গম্ভীর মুখখানি তার কী এক করুণায়, কী এক মমতায় কাতর হয়ে আসে, চোখ জোড়া ভরে যায় পানিতে। ধীরে ধীরে বলল রানু, মালু, তুই বড় অভাগা। এত অল্প বয়সে বাবা মাকে হারালি?

রানুর চোখের কোণে দু ফোঁটা জল কেঁপে কেঁপে ঝরে গেল।

আর কিছু বলল না রানু।

মালুও জিজ্ঞেস করল না কিছু।

কী-ই বা জিজ্ঞেস করার আছে মালুর। বাবা মার যেটুকু অস্তিত্ব ওর জীবনে সত্য সে হল বাল্যের আর কৈশোরের কতগুলো তিক্ততা যা কোনোদিন ভুলবে না ও। এ ছাড়া তাঁদের উপস্থিতি বা অভাবটা কখনো অনুভূত হয়নি ওর জীবনে। বাবা মাকে বাদ দিয়েই যেন শুরু হয়েছিল ওর জীবন। ওদের ছাড়াই সে বেঁচেছে, বেড়েছে, বাঁচবেও। বুঝি তাই রানুর মুখে অকস্মাৎ সংবাদটা শুনে দুঃসংবাদ বলে মনে হয় না ওর, দুঃখের বা শোকের কাতরতা জাগে না মনে। ওরা যদি বেঁচেও থাকত মালু কী তাদের কাছে ফিরে যেতে পারতো?

ওর মুখে কোনো ভাবান্তর লক্ষ না করে রানুও বুঝি কম অবাক হয় না। এখনি কী করবি? অনেকক্ষণ পর শুধাল রানু।

এ প্রশ্ন নিয়েই তো ভাবছে মালু। কিন্তু জবাব যে এখনো খুঁজে পাচ্ছে না ও।

নিজেই যেন একটা উত্তর খুঁজে পেল রানু : পড়বি? নিজের চেষ্টায় আজকাল কত ছেলে পড়াশোনা করছে, মানুষ হচ্ছে!

বলা তো খুব সোজা। থাকব কোথায়? খাব কী?

কী যেন ভাবল রানু। শুধাল–কাজ করবি?

হ্যাঁ।

বেশ, খুড়োর দোকানে দিনের বেলায় কাজ করবি! রাতে মাস্টার সাহেবের কাছে পড়বি। কথাটা বলে রানু আর একটুও সময় দিল না ওকে। স্নানের তাড়া দিল। খাবার তাড়া দিল। নিজেই খুলে ফেলল ওর গাঁটরিটা। অবাক হল : এটা আবার কী?

দেখতেই তো পাচ্ছ বাবুই পাখির বাসা। ওর একটা গোপন জিনিস অন্যায়ভাবে রানু দেখে ফেলেছে বলে রুষ্ট হল মালু।

তুই কী ভাবিস, এখনো সেই বাচ্চা ছেলেটি রয়েছিস? বাবুই পাখির বাসাটা ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দেয় রানু।

২৮.

মাসিক সাত টাকা বেতন।

রামদয়ালের মনিহারি দোকানটায় বহাল হয়ে গেল মালু। খাওয়া দাওয়া আর জামা কাপড়ের খরচ দোকানের। নিরাশ্রয়ের পক্ষে খুশি হবার মতোই ব্যবস্থা। কিন্তু, মালুর খুশিটা বুঝি অন্য কারণে।

রানুর খুড়তুতো ভাই অশোক। থাকে কোলকাতায়। জাপানী বোমার আতঙ্কে আর মাথার উপর হরদম উঁচিয়ে থাকা খড়গের মতো হুকুম দখলের ভয়ে গ্রামকে গ্রাম যখন বিরানা হতে চলেছে, সেই সময়টিতে কেন যেন গ্রামে বেড়াবার শখ জেগেছে অশোকের। সারাদিন টো টো করে, কিন্তু সকাল আর বিকেল বেলাটায় তার বাঁধা কাজ। সকালে ও গান শেখায় মেয়েদের আর বিকালে ছেলেদের। অশোককে কেন্দ্র করে তালতলির প্রায় মরে যাওয়া ক্লাবটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সকাল বিকেল ছোট ছোট ছেলে মেয়ের বিচিত্র কণ্ঠ আর যন্ত্রের নানা রকম স্বর-নিক্কণে মুখর থাকে ক্লাব-ঘর।

মালুর চোখে অশোক এক পরম বিস্ময়। নিষ্প্রাণ তার, জড় যন্ত্র, কেমন বোকার মতো সব পড়ে থাকে ক্লাবের শতরঞ্জির উপর, অথচ অশোকের সামান্য একটা আঙ্গুলের ছোঁয়ায় কী বিচিত্র সুরে কথা কয়ে ওঠে। যে মানুষের স্পর্শ পেয়ে অমন নিষ্প্রাণ বস্তুগুলোও জেগে ওঠে, রিনরিনিয়ে বেজে ওঠে, না জানি কী মহামন্ত্র সে মানুষের আয়ত্তে।

সে যন্ত্রের ঝংকারে, বাদ্যের তালে গান ধরে অশোক, উঠতি পড়তি গলার বিচিত্র স্বরে, সুরের গমকে এ এক নতুন ধরনের গান। এ গান কখনো শোনেনি মালু। বাদ্য ঝংকারে অনুপম মিতালির সে গান যখন ভেসে আসে মনটা মালুর আনচান করে। অস্থির হয়, দোকানের কাজ ফেলে ও ছুটে আসে ক্লাব ঘরটার দিকে।

বলি বলি করেও বলা হয় না মালুর কথাটা। ঘুর ঘুর করে, প্রতিদিন সন্ধ্যায়। কিন্তু ক্লাবের ভেতরে যাবার সাহসটা কিছুতেই সঞ্চয় করতে পারে না মালু। শেষে মরিয়া হয়ে কথাটা বলেই ফেলল মালু, আশোকদা, আমায় বাজনা শেখাবেন?

কেমন মানুষ অশোক! মালুর দিকে একবার তাকাল না, ওর কথাটা কানে তুলল কিনা তাও বোঝা গেল না। শুধু বলল, বেশ আয়। পিছে পিছই এল মালু।

হারমোনিয়মে সা-রে-গা-মা-র প্রথম পাঠ ওকে লাগিয়ে দিল অশোক।

বারে আমি তো বাজনা শিখতে চাই, বলল মালু।

আরে পাগল! সারেগামাটা আগে ধরতে শেখ তো, তারপর বাজনার তালবোল নিজেই ধরতে শিখবি।

অশোকের বিরাটত্বে এতদিন মুগ্ধ ছিল মালু। আজ বুঝি ধন্য আর কৃতার্থ হল ওর স্নেহের ছোঁয়ায়।

সারেগামার গন্ টানতে টানতে দুর্বোধ্য যন্ত্রগুলোর দিকে বুভুক্ষুর মতো চেয়ে থাকে মালু। কবে, কবে ও ছুঁতে পারবে ওই যন্ত্রের বিস্ময়কে! কবে ওর আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে কথা কয়ে উঠবে ওরা যেমন ঝংকার দিয়ে ওঠে অশোকের অঙ্গুলি স্পর্শ? কবে ওর মনের সুরটা যন্ত্রের ধ্বনিতে ছড়িয়ে পড়বে মানুষের কানে, বাতাসে বাতাসে?

এতদিন আপন মনে যেমন খুশি গেয়ে এসেছে মালু। গনি বয়াতির কাছে শুধু কয়েকটি পালা আর গানই শিখেছে মালু। কিন্তু গানের যে কত বিধিবদ্ধ নিয়ম, রাগ রাগিণীর শৃঙ্খলা, তালবেলের কত কলাকৌশল, অশোকের কাছে এই প্রথম সে কথাটা শুনল মালু।

অদ্ভুত তোর গলার খাঁজ, বাজনার সাথে চমৎকার খুলবে রে! অশোকের প্রশংসায় দশহাত ফুলে ওঠে মালুর বুকটা।

কিন্তু জানিস, সুরের সাধনা বড় কঠিন, দীর্ঘ সাধনার ধন এই সঙ্গীত।

সাধনা? বুঝতে না পেরে শুধায় মালু।

মানে লেগে থাকতে হবে আর কী! জোঁকের মতো আঁকড়ে থাকবি, ছাড়বি না।

অশোকের কথায় কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায় মালুর।

তালিম দেয়া গলা নয় ওর। কসরত করতে হয়নি ওকে সুরের জন্য। বেগ পেতে হয়নি কথার জন্য। ওই পাখির ডাক, দোল-খাওয়া পাতার শন শন ঝরে পড়া পাতার মর্মর থেকেই বুঝি ধ্বনির অলক্ষ চেতনা পেয়েছে ও। বড় খালের কুল কুল তরঙ্গ, বাতাসের মন্দ্র-গুঞ্জন, এ সবই তো ওর সুরের উপাদান, সেখান থেকেই এসেছে ওর সুর। তাই সুরটা ওর স্বভাব, সুরের প্রকাশটা সহজ এক অভিব্যক্তি ওর কাছে। সে সুর নিয়ে মাথা ঘামিয়ে হয়রান হতে হবে, এ সব কথা ওর কাছে একেবারেই নতুন।

অবিচল নিষ্ঠায় বছরের পর বছর অক্লান্ত সাধনা। ধৈর্য আর তিতিক্ষা। তবেই পাওয়া যায় সার্থক শিল্পীর গৌরব, বুঝলি?

অশোক যেন একটা প্রত্যাশা নিয়ে তাকায় মালুর দিকে।

ঘাড় নাড়ে মালু। যেন খুব বুঝেছে ও।

.

বুঝুক না বুঝুক অশোকের সব কথাই মন দিয়ে শোনে ও। ভালো লাগে শুনতে। প্রথমটায় যেমন ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছিল অশোক, ধীরে ধীরে সে অবস্থাটার পরিবর্তন হয়। অনেক কিছুই যেন স্পষ্ট হচ্ছে, বুদ্ধির নাগালে ধরতে পারছে মালু।

সারেগামার পাঠ সারতে দেরি লাগল না মালুর। তবলা সারেঙ্গী সেতার এসরাজ, একে একে যন্ত্রগুলো ওকে চিনিয়ে দেয় অশোক। মালু হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেই বিস্ময়কর জড়পদার্থগুলো যার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানুষের মনের সুর হৃদয়ের কথা।

টংকার খাওয়া সেতারের তারটির মতোই যেন কেঁপে কেঁপে যায় মালুর দেহের তন্ত্ৰীগুলো। এ যেন অজানা পৃথিবীর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আশা দুরাশার ঘন আন্দোলনে বেহুঁশ হওয়া। জ্ঞানীর গুণির ধ্যানীর জগৎ শুধু গান নয়, শুধু সুর নয়–সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ ধ্বনি তরঙ্গের লয় প্রলয়, কোমল বিন্যাস–সে যে সঙ্গীতের জগৎ, সাধনার জগৎ, সেখানে মালু বয়াতির স্থান হবে কী?

যত্ন করেই ওকে শেখায় অশোক।

অশোকদা খুব ভালো। অশোকদা খুব চমৎকার। মনে মনে উচ্চারণ করে মালু।

কিন্তু সব ভালো কাজেই যেন শুধু বাধা আর বিপত্তি।

আবার গান নিয়ে মেতেছিস? পড়বি বলে না কথা দিয়েছিলি আমায়? চোখ মুখ লাল করে ধমকায় রানু।

আহা পড়ার সময়টা কী চলে যাচ্ছে নাকি? কিন্তু অশোকদা চলে গেলে এ সব নতুন ধরনের গান বাজনা শিখবে কোথায় মালু।

মালুর, যুক্তিতে মন গলে না রানুর। বলে, বেশ গান নিয়েই থাক, আমি খুড়োকে বলে দিচ্ছি চাকরির আর দরকার নেই তোমার।

রেগে মেগে ওকে তুমি বলতে শুরু করে দিয়েছে রানু।

কেঁদে দেয় মালু।

গলে যায় রানুর মনটা। হেসে দেয়, বলে, কত বড় হয়েছিস, খেয়াল আছে?

আয়নায় চেহারাটা একবার দেখিস। এ্যাদ্দিনে অন্তত ম্যাট্রিকটা তোর পাস করে ফেলা উচিত।

রানুর হাত থেকে রেহাই পেল মালু। কিন্তু রামদয়ালের মতো বাধাটা ডিঙ্গিয়ে যাবার শক্তি কোথায় মালুর।

যুদ্ধ লাগার পর থেকেই মনোহারি দোকানটার দায়িত্ব ভাইপো রমেশের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে রামদয়াল। সাবেক দোকানটার সীমানা থেকে পুরো তালতলি বাজারের আধেকটা জুড়ে লম্বা তিনটি গুদাম ঘর, মাঝারি গোছের চারখানি দোকান ঘর। সেই প্রাচীন মনোহারি দোকানটার সাথে যুক্ত হয়েছে এগুলো। চালডাল সুপুরির আড়তদারি, কন্ট্রোলের তেল চিনি কাপড়ের ডিলারি, কত রকমের কারবার রামদয়ালের। যুদ্ধের বাজারে ফেঁপে উঠেছে রামদয়ালের ব্যবসা। এক এক গুদাম, এক এক দোকান পৃথক পৃথক আত্মীয়-কর্মচারীর জিম্মায়, কিন্তু সবটার উপর রামদয়ালের তীক্ষ্ণ নজর। দোকান আর গুদামগুলোর ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একখানি ঘর। সেখানে বসে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে রামদয়াল। এ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে রোজ রোজ দোকান পালানো কঠিন।

অবশ্য মালু যে ভাবে যায় তাকে আর যাই বলা হোক, পালানো বলা চলে না। প্রথমত রমেশের অনুমতি নেয় ও। দ্বিতীয়ত যে সময়টিতে যায় মালু ওটা দোকান বন্ধ হবার সময়। বড়জোর পনেরো বিশ মিনিট আগে চলে যায় ও। একমাত্র ব্যতিক্রম সপ্তাহের দুটো হাটবার। সে সময়ে তো রাত বারটা কখনো একটা পর্যন্তও খোলা থাকে দোকান। হাটবারে সকাল বেলায় গিয়ে কিছুক্ষণ গলা সেধে আসে মালু। এ ব্যবস্থাই হয়েছে অশোকের সাথে।

কিন্তু, বিশ মিনিটই হোক আর দশ মিনিটই হোক, দোকান খুলতে দেরি করা অথবা আগে ভাগে বন্ধ করা, রামদয়াল তা সইবে কেন? ওকে কী এই জন্য মাইনে দিচ্ছে রামদয়াল?

 দু একদিন কানআড়ি শুনেছেও মালু। রমেশকে জিজ্ঞেস করছে রাম-দয়াল : এই রমেশ ওই নেড়ের বাচ্চাটা আগে আগে কোথায় বেরিয়ে যায় রে? অমন চটপটে, বি. এ .পাস গুণীলোক অশোক, তারই বড় ভাই রমেশ। কিন্তু হলে কী হবে, বুদ্ধিতে একেবারে নিরেট বলে কলকাতার ব্যবসায় কোথাও স্থান হয়নি তার। তাই এই গ্রামের দোকানটায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। কোথায় একটু ছিপিয়ে ছুপিয়ে বলবে, তা নয়, একেবারে সোজাই বলে ফেলল, কেন ওই ক্লাবে?

ওতো গান শেখে অশোকের কাছে।

কাকে বলে যায় ও? গম্ভীর কৈফিয়ত তলবের স্বর রামদয়ালের।

আমাকে বলে। আমি তো ছুটি দিয়ে দিই ওকে। সরল মনে সত্য কথাটাই বলে রমেশ।

গর্জে উঠেছিল রামদয়াল। তারপর ভাইপোর উদ্দেশে কী কী সব শ্রাব্য অশ্রাব্য উক্তি করেছিল রামদয়াল, সে সব শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি মালু।

কিন্তু তক্ষুনি তক্ষুনি মালুর তলব পড়েনি। তার পরদিন অথবা পরের সপ্তাহেও না। হয়তো ভুলেই গেছে রামদয়াল। আর মাটির মানুষ রমেশদা, সে তো কিছুই বলে না মালুকে।

মালুর সাহসটা যায় বেড়ে।

রমেশদা যাই? বলে একটু আগে ভাগেই বেরিয়ে পড়ে মালু।

কথায় বলে সাতদিন চোরের, একদিন গেরস্তের।

দোকান থেকে বেরিয়ে সবে মোড়টা নিয়েছে মালু সুমুখে রামদয়াল। এদিকে আয়, দোকান ঘরে ঢুকে ওকে ডাক দেয় রামদয়াল।

অপরাধীর মতো এসে দাঁড়াল মালু।

এটা চাকরি, দোকানের কাম, মামা বাড়ি নয়। বলতে বলতে মালুর গালে ঠাস ঠাস কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয় রামদয়াল। অতর্কিত আক্রমণে বুঝি হকচকিয়ে যায় মালু, পেছন সরে পরিস্থিতিটা বুঝবার আগেই একটা কেরোসিন টিনের গায়ে পা লেগে পড়ে যায় ও।

ব্যাটা, ভাব তুমি, কিসসু নজরে পড়ে না আমার? বেরিয়ে যায় রামদয়াল। উঠে দাঁড়াল মালু। কী এক দুরন্ত উত্তাপে টগবগিয়ে উঠতে চায় মালুর তরুণ রক্ত। হাতটা মুঠো করে ও। অনুভব করে, আর যেন এই প্রথম অনুভব করে, শক্তি আছে, বিপুল শক্তি ওর দেহে।

না। রানুদির জ্যাঠা মশাইকে মেরে, রানুদিকে মুখ দেখাবে কেমন করে মালু? মুঠো ওর শিথিল হয়ে আসে। ধীরে ধীরে ক্লাবের দিকেই চলে যায় ও।

প্যাঁ পুঁ করাই সার হল। সুর সাধনা আজ জমল না। ভয় লেগেছে মালুর আজকের ঘটনার পর চাকরি নিশ্চয় থাকবে না ওর। তা হলে? তা হলে অশোকদার সযত্ন শিক্ষকতায় গান শেখার ইতি হবে এখানেই?

আগাগোড়া শুনে হেসেই খুন রানুদি। বলে, তুই একটা বোকা। আরে যুদ্ধের বাজারে লোক ওরা পাবে কোথায় যে তোকে জবাব দেবে?

সত্যি তাই। সকালে যথারীতি দোকান খুলল মালু। রমেশ বা রামদয়াল কেউ মুখটা পর্যন্ত খুলল না, যেন কিছুই হয়নি।

শুধু একটা নতুন নিয়ম চালু করল রামদয়াল। ওই দোকান ঘরেই ঘুমুতে হবে মালুকে। এতদিন ওর ঘুমুবার জায়গাটা ছিল অন্যত্র।

সঙ্গে সঙ্গেই রাজি মালু; কিন্তু যখন আপনি ক্যাশ বন্ধ করে ফিরবেন তখন আমাকেও বন্ধ করে যাবেন।

অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। দোকান বন্ধ হয় সন্ধ্যার পর পর। মালু কী তখন থেকেই তালাবদ্ধ হয়ে থাকবে নাকি? না তা করতে পারে না রামদয়াল।

 রামদয়ালের দুষ্ট চালটা ব্যর্থ গেল। দিব্যি গানটা সেরে শুতে আসে মালু। রাত তখন কখনো বারটা, কখনো আরো বেশি। রামদয়াল তখনো সরকার মশায়কে নিয়ে হিসেবে মিলাচ্ছে।

২৯.

কী কাল যুদ্ধ!

আর কী সর্বনেশে!

সব কিছু লণ্ডভণ্ড, তছনছ করে দিয়ে গেল। যেন লক্ষ কোটি শকুনি পাখা বিস্তার করেছে আকাশে। যে আলোয় আলোকিত থাকত পৃথিবী সে আলোটা আড়ালে পড়েছে। পৃথিবীময় শকুনি পাখার অন্ধকার ছায়া। শকুনির হিংস্র কুটিল দৃষ্টি আগুন ঝরিয়ে চলেছে, সে আগুনে মাটি পুড়ছে। মানুষ, জানোয়ার, পৃথিবীর সভ্যতা, পৃথিবীর সবুজ, পুড়ে খাক হচ্ছে। শকুনির জিহ্বা বেয়ে টপটপ বিষ ঝরছে। সে বিষ মাটিতে মিশে মানুষের গায়ে লেগে ছড়িয়ে চলেছে রোগ মহামারী দুর্ভিক্ষ।

সেকান্দর মাস্টারের স্বপ্নটাও ছিনিয়ে নিয়েছে এই সর্বনেশে যুদ্ধ। সব ছারখার হয়ে গেল রে মালু। সব ছারখার হয়ে গেল। কেমন শুকনো ম্লান মুখে বলে সেকান্দর মাস্টার।

শত দুর্যোগ, শত অনটনের মাঝেও যে স্বপ্নটিকে ও শুকতারার মতো জ্বালিয়ে রেখেছিল চোখের সুমুখে যুদ্ধের শুরুতেই সেই স্বপ্নের কবর খুঁড়ে চলে গেছে সুলতান। পড়াশোনার দরকার নেই তার। টাকা কামাবে সে, তাই কামাইয়ের জন্য যুদ্ধের হাটে নেবে পড়েছে ও।

জীবনের অপূর্ণ যত ছোট ভাইটির সার্থকতার মাঝে পূর্ণ করবে বলে এত যে তার আয়োজন সবই ব্যর্থ করে দিয়ে গেল সুলতান। বুকটা বুঝি ভেঙে পড়েছিল সেকান্দর মাস্টারের। নিমিষের জন্য সমস্ত শ্রম সমস্ত উদ্যোগ আর তিল তিল ত্যাগ সবই যেন অর্থহীন মনে হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ মানুষের লক্ষ দুঃখ ওর একার দুঃখটাকে যে কখন ভাসিয়ে নিয়ে গেল টেরই পেল না সেকান্দর।

এমনিতেই কাজ কী তার কম? জাহেদের চাপিয়ে দেওয়া সেই দায়িত্ব, স্কুলের কাজ, ডানে বাঁয়ে তাকাবারও সময় দেয়নি ওকে। তার উপর যুদ্ধ বিশৃঙ্খল জীবনের হাজার ফরিয়াদ, লক্ষ অনাচার, একটি প্রতিকার; ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি, নিজের বলতে সব কিছুই যেন চাপা পড়ে গেছে এত কিছুর মাঝে।

মাস্টারের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন কান্না পায় মালুর। তিনটি বছরের প্রতিটি দিন, এক হাজার পঁচানব্বইটি দিনের প্রতিটি ঘণ্টা আর মিনিট অসংখ্য চিন্তা দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার রেখার দাগে যেন এক একটি করে ছাপ ফেলে গেছে তার মুখে। অকাল বার্ধক্যের চিহ্ন সেকান্দর মাস্টারের মুখে, মাঝ কপাল বরাবর এক পোঁচ সাদা চুল। তিনটি বছর এমন নির্দয় স্বাক্ষর রেখে যেতে পারে কোনো মুখে–মাস্টার সাহেবকে না দেখলে কোনো দিনই বিশ্বাস করত না মালু।

কিন্তু মাস্টার সাহেব, যে ভাবে ছুটোছুটি করছেন আপনি তো মরে যাবেন। বলিস কিরে? মরে যাব? মালুর কথাটা কেড়ে নেয় সেকান্দর মাস্টার। বলে, চোখে যদি দেখতিস কাণ্ডকারখানা তবে বলিতিস না এ কথা। সুলতানপুর চাটখিল গোটা মৌজাটার উপর নোটিশ পড়ল, তিনদিনে খালি করতে হবে। কমসে কম হাজার কুড়ি মানুষ তো হবেই, তিন দিনে বাড়ি ঘর খালি করবে কেমন করে? আমি তো ভাবলাম এই হুড়োহুড়ি টানা-টানির চোটে আধেক লোকই বুঝি সোজা বেহেশতের দিকে রওনা দিবে। বলে কয়ে গোরা সাহেবটার কাছে থেকে আর একটা দিন বাড়িয়ে নিলাম। গরু, বাছুর, কাঁতা, বালিশ, খোরা, শানকি, সব নিয়ে যে যেদিকে পারল চলে গেল। গুনে দেখি, ও মা, মরল মোটে গণ্ডা দেড়েক মানুষ আর এক জোড়া বুড়ো বলদ।

বলে কেমন ম্লান করে হাসে সেকান্দর। মালুর মনে হয় সে হাসিটা কান্নারই আর এক রূপ। তারপর সেকান্দর মাস্টার জুড়ে দেয় শেষ বাক্যটা : এখন বুঝলি তো, মরা কত কঠিন? মরাটা যেমন সহজ তেমনি কঠিনও।

অপলক চেয়ে থাকে মালু। ওর আবাল্য শ্রদ্ধার মানুষ মাস্টার সাহেব। আজ আবার তার পায়ের ধূলো নিল মালু।

থাক থাক। বুঝি বিব্ৰত হয় সেকান্দর মাস্টার।

হঠাৎ অমন নাটকীয় ভাবে কদমবুচি করার কী ঘটল বুঝতে পারে না সেকান্দর! হাত দুটো ধরে মালুর ঝুঁকে থাকা কাঁধটা উঠিয়ে আনে ও। যেন গভীর মনোযোগে চেয়ে থাকে মালুর মুখের দিকে। ছলছলিয়ে ওঠে ওর চোখজোড়া, বলে : বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিস রে! বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিস তুই। শেষ দেখাটা তুইও দেখলি না, ওঁরাও দেখলেন না। সে দুঃখটাই সব সময় আমার মনে বাজে।

বুঝি অতীতের সেই দুঃখ দিনটিই ভেসে উঠেছে মাস্টারের মনের পর্দায়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সজাগ ছিলেন মুন্‌শীজী। পরিষ্কার নিখুঁত কেরাত ধরে দোওয়া পড়েছেন আর শুধু তোর কথা জিজ্ঞেস করেছেন। গরু খোঁজার মতো খুঁজলাম তোকে। হয়তো খবর পেলাম অমুক বাজারে আছিস, গিয়ে দেখি, কোথায় কী? থামল সেকান্দর। ছাতাটাকে কোলের উপর তুলে শুইয়ে রাখল। বলল আবার : তিনটি মাস যেতে না যেতেই তোর আম্মাও অসুখে পড়লেন। সে অসুখই তাঁর শেষ অসুখ। আমার কী মনে হয় জানিস? ওদের কাছে শেষ জীবনের ওই পরিহাসটার চেয়েও বড় ছিল তোকে হারানোর শোক। শোকেই … হঠাৎ সেকান্দরের নজরে পড়ে, মালু শুনছে না ওর কথাগুলো। হাতে একটা ন্যাকড়া প্যাঁচিয়ে চাটাই ঘষছে মালু। ঘষে ঘষে ময়লা তুলছে। যখনি দেখা হয়েছে মাস্টারের সাথে প্রসঙ্গটা অনিবার্যভাবেই এসে পড়েছে। আর নির্বাক অন্যমনস্কতায় আপনাকে সরিয়ে নিয়েছে মালু। মাস্টার সাহেবের সমবেদনা এতটুকু দাগ কাটে না ওর মনে। ভারি হয় না মনটা।

অমন যে মালু, একটুতেই জলে ভরে আসত যার চোখ, সেই মালু অনেক সাধ্য সাধনা করেও ঝরাতে পারে না এক ফোঁটা অশ্রু। রানুদির, মাস্টার সাহেব, ওদের সমবেদনার জবাবে সামান্য একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের খাতিরেও না। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন কঠিন হয়ে আসে ও। চোখজোড়া যায় শুকিয়ে। আর সেই শুকনো চোখের গর্ত থেকে কী এক জ্বালা উঠে আসে। সে জ্বালায় কপালের শিরা আর মাথার ঝিল্লিগুলো দপদপিয়ে ওঠে, সারা দেহে আগুন ছড়ায়।

যেন কলঙ্কের ভারে নুয়ে ছিল ওর পিঠটা, ছোট ছিল ওর মুখটা। আব্বা আম্মা মরে গিয়ে সে ভার থেকে মুক্ত করেছে ওকে। সিদা হয়ে আজ দাঁড়াতে পারবে ও, মুখ বড় করে কথা বলতে পারবে। কেন এমন মনে হয় মালুর?

দুঃখ সওয়া, দুঃখ নেওয়া খুব বড় জিনিস রে মালু, খুব বড় জিনিস, দুঃখের আগুনে যে না পুড়েছে সে চিনতে পারে না, জানতে পারে না এই দুনিয়াটাকে। ভুল করে ওকে সান্ত্বনা দেয় সেকান্দর মাস্টার।

চোখ তুলে তাকায় মালু। ঘরে ঘরে যুদ্ধের সর্বনাশ ডাকা এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটার সান্ত্বনা, সহিষ্ণুতা আর আশার প্রতীক সেকান্দর মাস্টার। কিন্তু তাকে কি সান্ত্বনা দেবার আছে কেউ? অথবা, আত্মবোধটাকে একেবারেই বিসর্জন দিয়েছে সেকান্দর মাস্টার, তাই নিজের জন্য সান্ত্বনার প্রয়োজন হয় না তার।

উঠি এখন। শিমুল পাড়াটা একেবারেই পুড়িয়ে দিয়েছে গোরাগুলো। যাচ্ছি সেখানে রিলিফ নিয়ে। কাল নাও ফিরতে পারি।

ছাতাটা বগলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সেকান্দর মাস্টার। কী যেন মনে পড়ে যাওয়ায় আবার বসে পড়ে।

ওহ্ হো ভুলেই গেছিলাম, জাহেদ লিখেছে যেমন করে হোক তোকে খুঁজে বের করতে আর তোর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে। বুক পকেট থেকে খামটা বের করে মালুর হাতে দেয় সেকান্দর। আর রাশু খবর পাঠিয়েছে ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে, তুই যেন একবার বেড়িয়ে আসিস।

তা হলে মেজো ভাই ভোলেনি ওকে? চিঠিটার উপর চোখ বুলিয়ে কী এক আনন্দে নেচে ওঠে ওর মনটা। কিন্তু রাশু! অবাক মানে মালু। রাশুর মুখটা সত্যিই ভুলে গেছে ও।

চল, আমার বাড়িতেই থাকবি তুই। দোকানের কাজ ছেড়ে দে। চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে পুরে বলল সেকান্দর।

ধপ করে যেন পড়ে গেল আনন্দে নেচে ওঠা সেই মনটা। কী আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল মালু : না না মাস্টার সাহেব, বাকুলিয়ায় যাবার কথা বলবেন না আমায়, সে আমি পারব না, কোনোদিন না।

তুই, তুইও একথা বললি? এখনো হুকুম দখলের নোটিশ পড়েনি। কিন্তু, জানিস এরি মাঝে আদ্ধেক গ্রাম খালি? শূন্য ভিটিগুলো দেখে মনে হয় খোলা বুকে মাতম করছে না ওরা, ওরা অভিশাপ দিচ্ছে, অভিশাপ। ধিক্কার দিচ্ছে তোকে, আমাকে, সবাইকে, সমগ্র মানবজাতিকে। মাটির অভিশাপ। আমি তাকাতে পারি না। চোখ বুজে হাঁটি।

রেগে গেছে সেকান্দর। রাগটাকে সামাল দিতে দিতে বেরিয়ে যায় ও। নিথর নির্বাক মালু। চেয়ে থাকে মাস্টারের ছেড়ে যাওয়া টিনের চেয়ারখানার দিকে।

অসাবধানে বলে ফেলেছে মালু, কিন্তু সে তো ওর মনেরই কথা। কেমন করে ও ফিরে যাবে বাকুলিয়ায়? রাবু, আরিফা, জাহেদ, যাদের কেন্দ্র করে ওর বাকুলিয়ার শৈশব, বাকুলিয়ার আনন্দ, ওরা তো কেউ আপন নয় ওর। সে সব দিন, সে সব আনন্দ পরাভূতের গ্লানি, উচ্ছিষ্টভোজীর অনধিকার। সে আনন্দের স্মৃতি আজ শুধুই দুর্বার। সে স্মৃতি আজ বেদনা দেয়, কী এক অপমানের জ্বালা ছিটিয়ে দেয় সর্বাঙ্গে। ওর এই মনের কথাটা কী বুঝবে না মাস্টার সাহেব?

মাস্টার সাহেবের সেই বেদনা-পীড়িত ক্ষুব্ধ মুখের ছবিটাই বার বার ভেসে ওঠে মালুর চোখের সুমুখে। আর ছোট বেলার সে সব স্মৃতি যা যন্ত্রণা হয়েই জাগে, সেই স্মৃতিরা কী এক টানে পেছনে নিয়ে যায় ওকে।

মাটিরও কী অভিশাপ আছে? হয়তো আছে। সেই মাটির অভিশাপটা বুঝি মিশে আছে মালুর রক্তে। আর ওর আম্মার অভিশাপ? সে তো এখনো পিছু তাড়া করে চলেছে ওকে।

ছিঃ মালুর মা। অমন করে কহর দেয় না ছেলেকে। মায়ের কহর বড় কঠিন, লেগে যায়। সৈয়দগিন্নীর সেই তিরস্কারটাও মনে পড়ে মালুর।

তার চেয়েও আশ্চর্য, মিঞা সৈয়দ গ্রাম ছেড়েছে বলে ধিক্কার দিয়ে গান বেঁধেছিল মালু। গোটা গ্রামের মানুষকে শুনিয়েছে সে গান। সেই মালুর কাছে বাকুলিয়া আজ কলঙ্কের সাক্ষী মর্মন্তুদ কোনো যন্ত্রণার পীড়ন! মনটা দমে যায় মালুর। গান আজ একটুও জমল না। বারে বারে সুর কেটে যায়, তালে ভুল হয়। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে বলে উঠে আসে ও।

বস্ মালু। আজ একটু দেরি হবে শুতে। ওকে দেখে বলল রামদয়াল। বসে বসে আরও খারাপ লাগে মালুর। অতীতটাই ছুটে আসে, ওকে ঘিরে ধরে। বাকুলিয়ার আনন্দ, রাবু আপা, মেজো ভাই, ওদের স্নেহ, সবই কী মিথ্যা? তা কেন হবে? আজও তো সেই স্নেহের টান অনুভব কর চলেছে মালু! মেজো ভাইয়ের চিঠির ছত্রে নিজের উল্লেখ দেখে নেচে উঠেছে ওর মন।

রাত বেড়ে যায়। ঠেস তোলা টুলে বসে বুঝি ঘুমে ঢুলে পড়ে মালু। হঠাৎ লরীর শব্দ পেয়ে ঢুলুনিটা ভেঙে যায় মালুর। তেরপল দিয়ে ঢাকা দুটো লরী এসে থামল রামদয়ালের গুদাম ঘরের সামনে।

ফিস ফিস কথা চলে ওদের। উসখুস করে মালু। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, বারটা বেজে মিনিটের কাঁটা ডান দিকে হেলে পড়েছে।

না না, সে সম্ভব হবে না। হঠাৎ উচ্চৈঃস্বর ভেসে আসে রমজানের। আরে হবে হবে। তুমি ইচ্ছা করলেই হবে। অনুনয়ের স্বর রামদয়ালের। আহা বুঝছেন না আপনি, গাড়ি যে মালে বোঝাই। ঘন ঘন ঘাড় নাড়ে রমজান।

কয়টিই বা বস্তা আমার। যতই মালে ঠাসা থাকুক, অত বড় গাড়িতে চার পাঁচটি বস্তা কী আর ধরবে না? চল দেখি না?

রামদয়াল লরীর ভেতরটা দেখবার জন্য উঠতে যাচ্ছে দেখে লাফিয়ে উঠে ওর পথটা আগলে দাঁড়ায় রমজান।

বলে, আচ্ছা দেন দেন। কিন্তু পাঁচ বস্তার বেশি নয়।

হাসির একটি চতুর রেখা খেলে যায় রামদয়ালের মোচের ফাঁকে।

ডাক পড়ে মালুর।

ওই চিনির গুদাম খোল। পাঁচটি চিনির বস্তা বের করে নিজেও মালুর পিছে পিছে আসে রামদয়াল।

বস্তাগুলো বের করার পর হুকুম দেয় রামদয়াল : এই গাড়িতে দুটো আর ওই গাড়িতে তিনটে তুলে দে।

দুমণি বস্তা। কিন্তু, পিঠে আর হাতে ভার টানতে টানতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে মালু। পিঠ বেঁকিয়ে একটু নিচেতে বসে ও। বস্তার কান দুটো ধরে একটু সুমুখে টেনে নেয়। পিঠ আর বস্তাটাকে সমান্তরাল করে। তার পর পা দিয়ে ঠেলে দেয় মালু। বস্তা শুদ্ধ উঠে আসে উর্ধ্বাঙ্গ। 

কিন্তু, এ কী মাল রমজানের গাড়িতে! কিষাণী মেয়েতে গাদাগাদি ভর্তি গাড়ি। ছোট বড় ন্যাকড়ার পুঁটলী হয়ে এ ওর গায়ে সেঁটে রয়েছে। এক তিল ঠাঁই নেই গাড়িতে। এরি মাঝে আচমকা একটা বস্তা এসে পড়ায় অতগুলো পুঁটলী  যেন এক সাথে নড়ে উঠল, কী এক আতঙ্কের চাপা আর্তনাদ তুলল। দরজার মুখের দুটো মেয়ে উহ্ করে ছিটকে পড়ল পেছনের কয়েকজনের গায়ের উপর দিয়ে। হঠাৎ বস্তা পড়ে বুঝি চোট লেগেছে ওদের পায়ে। ধপাধপ বস্তাগুলো ফেলল মালু।

ওরা ভয়ে মৃত। ওরা আতঙ্কিত। উহ্ করে শুধু সরে গেল। এ ওর গায়ের উপর ভয়ের কম্বল জড়িয়ে পড়ে রইল।।

বস্তাগুলো উঠানো হলে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল রমজান। গাড়ি ছেড়ে দিল।

ঘুম পালিয়ে গেছে মালুর। ঘুম আর হবে না। বিড়ি তামাক, চিড়া গুড় তেল সাবান, সব মিলিয়ে মনোহারী দোকানের যে বিচিত্র গন্ধ, শুয়ে শুয়ে সেই গন্ধটা শোকে মালু। এ পাশ ওপাশ করে।

এই তবে রমজানের ব্যবসা? সুলতান তার সহকারী? শুনেছে মালু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানিয়েছে রমজান। যুদ্ধের হাটে বিচিত্র পণ্যের কারবার তার। রামদয়াল তার দোসর। ঘরে ঘরে বুভুক্ষু কৃষক বধূরা, নিরাশ্রয়া কিষাণী কুমারী রমজানের পুঁজির কড়ি। অন্ধকারেই উঠে বসে মালু। দিয়াশলাই হাতড়িয়ে মোম জ্বালায়। মোমটা কাত করে ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে বস্তাগুলোর দিকে। কোণের দিকে একটার পর একটা একবারে ছাদ অবধি সাজানো বস্তার সার, চাল ডাল লবণের। দোকানের মজুদ মাল। এ বস্তাগুলোর মাঝেই কতগুলো নতুন ধরনের বস্তা রেখে গেছে রমজান। ময়লা আলকাতরার দাগ পড়া বস্তা, হাত দিয়ে ছুঁতেই ঘেন্না ধরে। অযত্নে রাখা, অথচ রামদয়ালের কেমন একটা গোপন সতর্কতা। স্টক দেখবার অছিলায় যখন দোকানে ঢেকে রামদয়াল ওই বস্তাগুলোর কাছেও যায় না সে, কিন্তু কেমন আড় চোখে সংখ্যাগুলো মিলিয়ে দেখে। মালুর দৃষ্টি এড়ায় না।

সেদিনও এমনি গভীর রাতেই গাড়ি থেকে বস্তাগুলো নাবিয়ে রেখে গেছিল রমজান। মালুকে ছুঁতে দেয়নি, নিজেই গাড়ি থেকে বয়ে এনেছিল রমজান।

মোমটা কাছের খালি টিনের উপর বসিয়ে একটা বস্তার উপর হাত রাখল মালু। চাল ডালের বস্তার মতো নয়, হাতটা কেমন শক্ত ঠেকে। মনে হয় বস্তার নিচেই পীচবোর্ড। হাতটা একটু চাপতেই ডেবে যায়। অবাক হয় মালু, ভুসিটুসি নয় তো? দু হাতের বেড়ে একটা বস্তা তুলতে গিয়ে বেকুব বনে গেল মালু। হাতে যতটা জোর খিঁচেছিল সেই জোর যেন উল্টে এসে ওর বুকে আছড়ে পড়েছে। একেবারে হাল্কা বস্তাটা, শুকনো মরিচের বস্তাগুলোও এত হাল্কা নয়।

ডবল সুতোর প্যাঁচে মজবুত করে বাঁধা বস্তার মুখটা। অভিজ্ঞ হাতের ক্ষিপ্র চালনায় সেই মজবুত সেলাইটা খুলে ফেলল মালু। যা ভেবেছিল তাই, মুখের দিকে পীচবোর্ডের ঢাকনির মতো পীচবোর্ডগুলো সরিয়ে হাতটা ভেতরে সেঁদিয়ে দিল মালু। যেন শুকনো পাতার গাদির ভেতর দিয়ে খরখরিয়ে গেল মালুর হাতখানা। খস খস আওয়াজ উঠল বস্তার ভেতর থেকে, শুকনো পাতা গায়ে গায়ে লেগে যেমন খসখসিয়ে ওঠে। এক মুঠো পাতা তুলে আনল মালু। মোমের সামনে ধরে হাতটা তার কেঁপে গেল। পাতাগুলো ঝরে গেল। ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

দু টাকার পাঁচ টাকার এক শো টাকার, সব ধরনের নোটই উঠে এসেছে ওই একটি মুঠোতে।

আবার ছুটে গেল মালু। আবার মুঠো ভরে তুলল, মেঝেতে ছড়িয়ে দিল, দশ টাকা এক শো টাকার কাগজ। রাজার ছবি আঁকা, বিচিত্র রং-করা, পাতা আঁকা সব কাগজ।

আবার ছুটে গেল মালু। খুলে ফেলল আর একটা বস্তা। বেরিয়ে এল গাদি গাদি নোট।

আর একটা বস্তা। সেখানেও শুধু গাদি গাদি কাগজের নোট।

আর একটা বস্তা। সেখানেও শুধু তাড়া তাড়া কাগজের টাকা।

এ কী করছে মালু? হঠাৎ বুঝি ভয় পেয়ে যায় ও। ফুক করে নিভিয়ে দেয় মোমটা।

টাকার গাদির উপর অন্ধকারে বসে থাকে মালু। বসে বসে ঘামে। অন্ধকার যেন ওকে দেখছে। দেখছে তন্ন তন্ন করে। দু চোখে সুঁচের তীক্ষ্ণতা ফুটিয়ে সেও ভাসমান আঁধারের মিসকালে দেহটাকে বিঁধে চলেছে। বুকের ভেতর শুনতে পাচ্ছে অন্ধকারের কুমন্ত্রণা। ওর পায়ের নিচে লক্ষ টাকার মর্মর শুকনো পাতার মতো যেন ভেঙে ভেঙে পড়ছে ওর পায়ের চাপে। অন্ধকারের কুমন্ত্রণার কাছে হার মানবে মালু?

মালু হাঁপিয়ে চলে। মালু ঘেমে একসা হয়।

ধ্যাৎ শালা। হারামের টাকা। পাপের টাকা। চোরা বাজারের টাকা। বুঝি অন্ধকারকেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলে মালু। উঠে দাঁড়ায়। মোমটা জ্বালায়। বস্তায় বস্তায় কাগজের টাকাগুলো ভরে রাখে। ঠিক যেমনটি ছিল তেমনি সেলাই করে রাখে মুখগুলো।

তারপর মোমটা নিভিয়ে কী এক স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে মালু। শুয়ে পড়ে সেই ময়লা চাটাইটার উপর। ঘুমিয়ে পড়ে।

ভোরে ঘুম ভেঙে মালু দেখল আর এক তাজ্জব কাণ্ড।

এক শো গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে তালতলির বাজারে। ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষ। সংসারকে সংসার যেন উপড়ে তুলে এনেছে ওরা। কোথায় চলেছে এত লোক?

ওরা চলেছে পঙ্গপালের মতো। মায়ের কোলে শিশু। মেয়েদের কোলে এবং মাথায় বাসন খোরা হাঁড়ি পাতিল। পুরুষদের কাঁধে কাঁথা বালিশ, মাথায় কোরা ভর্তি দা, কুড়োল, ছেনি, ছোটখাট করাত, যার যা সম্পত্তি। ওদের পরনে জোলার তৈরি শাড়ি, জোলার তৈরি লুঙ্গি অথবা ধূতি। ওদের চেহারা, ওদের পোশাক দেখেই চেনা যায়, ওরা আশেপাশের গ্রামেরই কিষাণ কিষাণী।

কিছুদিন ধরেই দেখছে মালু, ওদের ছোট ছোট দল তালতলির উপর দিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে ওঠে। সে রাস্তা ধরে কোথায় যে যায়, জানে না মালু। যেতে যেতে ওরা খোরা বাড়িয়ে দেয় এক মুঠো খুদ অথবা চালের জন্য। হাত বাড়িয়ে দেয় একটি পয়সার জন্য।

কখনো বা রাতের বেলায় ভাত মেগে বেড়ায় ওরা। ভাতের অভাবে ফেন চায়। মাঝে মাঝে মালুর বয়সী ছেলেরাও দল বেঁধে চলে যায় বড় রাস্তার দিকে। ওদের পিঠে ঝোলান থাকে ওঁড়া-কোদাল। ওরা যায় মেলেট্টরির মাটি কাটতে।

কিন্তু আজ একটা দুটো দল নয়। পিঁপড়ের মিছিলের মতো, যেন শেষ নেই ওদের। যেতে যেতে ভিখ মাংছে। : এক খোরা ভাত দেবে? এক মুঠো খুদ দেবে? একটা পয়সা দেবে?

মুখগুলো দেখেই বুঝতে পারে মালু সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় পেট ওদের পুড়ছে। তবু চাওয়াটাকে যেন সামান্যের মাত্রায় সীমাবদ্ধ রাখতে বিশেষ চেষ্টা ওদের; এক খোরা ভাত অথবা একটি পয়সা। বেশি কিছু নয়।

মাত্র কয়েকদিন আগে চালের বড় গুদামটাকে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করিয়ে ছিল রামদয়াল। ধূলো বালি শুদ্ধ মালুই সে চালগুলো একটা বস্তায় পুরে ফেলে রেখেছে দোকান ঘরের এক কোণে। বস্তাটা টেনে বের করল মালু। ধূলো বালি ঝেড়েঝুড়ে মণ দেড়েক চাল তো হবেই।

বস্তাটা খুলে এক কোষ করে চাল ওদের বিলোতে লাগে মালু। দেখতে দেখতে ভিড় জমে যায়। ভিড় বেড়ে যায়। হল্লা লেগে যায়। ছুটে আসে রামদয়াল। আমি কী দানছত্র খুলেছি? ব্যাটা আমার দোকানটা কী লুট করাবে আজ? ব্যাটা নেড়ের বাচ্চা, দাঁড়াও আজই তোমায় আমি ঠেঙিয়ে বিদেয় করছি? একে গুঁতো দিয়ে, ওকে ঠেলা মেরে এগিয়ে আসতে আসতে বেহদ চেঁচিয়ে চলে রামদয়াল। কাছে এসে দু হাতে টেনে নেয় বস্তাটা। শূন্য বস্তা। চাল তখন বণ্টন হয়ে গেছে।

খালি বস্তাটা ওদের দেখায় মালু, বলে, আর চাল নেই, যাও তোমরা।

ভিড়টা আস্তে আস্তে গলে যায়।

কটমট চোখে একবার রামদয়ালের দিকে তাকিয়ে বেচাকেনার জায়গাটিতে এসে বসে মালু।

ব্যাপার স্যাপার ভালো দেখাচ্ছে না। দোকান বন্ধ করে দাও। রমেশকে উদ্দেশ্য করে বলল রামদয়াল। তরপর মালুর দিকে একটি অপাঙ্গ দৃষ্টির শাসানি ছুঁড়ে চলে গেল গুদামের দিকে।

ভালই হল। দোকান ছেড়ে ওই পিঁপড়ের সারিতে মিশে গেল মালু। দত্ত দীঘির গা ঘেঁষে ওরা যায় ডানমুখী। মালু উঠে আসে দীঘির পাড়ে। পাড়ের কিনার ঘেঁষে এগিয়ে যায় ভিক্ষুকের মিছিল। বড় দলটা বোধ হয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে ট্রাঙ্ক রোডে। এবার আসছে সব ছোট ছোট দল।

মেয়েগুলোর মাথায় ঘোমটা। জড়সড় ক্লান্ত পা ওদের। কোনোদিন বুঝি এমন করে পথে নাবেনি ওরা। আজ এই প্রথম পথ ভাংতে গিয়ে কেবলই হোঁচট খাচ্ছে। কোথায় চলেছে ওরা? শহরে? কিন্তু সেখানেও তো নাকি শুধু ক্ষুধার হাহাকার!

এ কী? এ কী হয়ে গেল হঠাৎ?

রাস্তার পাশে পাকুড় গাছটার নিচে অনেকক্ষণ থেকেই দাঁড়িয়েছিল একটা লরী। সেই গভীর রাতে দেখা রমজানের মাল বোঝাই লরীগুলোর মতোই তেরপল দিয়ে ঢাকা। আচমকা তেরপলের পর্দা সরিয়ে তিনটি কী চারটে লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরন্নের কাফেলার উপর। ছোঁ মেরে তুলে নেয় দুই কিষাণী কন্যা। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জন করে ছুট দেয় গাড়িটা।

ভয়ে আতঙ্কে ভেঙে যায় কাফেলার লাইন। কেউ পাশের ঝোপে, কেউ ক্ষেতে ছিটকে পড়ে। কেউবা প্রাণ ভয়ে দৌড় দেয় ক্ষেতের আল ধরে। কে যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। হয়তো ওই কিশোরীদের মা।  

হাহাকার উঠে নিরন্নের কাফেলায়।

চকিতে পাড় ছেড়ে দৌড়ে আসে মালু। কিন্তু নিরর্থক। মাল বোঝাই গাড়িটা তখন চলে গেছে অনেক দূর।

৩০.

গুজবের পর গুজব আসছে।

জাপানীরা নাকি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম। ফেনী শহরেও বোমা পড়েছে।

ট্রাঙ্ক রোডের উপর কে নাকি জাপানীদের দেখে এসেছে স্বচক্ষে। স্বচক্ষের বর্ণনাটাও ছড়িয়ে পড়েছে মুখে মুখে : থ্যাবড়া নাক, ইয়া ইয়া জোয়ান, চোখ এক রকম নেই বললেই চলে। বাচ্চা ছেলেদের ধরে ধরে কাঁচাই চিবিয়ে খায় ওরা।

গিয়ে টিয়েও যে কয়েক ঘর বাসিন্দা পড়েছিল তালতলিতে তারাও পালাচ্ছে। আসলে দু এক ঘর করে রোজই সরে পড়ছিল। নজরে পড়েনি মালুর। আজ ক্লাবে এসেই বুঝল, কেউ আর থাকছে না তালতলিতে।

ভবেশ পণ্ডিতের পাঠশালার পেছনে সেই ঘরটি। সেই ঘর থেকে ছড়িয়ে পড়ত অশোকের গলা, সুরের ঝংকার। সেই ঝংকার গিয়ে পৌঁছাত ওই তেল নুনের দোকানে। কী আনন্দে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসত মালু!

আজ গান নেই। আনন্দের ডাক নেই। ভবেশ পণ্ডিতের পাঠশালার কাছে এসেও সামান্য একটু টুং টাং আওয়াজ পেল না মালু। তালতলির বাতাস কী আর সুরের ঝংকারে উতলা হবে না কোনোদিন?

ক্লাবের ভেতর পর্যন্ত যেতে হল না মালুকে। দরোজার কাছাকাছি এসেই দেখল মালু, যন্ত্রপাতিগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে অশোক। অশোকের পেছনে ওরই দু জন ছাত্র।

ওরা দু জন আর মালু, গত কয়েক দিন এই তিন ছাত্রকে নিয়েই অশোকের গানের স্কুল বসেছিল। আজ ওরাও চলে যাচ্ছে।

মালু, তুইও চল আমাদের সাথে, বলল অশোক।

না। কেমন কর্কশ শোনায় মালুর এক শব্দের উত্তরটা। অশোক যেন চমকে তাকাল ওর দিকে। বলল : ও, তুই বুঝি জাপানীদের ঠেঙ্গাবার জন্য থেকে যাবি? তোর ওই মাস্টার সাহেব যেমন বলে?

উত্তর দেয় না মালু। মাস্টার সাহেবকে নিয়ে কোনো বাঁকা কথা, সে যার কাছে থেকেই আসুক, অসহ্য মালুর পক্ষে।

অশোক আগে আগে। ওরা পিছে পিছে।

রানুও তো চলে যাচ্ছে, বলল অশোক।

রানুদিও যাচ্ছে? বুকের তলা থেকে বেরিয়ে আসা একটা আর্তনাদ বুঝি অতি কষ্টে চেপে রাখল মালু। সবাই চলে গেলেও রানুদি যাবে না, এমন একটা কথা কেন যেন ভেবে রেখেছিল ও।

এমন সুন্দর গলাটা। চর্চা করলে সত্যি সত্যি ওস্তাদ হতে পারতিস তুই। হঠাৎ প্রসঙ্গটা পাল্টিয়ে নিল অশোক।

গানের কথা আসতেই কেমন নরম হয়ে যায় মালু। জড়িয়ে আসে পা জোড়া। গান শিখবি তো কোলকাতায় তোকে আসতেই হবে। এই চোরা বাজারের ডিপোতে চোর চোট্টাদের সাথে থেকে গান শিখবি তুই? পেছন ফিরে মালুর মুখের উপর চোখ রেখে বলল অশোক।

তক্ষুণি যেন মন স্থির করে ফেলে মালু। গানের জন্য কোলকাতা কেন, যে কোনো দোজখে যেতে প্রস্তুত মালু। আর কোলকাতা যাওয়াটা তো অনেক দিনের স্বপ্ন ওর। সেই স্বপ্নটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল বুঝি। মুখে কিছু না বলে নীরবেই যেন সম্মতিটা জানিয়ে দেয় মালু।

বুঝি কোনো আসন্ন প্রলয়ের মুখে নিঃশব্দ প্রস্তুতি চলছে রানুদের বাসায়। কাকপক্ষীও টের পায় না এমনিভাবে সেরে ফেলেছে সব বাঁধা সাঁধার কাজ। এখন শুধু যাত্রাটাই বাকী। কেন যে এই গোপনীয়তা বুঝতে পারে না মালু।

অস্বাভাবিক গম্ভীর রানু। মালুকে দেখে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল, বলল : এবার পড়ার দিকে মন দিবি। বুঝলি? মাস্টার সাহেব এসেছিলেন, তোর কথাই আলাপ হল।

রানুর কথাটা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য নেই মালুর। ও শুধাল : তুমি চলে যাচ্ছ রানুদি?

গম্ভীর মুখটাকে যেন আরো গম্ভীর করে হাসল রানু। বলল : মেয়েরা কী চিরকাল বাপের বাড়ি থাকে রে?

বুঝতে না পেরে রানুর মুখের দিকে প্রশ্নভরা চোখে চেয়ে থাকে মালু। আমরা যাচ্ছি ভাগলপুর, মামার বাসায়। সেখানে আমার বিয়ে হবে। হাঁদারাম কোথাকার! এবার বুঝলি?

বুঝতে পেরেও খুশিতে হাসবে, না দুঃখে কাঁদবে, সেটা বুঝতে না পেরে চুপ মেরে যায় মালু।

লক্ষ্মী ছেলের মতো থাকবি। জ্যাঠ্যা মশায়ের সাথে ঝগড়া করবি না। দুর্ব্যবহার করলে আমাকে লিখবি। কেমন? এক টুকরো কাগজে ঠিকানাটা লিখে মালুর হাতে গুঁজে দেয় রানু, বলে, এক পিঠে অশোকদার, উল্টো পিঠে আমার।

ঠিকানা লেখা কাগজটা পকেটে না পুরে হাতের চেটোয় কচলে চলল মালু।

কিন্তু পড়াশুনা করবি লক্ষ্মী ভাইটি। মালুর মাথাটা কাছে টেনে হাত বুলিয়ে দেয় রানু।

বুঝি এই আদরটুকুর অপেক্ষায়ই ছিল মালুর চোখের জল। বহু দিন পর সেই ছোট বেলার মতোই মালুর চোখ পানিতে ঝাপসা হল।

গভীর রাত।

বড় খাল।

মালুর মনে আছে, এমনি এক রাতে বিদায় দিয়েছিল কসিরকে। আজ বিদায় দিল রানুদের গোটা পরিবারটাকে। তালতলিতে রইল ওদের পরিবারের রামদয়াল আর রমেশ।

নৌকোটা ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও বুঝি তৈরি ছিল মালু, আর একবার বলবে অশোক–চলে আয়। অমনি নৌকোর গলুইতে উঠে বসবে মালু। কিন্তু কেউ ওকে ডাকল না, না অশোক, না রানু। রাবু আপা চলে গেছে। রানুদিও চলে গেল। আবাল্য আপন বলে যাদের ভেবে এসেছে এমনি করে তারা সবাই ওকে বর্জন করে চলে গেল। বড় খালের ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে মেখে ফেরার পথে কেন যেন এ কথাটাই ভাবল মালু, আর বুকটা ওর ভারি হয়ে এল।

কিন্তু বড় খাল থেকে ফিরে তালতলির বাজারে পা রেখে আবার অশোককেই দেখতে পাবে এমন একটা ভৌতিক কাণ্ড কেমন করে কল্পনা করতে পারে মালু।

সত্যি সত্যি অশোককে দেখল মালু। একটা জীপের ভিতর বসে আছে অশোক। দুপাশে গোরা সেপাই। হয়ত বাজার বলেই জীপের গতিটা শ্লথ। মুখ বাড়িয়ে অশোক বলেছে, এই মালু। এই মালু, আমাকে এরা এ্যারেস্ট করেছে।

কেন?

জানি না। এরা বলছে আমি নাকি রাজ-বিরোধী, জাপানী স্পাই।

কখন ধরল?

এই তো এখুনি। মাঝ গাঙ্গে নৌকোটা ঘেরাও করে তুলে নিয়ে এল আমাকে।

কখন ছাড়বে? জীপের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে শুধাল মালু। কিন্তু জবাব পেল না। জীপটা ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে, শাঁ করে বেরিয়ে গেছে বাজার ছেড়ে ট্রাঙ্ক রোডের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *