দরজা বন্ধ। কড়া নাড়তেই শব্দ ছড়াল। সেকেন্ড দশেকে পৃথিবীর কেউ কেউ একশো মিটার দৌড়ে যায়, কিন্তু দরজা খুলল না। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তেই পেছন থেকে এক বিধবা বুড়ি বলল, চোরের মতন থাকে, সহজে সাড়া দেয় না।
এই বুড়ি বৃষ্টি না হলে গলির পাশে দরজার গায়ে বসে থাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। কে যাচ্ছে, কে আসছে তা নাকি শকুনের মতো খুঁটিয়ে দেখে। এক রাত্রে কাজ থেকে ফিরছিল অর্ক, বস্তির একটি যুবতী বউ তার কিছুটা সামনে হেঁটে এখান দিয়ে ফিরছিল। বুড়ি ডাকল, ও বউ! যখন বেরোস তখন তো পাই না। ফেরার সময় এত ফুলের বাস ছড়িয়ে কোত্থেকে ফিরিস?
বউটি থমকাল, উঃ, সব গেছে কিন্তু নাক আর চোখ গেল না। মরলে বস্তির লোক বেঁচে যাবে। বউটি চলে গেলে বুড়ি অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল, সত্যি কথা আজকাল কারও ভাল লাগে না। অর্ক জবাব দেয়নি। দরজা খুলল রামজি, খুলে অর্ককে দেখে হেসে হিন্দিতে বলল, সরি, ল্যাট্রিনে ছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?
দরজা বন্ধ করে উঠোনে দাঁড়িয়ে অর্ক বলল, ওখানে তেমন কোনও কাজ ছিল না। আপনি কেমন ছিলেন? অসুবিধে হয়নি তো?
হাসলেন রামজি, তেমন কিছু নয়। যা হয়েছে তা স্বাভাবিক। চা বানাই?
মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকে গেল অর্ক। চারপাশে তাকিয়ে খুশি হল সে। মা বাড়িতে থাকতেও এই ঘর এত গোছানো থাকত না। রামজির রুচি খুবই ভাল।
বাড়িতে যেহেতু কোনও মহিলা নেই তাই রামজি বারমুডা আর গেঞ্জি পরে থাকে। প্রথম দিনেই সে অর্কর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে হলে হয় হিন্দি নয় ইংরেজি বলতে হয়। অর্ক হিন্দিতে স্বচ্ছন্দ নয়, বলার সময় কোনও কোনও শব্দের হিন্দি জানা না থাকায় বাধ্য হয়ে বাংলাটাই বলে। রামজির গুণ হল শব্দ না বুঝলেও প্রশ্ন করে না।
শরীর আরাম চাইছিল। বাথরুমে ঢুকে একেবারে স্নান করে বেরিয়ে এল অর্ক। রামজি দুটো প্লেটে রুটি তরকারি নিয়ে এল। অর্ক খুশি হল, বাঃ, খুব খিদে পেয়েছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।
জলপাইগুড়িতে যাওয়ার আগে সে রামজিকে খাবার বানাতে দেয়নি। সকালে ভাতে-ভাত নিজেই করত। রাত্রের খাবার বেলগাছিয়ার মোড়ের ঠাকুরের দোকান থেকে কিনে আনত। এখন খেতে খেতে বুঝল রামজিরা নিশ্চয়ই মোটা মোটা রুটি খায়। মোটা হলেও সুস্বাদু।
পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে আপনাকে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। রামজি হাসল, তেমন কিছু না। আমি কে? কোত্থেকে আসছি? আপনার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? এইসব। এই গলিতে যে বুড়ি বসে থাকে সে আমার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছে।
কী বলেছে?
আমি ভালমানুষ, বাড়ির ভিতর চুপচাপ থাকি। আমার কাছে এখন পর্যন্ত কোনও লোককে আসতে দিইনি। বস্তির কোনও মেয়ের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাই না। রামজি হাসল।
পাড়ার ছেলেদের কী জবাব দিয়েছেন?
একটু মিথ্যে বলতে হল। আমার ভোটার কার্ডে লেখা আছে আমি বলরাম মাহাতো। তাই বললাম, নাম বলরাম। থাকি হাজারিবাগে। আমার পাশের বাড়ির বাঙালিদাদার অনুরোধে অর্কদাদা থাকতে দিয়েছেন। ওঁরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তেন। আমি এখানে এসেছি চাকরির খোঁজে। ইন্টারভিউ দিয়েই চলে যাব।
রামজি উঠে ঘর থেকে ভোটার কার্ড নিয়ে এসে অর্ককে দিল, এই কার্ড দেখে ওরা আর কোনও প্রশ্ন করেনি। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
এ পাড়ার একটি ছেলে যে আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূলে আছে, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। অর্ক বলল। রুটি শেষ হলে রামজি রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে এল। চা খেতে খেতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, জীবনদার কাছে গিয়েছিলে?
না। ওঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। উনি সন্দেহ করছেন বাড়ির ওপর ওয়াচ রাখা হচ্ছে। ফোন করতে বলেছেন। কিন্তু মোবাইল অফ করা আছে। রামজি নিচু গলায় বলল, আমি বাঙালি নই বলে কারও সন্দেহ হতে পারে, আপনি যদি একবার খোঁজ নেন–। এভাবে চুপচাপ কতদিন বসে থাকব?
অর্ক মাথা নাড়ল, জীবনদা আমাকেও যেতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, দরকার হলে তিনিই ফোন করবেন।
তা হলে আমি কি মেদিনীপুরে চলে যাব?
মেদিনীপুরের কোথায়?
হলদিয়ায়। ওখানে রামপ্রকাশ আছে।
রামপ্রকাশ কে?
রামপ্রকাশ মাহাতো, আপনি চিনবেন না।
আমার মনে হয় আপনি আরও দু-তিন দিন অপেক্ষা করে যান।
আপনার পেরেন্টস কবে আসবেন?
দেরি আছে। ওদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। অর্ক উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কে?
অল্পবয়সি গলায় জবাব এল, অর্কদা, আপনাকে সুরেনদা এখনই যেতে বললেন। খুব জরুরি।
কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল অর্ক, ঠিক আছে।
সুরেন মাইতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কথাবার্তাও হয় না। লোকটা একশোভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত, উদ্ধত। বস্তির লোকেরা ভয় পায় বলে চুপ করে থাকে। সে রামজির দিকে তাকাল, আপনার সঙ্গে যারা কথা বলতে এসেছিল তারা কোন পার্টির লোক?
রামজি বলল, আমি তো ওদের চিনি না–!
খুব উদ্ধত, মানে, মেজাজ দেখিয়ে কথা বলেছে?
না না। অস্বাভাবিক ব্যবহার করেনি। রামজি বলল।
একটু চিন্তায় পড়ল অর্ক। শুধু ঈশ্বরপুকুর লেন কেন গোটা পশ্চিমবঙ্গে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার সুরেন মাইতির পার্টি ছাড়া আর কারও এই মুহূর্তে নেই। অথচ রামজি বলছে পাড়ার যেসব ছেলে এসেছিল তারা স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। কী করে সম্ভব? সে বলল, দরজাটা বন্ধ। করে দিন, আমি একটু ঘুরে আসছি।
কোথায় যাচ্ছেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।
এই এলাকার সিপিএমের সর্বময় নেতা সুরেন মাইতির কাছে হাজিরা দিতে।
এখনই সংঘাতে যাবেন না। রামজি বলল। হেসে বাইরে বেরিয়ে দরজা টেনে দিল অর্ক।
গলিতে পা বাড়াতেই সেই বুড়ি ডাকল, ও ছেলে, খবর শুনেছ?
কী খবর?
ওই যে মেয়েটা, যাকে তোমার মা আশ্রয় দিয়েছিল, সে পালিয়ে গেছে।
পালিয়ে গিয়েছে মানে? অর্ক অবাক হয়ে গেল।
পালিয়ে যাওয়া মানে বোঝে না? সরল কথা। বুড়ি বলল।
ওপাশের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল একটি অল্পবয়সি বউ। সে ঝঝিয়ে উঠল, তোমার দোষ কী জানো? তুমি অর্ধেক বলো অর্ধেক পেটে রেখে দাও। সুজাতা এখানে নেই। আমাদের বলেছে এখানে থাকতে তার ভয় করছে। কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় কলকাতার বাইরে থাকে, তার কাছে চলে গেছে। পালিয়ে যায়নি। অবশ্য কোথায় গিয়েছে তার ঠিকানা বলেনি। বউটি বলল।
অর্ক আর দাঁড়াল না। তার মনে হল, এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ এই মুহূর্তে বেঁচে আছে। প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনও সমস্যায় কম বেশি ভুগছে। এক-একজনের এক এক রকমের সমস্যা। কেউ সম্পূর্ণ সমস্যা মুক্ত হয়ে বেঁচে নেই। কোটি কেন, আশেপাশের দশজনের সমস্যা শুনে যদি কেউ সমাধানের চেষ্টা করে তা হলে তাকে পাগল হয়ে যেতে হবে। অথচ রাস্তাঘাটে বা বাড়িতে ওইসব মানুষগুলো এমন মুখ করে থাকে যে মনে হবে তাদের কোনও সমস্যা নেই। অন্যের সঙ্গে তো বটেই, এখন নিজের সঙ্গেই অভিনয় করতে মানুষ বেশ পটু হয়ে গিয়েছে। অর্ক বস্তি থেকে বেরিয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
সুরেন মাইতির গলা রাস্তায় পৌঁছোচ্ছিল। কাউকে খুব ধমকাচ্ছে। অর্ক দরজায় পৌঁছে দেখল একজন মধ্যবয়সিনি মহিলা বালিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুরেন মাইতি তার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল, আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান মা। আপনি কাকে বাড়ি ভাড়া দেবেন সেটা নিয়ে কেউ আপনাকে কোনও কথা বলবে না। যদি বলে তা হলে তাকে এ পাড়া ছেড়ে যেতে হবে। মা-বোনেদের ইজ্জত সবার আগে। যান আপনি।
কী বলে যে ধন্যবাদ দেব– ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞ গলায় বললেন।
ছি ছি ছি। এসব কী বলছেন। আসুন।
ভদ্রমহিলা বালিকাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ঘরের একপাশের বেঞ্চিতে বসা ছেলেদের একজনকে বলল, অ্যাই! উঠে দাঁড়া। ছেলেটা উঠল।
অর্ক দেখল একেবারে লপেটামার্কা চেহারা। পরনে জিন্স আর গেঞ্জি। শরীরে মাংস নেই কিন্তু হাতে বালা আর গলায় হার আছে।
অ্যাই! হাঁড়ির জলে চাল ফেললেই ভাত হয়ে যায়? সুরেন জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল ছেলেটা, না।
ভাতটা হওয়ার জন্য সময় দিতে হয়। কিছু বুঝলি? ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
গুড। যা এখান থেকে। তর সইছিল না।
অর্ক বুঝতে পারল একেই একটু আগে ধমকাচ্ছিল সুরেন মাইতি।
আমাকে ডেকেছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
আরে। আসুন আসুন। কিন্তু আপনি এটা কী বললেন? আমি কি আপনাকে ডাকতে পারি? আপনার বাবা কত বড় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, আপনার মায়ের মতো মানুষ বস্তিতে ছিলেন এটাই ভাগ্যের কথা। আর আপনি, কত অল্প বয়সে বস্তিতে কমিউন করার চেষ্টা করেছিলেন। আপনাদের পরিবারের যে ইতিহাস তাতে আমারই উচিত ছিল দেখা করতে যাওয়া। যেতামও। কিন্তু মাঝখানে ওই ভদ্রমহিলার কেস এসে পড়াতে–, বসুন বসুন। অ্যাই, চা বল। সুরেন মাইতি হাঁক দিল।
আমি কয়েক মিনিট আগে চা খেয়েছি। অর্ক বলল।
অ। ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে কী ব্যাপারে কথা বলব যেন–। টেবিলে টোকা মারল সুরেন মাইতি, ও হ্যাঁ, আপনার বাবা-মা তো এখন জলপাইগুড়িতে। আপনিও গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ।
পৈতৃক বাড়ি। যাবেনই তো। আপনার কোনও বন্ধু বোধহয় এখানে ছিল!
হ্যাঁ। ছিল। অর্ক বলল, এখনও আছে।
থাকতেই পারে। আমার বাড়িতে আমি কাকে রাখব সেটা আমিই ঠিক করব। কিন্তু পাড়াপড়শির তো ঘুম নেই। আমি শুনলাম ওই যে ছোকরা, আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূল করে, সে নাকি ছেলে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। আমরা সিপিএম পার্টির কর্মীরা ডিসিপ্লিন মেনে চলি কারণ আমাদের পার্টির একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। যাকে সংবিধানও বলতে পারেন। ওদের কী আছে? নাথিং। একজন মহিলা হয়ে দলটাকে বহন করছেন। তিনি যা বলবেন তা এদের কানে কতটা পৌঁছাবে কে জানে! তা শোনামাত্র মনে হল আমার উচিত আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করা। আপনার ব্যাপারে নাক গলিয়েছে ওরা, আপনি ক্ষমা করে দিন। খুব বিনীত গলায় কথাগুলো বললেন সুরেন মাইতি।
ওরা এমন কিছু বলেনি যে আপনাকে এসব কথা বলতে হবে।
বলেনি?
না।
আপনাদের বলেনি কিন্তু প্রচার করছে। আমরা নাকি অবাঙালি বাইরে থেকে এনে পাড়ায় লুকিয়ে রাখছি। সময় হলেই তাদের কাজে লাগাব। শব্দ করে হাসল সুরেন মাইতি। তারপর মুখে খানিকটা পানবাহার ছুঁড়ে দিয়ে বলল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বাইরে থেকে লোক আনতে হবে কেন? সুরেন মাইতি তো মরে যায়নি। যাক গে, শুনলাম, লোকটা নাকি অবাঙালি?
হ্যাঁ।
কোথায় বাড়ি?
আপনার কি সেটা জানার খুব দরকার?
আরে না না। কথার পিঠে কথা বলছি। আপনি শুধু বলুন, ওকে বিলক্ষণ চেনেন কি না!
চিনি।
এই তো সমস্যায় ফেললেন।
কেন?
আপনি তো বেলগাছিয়ার বাইরে মাত্র দুবার গিয়েছেন। তাও জলপাইগুড়িতে। একজন অবাঙালিকে চেনার স্কোপ পেলেন কী করে?
আমার স্কুলের এক বন্ধু চাকরি নিয়ে হাজারিবাগে গিয়েছে। ও থাকে এই ছেলেটির পাশের বাড়িতে। তার কাছেই এর কথা শুনেছি। ও ফোনে বলেছিল ছেলেটি চাকরির পরীক্ষা দিতে কলকাতায় আসবে কিন্তু থাকার জায়গা নেই। আমি যদি থাকতে দিই তা হলে ও খুশি হবে। আমি রাজি হলে ও এসে ওর ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, অ্যাডমিট কার্ড দেখায়। বুঝতেই পারছেন, আমি কোনও উটকো লোককে বাড়িতে ঢোকাইনি। অর্ক স্পষ্ট করে কথাগুলো বলল।
হয়ে গেল। জলের মতো সহজ হয়ে গেল। সুরেন মাইতি দুরে দাঁড়ানো পার্টির ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, নেই কাজ তো খই ভাজ। যত উলটোপালটা কথা কানে ঢোকাচ্ছে। সরি, আপনাকে কষ্ট দিলাম।
অর্ক যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা বলুন তো, এই যে আপনি এলেন, আমি কি খারাপ ব্যবহার করেছি? আপনার সঙ্গে উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলেছি?
একদম নয়।
গুড। এই কথাটা যদি বস্তির মানুষকে বলেন তা হলে খুব খুশি হব। উঠে দাঁড়াল সুরেন মাইতি, অপপ্রচার। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। দেশের উন্নতি করতে শিল্পস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শিল্প তো আকাশে তৈরি হতে পারে না। কলকারখানা করতে জমি দরকার। মানেন তো?
নিশ্চয়ই।
তা হলে? আপনি বুঝলেন। কিন্তু ওরা কৃষকদের খেপাচ্ছে। কারখানার জন্যে শিল্পপতিদের জমি চাই। কৃষকদের সমস্ত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে একফসলি জমি যদি কারখানার জন্যে নিতে চাই তা হলে বলা হচ্ছে আমরা তাদের গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছি। এক বিঘে জমিতে খরচ করে চাষের পর যে ধান হয় তার দাম কত? একজন কৃষককে সেই এক বিঘের জন্যে যে টাকা দেওয়া হবে তা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদের পরিমাণ পাঁচ গুণ হবে। আরও ভালভাবে বাঁচতে পারবে তারা। কিন্তু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে জমিকে মা বানিয়ে ভূমি রক্ষা আন্দোলন করানো হচ্ছে। মানুষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল কেউ যদি তার সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেয় তা হলে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দেখুন, এত বছর গেল, কংগ্রেসকে কোথাও দেখেছেন? সাইনবোর্ডের দল হয়ে গেছে। ওই সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে নতুন দলটা দাঁড়াতে চাইছে।
অর্ক হাসল, আমাকে এসব বলছেন কেন? আমি শহরের মানুষ, জমিজমা নেই। রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখি না। চলি।
হুম। আমাদের বড় শত্রু হল মাওবাদীরা। ওরা মদত পাচ্ছে এদের কাছ থেকে। এখন কলকাতা শহর হল মাওবাদীদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। একটা প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন আপনার অতিথির রেকর্ড থানায় থাকা উচিত। আমি বড়বাবুকে বলে দেব যাতে আপনি গেলে ভাল ব্যবহার করেন। না বললে, বুঝতেই পারছেন, পুলিশের চরিত্র বদলায় না।
অর্ক আর দাঁড়াল না। সুরেন মাইতিকে তার এতকাল মনে হত একজন গোঁয়ার, অশিক্ষিত, উদ্ধত মানুষ যে নেতাদের পায়ে তেল দিয়ে ক্ষমতা হাতে রেখে চলেছে। আজ বুঝতে পারল, পার্টি ওর ব্রেনওয়াশ এমনভাবে করেছে যে শিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলা রপ্ত করতে পেরেছে।
গলিতে ঢোকার পরেই বুড়ির গলা কানে এল, ও বাবা, দাঁড়িয়ে যাও।
আবার কী হল? অর্ক দাঁড়াল।
বস্তির ওপাশের অলকা দুবার তোমার দরজা থেকে ঘুরে গেছে। আমি যত বলি তোমরা বাড়ি নেই, বিশ্বাস করে না। ভগবান শরীর দিয়েছে বলে বড্ড দেমাক ওই মাগির। আবার নিশ্চয়ই আসবে। কী বলে তা আমাকে জানিয়ো তো! বুড়ি চকচকে চোখে কথাগুলো বলল।
দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ার পর অর্ক একটু জোরে বলল, খোলো।
রামজি দরজা খুলে বলল, একজন মহিলা দুবার দরজায় শব্দ করে ডেকেছিল। আমি খুলতে ভরসা পাইনি।
ঠিক করেছ।
কী কথা হল?
অনেক আলতু ফালতু কথা। আচ্ছা, রামপ্রকাশের কোনও ফোন নাম্বার আপনার জানা আছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ মোবাইল নাম্বার জানি।
আপনি ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করুন আজকালের মধ্যে ওর কাছে। যেতে পারেন কি না?
অর্কর কথা শুনে রামজির চোখ ছোট হল। বোতাম টিপে যন্ত্রটা কানে চেপে বলল, সুইচ অফ। ঠিক তখনই ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। অর্ক অবাক হয়ে দেখল একজন মহিলা দাঁড়িয়ে হাসছেন।
.
২৭.
অর্ক কিছু বলার আগেই মহিলা ভেতরের উঠোনে চলে এল। তার বাঁ হাত কপাল থেকে চুল সরাল, মাসিমাকে ডেকে দিন না।
আপনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
আমি অলকা।
মা এখন এই বাড়িতে নেই। অর্ক বলল।
যাঃ। আপনিও ওই বুড়ির মতো কথা বলছেন।
আশ্চর্য! অর্ক বারান্দায় বসা রামজির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে সত্যি কথা বলছি। মা এখন কলকাতাতেই নেই।
এবারে মহিলার মুখের অবিশ্বাসের হাসি মিলিয়ে গেল, কবে আসবেন?
কোনও ঠিক নেই।
উনি তো কখনও বাইরে যান না!
দরকার বলে গিয়েছেন।
মহিলা অকারণে বুকের আঁচল টানল। অর্ক লক্ষ করল এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না মহিলা। শরীরের ভার কখনও বাঁ পায়ে কখনও ডান পায়ের ওপর রাখছে। এবার বলল, এখন আমি কী করব?
বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল মহিলা খুব হতাশ হয়ে পড়েছে, সেটা বুঝেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মায়ের সঙ্গে কী দরকার ছিল তা যদি বলেন।
চোখ তুলে কাতর গলায় বলল মহিলা, পারবেন আমায় সাহায্য করতে?
না শুনলে কী করে বলব?
আ-আমি একটু বসতে পারি?
অর্ক ঘর থেকে একটা মোড়া এনে বারান্দায় রাখলে মহিলা সেখানে বসে রুমালে গলা এবং কাধ মুছল। তারপর রামজির দিকে তাকাল, উনি–!
বাংলা বোঝেন না। ওঁর সামনে কথা বলতে পারেন। অর্ক বলল।
আমার মেয়েটাকে মাসিমার স্কুলে ভরতি করতে চাই। নিজে গিয়েছিলাম, বলছে, ক্লাস টু-তে ভরতি হবে না। কিন্তু ভেতর থেকে জানতে পারলাম তিনটে সিট খালি আছে। শুনলাম হেডমিস্ট্রেসের কোটা আছে। মাসিমা যদি হেডমিস্ট্রেসকে আমার মেয়ের কথা বলে দেন তা হলে খুব উপকার হবে।
মা অবসর নিয়েছেন অনেকদিন হয়ে গেল!
কথা শেষ করতে না দিয়ে মহিলা বলল, তাতে কী হয়েছে। আমি স্কুলে গিয়ে শুনে এলাম সবাই এখনও মাসিমার কথা বলে। একজন তো বলেই দিল, মাধবীলতা দিদিকে ধরুন, উনি বললে হয়ে যাবে।
অর্ক হেসে ফেলল, তা হলে মায়ের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আপনি বলছেন কবে ফিরবেন ঠিক নেই!
ঠিকই বলেছি।
আপনার সঙ্গে হেডমিস্ট্রেসের চেনা নেই?
না।
কিন্তু নাম বললে তিনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। মহিলা করুণ চোখে তাকালেন।
বেশ অবাক হয়ে গেল অর্ক। মহিলার সমস্যা প্রবল বলে দিশেহারা হয়ে এইরকম কথা বলছেন। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মেয়ে এখন কোন স্কুলে পড়ে?
দত্তবাগানের একটা স্কুলে।
সেখানে কী অসুবিধে হল?
ওখানে সমস্যা হয়েছে বলেই তো।
সমস্যা কী?
দেখুন, আমার স্বামী অফিসে কংগ্রেসি ইউনিয়ন করেন। পইপই করে বলেছি, করতে হলে সিপিএমের ইউনিয়ন করো, কিন্তু শোনেনি। সেই মহাত্মা গাঁধীর ঘি হাতে মেখে গন্ধ শুঁকে চলেছে। আদর্শে বিশ্বাস করে। একবার ইউনিয়নের ইলেকশনে জিতেছিল বলে মাথা ঘুরে গেছে। অথচ ওর সঙ্গে যারা কাজ করে তারা সিপিএমের লোক বলে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। মহিলা শ্বাস ফেলল।
আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। অর্ক বলল।
হ্যাঁ। ওই দত্তবাগানের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ডেকে পাঠিয়ে বলল, মেয়েকে অন্য স্কুলে নিয়ে যান। এখানে রাখা যাবে না।
কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
প্রথমে কিছুতেই বলতে চায় না। তারপর আমাকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি কংগ্রেসি ফ্যামিলি? আমি না বললে তিনি মাথা নাড়লেন, সত্যি বলছেন না। আপনার স্বামী এতদিন কংগ্রেসি করতেন এখন তৃণমূলে ঢুকেছেন। এর বেশি আপনাকে কিছু বলতে পারব না। এখন ভরতি চলছে, মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়িতে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসা করে আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। উনি যে পার্টি বদলেছেন তা আমাকেই জানাননি অথচ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস জেনে গেছেন। আমি চেঁচামেচি করলে বলল, কংগ্রেস এখন মরা পার্টি হয়ে গিয়েছে। তৃণমূল উঠছে। আর পার্টির সঙ্গে কংগ্রেস নামটা তো রয়েছে। তুমি চিন্তা কোরো না, অন্য স্কুলে ভরতি হয়ে যাবে।
তা হলে আপনি চিন্তা করছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
ছাই হবে। দুদিন সময় নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত আপনার মায়ের কথা বলল। আপনি আমার সঙ্গে চলুন না!
কোথায় যাব?
স্কুলে। আপনি বললে হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না।
আমি একটু ভাবি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মা রাজি হলে যেতে পারি। তা ছাড়া মা চাইলে হেডমিস্ট্রেসকে ফোনও করতে পারেন। আমি এই প্রথম শুনলাম, বাবা বিরোধী পার্টি করে বলে মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হচ্ছে। কী ভয়ংকর অবস্থা। অর্ক বলল।
মহিলা গলা নামাল, আমি সুরেন মাইতির কাছেও গিয়েছিলাম।
ও। কী বললেন তিনি?
প্রথমে খুব খেপে গেলেন ও কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গিয়েছে বলে। বললেন, কংগ্রেসে ছিল, ওটা থাকা আর না থাকা তো একই কথা, কিন্তু কোন আকেলে তৃণমূলে গেল? এ তো আমাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামা! আমি বললাম, এ কথা কেন বলছেন। আমি বা আমরা কি কখনও আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি? তা ছাড়া ও তো কোনওভাবে রাজনীতি করে না। বস্তিতে কখনও কি দেখেছেন আপনাদের বিরুদ্ধে মিটিং করতে? আপনার ওপরই ভরসা করি।
অর্ক হাসল, কী বললেন তিনি?
অনেক বলার পর একটু নরম হলেন। বললেন, স্কুলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন। একদিন সন্ধেবেলায় ওঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে যেতে হবে।
গিয়েছিলেন?
না না। ওকথা বলার সময় উনি যেভাবে তাকিয়েছিলেন তারপর যেতে সাহস হয়নি। মেয়েরা পুরুষের কিছু কিছু চাহনি চিনতে পারে। মহিলা আবার জোরে শ্বাস ফেলল, বুকের আঁচল টানল। অর্ক বুঝল ওটা ওর অভ্যেস।
ঠিক আছে তা হলে? অর্ক কথা শেষ করতে চাইল।
আপনি এখানে এখন একাই থাকেন?
একা কোথায়? আমার এই বন্ধু তো আছেন।
ও। রান্না করেন আপনারা?
দুর। যা করি তাকে রান্না বলে না!
আমি তো বস্তির ওপাশে থাকি। মাঝে মাঝে এসে একটা-দুটো পদ যদি বেঁধে দিই তা হলে নিশ্চয়ই না খেয়ে ফেলে দেবেন না!
তার কোনও দরকার নেই।
মহিলা উঠে দাঁড়াল, আমার নাম নিশ্চয়ই আপনার মনে নেই? অর্ক বলল, অলকা। ওই বুড়ি আগেই বলেছিল।
ওঃ, ওই বুড়ি আপনার কান ভারী করেছে, মহা শয়তান বুড়ি। শুধু ওইখানে বসে শকুনের মতো চারপাশে খুঁটিয়ে দেখে। আমাকে বলে কিনা, ভগবান তোমাকে এমন শরীর দিয়েছে, এই বস্তিতে পড়ে আছ কেন? ও যাই বলুক আমি কিন্তু ওরকম না। আমার পুরো নাম হল অলকা দাস, মেয়ের নাম করিনা দাস। হাসল অলকা।
করিনা? এ তো অবাঙালি নাম!
আজকাল আর বাঙালি অবাঙালির পার্থক্য নেই। আপনি তা হলে আজই মাসিমার সঙ্গে কথা বলবেন, চলি। যেতে ইচ্ছে ছিল না তা বুঝিয়ে অলকা চলে গেল।
দরজা বন্ধ করে অর্ক রামজির দিকে তাকাল, এই মহিলা যা বলে গেল তার কিছু বোঝা গেল? হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল সে।
রামজি কাধ নাচাল, না।
না বোঝাই ভাল। কিন্তু রামজি, একটা ঘোঁট পাকছে আপনাকে নিয়ে। তৃণমূল তত বলেছে, এখন সিপিএমও খোঁজ নিচ্ছে। আমার মনে হয় আর দেরি না করে হলদিয়াতে চলে যাওয়াই ভাল। অর্ক বলল।
মাথা নাড়ল শ্রীরাম। কিন্তু বোঝা গেল সে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
.
শেষ পর্যন্ত রামপ্রকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল শ্রীরাম। তখন অনেক রাত। অর্ক ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে বসে কথা বলছিল শ্রীরাম। রামপ্রকাশ বলল, এখনই এখানে আসা ঠিক হবে না। মোবাইলে কম কথা বলা ভাল। তুমি কয়েকটা দিন তালসারিতে গিয়ে থাকো। ওখানে শ্রীনিবাস আছে। সাত নম্বরটা কল্পনা করে নেবে। তার কয়েক মিনিট পরে এসএমএস এল–নাইন ফোর ড্যাশ, থ্রি টু ড্যাশ, ওয়ান ওয়ান, ড্যাশ, ড্যাশ।
ড্যাশের জায়গায় সাত বসিয়ে নাম্বারটা মুখস্থ করে ফেলল রামজি। তারপর এস এম এস মুছে ফেলে আর একটা নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হচ্ছে। এখন রাত দুটো। কিন্তু লোকটা সাড়া দিল। শ্রীরাম বলল, শ্রীনিবাসের কাছে যাওয়ার অর্ডার হয়েছে।
বাসে যাও। দিঘার বাসস্ট্যান্ডে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে। হাতে সাদা রুমাল রেখো। লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। শ্রীরাম বুঝতে পারে না সবাই এত সতর্ক কেন? এই রাত্রে কে জেগে থেকে যত মোবাইল ফোন হচ্ছে তার সবগুলোর কথা শুনবে। সে বিড়ি ধরাল। অর্ক বলেছে বিড়ির পোড়া অংশ যেন এক জায়গায় জমা করে রাখে। একটা ভাঁড় সংগ্রহ করে নিয়েছিল সে ওই কারণে।
ভোর চারটের সময় অর্ককে ঘুম থেকে তুলল সে, আমি চলে যাচ্ছি।
এখন? এই রাত্রে? অর্ক একটু বিরক্ত।
রাত কোথায়? ভোর হয়ে আসছে। দিনের আলোয় যেতে চাই না।
কিন্তু এখন হলদিয়াতে কীভাবে যাবেন? এত সকালে কি বাস পাবেন?
হলদিয়াতে যাচ্ছি না। তালসারি নামের এক জায়গায় যাব। ওটা কোথায় তা আপনি কি জানেন? শ্রীরাম তার জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
মনে পড়ছে না।
দিঘা কোথায়? সমুদ্রের ধারে, না?
হ্যাঁ। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কোথায় যেন পড়েছি। তালসারিও সমুদ্রের ধারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ওড়িশায়। দিঘা হয়ে যেতে হয়। অর্ক বলল।
সেইজন্য আমাকে দিঘায় যেতে বলা হয়েছে।
এখান থেকে বেরিয়ে ট্রাম পেয়ে যাবেন। হাওড়া স্টেশনের পাশ থেকে দিঘার বাস ছাড়ে। মনুমেন্টের ওখান থেকেও পেতে পারেন।
আপনি দয়া করে সাহায্য করবেন?
কী করতে হবে, বলুন।
মুখ ধুয়ে নিন। আমাকে একটু এগিয়ে দিন। এখন রাস্তায় লোক থাকবে না। একা হেঁটে যেতে চাই না। রামজি বলল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পকেটে কয়েকটা টাকা নিয়ে অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রামজি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ক অনেকদিন পরে শুকতারা দেখতে পেল। দরজায় তালা দিয়ে কয়েক পা হাঁটতেই কণ্ঠস্বর কানে এল, কে যায়?
অর্ক জবাব না দিয়ে আধা অন্ধকারে রামজির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল, বুড়ি চেঁচিয়ে বলছে, আ মরণ, কথার জবাব দেয় না যে, মর, মর! অর্ক হেসে ফেলল।
ঈশ্বরপুকুর লেনের আলোগুলো এখন হলদেটে। দু-তিনজন মানুষ ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। এখনও ঘুম সর্বত্র জড়ানো। রামজির পাশাপাশি হাঁটছিল অর্ক। সে মুখ তুলে দেখল মোড়ের বড় বটগাছটায় এখনও অন্ধকার সেঁটে আছে। রামজি নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, এখন ট্রাম পাব তো?
প্রথম ট্রাম তো এই সময় ডিপো থেকে বের হয়। অর্ক জবাব দিল।
গলি থেকে বের হতেই চোখে পড়ল ভ্যানটাকে। অর্ক কিছু বলার আগেই রামজি জিজ্ঞাসা করল, ভ্যানের পাশ দিয়ে যেতে হবে নাকি?
হ্যাঁ, চলুন। জিজ্ঞাসা করলে বলব আর জি কর হাসপাতালে যাচ্ছি।
সেটা কোথায়?
ব্রিজ পার হয়ে ডান দিকে। নিশ্চয়ই দেখেছেন। আপনি কথা বলবেন না। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল। ভ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে কোনও পুলিশকে দেখতে পেল না। এমনকী ড্রাইভারও সিটে বসে নেই।
ডিপোর মুখে ট্রামস্টপে দাঁড়াল ওরা।
হাওড়া স্টেশনের কতদুরে বাসস্ট্যান্ড? রামজি জিজ্ঞাসা করল।
একদম গায়ে। বলামাত্র ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক। ডিপো থেকে বেরিয়ে আসছে সামনে আলো জ্বেলে। রামজি তৈরি হচ্ছিল ওঠার জন্যে। অর্ক বলল, এটা এক নম্বর ট্রাম, এসপ্ল্যানেড যাচ্ছে, হাওড়ায় নয়।
ও। পিছিয়ে এল রামজি।
আচ্ছা, উঠুন। ট্রাম দাঁড়াতেই রামজির সঙ্গে উঠে পড়ল অর্ক।
একদম ফাঁকা ট্রাম। সামনের দিকে বসে রামজি জিজ্ঞাসা করল, আপনি উঠলেন কেন? আমি নিজেই যেতে পারতাম।
নিশ্চয়ই পারতেন। হঠাৎ মনে হল, এখন ফিরে গেলে আর কেউ না দেখুক, ওই বুড়ি চেঁচাবে। অত ভোরে আমি বেরিয়েই কেন ফিরে এলাম তা নিয়ে বস্তির মানুষের কৌতূহল বাড়বে। যদি কেউ এর মধ্যে জেগে বাইরে আসে সে জানতে চাইবে কোনও বিপদ হয়েছে কিনা! তার চেয়ে একটু বেলা করে ফেরাই ভাল। কেউ প্রশ্ন করবে না। অর্ক বলল।
রামজি হাসল, আপনি তত খুব ভাবেন।
অর্ক কথা বলল না। ট্রাম তখন খাল পেরিয়ে শ্যামবাজারের দিকে ছুটছে। অর্ক লক্ষ করল এখনকার ট্রামের চলনের সঙ্গে দিনের অন্য সময়ের ট্রামের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এখন ঝড়ের মতো ছুটছে ট্রাম, স্টপে লোক না থাকলে দাঁড়াবার প্রয়োজন বোধ করছে না। গোটা দিনে যদি ট্রাম এইরকম রাস্তা পেত।
একবার তালসারিতে আসুন। সমুদ্রের গায়ে যখন তখন ভাল লাগবে। রামজি কথাটা বলতেই ওর দিকে তাকাল অর্ক। বলার ভঙ্গিতে বেশ আন্তরিকতা রয়েছে। হঠাৎ প্রশ্নটা করে ফেলল সে, কিছু মনে করবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, হাজারিবাগ ছাড়ার পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
রামজি হাসল, আমি হাজারিবাগ থেকে এসেছি কিন্তু আমার বাড়ি ওখানে নয়। আমি দুমকার লোক। বাবা-মা মারা গিয়েছেন, এক বোন আছে জামসেদপুরে। ম্যারেড। তাকে অনেকদিন দেখিনি।
তা হলে হাজারিবাগে কী করতেন?
ট্রেনিং। বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল রামজি। হেদুয়ার স্টপ থেকে কয়েকজন ট্রামে উঠে নিজেদের মধ্যে উঁচু গলায় কথা বলতে লাগল। অর্ক বুঝল এরা সবাই ময়দানে যাচ্ছে হাঁটার জন্যে। সামনে পেছনে ওরা বসতেই রামজি গুটিয়ে গেল। কন্ডাক্টর এলে টিকিট দুটো কাটল অর্ক।
এসপ্ল্যানেডের ট্রামডিপো থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজ নিতেই জানা গেল ঠিক পাঁচটার সময় দিঘার বাস ছাড়ছে। সাধারণ চেহারার প্রাইভেট বাস, ভাড়া কম। অর্ধেকও ভরতি হয়নি, রামজি নিজের টিকিট কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়ল, সিটে বসে হাত নাড়ল।
কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়াবার পরে অর্ক দূরে চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। এখন কলকাতায় অন্ধকার সরে গিয়ে ছায়া নেমেছে, সূর্য ওঠেনি। চায়ের দোকানে ভিড় জমেনি। আড়াই টাকায় এক ভাঁড় চা কিনে চুমুক দিতে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হল।
দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? পাশ থেকে একজন প্রশ্ন করলে অর্ক তাকাল, লোকটা একদম অচেনা। বলল, কোথাও না।
কাউকে কি ছাড়তে এসেছেন?
কী ব্যাপার বলুন তো?
না না কোনও ব্যাপার নয়। চারধারে প্রচুর খোচড় ঘুরছে তো। দেখে মনে হল আপনি ভদ্রলোক, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। লোকটা বেশ দ্রুত সরে পড়ল। দিঘার বাস বেরিয়ে গেছে। চা শেষ করে ভাঁড়টা একটা টিনে ফেলতেই চা-ওয়ালা বলল, আপনাকে কী বলছিল?
এখন খদ্দের মাত্র গোটা চারেক। অর্ক হেসে বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি, কাউকে ছাড়তে এসেছি কিনা, যত ফালতু প্রশ্ন।
এই হয়েছে মুশকিল। লোকটা পুলিশ। পাঁচজনের দল রোজ ভোরে আসে। একটু সাবধানে যাবেন। চা-ওয়ালা মাথা নাড়ল।
অর্ক শক্ত হল। লোকটা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে রামজিকে দেখেছে। তা না হলে জিজ্ঞাসা করবে কেন কাউকে ছাড়তে এসেছে কিনা! লোকটা কি রামজিকে সন্দেহ করেছে? একবার মনে হল রামজির মোবাইলে ফোন করে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু মোবাইলের সুইচ অফ থাকাই স্বাভাবিক।
কিছুই হয়নি এমন ভাব করে শিয়ালদার ট্রাম ধরতে এগোল সে। লোকটা যদি তাকে অনুসরণ করে তা হলে কিছুতেই বেলগাছিয়ার হদিশ যেন না পায়। এই সময় হকাররা ভোরের খবরের কাগজ নিয়ে হইহই করে চলে এল। একজন চেঁচিয়ে বলছিল, জোর খবর, জোর খবর, নন্দীগ্রামে জোর আন্দোলন চলছে। মাটি ছাড়বে না মানুষ। জোর খবর।
একটা কাগজ কিনে নিয়ে শিয়ালদার ট্রামে উঠল অর্ক।
.
২৮.
ট্রামের জানলার পাশের সিটে বসে খবরের কাগজ খুলল অর্ক। প্রথম পাতা জুড়ে নন্দীগ্রামের খবর। মুখ্যমন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঘোষণা করেছেন, নন্দীগ্রামের মানুষদের সম্মতি ছাড়া সেখানকার জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, কিন্তু এই ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারছেন না গ্রামের মানুষ। সিপিএমের সঙ্গে ভূমিরক্ষা কমিটির সংঘাত মাঝে মাঝেই হচ্ছে। এই প্রথমবার গ্রামের মানুষ সিপিএমের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। সংঘর্ষে সিপিএম কর্মীরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলেও মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না। মাটি যাদের কাছে মায়ের মতো তারা কিছুতেই বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়। পুলিশ শান্তি স্থাপনের জন্যে গ্রামে ঢুকতে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না, কারণ মাটির পথগুলোকে গ্রামবাসীরা কেটে রেখেছে। গাড়ি ঢুকতে পারছে না। এই অগ্নিগর্ভ পরিবেশকে শান্ত করতে বামফ্রন্ট সরকার এখনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এই অবস্থায় তৃণমূলনেত্রীর সমর্থন পাওয়ায় জমি রক্ষা কমিটি নতুন উদ্যমে প্রস্তুত হচ্ছে।
অর্কর পাশে এসে বসলেন একজন ভদ্রলোক। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে বললেন, আবার একটা ঝামেলা–!
অর্ক কোনও মন্তব্য না করে কাগজটাকে ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল মৌলালির মোড়ে। এই লোকটা পুলিশের লোক কিনা তা কে জানে?
বাসস্টপে মানুষ নেই। বেলগাছিয়ার বাস আসতেই উঠে পড়ল অর্ক। সে নিশ্চিত, কেউ এখন তাকে অনুসরণ করেনি। দু-তিন জন যাত্রী নিয়ে বাস যাচ্ছিল শামুকের গতিতে। অর্ক এবং আর একজন যাত্রী জোরে চালাতে বললেও বধিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল কন্ডাক্টররা। বাসের চালক সম্ভবত আধঘুমে। শেষ পর্যন্ত প্রচুর সময় নিয়ে শ্যামবাজার ইলেকট্রিসিটি অফিসের সামনে এসে বাস থেমে গেল। ড্রাইভার দু-তিনবার ইঞ্জিনে শব্দ করে বেরিয়ে এল, বাস খারাপ হয়ে গেছে। নেমে যান।
ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত বোঝা গেলেও কিছু করার নেই। অর্ক নেমে পড়ল। অন্য যাত্রীটি নাছোড়বান্দা। তিনি বেলগাছিয়াতে যাওয়ার জন্যে বাসে উঠেছিলেন। আবার আর একটা বাসের ভাড়া দেবেন না। অর্ক হেঁটে চলে এল শ্যামবাজারের মোড়ে। আজ পর্যন্ত ছুটি নেওয়া আছে, কাল অফিসে যেতে হবে। সে নেতাজির মূর্তির দিকে তাকাল। মাত্র সত্তর বছর আগেও ভদ্রলোক বেঁচে ছিলেন এখানে। তখনকার মানুষের সঙ্গে এখনকার মানুষের কী বিপুল পার্থক্য হয়ে গেছে। এখনকার কোনও মানুষের মূর্তি বড় রাস্তায় ওইভাবে বসিয়ে পঞ্চাশ বছর পরের জনতা দেখতে চাইবে? অনেক ভেবেও সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কারও নাম মনে এল না।
ওমা! আপনি এখানে?
মহিলার গলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অলকাকে দেখতে পেল অর্ক। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে বলল, কাজে এসেছিলাম।
এই, অ্যাত্তো সকালে! চোখ বড় করল অলকা।
অর্ক জবাব না দিয়ে ভাবল ট্রাফিক সিগন্যাল বদলে গেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে বাস ধরবে। অলকা বলল, আপনি তো অদ্ভুত মানুষ!
কেন? না জিজ্ঞাসা করে পারল না অর্ক।
একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না আমি এই সময় এখানে কেন!
নিশ্চয়ই কোনও দরকারে এসেছেন। অর্ক বলল।
উঃ। আমার মেয়ের বাবা রাতে বাড়ি ফেরেননি। মেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে দেখে ওর অফিসের একজনের বাড়িতে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম তিনি নাকি মেদিনীপুরে গিয়েছেন। অথচ বাসায় বলে যাওয়ার কথা মনে রাখেননি। ভাবুন, আমার সকাল থেকে চা খাওয়াও হয়নি।
মেদিনীপুরে যদি কেউ থাকেন তা হলে ফোনে খবর নিতে পারেন।
কেউ থাকে না। ওর বাপ, চৌদ্দ পুরুষ বরিশালের। ও হ্যাঁ, আজ কী হয়েছিল বলুন তো? আপনি কখন বেরিয়েছেন? অলকার মনে পড়ে গেল যেন!
কেন? কিছুই তো হয়নি। অর্ক বলল।
বাপ রে! বুড়ির চিৎকারে সমস্ত বস্তি জেগে উঠেছিল। সবাই ভিড় করে গেল আপনাদের গলিতে। লোক ছুটল সুরেন মাইতিকে ঘুম থেকে তুলতে। ওই বুড়িকে বিশ্বাস নেই। কল্পনা করে নিয়ে যা মনে আসবে তাই বলবে। চোখে হাসি ছড়িয়ে মুখ ঘোরাল অলকা।
সর্বনাশ। বুড়ি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল ঠিকই কিন্তু চলে আসার পরে বস্তিতে যে লোক জমা করবে তা ভাবেনি অর্ক! কিন্তু বুড়ি কি তাদের উদ্দেশে এইসব করেছে। বস্তিতে ফিরে যাওয়ার আগে জানলে সাবধান হওয়া যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কী হয়েছিল তা জানেন?
উঁহু! ভীষণ চা-তেষ্টা পেয়েছে। একা একা দোকানে ঢুকে চা খেতে খুব সংকোচ হয়। কটা মেয়ে একা চা খেতে পারে বলুন। আপনি সঙ্গে থাকলে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে!
কিন্তু এই সকালে তো চায়ের দোকান খোলেনি!
খুলেছে। ওপাশের একটা দোকান খুলে গেছে।
ঘটনাটা জানার জন্যেই অলকার পাশে হেঁটে সেই দোকানটায় ঢুকল অর্ক। চায়ের অর্ডার দিল অলকাই। জিজ্ঞাসা করল, শিঙাড়া আছে?
না নেই। লোকটা চলে গেল।
মুখোমুখি বসে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে বলুন তো?
বলছি। মাসিমার সঙ্গে কথা হয়েছে?
মাসিমা–!
ওঃ। আপনি তা হলে মাসিমাকে ফোন করেননি? আমার মেয়ের ভরতির ব্যাপারটা একদম ভুলে গেলেন?
মায়ের ফোন বন্ধ ছিল। একটু বেলা হলে করব। বলুন!
আমি তো বিছানা ছেড়ে ওই ভিড়ের মধ্যে যাইনি। চিৎকার কানে আসছিল। পরে ঘুম থেকে উঠে পাশের ঘরের স্বস্তিকার কাছে শুনতে পেলাম বুড়ি নাকি শেষ রাত্রে দুজন লোককে দৌড়ে বস্তি থেকে বের হতে দেখেছে। বুড়ি তাদের থামতে বললেও তারা থামেনি। অল্প আলোয় বুড়ি তাদের স্পষ্ট দেখতে পায়নি। নিশ্চয়ই কারও সর্বনাশ করে গেছে ভেবে সে তোক জড়ো করেছে।
তারপর? অর্ক শ্বাস চাপল।
সুরেন মাইতি আসার আগেই বিশ্বজিৎ এসে গিয়েছিল। ওকে চেনেন তো? এখন তৃণমূলের নেতা হয়েছে। আমার স্বামী আর ওর একই পার্টি। দেখা হলেই বউদি বউদি করে ভাব জমাতে আসে। মরণ! কথা থামিয়ে চায়ের কাপ টেনে নিল অলকা। আলতো চুমুক দিয়ে বলল, ওই বিশ্বজিৎ নাকি সবাইকে বলেছিল যে যার ঘর পরীক্ষা করে দেখুন কিছু চুরি গিয়েছে কিনা! সেটা করে যখন কেউ কান্নাকাটি করল না তখন কয়েকজন ছুটল ট্রামরাস্তার দিকে, যদি লোকগুলোকে পাওয়া যায়। কিন্তু খানিকক্ষণ পরে তারা ফিরে এসে যখন বলল কাউকে দেখা যায়নি তখন গুলতানি শুরু হল। কেউ বলল, বুড়ি স্বপ্ন দেখেছিল, কেউ বলল বুড়িকে ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে যেন এরকম চেঁচামেচি করে পাবলিকের ঘুম না ভাঙায়। অলকা চা খেল।
অর্ক একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, আমার কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন কেন?
আরে তারপরই তো সুরেন মাইতি এল, সব শুনে প্রথমে আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেল। গিয়ে দেখল বাইরের দরজায় তালা ঝুলছে। অথচ কেউ বলতে পারল না আপনি কোথায় গিয়েছেন। আপনি যে বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন, ওই বাড়িতে আপনার বন্ধু ছিল, এ কথা সবাই জানে। তা হলে গেলেন কোথায় আর কখন গেলেন? কেউ মনেই করতে পারল না আপনাদের যেতে দেখেছে কিনা! তবে আপনাদের বাড়িতে চুরি হবে না, হলে বাইরের দরজায় তালা থাকত না। চা শেষ করতে গিয়ে থমকে গেল অলকা, এ কী! চা খাচ্ছেন না কেন?
খাচ্ছি। কাপ তুলল অর্ক।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? অলকা তাকাল।
আপনি তো পাড়ার কারও সঙ্গে মেশেন না। কেন?
চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ক হাসল, সময় পাই না।
আপনি কি সবসময় এইরকম কম কথা বলেন?
কী জানি!
আমি কথা না বলে থাকতে পারি না। অলকা বলল, হ্যাঁ, সংসার চালানোর জন্যে মাসের প্রথমে ঠিকঠাক টাকা আমায় স্বামী দেন। কিন্তু সমস্ত ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হয়। তিনি তো টাকা দিয়েই খালাস। মেয়ের পড়াশোনা থেকে বাজার-রান্না এক হাতে করতে হয় আমাকে।
অর্ক মুখ তুলে তাকাল, ও!
এখন আমাদের সম্পর্ক দাদা-বোনের মতো। অলকা বলল।
সেটা খারাপ নয়। অর্ক গম্ভীর মুখে বলল।
আপনি অদ্ভুত লোক তো! মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যাই। বাবা নেই কিন্তু বউদির কথা ভেবে যেতে পারি না। ও হ্যাঁ। যে কথা বলছিলাম, আমি তো কথা না বলে থাকতে পারি না। মেয়ের বাবা বলত আমি নাকি বড় বেশি কথা বলি। কিন্তু একটা কথা কখনও বলিনি তাকে। অলকা হাসল।
ওঁকে যখন বলেননি তখন মনে রেখে দেওয়াই ভাল।
কিন্তু আমি যে সমস্যায় পড়েছি। বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে ভাবতে হত না। দাদা-বউদিকেও বলা যাবে না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?
দেখুন, আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার হলে আমাকে বলবেন না। আমার সঙ্গে আপনার মাত্র দুদিন কথা হয়েছে, কেউ কাউকে চিনি না–
শুনুন মশাই, অবিবাহিতা মেয়েরা অনেক সময় অন্ধ হয় কিন্তু যে বিবাহিতা মেয়েকে সব সামলাতে হয় সে মানুষ চিনতে ভুল করে না।
অলকার কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল অর্ক, বেশ, বলুন।
বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার নামে কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন কাউকে না জানাতে। অলকা বলল।
বাঃ, ভাল কথা।
কিন্তু সময়টা শেষ হয়ে গিয়েছে। টাকাটাও দ্বিগুণ হয়েছে। অলকা বলল, মেয়ের বাবা ব্যাপারটা জানেই না। আমি এখন বুঝতে পারছি না ওই টাকাটা নিয়ে কী করব?
আপনার বাবা বলেছিলেন কাউকে না জানাতে, আমাকে জানালেন কেন?
বললাম না সমস্যায় পড়েছি, মাথায় কিছু ঢুকছে না।
আপনি সমস্যা ভাবছেন তাই–আসলে কোনও সমস্যাই নেই। ব্যাঙ্কে গিয়ে আবার পুরো টাকাটাই এমন সময়ের জন্যে ফিক্সড করে দিন যাতে অঙ্কটা আরও বেড়ে যায়। আপনার মেয়ে যখন বড় হবে তখন ওর পড়াশোনার প্রয়োজনে খরচ করবেন। অর্ক বলল।
হাসি ফুটল অলকার মুখে। বলল, ঠিক বলেছেন, ওর দাদুর টাকা ওর পড়াশোনায় লাগুক। আর একটা কথা, বাবার কথা আমি পুরোটা অমান্য করিনি।
মানে?
উনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে। আমি পুরোটা বলিনি। উনি কত টাকা আমার নামে রেখেছিলেন তা কি আপনি জানেন?
না।
ব্যস। কথা রাখা হয়ে গেল।
হেসে ফেলল অর্ক। তার মনে হল অলকা আদৌ জটিল নয়। চায়ের দাম দিয়ে অর্ক বলল, আপনি এখোন, আমি পরে যাব।
উঁহু। আপনি আগে যান, আমি বাজার করে বাসায় যাব। অলকা উঠে দাঁড়াল, মনে করে ফোন করবেন কিন্তু।
করব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই বাস পেয়ে গেল অর্ক। খালি বাস। উঠেই বসে পড়ল সে। জানলার বাইরে তাকাতেই পাঁচ মাথার মোড়ে মানুষের চলাফেরা নজরে এল। এইসব মানুষ প্রত্যেকেই সমস্যা নিয়ে চলাফেরা করছে। আলাদা আলাদা সমস্যা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখে একটা ছোট বাজার প্রতি সকালে বসে। সেখান থেকে আলু পেঁয়াজ আদা রসুন আর ডিম কিনে নিল অর্ক। একদম টাটকা পাবদা মাছ চোখে পড়তে এক মুহূর্ত থমকে ছিল সে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ! মাছ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে যদি ফেলে দিতে হয়! তার চেয়ে যেটা পারে সেটা করাই ভাল।
বস্তির মুখে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকদিন আগেও ছেলেটাকে প্রকাশ্যে কথা বলতে দেখা যেত না। নন্দীগ্রামের আন্দোলন এবং তৃণমূলের সক্রিয় সমর্থনের পর কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা বিশ্বজিতের সাহস বোধহয় একটু বেড়েছে। এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছে সে। অর্কর অনুমান, সিপিএম পার্টি ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
বাজার করে এলেন? বিশ্বজিৎ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।
প্ল্যাস্টিকের থলে একটু ওপরে তুলে অর্ক বলল, যদি এটাকে বাজার বলা যায়! খেতে হবে তো!
মাসিমারা কবে ফিরবেন? তদ্দিন তো আপনাকেই রাঁধতে হচ্ছে!
ফিরবেন। তবে দিন ঠিক হয়নি।
আপনাদের দরজায় তালা দেখলাম। গেস্ট চলে গেলেন?
হ্যাঁ। আজ ভোরের বাসে চলে গেল। ওকে পৌঁছাতে গিয়েছিলাম।
দেখুন কাণ্ড!
কেন? কী হয়েছে? প্রশ্ন করার ফাঁকেই অর্ক দেখছিল তাদের আশেপাশে মানুষ জমছে।
আরে, আপনাদের গলির ওই বুড়ি, ভোররাতে চিৎকার করছিল, বস্তিতে চোর ঢুকেছে। কারও কিছু চুরি যায়নি কিন্তু বুড়ি নাকি স্পষ্ট দেখেছে দুটো লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার ঠিক আছে শুধু আপনাদেরটা জানা হয়নি, কারণ দরজায় তালা রয়েছে। তালা যখন ভাঙেনি তখন ভেতরে চোর ঢুকবে কী করে? তখন কথা উঠল, আপনারা গেলেন কোথায়? বিশ্বজিৎ বলল।
তারপর? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
আমি বললাম, উনি কোথায় যাবেন তা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাঙালি সবচেয়ে ভালবাসে সন্দেহ করতে। হঠাৎ বড়দাদা হাওয়ায় কথা ভাসালেন। আপনার মা-বাবা আজ ফিরে আসছেন বলে গেস্টকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছেন। কারণ হল, আপনার গেস্টকে ওঁরা একদম পছন্দ। করবেন না। ছেলের গেস্টকে অপছন্দের কারণ কী? এই নিয়ে জল্পনা চলেছে। আপনি যান, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ নাক গলাক তা আমরা চাই না। বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল বিশ্বজিৎ।
গলিতে ঢুকল অর্ক। বুড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গলা ভেসে এল, অই তো। এসে গেছ? কখন গেলে তা তো দেখলাম না। তোমার বাড়ির সেই উটকো লোকটাও নাকি আর নেই। দেখো, চুরি করে পালাল কিনা!
.
ডিমের ঝোল মোটামুটি ম্যানেজ করতে পারে অর্ক। সেটা নামাতেই বাইরের দরজায় শব্দ হল। সাড়া দিয়ে গেট খুলতেই সুরেন মাইতির হাসিমুখ দেখতে পেল অর্ক। পেছনে দুটো চামচে দাঁড়িয়ে আছে।
আরে! আপনি? আসুন। অর্ক সরে দাঁড়াল।
চামচেদের ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকল সুরেন মাইতি। চার পাশে তাকিয়ে বলল, এই বস্তিতে এরকম বাড়ি আর একটাও নেই। নিজস্ব উঠোন, দুটো শোওয়ার ঘর, কিচেন, টয়লেট, বারান্দা। ওটা কী গাছ?
ডুমুর।
অদ্ভুত গাছ। ফুল হয় না কিন্তু ফল হয়। ইন্টারেস্টিং। বারান্দায় চেয়ার এগিয়ে দিতে সুরেন মাইতি বসল, তা হলে আপনার মা-বাবা আজ ফিরছেন? ভাল ভাল।
অর্ক হাসল, এখনও ফেরার দিন ঠিক হয়নি।
তাই নাকি? ও। তা হলে আপনার গেস্টকে তো কদিন থাকতে বলতে পারতেন।
কেউ না থাকতে চাইলে তাকে কি জোর করে রাখব?
তা বটে। থাকতে চাইল না কেন?
ওর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।
কোথায় যেন বাড়ি?
হাজারিবাগে।
ওইসব অঞ্চলে তো মাওবাদীরা থিকথিক করছে।
আমি যাইনি কখনও–
আরে জানতে গেলে কি সবসময় যেতে হয়? রানিগঞ্জে যে কয়লা পাওয়া যায় তা জানতে কি লোকে সেখানে যায়! মুশকিল কী জানেন, এই মাওবাদীরা ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দলে দলে চলে আসছে কলকাতায়। লুকিয়ে থাকার জন্যে এমন চমৎকার শহর তো ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে না। এসে মিশে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে। আর সেই কাজটা সহজ করে দিচ্ছে এই শহরের কিছু বাঙালি। তাদের মধ্যে লেখক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তারও আছেন। যে-কোনও দিন এরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করতে পারে।
কী যা তা বলছেন! অর্ক প্রতিবাদ করল।
বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এরাই গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে একটা রাজনৈতিক দলের মদতে। সেই দলের সবাই উপনেতা, একজনই প্রধান নেত্রী। তিনি তো বলেই দিয়েছেন মাওবাদী বলে কিছু নেই। পড়েননি? তা হলে গ্রামে খুন করছে কারা? আকাশ থেকে খুনিরা নামছে? যাক গে, আপনার বাড়িতে যে ছিল আশা করি সে মাওবাদী নয়। সুরেন মাইতি কথা শেষ করে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল অর্ক। মা বলত, মধ্যবিত্তরা প্রতিবেশীর সম্পর্কে বেশি আগ্রহী হয়। উচ্চবিত্ত এবং বিত্তহীনরা এই ব্যাপারে একদম উদাসীন। মা তাই এই বস্তিতে চলে এসেছিল। তা হলে কি সময়টা বদলে গিয়েছে?
.
২৯.
গত সন্ধ্যায় দেবেশ ফোন করেছিল। বলেছিল, কোনও অজুহাত শুনব না, কাল সকালে আমার এখানে চলে আয় তোরা। সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে ফিরে যাবি।
ফোন বন্ধ করে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলতেই তার মুখে হাসি ফুটল, গেলে খারাপ হয় না। একটা অন্যরকম দিন কাটবে।
কিন্তু মিস্টার রায় যদি ডেকে পাঠান। উইলের প্রবেট নিতে নিতে মাস আটেক লাগবে, প্রবেটের ফি-ও দিতে হবে। মিস্টার রায় তাই চাইছেন ছোটমা একটা এফিডেবিট করুন যাতে তিনি বলবেন বাবার সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী তিনি। দরকার হলে কোর্ট থেকে সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। আর এইসবের জন্যে যদি বলেন আগামীকালই দেখা করতে হবে, তা হলে? অনিমেষ মাথা নাড়ল।
আশ্চর্য! তোমার কী হয়েছে বলো তো? শুনেছি নীরদ সি চৌধুরী একশো বছর বয়সেও অবাস্তব কথা বলতেন না। তোমার এখনই সেটা হয়ে গেল! মাধবীলতা বলল।
কী বলতে চাইছ? বিরক্ত হল অনিমেষ।
এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আমি হলে মিস্টার রায়কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম আগামীকাল তিনি আমাদের ডাকবেন কিনা! ওঁর উত্তরটা দেবেশবাবুর ওখানে যাওয়া বা না যাওয়াটা সহজ করে দিত।
অনিমেষ শ্বাস নিল, সত্যি! আমার মাথায় এত খেলে না! মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করে মাধবীলতার কথাগুলো বলতেই মিস্টার রায় হাসলেন, আমি ডাকলেও কোনও কাজ হবে না। কাল কোর্ট মহরমের জন্যে বন্ধ।
শুনে মাধবীলতা বলল, হল তো?
তুমি জানতে কাল মহরম? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
স্কুলে যখন চাকরি করতাম তখন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের ধর্মীয় কারণে যেসব দিন ছুটি বলে ঘোষণা করা হয় তার হিসেব রাখতাম। তা হলে আমরা যাচ্ছি। শোনো, ওঁকেও নিয়ে যাব। মাধবীলতা উঠে পড়ল।
যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি জোগাড় করতে হবে।
দেবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করো। উনি স্থানীয় মানুষ, সস্তায় ব্যবস্থা করবেন।
ছোটমা তখন ঠাকুরদের রাত্রের জন্যে বিশ্রাম দিয়ে প্রণাম করে উঠেছেন, মাধবীলতা দরজায় এসে দাঁড়াল। ছোটমা বললেন, কিছু বলবে?
ওর বন্ধু দেবেশের কথা বলেছিলাম আপনাকে, ওই যে যার ওখানে সবাই মিলে যাওয়ার কথা হয়েছিল। সে ফোন করেছিল। কাল যাবেন?
মাধবীলতা দেখল ছোটমায়ের মুখটা যেন পালটে গেল। খুশি চেপে রেখে বললেন, গেলেই হয়, কিন্তু–!
কিন্তু কী?
এই বাড়ি পাহারা দেবে কে? ঠাকুর আছেন, তোমাদের জিনিসপত্র আছে। বাগান আছে। সব যে ভোলা পড়ে থাকবে।
দরজায় তালা দিয়ে দেব। আর বাগানে তো নারকেল ছাড়া কিছু নেই।
নেই কী বলছ? শেয়ালছানারা নেই! সাপও আছে। আমরা নেই জানতে পারলে কেউ এসে ওদের মেরে ফেলবে। দেখো। ছোটমা বললেন।
মাধবীলতা অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল। ওই শেয়াল অথবা সাপও ওঁর কাছে এত মূল্যবান হয়ে গিয়েছে। মায়া বড় গভীরে শেকড় ছড়ায়।
মাধবীলতা বলল, ভাড়াটেদের ছোটবউকে বললে হবে না? মাথা নাড়ল ছোটমা, ঘুম থেকে উঠে কাজের চাপে মাথা তুলতে পারে না বেচারা। দুপুরের পর চোরের মতো আমার কাছে আসে। একটা উপায় আছে, লছমন একটু পরে আসবে। ওকে বাতাসা আনতে দিয়েছি। ওকে বলব যদি কাল ওর বউ ছেলেকে এই বাড়িতে আসতে বলে। কিন্তু যদি রাজি হয় তা। হলে ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে তো হবে।
আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ভোরবেলায় উঠে ওদের দুবেলার খাবার করে দিয়ে যাব। সকাল আর দুপুর। বিকেলে তো ফিরেই আসব। মাধবীলতা ছোটমাকে আশ্বস্ত করল।
.
দেবেশই গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। দিনবাজার থেকে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ছেলেটি পৌঁছে গেল সকাল সাতটায়। মাধবীলতা গতরাত্রে বলেছিল, গাড়ির ভাড়া কত দিতে হবে তা জেনে নাওনি, কী যে করো!
অনিমেষ বলেছিল, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও বলেছিল ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে নিতে। দেবেশের পরিচিত, কিন্তু ও তো গাড়ি ভাড়া নেয় না, তাই জানে না।
ওর ওখানে যেতে হলে বাস থেকে নেমে অনেক হাঁটতে হবে?
মাধবীলতার প্রশ্ন শুনে অনিমেষ তাকাল। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না মাধবীলতা টাকার কথা চিন্তা করছে। সে বলেছিল, বাসে যাওয়ার সুবিধে থাকলে দেবেশ গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পরামর্শ দেবে কেন?
মাধবীলতা কথা বাড়ায়নি।
সকালে গাড়ি আসার আগেই বাবা তার মাকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল লছমনের রিকশায় চড়ে। মাধবীলতা দেখল বউটিকে। বিহারের গ্রামের মেয়ে, প্রায় নাক পর্যন্ত ঘোমটা টানা। লম্বা, ছিপছিপে। শাড়ি পরার ধরন এবং রঙে বাঙালিয়ানা নেই।
ছোটমা খুশিমুখে ডাকলেন, আয়, আয়। তোর বর, ছেলে আসে, তুই তো আসিসই না। কী যেন নাম তোর?
লছমন পেছন থেকে বলল, রাধা।
অ্যাঁ। সে তো আয়ান ঘোষের বউ। বলে হাসলেন ছোটমা। তারপর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
মাধবীলতা বলল, ওকে সব বুঝিয়ে দিন।
লছমন মাথা নাড়ল, আমি সব বলে দিয়েছি। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আজ বাবার স্কুল ছুটি। ও মায়ের সঙ্গে থাকবে।
তৈরি হতে আটটা বেজে গেল। দেরি করলেন ছোটমা, বেরোবার সময় একটা না একটা কাজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। ক্রাচ বগলে নিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে গাড়ির পাশে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী নাম ভাই? বছর পঁচিশের ভদ্র চেহারার ছেলেটি হাসল, আমাকে খোকন বলে ডাকবেন।
আচ্ছা। এবার বলো, আমরা কোথায় যাচ্ছি তা কি জানো?
হ্যাঁ। খোকন বলল।
তোমাকে গাড়িভাড়া বাবদ কত দিতে হবে?
কাকাবাবু, আপনারা কতক্ষণ গাড়িটাকে রাখবেন তার ওপর নির্ভর করছে। যদি সারাদিন রাখেন তা হলে তো বেশি পড়বে। আর যদি ড্রপ করে চলে আসি আর ফেরার টাইম বললে নিয়ে আসতে যাই তা হলে অনেক কম চার্জ লাগবে। দুই লিটার তেলের দাম এক্সট্রা দিয়ে দেবেন।
কেন?
দু-দুবার যেতে আসতে হবে যে!
তা হলে দ্বিতীয়টাই করো। অনিমেষ বলল।
পেছন থেকে মাধবীলতা কথা বলল, একটা সমস্যা হতে পারে। যদি কোনও কারণে আমাদের আগেই চলে আসতে হয় তা হলে?
খোকন বলল, চিন্তা করবেন না কাকিমা। আমাকে মোবাইলে ডেকে নেবেন। আমি চলে যাব।
অনিমেষ ছোটমাকে দেখে খুশি হল। এখানে এসে ওঁর পরনে ময়লাটে কাপড়, যা হয়তো কখনও সাদা ছিল তাই দেখে এসেছে। মাধবীলতার অনুরোধ সত্ত্বেও সেগুলো ছাড়তে রাজি হননি। বলেছেন, ঘেঁড়েনি যখন তখন ফেলে দেব কেন? কিন্তু এখন ধবধবে সাদা শাড়ি যার সরু পাড়ে হালকা নীল রং, সাদা জামায় ছোটমায়ের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। মাধবীলতা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, বসুন। অনিমেষ লক্ষ করল, ছোটমায়ের হাতে ভাঁজ করা ঘিয়ে রঙের চাদর রয়েছে।
গাড়িটা মারুতি ওমনি ভ্যান। ড্রাইভারের পেছনে মুখোমুখি সিটে ওরা তিনজন উঠে বসল। বাবা আর তার মা দাঁড়িয়ে ছিল যাত্রা দেখতে। গাড়ি বাড়ি থেকে গলি দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে না গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এদিকে তো জেলা স্কুলে যাওয়া যায়, তুমি তো হাসপাতালের দিকে যাবে।
খোকন বলল, আপনি বোধহয় অনেকদিন আসেননি কাকা। এদিক দিয়ে গেলে রাস্তা কম হয়।
কৈশোরের পরিচিত বাড়িগুলো দেখতে দেখতে অনিমেষ নিজের মনেই বলল, সব একইরকম আছে!
মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
জেলা স্কুলের হস্টেলের পেছন দিয়ে সেনপাড়ার ভেতর দিয়ে খোকন গাড়িটাকে নিয়ে রাজবাড়ির কাছে চলে এল। তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে তিস্তা ব্রিজে উঠে টিকিট কাটল। ছোটমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার বাইরে তাকিয়ে বললেন, এই নদীটা কত বড় ছিল, এখন দেখো, ছোট হয়ে গিয়েছে।
মাধবীলতা বলল, তিস্তা আর নদী কোথায়! জলই নেই। ওই ওপাশে অল্প একটা ধারা। তাও যাচ্ছে কি যাচ্ছে না বোঝা যাবে না!
তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে খানিকটা আসার পর হাইওয়ে ছেড়ে মেঠো রাস্তায় গাড়ি নামল। দুপাশে চাষের খেত, রাস্তাটা গর্তে ভরতি। একটা গোরুর গাড়ি সেটা আটকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলছে। খোকন চিৎকার চেঁচামেচি করেও যখন হুশ ফেরাতে পারল না তখন তার মুখ থেকে একটা অশ্লীল শব্দ ছিটকে বের হল। অনিমেষের মনে হল দুকান দিয়ে গরম সীসে শরীরে ঢুকল। তার সামনে মাধবীলতা এবং ছোটমা বসে আছে। সে চোখ বন্ধ করল যাতে ওদের মুখ দেখতে না হয়। একবার ভাবল খোকনকে খুব ভর্ৎসনা করবে। কিন্তু তখনই গোরুর গাড়ির চালক একপাশে সরে দাঁড়াল। তাকে পেরিয়ে যাওয়ার জায়গা পেয়ে খোকন চিৎকার করল, গালি না দিলে ভাল কথা শুনতে পাও তোমরা?
হঠাৎ অনিমেষের মনে হল, খোকনের উচ্চারণ করা অশ্লীল শব্দটা সে, মাধবীলতা এবং ছোটমা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে থাকলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ড্রাইভাররা গালিগালাজ দিতে অভ্যস্ত এই তথ্যটা মেনে নিলে সব চুকে যাবে।
দোমহনি একটি ক্ষুদ্র জনপদ। ছোটখাটো কিছু দোকান, গরিব মানুষদের ঘরবাড়ি, দু-তিনটে ইট সিমেন্টের দোতলা বলে দিচ্ছে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা আদৌ ভাল নয়। অনিমেষের মনে পড়ছিল, ছেলেবেলায় সে শুনত দোমহনির কথা। বেশ জাঁকজমক ছিল। একটা রেলওয়ে জংশন ছিল।
খোকন, তুমি দেবেশের ওখানে আগে গিয়েছ?
না কাকা। জিজ্ঞাসা করতে হবে। খোকন গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজন প্রৌঢ়কে ডেকে বলল, আচ্ছা, দেবেশবাবুর বাড়ি কোথায়?
দেবেশ? ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল।
অনিমেষের জানলার কাছে মুখ এনে বলল, যিনি এখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম চালান। সাইকেলে ফেরেন।
ও, তা বাড়ি বলছেন কেন? আশ্রম বলুন। ডানদিক ধরে সোজা চলে যান। রেললাইন পেরিয়ে খানিকটা গেলে যাকে জিজ্ঞাসা করবেন সে-ই বলে দেবে। দেবুদার আশ্রম। হাসলেন প্রৌঢ়।
ডানদিকে ঘুরে খানিকটা যেতেই রেললাইন দেখা গেল। একটাই লাইন, দেখে বোঝা যাচ্ছে ট্রেন চলাচল করে। ডানদিকে কিছুটা দূরে খোলা মাঠের ওপর একতলা ঘরটা বোধহয় স্টেশন। কোনও বাউন্ডারি নেই।
লাইন পার হতেই এগিয়ে আসা সাইকেল আরোহী হাত তুলে থামতে বলল, তারপর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
দেবেশকে দেখে খুশি হল অনিমেষ, তুই কোথায় যাচ্ছিস?
তোদের দেরি দেখে এগোচ্ছিলাম। ড্রাইভারভাই, তুমি আমার পেছনে এসো। কাছেই আশ্রম। সাইকেল ঘোরাল দেবেশ।
গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। তারের বেড়ার ভেতরে অনেকটা জমিতে শাকসবজির চাষ হয়েছে। তার ওপাশে টিনের চাল ইটের দেওয়াল দেওয়া লম্বা লম্বা ঘরবাড়ি। দুপাশে খোলা মাঠ, পেছনে জঙ্গলের আড়াল।
গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় খোকন ডাকল, কাকা।
অনিমেষ তাকালে সে একটা কাগজ এগিয়ে দিল, আমার মোবাইল নম্বর।
মাধবীলতা সেটা নিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ ভাই।
দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, তুই কি গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছিস?
অনিমেষ মাথা নাড়ল, সারাদিন আটকে রেখে লাভ কী? খরচ বাড়বে। দেবেশ খোকনের দিকে তাকাল, ফোন পেলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে।
মাথা নেড়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল খোকন। দেবেশ ছোটমায়ের সামনে গিয়ে বলল, আপনারা যে শেষ পর্যন্ত আমার এখানে এসেছেন, খুব ভাল লাগছে। আসুন, আসুন আপনারা!
আর একটু এগোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। আশ্রমের বাসিন্দা বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা পরিষ্কার জামাকাপড় পরে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। দেবেশ একে একে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মাধবীলতা মহিলাদের দিকে তাকিয়েছিল। ছয়জন আছেন। অতি বৃদ্ধা যিনি তার বয়স আশির ওপরে, লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার হাত ধরল, আপনি কেন কষ্ট করে উঠে এলেন? চলুন, বসে কথা বলব।
বৃদ্ধা খালি হাতটা মাধবীলতার গালে ছোঁয়ালেন, কেউ তো খবর নিতে আসে না। ওই ছেলে ছিল বলে এখনও বেঁচে আছি। তা শুনলাম তোমরা আসছ। ছেলের স্কুলের বন্ধু আর তার মা-বউ। না এসে কি পারি?
দেবেশ বলল, চলুন, আমরা সবাই কমনরুমে গিয়ে বসি।
কমনরুম বলতে বাঁধানো মেঝের ওপর বাঁশের খুঁটিতে খড়ের ছাউনি আটকানো, চারধার খোলা। মেঝের ওপর চারদিক জুড়ে বেঞ্চি পাতা। সবাই বসলে দেবেশ বলল, অনিমেষ আর আমি একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। মাসিমা, আপনার সঙ্গে তখন আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ওদের বাড়িতে আমি সপ্তাহে একদিন অন্তত যেতাম। কেন জানেন?
মাধবীলতা হাসল, আমি জানি।
বেশ আপনিই বলুন। দেবেশ বলল।
না, আপনার মুখে শুনতে চাই।
আমরা কয়েকজন প্রথম গিয়েছিলাম স্কুল ছুটির পর। তখন ওই বাড়ি বড়পিসিমার কন্ট্রোলে। অনিমেষকে খুব ভালবাসতেন। বালবিধবা মহিলা। প্রথম দিনে সবার নাম জিজ্ঞাসা করলে যেই তিনি আমার নাম শুনলেন অমনি আমার খাতির বেড়ে গেল। অন্যরা যা খাবার পেত আমি তার দ্বিগুণ পেতাম। কারণটা খুব মিষ্টি। বড়পিসিমার এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, বারোর আগে তার স্বামী মারা যান। কিন্তু প্রৌঢ়া মহিলা তার স্বামীর নাম ভোলেননি। দেবেশ শুনেই আমার প্রতি তার মন নরম হয়ে গিয়েছিল। দেবেশ খুব গাঢ় গলায় কথা বলছিল।
ইতিমধ্যে জলখাবার এসে গেল। গরম গরম রুটি আর আলুর তরকারি। ছোটমা মাধবীলতাকে নিচু গলায় বললেন, আমাকে দিতে নিষেধ করো।
মাধবীলতার চোখে প্রশ্ন দেখে বললেন, সকালের এই সময়ে আমি তো খাই না।
পাশে বসা একজন বৃদ্ধা বললেন, কিছু মনে করবেন না দিদি, আপনি নিশ্চয়ই এই সময় বাড়ির বাইরে আসেন না, আজ যেমন এসেছেন।
না। কত বছর পরে এলাম তাও মনে নেই। ছোটমা বললেন।
তা হলে দিদি, আজ নিয়ম ভাঙলে কোনও ক্ষতি হবে না। খেয়ে নিন।
মাধবীলতা দেখল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোটমা খাবারের থালা নিলেন।
কথা শুরু হল। এখানে যারা আছেন তাদের সবাই যে খুব অসহায় অবস্থা থেকে এসেছেন তা নয়। ছেলে প্রবাসে বাড়িঘর করে আছে। জলপাইগুড়িতে কখনওই থাকবে না, আবার বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় দুটো কারণে। এক, প্রবাসে গিয়ে বাবা এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। দুই, জলপাইগুড়ির পরিচিত পরিবেশে থাকতে তিনি অনেক বেশি স্বস্তি অনুভব করবেন। ফলে, ছেলে এসে পৈতৃক বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাবাকে এখানে রেখে গেছে। ভাড়ার টাকা প্রতিমাসে খরচ বাবদ আশ্রমকে দেওয়া হয়ে থাকে। কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা, যাঁরা স্বামী-স্ত্রী, শুধু পেনশনের ওপর নির্ভর করে এখানে আছেন, আবার কয়েকজন আছেন, যাঁরা কোনও আর্থিক সাহায্য আশ্রমকে দিতে পারেন না। কিন্তু সেই কারণে দেবেশ কোনও শ্রেণিভাগ করেনি।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আপনারা সারাদিন কী করেন?
একজন প্রৌঢ় বললেন, আমরা সকাল ছটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে ওই বাগানে গিয়ে বসি। তখন সবে সূর্য উঠছে। যে যার মতো পনেরো মিনিট ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সূর্যের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টি পড়লে এই কমনরুমে এসে প্রার্থনা করে নিই। তারপর চা বিস্কুট খেয়ে নিই। এরপরে, সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুরুষরা বাগানের কাজ করি। মাটি কোপানো, সার বীজ লাগানোর কাজ করতে দেবেশবাবুকে লোক ভাড়া করতে হয়। আমাদের যা শরীরের অবস্থা তাতে ওই পরিশ্রম সম্ভব নয়। কিন্তু সবজি এবং ফলের গাছগুলো মাটির ওপরে উঠে এলে আমরাই দেখাশোনা করি। বছরের নয়-দশ মাসের তরিতরকারি এই বাগান থেকেই পেয়ে যাই। মহিলারা তরিতরকারি কাটা, রান্নার ব্যাপারে ঠাকুরকে সাহায্য করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। কারও জামাকাপড় সেলাই করার দরকার হলে তা করে দেন। তারপর জলখাবার খেয়ে বিশ্রাম। দেবেশ একটা ছোট লাইব্রেরি করে দিয়েছে। সেই বই পড়ি যা পড়তে চাই। তারপর স্নান খাওয়া সেরে বিশ্রাম। তিনটের সময় একজন ডাক্তার এসে আমাদের শরীরের খবর নেন। পাগল ডাক্তার, নইলে রোজ আসত না। তারপর সবাই মিলে হাঁটতে বের হই। বড়দিদি হাঁটতে পারেন না বলে বাগানে বসে থাকেন।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তা হলে কি বুঝব আপনারা এখানে ভাল আছেন?
বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, খুব ভাল আছি মা। একসঙ্গে ভাল আছি।
এইসময় মোবাইল বেজে উঠতেই মাধবীলতা হকচকিয়ে গেল। সবাই কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাধবীলতা মোবাইল অন করে বলল, হ্যালো?
অর্কর গলা শোনা গেল, মা, তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?
.
৩০.
মাধবীলতা আড়চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল। মোবাইলের রিং শুনে সে মুখ ঘুরিয়েছিল এদিকে। মাধবীলতা বলল, খুব জরুরি কিছু?
তুমি কি ব্যস্ত আছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। চোখ বন্ধ করল মাধবীলতা, কী বলতে চাইছিস, বল!
আমাদের এই বস্তির একটা বাচ্চা খুব সমস্যায় পড়েছে। ও যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুল থেকে বলেছে ওকে অন্য জায়গায় ভরতি করতে। শুনতে পাচ্ছ?
হঠাৎ একটা বাচ্চাকে কেন এ কথা বলবে? সে কি কোনও সমস্যা করেছে?
না না, তার সমস্যা করার বয়সই হয়নি। ওর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিল। বোধহয় তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। সেই অপরাধে বাচ্চাটাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
অদ্ভুত ব্যাপার! মাধবীলতা বলল।
সত্যি অদ্ভুত। কিন্তু এটা ঘটনা। অর্ক বলল।
আমি এই ঘটনার কথা বলছি না।
তা হলে?
সেই কমিউনের ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তোকে কোনও পরিবারের সঙ্গে মিশতে দেখিনি। বস্তির কোনও মানুষের সঙ্গে কথাও বলতিস না। শুধু শোওয়ার জন্যে বাড়িতে আসতিস। আজ হঠাৎ তাদের একটা বাচ্চার জন্যে তোর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল কী করে তাই বুঝতে পারছি না।
খুব সহজ ব্যাপার। আজকাল তুমি বা বাবা যে-কোনও স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে অস্বাভাবিকতা খোঁজো। বাচ্চার মা তোমার কাছে এসেছিল। ভেবেছিল, তুমি বললে তোমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না। তুমি এখন জলপাইগুড়িতে আছ, কবে আসবে জানা যাচ্ছে না শুনে ভদ্রমহিলা আমাকে অনুরোধ করেছেন তোমাকে ফোন করতে। তুমি যদি হেডমিস্ট্রেসকে একটা ফোন করে দাও! অর্ক খুব স্থির গলায় কথাগুলো বলে গেল।
এই মহিলা কে? কী নাম?
অলকা। তুমি বোধহয় চিনতে পারবে না।
অলকা–? তুই আগে দেখেছিস?
না। বস্তির পেছন দিকে থাকত।
ওই অলকা তোর কাছে এসেছিল? ওর স্বামী আসেনি?
মা, তুমি–।
আমি ঠিকই জিজ্ঞাসা করছি। মেয়ের সমস্যা দূর করতে বাবারই তো আসার কথা। আমি কলকাতায় নেই শুনে তোর কাছে স্বামীকেই পাঠানো কি উচিত কাজ নয়?
আমার কাছে ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ফোনটা যেহেতু তুই আমাকে করতে বলেছিস তাই আমি যা ভাবছি তাই বললাম। শোন অর্ক, যাকে চিনি না, জানি না, তার জন্যে আমি কাউকে অনুরোধ করতে পারব না কৃপা করতে। আমার ছেলে হয়েও তুই যে এতদিনে আমাকে বুঝিসনি দেখে খারাপ লাগছে। যাক গে, আমি, আমরা বাড়িতে নেই এখন। রাখলাম। মাধবীলতা ফোন বন্ধ করল। বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, তোমার মুখ এত শক্ত হয়ে গেল কেন মেয়ে?
মাধবীলতা হাসার চেষ্টা করল, কই, না তো!
বৃদ্ধা বড়দিদি মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখলেন, তোমার কথাটা আমার ভাল লেগেছে। যাকে জানো না তার জন্যে কেন সুপারিশ করবে? ঠিক কথা।
দেবেশ বলল, অনিমেষ, আমাদের বড়দিদি চমৎকার গান করেন।
বৃদ্ধা বড়দিদি দ্রুত হাত নাড়লেন, না না এ কী কথা। এই বয়সে কি গলায় সুর আসে? গান গেয়েছি বিয়ের আগে। আর তারপর তোমরা ধরো বলে এই আশ্রমে এসে। আমি কি গাইতে পারি?
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি বিয়ের পর গান গাওয়ার সুযোগ পাননি?
এবার আর একজন প্রৌঢ়া কথা বললেন, আমি বলি। বড়দিদি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে খুব অস্বস্তি বোধ করেন। প্রৌঢ় বৃদ্ধা বড়দিদির দিকে তাকালেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি।
পড়েছি মোগলের হাতে, বলো। বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন।
প্রৌঢ়া বললেন, বড়দিদির বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। ওঁর বাবা খুব ভাল গাইতেন। অতুলপ্রসাদের গান, রজনীকান্তের গান। অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন না।
বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, বাবা বলতেন, সবার গলায় গুরুদেবের গান মানায় না।
প্রৌঢ়া বললেন, বাবার কাছেই গান শিখেছিলেন বড়দিদি। বিয়ের পরে একান্নবর্তী সংসার ওঁকে বেশিদিন করতে হয়নি। ওঁর স্বামী পাটনায় চাকরি করতেন বলে ওঁকে সেখানে যেতে হয়েছিল। তখন সংসার সাজাতে ব্যস্ত তিনি, কিন্তু মাত্র ছয় মাস পরেই ওঁর স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। বাধ্য হয়ে পাটনায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। ওঁর বাবা যতবার ওঁকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ততবার ওঁর শ্বশুর একটা না একটা বাহানা দেখিয়ে ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রলোকের ভয় হয়েছিল বিধবা পুত্রবধূকে তার বাবা আবার বিয়ে দিতে পারেন।
বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন, একটু বলি। আমার শ্বশুর ছিলেন ঠিক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, মহর্ষি?
বৃদ্ধা বড়দিদি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ গো। তুমি সাহানা দেবীর নাম শুনেছ? যাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের এক পাগল ছেলের সঙ্গে। সেই পাগলকে ঘুম পাড়াতে বেচারাকে সারা রাত গাইতে হত! তা সেই পাগল মারা যাওয়ার পর সাহানা দেবীর বাবা মেয়েকে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা মনে নেই। হয় এলাহাবাদ বা লখনৌ। কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তিনি অনুমতি চাইলেন, মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চান। দেবেন্দ্রনাথ খুব রেগে গিয়ে সমরেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বললেন সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে আনতে। ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ বিধবা হলেও সসম্মানে বাড়িতেই থাকবেন। তাঁকে আবার বিয়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু নিয়ে আসতে হলে অসত্য কথা বলতে হবে। দেবেন্দ্রনাথের ছেলেরা, সত্যেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাবার আদেশ পালন করতে যখন চাইলেন না তখন রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ল। বাবার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুর্বল হয়ে গেলেন। তিনি গিয়ে সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বড়দিদি হাসলেন, এসব ব্যাপার আগেকার দিনে খুব স্বাভাবিক ছিল।
মাধবীলতা অবাক হয়ে শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন? রবীন্দ্রনাথ–!
তখন তো ওঁর অল্প বয়স। যুবকও হননি। পিতৃভক্ত ছিলেন। এরকম হয়।
প্রৌঢ়া বললেন, রবীন্দ্রনাথের সময় মানে একশো তিরিশ বছর আগেকার কথা। সে সময় যা হতে পারত তা বড়দিদির সময়েও হয়েছিল। ওঁর বাবা অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে আবার সংসারী করতে পারেননি। শ্বশুরবাড়িতে একাদশী-অমাবস্যা আর অম্বুবাচী করেই জীবনের অনেকটা পার করে দিয়েছিলেন।
বড়দিদি মাথা নাড়লেন, না না, সবকিছুর জন্যে ওঁদের দায়ী করা ঠিক নয়। আসলে কী জানো, তিন-চার বছর বিধবার জীবনযাপন করার পর আমিই আপত্তি করেছিলাম। আবার একটা পুরুষমানুষের সঙ্গে ঘর করব! এক স্বামীর ঘর ছেড়ে আর এক স্বামীর ঘরে? কীরকম ঘেন্না লাগার বোধ তৈরি হল।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা এখন মেয়েরা বিবাহিত জীবনে অসুখী হয়ে বিয়ে ভেঙে আবার আর একজনকে ভালবেসে বিয়ে করে সংসার করছে, এটা নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ নয়?
ওমা! কে বলল? একটা মেয়ের বুকে যতদিন নিজের জন্য আবেগ থাকবে, যতদিন সে ভাববে আমার সংসার আমি নিজের ইচ্ছেয় তৈরি করতে পারি ততদিন সে পথ তৈরি করে নিতেই পারে। আমার মনে ওই ইচ্ছেটাই ছিল না। বড়দিদি বললেন, আসলে কী জানো, চিরকাল জেনে এসেছি আমার কোনও ঘর নেই। এই সেদিনও মেয়েদের কোনও ঘর ছিল না। হয় বাপের বাড়ি, নয় শ্বশুরবাড়ি। তারপর ছেলের বাড়ি। নিজের বাড়ি কোথায়? মেয়ে জামাই দুজনে যদি সংসার করে তা হলে সেটা হত জামাইয়ের বাড়ি। হাজার মাইল দূরে হলেও সেখানে গিয়ে তেরাত্তিরের মধ্যে চলে আসতে হত। মেয়ের বাড়ি বলে ভাবত না কেউ।
এতক্ষণ সবাই চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু কেশে নিয়ে বললেন, আমি একটা কথা বলব?
ওমা! এ কী কথা? বড়দিদি হাসলেন, শুনি।
আমার মনে হয় এর জন্যে তখনকার সামাজিক ব্যবস্থাই দায়ী। প্রৌঢ় বললেন, একান্নবর্তী পরিবারে যুবক বাবার সঙ্গে তার ছেলেমেয়েদের কোনও যোগাযোগ থাকত না। অভিভাবক-অভিভাবিকারাই দেখাশোনা করতেন। বিশেষ করে মেয়ের সঙ্গে মা-ঠাকুমা-পিসিদের সম্পর্কই বেশি ঘনিষ্ঠ হত। বাবা যেমন দুরের মানুষ, যোগ্য মেয়েও বাবার কাছের মানুষ ছিল না। বিয়ের পরে সেই দূরত্ব আরও বেড়ে যেত বলে বাবা মেয়ের সম্পর্কে ততটা টান অনুভব করতেন না। ছেলেমেয়েরা কথা বলার সুযোগ হলে বাবাকে আপনি সম্বোধন করত। কিন্তু গত চল্লিশ বছরে ছবিটা একদম বদলে গেল। একান্নবর্তী সংসার ভেঙে যাওয়ায় বাড়িতে মা এবং বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ে বাবার সঙ্গে শৈশবে খেলেছে, কাঁধে মাথায় চড়েছে, তুমি সম্বোধন করাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাবা ক্রমশ বন্ধু হয়ে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক তার চাইতে বাবার সঙ্গে বেশি নিকট সম্পর্ক। সে পড়াশুনা করেছে। যা পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায় তাই পড়ে চাকরি করছে। বিয়ের পর তাই তাদের বাড়িটা আর বাবার কাছে জামাইয়ের বাড়ি নয়, মেয়েরও বাড়ি। আর আপনারা তো সবাই জানেন, এখন বৃদ্ধ বাবা মায়ের পাশে ছেলেরা যতটা না থাকছে তার অনেক বেশি মেয়েরা দাঁড়াচ্ছে। প্রৌঢ় হাসলেন।
দেবেশ বলল, খবরের কাগজে আদালতের খবর তো তাই বলে।
একজন প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন, ঠিক। বাবাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, মাকে খেতে দিচ্ছে না, বাড়ি লিখে দিতে বলছে, নইলে অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে, এইসব মামলা হাতে পেলেই বিচারক ছেলেকে ডেকে ভর্ৎসনা করছেন। খোরপোেষ দিতে বলছেন। মেয়ে এরকম করছে বলে খবর পড়িনি।
দেবেশ হেসে ফেলল, তা হলে দেখুন, মেয়েদেরই জয়জয়কার। বুঝলি অনিমেষ, এই যে মায়েরা এখানে আছেন, এঁদের সংখ্যা কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এই যে আপনারা এখানে আছেন, এতদিন যে সংসারে ছিলেন তা ছেড়ে এসে এখানে কেমন লাগছে?
একজন বছর পঞ্চাশেকের মহিলা বললেন, দেখে কী মনে হচ্ছে?
মাধবীলতা হেসে ফেলল, তা হলে দেখে যা মনে হচ্ছে তা সত্যি?
মহিলা বললেন, পুরোপুরি। আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, কিছু হারালে এ ওকে সন্দেহ করি, আবার কারও শরীর খারাপ হলে সবাই পালা করে তার পাশে দিন রাত থাকি। কিন্তু সবার মনে একটাই ভয়–!
কীসের ভয়?
যে মানুষটার জন্যে আমরা এখানে এসে শান্তি পেয়েছি তার যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমাদের কী হবে! মহিলার মুখ অন্যরকম দেখাল।
সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ প্রতিবাদ করল, এ কী কথা? আমি তাড়াতাড়ি মরছি । আর দুর্ঘটনা যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমার অবর্তমানে আপনারা যাতে ঠিকঠাক চালাতে পারেন সে ব্যবস্থা করেই দিয়েছি। চল, অনিমেষ, তোকে আমাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে আনি। হাঁটতে পারবি তো?
নিশ্চয়ই। অভ্যেস এমন একটা ব্যাপার যার কোনও বিকল্প নেই।
দেবেশ এবং অনিমেষ উঠতেই পুরুষরাও বেরিয়ে গেলেন। মাধবীলতা বড়দিদিকে জিজ্ঞাসা করলে, এঁরা চলে গেলেন কেন?
বাগানে যাচ্ছে কাজ করতে। রোদ চড়া হয়ে গেলে তো পারবে না। ছেলেরাই তো শাক সবজি থেকে সমস্ত আনাজ তৈরি করে। বড়দিদি বললেন, কিন্তু মা, তখন থেকে আমরাই কথা বলে যাচ্ছি, উনি কিছু বলছেন না।
ছোটমা মাথা নাড়লেন, আমাকে আপনি বলবেন না। আমার কিছু বলার নেই।
ও কী কথা! আমাদের কাছে এসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
আপনারা সবাই একসঙ্গে আছেন দেখে ভাল লাগছে। ছোটমা বললেন, আমি তো বহু বছর একা একা থাকছি, এখন একা থাকতেই ভাল লাগে।
বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, সবাই মিলে হইচই করতে ইচ্ছে হয় না?
একসময় খুব হত। এখন হয় না। এই যে ওরা এত বছর পরে কলকাতা থেকে এসেছে, ভাল লাগছে আবার–! জানি আমারই ত্রুটি। ওদের সঙ্গে একটু কথা বলেই নিজের ঘরে চলে আসি। অথচ ওরা আমার ভাল চায়–! ছোটমা বললেন।
এইসময় রান্নার লোক এসে বলল, এখনও তরকারি কাটা হয়নি!
দুজন মহিলা উঠলেন। একজন জিভ কেটে বললেন, এই যাঃ!
হঠাৎ ছোটমা বললেন, আমি যেতে পারি? বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়?
তরকারি কাটতে আমার ভাল লাগে।
তাই? যাও। এই, ওকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।
মাধবীলতা একটু অবাক হয়ে তাকাল। এখানে আসার পর একদিনও সে ছোটমায়ের মুখে এমন কথা শোনেনি!
দেবেশের সঙ্গে আশ্রমের অনেকটা দেখে একটা মাঝারি পুকুরের পাশে এসে দাঁড়াল অনিমেষ, মাছ আছে?
আছে। তিন কেজির ওপর হয়ে গেলে বিক্রি করে দিই। খানিকটা আয় হয়। দেবেশ হাসিমুখে বলল।
এই যে এতগুলো মানুষ, কয়েকজন কর্মচারী, এদের খাওয়াদাওয়া ছাড়াও তো অনেক খরচ আছে, চালাচ্ছিস কী করে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
চলে যাচ্ছে। আসলে সবাই মিলে চালাচ্ছি। এখানে আসার সময় এঁরা কিছু টাকা যে যার মতো পারেন দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিইনি। কিন্তু টাকাগুলো একটা নতুন অ্যাকাউন্ট করে ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছি যা থেকে প্রতিমাসে সুদ পাওয়া যায়। সিনিয়ার দুজন আবাসিক সই করে টাকা তোলেন। তা ছাড়া শাকসবজি তো ওঁরাই পরিশ্রম করে পেয়ে যান। গোয়ালে যে চারটে গোরু দেখলি তাদের দেখাশোনা করে যে রাখাল সে খুব ভাল ছেলে। মাত্র তিনশো টাকা মাইনে নেয় আর থাকা-খাওয়া। প্রায় সব মাসেই দুধ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আমি জলপাইগুড়ির তিনজন ধনী মানুষের সাহায্য পাই। এই করেই চলে যাচ্ছে। দেবেশ বলল।
তৃপ্তি পাস?
খুউব। সংসারে যাঁদের কেউ নেই, জীবনের উপান্তে যাঁরা চলে এসেছেন, তাদের মুখে হাসি দেখতে পেলে খুব আনন্দ হয়। জানিস, একটা কাণ্ড হয়েছে। ওঁরা সবাই মিলে কলকাতার বিখ্যাত লেখক এবং প্রকাশকদের কাছে আবেদন করেছিলেন বইয়ের জন্যে। বেশিরভাগই পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাকে এখন দুটো কাঠের আলমারি কিনতে হবে। দেবেশ বলল।
তুই ভাল আছিস দেবেশ। নিচু গলায় বলল অনিমেষ।
হ্যাঁ। তা ঠিক। তুই কতদিন জলপাইগুড়িতে আছিস?
ঠিক নেই। বাড়িটা ছোটমায়ের নামে আদালত করে দিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উনি ওটা বিক্রি করে দেবেন কিনা! সেই অবধি তো আছি। অনিমেষ কথা শেষ করতেই দেখল একটা গাড়ি আশ্রমের দিকে আসছে।
দেবেশ বলল, কেউ আসছেন। চল, দেখি।
ওরা যতক্ষণে সামনের বাগানে এল ততক্ষণে তিনজন মানুষ গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল দেবেশ, কী সৌভাগ্য, আপনি! আসুন, আসুন।
আর আসুন! আপনি তো আমাদের বাদ দিয়েই এসব করছেন।
আমার একার পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব?
নয় তো কী? লাস্ট কবে ময়নাগুড়িতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন? ভোটার লিস্টে এদের নাম তুলেছেন?
বিশ্বাস করুন, বলেছিলাম, এঁরা কেউ রাজি হননি!
সে কী! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট না দেওয়া অপরাধ, ওঁরা জানেন না?
বলেছিলাম। আসলে সব ত্যাগ করে এসে আর পেছনে তাকাতে চান না। বলুন, কী করতে পারি?
এই যে গুরুচরণবাবু, আমাদের পার্টির একজন প্রবীণ কর্মীর কাকা। খুব কষ্টে আছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন। এঁকে আপনার আশ্রমে রাখুন। কিন্তু দেবেশবাবু, উনি পয়সাকড়ি দিতে পারবেন না।
আমরা খুব টানাটানির মধ্যে আছি–!
আরে! আপনার কাছ থেকে আমরা কখনও ডোনেশন চাইনি। ওকে রাখা মানে পার্টিকে সাহায্য করা। গুরুচরণবাবু, আপনার কিছু জানার থাকলে দেবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন।
অন্ধের কী বা দিন কী বা রাত! কী জিজ্ঞাসা করব? একটা আলাদা শোওয়ার ঘর, খাট বিছানা, চারবেলা খাওয়া। নিরামিষ দরকার নেই, একটু মাছের ঝোল আর ভাত হলেই হবে। বছরে চারটে পাঞ্জাবি আর পাজামা। আর হ্যাঁ, রোজ একটা খবরের কাগজ, এইটুকু। গুরুচরণবাবু বললেন।
আমাদের এখানে সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ হয়। দেবেশ বলল।
তা হলে সেই তিনদিন ডিম দেবেন। গুরুচরণবাবু বললেন।
দেবেশ বলল, আপনাকে দিন দশেক অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানাব।
মাতব্বর ভদ্রলোক বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। কোনও দরকার হলে বলবেন।
ওঁরা গাড়িতে উঠে পড়লেন, হাত নাড়লেন, চলে গেলেন।
দেবেশ বলল, এই প্রথম।
লোকটা কে?
পার্টির লোকাল নেতা। ওই গুরুচরণবাবুকে লক্ষ করেছিলি? আশ্রমে ঢুকলে পরিবেশ বিষাক্ত করে দেবে। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
নৃপেনদা বোধহয় কারও উপকার করেন না। অনিমেষ বলল।
দেবেশ হাসল, তুই ভুলে গিয়েছিস। ওঁর স্ত্রী আমার জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে।