২৬-৩০. চোখের সামনে সূর্য ডুবছে

ওরা সকলে বসে আছে। চোখের সামনে সূর্য ডুবছে। ঝুরুঝুরু করে হাওয়া দিচ্ছে একটা। কোকিল আর পিউ কাঁহা ডাকছে বুকের মধ্যে চমক তুলে।

নরেশ বলল, অগ্নি আর আপনার ওয়াইফ কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন ব্যারিস্টার সাহেব? বিকেলে বেড়াতে তো গেছিলাম আমরা সকলেই।

–যেখানে গেছে যাক। কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র তো নয়।

নরেশ বলল, তা নয়। তবে এখানে আজকাল এম.সি.সি.-র ছেলেদের দৌরাত্ম আরম্ভ হয়েছে নাকি।

ব্রতীন বলল, যতটা রটনা ততটা ঘটনা নয়। বেড়াতে-আসা মানুষদের ওরা কিছুই বলে না। আমরা ওদের শ্রেণিশত্রু নই।

–তা নই। কিন্তু যদি একবার জেনে যায় যে, ডাকসাইটে ব্যারিস্টার ঘোষ সাহেবের স্ত্রী অপালা দেবী তবে তাঁকে কিডন্যাপ করে মোটা র‍্যানসাম মানি দাবি করতে পারে।

ব্রতীন বলল, আপনার কোনো টেনশান হচ্ছে না ঘোষ সাহেব? পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একটামাত্র বউ।

–আরে মশাই! যদি কেউ নিয়েই যায় তবে র‍্যানসাম চাইতে হবে না, আমি তাকে এমনিতেই মোটা অঙ্কের চেক লিখে দেব। বিয়ে তো করেননি আপনাদের কেউই। “কী যাতনা বিযে বুঝিবে সে কীসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।”

তৃষা বলল, ‘আশীবিষ’ মানে কী মেসোমশাই? আমি বিজ্ঞাপনের কপি রাইটিং করি, বাংলাতেও করি অথচ এই শব্দটি তো কখনো পাইনি।

–কী করে পাবি মা! তোরা কি মাইকেল পড়েছিস?

রুরু বলল, মাইকেল জ্যাকসন? তিনি আবার বইও লিখেছেন নাকি? স্ট্রেঞ্জ!

ব্রতীন, নরেশ, অরা সকলেই একইসঙ্গে জোরে হেসে উঠল রুরুর কথা শুনে।

ঘোষ সাহেব বললেন, মাইকেল মানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ব্যারিস্টার ছিলেন, মানে, সেম ফ্লাটার্নিটির মানুষ বলেই যে, তাঁর লেখা পড়েছি তাই নয়, বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁদের কারবার তাদের পক্ষে মাইকেল পড়াটা একটা মাস্ট। আমি বেশি কিছু পড়িনি, তবে ওটি পড়েছি।

–ব্রতীন বলল, রুরু তোরা তো বাংলা ব্যাণ্ড, লিটল ম্যাগ, নাটক-টাটকও করিস-টরিস, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর জামাই মেঘনাদের একক অভিনয়ও দেখিসনি? মেঘনাদবধ কাব্য থেকে একটি অংশ নিয়ে করা?

রুরু কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাতে থেকে বলল, মোসোমশাই যে, মেঘনাদবধ কাব্যর কথা বললেন একটু আগেই। মেঘনাদ যদি মরেই যাবে তাহলে আবার নাটক করবে কী করে!

অরা খুব লজ্জিত হল রুরুর অপার অজ্ঞতাতে। অস্ফুটে বললেন, ছিঃ ছিঃ। আমার ছেলেমেয়েগুলোযে, কী হল। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরাও বোধ হয় এদের চেয়ে বেশি বাংলা জানে। তারপর বলল, ব্রতীনবাবু, রুদ্রপ্রসাদের জামাই মেঘনাদ ভট্টাচার্য নয়, তার পদবি হালদার এবং নামও মেঘনাদ নয়। নাম, গৌতম।

নরেশ বলল, মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্ত্রী কিন্তু অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছিলেন। অপরূপ সুন্দরী। নাম ছিল হেনরিয়েটা।

ব্রতীন বলল, আমাদের একেবারে ছেলেবেলাতে যে, বাংলা ছবিটি এসেছিল মাইকেলের জীবনী অবলম্বন করে তাতে হেনরিয়েটাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া মধুসূদন দত্তর চরিত্রের অভিনেতার মুখে একটি গান ছিল মনে আছে অরা দেবী?

–কোন গান?

–”তুমি যে আমার কবিতা”।

–না। আমি ছবিটি দেখিনি।

তারপর বলল, অরা মানবী হতে পারে কিন্তু দেবী হলাম কী করে!

ঘোষসাহেব বললেন, যারাই আপনার সংস্পর্শে এসেছে, তারাই আপনার দেবী-মাহাত্ম্য সম্বন্ধে অবহিত। তাই আপনা থেকেই সম্বোধনে দেবী বেরিয়ে আসে।

–খুব-ই বিপজ্জনক কথা। আমি অতিসাধারণ মানবী, দয়া করে আপনারা কেউই আমাকে দেবী বলবেন না।

বলেই বলল, এবারে কিন্তু আপনাদের ওদের খোঁজে যাওয়া উচিত। মুখার্জিবাবুকে ডেকে নিয়ে টর্চ নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলে কি ভালো হয় না, ঘোষসাহেব? শুনেছি আপনার কাছে তো পিস্তলও আছে।

ঘোষসাহেব হেসে বললেন, যাক না। যারা ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাদের খুঁজতে যাওয়ার মতো মূর্খামি আর নেই। তা ছাড়া, অপালা তো সারাজীবন আমার মতো কাঠখোট্টা মানুষের সঙ্গেই জীবনটা কাটাল। অগ্নির মতো একজন পুরুষের মতো পুরুষের সঙ্গে এই অনন্তকালের মধ্যে দু-দন্ড কাটাতে চাইলে কাটাক-ই না।

অরা বলল, ওরা নিশ্চয়ই পথ ভুলে গেছে।

–হয়তো গেছে। কিন্তু পথ ভোলা শব্দটা দ্ব্যর্থক। পথ হয়তো ভুলেছে কিন্তু তা ম্যাকলাস্কির পথ নয়।

আপনার মতো উদার স্বামী পাওয়া খুব-ই সৌভাগ্যের কথা। আশিস কিন্তু ভীষণ-ই পজেটিভ ছিল আমার ব্যাপারে আর জেলাস ছিল, বিশেষ করে অগ্নির ব্যাপারে। আর বিধাতার কী লীলাখেলা দেখুন। সেই অগ্নিই তৃষা আর রুরুর গডফাদার হয়ে এল, ওর হঠাৎ চলে যাওয়ার পরে।

ঘোষসাহেব বললেন, আমি উদার কি না জানি না। তবে আমি নর্মাল। অনেক দিন আগে ‘স্বামী হওয়া’ নামের একটি গল্প পড়েছিলাম কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকাতে। অসাধারণ গল্প মশাই। সেই গল্পে স্ত্রী, স্বামীর এক অল্পবয়সি ব্যাচেলার সহকর্মীর সঙ্গে অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছেলেটি যথেষ্ট মাখামাখির পর, তার বাড়ির পছন্দে বিয়ে করে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কটিকে ছিঁড়ে ফেলে।

–আমিও পড়েছি গল্পটা।

ব্রতীন বলল।

অরা বলল, তারপর?

–তারপর অপমানিত, আহত, ব্যথিত স্ত্রী একরাতে তার স্বামীর কাছে ভেঙে পড়ে ক্ষমা চায় তার কৃতকর্মের জন্যে। স্বামী বলে, তুমি তো আমাকে কোনোভাবেই ঠকাওনি। আমার প্রাপ্য এবং চাহিদার, তার সবটুকু মিটিয়ে তোমার যা-উদবৃত্ত, তা থেকে অন্যকে যদি কিছু দিয়েও থাকো, এবং দিয়ে খুশি হয়ে থাকো তবে আমার আপত্তির কী থাকতে পারে!

ব্রতীন বলল, শেষলাইনটা বলুন ঘোষসাহেব।

-আপনিই বলুন।

-সেই স্বামী বলছেন, যেদিন উলুধ্বনির মধ্যে, সানাইয়ের সুরের মধ্যে, গুরুজনদের আশীর্বাদে ধন্য হয়ে, একটি নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম, সেদিন আমি বর’ হয়েছিলাম। আর আজ এতদিন পরে স্বামী’ হলাম।

–”স্বামী হওয়া’ আমি পড়িনি কিন্তু এরকম-ই একটি গল্প পড়েছিলাম, ‘বাবা হওয়া’। সন্তানের জনক হওয়া আর বাবা হওয়াতে অনেক-ই তফাত।

ঘোষসাহেব বললেন, আমরা এই তিন মক্কেলের কেউই তো, বাবা হতে পারলাম না, তাই বাবা হওয়া’ গল্পের সারমর্ম আমাদের উপলব্ধি করা হল না। তাই সে-প্রসঙ্গ না হয় থাক।

.

২৭.

অন্ধকার নেমে-আসা জঙ্গলের মধ্যের একট চ্যাটালো কালো পাথরের ওপরে চিত হয়ে অপা শুয়েছিল। বিবস্ত্রা। পাশে দাঁড়ানো অগ্নি কেটে কেটে, সামান্য উত্তেজিত গলাতে বলল, চলো, এবারে ফেরা যাক। যেতেও মিনিট কুড়ি লাগবে। যদিও চাঁদ উঠেছে তবে সবে গরমটা পড়েছে। সাপ, বিছে আছে।

অপার জামাকাপড় পরা হয়ে গেছে, অগ্নির পাশে এসে অগ্নিকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল শব্দ করে অপা।

-ভালো লেগেছে তোমার?

অগ্নি বলল।

–এখন কথা বোলো না। চলো, এগোই।

তারপর বলল, তোমার জীবনে এই কি প্রথম অভিজ্ঞতা?

–মিথ্যে বলব না। প্রথম নয়।

কিন্তু অরার সঙ্গে একদিনও হয়নি এ অভিজ্ঞতা?

–হয়তো বিশ্বাস করবে না। হয়নি। ও আমাকে ওর কুলুঙ্গির ঠাকুর করেছে। আমাকে সে, বিছানাতে পেতে চায় না।

–বিছানাতে না পেতে চাক, এমন বনের মধ্যে তো পেতে পারত?

পারত হয়তো। কিন্তু চায়নি।

ওই স্বল্প আলোতেও সদ্যতৃপ্ত শরীরের সব আনন্দ, অপালার মুখে এক জ্যোতি দিয়েছিল যা, শরীরের পূর্ণ পরিতৃপ্তির পরেই শুধু আসে। যারা জানেন, তারাই শুধু জানেন, বিশেষ করে, মেয়েরা।

অগ্নি বলল, ওরা সবাই খুব চিন্তা করছে।

–তুমি শুধু চিন্তা করাটার কথাই ভাবছ? ওরা কী মনে করছে তা ভাবছ না একবারও?

–তোমার জন্যেই তো এতদেরি হল। পথের কাঙালিরাও এমন করে চেটেপুটে খিচুড়ি খায় না। আমিও বুঝতে পারলাম যে, তুমি বড়োই উপোসি ছিলে।

–উপোসি ছিলাম না। কচুবনে শুয়োরের আবির্ভাব তো ঘনঘনই হয়। কিন্তু আমার শরীরের বনে বাঘ তো আসেনি এর আগে। কখনোই আসেনি। আমি জানি না, কী করে তোমাকে ধন্যবাদ জানাব। আমি তোমার জন্যে সব করতে পারি। ঘরও ছাড়তে পারি।

–ঘর ছাড়ার মতো সোজা কাজ আর কী আছে? তা ছাড়া ঘোষ সাহেবের মতো এমন দেবতুল্য স্বামী।

–দেবতুল্য না ছাই।

–ছিঃ। উনি একজন চমৎকার মানুষ। একজন মহৎ, উদার মানুষ। তাঁর একটি অপূর্ণতার জন্যে, পুরো মানুষটাকে কি বাতিল করা যায়? জানি না, তুমি বুঝতে পারবে কি না বললে, আমরা প্রত্যেকেই খন্ড মানুষ। রবীন্দ্রনাথ যে, পূর্ণ-মনুষ্যত্ব’র কথা বলতেন, তাঁর শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, তা চারিয়ে দিতে চাইতেন, তা আদর্শ হিসেবে অবশ্যই গ্রহণীয়। কিন্তু এই পৃথিবীতে এই জীবনে, পূর্ণ মানুষ’ ক-জন হতে পারে? ক-জন নারী বা পুরুষ? এ-জীবনে আমার দেখা নারী পুরুষদের মধ্যে, একমাত্র অরাকেই পূর্ণ মনুষ্যত্বের কাছাকাছি আসতে দেখেছি। ও আমাকে ওর কুলুঙ্গির ঠাকুর করেছে। ও বলে যে, কিন্তু আসলে ও নিজেই আমার মনে দেবীর আসনে অধিষ্ঠিতা।

একটু পরে অগ্নি বলল, আসলে আমরা প্রত্যেকেই ‘খন্ড’ মানুষ। আমার একটি গুণে তুমি অভিভূত হলে, আমার যে, কত দোষ তার কোনো খবর-ই তুমি রাখো না। ঘোষ সাহেবকে তুমি অসম্মান কোরো না কখনো। উনি একজন আশ্চর্য মানুষ। ওনাকে যত দেখছি ওনার প্রতি শ্রদ্ধা ততই বাড়ছে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, দেখে চলো, পড়ে যেয়ো না।

অপালা বলল, পড়ে তো গেছিই। এখন আর দেখে চলে লাভ কী?

.

২৮.

ব্রতীন বলল, সত্যিই তো অনেক-ই দেরি হয়ে গেল। নাঃ এবারে একটা কিছু করতে হয়। মুখার্জিবাবুকে ডাকি? ঘোষসাহেব আপনাকেও উঠতে হবে। আপনার সঙ্গে পিস্তল আছে?

–ওরে বাবা। আমি মোটা মানুষ। অনেক হাঁটা হয়েছে বিকেলে। আমার দ্বারা আর হাঁটাহাঁটি সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমার আহ্নিকেরও সময় হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পরস্ত্রী হলেও না, হয় কথা ছিল। নিজের স্ত্রীকে গোরু খোঁজা খুঁজতে, অতকষ্ট করার মধ্যে আমি নেই। তা ছাড়া ইংরেজিতে একটা কথা আছে না?

–কী কথা?

–”দেয়ার ইজ নো পয়েন্ট ইন ট্রাইং টু ডু সামথিং হোয়েন দেয়ারস নাথিং টু বি ডান।”

–আপনাকে কিছু বলার নেই। আশ্চর্য মানুষ আপনি।

নরেশ বলল।

ব্রতীন বলল, কিছু বলতে যাসও না। ওদের একটু আলগা থাকতে দে-না।

পরের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাতে হস্তক্ষেপ করাতে আপনাদের এত উৎসাহ কেন মশায়? ঘোষ সাহেব বললেন।

তারপর-ই বললেন নরেশকে, আপনারা শিভালরি দেখাতে যেখানে খুশি যান স্যার, যাওয়ার আগে আমাকে একটা বড়ো করে হুইস্কি সেজে দিয়ে যান।

–আশ্চর্য মানুষ তো আপনি। আপনার-ই তো স্ত্রী। আর আপনার-ই কোনো হেলদোল নেই?

–আহা। সে তো যোগ্যজনের সঙ্গেই আছে। কিডন্যাপড় তো আর হয়নি।

ইতিমধ্যে শোরগোল শুনে মুখার্জিবাবু নিজেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। নরেশ বলল, আপনারা টর্চটা নিয়ে একবার আসবেন আমাদের সঙ্গে?

–কী হল?

–না, অগ্নিবাবু আর অপালা দিদি এখনও ফেরেননি।

নিরুদ্বেগ গলাতে উনি বললেন, ফিরে আসবেন। চাঁদের আলো আছে। জঙ্গলে এই সময়ে হেঁটে বেড়াবার মজাই আলাদা।

–আর এম.সি.সি.-র ছেলেরা?

–ওরা সব ভালো ছেলে। আমাদের অতিথিদের কোনো ক্ষতি করবে না।

–একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলে হত না? ঘোষসাহেবের কাছে পিস্তলও আছে।

–আস্তে বলুন। ওরা জানতে পারলে, ওটিকে ট্যাঁকস্থ করবে। তা ছাড়া পিস্তল-ফিস্তল আজকাল কোনো কাজে আসে নাকি? ওরা সব এ.কে. ফর্টিসেভেন আর ল্যাণ্ডমাইনের কারবারি। তাও আবার রিমোট কন্ট্রোলে এক্সপ্লোশান ঘটায়।

-তাই নাকি?

নরেশ বেশ ভয়ার্ত গলাতে বলল।

ঘোষসাহেব হুইস্কির গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে তৃষাকে বললেন, একটা গান শোনাত মা। তোর মা তো আমার কথাতে গাইবেন না।

রুরু বলল, তাহলে কার কথাতে গাইবেন?

অগ্নিবাবু বললে গাইতেও বা পারেন।

–গাইতে ইচ্ছে করছে না। করলে, আপনি বললেও গাইতাম।

শেষপর্যন্ত ওরা কেউই অগ্নি আর অপালাকে খুঁজতে গেল না, মুখার্জিবাবুর কথা মেনে নিয়ে। এবং বলাই বাহুল্য, সকলেই আহ্নিক শুরু করে দিলেন।

তৃষা বলল, দেখেছ মা, জঙ্গলের মধ্যে আলো-ছায়া মিলে, কেমন রহস্যর বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।

–হুঁ।

অরা অন্যমনস্ক গলাতে বলল। অগ্নি যে, অপালাকে নিয়ে রাতের জঙ্গলে ঘুরছে সেজন্যে তার কোনোই উত্তেজনা ছিল না। অগ্নি সম্বন্ধে অরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, ওর মনে কোনোকিছুই হচ্ছিল না। ঘোষ সাহেবের মনেও হল না বলেই, মনে হল অরার।

ঘোষসাহেব বললেন, কী হল তৃষা? গান হবে না একটা? রবীন্দ্রসংগীত?

-কোনটা গাইব মা? “তুমি কিছু দিয়ে যাও”?

–ওটা তো সকালের রাগের গান। অন্য কোনো গান গা।

অরা বলল।

–তাহলে ‘ও চাঁদ তোমায় দোলা দেবে কে’ গাই?

–গাও ।

তৃষা গান ধরল। সকলে মাথা নেড়ে হাতে তাল দিয়ে, সেই গান অ্যাপ্রিসিয়েট করতে লাগলেন। অরা ছাড়া। ঘোষসাহেব সামনে কনফিডেন্টলি বেতালে তাল দিয়ে যেতে লাগলেন।

এমন সময়ে গেট দিয়ে অগ্নি আর অপালাকে আসতে দেখা গেল।

ওঁরা সকলেই একসঙ্গে ওদের আক্রমণ করল–ঘোষসাহেব ও অরা ছাড়া।

ওরা কাছে এলে অরা লক্ষ করল যে, অপার শাড়িটা ক্রাশড যে, শুধু তাই নয়, পেছন। দিকে ধুলো-বালি-খড়কুটো লেগে আছে।

অপা বলল, কী যে, মিস করলি তুই অরা। কী অপূর্ব সানসেট যে, দেখলাম।

–জীবনে এতকিছু অপূর্ব দৃশ্য আছে, এতসব জায়গা, এতসব অনুভূতি, সব-ই কি, একজীবনে পাওয়া যায়? তৃষাদের মোবাইল ফোনের-ই মতো জীবনটা, প্রত্যেকের জীবন-ই ‘মিসড কল’-এ ভরা। ‘মিসড কল’-এই ঝুড়ি ভরে ওঠে জীবনের। সব ডাকে, সবার ডাকে কি সবসময় সাড়া দেওয়া যায়? বল তুই? অনেক কিছুই ছেড়ে দিতে হয়, হারাতে হয় জীবনে।

অরার বক্তব্যর অনেকখানিই হয়তো, অপালার সেই ঘোরলাগা অবস্থাতে ওর মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কিন্তু অন্য সকলেই অরার কথা শুনে একইসঙ্গে বলে উঠলেন, ভেরি ওয়েল সেইড ইনডিড।

অপালা ঘোষসাহেবের দিকে ফিরে বলল, তুমিও খুব মিস করলে কিন্তু। অন্য সকলেই, বিশেষ করে তৃষা ও রুরু। ব্রতীনবাবু তার বন্ধু ইন্দ্রজিত্ববুর কাছ থেকে, এই জায়গাটার সব গলি-অলি চিনে রেখেছেন। ব্রতীনবাবু জায়গাটার হদিশ না দিলে তো আমরা খুঁজেই পেতাম না।

–আমি!

অবাক গলাতে বলল ব্রতীন। তারপর আরও কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। ঘোষসাহেব বললেন, আমি কিছুই মিস করিনি। তুমি সেই একটা গান গাও না? “তুমি সুখী হলে আমি সুখী হই”, না-কী যেন। আমার সেই কথা।

অগ্নি চুপ করেছিল। অপার সুগঠিত শরীরের ঘ্রাণ, মসৃণ ত্বকের স্পর্শ, তার আশ্লেষ তাকে তখনও আচ্ছন্ন করেছিল। কত বছর পরে যে, সে নারীসঙ্গ করল। মন-বিবর্জিত শরীরে যাওয়া আর দেহপসারিনির কাছে যাওয়া একই ব্যাপার। কিন্তু পুরুষকে বিধাতা বড়োভঙ্গুর করে গড়েছেন। বড়ো দুর্বল। তাই মহাজ্ঞানী গুণী পুরুষকেও-তাঁর পিপাসা তেমন তীব্র হলে-তাঁর দেহ বড়ো বেশিদিন উপোসি থাকলে, অমন জায়গাতেও যেতে হয়। নয়তো তিনি এমন কিছু করে বসেন, যা অভাবনীয়। তাঁর ভাবমূর্তি তাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু প্রাণ তো বাঁচাতেই হবে। পুরুষের অসহায়তার কথা শুধু অন্য একজন পুরুষ-ই বুঝতে পারে।

–জায়গাটা কোন দিকে? অনেক দূরে?

নরেশ প্রশ্ন করল।

–অগ্নি কোনো বিশেষ দিক না দেখিয়ে আঙুল তুলে বলল ওইদিকে। সে-দিকটা যে কোন দিক তা কেউই বুঝতে পারল না। আসলে কোনো সানসেট পয়েন্টেই তো যায়নি ওরা। ম্যাকলাস্কিতে কোনো সানসেট পয়েন্ট নেইও, নেতারহাটের ‘ম্যাগনোলিয়া পয়েন্টের মতো। ওরা নিজেদের শরীরের চাঁদ-সূর্য নিয়ে খেলা করতেই ব্যস্ত ছিল। অগ্নি ভাবছিল, শরীরের মধ্যে যে, কী গভীর আনন্দ থাকে তা তো দুই সন্তানের মা অরা, ভালো করেই জানে। তবু কেন, কী করে, সে নিজেকে এবং অগ্নিকেও এমন করে বঞ্চিত করে রাখল? এইজন্যেই বোধ হয় কথা আছে– “শ্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ”।

.

২৯.

ঘোষসাহেব বললেন, এতক্ষণে তো শান্তি হয়েছে আপনাদের। নিন আমার গ্লাস শেষ। আর একটা সাজুন দেখি। ভেবেছিলাম এম.সি.সি.-র ছেলেগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তা-না দেখি, দিব্যি ফিরে এল। আরে বউ তো আমার, আমার নিজের কোনো টেনশান ছিল না, আর এই ব্রতীনবাবুরা টেনশানে মরে গেলেন।

পরস্ত্রী সম্বন্ধে পরপুরুষ মাত্রই অত্যন্ত কনসার্নড। তাঁদের ভালোমন্দর চিন্তা, নিজের স্ত্রীর ভালোমন্দর চেয়ে অনেক বেশি মথিত করে ওঁদের।

ঘোষসাহেব পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে জোরে হেসে উঠলেন।

নরেশ ওঁর গ্লাসটা নিয়ে আবার ভরে দিয়ে বলল, আচ্ছা খ্যাপা লোক ঘোষসাহেব আপনি। ওরা নিয়ে গেলে র‍্যানসাম তো আপনাকেই দিতে হত।

–ওরা জানত কী করে যে, অপালা আমার বউ। ওরা ভাবত সে, অগ্নির বউ। তা ছাড়া জানলেও র‍্যানসাম আমি থোড়াই দিতাম?

–হ্যাঁ। তাই ভাবছেন!

অপালা অরার পাশের চেয়ারে উঠে এল, তৃষা আর রুরু ভেতরে চলে গেল। বড়োদের কথার মধ্যে থাকাটা অরা পছন্দ করে না। খাওয়ার আগে, ওরা দু-জনে ঘুমিয়েও নেবে একটু। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। অভ্যেস তো নেই।

অরা পূর্ণদৃষ্টিতে অপার মুখে চাইল।

অপালাকে অপরাধী অপরাধী দেখাচ্ছিল।

অপা অরার এই উদাসীনতাতে অবাক হল। ও ভেবেছিল, অরার চোখে রাগ বা ঘৃণা বা কোনো মিশ্র অনুভূতি দেখতে পাবে কিন্তু দেখল, অরা তেমন-ই উদাসীন এবং অপার প্রতি অপার প্রীতিময়ী।

অরা শুধু ফিসফিস করে, প্রায় অপার কানে-কানেই বলল, একটা সিল্কের শাড়ি পরে গেলেই পারতিস, তাঁতের শাড়ি না পরে।

ধরা-পড়া অপার মুখ লজ্জায় এবং অপরাধে লাল হয়ে গেল। রক্ত উঠে এল ওর গালে।

উত্তর না দিয়ে ও মুখ নামিয়ে নিল।

ঘোষসাহেব অগ্নিকে বললেন, একটা গান শোনান তো মশাই। কোথায় যে, আমার বউকে নিয়ে ভাগলবা হলেন, আর তা নিয়ে আপনার দুই বন্ধুর কী নার্ভাসনেস। আরে! যার সম্পত্তি, তাঁর-ই নেই কোনো মাথাব্যথা, এঁরা ভেবে ভেবে কপালের শিরা ফাটালেন। টিপিক্যাল বাঙালি! নিন, গান ধরুন একটা, নইলে আমি কিন্তু সেই ঘুঘু পাখির গানটা আবার গেয়ে দেব।

সকলেই বলল, তা হোক-না গানটা। ও গান তো হাজারবার শোনা যায়। তা ও গান শিখলেন কোথায়?

–চাটুজ্যে শিখিয়েছিল।

–তিনি কে?

–সে ছিল আমার গল্ক খেলার পার্টনার। টলি ক্লাবে। একটা বিদেশি কোম্পানির সি.ই.ও ছিল। এক রবিবার খেলার পরে আমরা খড়ের চালের গোলঘরের নীচে বসে বিয়ার খাচ্ছি, তখন খোনা চাটুজ্যে গানটা শুনিয়েছিল।

-উনি কি খোনা ছিলেন?

–একটু। দেশ ছিল খন্যানে। বড়োলোকের মেয়েকে বিয়ে করে বিলেতে গিয়ে, এঞ্জিনিয়ারিং আর এম বি এ পড়ে এসেছিল। খুব আমুদে মানুষ ছিল চাটুজ্যে। মারা গেছে। প্রায় পনেরো বছর। আমি গল্ফ খেলা ছেড়ে দিয়েছি চোদ্দো-পনেরো বছর হল। তারপরেই তো এই ভুঁড়ি।

-তা ছাড়লেন কেন? ব্রতীন বলল।

–সময় কোথায়? তা ছাড়া, তখন সপ্তাহে দু-তিনদিন বিভিন্ন হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে যেতে হত। জীবনে এখন সব-ই আছে শুধু সময়-ই নেই।

ঘোষসাহেবের দিকে চেয়ে অগ্নির অপালার বর্ণনা দেওয়া কচুবনে শুয়োরের ঘোঁতঘোতানির কথা মনে হচ্ছিল। হাসিও পাচ্ছিল আবার দুঃখও হচ্ছিল। ঘোষ সাহেব মানুষটা যে, বড়ো ভালো।

ঘোষসাহেব বেশিক্ষণ চুপ করে থাকার পাত্র নন।

আবার বললেন, কী হল? গানটা কী হল অগ্নিবাবু?

অগ্নি একবার আড়চোখে অরা এবং অপলার দিকে চেয়ে শুরু করল—

কলঙ্কেতে ভয় কোরো না বিধুমুখী
যে যা বলে সয়ে থেকো
হয়ে আমার দুখে দুখি। মা
তঙ্গ পড়িলে জলে,
পতঙ্গেতে কী না বলে,
কণ্টকেরি বনে গেলে কাঁটা ফোটে পায়
তাই বলে কি বিধুমুখী অমনি থাকা যায়?
ডুবেছি না ডুবতে আছি পাতাল কত দূরে দেখি
কলঙ্কেতে ভয় কোরো না বিধুমুখী
যে যা বলে সয়ে থেকো
হয়ে আমার দুখে দুখী।

.

৩০.

দিন যায়, রাত যায়, এমনি করে জীবনও যায় অমোঘ মৃত্যুর দিকে। পর্ণমোচী গাছের পাতা খসায়, প্রতিবছরে পরের বছরে নবসাজে সেজে আসবে বলে। কিন্তু মানুষ চলে গেলে, আর ফিরে আসে না। যদি ‘জন্মান্তরবাদ’ সত্যিও হয়, তবুও ফুলের মতো, পাতার মতো তার পুরোনো অনুষঙ্গে, তার পুরোনো বৃন্ততে ফিরে আসে না। একজীবনের সব চাওয়াপাওয়া, সব পাপপুণ্য, সেই জীবনেই জারিত হয়। কোনো মানুষ যদি অসাধারণ হন, তবে তাঁর প্রভাব থেকে যায় অন্যদের মধ্যে, তাঁর লেখা, তাঁর ছবি আঁকা, তাঁর গান এ সব-ই, তাঁর চলে যাওয়ার পরে অন্য মানুষেরা, কাছের এবং দূরের, এক অন্য চোখে আবিষ্কার করেন। কিন্তু সেসব ঘটে, অসাধারণ মানুষদের-ই বেলাতে। অরা তো অসাধারণ নয়, সে অতিসাধারণ। তার জীবনের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ন্যায়, নীতি, শুচি-অশুচি বোধ, যা-কিছুই আঁকড়ে, সে এতদিন বেঁচেছিল, সেইসব-ই যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ থেকে ফিরে আসার পর ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Crestfallen’ –ও তাই হয়ে গেছে।

অগ্নিকে মুখে এবং চিঠিতে ও বহুবার বলেছিল যে, তুমি অন্য নারীতে যেতে পারো আমার আপত্তি নেই। শুধু আমাকে চেয়ো না। আমি তোমাকে কুলুঙ্গির ঠাকুর করেছি। মুখে বলেছিল, তোমার ওপর আমার কোনো দাবি নেই” কিন্তু মনে মনে যে, তার দাবি কায়েম করেছিল পুরোপুরিই অগ্নির ওপরে, সে-কথা, অগ্নির শরীরের আগুন অপালা নিভিয়ে দেওয়ার পরেই অরার কাছে প্রাঞ্জল হয়েছে।

অগ্নিকে সে, সত্যিই কুলুঙ্গির ঠাকুর-ই করে রেখেছিল। দেবতাকে যে-ভক্ত পুজো করে, সে তো তার সব ভক্তি সঁপে দিয়েই তাঁকে পুজো করে কিন্তু দেবতারও কি ভক্তর প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? পুজোর যে-উপচারকে, ভক্ত ‘পূত-পবিত্র’ বলে জানত, সেই উপচারের কোনো মূল্যই কি দেবতার নিজের কাছে ছিল না?

ম্যাকলাকিগঞ্জ থেকে ফিরে আসার পর, অরা যেন, তার মনের সব ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। অগ্নিকে যে, কতখানি ভালোবেসেছিল তা অগ্নি অপালার সঙ্গে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের আরণ্যক পরিবেশে সংগমে লিপ্ত হওয়ার পর-ই যেন, হাহাকারের সঙ্গে বুঝতে পেরেছে অরা। অথচ ও জানে যে, এই শাস্তি তার নিজেরই কৃতকর্মের ফল। অরা যে, অসাধারণ, অসাধারণ তার ভালোবাসা, এই সৎ ও গভীর বোধ অরার প্রেমিককেও যে, সমানভাবে আচ্ছন্ন করবে না, এ-কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি অরা। ওর মনে মনে এই wishful Thinking ছিল যে, যত কষ্টই হোক-না কেন অগ্নির, সে অরার প্রেমিক হিসেবে সেই দুঃখের মহান ভার সারাজীবন হাসিমুখে বইবে। অগ্নিও যে, আর দশটি পুরুষের মতো সাধারণ, এই সত্য তাকে বজ্রর মতো বেজেছে। অরা বুঝেছে যে, একজন নারী যা পারে, একজন পুরুষ তা কখনোই পারে না। একজন ভারতীয় নারী, তার প্রেমে, তার বিরহে, তার কৃচ্ছসাধনে চিরদিন-ই একজন পুরুষের চেয়ে অনেক-ই বড়ো। সত্যিই যে, বড়ো তাতে সন্দেহ নেই। তাই বাংলা সাহিত্যে পুরুষ ও নারীর প্রেমের যেসব উপাখ্যান আছে, সেসবে এই সত্যই স্বমহিমাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সমারসেট মম-এর একটি গল্প পড়েছিল প্রথম যৌবনে। গল্পটির নাম সম্ভবত ‘দ্যা রেইন”। ঠিক মনে নেই এতদিন পরে। সেই গল্পের যুবতী, এক অরমিতা নারী শেষে একজন ধর্মযাজকের দ্বারাও রমিত হয়েছিল তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। গল্পের শেষে আছে যে, সেই নারী বলছে “অল মেন আর পিগস”। পুরুষ মাত্রই শুয়োর। চর্ম ঘর্ষণ-ই তাদের জীবনের সারাৎসার। প্রেম বা রমণীর কোমল মানসিকতার যথার্থ মূল্য, কোনো পুরুষের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়–তারা সকলেই নারীকে ব্যবহার করে, করে জীবনানন্দর কবিতার নারীর মতো শূকরীর মাংস করে তুলতে চায়।

না, অরার চোখে অগ্নি এক ব্যতিক্রমী পুরুষ ছিল। তার স্বপ্নের পুরুষ। রবীন্দ্রনাথের নায়কদের মতো পুরুষ। কিন্তু আজকে অরার সে-ভুল ভেঙেছে।

তবে শুধু অগ্নিকে দোষ দেওয়াটা বোধ হয় ঠিক নয়। তার বান্ধবী অপালাই বা কী কম শরীর সর্বস্বী! অরা তো বহুদিন-ই বিধবা কিন্তু অপালার স্বামী তো জলজ্যান্ত বর্তমান। সে মানুষটার প্রতি কোনো দায়, এমনকী দয়াও কি অপালার ছিল না? ছিল যে-না, তা অরা তো বুঝতেই পারছে। ঘোষসাহেবও অরার-ই মতো প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পেরেছেন, সেই আরণ্যক গা-ছমছম সন্ধেতে তার স্ত্রী ও অগ্নির মধ্যে কী ঘটেছিল? কিন্তু বোঝার পরও তার মানসিকতা ও ঔদার্য হঠাৎ করে, অরাকে সেই মানুষটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাতে আপ্লুত করেছে। প্রীতি, মায়া, মমতা, সহানুভূতি এবং করুণার-ই মতো শ্রদ্ধা ও প্রেমের বীজতলি। প্রেমের বীজ এসবের কোন জমিতে রোপিত হয়ে যে, ফুল ফোঁটায়, তা হয়তো আগে থাকতে বোঝা যায় না। সাধারণত প্রেম নিঃশব্দ চরণেই আসে, নিঃশব্দ চরণে চলে যায় কিন্তু কখনো কখনো হয়তো বিস্ফোরকের স্ফুটনের মতো হঠাৎ-ই শব্দ করেও প্রেমের ফুল ফোটে। নর নারীর মনের সম্পর্ক বড়ো দুয়ে। যখন মনে হয়, সব-ই জানা হয়ে গেছে অন্যের সম্পর্কে, তখন-ই বড়োবিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে মন জানে যে, সেই মনে হওয়াটা ‘ভুল’। মস্ত ভুল।

বাড়িতে ছেলেমেয়েদের কেউই ছিল না। আজ রবিবার। থাকবেই বা কেন? ওদের এখন উড়ে বেড়াবার সময়। এখানে ওখানে ওড়াওড়ি করে নানা ফুলের মধু খেয়ে, অনেক পরে নীড় বাঁধার কথা ভাববে ওরা, কোনো বসন্ত প্রভাতে। ওদের প্রজন্ম আর অরাদের প্রজন্ম আলাদা। অরার আজকাল প্রায়-ই হাজারিবাগের কথা মনে পড়ে তার ব্রাহ্ম বাবার কড়া কিন্তু আদর্শ শাসনের মধ্যে একটি মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা। সেই শাসন চোখরাঙানির ছিল না তাতে বাঁধন’ যতটুকু ছিল তা, সম্ভ্রান্ততার বাঁধন। একটি বাজে পরিবারের মেয়ের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের যতটুকু তফাত থাকা উচিত–সেই তফাতটুকুই অরাকে স্বাতন্ত্র দিয়েছিল। এতদিন অগ্নিকেও অরা ওর-ই মতো সম্ভ্রান্ত ও স্বতন্ত্র বলে মনে করত। অগ্নি অবেলায় পৌঁছে নিজেকে বদলাল।

পাগল পাগল লাগে অরার ম্যাকলাস্কিগঞ্জ থেকে ফিরে এসে। রোজ-ই রাতে একটি করে দীর্ঘ চিঠি লিখেছে অগ্নিকে আর, তারপর-ই ছিঁড়ে ফেলেছে। ছিঁড়েছ কুচি কুচি করে, ছেলেমেয়ে কারোরই চোখে না পড়ে সেইসব টুকরো-টাকরাও। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের চাঁদভাসি আকাশে একটা পিউ-কাঁহা পাখি ‘পিউ-কাঁহা-পিউ-কাঁহা-হা-হা করে হাহাকার করে ডেকে ফিরত। সেই হাহাকারটা বুঝি অরার বুকে ফিরে এসেছে–বয়ে নিয়ে এসেছে সেই বসন্তবনের বুক থেকে অরা এই কলকাতাতে।

ম্যাকলাস্কিগঞ্জে অথবা হাজারিবাগে অথবা এদিকের অন্য কোনো বনেও বোধ হয় ভূত গাছ নেই। যে, গাছের ইংরেজি নাম Karu-Gum tree। নাগপুর থেকে একবার মহারাষ্ট্রের আন্ধারী-তাড়োবা টাইগার রিসার্ভে গেছিল বসন্ত শেষে। সেখানেই প্রথম ভূতগাছ দেখে। রাতের কালো বনের মধ্যে ধবধবে সাদা পত্রশূন্য সে-গাছ দেখে চমকে উঠতে হয়। সত্যিই ভূত দেখার মতো অবস্থা হয় মনের মধ্যে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ভূত গাছ ছিল না। কিংবা কে জানে! হয়তো ছিল। অরা দেখেনি। একটি ভূত-গাছকেও উপড়ে নিয়ে এসেছে অরা বুকে করে। সেই ভূত-গাছটাকে একেবারে অগ্নির মতো দেখতে কি?

অগ্নি বেচ্চারা। আহা ভালো তো বেসেছিল দু-জনে, দু-জনকে। ভীষণ-ই ভালোবেসেছিল। শ্যামার মতো গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে অরার “হায়! এ কী সমাপন।”

লিখবে লিখবে লিখবে করে চিঠি আর লেখা হল না অগ্নিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *