স্বৰ্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই, তা এখানেই। ফারসী লিপিতে এই বাণী লালকেল্লার দেওয়ান-ই-খাসের অলঙ্কৃত দেওয়ালে উৎকীর্ণ। সেই স্বর্গে সেপ্টেম্বরের বিশ তারিখে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো বিজয়ী ইংরেজ সেনানী। তাদের মুখে অসম্ভব ক্রোধ ও অস্থিরতা ঘাম ও রক্তের মতন মাখা। বিকটভাবে চর্ম পাদুকার শব্দ তুলে তারা ছোটাছুটি করতে লাগলো চতুর্দিকে, তাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত অস্ত্ৰ।
লালকেল্লা জনশূন্য। কয়েক মাসের দ্বাদশাহ বাহাদুর শাহ সপরিবারে পলাতক। ইংরেজ সৈন্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাঁদের কারুকে না পেয়ে অপরিসীম ক্ৰোধে উন্মত্তবৎ হয়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে আঘাত করে করে ভাঙতে লাগলো দেওয়ান-ই-খাসের স্বগোিপম দেওয়ালসজা। দুর্লভ প্রস্তরের কারুকাজ টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে লাগলো মেঝেতে। সেনাপতি কোনোক্রমে শান্ত করলেন তাঁর বাহিনীকে। প্রাঙ্গণে উড়িয়ে দেওয়া হলো ইউনিয়ন জ্যাক, যুদ্ধ বিজয়ের জন্য পরম করুণাময় ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য সেখানে অনুষ্ঠিত হলো থ্যাঙ্কস গিভিং প্রার্থনা।
লালকেল্লা থেকে চার মাইল দূরে হুমায়ুনের সমাধি ভবনে সম্রাট তখন সদলবলে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গে তখনও হাজারখানেক সিপাহী। তাঁর পরমার্শদাতারা তাঁকে পরস্পর-বিরোধী উস্কানি দিচ্ছে তখনও। কেউ বললো, এখনো সময় আছে, জাঁহাপনা দিল্লি ছেড়ে পলায়ন করুন, লক্ষ্ণৌয়ের দিকে সিপাহীরা আজও আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। কেউ বললো, বাদশাহ বরং দূত পাঠান ইংরেজের কাছে, তিনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করার জন্য বলুন যে এ বিদ্রোহে তাঁর সম্মতি ছিল না, সিপাহীরা জোর করে তাঁর ওপর কর্তৃত্বের ভার চাপিয়ে গেছে।
বৃদ্ধ, বিমূঢ় সম্রাট এর কোনোটাই করলেন না, বিহ্বল ও জড়ের মতন তিনি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলেন তাঁর পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের সুবিশাল সমাধিভবনে। সেই হুমায়ুন, যিনি একবার সাম্রাজ্য হারিয়েও আবার তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
ইংরেজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর একচক্ষু কানা রজব আলী সম্রাটের গতিবিধির সম্পূর্ণ বিবরণ এসে দাখিল করলো। পরদিনই ইংরেজ বাহিনীর সবচেয়ে দুঃসাহসী এবং হঠকারী সেনাপতি হডসন মাত্র পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে এগিয়ে গেল হুমায়ুনের সমাধির দিকে। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ এই যে সম্রাট বাহাদুর শাহকে সশরীরে বন্দী করতে হবে। সেইজন্য হাত নিসপিস করলেও হডসন সন্ধি করার আদেশ পাঠালেন সম্রাটের কাছে। পূর্ণ তিন ঘণ্টা রোদুরের মধ্যে অপেক্ষা করতে হলো হডসনকে, কোনো উত্তর এলো না। যে সহস্ৰাধিক সশস্ত্ৰ সিপাহী হুমায়ুনের সমাধি প্রহরায় রয়েছে, তারা ইচ্ছে করলে হাডসনের ক্ষুদ্র বাহিনীটিকে অল্পকালের মধ্যেই পর্যুদস্ত করতে পারে, কিন্তু তাদেরও আক্রমণ করার নির্দেশ দিল না কেউ।
তারপর এক সময় মসলিনের পদাঘেরা একটা পাল্কি খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। তার মধ্যে শুয়ে আছেন এক ক্ষুদ্রকায় বৃদ্ধ, যাঁর গুফ, দাড়ি ও মুখের রঙ একই রকম শ্বেত। ওষ্ঠে আলবোলার নল। সম্রাট সম্পূর্ণ বাক্যহীন।
বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রাখা হলো লালকেল্লার একটি ক্ষুদ্র কক্ষে। তাঁর খাদ্য পানীয়ের জন্য সাময়িকভাবে ভাতা বরাদ হলো দৈনিক দু আনা। সদ্য রাজ্যহীন, খেতাবহীন বাদশা সেখানে প্রায়ই বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন, হিন্দুস্তানীওমে কুছ দোস্ত, কুছ শাগির্দ, কুছ আজীজ, কুছ মাসুক, উও সব কে খাকমে মিল গ্যয়ে-। সব বন্ধু, প্রিয়, দোসর, আত্মীয় শেষ হয়ে গেল, শেষ হয়ে গেল।
সম্রাটকে বন্দী করেই ক্ষান্ত হলো না হডসন; এবার রাজকুমারদের পালা। উচ্ছৃঙ্খল, হঠকারী শাহী বংশের দুলালরা এই কয়েক মাস দিল্লিতে বসে ধরাকে সারা জ্ঞান করেছে। এবাবে হডসন সঙ্গে নিল একশো জন অশ্বারোহী, ওদিকে হুমায়ুনের সমাধির সামনেও প্রচুর ভিড় জমেছে। জনতা মাঝে মাঝে ধ্বনি তুলছে জেহাদের। কিন্তু রাজকুমারেরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করার বদলে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিল। রাজকুমাররা বেরিয়ে আসার পর তাদের সামনে পিছনে সৈন্য সাজিয়ে অগ্রসর হবার হুকুম দিল হাডসন। আর তাদের পাশে পাশে বিলাপ করতে করতে চললো দিল্লির মুসলমানরা।
খানিক দূর যাবার পর আর ধৈর্য রাখতে পারলো না হডসন। রাজপুত্র নামধারী এই বর্বর যুবকদের এখনো দিনের পর দিন বন্দী অবস্থায় খাইয়ে পরিয়ে তোয়াজ করে রাখতে হবে! খ্ৰীষ্টান নারী ও শিশুদের হত্যার জন্য এরাও দায়ী নয়? রাজকুমারদের মান সম্ভ্রম ধূলিসাৎ করবার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গরুর গাড়িতে, নিজে ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো হডসন। রাজকুমারদের পথে নামিয়ে হডসন কর্কশ গলায় হুকুম দিল তাদের সব বহুমূল্য পোশাক-পরিচ্ছদ তখনই খুলে ফেলবার জন্য। প্রায় নগ্ন অবস্থায় দণ্ডায়মান সেই রাজকুমারদের একেবারে বুকের কাছে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে নিজের হাতে প্ৰত্যেককে খুন করলো হডসন। তারপর উন্নত গ্ৰীবা ঘুরিয়ে হডসন তার অনুচরদের হুকুম দিল মৃতদেহগুলো কোতোয়ালির সামনে পথের উপর ফেলে রাখা হোক। দেখুক দিল্লির লোক!
সেখানেও শেষ নয়। কোনো এক অতিরিক্ত ইংরেজ-তোষামুদে দুই রাজকুমারের মুণ্ড কেটে নিয়ে তারপর সেই দুই ছিন্নমুণ্ড থালায় সাজিয়ে উপহার হিসেবে প্রেরণ করলো বাহাদুর শাহের কাছে।
রাজকুমারদের হত্যার পরই শুরু হলো প্ৰতিশোধ গ্রহণের পর্ব। সৈন্যবাহিনীকে দেওয়া হলো নির্বিচার হত্যা ও অবাধ লুণ্ঠনের অধিকার। দিল্লি নগরী নারকীয় রূপ ধারণ করলো, পথে পথে ছড়ানো মৃতদেহ, গৃহে গৃহে তাণ্ডব ও হাহাকার। খ্ৰীষ্টান হত্যার বদলা নেবার জন্য ইংরেজ জাতির মনে আর কোনো বিবেকের বাধা নেই। রুল অব ল এখন মুলতুবি। দিল্লির পর অন্যান্য বিদ্রোহী নগরীও একে একে ফিরে আসতে লাগলো ইংরেজের করায়ত্তে, সেসব স্থলের সামান্য সিপাহী-গন্ধযুক্ত হাজার হাজার মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হতে লাগলো। ফাঁসীতে ঝোলাতে সময় অযথা ব্যয় হয় বলে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে মনুষ্য-শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া অনেক বেশী সুবিধাজনক। মানুষই এমনভাবে মানুষকে মারতে পারে।
বিজয় অভিযান শুরু হওয়ার পর কোম্পানির রাজত্বের রাজধানী কলকাতা নগরীতেও দেখা গেল প্ৰবল প্ৰতিক্রিয়া। ইংরেজ সমাজ এবং তাদের সংবাদপত্রগুলি হিংসা-ক্ৰোধে লেলিহান ভাষায় দাবি তুললো প্ৰতিশোধের। ভারতীয়দের তারা সম্বোধন করতে লাগলো কুকুর, বাঁদর, নরকের কীট এবং আরও কদৰ্য ভাষায়। কোনো ভারতীয়ই বিশ্বাসযোগ্য নয়, এবং যে-হেতু ভারতীয়রা পুরোপুরি মনুষ্য পদবাচ্য নয়, তাই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব খোঁজারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। যে-সব ইংরেজ এতদিন ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করেছে, কোনো ভারতীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে, তাদের উদ্দেশ্যেও বর্ষিত হতে লাগলো প্রচণ্ড বিদ্রূপ। একবার যখন ভারতীয়রা বিদ্রোহ করেছে, এর পর থেকে তাদের একেবারে পায়ের তলায় চেপে রাখতে হবে। কেই সরকারকে পরামর্শ দিলে, সৈন্যবাহিনীতে আর একজনও ভারতীয় রাখা উচিত নয়, আফ্রিকা থেকে ভাড়াটে সৈন্য এনে এ দেশটাকে চাবকানো হোক। কেউ বললে, এবার এই সুযোগে সমস্ত ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানদের ধরে ধরে জোর করে খ্ৰীষ্টান করে দেওয়া হোক। যেন করা হয়েছে আমেরিকায় ক্রীতদাসদের, তা হলে আর তারা কখনো খ্ৰীষ্টান প্ৰভুত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। কেউ বললে, ভারতীয় রমণীদের বাধ্য করা হোক ইংরেজদের সঙ্গে রমণ-সহবাসে, তা হলে কিছুদিনের মধ্যেই এদেশে গড়ে উঠবে এক বেজন্ম জাতি, তারা আর নিজেদের হিন্দু বা মুসলমান বলে পরিচয় দিতে পারবে না, তারা রক্ত সম্পর্কে ইংরেজদের কাছে বশ্যতা মেনে থাকবে।
গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের অবশ্য যুক্তিসঙ্গত আইন প্রতিষ্ঠার বাতিক আছে। সারাজীবন তিনি সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য খ্যাতি পেয়েছেন, সব দিক বিচার করে ঠিক সুষ্ঠুভাবে তিনি সব কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে চান। সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী এই অসম্ভব বিশৃঙ্খলা, প্রতিশোধের পাগলামি এবং অকারণ নরহত্যার দাবিতে তাঁর শিক্ষিত স্বদেশবাসীর এমন চিৎকার, হট্টগোল—এসবে তিনি সায় দিতে পারলেন না। তিনি কড়া-হাতে রাশ টানবার চেষ্টা করলেন এবং ইংরেজদের অনুরোধ করলেন মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য। কিন্তু তাতে যেন আরও ভস্মে ঘি ঢালা হলো, ইংরেজদের মধ্যে হিংসার আগুন আরও বেশী জ্বলে উঠলো লকলক করে। তারা ক্যানিংকে মনে করলো স্ত্রীলোকদের মতন দুর্বল, বিদুপমিশ্রিত করে তাঁর নাম রাখলো ক্লিমেন্সি ক্যানিং, বিলেতে দরবার পাঠালো, যেন ক্যানিংকে অবিলম্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত থেকে। ইতিমধ্যে ভারত জুড়ে হত্যালীলা চলতে লাগলো যথেচ্ছভাবে।
সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পরও ইংরেজদের এই প্রতিক্রিয়া দেখে কলকাতার বাবু ও ধনী সমাজ হতভম্ব হয়ে গেল একেবারে। বাঙালীদের প্রতিও ইংরেজদের সমান রাগ। বাঙালীদের প্রতি তাদের কটুক্তির মাত্রা যেন আরও বেশী। অথচ, বাঙালীরা তো সিপাহী বিদ্রোহ সমর্থন করেনি, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সিপাহীরা ফুসে উঠলেও বাংলার ধনী ও জমিদারশ্ৰেণী তো তাদের কোনোরকম সাহায্য করেনি। এই তার পুরস্কার? ইংরেজের তল্পিবাহক বলে উত্তর ভারতে সিপাহীরা বাঙালীদের ঠিক খ্রীস্টানদের সমান গণ্য করেই মারধোর করেছে, ব্ৰাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পর্যন্ত সিমলা পাহাড়ে সিপাহীদের ভয়ে পলায়নের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, আর এখন সেই বাঙালীদের ওপরই ইংরেজদের এত রাগ?
ইংরেজের রাজত্বে বাংলায় এই প্ৰথম গড়ে উঠেছে একটা চাকুরিজীবী সমাজ। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের আর খাদ্যবস্ত্রের সমস্যা নেই এবং এই চাকুরির প্রভাবেই তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং তারা এদেশে ইংরেজের বদলে সিপাহীতন্ত্র চাইবে কেন? আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুণ এ দেশের জামদারশ্রেণী আগের চেয়ে অনেক বেশী ধনী হয়েছে, তাদের ধনাগমের অনিশ্চয়তাও কেটে গেছে, এমন সুখের অবস্থায় তারা ইংরেজ-বিরোধিতা করবে কোন মূঢ়তায়? আপামর জনসাধারণকে ইংরেজ যথাসাধ্য শোষণ করছে আর জমিদারদেরও শোষণ করার সুযোগ দিয়েছে, অতএব ইংরেজ ও দিশি জমিদার তো এক পক্ষে থাকবেই! তবু আজ জমিদার-তালুকদারদের ওপর ইংরেজের এত উম্মা কেন?
কোনো অনিচ্ছাকৃত দোষ করে ফেলার ফলে প্ৰভু যদি লাথি ঝাঁটা মারে তাতে আক্ষেপের কিছু থাকে না। কিন্তু কোনো দোষ করা হয়নি, বরং প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও প্ৰভু যদি প্রহার করার জন্য উদ্যত হন, তা হলে সেটা বড়ই মনস্তাপের ব্যাপার হয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ সমান খড়্গহস্ত হওয়ায় এবং প্রতিশোধের নানান হৃৎকম্প উদ্রেককারী প্রস্তাব শুনে বাঙালীবাবু ও ধনীরা প্রথমে বিস্মিত, তারপর ম্রিয়মান, তারপর প্ৰতিকারের চেষ্টায় তৎপর হলো।
বাঙালীরা অনেকেই ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষায় বেশ দক্ষ হয়েছে। তারাও কয়েকটি ইংরেজী পত্র-পত্রিকা প্ৰকাশ করে। সেই সব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে লাগলো নানান কাহিনী, কোথায় কোথায় ভারতীয়রা ইংরেজের পক্ষ নিয়ে প্রতিহত করেছে। সিপাহীদের। কোথায় কোন তাড়া খাওয়া, বিপন্ন ইংরেজ রাজপুরুষ আশ্রয় নিয়েছে দরিদ্র কৃষকের ঘরে। ইংরেজ রমণীদের মা ও ভগিনীজ্ঞানে আশ্রয় দিয়েছে কত পরিবার।
বাংলা সংবাদপত্রগুলিও পিছিয়ে রইলো না। অনেক ইংরেজ বাংলা পড়তে পারে কিংবা বাংলা সংবাদপত্রের মন্তব্য রেভারেণ্ড লঙ-এর মতন বাংলা-বিদদের কাছ থেকে জেনে নেয়। বাংলা পত্রপত্রিকাগুলিতেও শুরু হলো ইংরেজের কাছে কাতর ভাবে দয়া ভিক্ষার জন্য ভাষার কারিকুরি। কবিকুল-চূড়ামণি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বরাবরই ইংরেজের পক্ষ সমর্থনকারী, এবার তিনি সিপাহীদের সর্বনাশ কামনা করতে লাগলেন অকুণ্ঠভাবে। ইংরেজরা সিপাহীদের হত্যা করার ফলে উত্তর ভারত হাজার হাজার বিধবা রমণীর কান্নায় ড়ুবে যাচ্ছে শুনে তিনি কৃত্রিম সমবেদনা জানিয়ে লিখলেন, আহা, ওদের ওখেনে একটি বিদ্যেসাগর থাকলেই তো সমস্যা চুকে যেত। বিদ্যাসাগর সেই বিধবাদের আবার বিবাহ দিতেন, আর অমনি ওরা গায়ে নতুন গয়না পরে আবার আমোদ আহ্লাদ করতো আর সাধ মিটিয়ে খাওয়া দাওয়া করতো। সিপাহী বিদ্রোহের নেতাদের প্রত্যেকের নামে গালি-গালাজ করে তিনি তাদের একেবারে বাপ-পিতামহ-চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করতে লাগলেন। ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে নারীবিদ্বেষী ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন :
পিপীড়া ধরেছে ডানা মরিবার তরে।
হ্যাদে কি শুনি বাণী?
হ্যাদে কি শুনি ঝান্সীর রাণী
ঠোঁটকাটা কাকী
মেয়ে হয়ে সেনা নিয়ে সাজিয়াছে নাকি?
নানা তার ঘরের ঢেঁকী
নানা তার ঘরের ঢেঁকী মাগী খেঁকী
শেয়ালের দলে
এতদিনে ধনে জনে যাবে রসাতলে
এসবের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আবেদন নিবেদন। রাজা মহারাজার দল আগে থেকেই বিনয় বিগলিত স্মারকপত্র পাঠিয়ে তাদের ইংরেজ-আনুগত্য জানাতে শুরু করেছিল, দিল্লি পতনের পর তারা নবোদ্যমে অভিনন্দন জানাতে লাগলো সরকার বাহাদুর সমীপে।
বর্ধমানের মহারাজার উদ্যোগে সভা ডেকে ইংরেজের জয়ে উল্লাস প্রকাশ করা হলো এবং সুদীর্ঘ পত্রে তা জানানো হলো লর্ড ক্যানিংকে। সেই পত্রে বর্ধমানের মহারাজা ছাড়াও স্বাক্ষর করলেন কলকাতার ধনী শিরোমণি রাজা রাধাকান্ত দেব এবং আরও আড়াই হাজার হোমরা চোমরা। কৃষ্ণনগরের মহারাজা শ্ৰীশচন্দ্রও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে পাঠালেন পৃথক পত্র। উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখার্জি আগেভাগেই চিঠি দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি শুধু ইংরেজদের সমর্থনই করেননি, তাঁর প্রজাদের মধ্য থেকে আগুরি, গোয়ালা, বাগদী এবং ডোমদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে রেখেছিলেন এক ইংরেজ সার্জেনের নেতৃত্বে, যাতে সিপাহীরা এসে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। হিন্দুরা একতরফাভাবে ইংরেজের দয়া আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো কলকাতার মুসলমান সমাজ। তারাও একযোগে একটি আবেদনপত্র দাখিল করে জানালো যে বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রতি তাদের কোনোই সমর্থন ছিল না। তারাও ইংরেজ-রাজ-ভক্ত প্ৰজা, ইংরেজ রাজত্ব তাদের কাছেও খুব সুখের। ঢাকার নবাব জানালেন, তিনি হাতি দিয়ে সাহায্য করেছেন ইংরেজ সরকারকে, সেখানকার অন্যান্য জমিদার ও মৌলবীরাও ইংরেজের পক্ষেই তো রয়েছে বরাবর।
নবীনকুমার সিংহের বাড়িতেও জমায়েত হয়েছে অনেকে। বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকেও একটি আবেদন পাঠানো দরকার। ইংরেজী সংবাদপত্রগুলিতে তারস্বরে চিৎকার করা হচ্ছে, দায়িত্বপূর্ণ চাকুরি থেকে বাঙালীদের সরিয়ে দেওয়া হোক। বাঙালী ধনীদের সশস্ত্ৰ বরকন্দাজ রাখার অধিকার কেড়ে নেওয়া হোক। সুতরাং আত্মরক্ষার্থে বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও নতুন ধনীদেরও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়োজন।
নবীনকুমার চুপ করে বসে আছে এক পাশে। তার মুখমণ্ডল থমথমে। যদুপতি গাঙ্গুলী, কিশোরীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণকমল ভট্টাচাৰ্য প্রমুখ যুবকের মুখও চিন্তা-ভারাক্রান্ত। এরা কেউ একটিও বাক্য বিনিময় করছে না পরস্পরের সঙ্গে। ইংরেজের বিজয়ে এরা খুশী-প্ৰস্তাব পাঠাতে বলেছে। কিন্তু এদের মুখে খুশীর চিহ্নমাত্র নেই।
দরখাস্তটি রচনা করেছে কৃষ্ণদাস পাল, সে এ ব্যাপারে খুব উৎসাহী এবং নিজের ইংরেজী ভাষাজ্ঞান সে নিজেই খুব তারিফ করে। লেখা সাঙ্গ হবার পর কৃষ্ণদাস মুগ্ধভাবে সেদিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর পড়ে শোনাতে লাগলো। কেউ কিছু উচ্চবাচ্য করলো না।
নিজের স্বাক্ষরটি দেবার পর নবীনকুমার স্বগতভাবে বললো, আমি এতে সই কচ্চি বটে, কিন্তু আমার মন এতে সায় দিল না।
তারপর মুখ তুলে সে যদুপতিকে বললো, ব্রাদার, সত্যি কতাটি বলবো? আমরা সবাই মুখে সেপাইদের দুষেচি বটে। কিন্তু এই যে-কটা মাস দিল্লি স্বাধীন ছেল, ততদিন আমিও যেন মনে মনে স্বাধীন মানুষ হয়ে গেসলুম। হাজার হোক, ইংরেজ আমাদের বিজাতি, তাদের অধীনে আমরা পরাধীন হয়ে থাকা কি আমাদের বুকের ওপর একটা পাষাণভার রাখা নয়কো?
যদুপতি বললো, আমি তো এ কতা তোমায় আগেই বলচিলুম। তখন উড়িয়ে দিলে—।
নবীনকুমার বললো, ঐ যে হরিশ আমাদের বোজালে—।
হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখুজ্যের মুখখানিও বিমর্ষ। সে বললে, নবীন, আমি স্বীকার কচ্চি আমার ভুল হয়েছেল। ইংরেজকে আমরা চিনতে পারিনিকো। হাজার তোষামোদ করেও ইংরেজের মন পাওয়া যাবে না। আজ আমার মনে হচ্চে, সেপাইদের যুদ্ধকে আমরা যে চোকে দেকিচি, ভবিষ্যতের ইতিহাস সে চোকে দেকবে না। এই আমি বলে গেলুম, দেকো, মেলে কিনা। আমাদের জীবদ্দশাতেই সুর উল্টো হয়ে যাবে। তোমাদের কাচে আজ আমি আর একটা কতাও বলে যাচ্চি, আর কখুনো আমার লেখনি দিয়ে ইংরেজের গুণগান করবো না। যদি করি, তা হলে আমি খানকিরও অধম!
কথা শেষ করেই হরিশ কুর্তার জেব থেকে একটা ব্র্যাণ্ডির শিশি বার করে সেই তরল আগুন ঢক ঢক করে ঢেলে দিল গলায়।