২৬. শীঘ্রই দেবুর ঘাড়ের বোঝা নামিল

শীঘ্রই দেবুর ঘাড়ের বোঝা নামিল।

ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি তিনকড়িদের দায়রায় বিচার শেষ হইয়া গেল। নিষ্কৃতির কোনো পথই ছিল না তিনকড়ির। এক ছিদামের স্বীকৃতি—তাহার উপর স্বর্ণের সাক্ষ্য আরম্ভ হইতেই তিনকড়ি নিজেই অপরাধ স্বীকার করিয়া বসিল। স্বর্ণকে অনেক করিয়া উকিল শিখাইয়াছিলেন একটি কথা না। জানি না মনে নাই এবং না-এই তিনটি তার উত্তর। প্রথম এজাহারের কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে কি বলিয়াছে তার মনে নাই। রাম এবং তিনকড়ির মধ্যে কোনো কথাবার্তা হইয়াছিল কিনা জিজ্ঞাসা করিলে বলবে না। এমন কথা শোনে নাই।… কিন্তু আদালতে দাঁড়াইয়া হলপ গ্রহণ করিয়া স্বৰ্ণ যেন কেমন হইয়া গেল। সরকারি উকিলটি প্রবীণ, মামলা পরিচালনা করিয়া তাহার মাথায় টাকও পড়িয়াছে, এবং অবশিষ্ট চুলে পাকও ধরিয়াছে; লোকচরিত্রে তাঁহার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। কখন ধমক দিয়া কাজ উদ্ধার করিতে হয়, কখন মিষ্ট কথায় কাজ হাসিল করিতে হয়—এসব তিনি ভাল রকমই জানেন। হলপ গ্রহণ করিবার পরই স্বর্ণের বিবর্ণমুখ দেখিয়া তিনি প্রথমেই গম্ভীরভাবে বলিলেন-ভগবানের নামে ধর্মের নামে তুমি হলপ করেছ, বাছা। সত্য গোপন করে যদি মিথ্যা কথা বল তবে ভগবান তোমার উপর বিরূপ হবেন; ধর্মে তুমি পতিত হবে। তোমার বাপেরও তাতে অমঙ্গল হবে। তারপর তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা আরম্ভ করিলেন—এই কথা তুমি বলেছ এস্-ডিওর আদালতে?

স্বৰ্ণ বিহ্বল দৃষ্টিতে উকিলের দিকে চাহিয়া রহিল।

উকিল একটা ধমক দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন বল? উত্তর দাও?

স্বর্ণের মুখের দিকে চাহিয়া মুহূর্তে তিনকড়ি কাঠগড়া হইতে বলিয়া উঠিল আমি কবুল খাচ্ছি হুজুর। আমার কন্যাকে রেহাই দিন। আমি কবুল খাচ্ছি।

সে আপনার অপরাধ স্বীকার করিল। হ্যাঁ, আমি ডাকাতি করেছি। মৌলিক-ঘোষপাড়ায় দোকানির বাড়িতে যে ডাকাত পড়েছিল—তাতে আমি ছিলাম। বাড়িতে আমি ঢুকি নাই, ঘাঁটি আগলেছি।

আপনার দোষই স্বীকার করিলকিন্তু অন্য কাহারও নাম সে করিল না। বলিল—চিনি কেবল ছিদেমকে। ছিদেমই আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল তারই চেনা দল। আমার বাড়িতে সে অনেককাল কাজ করেছে। বন্যের পর ভিক্ষে করেই একরকম খাচ্ছিলাম। সাহায্য-সমিতি থেকে চাল-ধান ভিক্ষে নিচ্ছি দেখে সে আমাকে বলেছিল—গেলে মোটা টাকা পাব। আমি লোভ সামলাতে পারি নি, গিয়েছিলাম। আর যারা দলে ছিল—তারা কোথাকার লোক, কি নাম—আমি কিছুই জানি না। রামভল্লার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিলরাম আমাকে বলেছিল—তুমি ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে এই করলে! এই পর্যন্ত।

সকলের নাম করিয়া রাজসাক্ষী হইলে তিনকড়ি হয়ত খালাস পাইত। কিন্তু তাহা সে করিল না। তবু বিচারক তাহার নিজের দোষ স্বীকার করার জন্য আসামিদের তুলনায় তাহাকে কম সাজা দিলেন। চারি বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড হইয়া গেল তিনকড়ির। রাম, তারিণী প্রভৃতির হইল কঠোরতর সাজা; পূর্বের অপরাধ, দণ্ড প্রভৃতির নজির দেখিয়া বিচারক তাহাদের উপর ছয় হইতে সাত বৎসর কারাবাসের আদেশ দিলেন।…

দেবু আদালত হইতে বাহির হইয়া আসিল। যাক, একটা অপ্রীতিকর অস্বস্তিকর দায় হইতে অব্যাহতি পাইল। দুঃখের মধ্যেও তাহার সান্ত্বনা যে, তিনকড়ি-খুড়া যেমন পাপ করিয়াছিল, তেমনি সে নিজেই যাচিয়া দণ্ড গ্ৰহণ করিয়াছে।

রায়ের দিন সে একাই আসিয়াছিল। স্বৰ্ণ বা তিনকড়ির স্ত্রী আসে নাই। দণ্ড নিশ্চিত এ কথা সকলেই জানে, কেবল দণ্ডের পরিমাণটা জানার প্রয়োজন ছিল—সেইটাই তাহাদিগকে গিয়া জানাইতে হইবে।

ফিরিবার পথে একবার সে ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টার অব স্কুসের আপিসে গেল—স্বর্ণের পরীক্ষার খবরটা জানিবার জন্য। খবর বাহির হইবার সময় এখনও হয় নাই; তবু যদি কোনো। সংবাদ কাহারও কাছে পাওয়া যায় সেইজন্যই গেল।

স্বর্ণ এম-ই পরীক্ষা দিয়াছে; এবং ভালই দিয়াছে। প্রশ্নপত্রের উত্তরগুলি সে যাহা লিখিয়াছে, সে তাহাতে পাস হইবেই। অঙ্কের পরীক্ষায় সমস্ত অঙ্কগুলি স্বর্ণের নির্ভুল হইয়াছে।

দেবুর প্রত্যাশা স্বর্ণ বৃত্তি পাইবে। এম-ই পরীক্ষায় বৃত্তি মাসিক চারি টাকা এবং পাইবে পূর্ণ চারি বৎসর। বৃত্তি পাইলে স্বর্ণ জংশনের বালিকা বিদ্যালয়ে একটি কাজ পাইবে। শিক্ষয়িত্রীরা আশ্বাস দিয়াছেন, স্কুলের সেক্রেটারিও কথা দিয়াছেন। তাঁহাদের গরজও আছে। স্কুলটাকে তাহারা ম্যাট্রিক স্কুল করিতে চান। চাকরি দিয়াও স্বর্ণকে হারা ক্লাস সেভেনে ভর্তি করিয়া লইবেন। এ হলেই স্বর্ণের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সে নিশ্চিত হইতে পারিবে। যে মন্ত্র সে দিতে পারে নাই, স্বর্ণ সেই মন্ত্র খুঁজিয়া পাইবে জ্ঞানের মধ্যে বিদ্যার মধ্যে। শুধু মন্ত্রই নয়—সসম্মানে জীবিকা উপার্জনের অধিকার পাইয়া স্বর্ণ তাহার জীবনকে সার্থক করিয়া তুলিতে পারিবে। কল্পনায় সে স্বর্ণের শুভ্ৰ-শুচি-স্মিত রূপও যেন দেখিতে পায়। বড় ভাল লাগে দেবুর। পরিচ্ছন্ন বেশভূষা পরিয়া, মুখে শিক্ষা এবং সপ্রতিভতার দীপ্তি মাখিয়া, স্বৰ্ণ যেন তাহার চোখের সম্মুখে দাঁড়ায় স্মিত হাসিমুখে।

স্কুল-ইন্সপেক্টারের আপিসে আসিয়া সে অপ্রত্যাশিতরূপে সংবাদটা পাইয়া গেল। জেলা শহরের বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী এবং সেক্রেটারি বারান্দায় দাঁড়াইয়া কথা। বলিতেছিলেন। সে অদূরে দাঁড়াইয়া খুঁজিতেছিল কোনো পরিচিত কেরানিকে। যখন সে গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিতি করিত, তখন কয়েকজনের সঙ্গে তাহার আলাপ ছিল। হঠাৎ তাহার কানে আসিল শিক্ষয়িত্রী বলিতেছেন আপনিই চিঠি লিখুন। আপনার চিঠির অনেক বেশি দাম হবে; স্কুলের সেক্রেটারি, নামকরা উকিল আপনি, আপনার কথায় ভরসা হবে তাদের। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে তো বৃত্তি পেলেও সহজে ঘর ছেড়ে শহরে পড়তে আসবে না। আপনি যদি লেখেন, কোনো ভাবনা নেই, হোস্টেলে ফ্রি, স্কুল ফ্রি, এ ছাড়া আমরা হাত-খরচাও কিছু দেব-আপনি নিজেঅভিভাবকের মত দেখবেন, তবেই হয়ত আসতে পারে।

—বেশ, তাই লিখে দেব আমি।

–হ্যাঁ। মেয়েটি অদ্ভুত নম্বর পেয়েছে। খুব ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে।

–স্বৰ্ণময়ী দাসী। দেখুড়িয়া, পোস্ট কঙ্কণা।–এই ঠিকানা তো?

–হ্যাঁ, মেয়েটির বাপের নাম বুঝি তিনকড়ি মণ্ডল। শুনলাম লোকটা একটা ডাকাতি কেসে ধরা পড়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন তো! বাপ ডাকাত, আর মেয়ে বৃত্তি পাচ্ছে!

দেবু আনন্দে প্রায় অধীর হইয়া উঠিল। সে অগ্রসর হইয়া পরিচয় দিয়া জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিল—তাহারা কি চান? কিন্তু সেই মুহূর্তেই সেক্রেটারিবাবু বলিল—আচ্ছা, আমি শিবকালীপুরের জমিদারকে চিঠি লিখছি—শ্ৰীহরি ঘোষকে। তাকে আমি চিনি।

দেবু থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল। তাহারা চলিয়া গেলে—তাহার দেখা হইল এক পরিচিত কেরানির। সঙ্গে। তাহাকে নমস্কার করিয়া সে বলিল ওই মহিলাটি আর ওই ভদ্রলোকটি কে বলুন তো?

–কে? ও মহিলাটি এখানকার গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস আর উনি সেক্রেটারি রায়সাহেব সুরেন্দ্র বোস উকিল। কেন বলুন তো?

—না। এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। বৃত্তির কথা বলছিলেন ওঁরা।

–হ্যাঁ। আজ বৃত্তির খবর জেনে গেলেন। ওঁরা বৃত্তি পাওয়া মেয়ে যাতে ওঁদের ইস্কুলে আসে। সেই চেষ্টা করবেন। তাই আগে এসে প্রাইভেটে সব জেনে গেলেন। আমরা পাব সব দু-চার দিনের মধ্যেই। আপনি তো পণ্ডিতি ছেড়ে খুব মাতব্বরি করছেন। একটা ডাকাতি মামলার তদবির করলেন শুনলাম। কি রকম পেলেন?

দেবুর মনে হইল—কে যেন তাহার পিঠে অতর্কিতে চাবুক দিয়া আঘাত করিল। পা হইতে মাথা পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া হাসিয়া সে বলিলতা বেশ, পাচ্ছিলুম বেশ, এখন হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।

—আমাদের কিছু খাওয়ান-টাওয়ান? লোকটি দাঁত মেলিয়া হাসিতে লাগিল।

দেবু বলিল—আপনিও হজম করতে পারবেন না। বলিয়াই সে আর দাঁড়াইল না। স্টেশনের পথ ধরিল। শহর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া খানিকটা মুক্ত প্রান্তর। প্রান্তরটা পার হইয়া রেলওয়ে স্টেশন। জনবিরল মুক্ত প্রান্তরে আসিয়া সে যেন নিশ্বাস ফেলিয়া বঁচিল। আঃ! এইবার তাহার ছুটি। এদিকে সাহায্য-সমিতির কাজ ফুরাইয়াছে; সমিতির হিসাব-নিকাশ ডাক্তারকে বুঝাইয়া দিয়াছে; সামান্য কিছু টাকা আছে, সে টাকা এখন মজুদ থাকিবে স্থির হইয়াছে। ডাক্তারকেই সে-টাকা যে দিয়া দিয়াছে। এদিকে তিনকড়ির মামলা চুকিয়া গেল; স্বর্ণ বৃত্তি পাইয়াছে। সে জংশনের স্কুলে চাকরিও করিবে–পড়াশুনাও চলিবে। শহরের স্কুলের চেয়ে সে অনেক ভাল। বিশেষ করিয়া সে স্কুলের সেক্রেটারি শ্রীহরির জানাশুনা লোক, সে মনে করে জমিদারই দেশের প্রভু, পালনকর্তা, আজ্ঞাদাতা, তাহার স্কুলে সে কখনই স্বর্ণকে পড়িতে দিবে না। কখনই না। জংশনের স্কুল অন্য দিক দিয়াও ভাল, ঘরের কাছে; জংশনে থাকিলে জগন ডাক্তার খোজখবর করিতে পারিবে। যাক, স্বর্ণদের সম্বন্ধেও সে একরূপ নিশ্চিন্ত। এইবার তাহার সত্য সত্যই ছুটি। আঃ, সে বাঁচিল!

 

জংশনে সে যখন নামিল, তখন বেলা আর নাই। সূর্য অস্ত গিয়াছে, দিনের আলাে ঝিকিমিকি করিতেছে ময়ূরাক্ষীর বালুময় গর্ভের পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে মনে হয় ময়ূরাক্ষীর দুটি তটভূমি একটি বিন্দুতে মিলিয়া দিগন্তের বনরেখার মধ্যে মিলিয়া মিশিয়া গিয়াছে। ময়ূরাক্ষীর গর্ভ প্রায় জলহীন। শীতের দিন, নদীর গর্ভে বালিতে ঠাণ্ডার আমেজ লাগিয়াছে ইহারই মধ্যে। নদীর বিশীর্ণ ধারায় কৃচিৎ কোথাও জল একটু। ঘাটে আসিয়া দেবু মুখ-হাত ধুইয়া একটু বসিল। তাহার জীবনে কিছুদিন হইতেই অবসাদ আসিয়াছে—আজ সে অবসাদ যেন শেষরাত্রির ঘুমের মত তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। খােকন আগের দিন মারা গিয়াছিল পরের দিন রাত্রি দুইটার সময় মারা গিয়াছিল বিলু। সেদিন শেষ রাত্রে যেমনভাবে ঘুম তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছিল—আজ অবসাদও তেমনিভাবে তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। যাক্, কাজ তাহার শেষ হইয়াছে। পরের বােঝা ঘাড় হইতে নামিয়াছে—ভূতের ব্যাগার খাটার আজ হইতে পরিসমাপ্তি। আর কোনাে কাজ নাই—কোনাে দায়িত্ব নাই।। | দেবুর মনে পড়িয়া গেল—ন্যায়রত্ন সেদিন ঠিক এইখানেই বসিয়া পড়িয়াছিলেন। সে উদাস দৃষ্টিতে উপরের দিকে চাহিল। ময়ূরাক্ষীর জলপ্রবাহের পর বালির রাশি; তারপর চর, এ-দেশে বলে—‘ওলা’; ময়ূরাক্ষীর চরভূমিতে এবার চাষ বিশেষ হয় নাই; উর্বর পলিমাটি কাটিয়া উষর হইয়া পড়িয়া আছে। চরভূমির পর বাঁধ। বাঁধের ওপাশে পঞ্চগ্রামের মাঠ। বন্যার পর আবার তাহাতে ফসলের অঙ্কুর দেখা দিয়াছে। সে অবশ্য নামে মাত্র। পঞ্চগ্রামের মাঠকে অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টন করিয়া পঞ্চগ্রাম। সাড়া নাই, শব্দ নাই, জরাজীর্ণ পাচখানা গ্রাম যেন চর্মকঙ্কালের বোঝা লইয়া নিঝুম হইয়া পড়িয়া আছে।

সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে। শীত-সন্ধ্যার সূর্যালােকের শেষ আভার মধ্য হইতে উত্তাপ ইহারই মধ্যে উপিয়া গিয়াছে। দেবু উঠিল। জল পার হইয়া বালি ভাঙিয়া সে আসিয়া উঠিল বাধের উপর। স্বর্ণদের বাড়িতে খবর দিয়া বাড়ি ফেরাই ভাল মনে হইল। তিনকড়ির সাজা । অনিবার্য—এ তাহারাও জানে, তবুও তাহারা উদ্বেগ লইয়া বসিয়া আছে। মানুষের মন ক্ষীণতম আশাকে আঁকড়িয়া ধরিয়া রাখিতে চায়। বন্যার স্রোতে ভাসিয়া যাওয়া মানুষ কুটা ধরিয়া বাচিতে চায় কথাটা অতিরঞ্জিত; কিন্তু সামান্য একটা গাছের ডাল দেখিলে সেটাকে সে ছাড়ে না—এটা। সত্য কথা। স্বর্ণ এখনও আশা করিয়া আছে যে, তাহার বাবা যখন দোষ স্বীকার করিয়াছে, তখন জজসাহেব মৌখিক শাসন করিয়াই ছাড়িয়া দিবেন। সাজা দিলেও অতি অল্প কয়েক মাসের সাজা হইবে। এ সংবাদে স্বর্ণ আঘাত পাইবে—কিন্তু উপায় কি? স্বর্ণের বৃত্তি পাওয়ার সংবাদটাও দেওয়া হইবে। সঙ্গে সঙ্গে দেবু স্বর্ণের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা পাকা করিয়া ফেলিবে। সব কাজ সারিয়া। শেষ করিতে হইবে। আর নয়। সে একবার বাহির হইতে পারিলে বাঁচে।

হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনে হইল—বাঁধের পাশে ময়ূরাক্ষীর চরের উপর জঙ্গলের ভিতরে যেন নিঃশব্দ ভাষায় কাহারা কানাকানি হাসাহাসিতে মাতিয়া উঠিয়াছে। পাশেই শ্মশান। দেবুর সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তাহার বিলু এবং খোকন এইখানেই আছে। তবে কি তাহারাই? হ্যাঁ, তাহাদের দেহ নাই, কণ্ঠযন্ত্রের অভাবে বুকের কথা শব্দহীন বায়ুপ্রবাহের মত শুনাইতেছে। তাহারা মায়ে-ছেলেতে বোধ করি খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে। হাসাহাসি কানাকানির ঢেউ শূন্যলোক ভরিয়া গিয়া লাগিয়াছে গাছের মাথায় মাথায়। শ্মশানের ভিতর জঙ্গলের মধ্যে অশরীরী আত্মা দুটি ছুটাছুটি করিয়া ফিরিতেছে। খেলায় মাতিয়া তাহারা যেন নাচিয়া নাচিয়া চলিয়াছে; তাহাদের চলার বেগের আলোড়নে শীতের ঝরা পাতার মধ্যে ঘূর্ণি জাগিয়াছে; বোধহয় খোকন ছুটিয়াছে, তাহাকে ধরিবার জন্য পিছন পিছন ছুটিয়াছে বিলু। ঠিক তাই। তাহাদের উল্লসিত চলার চিহ্ন পাতার ঘূর্ণি এ গাছের আড়াল হইতে ও গাছের আড়ালে চলিয়াছে নাচিয়া নাচিয়া। দেবু আর এক পা নড়িতে পারিল না। সে যেন কেমন অভিভূত হইয়া পড়িল। ভয়-বিস্ময়-আনন্দ সব মিশাইয়া সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! তাহার ইচ্ছা হইলসে একবার চিৎকার করিয়া ডাকে বিলুবিলু খোকন। কিন্তু তাহার গলা দিয়া স্বর বাহির হইল না। কিন্তু তাহারাও কি তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না? তাহার উপস্থিতি সম্বন্ধে তাহাদের এত অবহেলা কেন? পরের বোঝা দশের কাজ লইয়া ভুলিয়া আছে—এইজন্য? কয়েক মুহূর্ত পরেই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য অশরীরীদের পদক্ষেপ স্তব্ধ হইয়া গেল। তবে তাহারা কি তাহাকে দেখিয়াছে? হ্যা! ওই যে আবার নিঃশব্দ ভাষায় আর হাসাহাসি কানাকানি নাই—এবার নিঃশব্দ অভিমান-ভরা একটানা সুর উঠিয়াছে। এবার যেন তাহারা ডাকিতেছে—আয়—আয়-আয়–আয়। আকাশে বাতাসে-গাছের মাথায় মাথায়—পঞ্চগ্রামের মাঠ ভরিয়া উঠিয়াছে সেই নিঃশব্দ। ভাষার উতরোল আহ্বান। হ্যাঁ, তাহারাই তাহাকে ডাকিতেছে। তাহার সর্বশরীর ঝিমঝিম করিয়া উঠিল—সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী যেন অবসন্ন হইয়া আসিতেছে। হাতের পায়ের আঙুলের ডগায় যেন। আর স্পর্শবোধ নাই। কতক্ষণ যে এইভাবে অসাড় অভিভূত হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল কে জানে, হঠাৎ একটা দূরাগত ক্ষীণ সুরধ্বনি তাহার কানে আসিয়া ক্রমশ স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে আরম্ভ করিল। শব্দের স্পর্শের মধ্য দিয়া জীবিত মানুষের সঙ্গে অস্তিত্ববোধ তাহার অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্ৰিয়গুলিকে সচেতন করিয়া তুলিল; সকালের রৌদ্রের আলোক এবং উত্তাপের স্পর্শেরাত্রের মুদিতদল পদ্মের মত আবার দল মেলিয়া জাগিয়া উঠিল। এতক্ষণে তাহার ভুল ভাঙিল; বুঝিল বিলু-খোকনের হাসাহাসি কানাকানি নয়, বাতাস ও গাছের খেলা; শীতের বাতাসে—তালগাছের মাথায় পাতায় পাতায় শব্দ উঠিতেছে। জঙ্গলের ঝরা পাতায় ঘূর্ণি জাগিয়াছে। ওদিকে পিছনে—ময়ূরাক্ষী গর্ভে মানুষের গান ক্রমশ নিকটে আগাইয়া। আসিতেছে।

কাহারা গান গাহিতে গাহিতে ময়ূরাক্ষী পার হইয়া এইদিকেই আসিতেছে। শুক্লপক্ষের চতুর্থ কি পঞ্চমীর একফালি চাঁদ রুপার কাস্তের মত পশ্চিম আকাশে মৃদু দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করিতেছে; প্রকাও বড় ঘরে প্রদীপের আলোর মত অনুজ্জ্বল জ্যোঙ্গা। লোকগুলি আসিতেছে—অস্পষ্ট ছায়ার মত। অনেকগুলি লোক, স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে দল বাঁধিয়া আসিতেছে। হঠাৎ মনে পড়িল—ও! বাউরি, মুচি, ডোমেরা সব কলে খাঁটিয়া ফিরিতেছে। এতক্ষণে দেবু চলিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে ভাবিতেছিল—বিলুর কথা নয়, খোকনের কথা নয়, ওই লোকগুলির কথা। উহাদের সাড়ায় সে যে আশ্বাস আজ পাইয়াছে, তাহা সে কখনও ভুলিতে পারিবে না। উহাদের মঙ্গল হউক। তাহাদের বর্তমান অবস্থার কথা ভাবিয়া দেবুর আনন্দ হইল। তবু ইহারা অনেকটা রক্ষা পাইয়াছে। দেড় মাস এখনও হয় নাই, ইহাদের মধ্যে অনেকে তিঠিয়াছে। অভাব অভিযোগ অনেক আছে, তবুও দুবেলা দুমুঠা জুটিতেছে। বাড়ি ফিরিয়া গিয়াই সকলে ঢোল পাড়িয়া বসিবে। ইহাদের সম্বন্ধে দেবু নিশ্চিন্ত হইয়াছে। একটা বোঝ ঘাড় হইতে নামিয়াছে। এইবার আজই স্বর্ণদের বোঝা নামাইবার ব্যবস্থা সে করিয়া আসিবে। অনেক বোঝা সে বহিল—আর নয়। ইহার মধ্যে কতদিন কতবার সে ভগবানের কাছে বলিয়াছে—হে ভগবান, মুক্তি দাও, আমাকে মুক্তি দাও।… কিন্তু মুক্তি পায় নাই। কতদিন বিলু ও খোকার চিতার পাশে কাঁদিবে বলিয়া বাহির হইয়াও কাঁদতে পায় নাই। মানুষ পিছনে পিছনে আসিয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। মুহূর্তে তাহার মন অনুশোচনায় ভরিয়া উঠিল। দীর্ঘকাল বিলু-খোকাকে ভুলিয়া থাকিয়া তাহার মনের অবস্থা এমন হইয়াছে যে, আজ নির্জন ওই শ্মশানের ধারে দাঁড়াইয়া বিলু-খোকার অশরীরী অস্তিত্বের আভাস অনুভব মাত্রেই তাহার মন, চেতনা ভয়ে সঙ্কুচিত হইয়া অন্তরে অন্তরে পরিত্রাণ চাহিয়া সারা হইয়া গেল। ওই মানুষ কয়টির সাড়া পাইয়া তাহার মনে হইল সে যেন বাঁচিল। নিজেকে নিজেই ছি-ছি করিয়া উঠিল। সংকল্প করিল-না, আর নয়, আর নয়।

দেখুড়িয়ায় ঢুকিবার মুখেই কে অন্ধকারের মধ্যে ডাকিল—কে? পণ্ডিত মাশায় নাকি?

চিন্তামগ্ন দেবু চমকিয়া উঠিল—কে?

–আমি তারাচরণ।

–তারাচরণ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। সদর থেকে ফিরলেন বুঝি?

–হ্যাঁ।

–তিনকড়ির মেয়াদ হয়ে গেল? কতদিন?

–চার বছর।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তারাচরণ বলিল—অন্যায় হয়ে গেল পণ্ডিত মশায়! ঘরটা নষ্ট হয়ে গেল।… তারপর হাসিয়া বলিল—কোন্ ঘরটাই বা থাকল? রহম-চাচারও আজ সব গেল।

—সব গেল! মানে?

–দৌলতের কাছে হ্যান্ডনোট ছিল, তার নালিশ হয়েছিল; সুদে আসলে সমান সমান, তার ওপর আদালত-খরচা চেপেছে। প্রথম আজ অস্থাবর হল। কি আর অস্থাবর? মেরেকেটে পঞ্চাশটা টাকা হবে। বাকির জন্য জমি ক্রোক হবে। জমিতে খাজনা বাকি পড়ে এসেছে।

দেবু চুপ করিয়া রহিল। সে যেন পথ চলিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিল।

পরামানিক বলিল—এ আর রহম-চাচা সামলাতে পারবে না। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া তারাচরণ বলিল—একটা কথা শুভোব পণ্ডিত মশাই?

—বল।

–আপনি নাকি তিনকড়ির কন্যের বিয়ে দেবেন? বিধবা-বিয়ে?

দেবু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল—কে বললে তোমায়?

তারাচরণ চুপ করিয়া রহিল।

দেবু উষ্ণ হইয়াই বলিল—তারাচরণ!

–আজ্ঞে?

–কে রটাচ্ছে এসব কথা বল তো? শ্ৰীহরি বুঝি?

–আজ্ঞে না।

–তবে?

তারাচরণ বলিল–ঘোষাল বলছিল।

—হরেন ঘোষাল?

–হ্যাঁ।

দপ করিয়া মাথায় যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিল—কিন্তু কি বুলিবে দেবু খুঁজিয়া পাইল না। কিছুক্ষণ পর বলিল—মিছে কথা তারাচরণ। তবে হ্যাঁ, স্বর্ণ রাজি হলে ওর বিয়ে আমি দিতাম।

 

স্বর্ণদের বাড়িতে যখন দেবু আসিয়া উঠিল—তখন মা ও মেয়ে একটি আলো সামনে রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে।

সমস্ত শুনিয়া তাহারা চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। কিছুক্ষণ ধরিয়া কেহ একটা কথা বলিতে পারিল না।

তারপর দেবু স্বর্ণের বৃত্তি পাওয়ার সংবাদ দিল। তাহা শুনিয়াও স্বর্ণ মুখ তুলিল না।

স্বর্ণের মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দেবু বলিল আমি আপনাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলাম।

স্বর্ণের মা বলিল—তুমি যা বলবে তাই করব। তুমি ছাড়া আর তো কেউ নাই আমাদের।

এমন সকরুণ স্বরে সে কথা কয়টি বলিল যে, দেবু কিছুতেই বলিতে পারিল না যে, আমি আর কাহারও বোঝা বহিতে পারি না। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে বলিল—আমি তো এখানে থাকব না খুড়ী-মা!

—থাকবে না?

স্বর্ণ চমকিয়া উঠিল; এতক্ষণে সে বলিল—কোথায় যাবেন দেবু-দা?

—তীর্তে যাব ভাই।

–তীর্থে।

–হ্যাঁ ভাই, তীর্থে। শূন্য ঘর আর আমার ভাল লাগছে না।

স্বৰ্ণ আর কোনো কথা বলিতে পারি না। স্তব্ধ নীরব হইয়া গেল মাটির পুতুলের মত। কিছুক্ষণ পর আলোর ছটায় দেবুর নজরে পড়িল—স্বর্ণের চোখ হইতে নামিয়া আসিতেছে জলের

দুটি ধারা। সে মুখ ঘুরাইয়া লইল। মমতায় তাহার অবিশ্বাস নাই, তাহার প্রাণে অফুরন্ত মমতা। এখানকার মানুষকে সে ভালবাসে নিতান্ত আপনজনেরই মত। এক শ্ৰীহরি ছাড়া কাহারও সঙ্গে তাহার মনোমালিন্য নাই। এখানকার মানুষ তো দূরের কথা—এখানকার পথের কুকুরগুলিও তাহার বাধ্য ও প্রিয়। গ্রামের কয়েকটা কুকুর ইদানীং উচ্ছিষ্ট-লোভে জংশনে গিয়া পড়িয়াছে। তাহারা জংশনে তাহাকে দেখিয়া আজও যে আনন্দ প্ৰকাশ করে সে তাহার মনে আছে। আজই দুইটা কুকুর তাহার সঙ্গে সঙ্গে ময়ূরাক্ষীর ঘাট পর্যন্ত আসিয়াছিল। এখানকার গাছপালা, ধুলা মাটির উপরে তাহার এক গভীর মমতা। এই গ্রাম লইয়া কতবার কত কল্পনাই সে করিয়াছে। কত অবসর সময়ে কাগজের উপর গ্রামের নকশা ঝাঁকিয়া পথঘাটের নূতন পরিকল্পনা করিয়াছে। কোথায় সাঁকো হইলে উপকার হয়, কোথায় অসমান পথ সমান হইলে সুবিধা হয়, বাঁকা পথ। সোজা হইলে ভাল লাগে, বন্ধ পথকে বাড়াইয়া গ্রামান্তরের সঙ্গে যুক্ত করিলে ভাল হয়—কত চিন্তা করিয়া ছবি ঝাঁকিয়াছে। গ্রামের লোক, এ অঞ্চলের লোকও তাহাকে ভালবাসে এ কথা সে জানে। তাহারাই আবার তাহাকে পতিত করে, তাহার গায়ে কলঙ্কের কালি লেপিয়া দেয়, তাহাকে আড়ালে ব্যঙ্গ করে—তবুও তাহারা তাহাকে ভালবাসে। সে ভালবাসা দেবুও অন্তরে অন্তরে অনুভব করে। কিন্তু সে মমতার প্রতি ফিরিয়া চাহিলে আর তাহার যাওয়া হইবে না। সে আপনাকে সংযত করিয়া মুখ ফিরাইয়াই বলিল—তোমার ব্যবস্থা যা বলেছিলাম আমি, তাতে তোমার অমত নাই তো?

স্বৰ্ণ মাটির দিকে চাহিয়া বোধ করি বারকয়েক ঠোঁট নাড়িল, কোনো কথা বাহির হইল না।

দেবু বলিয়া গেল—আমার ইচ্ছা তাই। ভেবে দেখে—এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা কিছু হতে পারে না তোমাদের। জংশনের স্কুলে চাকরি করবে, পড়বে। তোমার মাইনে বৃত্তি প্রভৃতিতে নগদ পনের-ষোল টাকা হবে। ওদের চেপে ধরলে কিছু বেশিও হতে পারে। এর ওপর সতীশকে আমার জমি ভাগে দিলাম—সে তোমাদের মাসে এক মন হিসেবে চাল দিয়ে আসবে। স্বাধীনভাবে থাকবে। ভবিষ্যতে ম্যাট্রিক পাস করলে চাকরিতে আরও উন্নতি হবে। লেখাপড়া শিখলে মনেও বল বাড়বে। কতজনকে তখন তুমিই আশ্রয় দেবে প্রতিপালন করবে। আর গৌরও নিশ্চয় ফিরবে এর মধ্যে।

দেবু চুপ করিল। স্বর্ণের উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। কিন্তু স্বর্ণ কোনো উত্তর দিল না। দেবু আবার প্রশ্ন করিলখুড়ী-মা?

একান্ত অনুগৃহীতজনের মানিয়া লওয়ার মতই স্বর্ণের মা দেবুর কথা মানিয়া লইল—তুমি যা বলছ তাই করব বাবা।

দেবু বলিল—স্বর্ণ?

—বেশ।…একটি কথায় স্বর্ণ উত্তর দিল।

দেবু এবার মুখ ফিরাইয়া স্বর্ণের দিকে চাহিল। স্বর্ণ এখনও আত্মসংবরণ করিতে পারে নাই, তাহার চোখের কোণের জলের ধারাটি এখনও শুকাইয়া যায় নাই।

দেবু উঠিয়া পড়িল; এ সবই তাহার না-জানার অভিনয়ের পিছনে ঢাকা পড়িয়া থাকা ভাল। নইলে কাঁদিবে অনেকেই।

 

তিন দিন পর যখন দেবু বিদায় লইল, তখন সত্য সত্যই অনেকে কাঁদিল।

বাউরিরা কাঁদিল। সতীশের ঠোঁট দুইটা কাঁপিতেছিল—চোখে জল টলমল করিতেছিল। সে বলিল, আমাদের দিকে চেয়ে কে দেখবে পণ্ডিত মশায়!

পাতু নাই, সে অনিরুদ্ধের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে—নহিলে সেও কাঁদিত। পাতুর মা হাউমাউ করিয়া কান্দিল আঃ, বিলু মা রে! তোর লেগে জামাই আমার সন্ন্যেসী হয়ে গেল।

আশ্চর্যের কথা, ইহাদের মধ্যে দুর্গা কাঁদিল না। সে বিরক্ত হইয়া মাকে ধমক দিল—মরণ! থাম বাপু তুই।

দেবুর জ্ঞাতিরা কাঁদিল। রামনারায়ণ কাঁদিল, হরিশ কাঁদিল। শ্ৰীহরিও বলিল—আহা, বড় ভাল লোক। তবে এইবার দেবু খুড়ো ভাল পথ বেছে নিয়েছে।

হরেন ঘোষালও কাঁদল—ব্রাদার, আবার ফিরে এস।

জগন ডাক্তারও দেবুর সঙ্গে নিরিবিলি দেখা করিয়া কাঁদিল; বলিল-আমিও জংশনে জায়গা কিনছি, এখানকার সব বেচে দিয়ে ওখানেই গিয়ে বাস করব। এ গাঁয়ে আর থাকব না।

ইরসাদ আসিয়াছিল! সেও চোখের জল ফেলিয়া বলিয়া গেল—দেবু-ভাই, এবাদতের কাজে বাধা দিতে নাই। বারণ করব না—খোদাতালা তোমার ভালই করবেন। কিন্তু আমার দোস্ত কেউ রইল না।

রহম আসে নাই। কিন্তু সে-ও নাকি কাঁদিয়াছে। ইরসাদই বলিয়াছে রহম-চাচার চোখ দিয়ে পানি পড়ল ঝঝর করে। বললে ইরসাদ বাপ, তুমি বারণ করিয়ো। সব্বস্বান্ত হয়েছি–এ মুখ দেখাতে বড় শরম হয়। নইলে আমি যাতাম বুলতাম যেয়ে দেবুকে।

ময়ূরাক্ষী পার হইয়া সে একবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। পঞ্চগ্রামের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইল। ওপারের ঘাটে একটি জনতা দাঁড়াইয়া আছে। সে চলিয়া যাইতেছে-দেখিতেছে। তাহাদের পিছনে বাঁধের উপরে কয়েকজন, দূরে শিবকালীপুরের মুখে দাঁড়াইয়া আছে মেয়েরা।

দেবুর মনে পড়িল এককালে এ রেওয়াজ ছিল, তখন কেহ কোথাও গেলে গ্রাম ভাঙিয়া লোক বিদায় দিতে আসিত। পঞ্চগ্রামে যখন ছিল ঘরে ঘরে ধান, জোয়ান পুরুষ, আনন্দ-হাসিকলরব। যখন বৃদ্ধেরা তীর্থে যাইত, গ্রামের লোকেরা তখন এমনই ভাবে বিদায় দিতে আসিত। ক্ৰমে ক্ৰমে সে রেওয়াজ উঠিয়া গিয়াছে। আপনিই উঠিয়া গিয়াছে। আজ উদয়াস্ত পরিশ্রম করিয়াও মানুষের অন্ন জোটে না; শক্তি নাই—কঙ্কালসার মানুষ শোকে ম্ৰিয়মাণ, রোগে শীর্ণ; তবু তাহারা আসিয়াছে, এতটা পথ আসিয়া অনেকে হাঁপাইতেছে, তবু আসিয়াছে—ঘোলাটে চোখ হতাশা-ভরা দৃষ্টি মেলিয়া এই বিদায়ী বন্ধুটির দিকে চাহিয়া আছে।

দেবু তাহাদের দিকে পিছন ফিরিল। নাঃ, আর নয়। সকলকে হাত তুলিয়া দূর হইতে নমস্কার জানাইয়া শেষ বিদায় লইল। সে আর ফিরিবে না। সে জানে ফিরিলেও আর সে পঞ্চগ্রাম দেখিতে পাইবে না। এখানকার মানুষের পরিত্রাণ নাই। জীবনের গাছের শিকড়ে পোকা। ধরিয়াছে। পঞ্চগ্রামের মাটি থাকিবে-মানুষগুলি থাকিবে না। পাতা-ঝরে শুকনা গাছের মত বসতিহীন পঞ্চগ্রামের রূপ তাহার চোখের সামনে যেন ভাসিয়া উঠিল।

না–সে আর ফিরিবে না।

আসে নাই কেবল স্বর্ণ ও স্বর্ণের মা। স্বর্ণের জন্য স্বর্ণের মা আসিতে পারে নাই। দুর্গা বলিল, স্বর্ণ দিতেছে; সেদিন সেরাত্রে বাপের উপর জেলের হুকুমের কথা শুনিয়া সেই যে বিছানায় পড়িয়া মুখ খুঁজিয়া, ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে শুরু করিয়াছে, তাহার আর বিরাম নাই।

দেবু কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। যাইবার সময় স্বর্ণ ও স্বর্ণের মাকে না দেখিয়া সে একটু দুঃখিত হইল। দেবুর মনে হইলসে ভালই করিয়াছে। আর সে ফিরিবে না।…

 

মাস ছয়েক পর।

দেশে–সমগ্র ভারতবর্ষে আবার একটা দেশপ্রেমের জোয়ার আসিয়া পড়িয়াছে। যাদুমন্ত্রে যেন প্রতিটি প্রাণের প্রদীপে আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা। সে উত্তেজনায় শহর-গ্রাম চঞ্চল-পল্লীর প্রতিটি পর্ণকুটিরেও সে উচ্ছাসের স্পর্শ লাগিয়াছে। উনিশশো ত্রিশ সালের আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। পঞ্চগ্রামেও উত্তেজনা জাগিয়াছে।

জগন ডাক্তার আসিয়াছিল জংশন স্টেশনে। তাহার পরনে খদ্দরের জামাকাপড়, মাথায় টুপি। ডাক্তারও এই উত্তেজনায় মাতিয়া উঠিয়াছে। জেলা কংগ্রেস কমিটির সেক্রেটারি আসিয়াছিলেন—তাহাকে সে বিদায় দিতে আসিয়াছে। গাড়িতে তাঁহাকে তুলিয়া দিল, ট্রেনখানা চলিয়া গেল। জগণ ফিরিল। হঠাৎ তাহার পিঠে হাত দিয়া কে ডাকিল–ডাক্তার।

জগন পিছন ফিরিয়া দেখিয়া আনন্দে উৎসাহে যেন জ্বলিয়া উঠিল; দুই হাত প্রসারিত করিয়া দেবুকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল–দেবু-ভাই, তুমি?

–হ্যাঁ ডাক্তার, আমি ফিরে এলাম।

–আঃ। আসবে আমি জানতাম দেবু-ভাই। আমি জানতাম।

হাসিয়া দেবু বলিল—তুমি জানতে?

—রোজই তোমায় মনে করি, হাজার বার তোমার নাম করি। সে কি মিথ্যে হয় দেবভাই! অন্তর দিয়ে ডাকলে পরলোক থেকে মানুষের আত্মা এসে দেখা দেয়, কথা কয়; তুমি তো পৃথিবীতে, এই দেশেই ছিলে।… ডাক্তার হাসিল।

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলনা ডাক্তার, মানুষের আত্মা আর আসে না। আজ তিন মাস অহরহ ডেকেও তো কিছু দেখতে পেলাম না!

কথাটায় ডাক্তার খানিকটা স্তিমিত হইয়া গেল। নীরবে পথ চলিয়া তাহারা নদীর ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেবু বলিল—বস ভাই ডাক্তার। খানিকটা বস।

—বসবার সময় নাই ভাই। চলি, আজ আবার মিটিং আছে।

–মিটিং?

—কংগ্রেসের মিটিং। আমাদের এখানে মুভমেন্ট আমরা আরম্ভ করে দিয়েছি কিনা। আজ মাদক বর্জনের মিটিং।

দেবু উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে চাহিয়া রহিল।

ডাক্তার বলিল—তুমি চলে গেলে! হঠাৎ একদিন তিনকড়ির ছেলে গৌর এসে হাজির হল একটা মস্ত বড় পতাকা নিয়ে কংগ্রেস ফ্ল্যাগ। বললে—২৬শে জানুয়ারি এটা তুলতে হবে।

—গৌর ফিরে এসেছে?

–হ্যাঁ। সে-ই তো এখন আমাদের কংগ্রেস কমিটির সেক্রেটারি। সে এখান থেকে চলে গিয়ে কংগ্রেস-ভলেন্টিয়ার হয়েছিল। ফিরে এসেছে গায়ের কাজ করবে বলে। তুমি নাই দেখে বেচারা বড় দমে গেল। বললে—দেবুদা নাই! কে করবে এসব? আমি আর থাকতে পারলাম না দেবু-ভাই,নেমে পড়লাম। উচ্ছ্বসিত উৎসাহে ডাক্তার অনর্গল বলিয়া গেল সে কাহিনী। বলিল ঘরে ঘরে চরকা চলছে, প্রায় সমস্ত বাউরি-মুচিই মদ ছেড়েছে, গায়ে পঞ্চায়েত করেছি, চারিদিকে মিটিং হচ্ছে। চল, নিজের চোখেই দেখবে সব। এইবার তুমি এসেছ, এইবার বান ডাকিয়ে দোব। তোমাকে কিন্তু ছাড়ব না। তুমি যে মনে করছ দুদিন পরেই চলে যাবে, তা হবে না।

দেবু বলিল—আমি যাব না ডাক্তার। সেই জন্যই আমি ফিরে এলাম। তোমাকে তো বললাম, অনেক ঘুরলাম কমাস। ছাব্বিশে জানুয়ারি আমি এলাহাবাদ ছিলাম। সেখানে সেদিন জহরলালজী পতাকা তুললেন, দেখলাম। সেদিন একবার গায়ের জন্য মনটা টনটন করে উঠেছিল ডাক্তার, সেদিন আমি কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল—সব জায়গায় পতাকা উঠল—বুঝি আমাদের পঞ্চগ্রামেই উঠল না। সেখানে মানুষ শুধু দুঃখ বুকে নিয়ে ঘরের ভেতর মাথা হেঁট করেই বসে রইল এমন দিনে। ফিরে আসতেও ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু জোর করে মনকে বললামনা, যে পথে বেরিয়েছিস্ সেই পথে চল। তারপর কিছুদিন ওখানে ত্রিবেণী সঙ্গমে কুঁড়ে বেঁধে ছিলাম। দিনরাত ডাকতাম বিলুকে-খোকনকে। সেখানে ভাল লাগল না। এলাম কাশী। হরিশ্চন্দ্রের ঘাটে গিয়ে বসে থাকতাম। এই শ্মশানেই হরিশ্চন্দ্রের রোহিতাস্ব বেঁচেছিল। কিন্তু–

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দেবু বলিল—তোমার কথা হয়ত মিথ্যে নয়। প্রাণ দিয়ে ডাকলে পরলোকের মানুষ আসে, দেখা দেয়। আমি হয়ত প্রাণ দিয়ে ডাকতে পারি নি। ন্যায়রত্ন মশাই কাশীতে ছিলেন তো, তিনি আমাকে বলেছিলেন পণ্ডিত, তুমি ফিরে যাও। এ পথ তোমার নয়। এতে তুমি শান্তি পাবে না। তা ছাড়া পণ্ডিত, ধ্যান করে ভগবানকে মেলে। কিন্তু মানুষ মরে গেলে সে আর ফেরে না, তাকে আর পাওয়া যায় না। বাইরে দেখতে পাওয়ার কথা পাগলের কথা, মনের মধ্যেও তাকে পাওয়া যায় না।… যত দিন যায়, তত সে হারিয়ে যায়। নইলে আর মরণের ভয়ে অমৃত খোঁজে কেন মানুষ! আমার শশীকে আমি ভুলে গিয়েছি পণ্ডিত। তোমাকে সত্য বলছি আমি, তার মুখ আমার কাছে ঝাপসা হয়ে এসেছে। তা নইলে বিশ্বনাথের ছেলে অজয়কে নিয়ে আমি আবার সংসার বাঁধি?…

তা ছাড়া… দেবু বলিল—ঠাকুর মশায় একটা কথা বললেন, পণ্ডিত, যে মরে তাকে আর পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যায় না, মানুষের মনেও সে থাকে না; থাকে–সে যা দিয়ে যায় তারই। মধ্যে। শশী আমাকে দিয়ে গিয়েছে সহ্যগুণ। আমার মধ্যে সে তাতেই বেঁচে আছে। তোমার স্ত্রীকে একদিন দেখেছিলাম—শান্ত-হাস্যময়ী মেয়ে। তোমাকেও আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি। তুমি ছিলে অত্যন্ত উগ্র, অসহিষ্ণু। আজ তুমি এমন সহিষ্ণু হয়েছ—তার কারণ তোমার স্ত্রী। সে তো হারায় নি। সে তো তোমার মধ্যেই মিশে রয়েছে। বাইরে যা খুঁজছ পণ্ডিত, সে তাদের নয়–সেটা তোমার ঘর-সংসারের আকাঙ্ক্ষা।… দেবু চুপ করিল। জগনও কোনো উত্তর দিতে পারিল না।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল-আজও ঠিক বুঝতে পারলাম না ডাক্তার, আমার মন ঠিক কি চায়! বিলু-খোকনকে ভাবতে বসতাম, তারই মধ্যে মনে হত গাঁয়ের কথা, তোমাদের কথা। তোমার কথা, দুর্গার কথা, চৌধুরীর কথা। গৌরের কথা—যাক সে দুষ্ট তা হলে ফিরেছে!

ডাক্তার বলিল—অদ্ভুত উৎসাহ গৌরের। আশ্চর্য ছেলে! ওর বোন স্বর্ণও খুব কাজ করছে। চরকার ইস্কুল করছে। চমৎকার সুতো কাটে স্বর্ণ!

–স্বর্ণ! স্বর্ণ পড়ছে তো? চাকরি করছে তো?

–হ্যাঁ। তবে চাকরি আর থাকবে কিনা সন্দেহ বটে।

দেবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল যায় যাবে। তাই তো ভাবতাম ডাক্তার। যখন দেখতাম চারিদিকে মিটিং, শোভাযাত্রা, দেখতাম মাতাল মদ ছাড়লে, নেশাখোর নেশা ছাড়লে, ব্যবসাদার লোভ ছাড়লে, রাজা, ধনী, জমিদার, প্ৰজা, চাষী, মজুর একসঙ্গে গালাগালি করে পথ চলছে তখন আমার চোখে জল আসত। সত্যি বলছি ডাক্তার, জল আসত। মনে হত আমাদের পঞ্চগ্রামে হয়ত কোনো পরিবর্তনই হল না।–কিছু হয় নাই। শেষটা আর থাকতে পারলাম না, ছুটে এলাম।

ডাক্তার বলিল—চল, দেখবে অনেক কাজ হয়েছে।… হাসিয়া পিঠ চাপড়াইয়া বলিল—যা গৌর চেলা ছেড়ে গিয়েছ তুমি!

 

গৌর জ্বলিয়া উঠিল প্রদীপের শিখার মত। দেবু-দা!

স্বর্ণ প্রণাম করিয়া অতি নিকটে দাঁড়াইয়া বলিল—ফিরে এলেন!

দুর্গা বলিল—তাহারও লজ্জা নাই, সঙ্কোচ নাই,গাঢ়স্বরে সর্বসমক্ষে বলিল, পরানটা জুড়ল জামাই-পণ্ডিত।

গৌর বলিল—এইখানেই মিটিং হবে আজ। এইখানেই ডাক, সবাইকে খবর দাও। বল দেবুদা এসেছে। সে বাহির হইয়া পড়িল।

দেবুর বাড়িতেই কংগ্রেস কমিটির অফিস। আপন দাওয়ায় বসিয়া দেবু দেখিল—গৌর আয়োজনের কিছু বাকি রাখে নাই। স্বর্ণ তাহাকে ডাকিল—আসুন দেবুদা, হাত-মুখ ধুয়ে ফেলুন।

বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া দেবু বিস্মিত হইল। ঘরখানার শ্ৰী যেন ফিরিয়া গিয়াছে, চারিদিক নিপুণ যত্বে মার্জনায় ঝকঝক করিতেছে। দেবু বলিলবাঃ! এখন এ বাড়ির যত্ন কে করে?

স্বর্ণ বলিল—আমি। আমরা তো এখানে থাকি।

দেবু বলিলখুড়ী-মা কই?

স্বর্ণ বলিল-মা নেই দেবু-দা।

দেবু চমকিয়া উঠিল—খুড়ী-মা নেই!

–না। মাস দুয়েক আগে মারা গিয়েছেন।

দেবু একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বড় দুঃখিনী ছিলেন খুড়ী-মা। হাত মুখ ধুইয়া সে নিজের সুটকেসটি খুলিয়া, একখানা খদ্দরের শাড়ি বাহির করিয়া স্বর্ণকে দিয়া বুলিল—তোমার জন্য এনেছি। স্বর্ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে ম্লান হইয়া গেল, স্নান মুখে বলিল–এ যে লাল চওড়াপেড়ে শাড়ি দেবু-দা?

দেবু চমকিয়া উঠিল, স্বর্ণ বিধবা—এ কথা তাহার মনে হয় নাই! কিছুক্ষণ চুপ করিয়া সে বলিলতা হোক। তবু তুমি পরবে। হ্যাঁ, আমি বলছি।

 

গৌর আসিয়া ডাকিল—আসুন দেবু-দা। সব এসে গিয়েছে।

দেবু বাহিরে আসিল। সমস্ত গ্রামের লোক আসিয়াছে। দেবুকে (দখিয়া তাহাদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া আসিল। শীর্ণ, অনাহারক্লিষ্ট মুখের মধ্যে চোখগুলি জ্বলজ্বল করিতেছে। সে যেদিন যায় সেদিন এই চোখগুলি ছিল যেন নির্বাণমুখী প্রদীপের শিখার মত। আজ আবার সেগুলি প্রাণের ছবি সংযোগে জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে দীপ্ত শিখায়। উচ্ছাসে উত্তেজনায়, জাগরণের চাঞ্চল্যে, শীর্ণদেহ মানুষগুলি দৃঢ়তার কাঠিন্যে মেরুদণ্ড সোজা করিয়া বসিয়া আছে। সে অবাক হইয়া গেল। সে পঞ্চগ্রামের মানুষের ধ্বংস নিশ্চিত ভাবিয়া চলিয়া গিয়াছিল—তাহারা আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়া বসিয়াছে; কণ্ঠে স্বর জাগিয়াছে, চোখে দীপ্তি ফুটিয়াছে, বুকে একটা নূতন আশা জাগিয়াছে।

দাওয়া হইতে দেবু জনতার মধ্যে নামিয়া আসিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *