২৬. রোমান্টিসিজম

২৬. রোমান্টিসিজম  

…রহস্যের পথ অন্তর্মুখী..

ভারি রিং বাইন্ডারটাকে নিজের কোলের ওপর গড়িয়ে পড়তে দিল সোফি। তারপর সেটাকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে যেতে দিল।

যখন সে বিছানায় উঠেছিল তখনকার চেয়ে ঘরে অনেক বেশি আলো এখন। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। প্রায় তিনটা বাজে।

গুটিসুটি মেরে চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ে চোখ বন্ধ করল সে। ঘুমিয়ে পড়বার সময় সে ভাবল তার বাবা রেড রাইডিংহুড আর পুহ-র কথা লিখলেন কেন…।

 পরদিন সকাল এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোল সে। শরীরের টানটান ভাবটা তাকে বলে দিল সারা রাত সে স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু কী স্বপ্ন তা সে মনে করতে পারল না। মনে হলো ওটা যেন একেবারে আলাদা একটা বাস্তবতা। নিচে নেমে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি করল সে। তার মা নীল জাম্পস্যুট পরে নিয়েছেন বোটহাউসে গিয়ে মোটরবোটটা ঠিকঠাক করার জন্যে। ওটা জলে না থাকলেও, বাবা যখন লেবানন থেকে ফিরে আসবে তখন বোটটাকে একেবারে ফিটফাট থাকতে হবে।

তুই নিচে এসে একটু হাত লাগাবি নাকি আমার সঙ্গে

 আগে একটু পড়তে হবে আমাকে। চা আর মাঝ-সকালের নাস্তা নিয়ে যাবো আমি?

মাঝ-সকাল কী বলছিস?

খাওয়া সেরে নিজের ঘরে গেল হিল্ডা, বিছানাটা গোছগাছ করল। তারপর রিং বাইন্ডারটা দুই হাঁটুর ওপর রেখে বসল আরাম করে।

.

বিরাট যে-বাগানটাকে একসময় সোফি তার নিজের নন্দনকানন বলে ভেবেছিল তার মধ্যে এসে দাঁড়াল সে বেড়ার ভেতর দিয়ে গলে…

আগের রাতের ঝড়ের পর সব জায়গায় ডালপালা আর পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মনে হলো সেই ঝড় আর ভেঙেপড়া ডালপালার সাথে ছোট্ট রেড রাইভিংহুড আর উইনি-দ্য-পুত্র সঙ্গে তার সাক্ষাতের একটা সম্পর্ক রয়েছে।

বাড়ির ভেতর ঢুকল সে। মাত্র কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছেন তার মা, ফ্রিজে কিছু সোডার বোতল রাখছিলেন তিনি। টেবিলের ওপর দারুণ মজার দেখতে একটা চকলেট কেক রাখা।

কোনো মেহমান আসছে বুঝি? জিগ্যেস করল সোফি; সে প্রায় ভুলেই গেছে আজ তার জন্মদিন।

আসলে পার্টিটা হচ্ছে সামনের শনিবার। কিন্তু আমি ভাবলাম আজকেও ছোট্ট একটা উৎসব করলে মন্দ হয় না।

কীভাবে?

জোয়ানা আর ওর বাবা-মাকে দাওয়াত দিয়েছি আমি। বেশ তো।

সাড়ে সাতটার খানিক আগে পৌঁছে গেলেন অতিথিরা। পরিবেশটা খানিকটা ফর্মাল-ই হলো। সামাজিক অনুষ্ঠানে জোয়ানার বাবা-মাকে খুব কমই দেখেছেন সোফির মা।

খানিক পরেই সোফি আর জোয়ানা সোফির ঘরে উঠে এলো গার্ডেন পার্টির দাওয়াত-পত্রটা লেখার জন্যে। অ্যালবার্টো নক্সকেও যেহেতু ডাকা হচ্ছে সোফির তাই মনে হয়েছিল লোকজনকে একটা দার্শনিক গার্ডেন পার্টি-তে দাওয়াত করলে মন্দ হয় না, জোয়ানা তাতে আপত্তি করেনি। শত হলেও পার্টিটা সোফির আর তাছাড়া ইদানিং থিম পার্টির বেশ চল-ও হয়েছে।

 শেষ পর্যন্ত দাওয়াত-পত্রটা লেখা শেষ হলো ওদের। দুঘন্টা সময় লাগল ওটা শেষ করতে আর এই দুঘণ্টা ওরা হেসে কুটিপাটি হয়েছে।

প্রিয়… আসছে শনিবার ২৩ শে জুন (মিডসামার ঈ) সন্ধ্যা ৭টায় ৩ ক্লোভার ক্লোজ-এ অনুষ্ঠিতব্য একটি দার্শনিক গার্ডেন পার্টিতে আপনাকে নেমন্তন্ন। সেই সন্ধ্যায় আমরা জীবনের রহস্য উন্মোচন করব বলে আশা রাখি। অনুগ্রহ করে সঙ্গে গরম সোয়েটার আর দর্শনগত ধাঁধা সমাধানের উপযোগী দারুণ সব আইডিয়া নিয়ে আসবেন। আমরা বসব করতে পারছি না, কিন্তু নিজের কল্পনার শিখা জ্বলতে দিতে কারো কোনো বাধা থাকবে না। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অন্তত একজন প্রকৃত দার্শনিক থাকবেন। সে কারণেই পাটিটা হবে একান্তই আমাদের নিজস্ব আয়োজন। সংবাদপত্রের লোকজনের প্রবেশাধিকার থাকবে না সেখানে।

শুভেচ্ছান্তে,
জোয়ানা ইঙ্গেব্রিগস্টেন (আয়োজক কমিটি)
সোফি অ্যামুন্ডসেন (নিমন্ত্রণকত্রী)

মেয়ে দুটো নিচে নেমে এলো তাদের বাবা-মার কাছে, তারা তখন আগের চেয়ে খানিকটা বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলছেন। ক্যালিগ্রাফি করার একটা কলম দিয়ে লেখা খসড়া দাওয়াত-পটা সোফি তার মায়ের হাতে দিল।

এটার আঠারোটা কপি করতে পারবে, প্লিজ? এর আগেও বেশ কয়েকবার মা কে তার অফিস থেকে ফটোকপি করে আনতে দিয়েছে সে।

তার মা দাওয়াত-পত্রটা পড়ে সেটা জোয়ানার বাবার হাতে দিলেন। আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলতে চাইছি? ওর মাথায় একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে।

কিন্তু এটাতো বড্ড এক্সাইটিং ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, কাগজের টুকরোটা স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মন্তব্য করলেন জোয়ানার বাবা। আমি নিজে তো সানন্দে আসবো।

বার্বি-ও দাওয়াত-পত্রটা পড়লেন। তারপর বললেন, তা তো বটেই। তা, আমরা কি আসতে পারি, সোফি?

তাহলে বিশ কপি-ই কোরো। ওঁদের কথা সত্যি ধরে নিয়ে সোফি বলল।

তোমাদের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ। জোয়ানা বলল।

সে-রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল সোফি। কী করে একবার অন্ধকারে অ্যালবার্টোর দেহকাঠামো দেখেছিল সে সে-কথা মনে পড়ল সোফির। সেটা এক মাসেরও আগের কথা। এখনও রাত অনেক গভীর, কিন্তু আজ এক ঝকমকে গ্রীষ্মের রাত।

.

মঙ্গলবার সকালের আগ পর্যন্ত অ্যালবার্টোর তরফ থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পেল না সোফি। সেদিন তার মা কাজে চলে যাওয়ার ঠিক পর পরই ফোন করলেন তিনি।

সোফি অ্যামুন্ডসেন।

আর অ্যালবার্ট নক্স।

সে-রকমই ভেবেছিলাম।

দুঃখিত, আরো আগে ফোন করতে পারিনি বলে, কিন্তু আমি আসলে আমাদের সেই প্ল্যানটা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। মেজর যখন পুরোপুরি তোমার ওপর মনোযোগ দেয় কেবল তখনই আমি একা হতে পারি, নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারি।

সেটাতো বড় অদ্ভুত ব্যাপার।

তো, তখন আমি সুযোগটাকে কাজে লাগাই, বুঝতে পারলে? দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও সীমাবদ্ধতা থাকে যখন তা মাত্র একজন লোক নিয়ন্ত্রণ করে….তোমার কার্ড পেয়েছি।

মানে সেই নেমন্তন্নের?

রিস্কটা নেয়ার সাহস হয় তোমার?

কেন নয়?

ও-রকম একটা পার্টিতে যা কিছু তাই ঘটতে পারে।

আপনি আসছেন তো?

আলবাৎ। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার আছে। তোমার কি মনে ছিল যে ঐ দিনই হিল্ডার বাবা লেবানন থেকে আসছে?

না, সত্যি বলতে কী, খেয়াল ছিল না।

ব্যাপারটা হয়ত পুরোটাই কাকতালীয় নয় যে সে যেদিন বিয়ার্কলে-তে ফিরছে সেদিনই একটা দার্শনিক গার্ডেন পার্টি আয়োজনের ব্যবস্থা করতে দিচ্ছে তোমাকে।

বললাম তো, কথাটা মাথায় আসেনি আমার।

 আমি নিশ্চিত, তার মাথায় ঠিকই এসেছিল। কিন্তু সে যাকগে, এ-নিয়ে পরে কথা বলব আমরা। আজ সকালে মেজরের কেবিনে আসতে পারবে?

ফ্লাওয়ার বেডগুলোর আগাছা পরিষ্কার করার কথা আমার।

তাহলে দুটোর সময়। পারবে তখন?

ঠিক আছে, থাকবো আমি ওখানে।

.

সোফি যখন পৌঁছল, অ্যালবার্টো নক্স তখন আবারো সিঁড়ির ওপর বসে।

 বোসো, তিনি বললেন, সরাসরি কাজের কথায় এসে।

এর আগে আমরা রেনেসাঁ, বারোক যুগ আর আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেছি। আজ আমরা কথা বলবো রোমান্টিসিজম নিয়ে। এটাকে বলা যেতে পারে ইউরোপের শেষ মহান সাংস্কৃতিক যুগ। দীর্ঘ কাহিনীটির শেষ দিকে এগোচ্ছি আমরা, সোফি।

রোমান্টিসিজম কি অতোদিন ধরে চলেছিল?

এর শুরুটা হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর তা চলেছিল উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু ১৮৫০-এর পর আর এমন কোনো সম্পূর্ণ যুগের কথা বলা গেল না যে-যুগ কাব্য, দর্শন, শিল্পকলা, বিজ্ঞান আর সঙ্গীত দিয়ে গড়া।

রোমান্টিসিজম কি তাহলে সে-রকম একটা যুগ?

বলা হয়ে থাকে যে রোমান্টিসিজম-ই ছিল জীবনের দিকে ইউরোপের শেষ সম্মিলিত অথবা সাধারণ অগ্রযাত্রা। রোমান্টিসিজমের শুরু জার্মানীতে, প্রজ্ঞার ওপর আলোকপ্রাপ্তির অবিচল আস্থার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। কান্ট আর তার শীতল বুদ্ধিবাদের পরে জার্মান তারুণ্য যেন স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

তা সেটার জায়গায় তারা কী নিয়ে এলো?

নতুন জনপ্রিয় শব্দগুলো ছিল অনুভূতি, কল্পনা, অভিজ্ঞতা আর আকুতি। আলোকপ্রাপ্তিযুগের কয়েকজন দার্শনিকও অনুভূতির গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে রুশোর নাম কম উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু তখন সেটা ছিল প্রজ্ঞার প্রতি পক্ষপাতিত্বের একটা সমালোচনা স্বরূপ। একসময় যা ছিল একটা চোরাস্রোত এখন তা-ই হয়ে দাঁড়াল জার্মান সংস্কৃতির প্রধান ধারা।

কান্টের জনপ্রিয়তা তাহলে বেশিদিন টেকেনি?

টিকেছিল আবার টেকেনি। অনেক রোমান্টিক-ই নিজেদেরকে কান্টের উত্তরসূরী বলে মনে করতেন, যেহেতু কান্ট-ই এ-কথা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে das Ding an sich সম্পর্কে আমরা কী জানতে পারবে তার একটা সীমা আছে। অন্য দিকে আবার, জ্ঞান বা বোধ (cognition)-এর ক্ষেত্রে অহম-এর গুরুত্বের কথাও জোর দিয়ে বলেছেন তিনি। কাজেই ব্যক্তি এখন জীবনকে তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে নেয়ার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেল। এরই সুযোগ নিলেন রোমান্টিকরা প্রায় অবারিত এক অহম পূজা-র মধ্য দিয়ে, যা জন্ম দিল শৈল্পিক প্রতিভাকে মহিমান্বিত করার বিষয়টির।

এ-ধরনের প্রতিভা তখন খুব বেশি ছিল বুঝি?

এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বেঠোতেন (Beethoven)। তাঁর সঙ্গীত তাঁরই নিজস্ব অনুভুতি আর আকুতি প্রকাশ করে। এক অর্থে বেঠোভেন ছিলেন একজন স্বাধীন শিল্পী– বারোক মাস্টার বা আর হ্যাঁন্ডেল কিন্তু তা ছিলেন না। তারা তাদের সঙ্গীত রচনা করতেন ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ্যের জন্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কঠোর সাঙ্গিতিক ফর্ম-এর মধ্যে থেকে।

আমি শুধু মুনলাইট সোনাটা আর ফিফ সিম্ফনীর কথা জানি।

কিন্তু তুমি এটা তো জানো মুনলাইট সোনাটা কতটা রোমান্টিক আর ফিফষ্য সিম্ফনীতে বেঠোভেন কতটা নাটকীয় ভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

আপনি বলেছিলেন রোমান্টিক মানবতাবাদীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদীও ছিলেন।

 ঠিক। রেনেসাঁ আর রোমান্টিসিজমের মধ্যে মিল ছিল প্রচুর। তার মধ্যে প্রধান একটি হলো মানুষের বোধ-এ শিল্পের গুরুত্বের বিষয়টি। এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন কান্ট। তিনি তাঁর নন্দনতত্ত্বে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন সৌন্দর্য, এই যেমন ধরো শিল্পের কোনো কাজের সৌন্দর্য, যখন আমাদের অভিভূত করে ফেলে তখন কী ঘটে। শুধু নান্দনিক আনন্দের জন্যে যখন একটি শৈল্পিক কাজের ভেতর নিজেদেরকে আমরা সমর্পণ করি তখন das Ding an sich-এর অভিজ্ঞতার কাছাকাছি চলে যাই আমরা।

তাহলে দার্শনিক যা প্রকাশ করতে পারেন না শিল্পী তা দিতে পারেন দেখা যাচ্ছে?

রোমান্টিকদের দৃষ্টিভঙ্গি সে-রকমই ছিল। কান্ট-এর বক্তব্য অনুযায়ী, শিল্পী তাঁর বোধশক্তির ওপর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। জার্মান কবি শিলার (Schiller)। কান্ট-এর চিন্তাকে আরো সম্প্রসারিত করেন। তিনি লিখেছিলেন যে শিল্পীর কাজকর্ম খেলা করার মতো আর মানুষ যখন খেলে তখন সে স্বাধীন ছাড়া কিছু নয়, কারণ তখন সে তার নিজের নিয়ম-কানুন তৈরি করে। রোমান্টিকরা বিশ্বাস করতেন যা ব্যক্ত করা যায় না তার কাছে কেবল শিল্পই আমাদের নিয়ে যেতে পারে। কেউ কেউ তো এততদূর পর্যন্ত গেলেন যে শিল্পীকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করলেন।

কারণ ঈশ্বর যেভাবে জগৎ তৈরি করেছেন শিল্পী সেভাবে তার নিজের বাস্তবতা তৈরি করেন।

বলা হতো যে শিল্পীর রয়েছে এক মহাবিশ্ব-সৃষ্টিকারী কল্পনা। শৈল্পিক পরমানন্দে ভাবাবেগে অভিভূত দশায় তিনি স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা মুছে যাওয়ার অনুভূতি লাভ করতে পারেন।

তরুণ প্রতিভাবানদের অন্যতম নোভালিস (Novalis) বলেছেন, জগৎ হয়ে যায় স্বপ্ন আর স্বপ্ন জগৎ। মধ্য যুগের পটভূমিতে Heinrich won Ofterdingen নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, সেটা শেষ করার আগেই ১৮০১ সালে মৃত্যু হয় তাঁর; কিন্তু তারপরেও উপন্যাস হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা। উপন্যাসে হেনরিখ নামের এক যুবকের কথা বলা হয়েছে যে একটা নীল ফুল খুঁজে বেড়াচ্ছে; স্বপ্নে একবার সেই ফুলটাকে দেখেছিল সে আর তারপর থেকেই সেটার জন্যে আকুল আকাঙ্খা তার। ইংরেজ রোমান্টিক কবি কোলারিজ-ও (Coleridge) একই ধারণা ব্যক্ত করেছেন খানিকটা এ-ধরনের কথা বলে:

ধরো যদি ঘুমিয়ে পড়লে? আর ধরো যদি সেই ঘুমের ভেতর তুমি একটা স্বপ্ন দেখলে? আর ধরো যদি সেই স্বপ্নে তুমি স্বর্গে গিয়ে অদ্ভুত আর সুন্দর একটা ফুল তুললে? আর ধরো যদি জেগে উঠে সেই ফুলটাকে তোমার হাতে দেখতে পেলে? তো, কী হবে তখন?

কী সুন্দর।

এমন কিছু যা দূরের, যা পাওয়া যায় না তার জন্যে এই আকুল আকাঙ্খ-ই রোমান্টিকদের বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে যাওয়া সময় যেমন মধ্য যুগের জন্যে আকুতি অনুভব করতেন তাঁরা, যে-মধ্যযুগকে আলোকপ্রাপ্তির নেতিবাচক মূল্যায়নের পর তখন অতি উৎসাহভরে নতুন করে দেখা হচ্ছিল। তাছাড়া তারা প্রাচ্য আর তার অতীন্দ্রিয়বাদ-এর মতো দূরের সংস্কৃতির প্রতিও আকুতি অনুভব করতেন। বা তারা আকর্ষণ অনুভব করতেন রাত্রি, প্রদোষকাল, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আর পরাবাস্তবতার প্রতি। আমরা সাধারণত যাকে জীবনের অন্ধকার, ঝাপসা, অতিপ্রাকৃত আর রহস্যময় দিক বলি সেদিকটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা।

এ-সব শুনে তো পিরিয়ডটাকে আমার খুব এক্সাইটিং বলে মনে হচ্ছে। তা, এই রোমান্টিকদের মধ্যে কে কে ছিলেন?

রোমান্টিসিজমটা ছিল প্রধানত একটা শহুরে ব্যাপার। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে আসলে ইউরোপের অনেক জায়গাতেই মেট্টোপলিটন সংস্কৃতির একটা জোয়ার ছিল। জার্মানীর নাম এক্ষেত্রে কম উল্লেখযোগ্য নয়। প্রতিনিধিত্বশীল রোমান্টিকেরা ছিলেন বয়েসে তরুণ, বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যদিও তাঁরা তাঁদের পড়াশোনাকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। জীবনের প্রতি তাদের একটা ইচ্ছাকৃত মধ্যবিত্ত-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এই যেমন পুলিশ বা তাঁদের বাড়িওয়ালীদেরকে তাঁরা শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ বা উদাসীন বা স্রেফ শত্রু বলে উল্লেখ করতেন।

কোনো রোমান্টিককে ঘরভাড়া দেয়ার সাহস আমার হতো না।

১৮০০ সালের দিকে তরুণ ছিলেন প্রথম প্রজন্মের রোমান্টিকেরা এবং রোমান্টিক আন্দোলনকে আমরা আসলে ইউরোপের প্রথম ছাত্র আন্দোলন বলতে পারি। একশো পঞ্চাশ বছর পরের হিপ্পিদের সঙ্গে রোমান্টিকদের খুব একটা অমিল ছিল না কিন্তু।

তার মানে সেই ফ্লাওয়ার পাওয়ার, লম্বা লম্বা চুল নিয়ে যারা গিটার বাজাত, এখানে-সেখানে শুয়ে থাকত, তারা?

হ্যাঁ। বলা হতো আলস্য-ই হচ্ছে প্রতিভাধরের আদর্শ, শ্রমবিমুখতা রোমান্টিকের গুণ। জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনই একজন রোমান্টিকের কর্তব্য-বা নিজেকে সেটা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখা। দৈনন্দিন ব্যাপার স্যাপারগুলোর ভার তাদের ওপরই ছেড়ে দেয়া ভালো যারা শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ, উদাসীন।

বায়রন তো একজন রোমান্টিক কবি ছিলেন,তাই না?

হ্যাঁ, বায়রন আর শেলি দুজনেই তথাকথিত স্যাটানিক স্কুলের রোমান্টিক কবি ছিলেন। তাছাড়া, রোমান্টিক যুগকে বায়রন উপহার দিয়েছিলেন সেটার আইডল বায়রনিক হিরো-অস্বভাবী (alien), খেয়ালি, বিদ্রোহী এক সত্তা, শুধু শিল্পের ক্ষেত্রেই নয় বাস্তব জীবনেও। বায়রন নিজেও ছিলেন একগুয়ে আর প্রবল আবেগপূর্ণ, তাছাড়া দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন হওয়াতে ফ্যাশনদুরস্ত রমণী পরিবেষ্টিত। সাধারণ মানুষের মুখরোচক গল্পগুজব অনুযায়ী বায়রণের কবিতার রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারগুলো তার নিজেরই জীবনের কাহিনী। তবে এ-কথা ঠিক যে তিনি অসংখ্য অবৈধ প্রেম-এ জড়িত থাকলেও সত্যিকারের ভালোবাসা নোভালিসের সেই নীল ফুলের মতোই চিরদিন তাঁর অধরা থেকে গেছে। নোভালিস-এর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল চৌদ্দ বছর বয়েসী একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি তার পঞ্চদশ জন্মদিনের চার দিন পর মারা যায়, কিন্তু নোভালিস তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের বাকি কটা দিন সেই মেয়েটির প্রতিই বিশ্বস্ত থাকেন।

মেয়েটি তার পঞ্চদশ জন্মদিনের চারদিন পর মারা গিয়েছিল বলছেন?

হ্যা…

আজ আমার বয়স পনের বছর চারদিন।

আচ্ছা।

কী নাম ছিল মেয়েটার?

 সোফি।

 কী

হ্যাঁ, তাই।

আপনি ভয় পাইয়ে দিলেন আমাকে। এটা কি একটা কাকতালীয় ঘটনা?

সেটা আমি বলতে পারবো না, সোফি। তবে তার নাম ছিল সোফি।

বলে যান।

নোভালিস নিজে মারা যান মাত্র উনত্রিশ বছর বয়েসে। তরুণ বয়েসে মৃতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। রোমান্টিকদের অনেকেই তরুণ বয়েসে মারা যান, যক্ষাতেই প্রধানত। কেউ কেউ হত্যা করেন…

আহা।

যারা বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন তাঁদের রোমান্টিকত্ব ত্রিশ বছর বয়েসেই ঘুচে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আবার পুরোপুরি মধ্যবিত্ত আর প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গিয়েছিলেন।

তাহলে তারা সেই শত্রু বনে গিয়েছিলেন।

হয়ত। কিন্তু আমরা কথা বলছি রোমান্টিক ভালোবাসা নিয়ে। থীম হিসেবে প্রতিদানহীন ভালোবাসা প্রচলন করেন গ্যেটে (Goethe) সেই ১৭৭৪-এ, তাঁর উপন্যাস তরুণ ওয়ার্থার এর দুঃখ-তে। যে-রমণীকে সে ভালোবাসে তাকে না পেয়ে নিজের গায়ে গুলি চালাচ্ছে ওয়ার্থার এইখানে এসে শেষ হয় উপন্যাসটি।

এতো বাড়াবাড়ির দরকার ছিল কী?

এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর হত্যার হার বেড়ে যায় এবং ডেনমার্ক আর নরওয়েতে কিছু দিনের জন্যে নিষিদ্ধ থাকে বইটি। তার মানে রোমান্টিক হওয়া বিপজ্জনকও ছিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিল প্রবল সব অনুভূতি।

 আপনি যখন রোমান্টিক শব্দটা উচ্চারণ করেন আমার মনে পড়ে যায় গহীন অরণ্য আর বুনো রূঢ় প্রকৃতিসহ বড় বড় ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টি-এর কথা…সে-সবের অনেকগুলোতেই থাকে কুয়াশার ঘূর্ণি।

হ্যাঁ, রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির রহস্য সম্পর্কে এই আকুলতা। আর আগেই বলেছি, এটা এমন একটা জিনিস যা পল্লী অঞ্চলে উদয় হয় না। হয়ত তোমার মনে পড়বে রুশোর কথা, যিনি ফিরে চল প্রকৃতির কাছে-এই শ্লোগানটা চালু করেছিলেন। রোমান্টিকরা জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন শ্লোগানটাকে। আলোকপ্রাপ্তির যান্ত্রিকতাপূর্ণ মহাবিশ্বের বিরুদ্ধে রোমান্টিসিজম একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ। বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীন মহাবৈশ্বিক চেতনার একটি পুনরুজ্জীবনের পরোক্ষ প্রকাশ হলো রোমান্টিসিজম।

বুঝিয়ে বলুন, প্লীজ।

এর মানে হলো প্রকৃতি-কে সামগ্রিকভাবে দেখা; রোমান্টিকরা তাদের উৎস হিসেবে কেবল স্পিনোজার কাছেই ফিরে যাচ্ছিলেন না, ফিরছিলেন প্লটিনাস আর রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক জ্যাকব বোমে (Jacob Bhme) আর জিওর্দানো নোর কাছেও। এই তাবৎ চিন্তাবিদের মধ্যেই যে-জিনিসটি ছিল তা হচ্ছে প্রকৃতির ভেতরে তাঁরা একটি স্বর্গীয় অহম প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

তাহলে তাঁরা সর্বেশ্বরবাদী ছিলেন বলুন…

দেকার্ত আর হিউম দুজনেই অহম আর পরিব্যাপ্ত বাস্তবতার মাঝখানে একটি স্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিলেন। কান্টও জ্ঞানমূলক (cognitive) আমি আর অনন্যসাপেক্ষ প্রকৃতির মধ্যে এক সুস্পষ্ট বিভেদরেখা টেনে দিয়ে গেছেন। তো, এখন বলা হলো যে প্রকৃতি একটি বিশাল আমি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্ব স্বা বা বিশ্ব চিদাত্মা কথাগুলোও ব্যবহার করতেন রোমান্টিকরা।

আচ্ছা।

শীর্ষস্থানীয় রোমান্টিক দার্শনিক ছিলেন শেলিং (Schelling), জন্ম ১৭৭৫-এ, মৃত্যু ১৮৫৪-তে। মন আর বস্তুকে এক করতে চেয়েছিলেন তিনি। শেলিং বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির সমস্ত কিছু-মানব ভ্রা আর ভৌত বাস্তবতা, এই দুই-ই-এক পরম বা বিশ্ব চিদাত্মার প্রকাশ।

আচ্ছা, ঠিক স্পিনোজার মতো।

শেলিং-এর বক্তব্য অনুযায়ী, প্রকৃতি হচ্ছে দৃশ্যমান চিদাত্মা, চিদাত্মা অদৃশ্য প্রকৃতি, তার কারণ প্রকৃতির সর্বত্রই মানুষ এক গঠনশীল জা প্রত্যক্ষ করে। তিনি আরো বলেছিলেন বস্তু হচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা বুদ্ধিমত্তা।

বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলতে হবে আপনাকে।

প্রকৃতিতে এক বিশ্ব চিদাত্মা দেখতে পেয়েছিলেন শেলিং, কিন্তু সেই একই বিশ্ব চিদাত্মা-কে দেখেছিলেন তিনি মানুষের মনের ভেতরেও। প্রাকৃতিক আর আধ্যাকি আসলে একই জিনিসের ভিন্ন অভিব্যক্তি।

হ্যাঁ, তাই তো।

কাজেই প্রকৃতি এবং কারো নিজের মনের ভেতর, এই দুই জায়গাতেই খোঁজা যেতে পারে বিশ্ব চিদাত্মাকে। সেজন্যেই নোভালিস বলতে পেরেছিলেন রহস্যের পথ অন্তর্মুখী। তিনি যা বলছিলেন তা হচ্ছে গোটা মহাবিশ্বকেই মানুষ তার মনের মধ্যে ধারণ করে এবং সে তখনই জগতের রহস্যের সবচেয়ে কাছাকাছি উপনীত হয়। যখন সে নিজের ভেতর পা বাড়ায়।

এটা কিন্তু চমৎকার একটা চিন্তা।

অনেক রোমান্টিকের কাছেই দর্শন, প্রকৃতি অধ্যয়ন আর কাব্য একটি সংশ্লেষণ বা সমম্বয় তৈরি করেছিল। চিলেকোঠায় বসে অনুপ্রাণিত কাব্যের ফোয়ার ছোটানো আর গাছ-গাছড়ার জীবন বা পাথরের গঠন পর্যবেক্ষণ করা আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, কারণ প্রকৃতি কেবলই একটা প্রাণহীন মেকানিজম নয়, এটা এক সজীব বিশ্ব চিদাত্মা।

আরেকটা কথা বললেই কিন্তু আমি রোমান্টিক হয়ে যাব।

নরওয়েজিয় প্রকৃতিবিদ হেনরিক স্টেফেন্স (Henrik Steffens)- যাকে ওয়ার্গল্যান্ড (Wergland) নরওয়ের ঝরে যাওয়া লরেল পাতা বলে অভিহিত করেছেন কারণ তিনি জার্মানীতে সেটুল করেছিলেন তিনি ১৮০১ সালে কোপেনহেগেন-এ গিয়েছিলেন জার্মান রোমান্টিসিজম-এর ওপর বক্তৃতা করতে। রোমান্টিক আন্দোলনকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন এই বলে যে নির্জলা বস্তুর ভেতর দিয়ে যুদ্ধ করে পথ বের করে নেয়ার নিরন্তর চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে অন্য আরেক পথ বেছে নিয়ে আমরা অনন্তকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছি। নিজেদের ভেতর প্রবেশ করে আমরা সৃষ্টি করেছি একটি নতুন জগৎ…

এতো কিছু কী করে মনে থাকে আপনার?

তুচ্ছ ব্যাপার, বৎস।

ঠিক আছে, বলে যান।

শেলিং-ও মাটি ও পাথর থেকে মানুষের মন পর্যন্ত প্রকৃতির একটা বিকাশ লক্ষ্য করেছিলেন। জড় প্রকৃতি থেকে আরো জটিল জৈব রূপ পর্যন্ত অতি ধীর রূপান্তরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। সাধারণভাবে এটা রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য যে এখানে প্রকৃতিকে একটা জীবদেহ (organism) হিসেবে বা অন্যভাবে বললে একটা সামগ্রিক বস্তু (unity) হিসেবে ভাবা হতো যা অনবরত তার অন্ত র্নিহিত সম্ভাবনাগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে চলছে। প্রকৃতি হচ্ছে ফুলের মতো যে-ফুল তার পাপড়ি মেলে যাচ্ছে। কিংবা এক কবির মতো যিনি তার কবিতার চরণগুলো মেলে ধরছেন।

এই সব কথা-বার্তা অ্যারিস্টটলের কথা মনে করিয়ে দেয় না আপনাকে?

তা করায় অবশ্য। রোমান্টিক প্রকৃতিবাদী দর্শনে অ্যারিস্টটলিয় আর নিওপ্লেটোনিক এই দুয়েরই প্রচ্ছন্ন সুর পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর বিষয়ে যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের চেয়ে অনেক বেশি জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অ্যারিস্টটলের…

হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা…।

ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিন্তা-ভাবনা ক্রিয়াশীল দেখতে পাই আমরা। জোহান গটফ্রিড ভন হার্ডার (Johann Gottfried von Herder) নামে একজন ঐতিহাসিক দার্শনিক প্রবল গুরুত্ব লাভ করেছিলেন রোমান্টিকদের কাছে। তাঁর জন্ম ১৭৪৪-এ, মৃত্যু ১৮০৩-এ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে চলমানতা, বিবর্তন আর পরিকল্পনা (design) ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য। আমরা বলি, ইতিহাস সম্পর্কে একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর, কারণ বিষয়টিকে তিনি একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন। আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকদের ইতিহাস সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি : ছিল প্রায় ক্ষেত্রেই স্থবির। তাদের বিবেচনায় একটি-ই মাত্র সার্বজনীন প্রজ্ঞা বর্তমান। হার্ডার দেখিয়েছেন যে প্রতিটি ঐতিহাসিক যুগেরই নিজস্ব সহজাত মূল্য আছে আর প্রত্যেক জাতিরই আছে তার নিজস্ব চরিত্র বা আ। প্রশ্ন হচ্ছে অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা নিজেদেরকে অবিচ্ছেদ্যভাবে এ করতে পারি কিনা।

তার মানে, লোকজনকে আরো ভালোভাবে বুঝতে হবে আমাদের।

এটা এখন মেনেই নেয়া হয়, কিন্তু রোমান্টিক যুগে ধারণাটা ছিল একেবারে নতুন। রোমান্টিসিজম-ই জাতীয় এতার অনুভূতিকে সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছে। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে এই সময়েই, ১৮১৪-তে, জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে নরওয়ের সংগ্রাম প্রবল হয়ে ওঠে।

আচ্ছা।

রোমান্টিসিজম যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্পর্ক তৈরি করছিল কাজেই স্বাভাবিকভাবেই দুধরনের রোমান্টিসিজম স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিকে রয়েছে প্রকৃতি, বিশ্ব ভ্রা আর শৈল্পিক প্রতিভা নিয়ে ব্যস্ত রোমান্টিকদের সার্বজনীন রোমান্টিসিজম। এ-ধরনের রোমান্টিসিজম-ই বিস্তার লাভ করেছিল গোড়ার দিকে, বিশেষ করে ১৮০০ সাল নাগাদ, জার্মানীর জেনা শহরে।

আর অন্যটা?

অন্যটা হচ্ছে তথাকথিত জাতীয় রোমান্টিসিজম, যা জনপ্রিয়তা অর্জন করে আরেকটু পরে। বিশেষ করে হাইডেলবার্গ শহরে। জাতীয় রোমান্টিকরা প্রধানত আগ্রহী ছিলেন সাধারণ অর্থে জনগণের ইতিহাস, জনগণের ভাষা এবং জনগণের সংস্কৃতি সম্পর্কে। আর জনগণ-কে দেখা হতো তার সহজাত সম্ভাবনাগুলোকে ঠিক প্রকৃতি আর ইতিহাসের মতো মেলে ধরতে থাকা এক জীবদেহ হিসেবে।

কোথায় থাকো বলল, আমি বলে দেবো তুমি কে।

যে-জিনিসটি এই দুধরনের রোমান্টিসিজমের মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি করেছিল তা প্রথমত এবং প্রধানত সেই চাবি শব্দ জীবদেহ। একটা গাছ আর একটা জাতি, এই দুটোকেই রোমান্টিকেরা সজীব জীবদেহ হিসেবে বিবেচনা করতেন। একটা কবিতাও একটা সজীব জীবদেহ। ভাষাও একটা জীবদেহ। গোটা ভৌত জগত্তাকে পর্যন্ত একটা জীবদেহ বলে ভাবা হতো। কাজেই সার্বজনীন রোমান্টিসিজম আর জাতীয় রোমান্টিসিজমের ভেতর সে অর্থে সে-রকম সুস্পষ্ট কোনো বিভাজন রেখা ছিল না। বিশ্ব চিদাআ জনগণ আর জনপ্রিয় সংস্কৃতির ভেতরে যেমন, তেমনি প্রকৃতি আর শিল্পের ভেতরেও একইভাবে বিদ্যমান।

আচ্ছা।

বহু দেশের লোক কাহিনী সংগ্রহ করে জনগণের কণ্ঠস্বর এই বাঅয় নামের বইতে সেগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমে হার্ডার পরিণত হয়েছিলেন একজন অগ্রদূতে। হাইডেলবার্গে লোকসঙ্গীত আর রূপকথা সংগ্রহ করতে শুরু করেন গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় (Brothers Grimm) এবং অন্যরা। তুমি নিশ্চয়ই গ্রিমভাইদের রূপকথার নাম শুনেছ।

তা শুনিনি আবার? তুষারকন্যা আর সাত বামন, রাম্পলস্টিস্কিন, ব্যাঙ রাজকুমার, হ্যাঁনসেল আর গ্রেটেল…

তাছাড়াও আরো অনেক আছে। নরওয়েতে আমাদের ছিল আসবিয়র্নসেন আর মো, তাঁরাও সারা দেশ ঘুরে ঘুরে জনসাধারণের নিজস্ব গল্প-কাহিনী সংগ্রহ করেছেন। ব্যাপারটা অনেকটা হঠাৎ করেই চমৎকার আর পুষ্টিকর একটা রসাল ফল আবিষ্কার করে সেটা গোলায় এনে তোলার মতো ব্যাপার। আর ব্যাপারটা ছিল বেশ জরুরি কারণ ফলটা তখন পেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোকসঙ্গীত-ও সংগ্রহ করা হলো; বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করা শুরু হলো নরওয়েজিয় ভাষা। পৌত্তলিক যুগের প্রাচীন পুরাণ আর সাগা আবিষ্কৃত হলো নতুন করে। আর ইউরোপের সমস্ত কম্পোজার তাঁদের কম্পোজিশনে লোকসঙ্গীত-এর মিশ্রণ ঘটাতে শুরু করলেন যাতে লোকসঙ্গীত আর শিল্প সঙ্গীত-এর (art music) মধ্যে একটা সেতুবন্ধ রচনা করা যায়।

এই শিল্প সঙ্গীতটা কী?

শিল্প সঙ্গীত হচ্ছে বিশেষ কোনো ব্যক্তি যেমন বেঠোভেন-এর তৈরি সঙ্গীত। লোকসঙ্গীত বিশেষ কোনো ব্যক্তির রচনা নয়, সেটা এসেছে জনসাধারণের কাছ থেকে। সে-কারণেই বিভিন্ন লোকজ সুরগুলো কবেকার তা সঠিকভাবে জানা যায় না। একইভাবে আমরা লোক-কাহিনী আর শিল্প কাহিনী-র (art tales) কথাও বলে থাকি।

তাহলে শিল্প কাহিনী হচ্ছে…।

বিশেষ কোনো লেখক যেমন হ্যাঁন্স ক্রিশ্চান অ্যান্ডারসন-এর (Hans Christian Andersen) লেখা কাহিনী। রূপকথা নামের জার (genre) রোমান্টিকেরা খুবই আগ্রহ নিয়ে চর্চা করেছেন। এই আঁর-এর অন্যতম জার্মান ওস্তাদ ছিলেন ই.টি.এ. হফম্যান (E.T.A. Hoffman)।

শুনেছি আমি হফম্যানের গল্প-র কথা।

রূপকথা ছিল রোমান্টিকদের পরম সাহিত্যিক আদর্শ, ঠিক যেমন বারোক যুগের পরম শৈল্পিক ফর্ম ছিল থিয়েটার। রূপকথা কবিকে তার নিজের সৃষ্টিশীলতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের সুযোগ দিত।

এক কাল্পনিক মহাবিশ্বের ঈশ্বর-এর ভূমিকা নিতে পারতেন তিনি।

ঠিক বলেছ। তো, এবার আমরা পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে একবার দেখে নেবার পর্যায়ে পৌঁছে গেছি।

বলে যান।

রোমান্টিসিজমের দার্শনিকেরা বিশ্ব স্যা-কে দেখেছেন একটি অহম হিসেবে, যে-অহম কম-বেশি এক স্বপ্নময় অবস্থায় জগতের সব কিছু তৈরি করেছে। দার্শনিক ফিক্সটে (Fichte) বলেছেন প্রকৃতির জন্ম হয়েছে উচ্চতর অচেতন এক কল্পনা থেকে। শেলিং স্পষ্ট করেই বলেছেন যে ঈশ্বর-এর ভেতরেই রয়েছে। জগন্টা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর সেটার খানিকটা সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু প্রকৃতির অন্যান্য কিছু ব্যাপার রয়েছে যা ঈশ্বরের ভেতরকার অজানা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ ঈশ্বরেরও একটা অন্ধকার দিক আছে। | চিন্তাটা একই সঙ্গে মজার আর ভীতিজনক। বার্কলে-র কথা পড়ে যাচ্ছে আমার কথাটা শুনে।

ঠিক একই আলোতে দেখা হয়েছিল শিল্পী আর তার কাজের মধ্যেকার সম্পর্কটিকে। রূপকথা লেখককে তাঁর মহাবিশ্ব সৃষ্টিকারী কল্পনার সুযোগ নেবার পুরো এক্তিয়ার দিয়েছিল। আর এমনকী সৃজনশীল কাজও যে সব সময় পুরোপুরি সচেতনভাবে করা হতো তা নয়। লেখকের মনে হতে পারে যে কোনো একটা অন্ত র্নিহিত শক্তি তার গল্পটা লিখে যাচ্ছে। লেখার সময় কার্যতই তিনি একটা সম্মোহক ঘোরের মধ্যে থাকতে পারেন।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, তাই, তবে সেই মায়া বা বিভ্রান্তিটা তিনি হঠাই নষ্ট করে দিতে পারেন। গল্পের মাঝখানে বাগড়া দিয়ে পাঠকের উদ্দেশে তিনি শ্লেম্ভক মন্তব্যও ছুঁড়ে দিতে পারেন, যাতে করে পাঠককে অন্তত মুহূর্তের জন্যে স্মরণ করিয়ে দেয়া যায় যে শত হলেও এটা নিছকই একটা গল্প মাত্র।

আচ্ছা।

একই সঙ্গে লেখক তার পাঠককে মনে করিয়ে দেন যে তিনি-ই সেই কাল্পনিক মহাবিশ্বের সমস্ত কলকাঠি নাড়ছেন। এই ধরনের বিভ্রান্তিকে বলে রোমান্টিক আয়রনি। এই যেমন হেনরিক ইবসেন (Henric Ibsen) পিয়ার গিন্ট নাটকে তার এক চরিত্রকে দিয়ে বলাচ্ছেন: পঞ্চম অঙ্কের মাঝখানে তো কেউ মরতে পারে না।

সত্যিই বড় মজার কথা। সে আসলে যা বলছিল তা হচ্ছে সে একটা কাল্পনিক চরিত্র।

বক্তব্যটা এতোই প্যারাডক্সিকাল যে এটার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার জন্যে আমরা একটা নতুন পর্ব শুরু করতে পারি।

.

তার মানে?

 ও কিছু না, সোফি। তবে আমরা জানি যে নোভালিসের প্রেমিকার নাম ছিল সোফি, ঠিক তোমার মতো আর সে যখন মারা গিয়েছিল তখন তার বয়স ছিল পনের বছর চার দিন…।

আপনি জানেন না বুঝি আমি ভয় পাচ্ছি?

পাথরের মতো মুখ করে তাকিয়ে রইলেন অ্যালবার্টো। তারপর তিনি বললেন: কিন্তু নোভালিসের প্রেমিকার ভাগ্য তোমাকে বরণ করতে হবে না, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।

 কেন?

কারণ আরো বেশ কিছু চ্যাপ্টার এখনো বাকি।

কী বলতে চাইছেন?

বলতে চাইছি যে সোফি আর অ্যালবার্টোর গল্পের পাঠক তার স্বজ্ঞা দিয়েই বুঝে নেবেন যে গল্পের শেষ হতে এখনো অনেক পৃষ্ঠা বাকি। মাত্র রোমান্টিসিজম পর্যন্ত এসেছি আমরা।

আপনি আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।

আসলে মেজর-ই হিল্ডার মাথা ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। কাজটা সে খুব ভালো করছে না, করছে কি? নতুন পর্ব।

***

অ্যালবার্টো তাঁর কথা শেষ করেছেন কি করেননি বনের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো একটি ছোট্ট ছেলে। তার মাথায় একটা পাগড়ি আর হাতে একটা তেলের প্রদীপ। খপ করে অ্যালবার্টোর হাত চেপে ধরল সোফি।

ও কে? জিগ্যেস করল সে।

জবাবটা ছেলেটাই দিয়ে দিল: আমার নাম আলাদিন, সেই লেবানন থেকে এতদূর এসেছি আমি।

কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন অ্যালবার্টো।

তোমার বাতির মধ্যে কী?

প্রদীপটায় একটা ঘষা দিল ছেলেটা আর তখন সেটার ভেতর থেকে ঘন একটা মেঘ বেরিয়ে এসে একটা মানুষের আকৃতি নিল। অ্যালবার্টোর মতো কালো দাড়ি আর মাথায় বেরে টুপি তার। প্রদীপটার ওপর ভাসতে ভাসতে সে বলে উঠল আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস, হিল্ডা? আমার মনে হয় জন্মদিনের বাড়তি কোনো শুভেচ্ছা দেয়ার পক্ষে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি স্রেফ বলতে চেয়েছি যে বিয়ার্কলে আর দেশের দক্ষিণ দিকটা এখানে এই লেবানন থেকে আমার কাছে পরীর দেশ বলে মনে হয়। দিন কয়েকের মধ্যেই ওখানে দেখা হবে আমাদের।

এ-কথা বলার পরেই ফের মেঘ বনে গেল আকৃতিটা, তারপর আবার ঢুকে পড়ল প্রদীপটার ভেতর। পাগড়ি-পরা ছেলেটা তার বাহুর নিচে ঢুকিয়ে রাখল প্রদীপটা, দৌড়ে ঢুকে পড়ল বনের ভেতর, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

এ-আমি বিশ্বাস করি না, বলে উঠল সোফি।

সস্তা চালাকি, মাই ডিয়ার।

 প্রদীপের ভূতটার গলা অবিকল হিল্ডার বাবার গলার মতো।

তার কারণ ওটা ছিল হিল্ডার বাবারই ভূত।

কিন্তু…

তুমি আর আমি দুজনেই এবং আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছুই রয়েছে মেজরের মনের গহীন ভেতরে। এখন শনিবার গভীর রাত্রি, ২৮শে এপ্রিল, মেজরের চারপাশের জাতিসংঘের সমস্ত সৈন্য গভীর ঘুমে বিভোর আর মেজর যদিও জেগে, কিন্তু তার চোখ ঘুমে ভেঙে আসছে। তবে হিল্ডাকে তার পঞ্চদশ জন্মদিনের উপহার হিসেবে সে যে-বইটা দেবে সেটা তাকে শেষ করতেই হবে। সেজন্যেই তাকে কাজ করতে হবে, সোফি। সেজন্যেই বেচারার নিঃশ্বাস নেবার কোনো ফুরসতই নেই প্রায়।

আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি।

নতুন পর্ব!

.

সোফি আর অ্যালবার্টো ছোট্ট লেকটার দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন। অ্যালবার্টোকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। খানিক পর তার কাঁধে মৃদু একটা ঠেলা দিল সোফি।

স্বপ্ন দেখছিলেন বুঝি?

হ্যাঁ, ঠিক ওখানটাতে বাগড়া দিচ্ছিল সে। শেষ কয়েকটা প্যারাগ্রাফের প্রতিটা অক্ষর ডিক্টেট করে গেছে সে। নিজের ওপর লজ্জা হওয়া উচিত তার। কিন্তু এবার তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে, খোলা জায়গায় এসে পড়েছে সে। এখন আমরা জানি যে আমরা আমাদের জীবন যাপন করছি একটা বইয়ের ভেতর যে-বই হিল্ডার বাবা বাড়িতে হিল্ডার কাছে পাঠাবে তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে। শুনলে তো কী বললাম? ইয়ে, কথাটা কিন্তু আমি বলছিলাম না।

আপনি যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তো আমি বইটা থেকে পালিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো যেদিকে খুশি চলে যাব।

ঠিক সে-কথাই ভাবছি আমি। কিন্তু তা ঘটার আগে হিল্ডার সঙ্গে অবশ্যই কথা বলার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। আমরা যা বলছি তার প্রতিটি শব্দ পড়ছে সে। একবার যদি এখান থেকে আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি তাহলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা বড্ড কঠিন হয়ে পড়বে। তার মানে এক্ষুণি সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে আমাদের।

আমরা তাহলে কী করছি?

আমার মনে হয় মেজর এক্ষুণি তার টাইপরাইটারটার ওপর ঘুমে ঢলে পড়বে, যদিও তার সব কটা আঙুল চাবিগুলোর ওপর ঝড়ের বেগে খেলে বেড়াচ্ছে এখনো…

এটা একটা অদ্ভুতুড়ে চিন্তা।

এখনই সেই সময় যখন সে এমন কিছু লিখে ফেলবে যা নিয়ে পরে আফসোস করবে সে। আর, তার কাছে কোনো ফ্লুইডও নেই যা দিয়ে ভুলটা শোধরানো যায়। এটাই আমার প্ল্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেউ যেন মেজরকে তার লেখার ভুল শোধরানোর জন্যে এক বোতল কারেকশান ফ্লুইড না দেয়।

আমি তো অন্তত এক ফোঁটাও দেবো না তাকে।

আমি সেই বেচারীকে এখানে এক্ষুণি হাজির হতে বলছি তার নিজের বাবার বিরুদ্ধে বেদ্রোহ করার জন্যে। ছায়ার সঙ্গে মেজরের অসংযমহীন এই খেলায় নিজেকে মজা পেতে দেয়ার জন্যে মেয়েটার লজ্জিত হওয়া উচিত। শুধু যদি লোকটাকে পেতাম এখানে তাহলে ওকে টের পাইয়ে দিতাম মজাটা।

কিন্তু সে তো আর এখানে নেই।

মনে-প্রাণে সে এখানে আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে সে লেবাননে আটকে আছে বহাল তবিয়তে। আমাদের চারপাশের সব কিছুই মেজরের অহম।

কিন্তু আমরা এখানে যা দেখতে পাচ্ছি সে তো তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

 মেজরের স্যার ভেতর ছায়া ছাড়া আর কিছুই না আমরা। আর ছায়ার পক্ষে তার প্রভুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো খুব সহজ কথা নয়, সোফি। কাজটাতে ধূর্ততা আর কৌশল দুটোই লাগে। তবে হিল্ডাকে প্রভাবিত করার একটা সুযোগ আছে। আমাদের। দেবদূতই কেবল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।

মেজর বাড়ি ফিরলে তাকে সব কথা খুলে বলার জন্যে হিল্ডাকে বলতে পারি আমরা। হিল্ডা তাকে বলতে পারে সে একটা পাজী লোক। সে তার নৌকোটা ফুটো করে দিতে পারে বা অন্তত লণ্ঠনটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।

অ্যালবার্টো মাথা ঝাঁকালেন। তারপর তিনি বললেন সে তার কাছ থেকে পালিয়েও যেতে পারে। কাজটা তার জন্যে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সহজ হবে। এমনও হতে পারে সে মেজরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর ফিরল না। আমাদের মাথার ওপর কাঁঠাল ভেঙে যে-মেজর তার মহাবিশ্ব সৃষ্টিকারী কল্পনা নিয়ে খেলে তার জন্যে ব্যাপারটা বড্ড যুতসই হবে না? কি বল?

বেশ কল্পনা করতে পারছি দৃশ্যটা। সারা দুনিয়া জুড়ে হিল্ডাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মেজর। কিন্তু হিল্ডা স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেছে, তার কারণ সে এ-রকম কোনো বাবার কাছে থাকা বরদাশত করতে পারে না যে-কিনা অ্যালবার্টো আর সোফিকে নিয়ে মশকরা করে।

 হ্যাঁ, ঠিক, মশকরা করে। আমাদেরকে জন্মদিনের আমোদ হিসেবে ওর ব্যবহারের কথা বলতে আমি এটাই বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু তার সাবধান হওয়া উচিত। হিল্ডারও।

কী বলতে চাইছেন?

 তুমি ঠিক মতো বসেছো তো?

প্রদীপ থেকে কোনো ভূত-টুত না বেরোনো পর্যন্ত ঠিক আছে।

কল্পনা করার চেষ্টা করো যে আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা আসলে চলছে একজন মানুষের মনের ভেতর। আমরা সেই মন। তার অর্থ আমাদের কোনো স্যা নেই, আমরা অন্যের ভা। এ-পর্যন্ত আমরা মোটামুটি পরিচিত দার্শনিক পরিস্থিতির ভেতরেই আছি। বার্কলে আর শেলিং দুজনেই নিশ্চয়ই কান খাড়া করবেন এখন।

আচ্ছা?

 তো, এটা খুবই সম্ভব যে এই আটা হিল্ডা মোলার ন্যাগ-এর বাবা। সে লেবাননে বসে তার মেয়ের পঞ্চদশ জন্মদিনের উপহার হিসেবে দর্শনের ওপর একটা বই লিখছে। ১৫ই জুন ঘুম থেকে উঠে হিল্ডা বিছানার পাশের টেবিলটার ওপর দেখতে পাবে বইটা। এখন, সে বা অন্য যে-কেউ-আমাদের কথা পড়তে পারবে। অনেক দিন ধরেই এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে উপহারটা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যাবে।

হ্যাঁ, আমার মনে আছে।

তোমাকে আমি এখন যা বলছি তা হিল্ডা পড়ে ফেলবে লেবাননে তার বাবা এ কথা একবার কল্পনা করার পর যে আমি তোমাকে বলছি যে সে-লোকটা লেবাননে আছে…আর কল্পনা করছে যে আমি তোমাকে বলছি যে সে লেবাননে আছে।

মাথা ঘুরতে শুরু করল সোফির। বার্কলে আর রোমান্টিকদের সম্পর্কে কী শুনেছে সে-কথা মনে করার চেষ্টা করল সে। অ্যালবার্টো নক্স বলে চলেছেন: কিন্তু সেজন্যে ওদের অতো পায়াভারি হওয়া উচিত হবে না। বরং ওদেরই হাসা উচিত সবার শেষে, কারণ ওদের হাসি খুব সহজেই ওদের গলায় আটকে যেতে পারে।

কাদের কথা বলছেন বলুন তো?

কেন, হিল্ডা আর তার বাবার কথা। ওদের কথাই আলোচনা করছিলাম না। আমরা?

কিন্তু ওদের অতো পায়াভারি হওয়া উচিত হবে না কেন বলছেন?

কারণ এটাও সম্ভব যে ওরা-ও মন ছাড়া আর কিছুই নয়।

সে কী করে সম্ভব?

বার্কলে আর রোমান্টিকদের জন্যে ব্যাপারটা সম্ভব হতে পারলে ওটা তাদের জন্যেও সম্ভব। এমনও হতে পারে যে মেজর-ও তাকে আর হিল্ডাকে নিয়ে লেখা বই-এর একটা ছায়া, যে-বইটা আবার আমাদেরকে নিয়েও লেখা, কারণ আমরা ওদের জীবনের একটা অংশ।

সেটা তো আরো খারাপ হবে। তাতে আমরা হবো ছায়ার ছায়া।

 কিন্তু আবার এটা সম্ভব যে একেবারে ভিন্ন একজন লেখক কোথাও বসে জাতিসংঘের এক মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ সম্পর্কে একটা বই লিখছে, যে-মেজর তার মেয়ে হিল্ডার জন্যে একটা বই লিখছে। এ-বইটা এক অ্যালবার্টো নক্স-কে নিয়ে লেখা যে হঠাৎ করেই ৩ ক্লোভার ক্লোজ-এর সোফি অ্যামুন্ডসেন-এর কাছে সাধারণ কিছু দার্শনিক বক্তৃতা পাঠাতে শুরু করে।

আপনি এ-কথা বিশ্বাস করেন?

 আমি শুধু বলছি ব্যাপারটা সম্ভব। আমাদের কাছে সেই লেখক হবেন এক গুপ্ত ঈশ্বর যদিও আমরা যা তার সব কিছু আর আমরা যা বলি বা করি তার সবকিছু তার কাছ থেকেই আসছে, কারণ আমরাই সে, কিন্তু তারপরেও তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবো না আমরা। আমরা রয়েছি সবচেয়ে ভেতরের বাক্সটায়।

অ্যালবার্টো আর সোফি এবার অনেকক্ষণ বসে রইলেন কোনো কথা না বলে। সোফি-ই ভাঙল নীরবতাটা: কিন্তু সত্যি-ই যদি এমন এক লেখক থেকে থাকেন যিনি লেবাননে থাকা হিল্ডার বাবাকে নিয়ে একটি গল্প লিখছেন, ঠিক যেমন হিল্ডার বাবা আমাদের নিয়ে একটা গল্প লিখছে…

হ্যাঁ?

..তো, সেক্ষেত্রে এটাও সম্ভব যে সেই লেখকেরও পায়াভারি হওয়া উচিত নয়।

কী বলতে চাইছ? হিল্ডা আর আমাকে তার মাথার গহীন ভেতরে লুকিয়ে রেখে তিনি কোথাও বসে আছেন। এখন এটা কি সম্ভব না যে তিনিও উচ্চতর একটা মন-এর অংশ?

মাথা ঝাঁকালেন অ্যালবার্টো।

অবশ্যই, সোফি। সেটাও সম্ভব। আর, ব্যাপারটা যদি তাই-ই হয় তাহলে তার অর্থ এই দার্শনিক আলাপে আমাদের নিয়োজিত হতে দিয়েছেন তিনি এই সম্ভাবনাটি উপস্থাপন করার জন্যে। তার ইচ্ছা এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা যে তিনি-ও এক অসহায় ছায়া মাত্র আর এই বইটি, যেখানে হিল্ডা আর সোফি-র আবির্ভাব ঘটেছে সেটা আসলে দর্শনের একটা টেক্সট বই।

টেক্সট বই?

কারণ আমাদের সমস্ত কথোপকথন, আমাদের সমস্ত সংলাপ…

 হ্যাঁ?

..আসলে এক দীর্ঘ একক সংলাপ (monologue)…

আমার মনে হচ্ছে সব কিছুই মন আর আার ভেতর বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি খুশি যে অল্প কয়েকজন দার্শনিক এখনো বাকি আছেন। থেলিস, এম্পিডক্লেস আর ডেমোক্রিটাসকে দিয়ে যে-দর্শনের সগৌরব যাত্রা শুরু হয়েছিল তা নিশ্চয়ই এখানে এসে আটকে যেতে পারে না, তাই না?

অবশ্যই না। এখনো হেগেল-এর কথা বলিনি তোমাকে। রোমান্টিকেরা সব কিছু তার ভেতর মিশিয়ে দেয়ার পর দর্শনকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসা প্রথম দার্শনিক তিনি-ই।

খুব কৌতূহল হচ্ছে আমার।

আর কোনো ভূত-প্রেত বা ছায়া যাতে আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্যে এখন ভেতরে যাবো আমরা।

এমনিতেও বাইরে এখানটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। পরের চ্যাপ্টার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *