রাধারানী একপ্রকার ভালো আছে
‘বঙ্গবন্ধু চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোও উঠে গেল,’ প্রবীণ এক সমাজকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন মুক্তিকে। শুনেছি জিনিসপত্রও নাকি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। পতিতালয় উচ্ছেদ করার মতো করে মেয়েদের তাড়িয়ে দেয়।
‘তারপর মেয়েরা কী করল, কোথায় গেল?’
‘সবকিছু থেকে অ্যালুফ তখন আমি। চারদিকে ধরপাকড় চলছে। কোন সময় জেলে ঢুকব, কোন সময় কীভাবে টর্চারড হব–এটাই চিন্তা করতাম সারাক্ষণ।
তারপর সমাজকর্মী বীরাঙ্গনাদের খোঁজার জন্য যে কয়েকটা জায়গার নাম মুক্তিকে বলেন, তার সব কটিই ব্রথেল, বেশ্যালয়। কিন্তু মুক্তি তো খুঁজছে বীরাঙ্গনাদের! ‘তাতে কী! বীরাঙ্গনা থেকে যারা বারাঙ্গনা হয়ে গেল, সমাজকর্মী বললেন, তারাই আজ তোমার কাছে মুখ খুলবে। এ দিয়ে একটা মেগা স্টোরি লিখতে পারবে তুমি।
‘কিন্তু একাত্তরের নির্যাতিতরা কি সত্যি সত্যি প্রস্টিটিউশনে চলে গেছে?’
‘যাবে না তো কী করবে? নো বডি কেয়ারস ফর বীরাঙ্গনাস। সমাজ তো দূরের কথা, কেউ ফিরেও তাকায়নি।’
তারপর মুক্তিকে তিনি অদৃশ্য বীরাঙ্গনাদের লম্বা এক ফিরিস্তি দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব মেয়ে বিদেশ চলে গেছে দালালদের খপ্পরে পড়ে, তারা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। তখন আত্মহত্যা করেছে কেউ কেউ। স্বেচ্ছায় বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সেটেল্ড করেছে যারা, ওখানে নোবডি কেয়ারস ফর দ্যাট। তিনটা বিয়ে করলে যদি অসুবিধা না-হয়, এটা তো একটা অ্যাকসিডেন্ট। এ নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তবে সেটেল্ড লাইফে একাত্তরের নির্যাতিত মেয়েরা আমাদের দেশে যে একেবারে নেই, তা নয়। তারা এখন ফিফটি আপ বা সিক্সটি–গোপনে সংসার করছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তারা কি একাত্তরের কাহিনি বলে স্বামী বা পুত্রহারা হবে? সে অধিকার তোমার-আমার কারো নেই। তার পরও তুমি যদি কথা বলতে চাও–নিজে গিয়ে দেখতে পারো, কেউ রেসপনস করবে না।
একসময়ের পুনর্বাসনকেন্দ্রের বেতনভুক কর্মী বেবির হদিশ দিয়েছিলেন এই সমাজকর্মীই। নাম-ঠিকানা নিজের হাতে পোড়ানো সত্ত্বেও মরিয়মের ঠিকানাটা যুদ্ধের আটাশ বছর পরও তার মনে ছিল। বেবি তত দিনে মহিলা অধিদপ্তরের একজন বড় কর্মর্কতা। পুনর্বাসন বোর্ড মহিলা অধিদপ্তরে মার্জড করে গেলে বেবিও ওখানে স্থানান্তরিত হয়। তার পর থেকে ওখানেই আছে। বেবির সঙ্গে যোগাযোগ করার আগে মুক্তি পতিতাপল্লি যাওয়া মনস্থ করে। এ ব্যাপারে তাকে দিকনির্দেশনা দেন উক্ত সমাজকর্মী।
‘তুমি যেতে পারো বানিশান্তায়,’ তিনি বলেছিলেন। মংলা পোর্টের দক্ষিণ দিকে পশুর নদের পশ্চিম পাড়ে বানিশান্তা পতিতাপল্লি। আরো দক্ষিণে গেলে সুন্দরবন। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে মুক্তির ভয় বেশি ব্রথেলের দালাল আর সর্দারনিদের। পতিতাপল্লিতে একবার ঢুকলে সে যদি বেরোতে না পারে! সব মেয়েরই পায়ে পায়ে একটা বেশ্যালয় ঘোরে। তা ছাড়া এত দূরের পথ বানিশান্তা, একা। যাওয়ার তার সাহস হয়নি। ‘তারপর ধরো ইংলিশ রোড, এই ঢাকার মধ্যেই, পতিতাপল্লির নাম কান্দুপট্টি।’ কান্দুপট্টি উচ্ছেদ হয়ে গেছে দু’বছর আগে, ১৯৯৭ সালের মে মাসে। সেখানকার মেয়েরা এখন ঢাকার পথে-পার্কে-দরগায় খদ্দের বসায়। সমাজকর্মীর বয়স দুই হাজার সালে আশি হবে। কান্দুপট্টি উচ্ছেদের খবর শুনে থাকলেও তার মনে নেই। তিনি মুক্তিকে এরপর টানবাজার যেতে বলেন। টানবাজার ব্রথেলে ঢোকার মুখেই দেখবে হংস থিয়েটার-পুরোনো সুন্দর একটা বাড়ি। আনারকলি ছবিটা তিনি হংস থিয়েটারেই ষাটের দশকে দেখেছিলেন। মধুবালা ছিল আনারকলির রোলে, আর দিলীপকুমার হচ্ছেন গিয়ে শাহজাদা সেলিম। পরে যিনি চতুর্থ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর হন।
দেড়শ-দু’শ বছরের পুরোনো টানবাজার পতিতালয়। শীতলক্ষ্যা পাড়ের প্রাচীন বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে। বিদেশি নাবিক-বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য অতীতের কোনো এক সময় তা গড়ে ওঠে। আজ যদিও শীতলক্ষ্যার বুকে বিদেশি জাহাজ নোঙর ফেলে না, পাট আর সুতোর জমজমাট ব্যবসাও নেই, তবু পতিতাপল্লিটিতে হু হু করে বন্যার পানির মতো মেয়ে বাড়ছে। বর্তমানে তারা প্রায় তিন হাজার। মালিক ও খদ্দের এখন তাদের ভিন্ন। সমাজকর্মী যখন মুক্তিকে টানবাজারে যেতে বলেন, তখন পতিতাপল্লি উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। প্রতিদিন কাগজে কোনো-না-কোনো খবর থাকছেই টানবাজার নিয়ে। কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে মুক্তিও একদিন যায়। ওখানে। ঢোকার মুখে হংস থিয়েটারের পুরোনো সুন্দর বাড়িটার দিকে তাকাবে কি, মেয়েদের দেখেই তো চক্ষু স্থির। গলির দু’দিকে শাটার-ফেলা দোকানের রোয়াকে বা সিঁড়িতে দিনদুপুরে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে করছে। তাদের সাজসজ্জা, ঠাকঠমক, দাঁড়ানোর অতি প্রাচীন ভঙ্গিমা, জীবনে প্রথম দেখলেও বোঝা যায়–এরা কারা। অথচ এই গলিপথেই সিগারেট বিক্রেতা, বাড়িঅলার এজেন্ট, ইনফরমার, সাংবাদিক, প্রেমিক, খদ্দের যারা আছে, জনে জনে পরিচয় না দিলে তাদের চেনা মুশকিল। প্রাপ্তবয়স্কদের পায়ে পায়ে ছোট ছোট বাচ্চারা ঘুরছে, হামা দিচ্ছে। গলির এপাশ ওপাশ করতে গেলে তাদের ডিঙিয়ে যেতে হয়। এদিকে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো খানে খানে ইউনিফরমধারী পুলিশ। মুক্তির মনে হয়, স্মৃতিভঙ্গুর এক বৃদ্ধার কথায় এমন জায়গায় একাত্তরের বীরাঙ্গনা খুঁজতে না-এলেই ভালো করত। মুখ ফুটে সহযাত্রীদের বলতেও পারছে না। কিছুটা ধাতস্থ হতে দেখে, তারা একদল মারমুখী মেয়ের বেষ্টনীর মধ্যে। সাংবাদিকরা তাদের দাবিদাওয়া জানতে চাচ্ছে। সাধারণ সব প্রশ্নের তুখোড় সব জবাব আসছে মেয়েগুলোর কাছ থেকে। কেউ কেউ প্রশ্নের তোয়াক্কাও করছে না। আমরা কি রোডে গিয়ে পুরুষগো ডাকতাম, আমরা কি আপনার স্বামীরে ডাইক্যা নিতাম বসতিতে যে আমাদের উচ্ছেদ করবার নাগছেন? মুক্তি এর জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও তার বিয়ে হয়নি, স্বামীও নেই। তারপর যে পুরুষ সাংবাদিকটির পেছনে সে আশ্রয় নেয়, মেয়েটি তার উদ্দেশে বলে, ‘তোমরা বউ থুইয়্যা আসো বা বউ ছাইড়া দেও, আমরা কইলাম হেইডাও কিনো দিন কই নাই। তোমরা টাকা দিছো, এনজয় কইরা চইল্যা গেছে। খেইল খতম, পয়সা হজম।’
উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে যে মেয়েরা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের মুখে রং নেই, সাজসজ্জার বালাই নেই। দু’দিন আগে রাজধানীতে গিয়ে বক্তৃতা-স্লোগান দিয়ে সবার গলা ভাঙা। আজ যাদের বয়স পঞ্চাশ, মুক্তি হিসেব করে একাত্তরে তারা ছিল ২১/২২ বছরের তরুণী। সেই বয়সের একজন ভাঙা গলায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ নকল করে, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ শেখের পার্টির লোকেরা এখন ক্ষমতায়। তারা টানবাজারে পানির সাপ্লাই বন্ধ করে, বিদ্যুতের লাইন কেটে, খদ্দের আসার পথে নানা প্রকার বাধা সৃষ্টি করে বেশ্যাদের ভাতে মারছে, পানিতে মারছে। ‘আমার কী লাভ হইল,’ একজন বিহারি মহিলা বলে। ‘আমি তো বিহারি আছিলাম, বাঙালি অইছি, আমারেও তো শেখের বাহিনী উচ্ছেদ করে দিতাছে।’ বিহারি মহিলার নাম নাসিমবানু। বাঙালি পুরুষদের গ্যাংরেপের শিকার হয়ে বাহাত্তর সালে টানবাজারে আসে। মা-বাবা-ভাই-বোনের খোঁজ নেই। বেঁচে আছে না মারা গেছে, জানে না।
শুরুতেই গন্ডগোল। মুক্তি দেখে, ইতিহাসের এক অন্ধকার গলিতে সে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি মেয়ে খুঁজতে এসে পেয়ে গেছে বিহারি নারী। নিজে সে বীরাঙ্গনার পুনর্বাসনকেন্দ্রে না গিয়ে, চলে এসেছে পতিতাপল্লিতে। মাঝখানে অনেকগুলো বছর। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পুনর্বাসনকেন্দ্র উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এখন পতিতাপল্লি উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে তার দলের লোক, যেখানে সমাজকর্মীর ভাষ্যমতে– পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়েরাও আছে। থাকলে তারা কোথায়? উচ্ছেদের ডামাডোলে হাজার হাজার মেয়ের অতীত পরিচয় উদ্ঘাটন সহজ কাজ নয়। জিগ্যেস করলে জবাব আসে, ‘আমার মা খানকি আছিল, আমিও খানকি।’ অতীত নিয়ে মাথাব্যথা নেই, ভবিষ্যতের চিন্তা সবার।
মুক্তি ফিরে এসে রিপোর্ট করে। সব শুনে সমাজকর্মী বলেন, ‘আমি কালের সাক্ষী বৃদ্ধ বটগাছ। আমার কাছে অসহ্য লাগে এগুলি।’ তবে তিনি তাকে ওইসব জায়গায় খোঁজখবর চালিয়ে যেতে বললেন। মুক্তির আর ওখানে যাওয়া হয়নি। টানবাজার উচ্ছেদ হয়ে গেছে। মেয়েদের ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাশিমপুর, পুবাইল ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। যদিও বঙ্গীয় ভবঘুরে আইন, ১৯৪৩ অনুযায়ী টানবাজারের মেয়েদের পেশা ভিক্ষাবৃত্তি ছিল না, অথবা রাস্তা বা জনপদে এমন কোনো ভঙ্গিমায় তারা দাঁড়িয়ে থাকেনি, যা দেখে মনে হতে পারে, তারা খয়রাত চাচ্ছে।
কাছাকাছির মধ্যে বাকি থাকে দৌলতদিয়া। পদ্মাপাড়ের পতিতাপল্লি। মুক্তি এবার সমাজকর্মীর নির্দেশমতো না-এগিয়ে নিজেই পথ ঠিক করে। কারণ তিনি বটগাছ হতে পারেন, কালের সাক্ষীও বটে, তবে এনজিওর কর্মকাণ্ড যে অরণ্যের দাবানলের মতো পতিতাপল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, আর আড়কাঠি, দালাল, খদ্দের ছাড়াও সেখানে যে। বাইরের মেয়েরাও যাতায়াত করে, যদিও অ্যাপ্রন পরে, নিজেরা যে বেশ্যা না, তা বোঝানোর জন্য, এসব কথা বোধ হয় শোনেননি। শুনলেও মনে নেই। তার শুধু এক কথা, ‘তুমি কান্দুপট্টি যেতে পারো।’ কান্দুপট্টি উঠে গেছে দুই বছর আগে। ‘তাহলে তুমি টানবাজারে যাও।’ টানবাজারের মেয়েরা এখন ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রতি জুম্মার দিনে মিলাদ-মহফিল হয় টানবাজারে। ‘আশ্চর্য, ঢাকা শহরে বসে থাকলে কাজ হবে তোমার! তুমি দৌলতদিয়া যাচ্ছ না কেন?’
মুক্তি দৌলতদিয়া যাওয়ার আগে সেখানকার অ্যাপ্রন পরা নারীকর্মীর শরণাপন্ন হয়। তারা পতিতাপল্লিতে বয়স্ক ও শিশু শিক্ষার প্রজেক্ট চালায়, কনডম ব্যবহারের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে আর ভবিষ্যহীন মেয়েগুলোকে সঞ্চয় করার উৎসাহ দেয়। তাদের একজনের মাধ্যমে মুক্তির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে একাত্তরের বীরাঙ্গনা রাধারানীর সঙ্গে।
দৌলতদিয়ার অলিগলিতে তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে রাধারানী। মুখ ভোলা দূরে থাক, ধরাই দেয় না। একবার একটা চিপাগলিতে উভয় পক্ষ মুখোমুখি। রাধারানী বলে, ‘আমি একাত্তরের বীরাঙ্গনা, শিক্ষিত, তায় বেশ্যা–এগুলি আমার পাপ, মহাপাপ। তোমরা আমারে বিরক্ত করবা না। পথ ছাইড়া খাড়াও।’ গলি থেকে বাইন মাছের মতো শরীর মুচড়িয়ে সে বেরিয়ে যায়। অ্যাপ্রন পরা এনজিওকর্মী জল-কাদা ডিঙাতে ডিঙাতে বলে, ‘এরা সত্য কথা বলে না কেউ। সাবধানে পা ফালান। নইলে আছাড় খাইবেন কিন্তু।’ উল্টোদিকের ঘরের দাওয়ায়, পরনের পেটিকোট বুকের ওপর গিঁট দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে এক বেশ্যা। সে মুচকি হাসে, ‘ভাড়াইট্টা টেনেসফার করায় রাধারানী। তোমরা কি হেরে টেকা দিবা, মাল খাওনের টেকা?’
বেশ্যার স্মার্ট চেহারার দিকে মুক্তি তাকিয়ে থাকে। অ্যাপ্রন পরা এনজিও কর্মী হাসে পাশ থেকে, ‘বুঝলেন না, এইডাই এখন রাধারানীর ব্যবসা। এ দিয়া হে মদের পয়সা তোলে। আপনে কাদায় পা ফালাইয়েন না কিন্তু। পিছলায় যাবেন।’
কাদা থেকে সরে এসে মুক্তিরা একটা শুকনো উঁচু জায়গায় দাঁড়ায়। এটা রেলস্টেশনের মুখোমুখি পতিতাপল্লি ঢোকার মূল গেট। পনেরো-বিশ জন মেয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খদ্দেররা ঢুকছে-বেরোচ্ছে। পতিতা আর খদ্দেরে যে কথা কাটাকাটি আর হাতাহাতি চলছে, দাঁত বের করে তা-ই দেখছে রাস্তার লোকজন। ক্যাসেট প্লেয়ারে উচ্চগ্রামে বাজছে মাইজভান্ডারির গান-দেখে যারে মাইজভান্ডারি, দেখে যারে মাইজভান্ডারি, হইতেছে রঙের খেলা, নূরে মাওলা বসাইছে প্রেমের মেলা, খাজা বাবা বসাইছে প্রেমের মেলা। এনজিও কর্মীর অ্যাপ্রনের হাতাটা চেপে ধরে মুক্তি শুধায়, ‘রাধারানীর কেইসটা কী–খুলে বলেন তো!’ ঠিক তখনই গলির মুখে উদয় হয় রাধারানী। ‘এ দি ভূতের লাহান, পাছ ছাড়ে না!’ বলেই কাদার ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে যায়।
‘হলো তো?’
এনজিও কর্মী তো অবাক, ‘কী অইলো?’ সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির জবাব ‘অপমান করে বেরিয়ে গেল!’
মুক্তির রাগ দেখে এনজিও মাঠকর্মী হেসে কুটি কুটি, ‘এত সোজা অদের ধরা! অ মাগো, মদ খাইয়্যা হে যহন গালিগালাজ শুরু করবে, তহন বুঝবেন কত ধানে কত চাউল। আপনে আবার আছাড় খাইয়্যা প্যাকে পইড়েন না য্যান।’
বর্ষাকাল। বলা নেই কওয়া নেই আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি। মুক্তিরা যার চালাঘরে দৌড়ে ঢোকে, সে নাকি রাধারানীর বোন। বলে, পাতানো বোন। নাম কুসুমকলি। রাধারানীর কাহিনি বলার জন্য কুসুমকলি প্রকৃতপক্ষে মুখিয়ে ছিল। ‘আমার বইনের মতো বেরেইন দুলুদিয়ায় কারো নাই, এমন শিক্ষিত-কথায় কথায় খালি ইংরাজি কয়!’ কুসুমকলির আফসোস, ‘মদ খায় বিধায় ঘরের ছেলেরা তারে ছাইড়া চইল্যা গেছে। এককালে ওর অনেক নামডাক ছিল। ও একটা বাড়িঅলি ছিল। টাকা কামাইছে হিউজ। মদ খাইয়্যা সব উড়াই দিছে। ভাড়াইট্টা টেনেসফার করে রাধারানীর এখন দিন চলে।’
‘ভাড়াইট্টা ট্রান্সফারের ব্যাপারটা কী?’
‘যেমন ধরেন, কারো টাকার সমস্যা থাকলে বাড়িঅলি উঠায় দেয়। হয়তো এরা লোক পায় কম। হয়তো সাজগোজের জিনিস কিনতে পারে না। বাড়িভাড়া দেয় না সময়মতন। তহন একটা গন্ডগোল বাধল…’ কুসুমকলির কথার মাঝখানে তার পালক মেয়ে আনারকলি ফোড়ন কাটে, ‘রাধারানী তখন হুগুনির লাহান হামলাই পড়ল।’
কুসুমকলি মনে মনে রাগ করলেও মেয়েকে কিছু বলে না। কারণ সে তার কামাই খায়। এখন ঠাকঠমক যা, সব পালক মেয়ের পয়সায়। মেয়েটা ব্যবসায় নেমেছে নতুন। উঠতি বয়স। পদ্মপাতায় মতো টলটলে মুখ। গলির মুখে না দাঁড়ালেও খদ্দের জোটে। তাই দেমাক বড়। বিগত যৌবনাদের প্রতি মায়াদয়া নেই। তার ঘরের চালের। নায়ক-নায়িকার পোস্টারগুলো কুসুমকলি মই বেয়ে উঠে, নিজহাতে সেঁটে দিয়েছে। তার দুঃখ, আনারকলির পছন্দ নয় রাধারানীকে। মুখের ওপর বলে কিলিকবাজ।
‘রাধারানী আসলে,’ কুসুমকলি ধীরে ধীরে কথা ভাঙে, ‘সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে এক বাড়ির ভাড়াইটা পটাইয়ে পটাইয়ে আরেক বাড়ি দিয়ে আসে। তাতে পাঁচ শ টাকা পায়। ব্যস্–মদ-ভাঙ খাইয়া পাঁচ শ টাকাই এক দিনে শ্যাষ।’
রাধারানীর সাত বছরের মেয়েটা এই জন সেই জনের দয়ায় বেঁচে আছে। কুসুমকলি পালক নিতে চাইলে রাধারানী বলে, ‘এরে আমি লেখাপড়া শিখাব। রান্ডি হতে দেব না।’
যে রাতদিন মদ-গাঁজার ওপর থাকে, মেয়ের দেখাশোনা করার সময় পায় না, সে শেখাবে মেয়েকে লেখাপড়া?
‘তুই এত মদ খাস ক্যান’–আমি জিগাইছি, কুসুমকলি বলে তয় ও কয়। আমি মদ খাব না, আমার জীবনে তো কিছু নাই, রাধারানী যখন ছোট ছিল, তারে মেলেটারি উঠায় নিয়া যায়। ক্যাম্পে রাখে কয় মাস, তারপর ছাইড়ে দেয়।
: কী মদ খায় রাধারানী?
: সোনাগাছি থাকতে খাইত শুনছি ডবল টাইগার, রাম, জিন। দুলুদিয়া ঘাটে আইসা তো বাংলা মদই খাইতাছে।
: মদের দাম কত?
: এক লিটার দুই শ।
: দুই শ! সোনাগাছি সে কবে গেছিল?
: এইডা বাহাত্তুরে। তারপর সেখান থেইকে এক দালালে নিয়া আসে। তুমি একটা ভালো বংশের মেয়ে, তোমায় বিয়েটিয়ে দিয়ে দিব। আইস্যা ফরিদপুর বেইচ্যে থুয়ে গেল, ফরিদপুর থে আসলো এই জাগায়।
: তারপর?
: তারপর আর কী।
: এত যে মদ খায় বলছেন, ওনার কোনো অসুখ-বিসুখের ঝামেলা নাই?
: ওর কোনো ব্যাধি নাই। লবণ দে ডিরিং করে। দশ দিন যদি আপনি লবণ দিয়া ডিরিং করেন, আপনার লিভার পচে বাইর হয়ে যাবে। রাধারানী হাত দেখে না, তয় কার কী ভবিষ্যৎ সঠিক বুইলে দিতে পারে। নিজের পরমায়ু হেইদিন কইলো, একশ বছর। আপনেগর শুভ কামনায়, মেদেনিপুরের হুজুরের দোয়ায়, বড় পিরের আশীর্বাদে রাধারানী একপ্রকার ভালো আছে।
মুক্তি এনজিওকর্মীর সঙ্গে কুসুমকলির ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসে, তখন বিকাল হয়ে গেছে। আকাশ ঝলমলে পরিষ্কার। পদ্মার ওপর সাদা সাদা মেঘ ডানা মেলে দিয়েছে। ‘ইশ্ আপনের কাপুড়চুপুড় এক্কেরে কাদায় মাখামাখি,’ এনজিওকর্মী চিন্তিত। ‘এই পইরা ঢাকা যাইবেন?’ মুক্তি অপাঙ্গে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। রাধারানীর সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো হতো। কোনো কথাই হলো না–এটা কেমন। অন্যের কথা দিয়ে কি গবেষণার কাজ চলে? ‘আপনে মনে করেন কুসুমকলি সত্য কথা কইছে?’ এনজিওকর্মী ভিড়ভাট্টা ঠেলে মুক্তিকে বেশ্যাপল্লির বাইরে আনতে আনতে বলে, ‘আমি কিন্তু অদের কানাকড়ি বিশ্বাস করি না।’
যে বেশ্যাদের কনডম জোগায়, এর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে, সে কি জানে খদ্দেররা কনডম ব্যবহার করে কি না? বেশ্যারা দিনের বেলায় দুয়ার খোলা রেখেও খদ্দের। বসায়। ইচ্ছা থাকলে খদ্দেরের পরনে কনডম আছে কি নেই–দেখতে বাধা নেই। তা তো তারা করে না। একটা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভর করে বছরের পর বছর বেশ্যাদের কনডম বিলিয়ে যাচ্ছে, রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছে, কেসহিস্ট্রি নিচ্ছে। অথবা বিশ্বাস না করেই এসব করে যাচ্ছে। মুক্তি তাদের বিশ্বাস করবে কি করবে না? রাধারানী যে বীরাঙ্গনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অচিরেই তার একটা সাক্ষাৎকার নিতে আসবে সে।
সেই যাওয়া সম্ভব হয় আরো দুই বছর পর। দৌলতদিয়া থেকে ফিরে মুক্তি যায় মহিলা অধিদপ্তরে বেবির কাছে। ফলত পদ্মার ওপারে বঁড়শি ফেলে সে নিজে ধরা পড়ে। আরেক বিস্তৃত জালে। জায়গাটা ঢাকার পশ্চিম প্রান্তের গিঞ্জি এলাকা রায়েরবাজার। বাঁশঝাড় দূরে থাক, ততদিনে হাস্নাহেনার চিহ্নমাত্রও নেই, এমন একটা বাড়ি। তবে বাড়ির নেমপ্লেট তখনো ঠিক ছিল। আর লোহার ভারী পাল্লাটাও আলিবাবার চিচিং ফাঁক বলার মতো একবারেই খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে মুক্তির হয় সাত চোরের দশা। সেখান থেকে জাল গুটিয়ে বেরোতে বেরোতে পাক্কা দুই বছর। কারণ রায়েরবাজারের। বাড়িটার প্রায় তিন যুগের বাসিন্দা, সেখানে যে কিশোরী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছে, সে গত এক বছর ধরে মুক্তির অপেক্ষায় ছিল।