1 of 3

২৬. মেঘ দেখলে আনন্দ হয়

২৬

মেঘ দেখলে আজও তার একইরকম আনন্দ হয়, ছেলেবেলায় যেমন হত। বৃষ্টি তাকে এখনও সম্মোহিত করে। এ বছর তার সাধ মেটাতে বৃষ্টিও হচ্ছে বটে। একদিন দুদিন শুকনো যায় তো চারদিন ধরে নেমে থাকে।

আজ এক বৃষ্টি-ঝমাঝম দিন। মেঘলা আকাশ চারদিকে আঁধার ছড়িয়ে দিচ্ছে আজ সকালে। ছেদহীন বৃষ্টি নেমে আছে শেষরাত থেকে। ঝাঁঝালো বৃষ্টির ভিতর দিয়ে চলেছে রেলগাড়ি। দরজা খোলা, জানালার পাল্লা নেই। হুহু করে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কামরার ভিতরটা। কোনওরকমে একটা খাঁজের আড়ালে বেঞ্চে বসে আছে সে। বেঞ্চের কাঠ চুরি হয়ে যাওয়ায় বসাটাও ভীষণ কষ্টকর হচ্ছে। বেঞ্চের লোহার কাঠামোর ওপর কোনওক্রমে শরীরের ভারখানি রাখা। জলকণায় সে ভিজছেও। কিন্তু কোনও বিরক্তি বা রাগ নেই তার। বৃষ্টি-মুগ্ধ দু’খানি চোখ পেতে সে দেখছে মাঠঘাট, দরিদ্র শহরতলি, দোকানপাট, ছোট্ট স্টেশন। কয়েকটা ভেজা চড়াই বসে আছে ওপরের মাল রাখার র‍্যাকে। বিনা টিকিটে রেলগাড়ি চেপে তারা কোথায় যাচ্ছে তা তারাও জানে না। পাখির তো দেশ নেই। তবে বাসা আছে, বাসায় আছে ডিম, আছে ওম, ওরা সেই টানে ঠিক ফিরে যাবে যথাস্থানে।

এবার কি বন্যা হবে? যা বৃষ্টি! হতেও পারে। খবরের কাগজে আসাম আর বিহারের বন্যার খবর দিচ্ছে। বছরওয়ারি ঘটনা। এ দেশে নদীর কোনও সংস্কার নেই। সে সারা দেশ ঘুরে দেখে, অধিকাংশ নদীই শুখার মরসুমে খাঁ খাঁ করে শুকনো বালিয়াড়ি বুকে নিয়ে। কোথাও তিরতির করে একপাশ দিয়ে নর্দমার মতো একটি ধারা প্রবহমান থাকে, কোথাও তাও থাকে না। তখন চাষ মার খায়, নদীর নাব্যতা বলে কিছু থাকে না। অগভীর খাতে যখন বর্ষার ঢল নামে তখন দুকূল ছাপিয়ে গ্রামের পর গ্রাম আর শহর ভেসে যায়। কেন প্রতি বছরই হবে খরা বা বন্যা? নদী সংস্কার করা হলে, জায়গামতো পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে জল সঞ্চয় করলে, নিয়মিত ড্রেজিং করা হলে, নিকাশী খাল কাটা হলে কত অনায়াসে কাজে লাগানো যেত জলের মতো মহার্য সম্পদ। এখনও এ দেশের কত ঊষর ভূমি তেষ্টা নিয়ে চেয়ে আছে বুদ্ধিমান মানুষের দিকে। অথচ ধী-সম্পন্ন মানুষ কেন কিছুই করছে না? তার ধী খেয়ে নিল কে? পলিটিকস? না কি স্বার্থ? না কি আলস্য ও দূরদর্শিতার আদ্যন্ত অভাব? অস্ট্রেলিয়ায় নদীর সংখ্যা কত কম, সেখানে চাষীদের জল পয়সা দিয়ে কিনতে হয় তবু কখনও জলের অভাবে চাষ মার খায় না। এক ফোঁটা জলের কোনও অপচয় করে না ওরা। ভারতবাসী যেন জানেই না নদীকে কিরকমভাবে ব্যবহার করতে হয়। এরা যেন বুড়ো বয়সেও হামা-টানা শিশুর মতো অবোধ। এবং নির্বোধ। গোটা ভারতবর্ষকে জলপথে নানাভাবে জাল বদ্ধ করার একটি প্ল্যান সে কর্তাব্যক্তিদের কাছে পেশ করেছিল। সেই প্ল্যান কার্যকর হলে, শুধু কৃষি নয়, পরিবহন ব্যবস্থাতেও একটা প্রভূত ওলটপালট ঘটতে পারত। এদেশে গরুর গাড়ি, জেট প্লেন, ভাঙা স্লেট, কম্পিউটার, বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের এক অসাধারণ সহাবস্থান। জলপথ থাকলে দিশি নৌকো ডিজেল ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাল পরিবহন করতে পারত। কর্তাব্যক্তিরা সবিনয়ে বলেছেন, প্ল্যান তো ভাল, কিন্তু আমাদের অত টাকা কোথায়? সে নিজের ভিতরে ভিতরে অসহায় রাগে মাথা কুটে মরে। এ সব নির্বোধরা কি জানে না, বৃক্ষপতনের ফলে ন্যাড়া প্রকৃতি একদিন আর বাদলমেঘ আকর্ষণ করতে পারবে না? খরার পর খরা আর অজন্মায় শুকোবে মাটি? বাড়বে সামুদ্রিক নোনা জলের স্তর এবং তা গ্রাস করবে নিচু সব ভূখণ্ড? আগামী শতাব্দীর মাঝামাঝি মানুষের অস্তিত্বে যে নাভিশ্বাস উঠবে সে তার শব্দটা অবধি আগাম শুনতে পায়। এরা কেন পায় না? খুব কি সময় আছে আর? মানুষের সর্বনাশের আগাম লক্ষণগুলি কি ধরা পড়ছে না এদের বোধবুদ্ধিতে?

একটা গল্পে সে পড়েছিল, পিঁপড়েদের চলন দেখে একটি গাঁয়ের লোক অনুমান করেছিল, বন্যা আসছে। বন্যা সত্যিই এসেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশে গাঁয়ের লোকেরা হাওয়ার চলন দেখে সঠিক নির্ধারণ করতে পারে, প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঝড় আসছে। চীনের প্রাকৃত মানুষেরা বন্য প্রাণীর হাবভাব দেখে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নির্ধারণ করতে পারে। অশিক্ষিত, প্রকৃতি-লালিত মানুষেরা অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির কথা জানে না বটে, কিন্তু তাদের জন্যও আছে এইসব প্রাকৃত বিজ্ঞান। মাঝে মাঝে যা যন্ত্রপাতিকেও হার মানায়। তার ইচ্ছে ছিল, সারা পৃথিবী ঘুরে আদিবাসী, উপজাতি, যাযাবরদের কাছ থেকে এই অতি সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ডিডাকশনের কৌশল শিখে নিয়ে তাকে আরও পরিশীলিত করে কাজে লাগাতে। পৃথিবীর জন্য কত কিছু করার ছিল তার, কত কী করতে সে আজও চায়! কিন্তু আজকাল তার কেবলই মনে হয় নানা আইন-কানুন, অবহেলা, ঔদাসীন্য, স্বার্থ আর রাজনীতি যেন তাকে হাত-পা বেঁধে একটা বাক্সে বন্দী করে ফেলেছে। তাকে কিছুই করতে দিচ্ছে না কেউ।

গাড়িতে লোকজন নেই বললেই চলে। একে ছুটির দিন, তাতে বৃষ্টি, কোনও স্টেশনে একটা দুটো লোক উঠছে, নেমে যাচ্ছে। ঠায় একা সে-ই বসে আছে ট্রেনে। তার যেন কোথাও যাওয়ার নেই, কোনও স্টেশনেই নামবার নেই। আজ বৃষ্টিভেজা দিনে ভাঙাচোরা ট্রেনের কামরায় সে একেবারে সম্পর্কহীন একা। বড় আনমনা। বাইরের আবছা দিগন্তের দিকে চেয়ে সে পৃথিবীর সঙ্গে তার ও মানুষের সম্পর্কের বুনটটা অবিষ্কারের চেষ্টা করছে। পারছে না। তার কেবলই মনে হয়, এতকাল পৃথিবীতে বাস করেও, পৃথিবীর সব ধনসম্পদ লুটপাট তছনছ করেও মানুষ—বোকা মানুষ ধরতেই পারেনি, এই পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী। পৃথিবীর ভূখণ্ডকে সে স্বার্থপরের মতো ভাগজোখ করে নিয়েছে, সে তৈরি করছে নানা জটিলতার বেড়াজাল, সংকীর্ণ দেশাত্মবোধ। মানুষ কি কখনও দেখে না, পাখি যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যায় তখন তার পাসপোর্ট লাগে না, ভিসা লাগে না, কাস্টমস ডিঙোতে হয় না? পৃথিবীকে ভাগজোখ করার সে কে? সে কেন দেশ ভাগ করে নিজের ভিতরে সৃষ্টি করে আঁটন বাঁধন? সে কেন গোটা এই গ্রহটির কথা ভাবে না! কালো মহাশূন্যে সবুজাভ নীল প্রাণময় এই তুলনাহীন পৃথিবীকে সে কেন গোটাগুটি নিজের বলে ভাবতে পারে না? এ যেন পৃথিবীকে শরিকানায় ভাগ করে নিজের নিজের কোর্ট আঁকড়ে থাকা। আর এই শরিকানার কাজিয়ায় চলে যাচ্ছে মানুষের আয়ু ও শ্রম, এই কাজিয়ায় আহুতি হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মহার্ঘ জলবায়ু, তার যতেক সম্পদ। তার খুব ইচ্ছে করে ভিখিরির মতো দেশে দেশে ঘুরে মানুষকে এইসব কথা বোঝাতে। সবাই এক হয়ে এই পৃথিবীর কথা ভাবো, পৃথিবী ছোট একটি গ্রহ, তার অফুরন্ত সম্পদ নেই। যা আছে, যেটুকু আছে তাকে যত্ন করে সঞ্চিত রাখো। মেক্সিকোয় ভূমিকম্প হলে উদাসীন থেকো না চীন, ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ হলে তার ক্ষুধা যেন স্পর্শ করে সুইডেনকেও, আফ্রিকায় মহামারী হলে তা যেন উদ্বিগ্ন করে আমেরিকাকেও।

সে ভারতবর্ষের এক সরল, গরিব, উদ্বিগ্ন মানুষ। সে একজন গ্রামবাসী হিসেবেই যাবে। রাষ্ট্রনায়কদের কাছে। বলবে আমি রাজনীতি জানি না, আমি জানি না অর্থনীতির কূট তত্ত্ব, আমি শুধু চাই পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে তার হৃৎপিন্ডের যে স্পন্দনটুকু আজও ধুকপুক করছে তা অব্যাহত হোক। মানুষ তাকে বোকা বলবে, দুয়ো দেবে, প্রত্যাখ্যান করবে। করুক। সেই অপমান তার গায়ে লাগবে না।

একসময় বহুদিন ধরে যাতায়াত করেছে বলে স্টেশনটা ভুল হল না তার। ভুল হওয়ারই কথা ছিল। প্রবল বৃষ্টিতে বাইরেটা বড়ই আবছা এবং সে ছিল গভীরভাবে অন্যমনস্ক। তবু স্টেশনের বেড়ার গায়ে মস্ত কাঠচাঁপা গাছটাই বোধ হয় চেনা দিল তাকে। যেন বলে উঠল এই যে অনেকদিন বাদে! এসো এসো। সে উঠল স্বপ্নোত্থিতের মতো, বাঙ্ক থেকে নাইলনের ব্যাগটা নামিয়ে ছাতা খুলে প্ল্যাটফর্মে পা দিল। বৃষ্টির ঝরোখা ঘিরে ফেলল তাকে।

তখন ছাতা জুটত না। কচুপাতা বা টোকা আটকাতে পারত না বৃষ্টিকে। ভেজা গায়ে ট্রেনে উঠে কলকাতায় যেত সে। সারা দিন ভেজা জামা প্যান্ট গায়েই শুকোত। সর্দি লাগত না। গরিবের শরীর সব সয়ে নিত। এক জোড়া রবারের সস্তা জুতো থাকত তার। শীত গ্রীষ্মে পরত। ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে নিত, সোল ক্ষয় হয়ে গেলে ভিতরে ভরে নিত পিচবোর্ড, যতদিন পারত সেই জুতোতেই চালিয়ে নিত। নিতান্ত অকেজো হয়ে গেলে, আর এক জোড়া কিনতে যে সময় লাগত, বাড়তি টাকা জোগাড়ের জন্য তখন খালি পায়ে হাঁটতে হত মাইলের পর মাইল। তবু সেই সব দিনের স্মৃতি কেন কেবলই আনন্দের শিহরণ বয়ে আনে আজও।

স্টেশনে পা দিয়ে ঠিক সেইরকমই মনে হল তার। সব পুরনো দিন ফিরে এল বুঝি!

স্টেশনে লোকজন নেই বললেই হয়। স্টেশনের শেড-এর তলায় সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। তাড়াহুড়ো নেই। সে কিছুক্ষণ শিউরানো রোমকূপ নিয়ে অনুভব করল তার হারিয়ে যাওয়া নিজেকে। শৈশবের সে এসে কি অলক্ষে হাত ধরেছে আজকের তার?

তাড়া নেই। কিছুমাত্র তাড়া নেই। খুব ধীরে ধীরে চুমুকে চুমুকে চা খাওয়ার মতো সে তার চারদিককার সব কিছুকে গ্রহণ করছে ভিতরে। উপভোগ করছে। ধীর পায়ে সে বেরিয়ে এল স্টেশনের বাইরে, যেখানে দোকানপাট, রিক্সা-ভ্যান গাড়ি, বাসের আড্ডা। আজ বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা। আজকাল শীতলাতলা বিষ্ণুপুরের বাস হয়েছে। এক টানে নিয়ে যায়।

একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল সে, শীতলাতলা বিষ্টুপুরের বাস কোথা থেকে ছাড়ে?

এই চৌপথী থেকেই ছাড়ে। আজ কি আর বাস পাবেন। সকালের দিকে দু’খানা গেছে। ফেরেনি এখনও।

বাসের অনিশ্চয়তায় সে একটুও ঘাবড়ে গেল না। মনে হল এটাই যেন ঈশ্বরের অভিপ্রেত, সে বরাবর হেঁটে স্টেশনে এসেছে গেছে। আজও তাই যাবে।

স্টেশনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যখন নির্জন ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়ল তখন নিবিড় ঝিমঝিম, অনুত্তেজক বৃষ্টি ঘিরে ধরল তাকে। ঘিরে ধরল ভেজা মাটির গন্ধ। ঘিরে ধরল গাছপালা। এরা কি জানে যে, সে এদের বন্ধু? সে পৃথিবীর প্রতিটি বৃক্ষের বন্ধু, কীটপতঙ্গের বন্ধু, তৃণভূমি, নদী, পশুপাখি সকলের বন্ধু সে। কিন্তু এরা কি টের পায় তা?

কবে পিচ হয়েছিল, তারপর গরুর গাড়ি, ট্রাক আর বাসের ধাক্কায় কবে উড়ে গেছে রাস্তার মসৃণতা। মাঝে মাঝে ডোবার মতো বড় বড় গর্ত। জলে ভরভরন্ত। সে জল বাঁচিয়ে চলার চেষ্টাই করল না। ছেলেবেলার মতো জল ভেঙে, খানাখন্দ ভেঙে, কাদা ঘেঁটে হাঁটতে লাগল। একদিন সে শহরের বাস ঘুচিয়ে চলে আসবে গাঁয়ে। মাটি মাখবে, ভাব করবে পৃথিবীর সঙ্গে।

আলপথ ধরে গেলে রাস্তা অনেক কম হত। কিন্তু সে দেখল, ক্ষেতগুলো জলে ডুবে আছে। পিছল আল ধরে যাওয়া ঠিক হবে না। ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তর গাঁয়ের মধ্যে চলে যেতে যেতে তার দু’খানা চোখ রূপমুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে যেতে লাগল। ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের চমৎকার পরিচ্ছন্ন কান্ট্রিসাইড এ নয়। তবু এই দীনদরিদ্র, শতাব্দীকাল পিছিয়ে থাকা পল্লী বাংলার সঙ্গে তার এখনও নাড়ীর টান।

সে যখন গাঁয়ের কাছাকাছি হচ্ছিল, যখন দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সুপুরি আর নারকেল গাছের জড়ামরি তখন শীতলাতলা বিষ্ণুপুরে বটতলার অনতিদূরে ঘোষপাড়ার নাবালের ধারে বহু মানুষ বৃষ্টির মধ্যেও জমা হয়েছে। নাবালে অনেক জল। তার মধ্যে উল্টো হয়ে অর্ধেক অন্তর্জলিতে পড়ে আছে একটা লাশ। মুণ্ডু সমেত মাজা অবধি ডুবে আছে জলে। পায়ের চটি আর কালো প্যান্টওলা দুখানা পা ছড়িয়ে আছে কাদামাখা ডাঙায়। গায়ের সবুজ জামাটা বাতাসে একটু ফুলে বেলুনের মতো ভেসে আছে জলের ওপর।

যারা দেখছিল তাদের কারও মুখে কথা নেই। তারা হয়তো কেউ জানে, কেউ হয়তো জানে না, কেউ জেনেও জানে না, এরা ভয় পেয়েছে। অস্তিত্বের ভয়ংকর অনিশ্চয়তার একটি দৃশ্য তাদের চোখের সামনে। কত আদরের শরীর, কত তাচ্ছিল্য ও অবহেলায় জলকাদায় পড়ে আছে মরা কুকুর-বেড়ালের মতো। এদের অনেকের আজ দুপুরের ভাত মুখে রুচবে না, রাতে ঘুম হবে না ভাল করে। এরা অনেকেই এখন কিছু দিন খুব ভয়ে ভয়ে থাকবে। চমকে উঠবে বাতাসের শব্দে। টিনের চালে বেড়াল লাফ দিলেও কেঁপে উঠবে ভয়ে।

একটু-আধটু ফিসফাস চলছে। কেউ কেউ বলছে খুন-হওয়া লোকটা রামজীবন বা ন’পাড়ার দুলু মণ্ডল। কেউ একজন বলল, মনে হচ্ছে গদাই।

গণার সাইকেলের দোকানের বাচ্চা ছেলে কালু অবশ্য জানে। কিন্তু মরে গেলেও সে মুখ খুলবে না। শেষ রাতে সে পেচ্ছাপ করতে উঠেছিল। ঝাঁপ খুলে বেরিয়েই সে বটতলায় একটা চেঁচানি শুনতে পায়, বাবা রে : তারপর কে একটা খিস্তি দিয়ে বলে উঠল, চোপ শুয়োরের বাচ্চা, মুখে ইয়ে ভরে দেবো…

কালুর পেচ্ছাপ পেটের মধ্যেই শুকিয়ে গেল ভয়ে, সে টপ করে দোকানে ঢুকে ঝাঁপ টেনে ফুটোয় চোখ রাখল। সাত আটজন লোকে একজনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে বড় বড় ল্যাজা, গজা, ভোজালি। এত জোরে লাথি মারছে, চাঁটি মারছে যে পটকা ফাটার মতো আওয়াজ হচ্ছে। লোকটা চেঁচাতে পারছে না, তার মুখে একটা নোংরা কাপড় গোঁজা। এত কিছু অন্ধকারে থেকেও দেখা যাচ্ছিল, বাদুর দোকানের হ্যাজাকবাতির আলোয়। বাদু ভোরবেলা গরু দুইতে ওঠে।

কালু লোকটাকে দেখেছে। তাকে সে চেনেও। যারা নিয়ে যাচ্ছিল তাদেরও। কিন্তু কালু জানে, তাকে এখানে বাস করতে হলে মুখে কোনও নাম উচ্চারণ করা চলবে না।

ঘোষপাড়ার নাবালে কি হল তা কালু আর জানে না। সে ভয়ে আর বেরোয়নি। ঘুমোতেও পারেনি। সকালে বেরিয়ে সে লাশটার কথা শুনল। কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে। দেখতে গেল না। সকাল থেকে সে মন দিয়ে সাইকেল মেরামতির কাজ করে যাচ্ছে।

যখন চা আর পাঁউরুটি খাচ্ছিল বাদুর দোকানের বেঞ্চে বসে তখন নাটা এসে কাছে দাঁড়াল। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেয়েছিল কালুর। পাঁউরুটির ডেলা আটকে গেল গলায়। বিষম খেল।

নাটা চাপা গলায় বলল, ঝাঁপ খুলে বেরিয়েছিলি কেন? মজা দেখতে?

কালু মাথা নেড়ে বলে, না তো! আমার পেচ্ছাপ পেয়েছিল, তাই।

মুখ দিয়ে যদি একটা কথাও বেরোয় তাহলে ফিনিস হয়ে যাবি।

কালু কথা কইতে পারেনি। শুধু মাথা নেড়ে বলেছিল, কিছু দেখিনি।

সাত আটজন খুনিয়ার মধ্যে নাটা ছিল। সবচেয়ে বেশীই ছিল। তার হাতে ছিল চকচকে মস্ত একটা ভোজালি। কালু সিঁটিয়ে আছে ভয়ে।

কাল রাত থেকে রামজীবন বাড়ি ফেরেনি। সকালে উঠে পটল শুনতে পেল, তার মা কান্নাকাটি করছে রান্নাঘরের দরজায় বসে। বারান্দায় দাদু মাথায় হাত দিয়ে বসা। ঠাকুমা ভ্যাবলা মুখে একটা কুলোয় চাল ঝাড়তে বসে থেমে আছে। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে।

রাঙা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ওই বটতলাই ওকে খাবে। সেই কাল দুপুরে ইঁটের ভাঁটিতে যাবে বলে বেরিয়েছিল, সঙ্গে পাঁচশ টাকা। দুপুরে এসে খাওয়ার কথা, বিকেল গেল, রাত গেল, এখনও কোনও খোঁজ নেই!

বামাচরণ গামছা পরে নির্বিকারভাবে কাঠকয়লার গুঁড়ো আর নস্যি মেশানো মাজনে দাঁত মাজতে মাজতে ঘর থেকে বেরিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি শুনল, তারপর ঘটি হাতে পুকুরের দিকে চলে গেল বৃষ্টির মধ্যে। যেন সে এ বাড়ির কেউ নয়।

শ্যামলী বেরোলো না, কিন্তু দরজার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তার শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছিল।

দৃশ্যটা, ঘটনাটা ঘুমের মাথায় বুঝতে অনেক সময় লাগল পটলের। তার বাবা ফেরে অনেক রাতে, যখন সে ঘুমিয়ে কাদা। বাবা যে রাতে ফেরেনি এটা তার জানা ছিল না।

সে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, কাঁদছো কেন মা? কী হয়েছে?

সাইকেলটা নিয়ে যা তো বাবা। বটতলায় খুঁজে আয়। আমার বুক কাঁপছে, অম্বলের ব্যথায় মরে যাচ্ছি। একটু আগে বমি হয়েছে এক কাঁড়ি। সারা রাত ঘুম হয়নি তো!

পটল আর একটিও কথা বলেনি। মুখে চোখে একটু জল ছিটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে।

বটতলা অবধি যেতে হয়নি তাকে। তার আগেই মল্লিকদের বাড়ির সামনে একটা জটলা দেখে সে সাইকেল দাঁড় করাল।

দেবদাস মল্লিক জটলার দিকে চেয়ে বলছিল, কে খুন হয়েছে তা আগ বাড়িয়ে কি বলা যায়? পুলিশ আসবে, লাশ তুলবে, তারপর বোঝা যাবে। দিনকাল যা পড়েছে এ সব নিয়ে বেশী কথা না বলাই ভাল। বটতলাটা তো একটা বিভীষিকা হয়ে উঠছে দিনকে দিন।

খুন কথাটা শুনেই পটল পাঁই পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে দিল। নামল এসে বটতলায় গণার সাইকেলের দোকানে। কালু অন্য দিনের চেয়ে বেশী মনোেযোগ দিয়ে একটা টিউবের লিক সারাচ্ছিল।

কালুর সঙ্গে তার খুব ভাব। গণা না থাকলে কালু অনেক সময় বিনা পয়সাতেও তার চাকায় পাম্প দিয়ে দেয়।

এই কালু, কোথায় কে খুন হয়েছে রে?

খুন! বলে কালু আকাশ থেকে পড়ে, জানি না তো!

বটতলায় আজ দোকানপাট খোলেনি তেমন! লোকজন দেখা যাচ্ছে না। থমথমে ভাব।

এই যে শুনলাম কে খুন হয়েছে! আমার বাবা নয় তো!

কালু মাথা নেড়ে বলে, আমি কিছু শুনিনি।

কালু যে মিথ্যে কথা বলছে তা এক লহমায় বুঝে গেল পটল।

লোকজন সব কোন দিকে গেছে জানিস?

আমি কিছু জানি না। কাজ করছি এখন।

বাদুর দোকানে জিজ্ঞেস করতেই চা-ওলা ছেলেটা বলল, ঘোষপাড়ার নাবালে যাও। কেটে ফেলে রেখে গেছে রাতে।

কে খুন হল?

কে জানে!

আমার বাবা নয় তো!

ছেলেটা নির্বিকার মুখে নিষ্ঠুরের মতো বলল, হতে পারে। দেখগে, চিনতে পারো কিনা।

পটলের হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। সাইকেলটা সে কালুর সামনে ফেলে রেখে বলল, এটা রইল। এখন চালাতে পারব না।

দৌড়তে দৌড়তে পটল যখন নাবালের ধারে পৌঁছোললা তখন ভিড়টা বেড়েছে। মেলা লোক, কিন্তু গণ্ডগোল নেই।

জীবনে খুন-হওয়া মানুষ কখনও দেখেনি পটল। মানুষকে যে এভাবে অনাদরে ফেলে রাখা যায়, মারা যায় তা তার কল্পনাতেও ছিল না কখনও। জলে আধ-ডোবা লোকটার নিথর পা দুখানার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল সে। আমার বাবা নয় তো!

হতে পারে তার বাবা-ই ওটা। সবুজ জামা আর কালো প্যান্ট তো বাবার আছে।

কাছেই দশরথ সাহা দাঁড়িয়ে। সে মুখ তুলে লম্বা লোকটার দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, দশরথ জ্যাঠা, এ আমার বাবা নয় তো!

দশরথ সাহা তার দিকে চেয়ে একটু যেন চমকে উঠল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কেন, তোর বাবা বাড়ি নেই?

না । কাল দুপুর থেকে আর ফেরেনি।

দশরথ সাহা কেমনধারা মুখ করে বলে, যা বাড়ি যা। পুলিশ এসে লাশ না তুললে কিছু বলা যাচ্ছে না। গিয়ে বামাচরণকে পাঠিয়ে দে।

সে আসবে না। কী হয়েছে বলুন না!

কে কি বলবে বাবা? দেখছিস তো কাণ্ডখানা! লোকে নানা কথা বলাবলি করছে। তুই আর থাকিস না এখানে।

কেন জ্যাঠা? আমি থাকলে কী হবে?

কী যে হবে তা দশরথও জানে না। দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, বাড়ির বড় কাউকে পাঠিয়ে দি গে যা।

পটল কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাদের যে আর কেউ নেই। দাদু বুড়ো মানুষ, বসা মানুষ, দাদু কি আসতে পারবে এত দূরে?

পটল হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ছুটতে লাগল বটতলার দিকে। জ্যাঠা এখনও বোধ হয় বেরোয়নি। সে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে ঠিক নিয়ে আসবে।

সাইকেলের দোকানের কাছাকাছি আসতেই সে একজন নতুন মানুষকে দেখতে পেল। জলকাদা মাখা মানুষ, কিন্তু এ গাঁয়ের হেটো মানুষ নয়। লম্বা চওড়া চেহারা, বাবু মানুষ। মুখটা পটলের বড্ড চেনা।

কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভাববার সময় ছিল না তার। সাইকেলটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, এমন সময় লোকটা ডাকল তাকে, এই, তুই পটল না?

উদ্‌ভ্রান্ত চোখে পটল লোকটার দিকে চাইল। চিনতে পারল। তারপর হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরল সে, বড়জ্যাঠা, আমার বাবা খুন হয়ে গেছে।

কৃষ্ণজীবন ভীষণ অবাক হয়ে বলল, খুন হয়ে গেছে! বলিস কী?

ঘোষপাড়ার নাবালে পড়ে আছে বাবা।

কৃষ্ণজীবন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরকম করিস না। আয় তো, দেখে আসি।

পটল অঝোরে কাঁদছে। নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে তার। পৃথিবীতে এখন বড়জ্যাঠার চেয়ে বড় সম্বল আর সহায় তার কেউ নেই যেন, এমনভাবে আঁকড়ে ধরল সে কৃষ্ণজীবনকে।

নাবালের ভিড়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণজীবন লাশটাকে দেখল। তারপর পটলের দিকে চেয়ে বলল, কে বলেছে যে ও তোর বাবা?

সবাই জানে।

কৃষ্ণজীবন পটলকে শক্ত করে ধরে বলল, রামজীবনের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে মস্ত কাটা দাগ আছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মহাদেব ঘোষের বাড়িতে পেয়ারা চুরি করতে গিয়েছিল রামজীবন। মহাদেব ঘোষ একটা দা ছুঁড়ে মেরেছিল। দাগটা এখনও আছে। আরও বেশি করে আছে। এ লোকটির বাঁ পায়ের গোড়ালিতে কোনও দাগ নেই।

পটল হাঁ করে কিছুক্ষণ জ্যাঠার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, এ আমার বাবা নয়?

কখনোই নয়। চল, বাড়ি চল।

পটলের মনে হল, বড়জ্যাঠা যেন মানুষ নয়। যেন দেবদূত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *