২৬. মা

২৬
আজ ইলেকশন ৷ কিশোর জায়েদ বোঝে না, ইলেকশন কী ? তবে তার মধ্যে তীব্র কৌতূহল ৷ সে ইলেকশন দেখতে যাবে ৷ চারদিকে নৌকা মার্কার জয়জয়কার ৷ এবার নাকি নৌকার জয় হবে ৷ নৌকা ছাড়া মার্কা আছে হারিকেন ৷ এই কদিন শহরটা ইলেকশন ইলেকশন করে পাগল হয়ে গেছে ৷ মাঝে মধ্যেই মিছিল বের হয়, মার্কাটা কী ? নৌকা ৷ জাগো জাগো, বাঙালি জাগো ৷ তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ৷ সেসব মিছিলে যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা ছিল, একদিকে আম্মা, আরেক দিকে দাদা, এদের কঠোর শাসনে সেই খায়েশটা তার পূরণ হয়নি ৷ এদিকে টেলিভিশনেও ভালো অনুষ্ঠান কম ৷ কয়েক দিন প্রচার হলো শুধু ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের খবর ৷ কী বড় জলোচ্ছ্বাসটাই না হয়ে গেছে কদিন আগে ৷ ১০ লাখ লোক নাকি মারা গেছে ৷ যে সে কথা!
জায়েদ বাসায় কিছু না বলে বেরিয়ে যায় নির্বাচন দেখতে ৷ ডিসেম্বর মাস ৷ ১৯৭০ সাল ৷ বাইরে শীত পড়েছে ভেবে জায়েদ একটা সোয়েটার পরে ঘর থেকে বেরয় ৷ কিন্তু বাইরে এসে বোঝে সে একটা ভুল করেছে ৷ রোদ চড়চড় করছে ৷ সোয়েটারটা গায়ে রাখা যায় না ৷ সে সোয়েটার খুলে কাঁধে ঝোলায় ৷ মুশকিলটা হলো, তার শার্টের পকেটটার সেলাই খুলে গেছে ৷ পকেটটা বুকের কাছে ঝুলে আছে ৷ ওপরে সোয়েটার থাকবে ভেবে সে আর শার্টটা পাল্টায়নি ৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সবাই তার ছেঁড়া পকেটটার দিকেই তাকিয়ে আছে ৷ সে গলায় পেঁচানো সোয়েটারের হাতাদুটো পকেটের ওপরে বারবার টেনে আনছে, যাতে এটা দেখা না যায় ৷ আস্তে আস্তে সে চলে আসে মগবাজারের মোড়ে ৷ ভোটটা হচ্ছে কোথায় ? সে দেখতে পায়, রিকশার গায়ে নানা সুন্দর সুন্দর পোস্টার লাগানো ৷ মনে হয় এই রিকশা ভোটের কাজ করছে ৷ সে রিকশাঅলাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভোট হইতাছে কই ?’
‘ওই তো ইশকুলে’-রিকশাওয়ালা দেখিয়ে দেয় ৷
ওরেব্বাস ৷ স্কুলের সামনে ভিড় ৷ আর পোস্টার টাঙিয়ে এলাকাটাকে একেবারে ছেয়ে ফেলেছে দেখা যাচ্ছে ৷ গেটের কাছে লুঙ্গি, খাকি শার্ট আর খাকি জুতা পরা আনসার দেখা যাচ্ছে ৷ লুঙ্গির সঙ্গে জুতা পরায় তাদের দেখা যাচ্ছে হাস্যকর ৷ তাদের হাতে লাঠি ৷ জায়েদ এগোতে থাকে ৷ ভোটকেন্দ্রের চত্বরে দেখা যাচ্ছে সবার বুকে মার্কা-আঁকা ব্যাজ ৷ নৌকা মার্কার ব্যাজটা সুন্দর ৷ কাগজটা ঝকঝক করছে ৷ আর হ্যারিকেন মার্কার ব্যাজটা ম্যাটমেটে ৷ তার খুবই শখ হয় সে একটা নৌকা মার্কার ব্যাজ পরবে ৷ ওই যে আজাদ দাদার বন্ধু ফারুককে দেখা যাচ্ছে ৷ সে তাঁর কাছে যায় ৷ ‘ফারুক ভাই, একটা নৌকা মার্কা ব্যাজ দেন না ?’
ফারুক এদিক-ওদিক তাকায় ৷ ‘ব্যাজ তো আর নাই ৷’
এদিকে জায়েদের এক বন্ধু মিজানকে দেখা যাচ্ছে একটা নৌকা মার্কা আরেকটা হ্যারিকেন মার্কা ব্যাজ পরে আছে ৷
মিজান বলে, ‘কী রে জায়েদ, কী হইছে ?’
জায়েদ বলে, ‘ব্যাজ খুঁজতাছি ৷’
‘লাগাইবি ?’
‘হ ৷’
‘লাগা’-সে একটা হারিকেন মার্কা ব্যাজ এগিয়ে দেয় ৷
জায়েদ উৎসাহ পায় না ৷ সে নৌকা মার্কা ব্যাজ খুঁজছিল ৷
মিজান এসে তার বুকে হারিকেনের ব্যাজ পিন দিয়ে লাগাতে লাগাতে বলে, ‘কিরে, পকেট ছিঁড়ছস কেমনে ?’
জায়েদ বলে, ‘আরে ব্যাটা টাকার ভারে ছিঁইড়া গেছে ৷’
‘হ ৷ কত টাকা ৷ ল ৷ এই ব্যাজ দিয়া তোর দুই কাম হইল ৷ পকেটটাও জোড়া লাগান হইল, ফির ব্যাজও লাগান হইল ৷’
জায়েদ হারিকেন মার্কার ব্যাজ পরে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ৷ তখন চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায় ৷ নৌকা মার্কা জিততে যাচ্ছে ৷ হারিকেন হেরে যাবে একদম নিশ্চিত ৷ সে কেন তাহলে নৌকা মার্কার ব্যাজ পেল না ৷ সে হ্যারিকেনের ব্যাজটা খুলে ফেলে ৷ তারপর আস্তে করে ফেলে দেয় ৷
‘এই জায়েদ, তুই এখানে কী করিস ?’ আজাদ দাদার গলা ৷ সর্বনাশ ৷ সে সভয়ে তাকায় ৷ আজাদ দাদা তাঁর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এদিকটাতেই আসছে ৷ বন্ধুরা গল্পে মশগুল ৷
‘এদিকে আয়’-আজাদ ডাকে ৷
জায়েদ এগিয়ে যায় ৷
‘কখন এসেছিস ?’
‘এই তো, পাঁচ মিনিট হইব ৷’
‘যা, বাড়ি যা ৷’
‘আচ্ছা ৷’
‘এই শোন, শার্ট ছিঁড়েছিস কেমন করে ?’
‘সেলাই খুইলা গেছে ৷’
‘যা, এমনি আসা নিষেধ, তার ওপর আবার ছেঁড়া শার্ট ৷ ভাগ ৷’
জায়েদ তাড়াতাড়ি স্কুল-চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ৷
রাতের বেলা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান মাঝে মধ্যেই বন্ধ করে দেখানো হচ্ছিল ভোটের ফল ৷ আজাদ আর বাশার বসে বসে টিভি দেখছে ৷ মোড়া নিয়ে এক কোণে বসে জায়েদও টিভি দেখে ৷ জায়েদ বুঝতে পারে, তার ধারণাই ঠিক ৷ সব নৌকা মার্কাই জিতে নিচ্ছে ৷ ভাগ্যিস সে তার হারিকেন মার্কার ব্যাজটা ফেলে দিয়েছিল ৷ এর মধ্যে সাফিয়া বেগম আসেন, কিরে, ইলেশকশনের কী খবর ?
আজাদ বলে, ‘ঠিক আছে ৷ একচেটিয়া নৌকা ৷ মা, দুই কাপ চা পাঠাবা ?’
মা হেসে সম্মতি জানান ৷
টিভি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় ৷ রেডিও খোলা থাকে ৷ কিন্তু রেডিওটা আছে আজাদ দাদার কাছে ৷ বাশার ভাইজান আর আজাদ দাদা গল্প করছে আর রেডিও শুনছে ৷ সেখানে গিয়ে রেডিও শোনার আশা বৃথা ৷
জায়েদ এর চেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাকেই শ্রেয় বলে মনে করে ৷
বিছানায় শুয়ে সে শুনতে পায়-বাইরে লোকেরা স্লোগান দিচ্ছে নৌকা নৌকা বলে ৷ মনে হচ্ছে বিজয়-মিছিল ৷ সেই মিছিলের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে দূর রাত্রির গায়ে ৷ আর আস্তে আস্তে ঘুমের অতলে পৌঁছে যায় জায়েদ ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *