অনেকদিন মান্টোর উপন্যাস অনুবাদের কাজ বন্ধ ছিল। তার কারণ, তবসুম এক পরিরানির মা হয়েছে। মাস দুয়েক তাই ওকে বিরক্ত করি নি। মেয়ের নাম দিয়েছে ফলক আরা। ইতিমধ্যে আমিও জীবনের এক অজানা পর্ব পেরিয়ে এসেছি। হঠাৎই আমার মদ্যপান এত বেড়ে গিয়েছিল যে চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। নেশাগ্রস্থ ও উন্মাদদের মধ্যে দিন পনেরো থাকতে থাকতে আমি বুঝতে পারি, এই মানুষগুলোরও সংলাপ আছে, শুধু আমাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিনের মতো নয়। বরং অনেক বেশী স্বপ্ন আর আবোলতাবোল-এ রাঙানো। সেই মানসিক হাসপাতালের জানলায় বসে আকেশের গায়ে টক।-টক গন্ধ আমি টের পেয়েছিলাম। ঠিকানাহীন এক আত্মার নামই উন্মাদনা।
সত্যি বলতে কী, মান্টোর উপন্যাস অনুবাদ করার ব্যাপারে আমি আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছিলাম। তার কারণ, ওই মানসিক হাসপাতালের মানুষগুলো আমাকে টানছিল; বার বার মনে হচ্ছিল, ওদের মধ্যে ফিরে যাই। কেন, কখন, কোথায়, কীভাবে-এসব কোন প্রশ্নই ছিল না সেখানে; শুধু একেকজনের অনর্গল সংলাপের প্রবাহ অথবা নীরবতার দূরপ্রসারিত ছায়া।
একদিন তবসুমকে ফোন করলাম ফলক আরার খবর জানার জন্য।
ছানাটা যে কী হাসতে পারে, ভাবতে পারবেন না। একদিন এসে দেখে যান। এ কেমন তরিবৎ আপনার, শুধু ফোন করে খবর নেন?
-যাব একদিন।
-আর কাজটা, সেটার কী হবে?
-ও, মান্টোর উপন্যাস-
-আপনি তো ভুলেই মেরে দিয়েছেন দেখছি।
-ভুলিনি।
-তা হলে আসুন, কাজটা আবার শুরু হোক।
আমি কোনও কথা বলি না।
-কী হল? কথা বলছেন না কেন, জনাব?
-ভাবছি
-কী?
-এই মান্টোর ভূত আমার ঘাড়ে এসেই কেন চাপল!
তবসুমের হাসি শোনা যায়। -সে তো আপনি নিজে যেচেই ঘাড়ে নিয়েছেন। এবার ঘাড় থেকে নামাতে চাইছেন?
-কেমন হয়, তা হলে?
-না, জনাব। এ কাজটি করবেন না। ফলক আরা-কে নিয়ে থাকতে থাকতেই আমি পুরো উপন্যাসটা পড়ে ফেলেছি। পড়তে পড়তে মান্টোসাবকে কী যে ভালবেসে ফেলেছি! একজন লেখক -কোনও ভান নেই, কায়দা নেই-মির্জা গালিবের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকেই মেলে ধরেছেন। এত সৎ লেখকের প্রতি অবিচার করবেন না। আসুন, আমরা অনুবাদটা শেষ করবই। –
মান্টো সৎ লেখক, বুঝলে কী করে? আমি হেসে বলি।
-বুঝতে পারি। আমি তো লেখক নই, বুঝিয়ে বলতে পারব না আপনাকে। মানুষ যেমন বুঝতে পারে, কোনটা সত্যিকারের প্রেম।
-কীভাবে বোঝ?
-জানি না।
আমি মনে মনে বলি, এই অজ্ঞানতা বাঁচিয়ে রেখো তবসুম। তা হলে তোমার কাছে আরও কিছুদিন গিয়ে বসতে পারব আমি।
-কথা বলছেন না কেন?
কাল যাব?
-আলবৎ। জিজ্ঞেস করতে হয়? একবার ফলক আরা-কে তো দেখবেন।
-হু। যে -উপন্যাসটা লেখা শুরু হয়েছে সবে।
-কোন উপন্যাস?
-ফলক আরা। সে -ও তো একটা উপন্যাস।
-আপনার মাথা ভর্তি শুধু উপন্যাস, তাই না?
-আমার মাথায় শুধু গু-গোবর-জঞ্জাল।
পরদিন তবসুমের বাড়িতে যাই। তার মেয়ে ফলক আরা সত্যিই এক নক্ষত্রের হার; যেন শিল্পী বিজ্জাদের কলম তাকে এঁকে দিয়ে গেছে। মেয়েটির মুখ থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
-কী দেখছেন এত? তবসুম হেসে বলে।
-মীরসাব একটা শের লিখেছিলেন।
-কী?
-আলম-এ হুস্ন হয় আজব আলম।
চাহিয়ে ইশ ইসভী আলম সে।
-আপনি পারেনও বটে। এইটুকু বাচ্চার জন্য মীরসাবের শের?
-রূপ কখন, কোথা থেকে তার ছুরি মারবে, তুমি বুঝতেও পারবে না তবসুম।
-তেমন ছোরার ঘা খেয়েছেন নাকি। এর মধ্যে?
-সব মরচে ধরা ছোরা তবসুম। গলগল করে রক্ত বেরোয় না। ভেতরটা পচিয়ে দেয়।
-আপনি তো দরবারি ডায়লগ বেশ রপ্ত করেছেন দেখছি।
আমি হেসে ফেলি।-এই জন্য তোমাকে ভাল লাগে তবসুম।
-কেন?
-এই জন্য।
-মানে?
-জানি না।
-দাঁড়ান এ বেটিকে কারুর কাছে রেখে আসি।
তবসুম ঘর থেকে চলে যেতেই দেওয়ালে ঝোলানো রাক্ষুসে আয়নাটা আমাকে গিলে ফেলে। আয়নার ভেতরে বহুদূরে আগ্রার চহরবাগ ফুটে ওঠে। ওই তো -ওই তো বেগম ফলক আরার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে আসাদুল্লা। আর এই মধ্য কলকাতার গলিতে তবসুমের বাড়িতে জন্ম নিয়েছে আর এক ফলক আরা। মানুষ ফেরে না, তবু নাম কেমন ফিরে ফিরে আসে। আয়নার ভেতরেই একসময় তবসুমকে দেখতে পেলাম।
-এই আয়নাটায় আপনি কী এত দেখেন, বলুন তো?
-তোমাদের আয়নাটায় কত পথ যে লুকিয়ে আছে।
-পথ?
-বাদ দাও। এবার মান্টোসাবের কথা বলো।
-হু। আবার কাজটা শুরু করুন তো-। বলতে বলতে সে আলমারি খুলে মান্টোর পাণ্ডুলিপি বার করে। তারপর বিছানায় এসে বসে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলে, আজ লিখবেন কি?
-খাতা তো আনিনি।
-ফাঁকি দেবার কত যে ফিকির আপনার।
-পরদিন লিখব। আজ নয় তোমার মুখেই শুনি। এখন লিখতে বড় ক্লান্ত লাগে তবসুম।
-কিন্তু এই অনুবাদটা আপনাকে শেষ করতেই হবে।
-করব, নিশ্চয়ই করব। তুমি পড়ো।
তবসুম পড়তে থাকে, এমন একটা সময়ে মির্জা গালিবকে নিয়ে কিস্সাটা লিখতে শুরু করলাম, যখন আমার দিনগুলো হাতে গোনা যায়। পাকিস্থানে আসার পর একেবারে খতম হয়ে গেছি। মনটাকে পোডড়া জমি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। শুধু কয়েকটা ক্ষতবিক্ষত কাঁটাঝোপ জেগে আছে। কী যে করব, বুঝতেই পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখা বন্ধ করে দেব; আবার মনে হয়, কে কী বলল, না ভেবেই লিখে যেতে হবে। এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, শুধু মনে হয়, কালি-কলম ছেড়ে একটা নির্জন কোনে যদি পড়ে থাকতে পারতাম, মাথায় ভাবনা এলে তাদের ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিতাম; এটুকু শান্তিও যদি না পাই, তবে কালোবাজারে গিয়ে না হয় টাকা কামাব, বিশ মেশানো মদ তৈরী করে রোজগার করব। টাকার দরকার, খুব দরকার। সারা দিন রাত গল্প আর খবরের কাগজের লেখা লিখেও সংসার চালানোর টাকা হাতে আসে না। শধু ভয় হয়, হঠাৎ যদি মরে যাই, আমার বিবি আর তিন মেয়ের কী হবে? আমাকে আপনার যা খুশি তাই বলুন অশ্লীল গল্পের লেখক, প্রতিক্রিয়াশীল কিন্তু একই সঙ্গে আমি তো একজনের স্বামী, তিনজনের বাবা। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে দোরে দোরে গিয়ে ভিক্ষা করতে হবে। সংসার খরচ ছাড়াও আমার রোজকার অ্যালকোহলের জন্য টাকা দরকার। চার্জড না হলে একটা বাক্যও তো এখন লিখতে পারি না। আঙ্কল স্যাম আপনিই বলুন, এই কি একজন লেখকের ভবিতব্য?
গতকাল আবার হাসপাতাল থেকে ফিরেছি। মদ ছাড়ানোর জন্য শফিয়া কত চেষ্টাই না চালিয়ে যাচ্ছে। এরা বোঝে না মদ এখন আমাকে গিলে খাচ্ছে। মদ খাওয়ার জন্যই কত বন্ধুর বাড়িতে পড়ে থাকি। লেখালেখির সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্কই নেই। তারা জানেই না,। মান্টো কে? আমিও জানাতে চাইনি। শুধু দিনে দিনে নিজের শরীর আর মনকে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি আমি। নিজের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে সত্যিই ঘেন্না হয়। আমি সবসময় সবকিছু সাফসুরত রাখতে চেয়েছি, শফিয়া একা পারবে না বলে একসময় ঘরদোরও পরিস্কার করতাম, এক কণা ধুলো পড়ে থাকলেও তা সরিয়ে না ফেলা পর্যন্ত আমার স্বস্তি ছিল না। শফিয়া বলত, এসব নাকি আমার বাতিক। কিন্তু চারপাশটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে না পারলে, মানুষের ভেতরটাও সুন্দর থাকে না। মদ্যপান আমার কাছে শুধু নেশা করার ব্যাপার ছিল না; পানের আসরে তরিকা আমি নিখুঁতভাবে মেনে চলতাম। বম্বেতে থাকার সময় পছন্দ করে কতরকম যে গ্লাস কিনছিলাম। এখন আমি মদের বোতল বাথরুমে কমোডের পেছনে লুকিয়ে রাখি। শফিয়াকে লুকিয়ে বাথরুমে ঢুকে মদ খেতে হয় আমাকে। শফিয়া একেক সময় জিজ্ঞেস করে, এতবার বাথরুমে যাই কেন? মিথ্যে বলি। পেচ্ছাপ পায়। মুখচোখে জল দিতে ইচ্ছে করে। কোনও মিথ্যেই আর আমার মুখে আটকায় না। অথচ শফিয়াকে আগে কখনও মিথ্যে বলিনি। নেশা আমাকে দিনে দিনে নৈতিক অধঃপতনের দিকে নিয়ে চলেছে।
কিন্তু কী করব? না-খেলে কলম চলতে চায় না। আর না লিখলে রোজগারও বন্ধ। বুঝতে পারি, নিজের তৈরী একটা গোলকধাঁধায় আমি ঘুরপাক খাচ্ছি। আমি জানি, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ নেই আমার। কিন্তু মির্জাকে নিয়ে এই লেখাটা আমাকে শেষ করে যেতেই হবে। সকালের দিকে কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম। হাসপাতাল থেকে আসার পর কয়েকদিন মদ ছুঁতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, সারা শরীর জুড়ে নতুন ঘাস গজিয়েছে, গন্ধ পাই সেই ঘাসের, কী যে ফ্রেশ লাগে। প্রতিবার প্রতিজ্ঞা করি, নাঃ! আর নয়, এ-জীবনে আর মদ ছোঁব না, শফিয়ার সঙ্গে, মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে ভাল লাগে। কয়েকদিন পরেই আবার মদের দোকানের লাইনে গিয়ে দাঁড়াই।
সকালের দিকে কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে কাগজের ওপর আঁকিবুকি কাটতে কাটতে একটা শব্দও লিখতে পারিনি। মাথাটা একেবারে ফাঁকা কীভাবে শুরু করব, বুঝতেই পারছিলাম না। আমি জানি, একটু পেটে পড়লেই কলম তরতর করে এগোবে। হঠাৎ বাইরের গলিতে কে যেন চিৎকার করে ডাকল, খালেদ মিঞা -খালেদ মিঞা -।
আমার হাত থেকে কলম খসে পড়ল। মনে হল এক্ষুনি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে; হয়তো এই বাড়িটা ভেঙে পড়বে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, জুজিয়া জি-জুজিয়া জি-।
ছোটমেয়ে নসরতকে আমি আদর করে এই নামেই ডাকি। মেয়েটা কোথা থেকে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকি। তখনই শফিয়া এসে ঘরে ঢোকে। হাসতে হাসতে বলে, বাপ বেটির আজ যে খুব মহব্বত দেখছি।
-বোসো শফিয়া।
নসরতকে কোল থেকে নামিয়ে বলি, খেলছিলি বুঝি?
-জি আব্বা।
-যা তবে।
ফড়িং-এর মতো রোগা মেয়েটা হাসতে হাসতে দৌড় লাগায়।
আমি শফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। মান্টোর জীবনে এসে কত তাড়াতাড়ি এই মেয়েটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। শফিয়া আমার পাশে এসে দাঁড়ায়; কাঁধে হাত রাখে। বলে চোখে জল কেন মান্টোসাব?
-খালেদ মিঞার কথা মনে পড়ে তোমার?
শফিয়ার হাত আমার কাঁধে খামচে ধরে। মুহূর্তেই সে যেন এক মর্মরমূর্তি।
-অনেকদিন পর আমার মনে পড়ল।
ঝড়ে ভাঙা গাছের মতো শফিয়া মেঝেতে বসে পড়ল। আমি তার মুখোমুখি গিয়ে বসলাম। শফিয়া অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে বসেছিল, তারপর মুখ তুলল; সেই মুখ, আমার মনে হল, কেউ যেন এখনই পাথর খোদাই করে তৈরি করেছে।
-খালেদ মিঞাকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম শফিয়া। তোমাকে কখনও পড়াইনি।
-কেন?
-তুমি কষ্ট পেতে।
-আমার হাতের ওপর খালেদ মরেছিল, আমি সহ্য করিনি মান্টোসাব?
মৃত্যুকে সহ্য করা যায় শফিয়া। স্মৃতিকে নয়। জীবনের অনেক বড় আঘাত আমরা সহ্য করতে পারি, তারপর হয়ত মনেও থাকে না। কিন্তু এক-একটা লেখা এসে বারবার আমাদের কাঁদায়। লেখার ভেতরে তো স্মৃতি ছাড়া আর কিছু থাকে না।
-গল্পটা আজ শোনাবেন?
-তোমার শুনতে ইচ্ছে করছে?
-খালেদের জন্য।
-সে গল্পে আমার নাম ছিল মমতাজ। রোজ ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠে মমতাজ তাদের তিনটে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করত। এতটুকু নোংরা যাতে না থাকে। তখন তার ছেলে খালেদ সবে টলোমলো পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে। এইরকম বাচ্চারা তো মেঝেতে ছড়ানো যা পায়, তাই। তুলে মুখে দেয়। মমতাজ অবাক হয়ে দেখত, যতই সে ঘর পরিস্কার করুক, ছেলেটা কিছু না কিছু খুঁজে বার করে মুখে পুরবেই। হয়তো দেওয়াল থেকে খসে পড়া প্লাস্টার, ঘরের কোণায় লুকিয়ে থাকা পোড়া দেশলাই কাঠি। আর মমতাজ মনে মনে নিজেকে গালাগাল দিত। খালেদের প্রথম জন্মদিন যতই এগিয়ে আসছিল, মমতাজের মনে এক অদ্ভুত ভয় ছড়িয়ে যাচ্ছিল। তার সবসময় মনে হত, এক বছর হওয়ার আগেই খালেদ মারা যাবে। একদিন বিবিকে সে ভয়ের কথাটা বলেও ফেলেছিল। বিবি তো সে কথা শুনে অবাক। মমতাজ তো এইরকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। বিবি বলল, তাজ্জব কি বাত! আপনার মুখে এমন ভয়ের কথা? শুনে রাখুন মমতাজ সাব, আমাদের ছেলে একশো বছর বাঁচবে। ওর জন্মদিনের যা ব্যবস্থা করেছি, দেখে আপনার তাক লেগে যাবে। তবু ভয়টা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে থাকে।
খালেদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো। গালের রং দেখে মনে হয় যেন রুজ মাখানো হয়েছে। অফিস যাওয়ার আগে রোজ মমতাজ ছেলেকে এক গামলা জলে বসিয়ে স্নান করায়। কিন্তু ইদানিং স্নান করাতে করাতে খালেদের দিকে তাকিয়ে তার মনে কলো মেঘ জমে। নিজেকে সে বলে, আমার বিবির কথাই ঠিক। খালেদের মৃত্যুর ভয় কোথা থেকে আমার ভেতরে এল? কেন মরবে ও? অনেক বাচ্চার চেয়েই ওর স্বাস্থ্য বেশ ভাল। খালেদকে খুব ভালবাসি বলেই কি এই ভয়?
রোজ সকালে ঘর ঝাঁট দেবার পর মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকতে ভাল লাগত মমতাজের। আর একদিন পরেই খালেদের জন্মদিন। হটাৎ বুকের ওপর ভার অনুভব করতেই সে চোখ খুলে দেখল, খালেদ তার বুকে শুয়ে আছে। পাশে তার বিবি দাঁড়িয়ে। খালেদ নাকি সারারাত ছটফট করেছে, কী এক ভয়ে কেঁপে-কেঁপে উঠেছে। মমতাজ ছেলের শরীরে হাত বুলোতে- বুলোতে বলে উঠল, আল্লা, মেরে বেটে কো-।
-এত ভয় কীসের মমতাজ সাব! সামান্য জ্বর, আল্লার দয়াতেই চলে যাবে। বলে তার বিবি চলে গেল। মমতাজ ছেলেকে যে কতভাবে আদর করতে লাগল।
খালেদের প্রথম জন্মদিনের জন্য মমতাজের বিবি বিরাট ব্যবস্থা করেছিল। সব আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করা হয়েছে। খালেদের জন্য নতুন পোশাক তৈরি করতে দিয়েছে। এত জাঁকজমক মমতাজের ভাল লাগছিল না। সে চাইছিল, নীরবে এক বছর পার হয়ে যাক। তা হলে আর কোনও ভয় থাকবে না।
খালেদ একসময় তার বুক থেকে উঠে টলোমলো পায়ে অন্য ঘরে চলে গেল। মমতাজ একই ভাবে শুয়ে ছিল। হঠাৎ ভেতর থেকে বিবির আর্তনাদ ভেসে এল, মমতাজ সাব, তাড়াতাড়ি আসুন, মমতাজ সাব।
মমতাজ দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখল, বাথরুমের সামনে খালেদকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার বিবি। খালেদ হাত-পা ছুড়ছে। সে বিবির কাছ থেকে খালেদকে কোলে তুলে নিল।
জল নিয়ে খেলতে খেলতে হঠাত্র খালেদের ফিট শুরু হয়ে যায়। মমতাজের কোলে খালেদ দুমড়ে মুচরে যাচ্ছিল। মমতাজ তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আরো কিছুক্ষণ হাত-পা ছোঁড়ার পর খালেদ অজ্ঞান হয়ে যায়। একেবারে নিস্পন্দ। মমতাজ ডুকরে ওঠে, খালেদ আর নেই। তার বিবি ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ইয়া আল্লা, এ কী কথা! একটু তড়কা হয়েছে, দেখবেন এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুক্ষন পর খালেদ চোখ মেলে। মমতাজ তার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে, খালেদ বেটা আমার, কী হয়েছে, কী কষ্ট হচ্ছে?
খালেদের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। মমতাজ তাকে কোলে নিয়ে পাশের ঘরে যেতেই আবার শুরু হয় খালেদের শারীরিক উন্মাদনা। মৃগীরোগীর মত কাঁপতে থাকে খালেদ। মমতাজ তাকে সামলাতে পারে না। তারপর আবার খালেদ শান্ত যায়। মমতাজ ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে যায়। ডাক্তার এসে খালেদকে দেখে বলে, বাচ্চাদের এমন তড়কা হয় মাঝে মাঝে। কৃমির জন্যও হতে পারে। ওষুধ লিখে দিচ্ছি। চিন্তার কিছু নেই।
কিন্তু খালেদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে, জ্বর বেড়ে চলে। পরদিন সকালে আবার ডাক্তার। আসে। বলে, ভয় পাবেন না মিঞা। মনে হচ্ছে ব্রঙ্কাইটিস। তিন চারদিনেই ভালো হয়ে যাবে
খালেদের জ্বর বাড়তেই থাকে। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ছাড়াও বাড়ির চাকর জামশেদের কথায় তাকে জলপড়া খাওয়ানো হয়। দুপুরে অন্য এক ডাক্তার আসে। ম্যালেরিয়া সন্দেহ করে। কুইনাইন ইঞ্জেকশন দেয়। খালেদের জ্বর ১০৬ ডিগ্রিতে গিয়ে পৌঁছয়। মমতাজ ঠিক করে, হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হবে খালেদকে। ঘোড়ার গাড়ি ডেকে খালেদকে কোলে নিয়ে বিবির সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন শুধু জলতেষ্টা পেয়েছে মমতাজের। কত যে জল খেয়েছে। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে যেতে মনে হয়, কোথাও দাঁড়িয়ে একটু জল খেয়ে নেবে। আর তখনই কে যেন বলে ওঠে, মিঞা, মনে রেখো, জল খেলেই তোমার খালেদ মারা যাবে। গলা শুকিয়ে কাঠ তবু সে জল খায় না।
হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছে সে একটা সিগারেট ধরায়। দুটান দিয়েই সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কে যেন বলে উঠেছে, মমতাজ, সিগারেট খেও না, তা হলে তোমার ছেলে মারা যাবে। কে, কে তার কানে এসে এইসব কথা বলছে? যতসব বাখোয়াস। সে আবার নতুন করে সিগারেট ধরাতে যায়, কিন্তু পারে না।
হাসপাতালে খালেদকে ভর্তি করার পর ডাক্তার জানায়, ওর ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়া হয়েছে।
অবস্থা ভাল নয়। খালেদের জ্ঞান ছিল না। ওর মা বিছানায় মাথার পাশে বসে আছে। মমতাজের আবার জলতেষ্টা পেল। ওয়ার্ডের কাছে কল খুলে জল খেতে গিয়ে মমতাজ আবার শুনতে পেল সে। কণ্ঠস্বর, কী করছ মমতাজ? জল খেয়ো না। তোমার খালেদ তা হলে মারা যাবে। তবু মমতাজ জল খেতেই লাগল; তার মনে হল, একটা সমুদ্র খেয়ে ফেললেও সেই তৃষ্ণা মিটবে না। জল খেয়ে এসে সে দেখল, খালেদ আরো বিবর্ণ গেছে। মমতাজের মনে হল, আমি জল না। খেলে খালেদ হয়ত এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত না। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর তার ভিতরে বারবার বলে চলেছে, একবছর বয়স হওয়ার আগেই খালেদ মারা যাবে।
তখন সন্ধ্যা নামছে। কত ডাক্তার এসে দেখে গেল খালেদকে। কত ওষুধ, ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। খালেদের তবু জ্ঞান ফেরেনি। হঠাৎ সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, এখনই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাও মমতাজ, নইলে খালেদ মারা যাবে। মমতাজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল। সেই কণ্ঠস্বর তার মাথার ভেতরে ভেতরে কত কথা বলে যাচ্ছিল। কণ্ঠস্বরের নির্দেশে সে একটা হোটেলে গিয়ে বসল, মদের অর্ডার দিল, মদ এল, কণ্ঠস্বর তাঁকে বলল, ছুঁড়ে ফেলে দাও মদ। মমতাজ মদ ছুঁড়ে ফেলে দিতেই আবার নির্দেশ এল, মদের অর্ডার দাও; আবার মদ এল; কণ্ঠস্বর বলল, ছুঁড়ে ফেলে দাও।
মদ আর ভাঙা গ্লাসের দাম চুকিয়ে মমতাজ হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়াল। তার মনে হল,। এই কণ্ঠস্বর ছাড়া পৃথিবী থেকে সব শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। সে হাসপাতালে ফিরে এল, খালেদের ওয়ার্ডে যাওয়ার সময় কণ্ঠস্বর আবার বলল, ওখানে যেও না মমতাজ। খালেদ তাহলে মারা যাবে।
হাসপাতালের মধ্যেই একটা পার্কের বেঞ্চে সে শুয়ে পড়ল। তখন রাত প্রায় দশটা। অন্ধকারে হাসপাতালের বাইরের ঘড়িটা শুধু দেখা যাচ্ছিল। সে বিড় বিড় করে বলছিল, খালেদ বাঁচবে তো? মরে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা কেন এই দুনিয়াতে আসে? জন্মের পরেই কেন মৃত্যু এভাবে
ওদের গ্রাস করে নেয়? খালেদ নিশ্চয়ই…
সেই কণ্ঠস্বর তাঁকে বলল, মমতাজ এভাবেই শুয়ে থাকো। একটুও নড়ো না খালেদ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।
মমতাজ একসময় নিজের ভেতরে চিৎকার করে উঠল, আল্ল মেহরবান, আমাকে বাঁচাও। খালেদকে মারতে চাইলে মারো। আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ কেন?
তার কাছেই দুজন লোক বসে কথা বলছিল।
-কী সুন্দর বাচ্চা।
-ওর মায়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ডাক্তারের পায়ে পড়ে শুধু কাঁদছে।
-ছেলেটাকে বাঁচানো যাবে না।
হঠাৎ তারা মমতাজকে দেখতে পেল।-আপনি এখানে কী করছেন?
মমতাজ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
-কে আপনি? একজন জিজ্ঞেস করল।
মমতাজের গলা শুকিয়ে কাঠ। ফ্যাসফেসে গলায় সে বলল, আমি পেশেন্ট ডাক্তারবাবু।
-পেশেন্ট তো বাইরে কেন? ভেতরে যান। এখানে কেন?
-স্যার আমার ছেলে…ওপরের ওয়ার্ডে…
-আপনার ছেলে
-আপনারা বোধহয় ওর কথাই বলছিলেন। আমার ছেলে খালেদ।
-আপনি তার আব্বা?
মমতাজ শুধু তার মাথা নাড়ে।
-এখানে শুয়ে আছেন? ওপরে যান তাড়াতাড়ি।
মমতাজ দৌড়তে থাকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই ওয়ার্ডের সামনে জামশেদকে দেখতে পায়। জামশেদ তার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে, সাব, খালেদ মিঞা চলে গেল।
ওয়ার্ডে ঢুকে মমতাজ দেখল, বিছানার ওপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তার বিবি। ডাক্তার নার্সরা তাকে ঘিরে আছে। মমতাজ বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ বুজে শুয়ে আছে খালেদ। মৃত্যুর শান্তি ছড়িয়ে আছে তার মুখে। মমতাজ তার রেশমের মতো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, লজেন্স খাবি খালেদ? খালেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মমতাজ বিড়বিড় করে বলে, খালেদ মিঞা, তুমি আমার ভয়টাকে নিয়ে যাবে না?
মমতাজের মনে হল, খালেদ যেন মথা নেড়ে বলল, জি আব্বা।
গল্প শুনতে শুনতে শফিয়া কখন যেন আমার হাত চেপে ধরেছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তার চোখ মরুভূমির মত উজ্জল। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে সে ডাক দেয়, জুজিয়া জি-জুজিয়া জি-।
শফিয়া তো কখনও নসরতকে ওই নামে ডাকেনি।