বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি পার্ক করে বিমানবিহারী, মামুন এবং প্রতাপ ট্রামলাইন পার হয়ে এলেন। কলেজ স্কোয়ারের গেটের দুপাশে দুটি পুলিশের গাড়ি পার্ক করা। রাইফেলধারী সিপাহীরা সকলেই দাঁড়িয়ে আছে, তারা পিঠে পিঠ দিয়ে নজর রেখেছে দু’দিকে। পার্কের মধ্যে জমায়েত হয়েছে কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ, প্রায় সকলেই বেশ বয়স্ক, তাদের চোখে মুখে অশান্তির চিহ্ন। কয়েকজনের হাতে ফুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক মুখোমুখি বসানো বিদ্যাসাগরের মূর্তিটির মাথা সাদা কাপড় দিয়ে। মোড়া। মাত্র কয়েকদিন আগেও এই পথের পথচারীরা দেখেছে বিদ্যাসাগরের মুণ্ডহীন মূর্তি। শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র এই কলেজ স্ট্রিটে এদেশে নারী ও শিশুদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ব্যবস্থার অগ্রণী পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মুণ্ডপাত করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
বিপ্লবী যুবসমাজ এখন মূর্তিভাঙার উল্লাসে মত্ত। বিদ্যাসাগর ছাড়াও রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও অন্যান্য জাতীয় নেতাদের মূর্তি ভাঙা হয়েছে অনেক জায়গায়, দেয়াল থেকে তাঁদের ছবি নামিয়ে এনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে আগুনে। বিদ্যাসাগরের ওপর রাগটাই যেন বেশী, বিদ্যাসাগরের শুধু মুণ্ডুই কাটা হয়নি, তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড ঘৃণা, দিকে দিকে স্কুল-কলেজে ভাঙচুর-তছনছ হচ্ছে, এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের স্কুল। প্রতিবাদ করার সাহস কারুর নেই। বিপ্লবী ছাত্রদের কাছে এখন প্রচুর হাতবোমা, সেগুলি যথেষ্ট কার্যকর, তাতে শুধু ভয়-ধরানো প্রচণ্ড শব্দই হয় না, মানুষও মরে। একসঙ্গে তিন চারটি যুবক ও তাদের সঙ্গে তিন চারটি হাতবোমা, এদের দেখলেই সাধারণ মানুষ। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালায়, যেন নতুন বর্গীর আমল এসেছে।
মূর্তি ভাঙার এই বিপ্লবের নির্দেশ যে ঠিক কার কাছ থেকে প্রথম এসেছিল তা ঠিক জানা যায় না। পরীক্ষার হলে ছাত্ররা হঠাৎ প্রশ্নপত্র ও খাতা ছিঁড়ে, চেয়ার-টেবিল ভেঙে পরীক্ষা। ব্যবস্থাটাকেই লণ্ডভণ্ড করতে গিয়ে কখনো হয়তো গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের ছবিও ভেঙে ফেলেছে। পূজনীয় মনীষীদের প্রতি এই অসম্মানে মধ্যবিত্ত নীতিবাগিশ শ্রেণীর মধ্যে যে হাহাকার জেগে। ওঠে, তা দেখেই যেন বেশী মজা পেয়েছে অল্প বয়েসীরা। মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আঘাত করতেই তো তারা চায়। ভাঙুক, সব কিছু ভাঙুক, পুড়ে যাক, পুরোনো সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাক!
মূর্তি ও ছবি এবং শিক্ষাব্যবস্থা ভাঙার ব্যাপারে যুবসমাজের এই প্রবল ও স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ দেখে নকশাল আন্দোলনের নেতারা এতে নৈতিক সমর্থন জানালেন। এই সব অত্যুৎসাহী ছাত্রেরা সি পি আই (এম এল) দলের সদস্য নয়, কিন্তু তারাও বিপ্লবী। এই ভাবেই তো বিপ্লব ছড়ায়। তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তের মতে, এইসব ছাত্র ও যুবকেরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ না পেয়েই এই মূর্তি ভাঙা শুরু করেছে, কিন্তু এরা জনসাধারণের চিন্তা ধারা ঠিক মতন অনুধাবন করতে পেরেছে, বিপ্লবী দলের রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গেও এর কোনো অমিল নেই। এরা মূর্তি ভাঙছে নতুন মূর্তি গড়বে বলে। গান্ধীকে সরিয়ে এরা ঝাঁসীর রাণীর মূর্তি বসাবে, ব্যারাকপুরের গান্ধীঘাট হবে মঙ্গল পাণ্ডে ঘাট। এই সব নবীনেরা শোধনবাদী অতীতের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়!
চারু মজুমদারও সমর্থন জানালেন এই তারুণ্যের উদ্দীপনাকে। তিনি লিখলেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা আর ধনতন্ত্রের দালালদের প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলো না ভাঙলে নতুন বিপ্লবী-শিক্ষা ও সংস্কৃতির পত্তন করা যাবে না। বাংলায় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ আজ এক বাস্তব সত্য–তারই প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র ও যুবসমাজ অস্থির হয়ে উঠেছে। যারা বারবার সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহকে শান্তির বাণী ও শোধনবাদ দিয়ে চাপা দিতে চেয়েছে, তাদেরই মূর্তিতে এখন আঘাত হানছে ছাত্ররা। এই ছাত্র ও যুবসমাজের লড়াই সেইজন্য সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহেরই অঙ্গ!
ভাঙতে গেলে শেষ পর্যন্ত আর বাদ বিচার থাকে না, একটা মূর্তি ভাঙলে অন্য মূর্তি ভাঙতেই বা দোষ কী! আবেগপ্রবণ বাঙালী মানুষ খুনের চেয়েও কোনো পূজনীয় পাথরের মূর্তির শিরচ্ছেদে বেশী শিহরিত হয়। অল্প বয়েসীদের তাতেই বেশী আনন্দ! বিপ্লবী পার্টির বয়স্ক নেতারা তাতেও আপত্তি জানালেন না। শুধু সুশীতল রায়চৌধুরীর মনে একটু দ্বিধা এসেছিল। গান্ধী আর বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথকে সমান পর্যায়ে দেখা কি ঠিক? এদের কয়েকজনকে অন্তত কি বুর্জোয়া ডেমোক্রাট বলা যায় না? ইস্কুল কলেজের চেয়ার-টেবিল ভাঙা ও ফাঁইল পোড়ানোর বদলে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের একটা আন্দোলনও কি শুরু করা উচিত নয়? রবীন্দ্রনাথের বুর্জোয়া মানবতাবাদ ও সীমাবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে কি কাজে লাগানো যায় না?
এর উত্তরে চারু মজুমদার কমরেড পূর্ণকে (সুশীতলের ছদ্মনাম) সতর্ক করে দিলেন একটি প্যামফ্লেটে যে, পার্টি কংগ্রেসের প্রোগ্রামেই বলা হয়েছে, ভারতীয় বুর্জোয়ারা প্রথম থেকেই একটি দালাল শ্রেণী। তাদের মধ্য থেকে বুর্জোয়া ডেমোক্রাটদের খুঁজে বার করার চেষ্টাই পাটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে। এদেশের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশ এবং সাধারণ মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়। বিপ্লবী আদর্শ এবং মাও সে তুং-এর চিন্তা ধারায় যারা বিশ্বাসী, এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করাই তাদের পবিত্র দায়িত্ব। সেই ঘৃণা থেকে যদি ছাত্ররা চেয়ার-টেবিল ভাঙে, কাগজপত্র পোড়ায়, তাহলে কোনো বিপ্লবীর তাদের বাধা দেবার অধিকার নেই।
হুগলীর এক গুপ্ত সভায় সরোজ দত্ত আরও আগুন ছড়ালেন। জনসাধারণ কখনো ভুল করতে পারে না। বিপ্লবের সময় কিছু বাড়াবাড়ি হয়েই থাকে। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবও এগিয়ে যাবে। তিনি সহকর্মীদের বললেন, অতীতকে ভুলে যাও! পুরোনো কবিদের ভুলে যাও! সংগ্রামী কৃষকদের মধ্য থেকেই লড়াকু কবিরা এগিয়ে আসবে। চারু মজুমদারের বাণীই আজকের কবিতা! “আজ অনুতাপের সময় নয়, আজ প্রদীপ্ত শিখার মত জ্বলে ওঠার দিন,” কিংবা “সত্তরের দশক মুক্তির দশক হোক” এই সবই তো কবিতা।
সুতরাং সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা, যারা রবীন্দ্ররচনাবলীর একশো ভাগের এক ভাগও পড়েনি, রামমোহন কে ছিলেন ভালো ভাবে জানে না, বিদ্যাসাগর সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাদের সমর্থন করেননি শুধু এইটুকুই শুনেছে কারুর কাছ থেকে, তারা ভাঙতে লাগলো, ভাঙার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠলো। বাধা পেল না বিশেষ। খবরের কাগজে বিস্তর অশ্রু বর্ষণ। হলেও একটাও ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগাতে এগিয়ে এলো না কেউ।
মূর্তি ভাঙা ও স্কুল বাড়ি পোড়ানোর সার্থকতার পর তরুণ বিপ্লবীরা এবার জীবন্ত শত্রুর দিকে মন দিল। বিপ্লবীদের দমনে পুলিশী অত্যাচার ক্রমশ কঠোর হয়ে উঠছে, ডেবরায়, গোপীবল্লভপুর, শ্রীকাকুলাম থেকে নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী ভেসে আসছে, সুতরাং এবার প্রতিশোধের পালা। শুরু হলো পুলিশ খুন। প্রথম দিকে তার সার্থকতাও চমকপ্রদ। প্রকাশ্য দিবালোকে চার পাঁচটি ছেলে শুধু ছুরি-ভোজালি দিয়েই একজন কনস্টেবলকে খুন করে বিনা বাধায় চলে যেতে পারে। রাস্তার লোকজনেরা বিস্ফারিত চোখে দেখে কিংবা ভয়ে পালায়। পুলিশ তো ধনিক শ্রেণীর পাহারাদার, তাদের হত্যা করতে কোনো রকম দ্বিধা নেই। মেরে মেরে পুলিশ বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে, তাদের মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে যাতে তারা চাকরি ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
অতর্কিতে কোনো কনস্টেবল বা ইনসপেক্টারকে আক্রমণ করে তার অস্ত্রটাও কেড়ে নেওয়া যায়। গ্রামের জোতদার কিংবা মফস্বলের ব্যবসায়ীদেরও অনেকেরই বন্দুক থাকে, সেগুলোও দখল করে নিতে পারলে বিপ্লবের জন্য অস্ত্র মজুত হবে।
মূর্তি ভাঙা, পুলিশ খুন, অস্ত্র লুঠ, শোধনবাদী পার্টির কর্মীদের বিনাশ এইসব চলতে লাগলো মাসের পর মাস। যেন মনে হলো, সত্যিকারের বিপ্লব এসে গেল, এসে গেল!
তারপর শুরু হলো চরম প্রতিক্রিয়া। পশ্চিম বাংলায় সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির শাসনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এলেন সিদ্ধার্থ রায়। পুলিশের বদলে নামানো হলো বি এস এফ এবং সি আর পি।
গেরিলা যুদ্ধের কোনোরকম ট্রেনিং যারা নেয়নি, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করার পরিকল্পনা যারা নেয়নি, যারা শুধু দেয়ালে স্লোগান লিখেছে, পাথরের মূর্তি ভেঙেছে, একা পেয়ে কোনো কনস্টেবলকে খুন করে হাত পাকিয়েছে, সেইসব মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত ঘরের আদর্শবাদী ছেলেরা এবার সম্মুখীন হলো এক সুশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর। প্যারা মিলিটারি ফোর্সের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে তারা সামান্য হাতবোমা, পাইপগান কিংবা পুরোনো রিভলভার নিয়ে দাঁড়াতেই পারলো না।
অন্য মার্কসবাদী দল এবং কংগ্রেসের ছেলেরাও এবার উঠে পড়ে লাগলো নকশালদের নির্মূল করার কাজে। মাঠে-ঘাটে, রেল লাইনের ধারে প্রতিদিন দেখা যেতে লাগলো সুন্দর, সুকুমার, স্বপ্নময় চোখের ছেলেদের মৃতদেহ। শাসকদের শক্তি এবং অন্য দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিশোধ স্পৃহা, এই ত্রিমুখী আক্রমণে পর্যুদস্ত হতে লাগলো নকশালপন্থীরা। জেলখানাও ভরে যেতে লাগলো।
বিদ্যাসাগর, রামমোহন, গান্ধীর ভাঙা মূর্তিগুলো এতদিন এমনই পড়ে ছিল, এবার কারুর কারুর নজর পড়লো সেদিকে। বিবেক দংশন তীব্র হলো।
কলেজ স্ট্রিটে দোকানে আসার পথে বিমানবিহারী বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ভাঙা মূর্তিটার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিতেন! অসহ্য কষ্ট হতো তাঁর। কয়েক মাস ধরেই তিনি কয়েকজন প্রকাশককে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন যে, এই মূর্তিটা সারানো তাঁদেরই পবিত্র কর্তব্য। বিদ্যাসাগর শুধু এদেশে বিদ্যাচচারই প্রসার ঘটাননি, তিনি বাংলার প্রকাশকদেরও আদি গুরু। কিন্তু অন্যরা কেউ উদ্যোগ নিতে সাহস পাননি, যে ঐ মূর্তি সারাতে যাবে, নকশালরা তার ওপরেই প্রতিশোধ নেবে।
এখন নকশালরা অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় এসে পড়েছে, তাই অনেকে এগিয়ে এসেছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনরুদ্ধারের কাজে। গতকাল রাতেই বিদ্যাসাগরের কাঁধে নতুন মাথা বসানো হয়েছে, আজ সকাল দশটায় তার উদ্বোধন হবে। আহ্বান করা হয়েছে সর্বদলীয় নেতাদের। আজ তাঁরা এখানে বাংলার যুবসমাজের মধ্যে খুনোখুনি বন্ধের প্রস্তাব নেবেন।
বিমানবিহারীরা একটু আগে এসে পড়েছেন। সাবধানের মার নেই বলে দু’গাড়ি সি আর পি মোতায়েন করা হয়েছে আজ, কেন না নকশালরা এখনও মরীয়া হয়ে এখানে সেখানে আক্রমণ চালাচ্ছে, হঠাৎ কলেজ স্কোয়ারেও বোমা চার্জ করতে পারে।
তিন প্রৌঢ় সিগারেট ধরালেন। আজ ভোরবেলাই বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই এখন বিশেষ গরম নেই, চারদিক ভিজে ভিজে। আকাশ এখনো মেঘলা।
মামুন বিদ্যাসাগরের বিশেষ ভক্ত। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতন একজনও জন্মাননি, তাই গত শতাব্দীতে বাঙালী মুসলমানরা শিক্ষার ব্যাপারে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। অবশ্য যৌবনে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরার সময় মামুন একথাও বুঝেছিলেন যে, একজন মুসলমান বিদ্যাসাগর যদি গত শতাব্দীতে বহুবিবাহ রদের কথা, স্ত্রী-শিক্ষার কথা প্রচার করতেন, তাহলে মুসলমানরা কি তাঁকে বাঁচতে দিত! হিন্দুদের বিদ্যাসাগর আবার নাস্তিক ছিলেন, একজন নাস্তিক মুসলমান সমাজ সংস্কারকের কথা কি এখনও কল্পনা করা যায়?
মামুন বললেন, ভাই, এই সব নকশাল ছেলেমেয়েরা তো বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পন্থাতেই লেখাপড়া শিখেছে। আর লেখাপড়া শিখেই তো তারা মার্কসবাদ বলো আর যাই-ই বলো। বুঝতে শিখেছে। তবু বিদ্যাসাগরের উপর তাদের এত রাগ কেন সেটাই বুঝি না!
প্রতাপ বললেন, ওদের মতে ইংরেজ সরকার নিজেদের দরকারে কেরানী বানাবার জন্য ইংরেজি শিক্ষা চালু করেছিলেন, বিদ্যাসাগর তাতেই মদত দিয়েছেন। এটা বিজাতীয় শিক্ষা!
বিমানবিহারী অসহিষ্ণুভাবে বললেন, তুমি কী বলছে, প্রতাপ? শিক্ষার আবার জাত আছে নাকি? শিক্ষা জিনিসটাকে যে যেভাবে নিতে পারে। সব দেশেই কিছু লোক লেখাপড়া শিখে কেরানী হয়, কিছু লোক পণ্ডিত, চিন্তাবিদ হয়। এই শিক্ষাতেই আমাদের দেশে জগদীশ বোস, সি ভি রমন, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বড় হননি? চারু মজুমদার নিজেই কি চীনে গিয়ে এ বি সি ডি পড়ে এসেছে? মামুন বললেন, এরা মূর্তি তো ভাঙছে, তার বদলে কার মূর্তি গড়বে তা কি বলেছে? শুধু কি মাও সে তুং আর লেনিন, কার্ল মার্কস? এদেশে কোনো নেতা নেই?
প্ৰতাপ বললেন, এদের একটা লিফলেটে ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের কথা পড়েছিলাম একবার।
বিমানবিহারী বললেন, মুখ, মুখ! আসলে এরা নিজেরাই পড়াশুনো কিছু করে নি। আর কারুকে খুঁজে পেল না। শেষ পর্যন্ত ঝাঁসীর রাণী হলো আদর্শ!
প্রতাপ বললেন, বিমান, তুমি এদের আর যাই বলো, মুখু বলতে পারো না! এদের মধ্যে অনেকেই ফাস্ট-সেকেন্ড হওয়া ছেলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম করা ছাত্র।
বিমানবিহারী বললেন, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলেই ভালো ছাত্র হয় না! স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশই যথার্থ শিক্ষার লক্ষণ। তা না, চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই চিলের পিছনে ছোটা। সাধারণ যাত্রা-থিয়েটারে ঝাঁসীর রাণী একজন হিরোইন হতে পারে কিন্তু ইতিহাসে তার স্থান কোথায় তা যারা মন দিয়ে ইতিহাস পড়েছে তারাই জানে। রমেশ মজুমদাবের বই খুলে দ্যাখো, সেখানেই আছে যে ঝাঁসীর রাণী নিজে চিঠি লিখে ইংরেজদের জানিয়েছিল যে, সে নিজে মোটেই বিদ্রোহে যোগ দিতে চায় না, কিন্তু সেপাইরা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। সে তাদের। দলে যোগ না দিলে সেপাইরা তার প্রাসাদ উড়িয়ে দেবার হুমকি দিয়েছে। অর্থাৎ সেপাই। বন্দুকের নল দিয়ে পিছন থেকে ঠেলে ঠেলে এনে সব বাণীকে নেত্রী করেছে।
মামুন বললেন, তাই নাকি? এটা তো আমার জানা ছিল না!
বিমানবিহারী বললেন, যাত্রা-থিয়েটারের যে গলা কাঁপানো সেন্টিমেন্ট, সেটাই আমাদের দেশে দেশাত্মবোধ হিসেবে চলে ‘ এই জঙ্গী বিপ্লবীরাও সেই সেন্টিমেন্টেই চলছে। আদর্শ মানে শুধু গাল ভরা কথার ফুলঝুরি! হুঃ বিপ্লব! বিপ্লব যেন হাতের মোয়া! আমি মাও সে তুং-কে তবু শ্রদ্ধা করি, তিনি অনেক দিনের প্রস্তুতি নিয়ে তারপর সংগ্রামে নেমেছিলেন। আর এরা যুদ্ধ কাকে বলে জানেই না! শুধু শুধু কিছু লোক মারলো, এখন নিজেরা মরছে।
মামুন বললেন, এই নকশালদের দেখে আমার সেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবীদের কথা মনে পড়ে। খুব মিল আছে। তোমাদের মনে আছে সেই সময়টার কথা?
বিমানবিহারী বললেন, তখন আমি খুবই ছোট ছিলুম, তবে জানি, ব্যাপারটা জানি, ওটা আবার বিপ্লব নাকি? আমরা অনেক বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখেছি। সিনেমা বানিয়েছি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই তো একটা ফিয়াসকো! ইংরেজরা নিশ্চয়ই খুব হেসেছিল সেই সময়!
মামুন বললেন, একবার অনন্ত সিং-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাঁর মুখে আমি আসল সত্যি কথাটা শুনেছি। ওনারা চিটাগাং-এর অস্ত্রাগার লুঠ করতে গিয়েছিলেন কিন্তু আর্মস অ্যামিউনিশান সম্পর্কে কোনো ট্রেনিং-ই ছিল না। একটা হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে ওনারা গেলেন আমারি রেইড করতে, যেন ব্যাপারটা অতই সোজা! তবু তো ফাঁকতালে ইংরেজদের খানিকটা অসতর্কতার সুযোগে অনেক অস্ত্র পেয়ে গেলেন, কিন্তু একটাও ব্যবহার করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত! কেন পারেননি জানো? তার কারণ, অস্ত্র পেয়েছিলেন, গোলাগুলি পাননি! ওঁরা এই সিম্পল ব্যাপারটাই জানতেন না যে, কোনো দেশেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ এক জায়গায় রাখা হয় না!
বিমানবিহারী বললেন, গোলাবারুদের ডিপোটা ছিল মাত্র এক মাইল দূরে, সেখানেও সে রাতে তেমন কিছু পাহারা ছিল না, তবু ওরা সন্ধানটাই পায়নি! এই তো বিপ্লবীদের মহান কীর্তি! শুধু নিজেদের প্রাণ নষ্ট করেছে। ওরা যখন পালাতে যাচ্ছিল, তখন নিজের দেশের মানুষই ওদের সাধারণ ডাকাত মনে করে ওদের কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে!
প্রতাপ অন্য দুই বন্ধুর এই সব মন্তব্য ঠিক পছন্দ করতে পারলেন না। তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তিনি বললেন, তোমরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ব্যাপারটা যে এত তুচ্ছ বলে মনে করছো, সেটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। ঐ ঘটনার ফলে সারা দেশে যে বিপুল উত্তেজনা এসেছিল, তা কি অস্বীকার করতে পারো? সূর্য সেনের মতন মানুষ মৃত্যুর পরেও হাজার হাজার অল্প বয়েসী ছেলেদের মনে প্রেরণা জুগিয়েছেন।
বিমানবিহারী বললেন, না, না, আমি চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করতে চাই না মোটেই। সূর্য সেনও অবশ্যই নমস্য। আমি বলছি, বিপ্লবের প্রস্তুতির কথা। ঠিক মতন। জন সংযোগ না হলে, একটা ব্যবস্থার বদলের জন্য সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করা, শুধু আগ্রহীই নয়, দরকার হলে সাধারণ লোকে এ যাতে রাস্তায় নেমে পড়ে হাতিয়ার ধরতে পারে, সেই ভাবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে, শুধু দু চারটে খুন-জখম করলে বিপ্লব হয়?
মামুন বললেন, এই নকশালদের ধরন-ধারণ দেখলে তো মনে হয়, ওরা যুদ্ধের কোনো ট্রেনিংই নেয়নি। ইস্কুল-কলেজের ভালো ছাত্র, মনে রয়েছে একটা আদর্শবাদ, কিন্তু ঠিক মতন তৈরি হয়ে না নিলে…
প্রতাপ অন্যমনস্কভাবে জলের দিকে তাকিয়েছিলেন। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, মামুন, তোমাদের ওখানেও তো পাকিস্তানী শক্তিশালী আর্মির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ লড়াইতে নেমেছে, তারা কি ট্রেনিং নিয়েছে?
মামুন বললেন, তারা তো ভাই বাধ্য হয়ে নেমেছে। মরতে মরতে রুখে দাঁড়িয়েছে। আর তো কোনো উপায় ছিল না। তাও তো আমি মনে করি, এভাবে লড়াই করে পাকিস্তানী ট্রেইনড আর্মিকে কোনোদিন হারানো যাবে না, যদি না অন্য কোনো দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। চার মাস কেটে গেল, কী যে হবে! ২
বাইরের রাস্তায় একজন কোনো বড় গোছের নেতা নামলেন গাড়ি থেকে। তাঁর সঙ্গে একটি জিপ, তাতে রয়েছে কয়েকজন যুবক, তাদের হাতে লাঠি। ঐ নেতার দেহরক্ষী যুবকদের পকেটে বোমা-পিস্তল থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। এরাও বোধহয় আশঙ্কা করেছে যে আজ এখানে নকশাল হামলা হতে পারে।
সেদিকে তাকিয়ে প্রতাপ ভাবলেন, শেষ পর্যন্ত কি সত্যিই একটা সামান্য পাথরের মূর্তিকে কেন্দ্র করে এখানে একটা খণ্ডযুদ্ধ ঘটে যাবে?
বিমানবিহারী একবার নিজের কোমরটা থাবড়ে দেখে নিলেন। তাঁর নিরীহ খদ্দরের সাদা। পাঞ্জাবির নিচে তিনি রিভলভারটা গুঁজে এনেছেন। ইদানীং তিনি সবসময় সশস্ত্র থাকেন।
ভাইস চ্যান্সেলরের আসবার কথা। তিনি এখনো এসে পৌঁছোননি বলেই অনুষ্ঠান শুরু হতে পারছে না। তবে ভিড়টা হয়েছে মন্দ না, সত্তর-আশিজন হবেই। এর মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা। নগণ্য, তিন চারজনের বেশী না। এদেশের রমণীদের জন্যই বিদ্যাসাগর জীবনের অনেক গুলি বছর খেটে খেটে মুখে রক্ত তুলেছেন।
দূরে কোথাও একটা বিকট শব্দ হলো। পটকা না গাড়ির টায়ার-টিউব বাস্ট করার আওয়াজ? এরকম কিছু শুনলেই গা ছমছম করে। গতকালও হাওড়ায় এক সাংবাদিক রাখাল নাহা খুন হয়েছে। এস এস কে এম হাসপাতাল থেকে একজন নামকরা নকশাল নেতা মহাদের মুখার্জি পালিয়ে গেছে। নকশালরা নাকি ঘোষণা করেছে, এক একজন বিপ্লবীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার হন। একশো জন প্রতি বিপ্লবীকে খতম করা হবে। এই বাজারে কে যে বিপ্লবী আর কে যে প্রতিবিপ্লবী তা বোঝার উপায় নেই। বিমানবিহারীর বাড়িতে পুলিশের একজন বড় কত বলছিলেন, নকশাল আর সি পি এম-এর মধ্যে যখন মারামারি হয়, তখন আমরা চোখ বুজে থাকি, ওদের মধ্যে কে কত বড় মার্কসবাদী, তা ওরা নিজেরাই বুঝে নিক, আমাদের মাথা গলাবার দরকার কী! সে কথা শুনে প্রতাপের ইচ্ছে হয়েছিল পুলিশের কতটিকে ঠাস করে একটা চড় কষাতে। তাঁর আজকাল প্রায়ই এরকম পাগলাটে ইচ্ছে হয়। ইদানীং তিনি যেন অনেক বেশী অধৈর্য ও খিটখিটে হয়ে গেছেন। খবরের কাগজ খুললেই শুধু নরহত্যার খবর তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না।
মামুন হঠাৎ পাংশু মুখে বললেন, ভাই, আমাদের কী হবে বলো তো? তোমাদের ইন্দিরা গান্ধী যে একেবারে চুপ মেরে গ্যালেন। আমরা কি আর দেশে ফিরতে পারবো না?
বিমানবিহারী বললেন, কেন, এখানে খুব খারাপ লাগছে?
মামুন বললেন, খারাপ-ভালো লাগার প্রশ্ন নয়। শেষে কি আমাদের টিবেটান রিফিউজিদের মতন দশা হবে? আমাদের কথা সারা পৃথিবী ভুলে যাবে?
বিমানবিহারী বললেন, রিফিউজিদের সংখ্যা সত্তর লাখ ছাড়িয়ে গেছে শুনছি! এত রিফিউজিকে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট কতদিন খাওয়াবে? ইন্দিরা গান্ধীকে একটা কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে। তার আগে দেশের ভেতরকার অবস্থাটা একটু গুছিয়ে নিতে হবে না?
প্রতাপদের কাছেই একটি যুবক এসে দাঁড়িয়েছে এটু আগে। বছর উনিশ বুড়ি বয়েস। খাঁকি প্যান্টের ওপর একটা গেঞ্জি পরা, খালি পা। চুলে অনেকদিন চিরুনি পড়েনি, কিন্তু মুখখানা বড় সুন্দর। মোমের তৈরি কোনো দেবতার মুখের মতন কোমল।
ছেলেটি প্রতাপদের কাথাই যেন শুনছে মন দিয়ে। হঠাৎ সে জামার পকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেট বার করে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে খ্যাসখসে গলায় বললো, দাদা একটু দেশলাইটা দিন তো!
দেশলাই দেবার বদলে প্রতাপের ইচ্ছে হলো ছেলেটির কান মুলে দিতে। আজও প্রতাপ নিজে তাঁর চেয়ে বেশী বয়স্ক ব্যক্তিদের সামনে সিগারেট ধরান না। তাঁদের যৌবনে যে-কোনো অচেনা বয়স্ক ব্যক্তিদেরই গুরুজন মনে করা হতো। এখনকার ছেলেরা যত ইচ্ছে সিগারেট খাবে খাক না, তা বলে বেয়াদপি করবে কেন?
প্রতাপ ছেলেটির কথা না শোনার ভান করে মুখ ফিরিয়ে রইলেন।
ছেলেটি এবার প্রতাপের গায়ে ঠেলা দিয়ে বললো, এই যে দাদা, আগুনটা—
প্রতাপ বললেন, আমার কাছে দেশলাই নেই।
কথাটা মিথ্যে নয়, প্রতাপ বিমানবিহারীর লাইটার থেকে সিগারেট ধরিয়েছেন। মামুন আর বিমানবিহারী নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত। ছেলেটি তবু প্রতাপের ঠোঁটের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, আপনার সিগারেটটা দিন, বিয়ে নিচ্ছি!
রাগে প্রতাপের গা জ্বলছে, তবু কিছু বলা যাবে না। যৌবন এমনই মহা শক্তিমান ব্যাপার যে তার কোনো প্রতিবাদ করা যায় না। প্রতাপ অর্ধ সমাপ্ত সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে ছেলেটিকে দিলেন। সে নিজের কাজ সেরে সেটা আবার ফেরত দিতে এলে প্রতাপ অসীম অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, দরকার নেই, ফেলে দাও!
ছেলেটি মুচকি হেসে নিজের সিগারেটটা টানবার আগে প্রতাপেরটাও দু’টান টেনে নিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, এখানে কিসের মচ্ছব হচ্ছে?
এই ছেলেটির সঙ্গে বাক্যালাপ করার কেনো ইচ্ছে নেই প্রতাপের, তিনি সেখান থেকে সরে গেলেন খানিকটা। ছেলেটির চোখ ঘন ঘন পিট পিট করছে। প্রতাপ সরে এসে ছেলেটির পিঠের দিকটা দেখলেন, তার কাঁধের কাছে কালো গোল গোল দাগ।
ছেলেটি এবার মামুনকে বললো, ও দাদা, এখানে আজ কিসের মোচ্ছব হচ্ছে?
মামুন বললেন, আজ এখানে-সকলে এসেছেন-বিদ্যাসাগরের মূর্তি…
ছেলেটি বললো,ঐ মূর্তিটা তো? ওর মুণ্ডুটা সারিয়েছে, না? মুণ্ডুটা কে ভেঙেছিল জানেন? আমি, আমি, আমি! এই সমীর নাগ!
মামুন ও বিমানবিহারী বিস্ফারিত চোখে তাকালেন ছেলেটির দিকে। বিমানবিহারী বিদ্রূপের সুরে বললেন, তুমি ভেঙেছিলে? কেন ভেঙেছিলে?
ছেলেটি কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, বেশ করেছি! তাতে তোর কী রে শালা?
প্রতাপ বিমানবিহারীর হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনলেন। ছেলেটির চোখ পিটপিটুনি দেখেই সন্দেহ হয়েছিল, এখন স্পষ্ট বোঝা গেল এর মাথায় গোলমাল আছে। এর ধারে কাছে থাকা ঠিক নয়।
তিন প্রৌঢ়ই সরে গেলেন বেশ খানিকটা দূরে। মামুন আপসোসের সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ইস, চেহারা দেখে মনে হয় ভালো ঘরের ছেলে। খালি পায়ে ঘুরছে। নিশ্চয় ছাড়া-পাগল!
ছেলেটি রেলিংয়ের গায়ে ঠেস দিয়ে গলা ফাটিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বললো, অ্যাই শুয়োরের বাচ্চারা শোন, ঐ শুয়োরের বাচ্চা বিদ্যাসাগরের মুণ্ডুটা আমি ভেঙেছি! বেশ করেছি!
বিমানবিহারী বললেন, ঘাড়ের কাছে কালো দাগগুলো দেখছো? খুব সম্ভবত পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করেছে। তারপর পাগল হবার পর ছেড়ে দিয়েছে। কিংবা ওর বাড়ির লোক ইনফ্লুয়েন্স খাঁটিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে। কিন্তু ওকে নজরে রাখা উচিত ছিল।
ছেলেটির চিৎকার অনেকেই শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকিয়েছে। আজ সবাই একটা পবিত্র মনোভাব নিয়ে এখানে এসেছে, তার মধ্যে একি উৎপাত? ছেলেটি পাগল হলেও তার মুখ। যথেষ্ট খারাপ!
ছেলেটি আবার চেঁচিয়ে বললো, আমি সমীর নাগ। পুলিশের বাপকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর আমাকে চেনে কি না। আমি ঐ বিদ্যাসাগরের মুণ্ডু ভেঙেছি। তোরা নতুন করে বসা, আবার ভাঙবো! তোদের ভক্তি-শ্রদ্ধার মুখে আগুন জ্বালাবো! পুরোনো বই পুড়িয়ে দাও, নতুন বই লেখা হবে।
বড় দরের রাজনৈতিক নেতার দেহরক্ষী যুবকেরা এগিয়ে এলো এবার। পাগল-ছাগল যাই হোক, এর মুখে শেয়ানার মতন কথা। পাগল হলেও নকশাল। এ নিজে যদি বিদ্যাসাগরের মুণ্ডু না ভেঙেও থাকে, তবু এ ভাঙাটাকে সমর্থন করে। লাঠি-হাতে এক যুবক রুক্ষ ভাবে বললো, আই, যা বাড়ি যা! ফোট!
ছেলেটি একটা কুৎসিত গালাগালি দিয়ে সেই মাস্তান যুবককে লাথি মারতে গেল। তখন লাঠি তুললো আরও দু’জন। একজন ঐ ছেলেটির মাথাটা রেলিং-এ খুব জোরে ঠুকে দিয়ে বললো, এখানে রংবাজি করতে এসছিস?
মামুন ভয়ার্ত গলায় বললেন, ও বিমান, ওরা ঐ পাগলটাকে মেরে ফেলবে নাকি?
হঠাৎ প্রতাপের চোখ জ্বালা করে উঠলো। তাঁর কোনোদিন এমন হয় না, লোকজনের সামনে তিনি আবেগ দেখানো পছন্দ করেন না। কিন্তু তাঁর মনে হলো, ঐ সুকুমার চেহারার ছেলেটি ঠিক বাবলুর বয়েসী না? বাবলুর মুখের সঙ্গে একটা মিল আছে না?
প্রতাপ ছুটে গিয়ে, অন্যদের ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেরো না, মেরো না, ওকে। ছেড়ে দাও, আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।
একজন মাস্তান প্রতাপের হাত চেপে ধরতেই প্রতাপ কাতর ভাবে বললেন, ও তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। ওকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, দয়া করে ভাই ছেড়ে দাও ওকে, ও আমার খুব চেনা। ও আমার।
তারপর প্রতাপ সেই পাগলটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।