বর্ণ ও শ্রেণী
উপরোক্ত উভয়পুরাণের মতেই করণ-কায়স্থ এবং বৈদ্য-অম্বষ্ঠদের পরেই গোপ, নাপিত, মালাকার, কুম্ভকার, কম কাব, শংখকার, কংসকার, তন্তুবায়-কুবিন্দক, মোদক এবং তাম্বলীদের স্থান। গন্ধবণিক, তৈলিক, তৌলক (সুপারী-ব্যবসায়ী), দাস (চাষী), এবং বারজীবি (বারুই), ইঁহাদেরও সদ্যোক্ত জাতগুলির সমপর্যায়ে গণ্য করা হইত। ইহাদের মধ্যে কৃষিজীবি দাস ও বারজীবি, এবং শিল্প জীবি কুম্ভকার, কর্মকার, শংখকার, কংসকার ও তন্তুবায় ছাড়া আর কাহাকেকও ধনোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যায় না। গোপ, নাপিত, মালাকার, ইঁহারা সমাজ-সেবক মাত্র। মোদক, তাম্বুলী (তাম্লী) তৈলিক-তৌলিক এবং গন্ধবণিকেরা ব্যবসায়ী শ্রেণী, এবং সেই হেতু অর্থোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যাইতে পারে; তবে ইঁহাদের মধ্যে মোদক বা ময়রার ব্যবসায় বিস্তৃত বা যথাযথভাবে ধনোৎপাদক ছিল, এমন বলা যায় না। গুবাক, পান এবং গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায় যে সুবিস্তৃত ছিল তাহা অন্যত্র নানা প্রসঙ্গে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কারণ ও অম্বষ্ঠদের বৃত্তিও ধনোৎপাদক বৃত্তি নয়। করণরা সোজাসুজি কেরাণী, পুস্তপাল, হিসাবরক্ষক, দপ্তর-কর্মচারী; অম্বষ্ঠ-বৈদ্যরা চিকিৎসক। উভয়ই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সাক্ষ্য হইতে স্পষ্টই মনে হয়, স্বর্ণকার ও অন্যান্য বণিকেরা—সুবর্ণবণিকেরা হয়ত ইহাদের অন্তর্গত ছিলেন –আগে উত্তম সংকর বা সংশূদ্র পর্যায়েই গণ্য হইতেন, কিন্তু বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনাকালে তাহারা ‘পতিত’ হইয়া গিয়াছেন। দ্বাদশ শতকে ভবদেব ভট্টও সুবর্ণকারদের নিম্নজাত পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। বল্লালচরিতে যে বলা হইয়াছে বল্লালসেন কোনও কোনও বণিক, বিশেষ ভাবে সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই ইঙ্গিতের যোগ থাকা অসম্ভব নয়। অন্ততঃ এইটুকু স্থম্পষ্ট যে, কোনও না কোনও কারণে অর্থোৎপাদক শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায়ের কোনও কোনও অংশ সমাজে ‘পতিত’ হইয়াছিল, তাহা রাষ্ট্রের নিদেশে বা অন্ত যে কোনও কারণেই হউক।
আশ্চর্য এই যে, সমাজের ধনোৎপাদক অনেক শিল্পী, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের লোকেরাই সংশূদ্র বা উত্তম সংকর বলিয়া গণিত হন নাই। ইহাদের মধ্যে স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, তৈলকার, চিত্রকার, স্বত্ৰধার, শোণ্ডিক বা শুড়ি, তক্ষণ, ধীবর-জালিক-কৈবর্ত অট্টালিকাকার, কোটক প্রভৃতি জগতের নাম করিতেই হয়; ইঁহারা সকলেই মধ্যম সংকর বা অসৎশূদ্র পর্যায়ের। যুঙ্গি-যুগীরা এবং চর্মকারেরাও অর্থোৎপাদক শিল্পী শ্রেণীর অন্ততম; ইঁহারাও অসংশূদ্র বা মধ্যম সংকর। নট সেবক মাত্র, ভবদেব ভট্টের মতে নট নর্তক। চর্মকার, শুড়ি, রজক, ইঁহারা সকলেই নিম্নজাতের লোক। ইঁহারা প্রয়োজনীয় সামাজিক স্তর সন্দেহ নাই, কিন্তু শোণ্ডিক ও চর্মকার ছাড়া অন্য দুইটিকে ঠিক অর্থনৈতিক স্তরের লোক বলা চলে কিনা সন্দেহ। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে চর্মকারেরা একেবারে অন্ত্যজ পর্যায়ে পরিগণিত —তাহাদের বৃত্তির জন্য সন্দেহ নাই। অসংশূদ্র পর্যায়ভুক্ত মল্ল (= মালো, মাঝি?) এবং রজক প্রয়োজনীয় সমাজ-শ্রমিক। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে মল্ল অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত।
সমাজ-শ্রমিকেরা কিন্তু প্রায় অধিকাংশই অন্ত্যজ বা ম্লেচ্ছ পর্যায়ে— বর্ণাশ্রমের বাহিরে তাহদের স্থান। চণ্ডাল, বরুড় (বাউড়ী), ঘট্টজীবি (পাটনী?), ডোলাবাহী (দুলিয়া, দুলে), মল্ল (মালো?), হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী?)—ইহারা সকলেই ত সমাজের একান্ত প্রয়োজনীয় শ্রমিক-সেবক, অথচ ইহাদের স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে। অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিতেছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। ইঁহারা বেদে বা বাদিয়া; বাদিয়ারা সাপখেলা দেখাইয়া বেড়াইত (ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়া ইতি খ্যাতে) ৷ চযাঁগীতিগুলি হইতে ডোম, চণ্ডাল, শবর প্রভৃতি নিম্ন অন্ত্যজ বর্ণ ও কৌমের নরনারীর বৃত্তির একটা মোটামুটি ধারণা করা যায়—বাঁশের তাঁত ও চাঙারি বোন, কাঠ কাটা, নৌকার মাঝিগিরি করা, নৌকা ও সাঁকো তৈরী করা, কাঠ কাটা, মদ তৈরী করা, জুয়া খেলা, তুলা ধোনা, হাতী পোষা, পশু শীকার, নৃত্যগীত ইত্যাদি ছিল ইঁহাদের বৃত্তি। এই সব বস্তু আশ্রয় করিয়াই বৌদ্ধ সহজ-সাধকদের গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি প্রকাশ পাইয়াছে।
শ্রীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত একটি লিপিতে সৎ ও অসৎ শূদ্র উভয় পর্যায়েরই কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ মিলিতেছে। কয়েকটি অজ্ঞাতনামা গোপ, জনৈক কংসকার গোবিন্দ, নাপিত গোবিন্দ, এবং দন্তকার রাজবিগা— ইঁহারা সংশূদ্র পর্যায়ের সন্দেহ নাই, কিন্তু রজক সিরুপা অসৎশুদ্র পর্যায়েব; নাবিক দ্যোজে কোন পর্যায়ের বলা যাইতেছে না।
মনে রাখা দরকার, বর্ণ ও শ্রেণীর পরস্পর সম্বন্ধের যেটুকু পরিচয় পাওয়া গেল তাহা একান্তই আদিপর্বের শেষ অধ্যায়ের। পূর্ববর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে এ-পরিচয় খুব সুস্পষ্ট নয়। তবু, প্রাচীনতর স্মৃতি ও অর্থশাস্ত্রগুলিতে বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধের একটা চিত্র মোটামুটি ধরিতে পারা যায়, এবং অনুমান করা সহজ যে, অন্ততঃ গুপ্ত আমল হইতে আরম্ভ করিয়া বাংলা দেশেও অনুরূপ সম্বন্ধ প্রবর্তিত হইয়াছিল। সেখানেও দেখিতেছি, অনেকগুলি অর্থোৎপাদক শ্রেণী—তাহাদের মধ্যে স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, তৈলকার, গন্ধবণিক ইত্যাদিরা ও আছেন – বর্ণ হিসাবে সমাজে ইঁহারা উচ্চস্থান অধিকার করিয়া নাই, বরং কতকটা অবজ্ঞাতই। আর, সমাজ-শ্ৰমিক যাঁহারা তাঁহারা তো বরাবরই নিম্নবর্ণস্তরে, কেহ কেহ একেবারে অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে। তবে, সমাজ যতদিন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধান ছিল, অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যই ছিল সামাজিক ধনোৎপাদনের প্রধান উপায় ততদিন পর্যন্ত বর্ণস্তর হিসাবে না হউক, অন্ততঃ রাষ্ট্রে এবং সেই হেতু সামাজিক মযাঁদায় বণিক-ব্যবসায়ীদের বেশ প্রতিষ্ঠাও ছিল। কিন্তু সপ্তম-অষ্টম শতক হইতে বাঙালী সমাজ প্রধানতঃ কৃষি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্পনির্ভর হইয়া পড়িতে আরম্ভ করে, এবং তখন হইতেই অর্থোংপাদক ও শ্রমিক শ্রেণীগুলি ক্রমশঃ সামাজিক মযাঁদাও হারাইতে আরম্ভ করে। হাতের কাজই ছিল যাঁহাদের জীবিকার উপায় তাঁহারা স্পষ্টতই সমাজের নিম্নতর ও নিম্নতম বর্ণস্তরে; অথচ বুদ্ধিজীবী ও মসীজীবী যাঁহারা তাঁহারাই উপরের বর্ণস্তর অধিকার করিয়া আছেন এমন কি, কৃষিজীবি দাস-সম্প্রদায়ও অনেক ক্ষেত্রে বণিক-ব্যবসায়ী এবং অতি প্রয়োজনীয় সমাজ-শ্রমিক সম্প্রদায় গুলির উপরের বর্ণস্তরে অধিষ্ঠিত। মধ্য ও উত্তর ভারতে বর্ণস্তরের দৃঢ় ও অনমনীঘ সংবদ্ধতা এবং সমাজের অর্থোৎপাদক ও শ্রমিক শ্রেণীঃস্তরগুলি সম্বন্ধে একটা অবজ্ঞা খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয়চতুর্থ শতক হইতেই দেখা দিতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর পারস্পরিক সম্বন্ধের বিরোধও ক্রমশঃ তীব্রতর হইতেছিল। বাংলা দেশে, মনে হয়, মোটামুটিভাবে পাল আমল পর্যন্ত এই বিরোধ খুব তীব্র হইয়া দেখা দেয় নাই; পাল আমলের শেষের দিকে, বিশেষ ভাবে সেন-বর্মণ-আমলে উত্তর ও মধ্যভারতের বর্ণ ও শ্রেণীগত সামাজিক আদর্শ, অর্থাৎ এই দুয়ের সুস্পষ্ট বিরোধ রূপ ধরিয়া ফুটিয়া উঠিল।