২৬. পথ নির্মাণ করেছেন যারা

পথ নির্মাণ করেছেন যারা

এক

এক একজন লেখক কোন ভাষায় লিখলেন, কী লিখলেন, কেমন লিখলেন, সেটাই বিবেচ্য। তিনি কোন ধর্মমতাবলম্বী, তিনি আস্তিক না নাস্তিক, সেটা তাঁর সাহিত্য বিচারের সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। লেখক কোন দেশের নাগরিক, জাতিসত্তার দিক থেকে তিনি কী– সেটাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তিনি কোন ধর্মাবলম্বী তা বড় ব্যাপার নয়। কাহলিল বা খলিল জিব্রান মূলত আরবি ভাষার প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও মরমি কবি। শেষ জীবনে তিনি ইংরেজিতেও লিখেছেন। তাঁর পরিচিতি তিনি আরবি সাহিত্যের লেখক। জাতীয়তার প্রশ্ন যদি আসে, তিনি একজন লেবানিজ। নাগরিকত্বের দিক থেকে দেখলে তিনি একজন আমেরিকান। তাঁর অশ্রু ও মৃদুহাসি আরবি ভাষায় রচিত, তা পরে আ টিয়ার অ্যান্ড আ স্মাইল নামে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। মূলত ইংরেজিতে রচিত তাঁর দ্য প্রফেট, দ্য ফোররানার, দ্য স্যান্ড অ্যান্ড ফোম প্রভৃতি। লেবাননের আরবি সাহিত্যের লেখক হিসেবেই তার পরিচিতি। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, বাস করতেন নিউইয়র্কে। ইংরেজি ভাষায় লিখলেও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে কাহলিল জিব্রান উল্লিখিত হন না। তিনি মুসলমান না খ্রিষ্টান, সে প্রশ্ন কেউ তোলে না। একই কথা একালের ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তিনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখক। জন্ম তাঁর মুম্বাইতে হলেও পশ্চিমেই থাকেন এবং লেখেন সব সময়ই শুধু ইংরেজিতে, কোনো ভারতীয় ভাষায় নয়। তিনি মুসলমান পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁর আসল নাম ‘আহমদ সালমান রুশদি’। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি তাঁর ফতোয়া দিয়ে রুশদির মুসলমান পরিচয়কে বিশ্বব্যাপী বড় করে তোলেন। তা না হলে তিনি আধুনিক ইংরেজি ভাষার একজন লেখক হিসেবেই শুধু পরিচিতি পেতেন। প্রেম চাঁদ উর্দু ও হিন্দি ভাষার ভারতীয় কথাশিল্পী, তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী কি না তা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। এ ভাষার ইতিহাস লেখকেরা কোনো দিন লেখেন না মুকুন্দ রায়, ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র হিন্দু কবি কথাশিল্পী, এ কথাও কেউ কখনো লেখেন না যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-ব্রাহ্ম কবি। কিন্তু যখন আলাওল, মীর মশাররফ বা নজরুল বা জসীমউদ্‌দীনের নাম আসে, তখন তাদের ধর্মীয় পরিচয়টি অবধারিতভাবে উল্লেখ করা হয়। অন্যান্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে তো বটেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড় বঙ্গীয় সমাজে অনেক গভীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস একেবারে নির্ভেজাল পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের কবি, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কেউ নন, কিন্তু শুধু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পশ্চিমবঙ্গ তাঁকে স্বীকার করে। তিনি মুসলমান হলে তাঁকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আলোচনা-গবেষণা করত না। এদিক থেকে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ অনেক বেশি উদার। এখানকার সাহিত্যসমাজ বাংলা ভাষার যেকোনো কীর্তিমানকে নিজের বলে মনে করে। সে কারণেই শামসুর রাহমানের জন্মমৃত্যু বার্ষিকীতে কলকাতায় এক ছটাকও লেখালেখি হয় না, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখকে নিয়ে এখানে নাচানাচির শেষ নেই।

ওখানকার একশ্রেণির কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশের বাজার ধরার জন্য বাংলাদেশকে চুটিয়ে প্রশংসা করেন, তবে তা করেন ঢাকায় এসে। দেশে ফিরে গিয়ে এখানকার প্রধান লেখকদের সম্পর্কেও দুই লাইন লেখেন না। আমাদের একশ্রেণির লেখক, সাংবাদিকের মধ্যেও একধরনের হীনম্মন্যতা ও দাস্যমনোবৃত্তি বাসা বেঁধেছে। তারা মনে করেন, কলকাতায় গিয়ে কল্কে পেলেই জীবন ধন্য। নির্ভেজাল জাতীয়তাবোধ বিকশিত হলে, স্বাজাত্যচেতনা অম্লান থাকলে এমনটি হতো না। জর্জ বার্নার্ড শ, জেমস জয়েস ইংরেজি সাহিত্যেরই দিকপাল, কিন্তু আইরিশরাই তাদের মনে করে নিজের মানুষ। জয়েসকে নিয়ে আইরিশদের যে অহংকার, ব্রিটিশদের ততটা নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তা থাকায় আমাদেরও সে রকম হওয়ার কথা। নির্মলেন্দু গুণ আমাদেরই কবি, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কেউ নন। তা যে নন তা গুণের উপস্থিতিতে আমি নিজেই কলকাতায় একবার প্রমাণ পেয়ে এসেছি। কয়েক বছর আগে নির্মল এক লাখ টাকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানটি ছিল চমৎকার, উপস্থিতিও ছিল ভালো। কিন্তু না পুরস্কারদাতারা শ্রোতারা কারোই গুণের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হলো না। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলাদেশের কেউ নন, সম্পূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতীয় লেখক, যদিও তার রচনার সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের পরিচয় যথেষ্ট। লেখকের জাতীয়ত্ব ও নাগরিকত্বের পরিচয়টি বড়, তাঁর ধর্মবিশ্বাস নয়।

বাংলা সাহিত্যের মূলধারার হিন্দু লেখকেরা বাঙালি মুসলমান লেখকদের আলাদা সারিতে রাখার পক্ষপাতী, যেমন অনেক আগে একসময় ভোজসভায় হিন্দু-মুসলমান। উচ্চবর্ণের হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হিন্দু আলাদা সারিতে বসতেন। এ ক্ষেত্রে নজরুলই প্রথম ব্যতিক্রম। কবিজীবনের শুরুতেই নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে তার পাশে বসান। ব্যাপারটি প্রতাঁকে পরিণত হয়। বাংলা কাব্যে নজরুলের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের পাশেই। রবীন্দ্রযুগের প্রধানতর একজন কবি জসীমউদ্‌দীন। তাঁকেও ‘পল্লীকবি’, ‘মুসলমান কবি’, ‘পূর্ব বাংলার কবি’ এ রকম নানা অভিধায় ঠেলে দিয়ে বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে সুকৌশলে সরানোর নানা অপচেষ্টা হয়েছে। কৌশলীরা আপাতত কিছুটা সফল হলেও চূড়ান্ত বিজয় জসীমউদ্‌দীনেরই হবে, কারণ তিনি ‘খাঁটি বাংলা ভাষার কবি। তিনি মৌলিক কবি, পশ্চিমের আধুনিক কবিদের অনুকরণ করে আধুনিক কবি’ হওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি।

১৯২০, ৩০ ও ‘৪০-এর দশকে নজরুল ছাড়াও বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী লেখকের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের রচনা যথেষ্ট পরিশীলিত নয়, কিন্তু তাঁরা আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক লেখক। তাঁরা বাঙালি মুসলমানসমাজের সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে আঘাত করে লিখেছেন। সৃষ্টিশীল ওই লেখকদের সব রচনা শিল্পকর্ম হিসেবে বড় কিছু নয়, কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। সেগুলো পাঠ করে বড় লেখকেরা যদি তাদের দুর্বলতাগুলোকে এবং গুণগুলোকে ধরিয়ে দিতেন, তাহলে তারা উৎসাহিত হয়ে হয়তো অপেক্ষাকৃত ভালো লিখতেও পারতেন। তাতে বাংলা সাহিত্য উপকৃত হতো। কিন্তু তারা পেয়েছেন শীতল অবজ্ঞা। অনেকের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু কোনো আনুকূল্য না পাওয়ায় তাঁদের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মুসলমান লেখকদের অনেকেই বহুদিন ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পড়ে থেকে শক্তি ক্ষয় করেছেন। বাংলার পলি মাটিতে তাদের পা দুটি ছিল, কিন্তু তাদের চোখ ও মন ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দিকে। বিশের দশকে অনেক মুসলমান তরুণ কবি-সাহিত্যিক যশোপ্রার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন নজরুল। তারা যে বাঙালি এই আত্মপরিচয় নিয়েও তাঁদের সব দ্বিধা কেটে যায়। পাকিস্তানি জোয়ারে অনেক মুসলমান তরুণ ভেসে গেলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই দশক আগে থেকেই একটি অসাম্প্রদায়িক ক্ষীণ ধারা মুসলমান লেখকেরা সৃষ্টি করেন। সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে কারও কারও রচনায়। তাঁরা কোনো দিক থেকেই কোনো আনুকূল্য পাননি। বামপন্থী কবি হিসেবে অকালপ্রয়াত সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বীকৃতি পান। কিন্তু তারও আগে যশোরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার অধিবাসী আশরাফ আলী খান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং শ্রমজীবী ও সর্বহারাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯২০-২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বহু পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেও জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারেননি। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ১৯৩৯ সালে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কংকাল একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতায় কাব্যগুণের অভাব কোথায়–

ওগো রাজপথ কোথা পেলে এত গভীর মায়ের স্নেহ?
তোমার বুকের স্নেহ-সুধা হতে বঞ্চিত নয় কেহ;
ধনীরা চালায় গাড়ি-ঘোড়া ওই বুকের উপর দিয়া,
দুখীরা ঘুমায় দুই বাহু ‘পরে ক্ষীণ দেহ এলাইয়া;
যেই অভাগার দাঁড়াবার স্থান জগতে কোথাও নেই;
তুমি দাও তব বিশাল বক্ষে যত্নে তাহারে ঠাঁই।

আশরাফ আলী খান ইকবালের উর্দু কাব্যগ্রন্থ শেকোয়ার বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর ওই তর্জমার তারিফ করেছেন নজরুল। এ ধরনের মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু চিন্তাচেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল।

বাঙালি মুসলমান আত্মঘাতী ও বিস্মৃতিপ্রবণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আশরাফ আলী খানের যেমন ঠাঁই হয়নি, যথেষ্ট সাহিত্যকর্ম তার নেই, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতায় তাঁর যে দান, তা-ও স্বীকৃতি পায়নি। বঙ্গীয় মুসলমানদের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনায় যারা পথিকৃৎ, আশরাফ আলী তাঁদের একজন। আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ রয়েছে। সেগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের কজন আশরাফ আলীর নামটি জানেন? ১৯২৮-২৯ সালে তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ছোলতান-এর সম্পাদক। বিশের দশকে মুসলমানদের একটি ইংরেজি দৈনিক ছিল দ্য মুসলমান। সম্পাদক ছিলেন মজিবর রহমান। কুড়ি শতকের প্রথম দিকের বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনার ইতিহাস রচনার জন্য দৈনিক ছোলতান, দ্য মুসলমানের সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। আমি দ্য মুসলমান ঘেঁটেছি কিন্তু দৈনিক ছোলতানের কপিগুলো দেখার। সুযোগ পাইনি। উল্লেখযোগ্য যে, ছোলতান নামে একটি সাপ্তাহিকও ছিল, যা সম্পাদনা করেছেন মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। দৈনিক ছোলতানেরও প্রধান পরিচালক ছিলেন তিনি। পথনির্মাতাদের ভুলে যেতে নেই।

বিত্তহীন ও মুসলমান বলে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কলকাতায় মর্যাদা পাননি। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ছিলেন বলে ডা. লুৎফর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। উন্নত জীবন, মানব জীবন, মহৎ জীবন প্রভৃতি বইয়ের সাহিত্যমূল্য যতটা, তার চেয়ে বেশি এগুলোর জীবন গঠনে ভূমিকার জন্য। তাঁর লেখাগুলো অনুপ্রেরণাদায়ক, যা একটি অনগ্রসর সমাজে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে খুবই প্রয়োজন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও সমাজসংস্কারক। লুৎফর রহমান সম্পর্কে মাসিক সওগাত মন্তব্য করেছিল :

‘[তাঁর থেকে] অনেক রচনা পাইবার আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত; এত বড় একজন শক্তিশালী লেখককে আমরা হারাইতে বসিয়াছি। বিগত কয়েক মাস যাবত তিনি কঠিন ক্ষয়কাস রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহার জীবনের আশা খুব কম। অর্থাভাবে চিকিৎসা হইতেছে না।]

[সওগাত, শ্রাবণ ১৩৩৩] তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসা সহায়তার জন্য ‘সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি মুসলমানসমাজ থেকে। নারীমুক্তি আন্দোলননের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ প্রবক্ত। গঠন করেছিলেন ‘নারী তীর্থ’ নামে একটি সংগঠন। নির্যাতিতা নারীদের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল নারী তীর্থ। নারী তীর্থের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লুৎফর রহমান সওগাতে লিখেছিলেন :

‘নারীর সুবিপুল দুর্ভাগ্যের বোঝা, তাহার জীবনের শত দুর্দশার কথা আমরা অবগত আছি। নারীর প্রতি যে অসহ্য রকম অবিচার হইতেছে, ইহার সাহস করিয়া বলিবার প্রয়োজন আমরা অনুভব করিতেছি। নারীকে লইয়া বাঙলার পথে ঘাটে যে রহস্য-লীলা চলিয়াছে, ইহার বিরুদ্ধে এবং নারীর অন্য সকল প্রকার দুঃখের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করিলাম।

‘নারী জীবন ব্যর্থ হইয়া যাওয়াতে আমাদের জীবনের কাজও ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আজ নারী-পুরুষ সবাইকে শক্তি-সাধনায় জাগ্রত হইতে হইবে। দিকে দিকে নারী-জীবনের জয়-সঙ্গীত ধ্বনিত হোক।’

মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, “দুঃখের বিষয় শারীরিক অসুস্থতার দরুন ও অর্থের অভাবে তিনি “নারী তীর্থ” সংঘটি পরিচালনা করতে পারেননি। … অর্থাভাবে তাহার উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। অকালে এই মহান লেখক ও চিন্তাবিদের জীবনদীপ নির্বাপিত হইয়াছে।

দুই

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চার একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে ঢাকায়, যেমনটি অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। ওই সময়ের নতুন লেখকদের বন্ধুচক্রটি বিশেষ ছোট ছিল না। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ। বয়সে ছিলেন চার-পাঁচ বছরের ছোট-বড়।

তরুণ লেখকদের মধ্যে ছাত্র হিসেবে মেধাবী এবং লেখক হিসেবে নিষ্ঠাবান ছিলেন আজাদ। তিনি আড্ডায় সময় দিতেন কম, লেখালেখিতে সময় দিতেন বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই তাঁর বেশ কয়েকটি বই বেরিয়ে যায় এবং তিনি অল্প সময়ে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। শামসুর রাহমান তাঁকে আখ্যায়িত করতেন ‘সাব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা” বলে। রাহমান তার স্মৃতিকথা কালের ধুলোয় লেখাতে বলেছেন :

‘আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাদের কালের বিরল এক প্রতিভাবান সব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা। … আমরা যারা পঞ্চাশ দশকের লেখক বলে চিহ্নিত তাদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ শুরু থেকেই একজন নামজাদা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’

প্রায় সব বয়সী এবং বন্ধুপ্রতিম আজাদ সম্পর্কে রাহমানের ধারণা ছিল খুবই উঁচু। সমসাময়িকদের মধ্যে খ্যাতির প্রশ্নে যে অসূয়া থাকা স্বাভাবিক, তিনি ছিলেন তা থেকে মুক্ত। আজাদ সম্পর্কে রাহমানের বক্তব্য তাঁর প্রমাণ। তিনি লিখেছেন :

‘আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখনী কখনো আলস্য পোহায়নি; জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, নানামুখী সাফল্য তাঁকে আত্মতুষ্টির মোহে আটক রাখতে পারেনি। তিনি লিখে গেছেন অনবরত, এখনও লিখে চলেছেন, প্রশংসিত হচ্ছেন বিজ্ঞ সমালোচক এবং উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা মহলে। ঈর্ষাযোগ্য তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষমতা। গোড়ার দিকে তাঁর জীবনযাত্রার পথ পুষ্পময় ছিল না, অভাবের কাটার খোঁচা তাঁকে খেতে হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রতিভার উজ্জ্বলতা যার সত্তাকে লালন করে, কোনও বাধা, কোনও অভাব কিংবা বহুরূপী প্রতিকূলতা তাঁর অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে পারে না। তাই আজাদ রূপকথার নায়কের মতো অভাবের রাক্ষসটিকে সাধনার ক্ষুরধার অস্ত্রের আঘাতে বধ করে গোছানো, নিরাপদ, ঝলমলে সংসাররূপী রাজকন্যার সঙ্গে সুখী জীবনযাপন করছেন।

আজাদের সঙ্গে শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। উভয়ের জীবনযাপনের ধরনও ছিল ভিন্ন। রাহমান ছিলেন অবৈষয়িক, অরাজনৈতিক সাদাসিধা মানুষ। শেষ জীবনে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে দূরত্ব রচিত হয়েছিল। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং সে সম্পর্কে বলতে গেলে দীর্ঘ আলোচনা করতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যখন শিথিল, সেই সময়ও শামসুর রাহমান আজাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন :

‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আল আজাদ কস্মিনকালেও স্থবিরতাকে মেনে নেবেন না; কারণ তিনি আমাদের একজন প্রধান লেখকই নন, একজন অত্যন্ত সচেতন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষও। আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তিনি তোলেন না বলেই জানি। তিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। পিএইচডি করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশের শিক্ষা বিভাগের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন ডক্টর আলাউদ্দিন আল আজাদ। তবে ভবিষ্যৎ তাকে কুর্নিশ করবে এ দেশের একজন প্রতিভাবান লেখক হিসেবেই।’

কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে তিনি যখন অনার্সের ছাত্র, তখন ১৯৫১-তে কলকাতায় এক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যান। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। শামসুর রাহমান সে প্রসঙ্গে জানান, ‘শান্তি সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেই প্রগতিশীল লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে কিছুদিন কাটাতে হয়। … প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্যে তাকে পাকিস্তান আমলে দুবার কারারুদ্ধ হতে হয়।’

জীবনের প্রথম দিকে জেলজুলুম সহ্য করেছেন, আজাদের শেষ জীবনটাও দুঃখভারাক্রান্ত। ডায়াবেটিসে ভুগেছেন বহুদিন। একমাত্র ছেলেটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছাত্ররা অনেকেই রাষ্ট্রের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাদের সহযোগিতা তার প্রত্যাশিত ছিল। চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে দেশের জন্য অনেকের কাছে গেছেন। দু-একবার আমি তাঁর সঙ্গী হয়েছি। কোনো আনুকূল্য পাননি। প্রীতিভাজনদের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন বটে, কিন্তু সে কষ্ট সামান্য কষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে প্রিয়তম পুত্রকে নিয়ে তিনি যে আঘাত পান, তা পৃথিবীতে যেকোনো পিতার জন্যে সর্বোচ্চ আঘাত। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে তাঁর ছেলে মারা যান। ওই সময় মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। যখন পুত্রের প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে দিতেন, আমি সইতে না পেরে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে কোনো অজুহাতে ফোন রেখে দিতাম। পুত্রের মৃত্যুর অল্পদিন পরই তিনিও মারা যান। তবে সন্দেহ নেই, একদিন তার মূল্যবান সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন হবে, রচিত হবে তার জীবন নিয়ে গ্রন্থ।

ব্যাপারটি কাকতালীয়। যা ছিল আমার শৈশবকাল ও কৈশোরের সময়, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যেরও সেটি শৈশবকাল।দেড়শ বছরের কলকাতার প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে এসে এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতি, তাদের স্বপ্ন ও বাস্তব, তাদের হতাশা ও বঞ্চনার কথা তাদের নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করার সুযোগ পায়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল পিছিয়ে থাকায় তাদের যোগ্যতার অভাব ছিল। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল থাকায় কলকাতায় তাদের কেউ জায়গা দেয়নি, মর্যাদা দেয়নি। আত্মপ্রকাশের জন্য একটা ভূখণ্ড চাইছিল তারা, যেখানে ঘটবে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। সেই ভূখণ্ডটি তারা অর্জন করে ১৯৪৭-এ। ফলে আত্মপ্রকাশ ঘটে একদল কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পীর।

যারা পথ নির্মাণ করেন, তাদের দোষ ও দুর্বলতা ক্ষমার অযোগ্য নয়। যে উদ্যানে গোলাপ, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি নেই, সেখানে ভাঁটফুল বুনোফুল যা-ই ফুটুক, তাকে কদর না করে উপায় নেই। ১৯৪৮ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত ঢাকা থেকে যেসব গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর লেখকদের অমূল্য সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, অন্য কারণে মর্যাদা প্রাপ্য। তাঁদের তৈরি মেঠো পথটিই ৫০ বছরের মধ্যে সুপরিসর পিচঢালা সড়কে পরিণত হয়েছে।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে একটি উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। সেটি আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত। তাঁর আরেকটি উপন্যাস কী পাইনি। দুটি উপন্যাসই আমাদের বাড়িতে পঠিত হয়েছে, আমিও পড়েছি, অন্যদেরও পড়তে দেখেছি। শিল্পকর্ম হিসেবে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু উপন্যাস দুটি ১৫-২০ বছর খুবই জনপ্রিয় ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো সংস্করণ হয়। এবং জনপ্রিয়তার কারণেই ষাটের দশকে অবাঞ্ছিতর কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্র হয়েছিল এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। মনে পড়ে আমিও দেখেছিলাম কারও সঙ্গে।

আকবর হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় ষাটের দশকের প্রথম দিকে। তখন আমার কিছু গল্প-কবিতা পত্রপত্রিকায় বেরোচ্ছে। কবি জসীমউদ্‌দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাহিত্য সাধনা সংঘ’। প্রতি সপ্তাহে ওই সংগঠনের বৈঠক বসত কমলাপুরে, কোনো দিন জসীমউদ্‌দীনের বাসভবন ‘পলাশবাড়ীতে, কোনো দিন তাঁর প্রতিবেশী অবাঞ্ছিতের লেখক আকবর হোসেনের বাড়িতে এবং কোনো দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জিয়াউল হকের বাসভবনে। তরুণ ও প্রবীণ ২৫-৩০ জন কবি-সাহিত্যিক সেই রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন। লেখকেরা তাঁদের রচনা পাঠ করতেন। তা নিয়ে আলোচনা করতেন অন্যরা। মাঝে। মাঝে ওই বৈঠকে আসতেন অজিত গুহ, জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তাঁর আলোচনা হতো খুবই বস্তুনিষ্ঠ ও মনোজ্ঞ । সাহিত্যের আসর শেষ হলে কোনো দিন অজিত গুহের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর হাটখোলার বাসস্থান ‘টয় হাউসে’ যেতাম। তিনি ছিলেন অসামান্য সংস্কৃতিমান মানুষ। আমাদের মতো কবিযশোপ্রার্থীদের অকৃপণভাবে উৎসাহ দিতেন।

সাহিত্য সাধনা সংঘের আসরে প্রবীণদের মধ্যে যেতেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, জয়নুল আবেদিন, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, কবি-গীতিকার আজিজুর রহমান, প্রাবন্ধিক আবদুল হক প্রমুখ। আরেকজন প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন, তিনি হলেন রাচি মানসিক হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। তিনি ছিলেন নজরুলের চিকিৎসক। আমি ১৯৬৪ সালে সাহিত্য সাধনা সংঘের এক বৈঠকে নজরুলের ওপর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। সেই কাঁচা রচনাটির ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন অজিত গুহ, আজিজুর রহমান ও মোহাম্মদ হোসেন। নজরুলের অসুস্থতা নিয়ে এবং তাঁর সেই সময়ের অবস্থা নিয়ে ডাক্তার হোসেন বহু মূল্যবান তথ্য দিয়েছিলেন। সম্ভবত ডাক্তার হোসেনের ভায়রা ছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শফিকুল আমিন। তিনিও মাঝে মাঝে জসীমউদ্‌দীনের রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন।

সাহিত্য সাধনা সংঘের সাহিত্য আলোচনার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না তাতে পরিবেশিত নাশপানি। জসীমউদ্‌দীনের কৃপণতা সম্পর্কে নানা সত্যমিথ্যা গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্যের বৈঠকে যারা যোগ দিতেন, তাঁদের তিনি অকৃপণভাবে আপ্যায়িত করতেন। যেদিন আকবর হোসেনের বাড়িতে বৈঠক হতো, সেদিন খানাপিনার আয়োজন থাকত পর্যাপ্ত। তিনি চাকরি করতেন অ্যাকাউনট্যান্ট জেনারেলের অফিসে। চাকরি ছাড়াও তাদের পারিবারিক অবস্থা ছিল ভালো। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী মহকুমার কেয়া গ্রামে। তাঁর সঙ্গে আমার এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে একবার মধ্য-৬০-এ তিনি আমাকে তাদের গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। চার-পাঁচ দিন ছিলাম সেখানে। তাঁর বৃদ্ধ বাবা ও ছোট ভাই নূরুদ্দীনের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাঁদের সঙ্গে আমি গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক-প্রকাশক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে যাই। হরিনাথের এক নাতি, তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হয়। কাঙালের গানের কিছু বই আমাকে উপহার দেন। স্মরণীয় যা তা হলো, যে মেশিনে দেড় শ বছর আগে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মুদ্রিত হতো, সেটি দেখতে পাই। ছোট ট্রেডল মেশিনটি তখনো চালু ছিল। অল্পসল্প ছাপার কাজ তাতে হতো। কাঙালের নাতির তা থেকেই খুব কষ্টে জীবিকা নির্বাহ হতো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমি মাস তিনেক জসীমউদ্‌দীন ও আকবর হোসেনের প্রতিবেশী ছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নিলে প্রথমেই আমি তাঁদের দুজনের সঙ্গে দেখা করি। তারা পরামর্শ দেন কোনো রকমে ঢাকার বাইরে যেতে। পূর্ববর্তী তিরিশ ঘণ্টার নারকীয়তার পর অস্পষ্ট অবস্থায় পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা বোঝার সাধ্য কারোরই ছিল না। যা হোক, আকবর হোসেনের আরও কয়েকটি উপন্যাস পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রকাশিত হয়, যেমন মোহমুক্তি, ঢেউ জাগে প্রভৃতি। তত দিনে নতুন যুগের কথাশিল্পীদের আবির্ভাব ঘটেছে।

তিন

আমাদের শৈশব-কৈশোরে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে যাদের সক্রিয় দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবাই আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের কেউ তাঁদের নামটিও জানেন না, তাঁদের লেখার সঙ্গে পরিচয় তো নেই-ই। একটি বনে কত উদ্ভিদই জন্মে কিন্তু টিকে থাকে অল্প, বৃক্ষে পরিণত হয় আরও অল্প কয়েকটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পনেরো-আনা’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘মরার পরে অল্প লোকেই অমর হইয়া থাকেন, সেইজন্যই পৃথিবীটা বসবাসযোগ্য হইয়াছে। ট্রেনের সব গাড়িই যদি রিজার্ভ গাড়ি হইত তাহা হইলে সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের গতি কী হইত?… জীবন বৃথা গেল। বৃথা যাইতে দাও। অধিকাংশ জীবনই বৃথা যাইবার জন্য হইয়াছে। এই পনের আনা অনাবশ্যক জীবনই বিধাতার ঐশ্বর্য সপ্রমাণ করিতেছে।’

শিল্প-সাহিত্যজগতের গৌণদের নিয়ে ভাবতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথাটিকে দামি মনে হয়। তাঁর ভাষায়, ‘জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও। কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে –তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন-ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে। আর কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে।’ কোনো জাতির শিল্প-সাহিত্যের জগৎটিও প্রবহমান নদীর মতো। শুধু অল্প কয়েকজন প্রধান তাঁকে প্রাণবন্ত রাখতে পারেন না, সজীব রাখতে গৌণদের ভূমিকাই বেশি।

১৯৫৫-তে আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি প্রকাশের আগে আরও অনেকে তাঁদের গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশ করেছেন। কবিতার বইও বেরিয়েছে কারও কারও। সেকালে দুজন বেদুইন ছিলেন, একজন বেদুইন সামাদ এবং আরেকজন বেদুইন শমসের। উভয়েরই লেখনী-নাম, আসল নাম ছিল অন্য। বেদুইন সামাদ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় আসেন। তিনি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেলাশেষে, পথে যেতে যেতে এবং নিষ্পত্তি প্রকাশিত হয় মধ্য-৫০ বা ওই দশকের শেষে। মোটের ওপর তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বেদুইন শমসের ছিলেন আইনজীবী, ফরিদপুরের অধিবাসী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর কয়েকটি উপন্যাস : রিকশাওয়ালা, বেঈমান, বুড়িগঙ্গার বুকে, কাঁটা ও ফুল প্রভৃতি। দুই বেদুইনই সেকালে বিভিন্ন সাময়িকীতে লিখতেন। তবে উভয়েই কর্মজীবনে ঢাকার বাইরে থাকায় মূলধারার লেখকদের সঙ্গে ছিল তাঁদের অনতিক্রম্য দূরত্ব। সে কারণেই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই হারিয়ে যান।

সরদার জয়েনউদ্দিনের আদিগন্ত, শামসুদ্দীন আবুল কালামের আলমনগরের রূপকথা, আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান পঞ্চাশের প্রথম দিকেই প্রকাশিত হয় এবং কথাশিল্পী হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পান। পরে অবশ্য তাঁরা আরও পরিণত উপন্যাস লিখেছেন। তাঁদের রচনার বিষয়বস্তু ইসলাম তথা পাকিস্তানি ধ্যানধারণা নয়, দেশের সাধারণ মানুষ।

পঞ্চাশের দশকে ছোটগল্প লিখে যারা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ষাট ও সত্তরের দশক পর্যন্ত খ্যাতি ধরে রাখতে পেরেছিলেন, অনেকেই হারিয়ে যান। কেউবা লেখাই ছেড়ে দেন। ওই দশকে যারা ছোটগল্পকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ সাবের, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মিরজা আবদুল হাই, সুচরিত চৌধুরী পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিলেন।

শহীদ সাবের ছিলেন চল্লিশের দশকের বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পরে কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের নজরে পড়েন এবং পঞ্চাশের প্রথম দিকে কয়েকটি বছর বিনা বিচারে কারাগারে কাটান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৫-তে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্প সংকলন এক টুকরো মেঘ। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি যখন বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে তাঁকে দেখেছি, তখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। টেবিলে বসে আপনমনে লেখালেখি করলেও কথাবার্তা বিশেষ বলতেন না। অনেকগুলো বছর সংবাদই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। সংবাদ যেন একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের একজন স্থায়ী সদস্যের মতো ছিলেন শহীদ সাবের। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি সংবাদ অফিসেই ছিলেন। পরবর্তী তিন-চার দিনে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও তিনি সংবাদেই থেকে যান। ৩০-৩১ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংবাদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়, ভেতরে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একজন চরম নিরীহ মানুষ মারা যান। শহীদ সাবেরের কবিতাও বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

হাসান হাফিজুর রহমান সংগঠক হিসেবে ছিলেন অসামান্য। অন্যকে লেখায় উৎসাহ দেওয়ায় ছিলেন অদ্বিতীয়। ছিলেন অসামান্য বন্ধুবৎসল। গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখতেন। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত তাঁর আরও দুটি মৃত্যু গল্পটি প্রশংসিত হয়েছিল। গল্পকার হিসেবে সাইয়িদ আতীকুল্লাহর হাত ছিল ভালো। পঞ্চাশ ও ষাটে কয়েকটি গল্প লিখে তিনি একজন আধুনিক গল্পকার হিসেবে পরিচিতি পান, কিন্তু একপর্যায়ে লেখা ছেড়ে দেন। কিছুই যখন লিখছেন না, চাকরি করছিলেন ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তার, অথচ লেখার শক্তি আছে। আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতাম, যদিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নীরস প্রকৃতির মানুষ। স্বাধীনতার পরে আমি তাঁকে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করি। আমি তখন সময় নামে একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশ করছিলাম। তার প্রথম সংখ্যায় তাঁকে একটি লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বললাম, একটা কবিতা অন্তত দিন। তিনি দিলেন একটি কবিতা। কেউ কেউ প্রশংসা করল। সেই যে তিনি কবিতা লেখা শুরু করলেন, আমৃত্যু শুধু কবিতাই লিখলেন। অনেকগুলো কবিতার বইও বের হলো। তাঁর কবিতায় রসের লেশমাত্র ছিল না। শেষ জীবনে সংবাদে কাজ করেছেন এবং ক্যানসারে মারা যাওয়ার আগে প্রেসক্লাবেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন।

আতীকুল্লাহর শেষ গল্পটি আমি তাকে অনুরোধ করে লিখিয়ে ত্রৈমাসিক নাগরিক-এ ছেপেছিলাম উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পরে। তাঁকে দিয়ে শেষ গল্প আমি লিখিয়েছি এবং প্রকাশও করেছি, এবং তাঁর প্রথম কবিতাও আমি অনুরোধ করে লিখিয়ে আমার পত্রিকায় ছেপেছি। আতীকুল্লাহকে দিয়ে চাপ দিয়ে লেখানোর কারণ তার পড়াশোনা ছিল। আধুনিক সাহিত্য কী তা তিনি বুঝতেন। কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে পণ্ডশ্রম করে শক্তি ক্ষয় করেন, সাহিত্যের কোনো উপকার করতে পারেননি।

বাংলাদেশে ছোটগল্পের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। যথেষ্ট ভালো লিখছিলেন অনেকেই। তবে নিষ্ঠাসহকারে চর্চা অব্যাহত রাখতে পারেননি তাঁরা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষা ভালো ছিল। বাহুল্যবর্জিত ও মার্জিত। চট্টগ্রামের সুচরিত চৌধুরীর গল্পের স্বাদ ছিল আলাদা। তাঁর গল্পের বই আকাশে অনেক ঘুড়ি ভালো লেগেছিল। মিরজা আবদুল হাই কয়েকটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির সূত্রে তাঁকে তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে হয়েছে, যে জন্য বাংলাদেশের মূলধারার লেখকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সত্তর ও আশির দশকে তার সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর একটি গল্প ‘মেহেরজানের মা’ পড়ে সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটি ছবি করার উপযুক্ত। আমাদের কোটারিবিশিষ্ট সাহিত্যজগতে দলছুট মিরজা আবদুল হাই জায়গা করে নিতে পারেননি। অবহেলিত থেকেই মারা যান।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহিলা কথাশিল্পী ছিলেন হাতে গোনা। নূরুন নাহার নামের একজন ছোটগল্পকারের দেখা পাওয়া যায় ‘৪৭-এর পরে। সম্ভবত তিনি থাকতেন চট্টগ্রামে, তবে শুনেছি তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রী। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পঞ্চাশের দশকে তাঁর খুবই খ্যাতি ছিল। সমাজের আনুকূল্য পাননি। ঢাকার বাইরের লেখকেরা মূলধারা থেকে প্রায়ই পান অবহেলা। তিনিও অবহেলায় আজ হারিয়ে গেছেন। অথচ তিনি সামান্য লেখিকা ছিলেন না।

নূরুন নাহারের একটি কবিতার বই অগ্নি ফসল প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম থেকে। পঞ্চাশের দশকেই প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্পের বই বোবা মাটি যথেষ্ট নাম করেছিল। সম্ভবত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। নূরুননাহারের বই নিয়ে চৌধুরী ছোট একটি আলোচনা লিখেছিলেন। নূরুন নাহারের দুটি উপন্যাসও বেরিয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। সেগুলো জাঙ্গালের মেয়ে এবং রূপালী হৃদয়ের তীরে। আজ আমাদের অনেক মহিলা কথাশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের পথ যারা তৈরি করেছিলেন প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁদের ঋণ অস্বীকার করা যায় না।

পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার ও সম্পাদকের নাম আহমদ মীর, আজ তিনি বিস্মৃত। তার আসল নাম মহিউদ্দিন আহমদ। হুগলীর অধিবাসী। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বহু মুসলমানের মতো তিনিও পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তার কয়েকটি গল্প অসামান্য। তাঁর গল্পগ্রন্থ লাল মোতিয়া বেরিয়েছিল ষাটের দশকে, কিন্তু গল্প লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন পঞ্চাশের দশকেই। তাঁর ‘ধোবিয়া তালাও’ গল্পটি আমার কাছে আছে। চমৎকার গল্প।

মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পাক জমহুরিয়াত পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। ওই পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। আমার সেদিনের আনন্দের কথা পৃথিবীর কোনো মানুষকে বোঝাতে পারব না। পঞ্চাশের দশকে স্পন্দন নামে একটি মাসিকপত্র তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমার আব্বা তার গ্রাহক ছিলেন। তারপর তিনি বের করেন একটি পাক্ষিক রম্য পত্রিকা রমনা। সেটিরও আমরা গ্রাহক ছিলাম। সেকালে একটি পত্রিকার নতুন সংখ্যাকে অমূল্য সম্পদ মনে হতো। এক লেখা কয়েকবার পড়তাম।

মহিউদ্দিন আহমদ ওরফে আহমদ মীরের আরেকটি পরিচয় তিনি ছিলেন ‘বার্ডস অ্যান্ড বুকস’ নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিক। আধুনিক সব বই তিনি প্রকাশ করতেন। চমৎকার তার প্রকাশনার মান। গেটআপ, ছাপা, বাঁধাই সুন্দর। তিনি কিছুদিন চাকরি করেছেন মার্কিন পরিক্রমা নামক একটি পত্রিকায়। মার্কিন ছোটগল্পকার এডগার এলান পোর অনেকগুলো গল্পের তিনি অনুবাদ করেন। সেগুলো তাঁর প্রকাশনা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন। তাঁর ওই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে একটি সময় মহিউদ্দিন আহমদ একটি অতি ভালো গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন।

চার

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯৬০ সালে। দ্বিতীয় বছর ১৯৬১ সালে কবিতায় আহসান হাবীব, উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ছোটগল্পে মবিনউদ্দীন আহমদ, নাটকে নূরুল হোসেন, গবেষণা প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই এবং শিশুসাহিত্যে বেগম হোসনে আরা পুরস্কৃত হন। মবিনউদ্দীন আহমদ আজ বিস্মৃত। যে লেখক আহসান হাবীব, ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাঁর নিশ্চয়ই পাঠযোগ্য সাহিত্যকর্ম থাকবে। সেকালে এখনকার মতো দলীয় রাজনীতির ব্যাপার ছিল না বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে। তা থাকলে সত্যেন সেনের মতো কমিউনিস্টের বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো না সামরিক শাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আমলে।

আজ বাংলাদেশের সাহিত্যে মবিনউদ্দীনের নামনিশানা নেই। তাঁর এভাবে হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুবই সহজ। তিনি বিত্তবান ছিলেন না। কোনো প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা রেখে যাননি। তিনি কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন না অথবা যুগ্ম সচিবের ওপরের পদে চাকরি করেননি।

যদি থাকত তার প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা অথবা কোনো নামীদামি পত্রিকার সম্পাদক তাঁর গুণগ্রাহী, তাহলে ২০১২ সালে তারা ঘটা করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করতেন। ওসব বাদ দিলেও বাংলাদেশে যদি একাডেমিক পর্যায়ে মৌলিক গবেষণার রেওয়াজ থাকত, তাহলে কেউ তার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতেন। মবিনউদ্দীন কোনো প্রকাণ্ড বড় লেখক ছিলেন না, কিন্তু লেখক তিনি ছিলেন এবং শুধু লেখকই ছিলেন। বেশ কিছু চমৎকার ছোটগল্প রয়েছে তাঁর। তিনি সেই সময় পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যের চর্চা করেছেন। যখন বড় মাপের লেখক এখানে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না।

মবিনউদ্দীন ছিলেন অতি সজ্জন, নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। তিনি যে একজন খ্যাতিমান লেখক, সে রকম কোনো অহংকার তাঁর আচরণে প্রকাশ পেত না। পঞ্চাশের দশকে আমি তাঁকে দেখেছি। তার সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল, যদিও আব্বা তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি তাঁকে দেখেছি পাটুয়াটুলী লয়াল স্ট্রিটে সওগাত অফিসে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সম্পাদকীয় দপ্তরে। মবিনউদ্দীন চাকরি করতেন ঢাকা জজ কোর্টে। সম্ভবত ছিলেন নিচের পদের কোনো কর্মকর্তা।

মবিনউদ্দীনের জন্ম ১৯১২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার পারিল নওয়াদা গ্রামে। তাঁদের পরিবার ছিল গ্রামীণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার। তাঁর এক চাচা ছিলেন ঢাকার সাব-ডেপুটি কালেক্টর। পরিবারের অনেকেই ছিলেন শিক্ষিত। কথাসাহিত্যিক মতীয়র রহমান খান তাঁদেরই পরিবারের সদস্য। মবিনউদ্দীন কলকাতা বঙ্গবাসী বা সিটি কলেজ থেকে চল্লিশের দশকে বিকম পাস করেন। আইকম পাস করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় চাচা-মামাদের অভিভাবকত্বে তিনি বেড়ে ওঠেন। সে জন্য তাকে কষ্ট করতে হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে একজন গ্র্যাজুয়েট মুসলমান চেষ্টা করলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। মবিনউদ্দীন ছিলেন সাহিত্যগত প্রাণ। কোর্টে চাকরি এবং লেখালেখি ছাড়া তিনি আর কিছুই করেননি। সেকালে তাঁর চেয়ে ছোট চাকুরে ঢাকায় বিষয় সম্পত্তি করেছেন। তাঁর সে আগ্রহ ছিল না। কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ছিলেন তাঁরই এলাকার মানুষ। মঈনুদ্দীনের বাংলাবাজার আলহামরা লাইব্রেরিতেও তিনি সন্ধ্যার দিকে যেতেন। তাঁর কোনো একটি বই আলহামরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে থাকতে পারে বলে মনে পড়ছে।

মবিনউদ্দীন মূলত ছোটগল্পই লিখতেন। একটি উপন্যাসও তার আছে। তাঁর ছোটোগল্প সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে কলঙ্ক (১৯৪৬), সাহানা (১৯৪৮), হোসেন বাড়ির বউ (১৯৫২), ভাঙা বন্দর (১৯৫৪), কুদরত খার ভিটে (১৯৫৫), মুখচর (১৯৫৬), বুনো শয়তান (১৯৫৬) প্রভৃতি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অনেক লেখাই অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন নতুন যুগের কেউ তাঁকে চেনে না। দুই লাইন মৃত্যুসংবাদ কোথাও বেরিয়েছিল বলে মনে পড়েনি। কেউ শোক প্রকাশ করেনি।

মবিনউদ্দীনের ‘সন্তান’ শীর্ষক একটি ছোটোগল্প পড়ে ভালো লেগেছিল বলে এখনো মনে আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের জীবনের দুঃখ-সুখ-দ্বন্দ্ব, তাদের হতাশা প্রভৃতি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। তার হোসেন বাড়ির বউ বইটি তিনি আমার আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর শৈল্পিক গুণাগুণ সম্পর্কে এখন বলতে পারব না। তবে পঞ্চাশের দশকে তিনি যথেষ্টই পঠিত ছিলেন এবং খ্যাতিমান ছিলেন। ষাটের দশকের প্রজন্ম থেকে উপযুক্ত মর্যাদা না পেয়ে আড়ালকেই বেছে নেন মবিনউদ্দীন আহমদ তাঁর জীবনের শেষ দুটি দশক। তাঁর উত্তরসূরিরা জানেন না যে তাঁদের পথনির্মাতাদের তিনি একজন।

সরদার জয়েনউদ্দীনের গল্পের বই নয়ান ঢুলী প্রকাশের মুহূর্তটির আমি একজন সাক্ষী, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। তার গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা অনেক। সত্তরের দশকে হাতিরপুল বাজারে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁচাবাজার করতে গিয়েছিলেন চটের থলে নিয়ে। অনেক দিন পরে দেখা বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। একপর্যায়ে তিনি প্রায় অনুরোধের মতো বললেন, ‘আমার অনেক সূর্যের আশা উপন্যাসটি কষ্ট করে হলেও পড়বেন।’ তাঁর ওই কথা আমার বুকে বাজে। লেখক কেন তার পরবর্তী প্রজন্মের একজনকে তাঁর একটি বই পড়তে অনুরোধ করবেন? তাঁর অনুরোধের আগে কেন আমি তাঁর উপন্যাসটি পড়িনি, তা ভেবে নিজের প্রতিই আমার ক্ষোভ হয়।

সরদার জয়েনউদ্দীন অবহেলা করার মতো কথাশিল্পী নন। তাঁর অবদান অস্বীকার করা অথবা তাঁকে অবহেলা করা অপরাধের শামিল। যখন তিনি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন, তার দ্বারা উপকৃত হয়েছে এ দেশের প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক। প্রত্যেকের বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পাদিত কেন্দ্রের সাময়িকী বইতে প্রশংসামূলক সমালোচনা করিয়েছেন। আমার কোনো কোনো বইয়েরও আলোচনা বেরিয়েছে বই পত্রিকায়।

একটি সময় সত্তরের দশকে কোনো কারণ ছাড়াই জয়েনউদ্দীন বাংলাদেশের লেখকসমাজ থেকে অবহেলিত হতে থাকেন। খ্যাতিমান সবাই তখন আখের গোছাতে অতি ব্যস্ত। এখন কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, যারা শেখ মুজিবের সরকার থেকে সুবিধা নিয়েছেন সাড়ে তিন বছর, জিয়া সরকার তাদের বঞ্চিত করল না। জিয়া মামলা-মোকদ্দমা ঠুকে দিলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। অনেকেই জেলের ভাতও খেলেন তার সময়ে। কিন্তু আওয়ামী কবি-শিল্প-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কোনো অসুবিধা হলো না। প্রাপ্তিযোগে বিশেষ ঘাটতি দেখা গেল না। ওই সব সুবিধাবাদিতা দেখে জয়েনউদ্দীনের ঘেন্না জন্মে থাকবে। তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বনামধন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ পেয়েছে কুমিল্লার লেখক-অধ্যাপক তিতাস চৌধুরীকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে। ১৩৯০ বঙ্গাব্দে লেখা ওই চিঠিতে সরদার লিখেছিলেন :

‘ঢাকার লোকজন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পেশাদার বুদ্ধিজীবীদের কার্যকলাপ দেখে-শুনে মনে ঘেন্না ধরে গেছে। শুধু তাই নয়, নিজের মনটার প্রতিও কেমন যেন অবিশ্বাস জন্মে গেছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় আগের সেই সহজ-সুন্দর অপরকে সহজে ভালোবাসবার মনটা বুঝি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। এ ভাবনার রশি আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, তাই সভা-সমিতি, যাকে মনে হয় গলাবাজীর আসর, ওসব জায়গায় আমি যাই-ই না। অর্থাৎ স্বনির্বাসিত জীবনযাপন করি।’

[তিতাস চৌধুরী, দেখা অদেখার স্মৃতি, পৃ. ১৮২]

একজন কথাশিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কতটা বেদনা থেকে এমন। কথা বলতে পারেন। সরদার ছিলেন সহজ-সুন্দর সাদা মনের মানুষ। সহজেই সব। বয়সের ও সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এখন বায়তুল মোকাররম। জাতীয় মসজিদের উত্তর দিকের যেখানে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি, সেখানে একটি দোতলা বাড়ি ছিল। পুরোনো বাড়ি। পরিত্যক্ত সম্পত্তি। চমৎকার একটি উঠানও ছিল। সেটি ছিল ন্যাশনাল বুক সেন্টার। মনে পড়ে সেখানেই ১৯৬৯ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে একটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিক শিল্পী প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নওরোজ কিতাবিস্তানের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, শওকত ওসমান, জয়নুল আবেদিন ও জয়েনউদ্দীন। সেদিন। ওয়ালীউল্লাহ একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের সাহিত্যসমাজ আমাকে এতটা ভালোবাসে, আমি জানতাম না। এতকাল বিদেশে রয়েছি, তবু তাঁরা আমাকে মনে রেখেছেন। আমার লেখা পড়েন। এর পরে আর বিদেশে থাকা যায় না। যত শিগগির সম্ভব আমার স্ত্রী ও আমি দেশে চলে আসব। ছেলে-মেয়ে থাকবে প্যারিসে।

ওই সময় ওয়ালীউল্লাহ গুলশানে একটি একতলা বাড়ি কেনেন। তাঁর পরিকল্পনা। ছিল তিন-চার বছরের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন এবং শুধু লেখালেখিতেই জীবনের শেষ বছরগুলো ব্যয় করবেন। এর অল্পকাল পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার। সপক্ষে ইউরোপে জনমত গঠনে তিনি বিরামহীন কাজ করেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে চাকরিচ্যুত করায় তিনি তখন বেকার। দেশের জন্য তাঁর উদ্বেগের অন্ত ছিল না। নিজের আর্থিক অনটন। মানসিক চাপ সইতে না পেরে একাত্তরের ১০ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।

ন্যাশনাল বুক সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে সরদার যে ঘরে বসতেন, সেটি ছিল একটি সুপরিসর কক্ষ। তিনি ছিলেন মজলিসি প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে তিনি একজন অফিসার মনে করতেন না। তাঁর গায়ের বর্ণ ছিল কালো। লম্বা গড়ন। চুল পেছনের দিকে আঁচড়াতেন। সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তাঁর ঘরে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। প্রায় প্রতিদিন। আমিও কোনো দিন যেতাম। যা মাইনে পেতেন, তার অনেকটাই কবি-সাহিত্যিকদের চা-শিঙাড়া-বিস্কুট খাইয়ে খরচ করতেন। সেই জয়েনউদ্দীন অবসর গ্রহণের পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ছিল তাঁর বাড়ি। শেষ দিনগুলো তাঁর সেখানেই একাকী কাটে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ তিনি মারা যান।

জয়েনউদ্দীনের জন্ম গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। পাবনা জেলার কামারহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর হিসাবে ১৯১৮ সালে, যদিও ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে অন্য সাল আছে। ১৯৪০ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে তিনি বছরখানেক পড়েছিলেন, কিন্তু কারও বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাজীবনে ইতি টেনে সেনাবাহিনীতে হাবিলদার ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান। কিছুদিন পাকিস্তান অবজারভার-এ কাজ করেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। পঞ্চাশের দশকে আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন তিনি দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজার।

পঞ্চাশের দশকে আমাদের বাড়িতে দুটি সাময়িকী যেত। তার নাম সেতারা ও শাহীন। এক কপি করে নয়, যেত একটা বান্ডিল। তাতে থাকত ১০টি কপি। আব্বা সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পুশিং সেল করতেন। কয়েক মাসের টাকা জমা হলে জয়েনউদ্দীন গিয়ে নিয়ে আসতেন। ওই উপলক্ষে এক বেলা তাঁর সান্নিধ্য পেতাম। ১৯৬২তে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেওয়ার আগে জীবিকার জন্য সরদারকে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়েছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আইয়ুব সরকার ন্যাশনাল বুক সেন্টার (জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করলে ১৯৬৪তে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে। পরে হয়েছিলেন পরিচালক।

নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন জয়েনউদ্দীন। ১৯৬৭ সালে তাঁর অনেক সূর্যের আশা আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পায়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে। আদিগন্ত (১৯৫৯), পান্না মতি (১৯৬৪), নীল রং রক্ত (১৯৬৫), বেগম শেফালী মীর্জা (১৯৬৮) প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থ বীরকন্ঠীর বিয়ে (১৯৫৫), খরস্রোত (১৯৫৫), বেলা ব্যানার্জির প্রেম (১৯৬৮) প্রভৃতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *