হাসুবৌ আজকাল প্রায়ই দরিয়াবিবির খোঁজ লইতে আসে। শাশুড়ীর কড়া তাগিদের তাড়া না আসিলে এই বাড়ি হইতে যাওয়ার নাম করে না সে।
আমজাদ মোনাদিরের খবর লইয়াছিল। সে তার আগেকার বাড়িতে যায় নাই। দরিয়াবিবি এ খবর জানে না। হাসুবৌ আমজাদকে তাহা বলিতে বারণ করিয়াছিল। পাছে তার মা আরো ব্যাকুল হইয়া পড়ে। আমজাদ তাই মিথ্যা কথা বলিয়াছিল। সে ওই গাঁয়ে আছে, মা।
হাসুবৌ গোপনে আমজাদের উপর ভর দিয়াছে, মুনির খবর আনা চাই-ই কিন্তু। হাসু চাচি, আমি আরো কয়েকজনকে তাগাদা দিয়েছি। এই ষড়যন্ত্রের কোনো খোঁজ দরিয়াবিবি রাখে না। সে চলিয়া গিয়াছে, তা যাক। কোনো উপায় তো আর নাই। তবু আত্মীয়দের সঙ্গে আছে, দরিয়াবিবির বুকে যেন বাঁধা থাকে সে।
হাসুবৌ জিজ্ঞাসা করিল, আমুর মা বুবু, তোমার নূতন মেয়েটি কিন্তু বেশ। আমাকে দিয়ে দাও, আমার তো ছেলেমেয়ে নেই।
তা কি দেওয়া যায়, পাগলী।
আমার কত সাধ একটা ছেলে–কানা খোঁড়াও যদি একটা ছেলে কি মেয়ে পেতাম।
দরিয়াবিবি এই বন্ধ্যা-নারীর ব্যথা অনুভব করে।
আল্লা দিলে হবে। তোর বয়স তো চলে যায়নি।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল হাসুবৌ নীরবে।
এমন সময় আসিল আমিরন চাচি। সঙ্গে আম্বিয়া।
দরিয়াবিবি খুব খুশি হয়, এসো বুবু।
কৈফিয়ত দিতে থাকে আমিরন চাচি, এতদিন পরে আজ একটু ফুরসত পেয়েছি জান-জালাপালা কাজে কাজে।
আসলে আমাদের মনে নেই।
দরিয়াবিবি কৃত্রিম ও কুটিল হাসির ছায়ায় চাহিয়া থাকে।
তুমি তো বলবেই দরিয়াবুবু! সত্যি নানা ঝঞ্ঝাট।
পেটে আর ভাত সেঁধোয় না।
কেন?
তারপর আমিরন চাচি তার দেবরের কাহিনী বলে। জমিগুলি হস্তগত করিতে সে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। তিন-চার বছর পরে আম্বিয়াকে বিদায় করিতে এই জমিগুলি কাজে লাগিত। হয়ত জমি দেখাইয়া কোনো ঘর-জামাই পাওয়া যাইত। ওই তো এক রত্তি মেয়ে। তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া ভিটায় বাস অসম্ভব।
দরিয়াবিবির সহানুভূতি আজও হ্রাস হয় না।
আম্বিয়ার জন্য অত মাথা ঘামিয়ো না। আল্লার মাল আল্লার হাতে সঁপে দেবে। কিন্তু তোমার দেবরটা এত ছোটলোক!
আর ঘরে বসে খাবে কী? পরের দিকে চেয়ে আছে শকুনের মতো।
আম্বিয়া মার পাশে ছিল না। আমজাদের সহিত সে দাওয়ার বাহিরে কাঁঠাল তলায় নানা কথায় ব্যস্ত।
মুনি আর এল না।
আমজাদ বিমর্ষ কণ্ঠে জবাব দিল, সে চলে গেছে কি-না। মা এখনো তার জন্য কত কাঁদে।
কবে যে আবার আসবে। তোর মুনিভাই কিন্তু বেশ।
বেশ, না?
হ্যাঁ।
মুনিভাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করে না।
খোঁজ করে নিয়ে আয় না তাকে।
খোঁজ নিয়েছি।
আসল কথা প্রায় প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল। হাসুবৌর উপদেশ স্মরণ হয় অকস্মাৎ।
কথা ঘুরাইয়া আমজাদ বলে, খোঁজ নিয়েছি। আসবে ইচ্ছামতো।
আম্বিয়া জবাবে সন্তুষ্ট হয় না।
তুমি বড় মিছে কথা বল। খোঁজ নিলে আর আসে না?
সে আসতে চায় না।
তার মুখে পড়া বেশ মানায়।
মোনাদির সকল প্রশ্ন ও জবাবের কেন্দ্র। আর যেন কোনো কথা নাই পৃথিবীতে।
আমিরন চাচি, হাসুবৌ, দরিয়াবিবি গৃহস্থালির নানা গল্প করে। দুঃখ-লাঘবিনী শক্তি আছে কথার। একের বেদনা-কাহিনী অপরের দুঃখাগ্নির মুখে ছাই চাপা দিতে পারে। সহানুভূতির হেতু আরো অটুট হয় তার জোরে।
হাসুবৌকে আমিরন চাচি বলে, হতভাগী, ছেলেমেয়ে চাস, এই দ্যাখ, আমরা পুড়ে মরছি।
এমন পুড়ে মরতেই বা জায়গা পাই কোথায়?
দরিয়াবিবির মন কয়েকদিন ভালো ছিল। নিত্যনূতন অভাব-বিজড়িত সংসারে যেন সামান্য সচ্ছলতার হাওয়া ঢুকিয়াছে। গল্পে গল্পে সময় কাটিয়া যায়। আম্বিয়া এই বাড়ি আসিলে আর যাইতে চায় না।
প্রায় সন্ধ্যা। এবার বাড়ি ফিরিতে হয়। মার ডাক আম্বিয়ার কানে যায় না।
তুমি যাও না, মা। তু
ই এই বাড়িতে থাক তবে, বুবুর বৌ হয়ে।
দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ আগে তার গোপন-মনে এমনই কল্পনার দুর্গ রচনা করিয়াছিল। মোনাদির আর চার বছরে মোলোয় পড়িবে। তখন
আমিরন চাচির কথা শুনিয়া দরিয়াবিবি হাসিয়া উঠিল।
বেশ, রেখে যাও।
আমার গাডেয় হাওয়া লাগে। খাইয়ে-পরিয়ে এখন মানুষ তো করো।
হাসুবৌ কথা গায়ে মাখিয়া লইল।
আমাকে দাও, আমি খাওয়াব-পরাব।
বেশ, নিয়ে যা।
আয়, আম্বিয়া আয় না, মা।
সাকেরের মার চড়া আওয়াজ দূর হইতে শোনা যায়। হাসুবৌ চলিয়া গেল।
আমজাদ চাচিদের আগাইয়া দিতে আসিল। মার বারণ সে শোনে না। তার আর ভূতের ভয় করে না। চন্দ্র কাকার গানের ঢেউয়ে সব কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে। হোক না সন্ধ্যা।
অস্পষ্ট বনের সড়কে মা-মেয়ে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়। আমজাদ কিছুদূর গিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।
সন্ধ্যার আঁধার-বন্দী বাতাস বেতগাছে শিরশির বহিয়া যায়। সেদিনও সন্ধ্যা ছিল। সেদিন মুনিভাই সঙ্গে ছিল। হঠাৎ তার দুই চোখ ছাপাইয়া পানি আসে। মুনিভাইকে সে সত্যি ভালোবাসিয়াছিল।
.
২৭.
চন্দ্র কোটালের অবসর নাই।
এই বছর ভালো ফসল হইয়াছিল। গ্রামে গ্রামে ভাড়-নাচের আসর বসে। অনেক বায়না কোটালের। রাজেন্দ্র সাজ-পোশাক আনিয়াছিল। বেশ জাঁক-জমকের সঙ্গে তার দল জমিয়া উঠিয়াছে। এই জন্য বিভিন্ন গ্রাম হইতে ডাক আসে।
আজহার নূতন ব্যবসা-পত্তনের সঙ্গী পায় না। কোটালও তাকে কিছুদিন সবুর করিতে বলিল। মনঃক্ষুণ্ণ হয় আজহার। হয়ত পরে তার হাতে টাকা থাকিবে না। সে নিজেই কোনো সুরাহা করিবে।
গঞ্জের দিনে ইয়াকুব আসিয়াছিল। সেও প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল। আজহার তার কথায় সায় দেয় না। ইয়াকুব একা আসে না তো। সঙ্গে হাট-বাজার। মুরগি, ঘি, এমনকি সরু চাল পর্যন্ত সে লইয়া আসে। আজহার এসব পছন্দ করে না। তার আত্মসম্মানে ঘা লাগে। এইজন্য ইয়াকুবের সঙ্গে কোনো অংশীদারী কাজ তার ভালো লাগে না।
দরিয়াবিবি আজকাল ইয়াকুবের চাল-চলন সহজে গ্রহণ করে। তার আত্মসম্মান সহজে তীক্ষ্ণ হইয়া ওঠে না। আপনজন আত্মীয়, সে কিছু সঙ্গে আনিলে, অত সংবেদনশীল হইলে চলিবে কেন?
আজহার চুপচাপ থাকে। মেহমানদারীর কাজে দরিয়াবিবির বেশ উৎসাহ দেখা যায়। বহুদিন পরে এই বাড়িতে পলান্নের সৌরভ পাওয়া গেল। আরো দুতিন রকমের তরকারী হইল। ইয়াকুব লুচি তৈয়ারি করিতে বলিয়াছিল। দরিয়াবিবির সম্মতি ছিল না। কাল সকালে নাস্তার সময় তৈয়ারি হইবে। বাড়ির ছেলেরা ইয়াকুবের নামে উৎফুল্ল হইয়া ওঠে। ইয়াকুব চাচা নামে মধু ঝরে না শুধু, নঈমার জিহ্বায় রীতিমতো লালা ঝরে।
আমজাদের স্কুলের বেতন সে নিয়মিত দিয়া আসিতেছে।
কয়েক বছর পূর্বে দরিয়াবিবি সামান্য দান-গ্রহণে আসেকজানের সহিত বিবাদ করিত। সেই তেজ অন্তর্হিত হইয়াছে। স্বামীর মানসিকতা সে চেনে। আজহারের উপর তার ক্ষোভ হ্রাস পায় না। আত্মীয়স্বজনের সহিত অত বাঁধাবাঁধি নিয়ম চলে না।
রাত্রে আহারের সময় আজহার ডাল ও দৈনন্দিন বরাদ্দ একটি আলুর তরকারি দিয়া ভোজ সমাধা করিল। মাগুর মাছ আনিয়াছিল ইয়াকুব। সে তা স্পর্শ করিল না।
দরিয়াবিবি শুধায়, গোশত খাবে না?
না, আমার পেটের গোলমাল আছে।
আসলে আজহার মনের কথা চাপিয়া গেল। ইয়াকুবের কয়েকটি টাকা সে লইয়াছে তাহা যেন তার গায়ে হুল ফুটাইতেছে। টাকা ফেরত দেওয়ার উপায় নাই। তার স্বপ্নরাজ্য যে ধূলিসাৎ হইয়া যায় টাকাগুলির অভাবে। এই বাধ্য-বাধকতার ছায়ায় আজহার নিরুপায়। নচেৎ সে ইয়াকুবের মুখোমুখি এই দাঁতব্যগিরি বন্ধ করিবার হুকুম দিত।
দরিয়াবিবি কোথায় ঘা দিতে হয়, ভালোরূপেই জানে।
রাত্রে স্বামীকে বলিল, আমুর ইস্কুলের মাইনে মাসে মাসে দিতে হয়রান। সামনের বছর ফসল যদি না হয়, কিভাবে যে দিন কাটবে।
আজহার কিছুক্ষণ নিরুত্তর রহিল।
জবাব দাও, এসব কথা মনে আছে! খালি ব্যবসা-ব্যবসা। কতবারই কত টাকা উড়িয়ে দিলে।
আল্লার মরজি হলে কতক্ষণ।
বিরক্ত হয় দরিয়াবিবি, আল্লার মরজি মরজি করে তো দশ বছর কেটে গেল। এখন তোমার মরজি হলে বাঁচা যায়।
আজহার জবাব দিতে গিয়া থামিয়া গেল।
ইয়াকুব ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা কর না। দেখ না, আল্লার মরজি কোন দিকে যায়।
ওর সঙ্গে ব্যবসা পোষাবে না।
তা পোষাবে কেন?
দরিয়াবিবি উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। আজহারের নির্বুদ্ধিতার শত রকম ব্যাখ্যা করিল।
কিন্তু অপর পক্ষ নীরব। আনমনা কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, সে জানে না।
পরদিন সকালে আবার নাস্তার বহর। ইয়াকুব দরিয়াবিবিকে তার বাৎসরিক মুনাফার বয়ান দিল। তিন হাজার টাকা পাইয়াছে পাটে, গোলদারীর দোকানে দুহাজার ইত্যাদি ইত্যাদি।
নাস্তা খাওয়ার সময় আজহারকে পাওয়া গেল না। সে মাঠে চলিয়া গিয়াছে। গোয়ালঘরে গরু-ছাগল কিছু নাই। দরিয়াবিবির অনুমান মিথ্যা নয়।
ইয়াকুব বলিল, ভাবী সাহেব, কেমন যেন আমাদের ভাই সাহেব। আমার সঙ্গে কাজকর্ম করত, আল্লা মুখ তুলে চাইতেন।
মাথায় ছিট আছে। কে পারবে বল ওর সঙ্গে।
আপনার মতো আক্কেল থাকলে আমি এতদিনে লাখপতি হয়ে যেতাম।
প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয় দরিয়াবিবি। দেবরকে সে পান সাজিয়া দিতেছিল। বাটায় সুপারি নাই। একবার উঠিয়া দরিয়াবিবিসিকায় সুপারি আছে। ঘরে প্রবেশের সময় সে একবার পিছন ফেরে। ইয়াকুব তার গমনপথ অথবা নিতম্বের দিকে চাহিয়া আছে, বোঝা যায় না। কিন্তু তার দৃষ্টি খুব শোভন মনে হয় না।
পানের বাটার নিকট ফিরিয়া আসিল দরিয়াবিবি সংকুচিত।
চোখাচোখি ইয়াকুবের দিকে সে তাকায়। না, তার দৃষ্টিভ্রম। আসলে ইয়াকুবের দৃষ্টি যেন এইরূপ।
অবসর সময়ে তার মনে আন্দোলন জাগে। আসলে লোকটা খারাপ নয়। তবে অমার্জিত রুচি। এই জাতীয় দ্বন্দ্বের ভিতর দরিয়াবিবি সমস্যার সমাধান খোঁজে। ব্যবসাদার লম্পট সম্বন্ধে দরিয়াবিবির কোনো জ্ঞান ছিল না। আজহার তার গুণগ্রামের হদিস জানিত বলিয়া দূরে দূরে থাকিত।
সেদিন সকালেই ইয়াকুব চলিয়া গেল। দুপুরবেলা বিছানা পরিষ্কার করিতে গিয়া বালিশের নিচে একটা দশ টাকার নোট পাইল, দাঁড়াইয়া রহিল দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ স্তব্ধ। মুঠির মধ্যে নোট অজানিতেই সে দুমড়াইতে থাকে। সচেতন হইলে সে সংকুচিত নোটটি আঁচলে বাঁধিয়া রাখিল।
মাঠের সামান্য কাজ করিয়া আজহার চন্দ্র কোটালের বাড়ি গিয়াছিল। সে বিকালে গানের বায়নায় যাইবে। সাজগোজ হইতেছে সকালে।
চন্দ্র আজহারকে বসিতে দিয়া তামাক সাজিতে লাগিল। শিবুর বৌ আগে আসিয়াছিল। একটি বছর চার বয়সের ছেলে মার অঙ্গসংলগ্ন হইয়া আঙুল চুষিতেছে। কাঁখে আর একটি মেয়ে।
আজহারের চোখে পড়িতে শিবুর বৌ ঘোমটা বাড়াইয়া দিল।
কেমন আছ, বৌ।
বৌ অশ্রুসজল কণ্ঠেই জবাব দিল, ভগবান মেরেছেন। আমাদের আর থাকাথাকি, চাচা।
শিবু আজহারকে চাচা বলিয়া ডাকিত। সেই সূত্রে এই আত্মীয়তা।
আজহার সমবেদনার কোনো কথা যেন খুঁজিয়া পায় না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। শিবুর বৌর কানে তা পৌঁছায়।
চন্দ্র এমন সময় কলিকা হাতে আজহারের পাশে আসিয়া বসিল।
দেখেছ তো খাঁ সাহেব। এই তোমার-আমার ধর্ম।
তা দেখছি।
দেখছ। ঘোড়ার ডিম দেখছ। ধর্ম না কচু। হাতেম বখশ যদি মুসলমান হয়, কি রোহিণী হিন্দু হয় তবে চণ্ডাল কে?
দেখছি সব।
তুসি কিছু দেখতে পাও না, খাঁ। টাকার নামে শালারা ধার্মিক। খামাখা দুটো গরিবের প্রাণ গেল।
শিবুর বৌকে সম্বোধন করিয়া বলিল, তুমি গিয়েছিলে মা, রোহিণী চৌধুরীর কাছে?
গিয়েছিলাম, পাঁচটা টাকা দিয়েছিল।
বড় ম্রিয়মাণ কণ্ঠ শিবুর বৌর।
শোনো, খাঁ। পাঁচ টাকা। অমন টাকায় মুতে দাও। একটা লোকের দাম পাঁচ টাকা। আজহার ভাই, গরিবে গরিবে যদ্দিন বেঁচে আছি, আর ধর্মের কথা কানে আনছি না। আমিও রোহিণীর ফাঁদে পড়েছিলাম। শালা রোহিণী।
গালাগাল দিয়ো না খামাখা।
গালাগাল দেব না। তুমি শিবুর বৌকে খাওয়াতে পারবে? ধরো, খাওয়াতে পারলে, কিন্তু ওর স্বামীকে জ্যান্ত করে দিতে পারবে? গালাগাল দেব না?
রক্তচক্ষু কোটাল হুঁকা টানিতে লাগিল।
শিবুর ছেলেটা দুইজনের দিকে অবোধ নয়নে চাহিয়া থাকে।
গালাগাল দেব না। ইসমাইলের বৌ ছেলেপুলে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেল। তারাও গরিব। তুমি তো চেন দশহাটার মল্লিকদের।
হুঁ চিনি।
শিবুর বৌর কেউ নেই। তার চালে খড় নেই দুআঁটি। বলছি, বৌ এখানে এসে থাক। আমি আর একটা কুঁড়ে তুলব। গাঁয়ের বাসেদ, পাড়, গণেশ সবাই গায়ে-গতরে খেটে দেবে বলেছে।
আজহার বলিল, যখন যা দরকার আমাকে ডেকো।
তা আলবৎ ডাকব। হাতেম বখশের গুষ্টিশুদ্ধ শহরে মদ টানে, সে মুসলমান, তুমিও তার কথায় উঠো বসো, না?
তুমিও তো রোহিণীর কথায় নেচেছিলে?
লজ্জিত কোটাল জবাব দিল, তা ঠিক। কিন্তু আর নয়। শালাদের ধর্মের নিকুচি। আর আজহার ভাই, তোমার মিনমিনে স্বভাব আমার ভালো লাগে না। জোর গলায় বুক ঠুকে ওদের কাছে কথা বলতে হবে।
ওরা বড়লোক। পুলিশ-দারোগা।
কথা তার মুখ হইতে চন্দ্র যেন লুফিয়া লইল, আইন নেই? আমরা তো দুচারজন নই। গাঁয়ের হাজার হাজার গরিব। পুলিশ যদি আইনমতো না চলে, ওদের কথায় ওঠে বসে; আমাদের লাঠি নেই, বল নেই?
ভাঁটার মতো চক্ষু ঘোরে কোটালের।
হঠাৎ থামিয়া সে বলে, কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল, অনেক গোছগাছ বাকি। পরে এসো তুমি। শিবু বৌমা, এখানে খেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি যেয়ো–
দুইজনে আসর ভাঙিয়া দিল।
আজহার গ্রামের পথে শিবুর বৌর কথা ভাবে। ভবিষ্যতের সংস্থান তারও নাই। একমাত্র আশ্রয় পথ। না, সে আবার ভাগ্য অন্বেষণে বাহির হইবে। টাকার জন্য এত হীনতা যখন স্বীকার করিয়াছে, ঘরে পড়িয়া থাকা ভালো নয়। কপাল ফিরিবে না তার?
খোদার মরজি হইলে কতক্ষণ?
.
২৮.
সকাল-সকাল দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজ সারিয়া বসিয়াছিল। কোলে ছোট খুকি শরী।
ঈষৎ সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া উঠিতেছিল। আমজাদ নিজের ঘরে জোরে জোরে পাঠাভ্যাস করিতেছে। আজহার দাওয়ায় বসিয়া হুঁকা লইয়া মশগুল। গুড়গুড় শব্দ উঠিতেছে।
মুনির মা!
আজহার ডাক দিল। মোনাদির আসিবার পর দরিয়াবিবির নাম বদলাইয়া ফেলিয়াছিল সে। কালেভদ্রে আমুর মা বলিয়া ডাক দিত।
কেন?
আজ ওদিকের গাঁয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
বীজ ধান কেনা দরকার।
উত্তপ্ত কণ্ঠ দরিয়াবিবির, তা আমাকে শোনানোর কোনো দরকার আছে?
না। এমনি।
আজহার চুপ করিয়া গেল। কিন্তু তার কথার খেই শেষ হয় নাই, কণ্ঠে তার পরিচয়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ সে বলে, ও গাঁয়ে গিয়েছিলাম, শুনলাম মুনি নাকি
দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হয় এইবার।
আজহার বলিতে থাকে : মুনি, ওগাঁয়ে নেই।
নেই!
শ্রুতি-ভ্রমের উপর এখনো বিশ্বাস আছে দরিয়াবিবির।
পুনরুক্তি করিল, কে নেই?
মুনি।
মুনি ও-গাঁয়ে নেই?
না।
কতদিন নেই!
এখান থেকে যাওয়ার পর আর নাকি ওখানে যায়নি।
আমজাদের ডাক পড়িল। সে পড়া ছাড়িয়া উঠিয়া আসিল।
দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে, আমু, তোর মুনিভাই তবে যে তার চাচার বাড়িতে আছে, আগে বলেছিলি?
আমি তো তাদের বাড়ি যাইনি। শুনে এসেছিলাম।
দরিয়াবিবি ক্ষোভে আগুন হইয়া উঠে, শুনে এসেছিলি
তারপর পুত্রের দিকে কটমট চোখে তাকায়।
আমজাদ প্রায় কাঁদিয়া ফেলার উপক্রম। নিজের সাফাই সে দক্ষ আসামীর মতো গাহিয়া গেল। আজহারের আফশোস বড় কম নয়। নিজের উপর বারবার ধিক্কার দিতে লাগিল।
আমার চণ্ডাল মেজাজে সেদিন আগুন ধরেছিল। এই হাতে আজার হোক।
দরিয়াবিবি আর কোনো কথা বলিল না। কারো বাক্যালাপ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতেছিল কি-না সন্দেহের ব্যাপার।
সমগ্র দাওয়া স্তব্ধ এক নিমেষে।
আমজাদ পা টিপিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। তার পাঠ্যাভ্যাস নিভিয়া গিয়াছে। কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আজহার হাঁটুর ভিতর মুখ খুঁজিয়া বসিয়া রহিল। দরিয়াবিবি কখন শরীকে লইয়া উঠিয়া গিয়াছে, তার খোঁজও সে রাখিল না। সেই অবস্থায় সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুম ভাঙার পর তার অচেনা ঠেকে সব জায়গা। দাওয়ায় পিদিম নাই। উঠানে অন্ধকার আর অন্ধকার। একরাশ ঝিঁঝি ঊধ্বশ্বাসে ডাকিতেছে। আজহারের মস্তিষ্কে তার অনুকরণ চলে। সন্তর্পণে সে ঘরের দুয়ারে করাঘাত করিল। না, সব বন্ধ। আমজাদের ঘরও ভোলা নাই। অভুক্ত সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সেও ঘুমাইয়া পড়িল দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া।
পরদিন খুব ভোরে আজহার মাঠে চলিয়া গেল।
দরিয়াবিবির ডাকে আমিরন চাচি হাজির হইল পরদিন। মুনির খোঁজ গ্রহণের সে প্রতিশ্রুতি দিল।
বিকালে আমিরন চাচি হতাশ। সংবাদ দিয়া গেল মুনি চাচার বাড়ি যায় নাই। ভয়ানক কান্না জুড়িল দরিয়াবিবি। কারো স্তোক বাক্যে থামে না। হাসুবৌ আসিয়াছিল। তারও চোখের পানি সহজে থামে না।
ও যদি একদম আর এ বাড়ি না আসত আমার দুঃখ ছিল না। কিন্তু এলো, আমি তাড়িয়ে দিলাম।
দরিয়াবিবি ফোঁপাইতে থাকে।
বেটাছেলে, কোথাও গেছে। আমি আরো খোঁজ নিচ্ছি। আশ্বাস দিল আমিরন চাচি।
আর সে ফিরে আসবে! কোথা গেল, অতটুকু কচি ছেলে।
আমি গণৎকারের কাছে গুনিয়ে আসব। কোনদিকে গেছে, কবে ফিরে আসবে ঠিক বলে দেবে, সেবার আমার বোনের দেবর এমনি।
আমিরন চাচি নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রত্যাবর্তনের কাহিনী বলিল।
দরিয়াবিবি আশ্বস্ত হয় না, তবু অনুরোধ করিল, আমি পাঁচ পয়সা দেব, বোন।
পাঁচ পয়সা আর একটা সুপারি লাগে।
আমিরন চাচি জবাব দিল।
তুমি এখনই নিয়ে যাও।
আম্বিয়া বাড়িতে আছে, আমিরন চাচি আর দেরি করিতে পারে না। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল। বেশ অন্ধকার চারদিক। বন-বাদাড় ভাঙিয়া যাইতে হইবে।
পয়সা, সুপারি আমি দেব। মুনি আমার ছেলে নয় নাকি? চাচির সহানুভূতি অকৃত্রিম।
হাসুবৌ ও আমিরন চাচি বিদায় লইল।
আজহার মাঠ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। আমজাদ শুধু সে সংবাদ জানে। থমথমে আবহাওয়ার জন্য পিতাকে একবার দেখিয়া সে নিজের ঘরে ডিপার আলোয় চুপিচুপি পড়িতেছিল। কিন্তু পড়ায় তার কোনো মন ছিল না।
দরিয়াবিবি সকলে চলিয়া গেলে আমজাদের ঘরে আসিল।
আমু।
মা।
কাল ও গায়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবি। আর একবার গঞ্জের দিকে যাস।
আচ্ছা, মা। মুনিভাইয়ের জন্য আমারও মন কেমন করে।
সত্যি সজল হইয়া উঠে আমজাদের চক্ষু।
তোর আব্বা মাঠ থেকে আসেনি?
এসেছিল তো। খানিক আগে দেখেছি।
ডিপা হাতে দরিয়াবিবি ঘরে প্রবেশ করিল। বাঁশের আলনায় আজহারের লুঙি পিরহান কিছু নাই। কাটা দেওয়ালের গায়ে একটি কুলুঙ্গী ছিল। আজহারের সূতা কন্নিক-পাটা উষো ও যাবতীয় রাজমিস্ত্রীর সরঞ্জাম থাকিত। সব শূন্য।
দরিয়াবিবি চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাইল এবং সবকিছু নিমেষে উপলব্ধি করিল।
.
২৯.
তোমার বাবা আবার রুই-পোনা ধরতে গেছে। চুনো চানা খেয়ে কি খাঁ সাহেবের দিন কাটে? জানো, চাচা?
চন্দ্র ও আমজাদের মধ্যে বাক্যালাপ হইতেছিল। হাসিয়া হাসিয়া কোটাল কথাগুলি উচ্চারণ করিল। দরিয়াবিবি দহলিজের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছে, চন্দ্রের তা খেয়াল ছিল না। তার মুখের হাসি তখনই নিভিয়া গেল।
দরিয়াবিবি চন্দ্রকে ডাকাইয়া আনিয়াছিল। আমজাদ জানে, বিপদে আপদে মা প্রথমে চন্দ্র কাকার কথাই মনে করে। পুত্রের মারফৎ এতক্ষণ অনেক কথাই দরিয়াবিবি তাহাকে শোনাইয়াছে।
তাই।
হাসি চাপা দিতে চন্দ্র কোটাল আবার উচ্চারণ করিল, তাই তো ভাবী সাহেব। এমন মানুষ আমি আর একটা দেখিনি। মাঝে মাঝে কি যেন ঝোঁক চাপে! দুহপ্তা গেল। মানুষ একটা খবর তো দেয়। তা-ও না।
দরিয়াবিবির দীর্ঘশ্বাস কোটালের কানে যায়। চন্দ্র সহসা কোনো জবাব দিতে পারে। আবহাওয়া হালকা করিতে সে ওস্তাদ। কিন্তু সেও কেমন যেন ম্লান হইয়া গিয়াছিল।
আমজাদ বলিল, জানো কাকা, আব্বা আমাদের দেখতে পারে না। তাই বাড়ি ছেড়ে পালায়।
চন্দ্র প্রতিবাদ জানাইল, তা না, চাচা। খেয়ালী মানুষ। সংসার নিয়ে কষ্ট পায়। তাই মাঝে মাঝে ঐ সব করে। ভাবে দুঃখ যাবে। কিন্তু দুঃখ কি সহজে যায়? ব্রিটিশ রাজত্ব। আগে ব্রিটিশ যাক, রোহিণী-হাতেম বখশ ঐ শালারা যাক, তবে না দুঃখ যাবে।
আমজাদ এত কথা বোঝে না।
সে সায় দিতে রাজি নয়। পিতার প্রতি তার আক্রোশ আছে।
কিন্তু ব্যাপার কি জানো, তোমার বাবা। চন্দ্র কোটালের বাক্য আড়াল হইতে পূর্ণ করিল দরিয়াবিবি, চুপ শয়তান।
চন্দ্র এবার হাসিল। সে যেন আত্মস্থ হইয়াছে। ঠিক বলেছেন ভাবী। আমার মনে যা হয়, মুখে তা বলে ফেলি। কিন্তু খাঁ ভাই? উহ্ জান গেলেও বেশি কথা বলে না। যদি কারও হাজার টাকায় চুপ শয়তান দরকার হতো, আমি তোমার বাবাকে বেচে দিতাম বাবা। চন্দ্র হা হা শব্দে হাসিতে লাগিল। আমজাদ সঙ্গে যোগ দিল।
এমন সময় ভিতর হইতে ধমকের সুরে দরিয়াবিবি ডাকিল, আমু, তোর কাকাকে জমির কথা জিজ্ঞেস কর।
দুই জনের হাসি হঠাৎ বন্ধ হইল। আমজাদ নয়, জবাব দিল কোটাল।
ভাবী সাহেব, তার জন্য আপনি ঘাবড়াবেন না। ধান আমি নিজে কেটে দেব। এবার খড়ের দাম খুব বেশি। মানুষ ঘরদোর ছাওয়াচ্ছে। পনেরো-ষোলো টাকা কাহন। আমি ভাবছি, খড় কিছু রেখে বাকি বেচে দেব।
কাহন খানেক রেখে দেবেন। মৃদুকণ্ঠে দরিয়াবিবি জবাব দিল।
চন্দ্র আবার বলিল, শুধু ধান কাটা নয়, তরমুজ আর কুমড়া বিঘে খানেক জমিতে দেব ভাবছি। কিন্তু আমার আসর গানের বায়না আছে। আমজাদ চাচা আছে, দেখি কি বন্দোবস্ত করা যায়।
দরিয়াবিবি এবার আমজাদকে ডাকিয়া বলে, আমু, তোর চাচাকে পান তামাক এনে দে।
ঘোর আপত্তি জানাইল চন্দ্র। না, এখন কিছু দরকার নেই। আমি আজ উঠি, ভাবী সাহেব। আমার ক্ষেতে অনেক কাজ পড়ে আছে। সত্যই চন্দ্র কোটাল উঠিয়া পড়িল। আমজাদ তার অনুসরণে গেল। মহেশডাঙার জলাজঙ্গল ভরা পথে পথে চন্দ্র কাকার সহিত বেড়াইতে পাইলে সে আর কিছু চায় না। কত হাসির গান, মশকরা আর প্রাণ ঢালা আদর না পাওয়া যায় চন্দ্র কাকার কাছ হইতে!
ভাবী সাহেব, ঘাবড়াবেন না– চন্দ্রের স্তোকবাক্যে দরিয়াবিবি জোর পায়, কিন্তু অসোয়াস্তি যায় না। গত বিশ বছর এমন কতবার ঘটিয়াছে। বার-ফাট্টা আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু যদি আর না আসে। দৈহিক শক্তি এতদিন দরিয়াবিবির সহায় ছিল। আজও স্বাস্থ্য তার অটুট। কিন্তু মন বড় নিস্তেজ ও নিঃসঙ্গ।
আত্ম-চিন্তায় মশগুল দরিয়াবিবি। উঠানে একটি ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াইতেছিল। শরী দাওয়ায় চুপচাপ একা ঘুমাইয়া। সে বড় লক্ষ্মী মেয়ে, কেবল ক্ষুধার সময় কাঁদে। পেটভরা থাকিলে শুধু ঘুমায়। দরিয়াবিবি তাই বড় নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্নে সাংসারিক কাজ সম্পন্ন করিতে পারে। ছাগলগুলি দরিয়াবিবির বড় প্রিয়। প্রতি বছর বছর বাচ্চা হয়। ঈদ ইত্যাদি পর্ব উপলক্ষে লোকে ছাগল কেনে। তখন ছাগল বেচায় একটা আনন্দ আছে। দাম বেশি পাওয়া যায়, তা ছাড়া টানাটানির দিন একটু সহজ হয়।
এই প্রাণীদের লইয়া দরিয়াবিবি ব্যস্ত। আমিরন চাচি কখন ধীরে ধীরে উঠানে ঢুকিয়াছে তা সে লক্ষ করে নাই। পাতা খাওয়ানো তো একটা দৈনন্দিন কাজ। দরিয়াবিবি ছাগলগুলির দিকে ভালোরূপে তাকায় নাই। কাঁঠালের ডালপালা শুধু আগাইয়া দিতেছিল। মনে নানা হিসাব নিকাশের ঝড়।
আমিরন চাচি দরিয়াবিবির থমথমে মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে হঠাৎ মৃদুকণ্ঠে ডাক দিল, বুবু।
দরিয়াবিবির ঠোঁটে অভ্যর্থনামুখর হাসি।
কখন এলে?
তারও খোঁজ নেই? কর্তাবিরাগী, গিন্নীর মন এমন উদাস না হলে চলে– বলিয়া আমিরন চাচি হাসিয়া উঠিলেন।
দরিয়াবিবির মুখ আবার থমথমে। আমিরন চাচি অপ্রস্তুত হইয়া যায়। দরিয়াবিবি সেদিকে চোখপড়া মাত্র সে ছাগলগুলিকে হাঁকাইয়া দিয়া চাচির কোমর জড়াইয়া বলিল, ঘরের ভিতর চল বুবু। কি আমার কর্তা রে– তার জন্য আবার চিন্তা!
আমিরন চাচি সহানুভূতির সুরে জবাব দিল, এমন লোক।
কিন্তু যেন ঝাপটা দিয়া দরিয়াবিবি তার মুখের কথা নিভাইয়া দিল। চল, পান খাই, দুটো কথা বলি।
নদীর ধারে বাস
দুক্ষু বারো মাস
রাখো বাজে কথা।
আমিরন চাচি দরিয়াবিবির সুখের কৃত্রিমতা কিছুই ধরিতে পারে না।
দুইজনে সত্যই কিছুক্ষণ আজেবাজে আলাপ করিল। গ্রামের কথা, পাড়া-পড়শীদের। কথা। সাকের কোথায় দাঙ্গা করিতে গিয়াছে, হাসুবৌ শাশুড়ির গঞ্জনা আজকাল অনেক বেশি শোনে ইত্যাদি।
আমিরন চাচি কাজের লোক। গরু-বাছুর-হাঁস-মুরগি লইয়া সে এক রাজ্যের অধিশ্বরী। বেশিক্ষণ কথা-ফোড়নের সময় কোথায়? একটি খবর দিতে আসিয়া সে এতক্ষণ সুযোগ খুঁজিতেছিল। হঠাৎ চাচি বলিয়া ফেলিল, দরিয়াবুবু, একটা খবর আছে।
কত সংবাদের জন্যই দরিয়াবিবি হা-প্রত্যাশায় নিমজ্জিত, তখনই উৎকর্ণ উন্মুখ ব্যগ্রতায় চাচির দিকে তাকাইল।
আমাদের মুনি চাচার খবর পেয়েছি।
দরিয়াবিবি অন্য কোনো সংবাদ পাইলে যেন সন্তুষ্ট হইত। বেশি উৎসাহ না দেখাইয়া সহজ গলায় বলিল, কি খবর?
মুনি চাচাও বাড়ি থেকে চলে গেছে। আরো পাঁচ ক্রোশ দূরে কি স্কুল আছে, সেখানেই পড়ে। চাচাঁদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ আর নেই। আমিরন চাচি খুব তরল গলায় পরিবেশন করিল।
যেখানেই থাক, ভালো থাক। আমার ছেলে তো নয়, আমার কি জোর আছে! ভয়ানক নির্লিপ্ত শোনায় দরিয়াবিবির কণ্ঠ।
প্রতিবাদ জানাইল আমিরন চাচি, তোমার ছেলে নয় কে বললে? দেখ রক্তের টান, চাচা আবার তোমার কোলেই ফিরে আসবে।
আসুক বা না আসুক, যেখানে থাক বেঁচে থাক। তুমি কোথা থেকে খবর পেলে?
আমি খবর পেয়েছি। আমার এক মামাতো ভাই আছে মুনিদের গাঁয়ের পাশে। তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। …তোমার মেহেরবানি বুবু।
তারপর আমিরন চাচি কর্তব্যের ডাকেই উঠিয়া পড়িল। আম্বিয়া একা বাড়িতে আছে। দেবর বিধবার সম্পত্তি হরণের নানা পাঁয়তারা কষিতেছে। আর বেশিক্ষণ এখানে কাটানো। চলে না। আমিরন চাচি কিন্তু অবাক হয়। আজ তার বুবু পুত্র প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করিল না। অথচ অন্য সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই এক কথাই বড় হইয়া দেখা দেয়।
দরিয়াবিবি আমিরন চাচিকে দহলিজ পর্যন্ত আগাইয়া দিল ও আবার আসার জন্য অনুরোধ করিল। কিন্তু উঠানের দিকে অগ্রসর হইতে তার পা যেন আর চলে না। ধীরে ধীরে ছোট্ট শরীর বিছানার পাশে আসিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল ও তার ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। তখন দরিয়াবিবি কী ভাবিতেছিল, শুধু সেই তার খবর রাখে।
.
৩০.
গঞ্জের পথে ইয়াকুব আসিয়াছিল খোঁজ-খবর লইতে। সে খালি হাতে আসে না। ছেলেদের জন্য মিষ্টি, তা ছাড়া এত জিনিসপত্র আনে যার প্রাচুর্যই যে কোনো সংসারের পক্ষে তিন-চার দিনের জন্য লোভনীয়। দরিয়াবিবি প্রথম প্রথম মৃদু আপত্তি জানাইত। এখন নিজেই ইয়াকুব আনীত মায়া পেটিকা নিজের হাতে খোলে। অবশ্য উৎসাহ দেখায় না বিশেষ।
এবার ইয়াকুব বড় বড় কই ও বড় বড় চিংড়ি মাছ পর্যন্ত আনিয়াছিল। আজহার ঘরে থাকিলে মাঝে মাঝে মাছ ধরিতে যায়। তখন এমন মাছ এই বাড়ির হাঁড়িতে উঠে। নচেৎ এত দামে এমন আমিষ আহারের সামর্থ্য কোথায়?
ইয়াকুব ফোড়ন দিয়া বলিল, ভাবী, এবার মটরশুটি পাওয়া গেল না। বড় চিংড়ি আর মটরশুটি আমার খুব পছন্দ।
তোমার ক্ষেতে হয় না? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল।
না। অসময়ে সব সময় কি আর এই ফসল তোলা যায়?
ছেলেরা ইয়াকুব চাচাকে ঘিরিয়া থাকে। নঈমা কাছ ছাড়া হয় না; বরং অন্য সময় মাকে জিজ্ঞাসা করে, চাচা কবে আসবে মা? কারণ চাচা একা আসে না। আমজাদ কাছ ঘেঁষিয়া বসে। সে লাজুক, তাই সে কম কথা বলে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইয়াকুবের সঙ্গ ত্যাগ করে না।
লৌকিকতার রেশ আর নাই। মেহমান হইলেও ইয়াকুব আহারের ফিরিস্তি নিজেই দিয়া থাকে। কারণ যোগাড় সে বহন করিয়া আনে।
দরিয়াবিবি বিকালে লুচি ভাজিতেছিল। পাশে কোনো ছেলেপুলে নাই। নঈমা একবার আসিয়াছিল শিশুসুলভ প্রত্যাশায়। কিন্তু মা বসিতে দেয় নাই, ধমক দিয়া তাহাদের ভাগাইয়াছে। আরো বকুনি খাইয়াছে আমজাদ। এত বড় ছেলে স্কুলে পড়িস। এমন হাঁ খেয়ে কেন? কোনোদিন লুচি দেখিসনি চোখে? ইহার চোটে দুরন্ত পেটুকও ছুটিয়া পলাইত।
আজহারের কথা এই বাড়িতে ছেলেরা কেহ মুখে আনে না। ইয়াকুব তার কথা জিজ্ঞাসা করে সারাদিন। কুশল জিজ্ঞাসার রীতিটুকু পর্যন্ত সে পালন করে নাই। অথচ আত্মীয়।
কড়ায় গরম তেলে ফেলা লুচির হ্যাঁক শব্দ হইতেছিল। দরিয়াবিবি আনমনা কাজ। করিয়া যায়। সে নিজের চিন্তায় কুঁদ, তা-ও মুখাবয়বে প্রমাণ। দরিয়াবিবি সুডৌল গৌর মুখ চুলার আঁচে ঘামিতেছিল।
ভাবী, ভাবী–আপনার রান্না কত দূর। ডাক দিতে দিতে ইয়াকুব চুলাশালে প্রবেশ করিল।
বেগুন ভাজা হয়ে গেছে, এখন লুচি ভাজছি। ইয়াকুবের দিকে না তাকাইয়া চুলার ভিতর এক খণ্ড লাকড়ি ঠেলিতে ঠেলিতে দরিয়াবিবি জবাব দিল।
এখানেই দিন, গরম গরম লুচি খাওয়া যাক।
বেশ। কিন্তু বসার জায়গা কোথায়?
বসার জায়গা কি হবে? এই আমি বসে দেখিয়ে দিচ্ছি–বলিয়া ইয়াকুব উবু বসিয়া পড়িল।
তোমার কাপড়চোপড় ময়লা হবে। ইয়াকুবের পরনে সিল্কের লুঙি, গায়ে শাদা শার্ট। দরিয়াবিবি মিথ্যা বলে নাই।
না, আমি তো আর ছেলেমানুষ নই। যেন কত রসিকতা করা হইল। ইয়াকুব বেদম হাসিয়া উঠিল।
বেশ, বসো। আমি থালা বাটি নামিয়ে আনি।
দরিয়াবিবি মাচাং হইতে লোয়াজিমা কয়েকটি নামাইয়া আনিল এবং বেগুনভাজা ও লুচি পরিবেশন করিতে লাগিল।
থালায় হাত নামাইয়া ইয়াকুব বলিল, ভাবী, ছেলেদের ডাকেন।
ওরা খেয়েছে। সংক্ষিপ্ত জবাব। ইয়াকুব চাহিয়া দেখিল দরিয়াবিবি তখন লুচি বেলায় মগ্ন। উত্তপ্ত কড়ার দিকে তার আড়চোখের দৃষ্টি। সেখানে টগবগ শব্দে তেল ফুটিতেছে।
সত্যি ওরা খেয়েছে?
হ্যাঁ। দরিয়াবিবির কণ্ঠ ঈষৎ তীক্ষ্ণ শোনায়।
দরিয়াবিবি গরম লুচি ছাঁকিয়া পাতে দিতে লাগিল। ইয়াকুব ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করে।
ভাবী, একটু পানি।
দরিয়াবিবি ঝটপট হুকুম তামিল করিল। আর কোনো বাক্যালাপ যেন এগোয় না। ইয়াকুব দরিয়াবিবিকে রীতিমতো ভয় করে। তার চোখের দিকে সহজে তাকাইতে পারে না। থমথমে মুখ যেন শাসনভঙ্গির আদল। ইয়াকুব অসোয়াস্তি বোধ করে। তবে সে দুই স্ত্রীর পতিদেব। মনের গোপনে একটা আত্মবিশ্বাস আছে তার। কিন্তু এখানে যেন সব ঠাণ্ডা হইয়া যায়। দরিয়াবিবি কত শান্ত। অথচ ইয়াকুব অসোয়াস্তি অনুভব করে।
নিজের মনেই সে বলিয়া যায়, আপনার বাড়ি এলে যা শান্তি পাওয়া যায়, আর কোথাও তা মেলে না।
আবার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন কেন?
কেন? যত্নআত্যি কে করে?
যত্নআত্যি! দরিয়াবিবি হাসিয়া উঠিল। ইয়াকুব কান খাড়া করিল। কথাটা বিদ্রুপের মতো শুনাইতেছে না তো? কিন্তু কিছু উপলব্ধি করিতে পারে না। দরিয়াবিবি কোনো সুযোগ না দিয়া বলিল, তুমি যত্নআত্যি কোথায় দেখলে?
কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা দোকানদারী ভাব।
ইয়াকুব মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়। তবু আবহাওয়া আরো সন্নিকট করিতে বলিল, না, ভাবী, এসব কপালের কথা। এমন শান্তি আমি ঘরেও পাই না।
তোমার তো খোদার মরজি দুবিবি আছে?
বিবি! বিবি কোথায় দেখলেন ভাবী?
ঘরের সে দুটো তবে কি?
গোশতের ঢিবি।
দরিয়াবিবি এবার হাসিয়া ইয়াকুবের দিকে তাকাইল। তখনই চোখ নামাইয়া বলিল, আমি বিবিসাবদের দেখিনি। মোটা হলে যদি গোশতের ঢিবি হয়, আমি তো গোশতের পাহাড়।
না ভাবী। আপনি সংসারের লক্ষ্মী।
দরিয়াবিবি এই প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয়। সেও হাসিতে থাকে এবং বলে, নূতন কথা শোনালে ভাই।
ইয়াকুব এই নৈকট্যের প্রাসাদই তো চায়। সে খুশি হইয়া বলিল, বাচ্চাদের ডাকেন, আমাকে আর দুটো লুচি দিন।
সহজ গলায় দরিয়াবিবি জবাব দিল, বাচ্চারা পরে খাবে। তুমি এখন খাও।
ইয়াকুব খাওয়া শেষ করিয়া বলিল, ভাবী, আমি একটু বেড়িয়ে আসি। আপনাদের গা খানা বড় জংলাটে। টাকা পকেটে করে ঘোরা যায় না। আমার ব্যাগটা রাখেন।
আমার কাছে কেন?
ইয়াকুব টাকার ব্যাগ হাতে বলিল, চুরি হওয়ার ভয় আছে।
কত টাকা আছে?
পাঁচশ।
না ভাই। এত টাকা–হঠাৎ রাত্রে চোর এসে নিয়ে গেলে।
আপনার কাছে চোর টাকা চুরি করতে আসবে না। ইয়াকুব মৃদু হাসি ছিটাইয়া বলিল।
তবে কেন আসবে?
কথা ঘুরাইয়া ইয়াকুব জবাব দিল, চোরের ভয় নেই? আপনার যা সাহস। আমার গোশতের ঢিবিরা এমন জংলা জায়গায় থাকলে দশটা দারওয়ান রাখতে হত।
দরিয়াবিবি হাত পাতিয়া দিল। ইয়াকুব মানিব্যাগ দিতে বিলম্ব করিল না। বাহিরে তখন গোধূলি। ইয়াকুব বাহির হইয়া আসিল। দরিয়াবিবি আঁচলে ব্যাগ বাঁধিয়া আবার কাজে মনোযোগ দিল।
পরদিন দুপুরে ইয়াকুব গঞ্জের নৌকা ধরিবে। যাইবার সময় সে বলিল, ভাবী, আমার ব্যাগটা দিন।
দরিয়াবিবি আমানত ফিরাইয়া দেওয়ার সময় বলিল, ভাই, তোমার কাছে একটা আরজ আছে।
ভয়ানক অধীরতা প্রকাশ করিল ইয়াকুব। সে ভাবিয়াছিল, ব্যাগে আরো টাকা আছে, হয়ত দরিয়াবিবি ঋণের আবেদন জানাইবে।
আপনার আরজ কি? হুকুম বলুন। তাড়াতাড়ি বলুন।
একটা খোঁজ-খবর নিও।
তা আর নেব না। আমি মনে করেন আপনাদের পর, ভাবী? ইয়াকুব দরিয়াবিবির মুখের দিকে তাকায়। সে কিন্তু নতমুখী। দৃষ্টি মাটির উপর কি যেন খুঁজিতেছে।
খুব মৃদু কণ্ঠেই দরিয়াবিবি জবাব দিল, আমাদের খোঁজ নয়।
ইয়াকুব হতাশ। আবার প্রশ্ন করিল, তবে কার?
তোমার ভাইয়ের খবরটা।
ওহ্ আজহার ভাইয়ের! তিনি তো খেয়ালী লোক, আসবেন একদিন। ইয়াকুব জবাব দিল অত্যন্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে।
তার জন্য আপনি এত উতোলা কেন? বিস্ময় প্রকাশ করিল ইয়াকুব।
স্বামীর জন্য এত মাথাব্যথা কেন, তুমি তা-ই জিজ্ঞেস করছ? দরিয়াবিবি সোজাসুজি ইয়াকুবের দিকে তাকাইল।
না-না, তা নয়। আমি ভাবছি, একটু বিরাগী ধরনের মানুষ তার জন্যে ভেবে লাভ কী। ইয়াকুব তখনই দৃষ্টি নামাইয়া অপরাধী সুলভ কণ্ঠে জানাইল।
তবু ভাবতে হয়। শহরে মালপত্র কিনতে তোমার লোক যায়, তাই খবর নিতে বলছি।
নিশ্চয়, খবর নেব বৈকি। আমি তার কোনো ত্রুটি রাখব না।
নিও ভাই। আল্লা তোমার ভালো করবে। দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বরে কোনো খাদ ছিল না।
গঞ্জের বেলা হয়ে গেল। আপনাকে খবর দেব, আপনি নিশ্চিত থাকেন।
ইয়াকুব আর দেরি করিল না। দরিয়াবিবি ঘরে ফিরিয়া আসিল।