তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে
তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে। কোনো কথাটথা না। চুপচাপ বসে থাকা।
হাসান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার বিছানার চাদরটা ধবধবে সাদা। গায়ে যে চাদরটা আছে তার রঙও সাদা। সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাইরে বেশ গরম। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু হাসানের মনে হয় শীত লাগছে।
তারেক বলল, তোর মাথার যন্ত্রণা কি একটু কমেছে?
হাসান নিচু গলায় বলল, হুঁ।
হুঁ বলার ধরন থেকেই বোঝা যায় মাথার যন্ত্রণা আসলে কমেনি। কড়া পেইনকিলার ব্যথাটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে।
তুই যে এত বড় অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতি বুঝতেই পারি নি। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
অসুখ-বিসুখ তো পৃথিবীতে আছেই।
তাও ঠিক।
তারেক আবার চুপ করে গেল। হাসান বলল, শুধু শুধু বসে আছ কেন? চলে যাও।
কোথায় যাব?
তোমার ঘরে যাও। অফিস থেকে এসেছ বিশ্রাম কর।
তোর কি কিছু খেতেটেতে ইচ্ছা করে?
না।
খেতে ইচ্ছে হলে বল। লজ্জা করবি না।
হাসান হাসল। একবার ভাবল বলে, আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে। আঙুর নিয়ে এসো। বলা ঠিক হবে না। ভাইজান সত্যি আধকেজি আঙুর নিয়ে আসবে।
হাসান!
জ্বি ভাইজান।
আমার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।
তুমি ঘরে যাও তো। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর।
আমার যদি ক্ষমতা থাকত–অবশ্যই তোকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করতাম। ঘরবাড়ি জমিজমা থাকলে অবশ্যই বিক্রি করতাম। কিছুই নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডে ষোল সতের হাজার টাকা আছে। আমি অবশ্য হাল ছাড়ি নি। দেখি কী করা যায়। লায়লার স্বামীর কাছে টাকা ধার চাইব?
কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না।
সে তো বাইরের কেউ না। এখন তো আমাদেরই একজন। টাকা তো আমি মেরেও দিচ্ছি না। মাসে মাসে শোধ দেব। মাসে তিন হাজার টাকা করে শোধ দিলেও বছরে হয়।
ভাইজান আমার আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে।
কোনো ব্যাপারই না। এনে দিচ্ছি। কোনটা খাবি–সাদাটা না কালোটা? আচ্ছা! যা দু পদেরই আনিব। ভিটামিন সি ছাড়া আঙুরের অবশ্য ফুটভ্যালু কিছু নেই। তোর যখন খেতে ইচ্ছে করছে খা।
তারেক উঠে দাঁড়াল। হাসান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেউ একজন পাশে এসে বসলেই তার খারাপ লাগে। পুরোপুরি এক সময়টা কাটাতে পারলে ভালো লাগত। কেউ কাছে আসবে না। চিঠি লিখবো। সেই চিঠিগুলো থাকবে বালিশের নিচে। যখন মাথার যন্ত্রণা একটু কমবে তখন সে চিঠি খুলে পড়বে। মানুষের সঙ্গের চেয়ে তাদের চিঠি পড়াটা এখন বোধহয় আনন্দময় হবে।
লিটনের একটা চিঠি পরশুদিন পেয়েছে। চিঠিটা বালিশের নিচে ছিল। আজ সকালে পড়েছে। কয়েকদিন পর হয়তো আবারো পড়বে। লিটন লিখেছে–
হাসান,
তোকে চিঠি লিখতে অনেক দেরি করে ফেললাম। আসলে কী ব্যস্ততায় যে সময় কাটছে। আমাকে না দেখলে তুই আমার ব্যস্ততা বুঝতে পারবি না। আমি ভোর আটটায় চলে যাই। ফিরি সন্ধ্যার পর। গ্রোসারি করা, ঘর-সংসার দেখা, রান্না করা–সব তোর ভাবির একা করতে হয়। সেই বেচারিরও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমাদের এপাটমেন্টটা উনত্রিশ তলায়। আর লড্রিঘর হচ্ছে এক তলায়। কাপড় ধুতে হলেও নিচে নামতে হয়। এত উঁচুতে থাকতে শুরুতে খুব অস্বস্তি লাগত। মনে হত জোরে বাতাস এলেই বিল্ডিংটা বুঝি ভেঙে পড়বে। এখন অবশ্য সয়ে গেছে।
শম্পা সারাদিন কী করে জানিস ‘ শুধু ঘর গোছায়। রাজ্যের জিনিস কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে। তার যে এমন খরুচে হাত তা জানতাম না। তার শখের জিনিস কী জানিস–স্ট্রফড এনিমেল। ঘরটিকে সে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছে। আমি একদিন তার ওপর সামান্য রাগই করলাম।—সে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড করেছে। তার অভিমান ভাঙবার জন্যে শেষে আমি নিজেই একটা বিশাল হাতি কিনে দিয়েছি। দাম কত নিয়েছে। শুনলে তুই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবি সাত শ’ সিঙ্গাপুরি ডলার। শম্পার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও খরচে হাত হয়ে যাচ্ছে। এক সময় কী যে কষ্ট করেছি। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। আমার খুব ইচ্ছা তোকে এনে কিছু দিন আমাদের সংসারে রাখি। আরেকটু গুছিয়ে বসেই তোর জন্যে টিকিট পাঠাব।
ইতি লিটন
পুনশ্চ : হাসান তুই কি একটা কাজ করবি? খুব সুন্দর কিছু বাংলা নাম পাঠবি? কুড়িটা ছেলের নাম এবং কুড়িটা মেয়ের নাম। কী জন্যে নাম পাঠাতে বলছি বুঝতেই পারছিস। বিদেশে শিশুপালন খুবই যন্ত্রণা হবে। কী আর করা। আমরা খুবই খুশি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।
হাসানকে রোজই একবার লায়লা দেখতে আসে। এই মেয়েটাকে হাসানের ভালো লাগে। লায়লা ঘরে ঢোকে কাদো কাদো মুখে।
ভাইয়া আজ তোমার অবস্থা কী? বলে বিছানায় বসে। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখ থেকে কাদো কাদো ভাবটা চলে যায়। সে মনের আনন্দে তার সংসারের গল্প শুরু করে। গল্প করার সময় আনন্দে সে কলমল করতে থাকে। হাসানের সব সময় মনে হয় এই আনন্দের পাশে দীর্ঘ সময় থাকলে তার মাথার অসুখটা কমে যাবে।
ভাইয়া শোন-বাবু কী রকম যে দুষ্ট তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ওর বাবার অবশ্য ধারণা আগে এত দুষ্ট ছিল না। আমি নাকি লাই দিয়ে দিয়ে তাকে দুন্টু বানাচ্ছি। এত ছোট একটা বাচ্চা আমি তো আদর করবই। মুখে ভাত তুলে না দিলে সে খায় না। বেচারা ছেলেমানুষ না। ও কী বলে জান? ও বলে রাত্ৰি তুমি বাবুকে যতটা ভালবাস আমাকে তার দশ ভাগের এক ভাগও বাস না। বুঝলে ভাইয়া ও আমাকে লায়লা ডাকে না। লায়লার অর্থ রাত। সেই জন্যে ডাকে রাত্রি। লজার ব্যাপার না? এখন কী করব। বল? আদর করে ডাকে আমি তো না বলতে পারি না। পরশুদিন আবার বলল, চল সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসি। ছেলের স্কুল কামাই করে আমি সিঙ্গাপুর যাব। আমার এত শখ নেই। ও তা শুনবে না। ওর স্বভাব হচ্ছে একবার কোনো একটা কথা মুখ দিয়ে বলে ফেললে সেটা করতেই হবে। খুব ভয়ে ভয়ে আছি। এদিকে আমার ড্রাইভার কী করেছে। জান? গত মঙ্গলবারের কথা। আমাকে বলল, চাকা পাংচার হয়েছে ঠিক করতে হবে। আমি একশ টাকা দিলাম। সে আর টাকা ফেরত দেয় না। বৃহস্পতিবার তাকে ডেকে বললাম। চাকা পাংচার সারাই করতে কুড়ি টাকা লাগে। বাকি আশি টাকা কোথায়? সে বলল, ম্যাডাম পকেটমার হয়ে গেছে। ওই আশি টাকা তো গেছেই আমার নিজেরও দু শ টাকা গেছে। এখন সে এডভান্স বেতন চায়। আমার অবস্থা দেখেছ?
তোর তো কঠিন অবস্থা।
কঠিন অবস্থা তো বটেই। কাউকে যে তুমি বিশ্বাস করবে। সে উপায় নেই। সবার দিকে চোখ রাখতে হয়। আমি তো আর মাছি না যে আমার পঞ্চাশ হাজার চোখ আছে। আমি একা কদিক সামলাব?
তা তো ঠিক।
সন্ধ্যা হতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমোতে পারি না। ওর অভ্যাস হচ্ছে রাতে ছবি দেখা। আমাদের একটা LD প্লেয়ার আছে। LD নিয়ে আসে। রোজ ছবি দেখে। LD কী জানি ভাইয়া?
না।
LD হলো লেজার ডিস্ক। পুরো সিনেমাটা একটা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো রেকর্ডে থাকে। কী সুন্দর ছবি যে আসে না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না। একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে দেখাব। সরি বাসা বলে ফেলাম। বলা উচিত ছিল বাড়ি। বাসা তো না, আমরা তো আর ভাড়া বাড়িতে থাকি না যে বাসা। তাই না ভাইয়া? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
না চোখ বন্ধ করে আছি।
ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও। আর শোন ভাইয়া, বেশি চিন্তা করবে না। আমি রোজ এসে দেখে যাব। ও বলছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে। মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথি মিরাকলের মতো কাজ করে। ওর এক আত্মীয়ের তোমার মতো ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছিল। ডাক্তাররা সব জবাব দিয়ে দিয়েছে। তখন সে হোমিওপ্যাথি শুরু করে আস্তে আস্তে টিউমার মিলিয়ে যায়। যে ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিলেন তিনি আবার ইন্ডিয়া চলে গেলেন। আমি ওকে বলেছি–ইন্ডিয়াতেই যাক আর বিলাতেই যাক তুমি সেই ডাক্তারের খোঁজ বের করবে।
দেখ খুঁজে।
ভাইয়া আজ যাই।
আচ্ছা।
হাসানের অসুখের খবর সে কাউকে দেয় নি। তারপরেও কেমন করে জানি সবাই জেনে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ উপস্থিত হচ্ছে। হাসানকে বিস্মিত করে একদিন সুমি এসে উপস্থিত। তার গায়ে ধবধবে সাদা ফ্রক। হাতে অনেকগুলো গোলাপ। কী সুন্দরই না হয়েছে মেয়েটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
আপনাকে দেখতে এসেছি।
থ্যাংক য়্যু। খবর পেলে কোথায়?
সুমি মুখ টিপে হেসেছে। খবর কোথায় পেয়েছে সে বলবে না।
এত বড় অসুখ কী করে বাঁধালেন?
বুঝতে পারছি না। সুমি। অসুখের কথা থাক। তুমি কেমন আছ বল?
ভালো আছি।
তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ?
হুঁ।
তোমার যে ই.এস.পি, ক্ষমতা ছিল এখনো কি আছে? ভবিষ্যৎ বলতে পারতে। এখনো কি পার?
হুঁ।
আচ্ছা বল দেখি আমি আর কত দিন বাঁচব?
সুমি হাতের ফুলগুলো নাড়াচাড়া করছে। কিছু বলছে না। কিন্তু তার মুখ বিষন্ন নয়।
স্যার আপনার জন্যে একটা মজার জিনিস। এনেছি।
মাজার জিনিসটা কী?
এক ধরনের ক্যান্ডি। মুখে দিয়ে রাখবেন–এক সময় মুখের ভেতর পটপট শব্দ হতে থাকবে।
সে কী?
বাবা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছেন। মুখে দিয়ে দেখুন।
হাসান ক্যান্ডি মুখে দিয়েছে। এক সময় মুখের ভেতর সত্যি সত্যি পটপট শব্দ হওয়া শুরু করল। হাসান থুঁ করে ক্যান্ডি ফেলে দিল। সুমি হাসছে খিলখিল করে। হাসান মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে।
শীতের মাঝামাঝি সময়ে হাসানের অবস্থা খুব খারাপ হলো। তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। হাসপাতালটাই হয়ে গেল তার ঘরবাড়ি। কেবিনে স্যাতস্যাতে ঘর। বিবৰ্ণ দেয়াল। ফেনাইলের গন্ধমাখা মেঝেতে তার জীবন আটকে গেল। মানুষের সঙ্গ তার অসহ্য বোধ হতে শুরু করল। কেবিনের জানালা খুলে আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে ছোট্ট করে শুয়ে থাকতে। নিজের মনে কথা বলতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের মনে কথা বলে। একেক সময় একেকজন এসে তার মাথায় উপস্থিত হয়। এদিন যেমন এলেন আম্বিয়া খাতুন।
কী রে হাসান আমার মৃত্যু সংবাদ শুনেও তুই দেখতে এলি না। তুই এত বড় পাষণ্ড! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
দাদিমা আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি।
অসুখ হবে না–রোদের মধ্যে টো টো করে ঘোর। নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই। অসুখ হয়েছে ভালো হয়েছে।
আপনি এমন রেগে আছেন কেন দাদিমা?
জোয়ান ছেলে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে আছিস রাগব না? আমি খুবই রাগ করেছি। দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে আছিস কেন? মরার আগেই তুই দেখি ঘরটাকে কবর বানিয়ে ফেলেছিস। জানালা খোল।
জানোলা খুলতে ইচ্ছা করে না দাদিমা।
ইচ্ছা না করলেও খুলতে হবে। দাঁড়া আমি খুলে দিচ্ছি।
আম্বিয়া খাতুন অনেক চেষ্টা করলেন। জানালা খুলতে পারলেন না। বৃদ্ধর প্রাণান্ত চেষ্টা দেখে হাসান নিজের মনে খুব হাসল। হাসান যতই হাসছে বৃদ্ধা ততই রাগছেন।
হাসানকে খুব অবাক করে দিয়ে হাসপাতালের কেবিনে উপস্থিত হলো চিত্ৰলেখা। তার উপস্থিতি কল্পনায় নয়, বাস্তবে। চিত্ৰলেখা আগের চেয়ে রোগা হয়েছে। গায়ের রঙও খানিক কমেছে। কিন্তু সে আরো সুন্দর হয়েছে।
চিত্ৰলেখা হাসিমুখে বলল, আপনার অসুখের খবর আমি অনেক আগেই পেয়েছি–আসতে দেরি করলাম।
এই প্রথম হাসান লক্ষ করল কেউ একজন হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হেসে হেসে কথা বলছে। যেন হাসানের অসুস্থতা কোনো ব্যাপারই না।
দাড়িগোফ গজিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। শেভ করেন না কেন?
রোজ করি না। দু-এক দিন পর পর করি।
রোজ শেভ করবেন। সকালবেলা শেভ করে আয়না দিয়ে চুল আঁচড়ে–আয়নার দিকে তাকিয়ে বলবেন, হ্যালো ইয়াংম্যান।
আচ্ছা বলব। আপনি আমাকে দেখতে আসবেন আমি ভাবি নি।
অন্যেরা ভাবতে পারে না–এমন সব কাণ্ডকারখানা আমি প্রায়ই করি। শুনুন হাসান সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন যে আমি একজন ডাক্তার।
জ্বি জানি।
আপনার অসুখ সম্পর্কে যা খোঁজখবর নেবার আমি নিয়েছি। ডাক্তারদের ডায়াগনেসিস দেখেছি। ডায়াগনেসিস ভালো করেছেন। মনে হচ্ছে টিউমারটা শেকড় বসিয়ে দিয়েছে।
তার মানে কি এই যে আমার সময় শেষ?
হ্যাঁ, মানে মোটামুটি তাই। তবে শুনুন হাসান সাহেব–অপারেশন এবং রেডিওথেরাপির সুযোগ আছে। অপারেশনটা খুবই জটিল। তবে জনস হবকিন্সে দুজন সার্জন আছে যাঁদের হাত জাদুকরী হাত। তারপরেও রিকোভারির সম্ভাবনা কম। থাটি পার্সেন্ট। তবে থাটি পার্সেন্ট সম্ভাবনাও এক অর্থে অনেক সম্ভাবনা। তাই না।
জ্বি।
আমি সেই সম্ভাবনাটা যাচাই করতে চাই। আপনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং সম্ভাবনাটুকু পরীক্ষা করার আমার ইচ্ছা। আপত্তি আছে?
আপনি এটা করতে চাচ্ছেন কেন?
দুটা কারণ আছে। প্রথমটা আপনাকে বলা যাবে। দ্বিতীয়টা বলা যাবে না। প্রথম কারণ হলো, আমার বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন–আপনার কোনো সমস্যা হলে দেখতে।
ও আচ্ছা।
চিত্ৰলেখার দ্বিতীয় কারণটা অনেক জোরালো। হাসান নামের অতি দুর্বল এই মানুষটাকে হিশামুদিন সাহেবের চেয়েও অনেক বেশি পছন্দ তার নিজের। অহঙ্কারী মেয়েরা নিজের পছন্দের কথা সব সময় লুকিয়ে রাখে।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
আমি যদি আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি আপনার আপত্তি আছে?
জ্বি না।
থ্যাংক য়্যু।
চিত্ৰলেখা হঠাৎ লক্ষ করল তার চোখে পানি চলে আসছে। সে জানালার কাছে সরে গেল। জানালা বন্ধ কেন? জানালা খুলে দি কেমন?
জ্বি আচ্ছা।
চিত্ৰলেখা জানালা খুলে দিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল একটা মেঘের স্তুপ ভেসে ভেসে আসছে। খুব সাবধানে চিত্ৰলেখা তার চোখ মুছল। তার কাছে মনে হলো–মেঘের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। মানুষ যেমন কাঁদে মেঘও কাঁদে। বৃষ্টি হচ্ছে মেঘের অশ্রু। চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে মেঘের স্তুপের দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখকরা কল্পনা করতে খুব ভালোবাসেন। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগছে–হাসপাতালের জানালা থেকে যে মেঘটা দেখা যাচ্ছে সেই মেঘই এক সময় ঢেকে দিয়েছিল তিতলী এবং শওকতকে।
মানুষের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব একটা হয় না। কল্পনা করতে ভালো লাগে। হাসানের অসুখ সেরে গেছে। সে শুরু করেছে আনন্দময় একটা জীবন। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরতে গিয়েছে। নদীতে খুব ঢেউ উঠেছে। চিত্ৰলেখা ভয় পেয়ে বলছে, এ কোথায় নিয়ে এলে? আমি তো সাঁতার জানি না। নৌকা এমন দুলছে কেন? নৌকার মাঝি হাসিমুখে বলছে, টাইট হইয়া বহেন আফা, আমি আছি কোনো চিন্তা নেই।
খুব সহজে কল্পনা করা যায়, তারেক ঘর গোছাতে গিয়ে হঠাৎ ড্রয়ারে খুঁজে পেয়েছে রীনার লেখা চিঠি-চিঠিটা খুব ছোট্ট। রীনা লিখেছে, ‘তুমি কোনোদিন জানবে না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।’ চিঠি পড়েই তারেক বের হলো। যে করেই হোক রাগ ভাঙিয়ে রীনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাস্তব কখনো গল্পের মতো হয় না। বাস্তবের রীনা ফিরে আসে না। বাস্তবের হাসানদের সঙ্গে কখনো বুড়িগঙ্গার জলের ওপর চিত্ৰলেখার দেখা হয় না। তবে বাস্তবেও সুন্দর সুন্দর কিছু ব্যাপার ঘটে। যেমন–লিটনের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। লিটন তার বন্ধু হাসানের পাঠানো দুটো নাম থেকে একটি নাম তার মেয়ের জন্যে রাখে। দুটি নামের কোনোটাই তার পছন্দ না–তিতলী, চিত্ৰলেখা। তারপরেও সে মৃত বন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্ৰদ্ধা জানাতে মেয়ের নাম রাখল–চিত্ৰলেখা।
জীবন বয়ে চলবে। আবার এক নতুন গল্প শুরু হবে নতুন চিত্ৰলেখাকে নিয়ে। কোনো এক লেখক লিখবেন নতুন গল্প, আশা ও আনন্দের অপূর্ব কোনো সঙ্গীত।
অসাধারণ এবং বেদনাদায়ক।কিছু বলার ভাষা নেই।তবে বাস্তবে যাতে কারো জীবনটা এমন না হয়।
আসলেই বাস্তবতা বড় কঠিন।কল্পনা নাম বস্তুটা না থাকলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারত না।বাস্তবে যা ঘটবার নয়,সেসব কল্পনা করে আমরা আনন্দ পাই,পাওয়ার চেষ্টা করি।
One of the best.
শেষটা এত চমৎকার ছিল…অসাধারণ!
এক কথায় অকৃত্রিম। অসাধারণ একটা বাস্তবিক আখ্যান।
শেষের প্রতি চরণে চরণে -বিস্ময়, আনন্দ ও বেদনা।