২৬. জুলেখা কলিকাতা বেতার ভবনে

জুলেখা কলিকাতা বেতার ভবনের একটা ঘরে অনেকক্ষণ হলো বসে আছে। ঘরটির বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা— মহিলাদের বিশ্রাম কক্ষ। তিন-চারজন পুরুষ মানুষকে দেখা যাচ্ছে। তারা আসছে যাচ্ছে।

ঘরের মেঝেতে ফরাস পাতা। হারমোনিয়াম তবলা আছে। হারমোনিয়ামের পাশেই বিরাট এক পিকদান। কেউ কেউ পানের পিক ফেলার জন্যেই ঘরে ঢুকছেন। পিক ফেলে চলে যাচ্ছেন।

জুলেখা এসেছে, আজ তাকে একটি গানের সুর দেখিয়ে দেয়া হবে। সে গলায় গান তুলবে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ইসলামি গান। ইসলামি গানের এখন খুব কদর হয়েছে। ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গানটির রেকর্ড আছে সব মুসলমানের বাড়িতে। আব্বাসউদ্দিনের সুরেলা গলা এইক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।

জুলেখা যে গান গাইবে তার কথা—

ভালোবাসা পায় না যে জন
রসুল তারে ভালোবাসে।
উম্মতেরে ছেড়ে কভু
বেহেশতে যায় না সে।।
যে জন বেড়ায় পিয়াস লয়ে
দ্বারে দ্বারে নিরাশ হয়ে
সবুরেরি মেওয়া নিয়ে
নবীজি তার সামনে আসে।।
যে খেটে খায় হালাল রুজি
তারি দুনিয়াদারি
মোর নবীজি কমিলিওয়ালা
সহায় যে হন তারি
সংসারে যে নয় উদাসীন
খোদার কাজে যে রাহে লীন
রসুল তারে বক্ষে বাঁধেন
রহমাতেরি বাহুর পাশে।

[সূত্র; নজরুল গীতি অখণ্ড, আব্দুল আজিজ আল আমান। হরফ প্রকাশনী। কলেজ স্ত্রীট, কোলকাতা।]

জুলেখাকে গানের কথা দেয়া হয়েছে। সুর বলা হয় নি। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে সুর দেখিয়ে দেবেন এবং গলায় গান তুলে দেবেন। এই আলাভোলা মানুষটার সঙ্গে জুলেখার পরিচয় আছে। তিনি যখন রেকর্ড কোম্পানিতে চাকরি করতেন তখনি পরিচয়।

কাজী নজরুল রেকর্ড কোম্পানির কাজ ছেড়ে রেডিওতে যোগ দিয়েছেন। রেডিওকে বলা হচ্ছে ‘আকাশবাণী’। রবীন্দ্ৰনাথের দেয়া নাম। আকাশবাণীতে যোগ দেয়ার পর থেকে কবি নজরুল অন্যমনস্ক। কথাবার্তা এলোমেলো। হঠাৎ হঠাৎ বিচিত্ৰ সব কথা বলেন। কাজে কোনো মন নেই। বনগাঁ সাহিত্য সভার চতুৰ্থ বার্ষিক সম্মেলনে তিনি হঠাৎ বললেন, দুদিন আগে যেমন করে যে ভাষায় বলতে পারতাম, সে ভাষা আমি ভুলে গেছি। যদি আর বাঁশি না বাজে আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন।

কবি নজরুল তার অতি ঘনিষ্ঠদের অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও বলেছেন। যেমন আল্লাহর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। অনেক গুঢ় বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। মা কালীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। মা কালীর কণ্ঠস্বর অতি মধুর ও সুরেলা।

জুলেখা কয়েকবার রেডিও অফিসে খোঁজ নিয়েছে। কাজীদা আসেন নি। সম্ভবত আজ আর গান তোলা হবে না। জুলেখা চলে যাবার জন্যে মন ঠিক করে। ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজী নজরুল ঢুকলেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গলায় গেরুয়া চাদর। কবি সরাসরি হারমোনিয়ামের সামনে বসে জুলেখাকে ডাকলেন।

জুলিয়া, ভালো আছ?

জুলেখা কবির সামনে বসল। কবি তাকে জুলিয়া ডাকেন। জুলেখা নামটা না-কি তার মাথায় থাকে না। পাতলা হয়ে জুলিয়া হয়ে যায়।

জুলিয়া, তুমি এই গান গাইবে বেণুকা রাগিণীতে। বেণুকা আর দোলনচাঁপা এই দুটা রাগিণী আমার তৈরি, তোমাকে বলেছি না?

জুলেখাকে এই বিষয়ে কাজী নজরুল কখনো কিছু বলেন নি, তবু জুলেখা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার প্রধান চেষ্টা সময় নষ্ট না করে গানটা গলায় তুলে নেয়া। একবার দেখিয়ে দিলেই সে পারবে। গান দেখিয়ে দেবার সময় কি কবির হবে? তিনি ছটফট করছেন।

জুলিয়া, আমি যে হাত দেখতে পারি তুমি জানো?

না।

এসো তোমার হাত দেখে দেই। গান পরে হবে। কবি জুলেখার হাত টেনে নিলেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে হাতের রেখা দেখতে দেখতে বললেন, তোমার হাতের রেখা ভালো। বৃহস্পতিতে ত্রিশুল চিহ্ন আছে। বৃহস্পতিতে ত্রিশুল থাকা অত্যন্ত শুভ। গানবাজনায় নাম করবে। অবশ্যি নাম তো এখনই করেছ। পারিবারিক জীবন শুভ। স্বামীভাগ্যে তুমি ভাগ্যবতী।

জুলেখা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কবি নিঃশ্বাসের অর্থ ধরতে পারলেন না।

মঙ্গলের ক্ষেত্রে অনেক কাটাকুটি। স্বাস্থ্য ভালো যাবে না। প্রায়ই নানান অসুখবিসুখ হবে। হয় না?

জুলেখার অসুখবিসুখ তেমনুকুয় না। তারপরেও হা-সূচক মাথু নাড়ল। আজ মনে হয় গান তোলা হবে না। সময় কেটে যাবে হাত দেখাদেখিতে।

কবি বললেন, তুমি কি আমার ঐ গানটা শুনেছ? ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারা ফুল।

জি শুনেছি।

গান লেখার ইতিহাসটা শোন। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ আব্বাসউদ্দিন বলল, এক লক্ষ টাকা যদি লটারিতে পাওয়া যায়, তাহলে প্রিয়ার জন্যে কে কী উপহার কিনবে? একেকজন একেক কথা বলছে, আমি করলাম কী হারমোনিয়াম টেনে গান ধরলাম– ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি দেব খোপায় তারার ফুল।’ হাঃ হা হা। একটা পয়সা খরচ হলো না। প্রিয়া তার উপহার পেয়ে গেল। হা হা হা।

জুলেখা তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে মানুষটা ভালো নেই।

কবি হঠাৎ গলা অস্বাভাবিক নিচু করে বুললেন, কাউকে যদি না বলে। তাহলে তোমাকে অতি গোপন একটা কথা বলব।

কাউকে বলব না।

তোমার চেহারার সঙ্গে নার্গিসের চেহারার মিল আছে। সেও তোমার মতো রূপবতী।

নার্গিস কে?

আমার প্রথম স্ত্রী। কুমিল্লার মেয়ে। বিয়ের রাতেই আমি তাকে ফেলে চলে আসি।

কেন?

সেটা তো তোমাকে বলব না। শৈলজানন্দ আমার অতি প্ৰিয়জন। তাকেও বলি নি।

কবি গলার স্বর নিচু করে বললেন, তবে আল্লাহর সঙ্গে আমার কী কথাবার্তা হয়েছে সেটা বলব। বাতেনী কথা, অর্থাৎ অতি গৃঢ় রহস্যের কথা। তিনি আমাকে ডেকেছেন ‘চিরকবি’ নামে। যে কারণে আমি যখন অটোগ্রাফ দেই তখন লিখি- চিরকবি নজরুল। দেখি তোমার গানের খাতা। চিরকবি নজরুল লিখে দেই।

জুলেখা গানের খাতা এগিয়ে দিল। কাজী নজরুল লিখলেন—

জুলিয়া
আমারে যেও না ভুলিয়া।
চিরকবি কাজী নজরুল ইসলাম।

এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই কবি চিরদিনের জন্যে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কবি তার একটি গানে লিখেছিলেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।’ তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশেই তাঁর কবর।

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মোয়াজিনের আজান শুনতে পাই।।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজিরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।
কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজির উম্মত
ঐ মসজিদে করে রে ভাই কোরান তেলাওত।
সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।
কত দরবেশ ফকির রে ভাই মসজিদের আঙিনাতে
আল্লাহর নামে জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে।।
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে
আল্লাহর নাম জপিতে চাই। *

[* হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড। গায়ক মোঃ কাশেম। রেকর্ড নাম্বার N 17476]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *