২৬. ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আমাদের নিত্য বসবাস। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এখনো 1910 সালের 12 নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টির কথা বলা হয়–অনুমান করা হয় সে রাতে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। (আমি সেটা দেখেছিলাম–জোছনার এক ধরনের আলো ছিল, তার মাঝে প্রচণ্ড ঝড়ে গাছপালা মাথা কুটছে, এরকম একটা দৃশ্য আমার স্মৃতির মাঝে গেঁথে আছে।) এই ঘূর্ণিঝড়ের সাথে বাংলাদেশের জন্মের একটা সম্পর্ক আছে। তখন এই দেশটা ছিল পাকিস্তানের অংশ, ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট–এরকম ভয়ঙ্কর একটা ঘূর্ণিঝড় হয়েছে জানার পরও এই মানুষটি চীন থেকে ফেরার পথে উপদ্রুত এলাকা দেখতে যায় নি। এই দেশের মানুষ সেদিন বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের সাথে তাদের থাকা যাবে না। এর পরের নির্বাচনেই বাংলাদেশের মানুষ নূতন রাষ্ট্রের সূচনাটি করে দিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় সম্ভবত প্রকৃতির চমকপ্রদ কিছু বিষয়গুলোর মাঝে একটি। যখন উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর ছবি ভোলা যেত না তখন সেটা এত স্পষ্ট করে মানুষ দেখে নি। এখন উপগ্রহের ছবিতে মানুষ স্পষ্ট দেখতে পায় একটা ঘূর্ণিঝড় জন্ম নিচ্ছে তারপর তার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। তার ভেতর সঞ্চিত রয়েছে কী অমিত শক্তি, কার সাধ্যি আছে তার সাথে যুদ্ধ করে। ভূমিকম্পের মতো সেটি গোপনে এসে আঘাত করে না, সে তার উপস্থিতির কথা জানিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, মানুষকে তার অদম্য ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা পাবার একটা সুযোগ দিয়ে রাখে।
যারা ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দেখেছে তারা সবাই জানে এর মাঝে আসলেই একটা ঘূর্ণন আছে। উত্তর গোলার্ধে সেটা হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে দক্ষিণ গোলার্ধে সেটা ঘড়ির কাঁটার দিকে। পৃথিবী তার অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে এটা ঘটে এবং এরকম যে হবে সেটা কেউ ইচ্ছে করলে ঘরে বসেই পরীক্ষা করতে পারবে! বাথটাব বা বেসিনে পানি ভরে হঠাৎ করে নিচের ফুটোটুকু খুলে পানিটাকে চলে যেতে দিলে দেখা যায় সেটা সোজাসুজি না গিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে যাচ্ছে এবং উত্তর গোলার্ধে সেটা সবসময়েই হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে! (ঘূর্ণন বোঝানোর জন্যে সবসময়েই বলা হয় ঘড়ির কাঁটার দিকে কিংবা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে। আজকাল ডিজিটাল ঘড়ি এসেছে, কিছুদিন পর যদি শুধু ডিজিটাল ঘড়িই থাকে তাহলে ঘূর্ণনের দিক বোঝাব কেমন করে?) আমি এখনো দক্ষিণ গোলার্ধে যাই নি তাই সেখানে যে ঘূর্ণনটা হয় ঘড়ির কাঁটার দিকে সেটা এখনো পরীক্ষা করে দেখতে পারি নি!
একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে অকল্পনীয় পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন ঘূর্ণিঝড় যে পরিমাণ তাপশক্তি তৈরি করে (বিলিয়ন মেগাওয়াট) সেটা সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তার একশ গুণ! প্রকৃতি যে পদ্ধতিতে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে এই বিশাল শক্তি সঞ্চয় করে সেটা অত্যন্ত চমকপ্রদ। শক্তিটা আসে সমুদ্রের পানি থেকে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যখন ২৬.৫ডিগ্রিতে পৌঁছায় তখন সমুদ্রের পানি থেকে শক্তিটা ঘূর্ণিঝড়ের যেতে পারে। সে জন্যে আমরা কখনো শীতকালে ঘূর্ণিঝড় হতে দেখি না–এটা সবসময়েই হয় গ্রীষ্মের শুরুতে যখন তাপমাত্রা এখানে পৌঁছায় আবার শীতের শুরুতে যখন তাপমাত্রা এখানে নেমে আসে। বাংলাদেশকে উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকার মাঝে ফেলা হয়, এই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আনুষ্ঠানিক সময় এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বড় বড় সব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে মে মাস কিংবা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।
ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার জন্য প্রথমে নিম্নচাপের সৃষ্টি হতে হয়। “নিম্নচাপ” কথাটার অর্থ হচ্ছে বাতাসের চাপ কমে যাওয়া–সেই চাপ পূরণ করার জন্যে আশেপাশের অঞ্চল থেকে বাতাস সেখানে ছুটে আসতে থাকে। বাথটাব কিংবা বেসিনের পানি ছুটে আসার সময় যেরকম ঘূর্ণন শুরু হয়–এখানেও সেভাবে, বাতাসের একটা ঘূর্ণন শুরু হতে পারে। বাতাসের ঘূর্ণনকে পুরোপুরি তৈরি করতে হলে তার মাঝে শক্তি দিতে হবে এবং এই শক্তি দেয়ার প্রক্রিয়াটি ঠিকভাবে শুরু হলো কী না তার উপরেই নির্ভর করে একটা ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেবে কী নেবে না।
যে প্রক্রিয়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের পানি থেকে শক্তি দেয়া হয় সেটা খুব সহজ এবং চমকপ্রদ। গরমের দিনে আমরা যখন খুব ভিড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ করে খোলা জায়গায় এসে হাজির হই তখন আমরা এক ঝলক শীতল অনুভব করি। তার কারণ ভিড়ের মাঝে গরমে আমরা ঘেমে যাই, যখন হঠাৎ ফাঁকা জায়গায় যাই বাতাসে সেই ঘাম শুকায়, যার অর্থ ঘামের পানিটুকু বাস্পীভূত হয়। পানি বাষ্পীভূত হওয়ার জন্যে তাপের দরকার, পানি সেই তাপটুকু নেয় শরীর থেকে, তাই শরীরটা শীতল হয়ে যায়।
আমরা যদি বিশ্বাস করে নিই যে পানিকে বাস্পীভূত করা হলে পানিটুকু তাপ নিয়ে নেয় তাহলে তার উল্টোটাও নিশ্চয়ই সত্যি। বাস্পীভূত জলীয়বাষ্প যদি পানির ফোঁটায় পাল্টে যায় তাহলে তাকে তাপ দিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার সময় ঠিক সেটা ঘটে, সমুদ্রের বাষ্পীভূত পানি উপরে উঠে গিয়ে পানির ফোঁটায় পরিণত হয় তখন সে তাপ দিতে থাকে। সেই তাপ শক্তি তখন বাতাসকে গতিশীল করে তোলে, সেই বাতাস তখন দ্রুত ছুটতে থাকে (শক্তি বেশি তাই গতি বেশি!) বাতাস যখন আরো দ্রুত ঘুরতে থাকে তখন নিচের সমুদ্রের পানি আরো দ্রুত বাস্পীভূত হতে থাকবে–যদি আরো দ্রুত বাস্পীভূত হয় তাহলে সেই বাষ্প উপরে উঠে আরো দ্রুত তাপ ছড়াতে থাকবে–আরো বেশি শক্তি সঞ্চিত হবে ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে।
বড় কেটলির মাঝখানে তাপ দিলে গরম পানিটুকু উপরে উঠে যায়, ঠাণ্ডা পানি কেটলির কিনারা দিয়ে নিচে নেমে আবার কেটলির মাঝখানে হার্ট হয়–সেখান থেকে গরম হয়ে আবার উঠে যায়। এভাবে ক্রমাগত একটা পরিবহন হতে থাকে আর তাপটুকু খুব চমৎকারভাবে পানির মাঝে সঞ্চালিত হয়। ঘূর্ণিঝড়েও এরকম তাপের পরিবহনের একটা ব্যাপার ঘটে–সমুদ্রের বাষ্পীভূত পানি তাপটাকে উপরে নিয়ে যায়, উপরে সেটা পানির ফোঁটায় পাল্টে গিয়ে তাপটুকু ছড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের বাইরের অংশ দিয়ে বাতাস আবার নিচে নেমে আসে-ঘূর্ণনের মাঝে দিয়ে মাঝখানে এসে আবার উপরে উঠে যায়। পুরো ব্যাপারটা একটানা ঘটতে থাকে। যতই সেটি ঘটে ততই আরো বেশি ঘটার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একটা ব্যাপার যখন সেটা আরো বেশি ঘটাতে শুরু করে তখন সেটাকে বলে “পজিটিভ ফিড ব্যাক” আর এই প্রক্রিয়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে বিশাল একটা শক্তি সঞ্চয় হয়। ঘূর্ণিঝড় তখন তার সেই বিশাল শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে–পৃথিবীর মানুষ হতবাক হয়ে সেই ঘূর্ণিঝড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটা ঘূর্ণিঝড় যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় তখন ঠিক তার কেন্দ্রে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়ের “চোখ” বা eye, সেটি হচ্ছে 30 থেকে 40 km বিস্তৃত একটা এলাকা যেটা আশ্চর্য রকম শান্ত! এই কেন্দ্রকে ঘিরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড তুলকালাম ঘটতে থাকে কিন্তু ঠিক মাঝখানে কিছু নেই–এমন কী অনেক সময় সেটা থাকে মেঘমুক্ত, শান্ত। সমুদ্রে মহাসমুদ্রে যখন ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় তখন সেটা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না–সেটা মানুষের ক্ষতি করে যখন সেটা স্থলভূমিতে মানুষের লোকালয়ে হাজির হয়। যারা নিজের চোখে ঘূর্ণিঝড়ের সরাসরি আঘাত দেখেছেন তারা সবাই ঘূর্ণিঝড়ের “চোখ” বা eyeটি দেখেছেন। প্রথমে দেখা যায় বাতাস একদিক থেকে অন্যদিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। ঠিক যখন ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি হাজির হয় তখন মনে হয় ঝড় থেমে গেছে। আকাশে মেঘ নেই, পরিষ্কার আকাশ। যারা ব্যাপারটা জানে না তারা ঘর থেকে বের হয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে শুরু করে। দেখতে দেখতে ঘূর্ণিঝড়ের চোখ এলাকাটাকে অতিক্রম করে আবার প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করে–এবারে সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে–মানুষের বিস্ময়ের সীমা থাকে না!
ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সমুদ্রে, তাই সেটা যখন উপকূলে আঘাত হানে তখন সাথে নিয়ে আসে জলোচ্ছাস। সেই বিশাল জলোচ্ছাসে তলিয়ে যায় উপকূলের বিস্তৃত এলাকা! আমরা জানি আমাদের দেশে সেই জলোচ্ছাসের আকার হয় বিশ থেকে ত্রিশ মিটার–কার সাধ্যি আছে সেই বিশাল জলরাশিকে আটকে রাখার?
ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে প্রকৃতির একটা ইঞ্জিন, তাপশক্তির ইঞ্জিন। সমুদ্রের পানি থেকে তাপ নিয়ে সেই ইঞ্জিন বাতাসে ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে। যদি কোনোভাবে সেই তাপ নেয়ার প্রক্রিয়াটা বন্ধ করে দেয়া যায় তাহলেই এই বিশাল ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। আসলেও সেটা হয় যখন ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভূমিতে উপস্থিত হয়। তখন নিচে সমুদ্রের উষ্ণ পানি নেই, সেই পানি থেকে জলীয়বাষ্প হিসেবে উপরে তাপ পাঠানোর কোনো উপায় নেই। তাই আমরা দেখতে পাই স্থলভূমিতে আসার পর ঘূর্ণিঝড় দেখতে দেখতে দুর্বল হয়ে যায়–সাধারণ ঝড় বৃষ্টিতে পাল্টে গিয়ে সেটা শেষ হয়ে যায়।
আগে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল না, ইদানীং তাদের নাম দেয়া শুরু হয়েছে। প্রথমে ঘূর্ণিঝড়ের নাম হতো মেয়েদের নামে। খুব সঙ্গত কারণেই মেয়েরা আপত্তি করল, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন মেয়েদের নামে হবে? এখন নামকরণের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে–একটা ছেলের নাম এরপর একটা মেয়ের নাম। এক এলাকায় যেসব দেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে সেই সব দেশ নামগুলো দেয়। বাংলাদেশের দেয়া নামগুলোর মাঝে আছে অনিল, অগ্নি, নিশা, গিরি বা চপলার মতো নাম। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর” নামটি ছিল ওমানের দেয়া, তার পরের নাম নার্গিস’ নামটি পাকিস্তানের।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেসব নাম মানুষের নাম হিসেবে প্রচলিত সেই নামগুলো ঘূর্ণিঝড়ের জন্যে ব্যবহার করা ঠিক নয়। সেই নামে কোনো মানুষ থাকলে সে আহত হয় এবং একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের পর সেই নামটি পৃথিবী থেকে মুছে যায়। ক্যাটারিনা খুব সুন্দর একটা নাম কিন্তু 2005 সালে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সম্পদ ধ্বংসকারী (100 বিলিয়ন ডলার) ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর সেই দেশে কেউ তার কন্যা সন্তানের নাম ক্যাটারিনা রাখে না।
ঘূর্ণিঝড়ের মূল বিষয়টা বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন বলে সেটাকে থামানোর জন্যে কিছু যে চেষ্টা করা হয় নি তা নয়। আকাশে সিলভার আয়োডাইড ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে দিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে। ঠিক যেখান থেকে উষ্ণ পানির তাপ আকাশে উঠে যায় সেখানে বরফের চাই (হিম শৈল) টেনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে–এমন কী নিউক্লিয়ার বোমা ফাটিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে ছিন্নভিন্ন করার কথাও যে আলোচিত হয় নি তা নয়! কিন্তু মানুষ পর্যন্ত টের পেয়েছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা চারটিখানি কথা নয়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তার সাথে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ!