২৬. গায়ে হলুদের দিন-তারিখ

শাহানার গায়ে হলুদের দিন-তারিখ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।

প্রথম ঠিক হল সোমবার সকালে। বরের বাড়ি থেকে ঠিক নটায় মেয়েরা আসবে। দশটার ভেতর বিদেয় করে দিতে হবে। বিয়ে শুক্রবারে, গায়ে হলুদ এত আগে আগে কেন? হলুদের পর কিছু নিয়মকানুন পালন করতে হয়। ঘর থেকে হলুদ-দেওয়া মেয়ে বেরুতে পারে না। ছেলেদের দিকে তাকাতে পারে না। বরপক্ষের কেউ কিছু শুনলেন না। ওদের একটিই কথা, সোমবারই হবে। এবং নটার সময়ই হবে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সোমবার খুব ভোরে তাঁরা জানালেন, একটা বিশেষ ঝামেলা হয়েছে।–হলুদ হবে মঙ্গলবার বিকেলে। ঠিক তিনটার সময় তাঁরা আসবেন, চারটির মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত সেই দিনও বদলাল। ঠিক হল বুধবার সকাল।

নীলু খুব বিরক্ত হল। বরের চাচাকে বলেই ফেলল, আপনারা মন ঠিক করুন। বরের চাচা মনে হল এই কথায় খুব অপমানিত বোধ করলেন। গলার স্বর চট করে পাল্টে ফেলে বললেন, অসুবিধা আছে বলেই তো বদলানো হচ্ছে। শখ করে নিশ্চয়ই বদলাচ্ছি না।

ভদ্রলোক মুখ অন্ধকার করে রইলেন। চা-নািস্তা কিছুই মুখে দিলেন না। যাবার সময় সহজ ভদ্রতায় বিদায়ও পর্যন্ত নিলেন না। নীলু খুব অপ্রস্তুত বোধ করল।

মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ক্যািটক্যাট করে ঐ কথাগুলি না-বললে হত না বৌমা?

ধলার ইচ্ছা ছিল না মা। মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। এমন কিছু অন্যায় কথাও কিন্তু বলি নি।

আমাকে ন্যায়-অন্যার শেখাতে এস না। বয়স কম হয় নি! ন্যায়-অন্যায় চিনি। তোমরা সবাই চাও বিয়েটা নিয়ে একটা ঝামেলা হোক। ভালোয়-ভালোয় এটা পার করি তা চাও না।

নীলু চুপ করে গেল। মনোয়ারা চুপ করলেন না। তাঁর স্বভাবমতে কথা বলতে ই লাগলেন। শেষের দিকে তাঁর কথায় মনে হতে লাগল, যেন নীলু আগের থেকে সব ঠিকঠাক করে বরপক্ষীয়দের সঙ্গে এই ঝামেলাটা বাধিয়েছে! এক পর্যায়ে শাহানা কড়া গলায় বলল, তুমি যদি এই মুহুর্তে চুপ না কর্ম, তাহলে কিন্তু আমি একটা কাণ্ড করব।

কী কাণ্ড কারবি?

সেটা যখন করব তখন বুঝবে। এখন বল চুপ করবে কি না। শুধু শুধু ক্যাচক্যাচ করে বাড়িসুদ্ধ সবার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ।

মনোয়ারার রক্ত চড়ে গেল। তিনি নিতান্তই অবান্তর সব কথা বলতে লাগলেন। যার মধ্যে একটি হচ্ছে নীলুদের পরিবার হচ্ছে ছোটলোকের পরিবার। তিন বছর পর মা মেয়েকে দেখতে এসেছিল খালিহাতে। একটা বিসকিটের প্যাকেট পর্যন্ত ছিল না। পরিবারের আছর যাবে কোথায়? মার যেমন ছোট মন, মেয়েরও তেমনি হয়েছে। মানুষের ভালো দেখতে পারে না-ইত্যাদি

এইসব কথাবার্তার কোনো রকম জবাব দেওয়া অর্থহীন। নীলু রান্না চড়িয়ে দিয়ে প্রাণপণে ভাবতে লাগল, সে এখন কিছুই শুনছে না। কিন্তু মনোয়ারা নীলুর একটি দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছেন, যা তিনি প্রায়ই করেন। নীলুর মা খালিহাতে মেয়েকে দেখতে এসেছিলেন। এই কথা নীলুকে অতীতে লক্ষ বার শুনতে হয়েছে। বাকি জীবনে হয়তো আরো কয়েক লক্ষ বার শুনতে হবে।

হোসেন সাহেব নিঃশব্দে রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। নিচু গলায় ডাকলেন, বৌমা!

নীলু স্বাভাবিক স্বরে বলল, চা লাগবে বাবা?

না মা, চা-টা কিছু না! তোমার শাশুড়ি কী সব শুরু করেছে। কিছু মনে করো না গো লক্ষ্মী ময়না।

আমি কিছু মনে করি নি।

যে-সব সে বলছে, ওগুলি তার মনের কথা না।

নীলু জবাব দিল না। তার চোখে পানি এসে গিয়েছে। এই স্নেহময় বৃদ্ধটি অসংখ্য বার তার চোখে পানি এনে দিয়েছেন। এই ভালোবাসার তেমন কোনো প্রতিদান নীলু কি দিতে পেরেছে?

তোমার শাশুড়ি হচ্ছে তোমার মেয়ের মতে, বুঝলে মা? মেয়ের উপর কি আর রাগ করা যায়, বল? কথা বলছি না কেন? ব্ল্যাগ করা যায়?

না, যায় না। আপনাকে চা করে দিই?

দাও।

রাতে ঘুমুতে যাবার সময় শফিক হাই তুলে বলল, মা-র সঙ্গে নাকি তুমুল একটা যুদ্ধ করলে?

হ্যাঁ, করলাম। খবরটা তোমাকে দিল কে?

টুনি দিয়েছে। বাতি নেভাণ্ড। শোন, মা-র সঙ্গে আর একটু মানিয়ে চলতে পার না? বুড়ো মানুষ কিছু একটা বললেই যদি কোমর বেঁধে ঝগড়া শুরু কর, তাহলে তো মুশকিল।।

নীলু বাতি নিভিয়ে দিল।

গা ঘামে চটচট করছিল অনেকখানি সময় নিয়ে গোসল করল। ফুল ভেজাবে না ভেজাবে না করেও চুল ভেজাল! নিৰ্ঘাৎ ঠাণ্ডা লাগবে; কিন্তু বাথরুম থেকে বেরুতে ইচ্ছে কব,ছে না! ইচ্ছা করছে। শাওয়ারের নিচে সারা রাত মাথা ধরে রাখতে, যাতে মনের সব গ্লানি জলধারার সঙ্গে ধুয়েমুছে যায়। কিন্তু তা কি আর যায়? যায় না। গ্লানি থেকেই যায়।

শাহানার ঘরে বাতি স্থূলছে। আজকাল অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে বাতি জ্বলে। সে কি ইচ্ছে করেই জেগে থাকে, না তার ঘুম আসে না? বিয়ে-ঠিক-হওয়া মেয়েকে একা একা ঘুমুতে দিতে নেই। কিন্তু শাহানাকে দিতে হচ্ছে। সে তার মার সঙ্গে ঘুমুতে রাজি না।

অবশ্যি তার ঘরের একটি চৌকিতে বাবলু ঘুমায়। তাকে কি মানুষের মধ্যে গণ্য করা যায়? বোধহয় যায় না। সে বাস করে ছায়ার মতো। কদিন ধরে জ্বর যাচ্ছে কিন্তু একটি কথাও কাউকে বলে নি। শফিক প্রথম লক্ষ করল এবং বেশ কিছু কড়া কড়া কথা শোনাল সে-সব কথার সারমর্মব হচ্ছে–এই ছেলেটা কোনো আসবাবপত্র না। এও একটি মানুষ।

বাতি জ্বলছে রান্নাঘরেও। রফিক ফিরেছে বোধহয়। ঘুমুবার আগে সে এক কাপ চা খায়। এতে নাকি তার সুনিদ্রা হয়। নীলু এগোলো রান্নাঘরের দিকে। চিরকাল সে শুনে এসেছে চা খেলে ঘুম কমে যায়, রফিকের বেলায় উল্টো।

রান্নাঘরে রফিককেই পাওয়া গেল। চা নয়, প্লেটে ভাত নিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত। বড়ো বড়ো দলা মেখে মুখে দিচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রচুর খিদে। নীলুকে দেখে রফিক অপ্রস্তুতের ভঙ্গিতে হাসল।

এটা কেমন খাওয়ার নমুনা, রফিক? শারমিনকে বললেই সে গরমটরম করে দিত।

ও ঘুমুচ্ছে। বেকার মানুষ, বৌকে রাত—দুপুরে ঘুম ভাঙাই কি করে?

আমাকে ডাকতে। যাও, টেবিলে গিয়ে বস। আমি গরম করে আনছি।

আমার খাওয়া শেষ, কাজেই তোমাকে কিছুই করতে হবে না, ঘুমুতে যাও।

এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী করছিলে?

নাথিং। তুমি আবার এখন উপদেশ দিতে শুরু করলে ঝামেলা হয়ে যাবে। যা বলছি তাই করা, ঘুমুতে যাও।

চল, একসঙ্গেই যাওয়া যাক?

আমার দেরি হবে। চা খাব।

রফিক চায়ের পানি বসাল! এঁটো থালা-বাসন পরিষ্কার করল। নীলু তাকিয়ে আছে। বেশ মজা লাগছে তার।

ড্যাবড্যাব করে কী দেখছ ভাবী?

তোমার ঘরকন্না দেখছি। এক হাতে প্লেট পরিষ্কার করার এই কায়দা কোথায় শিখলে?

সব কিছু কি ভাবী শিখতে হয়? কিছু বিদ্যা মানুষ সঙ্গে নিয়েই জন্মায়। তুমিও কি চা খাবে?

না।

আমি কিন্তু দু জনের পানি দিয়েছি।

তুমি নিজেই দু কাপ খাও। ভালো সুম হবে।

রফিক চা বানাতে পারল না! ঘরে চায়ের পাতা নেই। নীলুর খুবই খারাপ লাগতে লাগল। বেচারা এত কষ্ট করে পানি টানি গরম করেছে।

সরি রফিক। আমি খেয়াল করি নি!

সরি হবার কোনোই কারণ নেই ভাবী। আজকের দিনটিই আমার জন্য খারাপ। যে কটা কাজ করতে গিয়েছি, প্রতিটি ভণ্ডুল হয়েছে।

মোড়ের চায়ের দোকানটা খোলা আছে না? ওখান থেকে খেয়ে আস।

দরজা খুলে দেবে কে?

আমি জেগে থাকব।

রফিক সঙ্গে সঙ্গে রওনা হল। তার মুখ হাসি-হাসি। নীলু বসার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। এক বার যখন বের হয়েছে এত সহজে ফিরবে না। শাহানার ঘরে এখনো বাতি জ্বলছে। এক বার উঁকি দিয়ে দেখলে হয়। কিন্তু কেমন আলসে লাগছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না।

মাঝে মাঝে এমন আলসেমি লাগে। কোনো কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। তারও কি বয়স হয়ে যাচ্ছে? হচ্ছে তো নিশ্চয়ই, কিন্তকেন জানি তা মেনে নিতে ইচ্ছা করে না। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয়, কই, বয়স তো কিছুই বাড়ে নি। সুন্দর একটি মায়াভিরা মুখ। ঘন কালো চোখ। এই চোখ নিয়ে কত কাণ্ড। তাদের কলেজের ইংরেজির স্যার আফতার উদিনের কাছে গিয়েছে পার্সেন্টেজ দিতে। ক্লাসে দেরি করে এসেছিল, সেখানে দেয়া হয় নি। আফতার স্যার রেজিস্টার খাতা খুলে বললেন, তোমার কটা পার্সেন্টেজ। দরকার বল তো? মোটে একটা? নীলু বিস্মিত হয়ে তাকাতেই তিনি বললেন, বাহ, তোমার চোখ তো ভারি সুন্দর! ভালো করে তাকাও আমার দিকে। এই বলেই কিছু বোঝাবার আগেই গালে হাত দিয়ে নীলুর মুখ তাঁর দিকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন বিকেল হয়ে গেছে। কমন রুমে একটি মানুষ নেই। আফতার স্যার তাকাচ্ছেন অদ্ভুত চোখে; কী সৰ্ব্বনাশা। কাণ্ড! প্রতিটি মেয়ের জীবনেই এ-রকম দু-একটা ঘটনা ঘটে, যা চিরকাল গোপন রাখতে হয়। কোথায় এখন আফতার স্যার কে জানে। কী সুন্দর ভরাট গলায় শেকসপীয়ার পড়াতেন! এখনো কানো বাজে।

Tell them that God bids us do good for evil.
And thus I clothe my naked villainy

With odd old ends stolen out of Holy Writ.
And seem a saint when most I play the devil.

কিং রিচার্ড দ্য থার্ড। আচ্ছা, তার যদি আফতার স্যারের সঙ্গে বিয়ে হত তাহলে কেমন হ৩? জীবনটা নিশ্চয়ই সম্পূৰ্ণ অন্য রকম হত। টুনি জন্মাত না। অন্য কোনো মেয়ে জন্মাত কিংবা কোনো ছেলে। এখন সে যেমন টুনিকে ভালোবাসে, সেই ছেলে বা মেয়েটিকে সে তেমনই ভালোবাসত। বাসত না?

ভাবী। একা একা বসে আছ কেন?

শাহানা বের হয়ে এসেছে। একটা সাদা চাদর এমনভাবে গায়ে জড়িয়েছে। যে, অদ্ভুত লাগছে দেখতে।

কথা বলছি না কেন ভাবী?

রফিকের জন্যে বসে আছি। রফিক দোকানে চা খেতে গিয়াছে। ঘরে চা ছিল না।

ছিল না, তবু খেতেই হবে? ছেলে হবার কত মজা, দেখলে ভাবী? একটা ছেলে যা চাইবে, সবাই তাকে তা করতে দেবে, কিন্তু একটা মেয়েকে দেবেন!

আমি দেব। তুমি যদি এখন বাইরে চা খেতে যেতে চাও, আমার কোনো আপত্তি নেই, যেতে পার।

শাহানা গভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলল। নীলুও হাসল। শাহানা বলল, তুমি শুয়ে পড়, আমি দরজা খুলে দেব। আমার ঘুম আসবে না। রাতে আমি প্রায় জেগেই থাকি। দিনে ঘুমাই।

অভ্যেসটা ভালো, বিয়ের পর তাহলে আর খুব কষ্ট হবে না। কষ্ট হবে না কেন? বিয়ের পর অনেক দিন পর্যন্ত স্বামী নামক জিনিসটি বৌদের রাতে ঘুমুতে দেয় না।

শাহানা কিছু বলল না। নীলু লক্ষ করল মেয়েটির ফর্সা গাল টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। কথাগুলি বলা ঠিক হয় নি। নীলুর লজ্জা লাগতে লাগল। এত বাচ্চা মেয়ে। জীবন সম্পর্কে কোনো বোধ পর্যন্ত জন্মায় নি। এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক হয় নি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন শাহানা, ধস।

শাহানা বসল না। দাঁড়িয়েই রইল। রফিক এখনো আসছে না। এক ঘণ্টার মতো হয়ে গেল। কী যে সে করে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *