২৬. কুশল জানতে চেয়ে চিঠি

রানু, কেমন আছ তোমরা?

কুশল জানতে চেয়ে চিঠি শুরু করা গেল। বিয়ের আগে যেসব চিঠি লিখেছি তার শুরু কেমন ছিল মনে করতে পারছি না। অনেক কিছুর সঙ্গে স্মৃতি শক্তিও আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। পুরনো কথা সহজে মনে পড়তে চায় না। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি বোধ হয়।

চিঠির শুরুটা ভাল হয় না। তোমার নিশ্চয়ই ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে। তবে একটা মজার কথা কী জানো? চিঠিতে এলেবেলে যাই লিখি না কেন তুমি মন দিয়ে পড়বে। রাগ দেখানোর জন্যে দুতিন লাইন পড়েই চিঠি ছুড়ে ফেলবে না। কেন পড়বে না। সেই কারণটিও বলি। কারণ, তুমি যে রাগ করে চিঠি ফেলে দিয়েছ এই দৃশ্যটি আমি দেখব না। যার ওপর রাগ করলে সে যদি নাই জানল, ধ্ৰুংলুরু করার যৌক্তিকতাটা কোথায়? কাজেই আমার ধারণা তুমি খুব মন দিয়েই চিঠি পড়বে। ঠিক বলিনি?

এখানে এসে পৌঁছেছি। গত পরশু। বিকেল চারটায় যে ট্রেন পৌছানোর কথা সেটা পৌছোল সন্ধ্যা ছাঁটায়। আমার ধারণা ছিল দেখব সব বদলে গেছে সব অচেনা, শহরতলি শহরতলি ভাব চলে এসেছে গ্রামে। সে রকম কিছুই দেখলাম না। সব কিছু আগের মতই আছে। আগের মতই অনেক অপরিচিত মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করল,

আপনার নাম?

যাইবেন কই?

কোন গেরাম?

কার বাড়ি?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানার তাদের দরকার নেই। তবু এমন ভাবে জিজ্ঞেস করছে যেন উত্তরগুলি জানা না থাকলে এদের খুব মুশকিল হয়ে যাবে। এবং মজার ব্যাপার হাচ্ছে এরা সবাই আগ্রহ করে বলল, আমাকে কী ভাবে যেতে হবে। জুম্মা-ঘরের ডান দিকের রাস্তা নিতে হবে না বা দিকের রাস্তা নিতে হবে। যদিও তাদের কাছে আমি কিছুই জানতে চাইনি।

রানু, নিশ্চয়ই তুমি অবাক হয়ে ভােবছ এসব আমি লিখছি কেন? কারণ একটা আছে। আমি মূল কথা বলবার জন্যে আবহ তৈরি করছি। ভূতের গল্প বলার আগে যেমন বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। কথক গলার স্বর অনেক খানি নামিয়ে আনেন, যাতে গা ছমছমানো একটা ভাব তৈরি হয়। এ রকম আর কী?

এই পর্যন্ত লিখেই ওসমান সাহেব চেয়াব ছেড়ে উঠে পড়লেন। যা লিখতে চাচ্ছেন তা খিলতে পারছেন না। অবাস্তর কথাবার্তা লেখা হচ্ছে। অবান্তর এবং অসত্য।

স্টেশন থেকে বাড়ি আসবার পথে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। গ্রাম আগের মত আছে বলে যা লিখছেন তাও সত্যি নয়। অনেকখানি বদলেছে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে। কিছু কিছু বাড়িতে লম্বা বাঁশের মাথায় টিভি এন্টেনা। এ গ্রাম ভিন্ন ধবনের গ্রাম। আগের চেনা গ্রাম নয়। তিনি কী জেনে শুনেই সমস্ত অস্বীকার করতে চাইছেন? ভান করছেন সব আগের মতই আছে?

তাছাড়া মূল কথা বলবার জন্যে আবহ তৈরি করছি এর মানেই কী? তার কী মূল কথা সত্যি সত্যি কিছু আছে?

ওসমান সাহেব বিরক্ত গলায় ডাকলেন, আইনুদ্দিন, আইনুদ্দিন! আইনুদ্দিন প্রায় ছুটে এল।

কিছু কইছেন ভাইজান?

কটা বাজে দেখত।

আইনুদ্দিন বোকার মত তাকিয়ে রইল। বাড়িতে নিশ্চযই কোনো ঘড়ি নেই। তিনি তার রিস্টওয়াচ ফেলে এসেছেন। লেখক সুলভ অন্যমনস্কতার কোনো ব্যাপার নয়। ঘড়ি রেখে এসেছেন ইচ্ছা! করেই। রওনা হবার শেষ মুহূর্তে তার মনে হল ঘড়ি কলম কাগজ এসব না নিয়ে গেলে কেমন হয়? একজন নাগরিক মানুষের পুরোপুবি মুক্তির জন্যে এসব সরঞ্জাম না থাকা একটি পূর্ব শর্ত।

জর্জ ম্যারন নামের এক আমেরিকান কবি বৎসবের একটি মাস নগর ছেড়ে অরণ্যে ঢুকে পড়তেন। কিছুই থাকত না তার সঙ্গে। কাপড় পর্যন্ত নয়। খাদ্য সংগ্রহ করতেন বন থেকে।

তাতে অবশ্যি সাহিত্যে তেমন কোনো লাভ হয়নি। জর্জ ম্যাবন নিম্নমানের কবিতাই লিখেছেন। বনবাসের ফল হিসেবে কোন মুক্ত মানুষের কবিতা লেখা হয়নি।

আইনুদ্দিন।

জি।

ঠিক আছে তুমি যাও।

কয়টা বাজে জাইন্যা আইতাম?

না, দরকার নেই কোনো। তুমি যাও।

আইনুদ্দিন চিন্তিত মুখে বের হয়ে গেল। ওসমান সাহেব নিশ্চিত হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একটি ঘড়ি জোগাড় করবে। এখানে পৌছানোর একদিন পরই তিনি আইনুদিনের কাছে কাগজ এবং কলম চেয়েছিলেন। আইনুদ্দিন বিব্রত ভঙ্গিতে বলেছিল কাগজ কলম তো ভাইজান নাই। আইন্যা দিমু?

থাকি দরকার নেই।

ইস্টিশনের কাছে এক দোকানে পাওযা যায়।

লাগবে না।

আইনুদ্দিন চলে গেল। সন্ধ্যা বেলা। তিনি দেখলেন তার বিছানার পাশের টেবিলে কাগজ এবং দু’টি বল পয়েন্ট কলম। একটি লাল এবং একটি কাল। দু’টি দুকালির কলম কেন। কিনল সে? ওসমান এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ সময় ভাবলেন। মাঝে মাঝে তুচ্ছ জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে তার ভাল লাগে। বিনা কারণে কেউ কিছু করে না। আইনুদিনের দু’টি কলম কেনার পেছনেও নিশ্চযই কোনো কারণ আছে যা শুধু আইনুদ্দিনই জানে।

ওসমান সাহেব বারান্দায় চলে গেলেন। সূর্যের দিকে তাকিয়ে যদি সময় টের পাওযা যায। তার কাছে মনে হল এগারোটার মত বাজে। উঠেনময় ধান শুকুতে দেয়া হচ্ছে। আইনুদিনের মেয়ে কঞ্চি হাতে উঠোনে বসে আছে। মেয়েটির বয়স ছ-সাত। রোদের আঁচে তার ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। কাক এসে ধানে বসা মাত্রই সে তার কঞ্চি নাড়াছে এবং মুখে বলছে হুঁস। কাজটি সে করছে খুব আগ্রহ নিয়ে। ওসমান সাহেব অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন। হঠাৎ করে তাঁর মনে হল শুধু কাক কেন ধান খেতে আসে? অন্য পাখিরা কেন আসে না? উঠোনে ধান পড়ে থাকবে, রঙ-বেরঙের পাখিরা আসবে ধান খাবার জন্যে। দৃশ্যটি কল্পনা করতেই ভাল লাগে।

এই মেয়ে তোমার নাম কী?

মেয়েটি গম্ভীর মুখে বলল, বাতাসী। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা বাতাসী শুধু কাক ধান খেতে আসে। অন্য পাখিরা কেন আসে না। এর কারণ তুমি জানো?

জানি।

কে আসে না?

কাউয়া মাইনষেরে ডরায় না। পক্ষী ডরায়।

চমৎকার জবাব! তার চেয়েও চমৎকার হচ্ছে মেয়েটির তৎক্ষণাৎ জবাব দেবার ভঙ্গি। মেয়েটি জবাব দেবার পরও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওসমান সাহেব বললেন, তুমি স্কুলে পড়?

মেয়েটি সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, চড়ুই পাখি আয়। চড়ুই পাখি ধান খায়।

তিনি সত্যি সত্যি বিস্মিত হলেন। পাখি ধান খায় না কেন এই প্রশ্ন বাতাসীকে বিচলিত করেছে। সে ভাবতে শুরু করেছে।

তুমি স্কুলে পড় না বাতাসী?

না।

কেন? স্কুল নেই এ দিকে?

আছে।

পড়তে ইচ্ছে করে না?

না।

ধান পাহারা দিতে ভাল লাগে?

মেয়েটি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ওসমান সাহেবের মনে হল জবাব না দেবার কারণ হচ্ছে সে ভাবতে শুরু করেছে। চট করে কিছু বলবে না। ভেবে চিন্তে বলবে। তিনি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অপেক্ষা করতে করতে তার মনে হল সম্পূর্ণ কর্ম-শূন্য তৃতীয় দিনটি তার শুরু হয়েছে। খুব একটা খারাপ তো লাগছে না।

এই কদিনে একবারও লেখালেখির কথা মনে হয়নি। কোন গল্পের পৃটি নিয়ে মাথা ঘামাননি। বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন বারান্দায় বসে। আইনুদিনের ঘরসংসার লক্ষ্য করেছেন। লক্ষ্য করেছেন বলাটা ঠিক নয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন আইনুদিনের স্ত্রী ধান মেলে দিচ্ছে। ধান সিদ্ধ করবার জন্যে আগুন জ্বালাচ্ছে। আইনুদ্দিন গরুর জন্যে ভাতের ফ্যান নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাগুলি ঘটছে চোখের সামনে। এ পর্যন্তই! একে লক্ষ্য করা বলা চলে না।

এই পরিবারটির দিকে তাকিয়ে থাকতে ওসমান সাহেবের ভাল লাগছে। কর্মব্যস্ত মানুষ দেখতে ভাল লাগে। একবার তিনি কল্যাণপুরের দিকে গিয়েছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা গোটা পরিবার ইট ভাঙতে বসেছে। মা, বাবা দু’টি ছোট ছোট ছেলে, একজন অতি বৃদ্ধ মহিলা। সবাই ইট ভাঙছে মহা উৎসাহে। কঠিন পরিশ্রমের এই কাজে তারা একটা উৎসবের ভাব নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধ মহিলাটি মাঝে মাঝে কী যেন বলছে–গোটা পরিবার হেসে উঠছে। মুগ্ধ করে দেবার মত একটি ছবি। ওসমান সাহেব আটকা পড়ে গেলেন। বেড়াচ্ছেন এ রকমের ভান করে এদের পাশ দিয়ে কয়েকবার হেঁটে গেলেন।

বাসায় ফিরে রানুকে খুব উৎসাহ নিয়ে ঘটনাটা বলতেই রানু বলল, ইট ভাঙছিল বাউটির বয়স কত?

কেন?

ঐ বিউটির বয়স নিশ্চয় কম। দেখতেও সে রূপসী। ইট ভাঙবার সময় তার কাপড় নিশ্চয় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। এর জন্যেই দৃশ্যটি তোমার কাছে স্বগীয় মনে হচ্ছিল। ইট ভাঙা কোন স্বগীয় ব্যাপার নয়। কষ্টের ব্যাপার।

ওসমান সাহেব থমকে গিয়েছিলেন। কারণ ঐ বউটির সত্যি সিত্য মায়া কাড়া চেহারা ছিল রানুর কথা উড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। আজ যে আইনুদিনের ঘর সংসার তার ভাল লাগছে এর পেছনেও কী ফ্রয়েডিয়া কিছু কাজ করছে? সম্ভবত নয়। আইনুদিনের স্ত্রীকে তিনি দেখেননি। সে কাজ করছে নতুন বেঁয়ের মত লম্বা একা ঘোমটা টেনে। তবে অনুমান করা যাচ্ছে বৌটি দেখতে ভাল, কারণ বাতাসী মেয়েটি সুন্দর দেখতে। মার মত হয়েছে নিশ্চয়ই।

তিনি সিগারেট ধরিয়ে বাতাসীকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। মেয়েটি এখন নিজের মনে কথা বলছে। ছড়া টড়া কিংবা গ্ৰাম্য কোনো বিয়ের গান। কারণ তার মাথা দুলছে। ছন্দের কোনো ব্যাপার ছাড়া মাথা দুলবে না। কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পারলে হত। কিন্তু কাছে যাওয়া মাত্র এই মেয়ে চুপ করে যাবে। তাছাড়া মেয়েটির ব্যক্তিগত সংলাপে হঠাৎ উপস্থিত হওয়া কী ঠিক?

ওসমান সাহেব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গানের মত क्राच्नेछ।

ভাত খাইছে ধান খাইছে

কলাই খাইছে কে?

গানের কলি এই একটিই। ঘুরে ফিরে তাই সে গাইছে। সুরও সম্ভবত তার নিজের। ওসমান সাহেব এক ধরনের বিষন্নতা অনুভব করলেন। যে গান একা একা গাওয়া হয়, সেই গান নৈসঙ্গের গান। তার সুর নিসঙ্গতা এনে দেবেই।

মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু গান বন্ধ করল না। সম্ভবত সে বুঝতে পারছে শহর থেকে আসা এই মানুষটি তার গান পছন্দ করছে। শিশুরা অনেক কিছু বুঝতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *