২৬. কমলাসুন্দরী

আবার রামকমল সিংহের নিজস্ব জুড়িগাড়ি এসে থামলো জানবাজারে কমলাসুন্দরীর গৃহের সামনে। গাড়িটি নিকষ কালো মেহগনি কাষ্ঠে নির্মিত, এমনই চিকন পালিশ যেন দর্পণের মতন মুখ দেখা যায়। আর অশ্বদুটি দুগ্ধ ধবল, তাদের পৃষ্ঠে জরির কাজ করা কিংখাব। গাড়ির সম্মুখের পিত্তল। দণ্ড দুটির এত চাকচিক্য যে সোনা বলে ভ্ৰম হয়। অবশ্য রামকমল সিংহ তাঁর জুড়িগাড়িতে স্বর্ণ দণ্ড ব্যবহার করলেও আশ্চর্যের কিছু ছিল না। গাড়ির সম্মুখে অধিষ্ঠিত বল্পাধারী কোচম্যানের পোশাক মুঘল সেনানীর মতন, তাকে দেখলেই পথচারীদের মনে সম্রাম জাগে। গাড়ির পিছনেও উর্দিধারী দুজন রক্ষী দণ্ডায়মান থাকে সব সময়।

চার বৎসর আগে জানবাজারের এই গৃহটি ক্রয় করা হয়েছিল, তারপর থেকে প্ৰায় প্রতিদিনই রামকমল সিংহের এই জুড়িগড়িকে দেখা গেছে দ্বারের সামনে। কিন্তু আজকের আগমনের সঙ্গে তার কত তফাত! আগে গাড়িখানি থামবার পরই পিছন থেকে রক্ষী দুজন ছুটে এসে দোর খুলে দাঁড়াতে। মেদবহুল শরীর নিয়ে রামকমল সিংহ রক্ষী দুজনের স্কন্ধে হস্ত স্থাপন করে ধীরে ধীরে নামতেন। তাঁর মাথায় সোনালী জরির পাগড়ি, অঙ্গে মখমলের কুতা, হাতে গজদন্তের ছড়ি, আঙুলগুলিতে মোট ছখানি আংটি, পুরুষ্টু গুম্ফ সমন্বিত মুখখানি সদা হাস্যময়, এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি শ্লথ পায়ে ঢুকে যেতেন গৃহের মধ্যে।

আজ সব কিছুই অন্যরূপ। জুড়িগাড়ি থামার পরই তার ভেতর থেকে দ্রুত নেমে এলো এক নবীন যুবা। চুনোট করা ধুতি ও চীনা সিল্কের বেনিয়ান পরা, শরীরে কোনো অলঙ্কার নেই। পাছে তাকে কেউ চিনতে ভুল করে তাই কোচম্যান নেমে এসে চিৎকার করতে লাগলো, এই সব হঠ যাও, হঠ যাও, বাবুর বড় ছেলে এয়েচোন! গড় কর, বাবুর বড় ছেলে।

গঙ্গানারায়ণ অন্যদের দিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না, সে থমকে দাঁড়িয়ে বাইরে থেকে একবার গৃহখানি নিরীক্ষণ করে নিল। গৃহটি দ্বিতল তবে প্রস্থে অনেকখানি, কক্ষের সংখ্যা অন্তত বারো চোদ্দটি হবেই। লৌহ ফটকের দুপাশে দুটি নারিকেল বৃক্ষ, গৃহের ডান পাশে ছোট একটি বাগানের মতনও রয়েছে।

গঙ্গানারায়ণ কোচম্যানের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আগে আগে চলো। গঙ্গানারায়ণ একুশ বৎসর বয়স্ক যুবা, এই প্রথম সে কোনো রুপোপজীবিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে যাচ্ছে। তার মতন বড় বংশের এবং তার বয়েসী যুবাদের এই সব প্রমোদ ভবনে গমনাগমন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। তার বয়েসী অনেক ধনাঢ্য যুবাই নিজ গৃহে এবং নিজ পত্নীর সঙ্গে একই শয্যায় রাত্রিযাপন করা বড় অসম্মানের কাজ মনে করে। সেজন্য অনেকেরই বাঁধা। রাঢ় থাকে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এরকমও দেখা যায় পিতা ও পুত্রের একই পল্লীর বিভিন্ন গৃহে গতায়াত আছে। কিন্তু হিন্দু কলেজের ছাত্ররা এই প্রথা পরিত্যাগ করেছে। গঙ্গানারায়ণের বন্ধুরা প্ৰায় সকলেই বারাঙ্গনা-গমনকে ঘৃণার চক্ষে দেখে।

এ বিষয়ে গঙ্গানারায়ণের ঘৃণা যেন আরও প্রবল। সে এসেচে। তাদের পারিবারিক সম্পত্তি উদ্ধার করতে। যে কুলটা স্ত্রীলোকের জন্য তার মা বিম্ববতী এতকাল মনঃকষ্ট পেয়েছেন, সেই স্ত্রীলোকটিকে সে আজই গৃহছাড়া করবে।

কোচম্যান ও অন্যান্য অনুচররা হঠো হঠো বলতে লাগলো, গঙ্গানারায়ণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো দ্বিতলে। মজলিস-কক্ষটিকে একটু আগেই যেন পরিষ্কার করা হয়েছে, ড়ুগি-তবলা, হারমোনিয়াম, ঘুঙুর সব অদৃশ্য। পরিচ্ছন্ন গালিচার ওপর শুধু একটি মাত্র কৌচ। উপরতলায় কোনো পুরুষ মানুষ নেই, তিনজন সুসজ্জিতা যুবতী দাসী যেন গঙ্গানারায়ণের জন্যই অপেক্ষা করে ছিল, তারা কৃতার্থ ভঙ্গিতে বললো, আজ আমাদের কত বড় সৌভাগ্য, আপনি নিজে এ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েচেন!

তারা গঙ্গানারায়ণের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালে সেই কৌচে। একজন হাঁটু গেড়ে বসে গঙ্গানারায়ণের পা থেকে জুতো খুলতে লাগলো। আর একজন দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো একটি শ্বেতপাথরের গেলাস ভর্তি সরবত, সেটি হাতে নিয়ে গঙ্গানারায়ণের সামনে অপ্সরার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো।

বিস্মিত গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করলো, এ কী?

মেয়েটি ঝলমল হাস্যে বললো, আপনি ক্লান্ত হয়ে এয়েচেন, একটু পেস্তার সরবত আপনার সেবার জন্য।

গঙ্গানারায়ণ হাত নেড়ে বললো, না, না। আমার প্রয়োজন নেই।

অন্য একটি মেয়ে ততক্ষণে নিয়ে এসেছে আলবোলা। তার রূপো বাঁধানো নলটি এগিয়ে দিল প্রাক্তন প্রভুর পুত্রের দিকে।

গঙ্গানারায়ণ তাকেও বললো, না, না, আমি ধূমপান করি না।

তখন তিনটি মেয়েই সমস্বরে বললো, আমরা আপনার দাসী, আপনি হুকুম করুন আপনার জন্য কী আনবো?

গঙ্গানারায়ণ প্রথমে খানিকটা বিমূঢ় বোধ করলো। নারীদের সঙ্গে সে সব সময় সম্ভ্রমপূৰ্ণ ব্যবহার করে। তার এ-যাবৎ জীবনে সে এমন লজ্জাহীনা রমণী দেখেনি। দু-চারজন আত্মীয়া ব্যতীত অপর নারীদের মুখ দর্শনই দুরূহ ঘটনা। পথে-ঘাটে সে নীচ জাতীয়া স্ত্রীলোকদের দেখেছে বটে কিন্তু গঙ্গানারায়ণ তাদের দিকে কখনো ভালো করে দৃষ্টিপাত করেনি। সে বরাবরই লাজুক স্বভাবের। কিন্তু এই স্ত্রীলোকদের এমন সাবলীল নির্লজ্জতা তাকে কাঁপিয়ে দেয়। তার দুই কৰ্ণমূল উষ্ণ হয়ে ওঠে। সে চক্ষু নত করলো।

দুটি মেয়ে টিপতে লাগলো গঙ্গানারায়ণের দুই পা, এবং এদের মধ্যে যে বেশী রূপসী সে গঙ্গানারায়ণের কানে তার নরম ওষ্ঠ ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বললো, আপনার জন্য একটা শ্যাম্পেন খুলবো কী?

বেশী লজ্জা পেলে মানুষ হঠাৎ রুক্ষ হয়ে ওঠে। গঙ্গানারায়ণ অতিরিক্ত রুক্ষতার সঙ্গে বললো, এসব কী? আপনারা সরে যান। আপনাদের কর্ত্রীকে ডাকুন।

একজন রমণী বললো, আমাদের কর্ত্রী তো আসবেন না।

আরেকজন বললো, আমাদের পছন্দ হলো না? হা আদেষ্ট!

গঙ্গানারায়ণ এবার সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বললো, কেন, তোমাদের কর্ত্রী আসবেন না কেন?

একজন রমণী বললো, আপনি এয়েচেন শুনেই তিনি ঘরে আগল দিয়েচেন।

আরেকজন বললো, তিনি আপনাকে মুখ দেকাবেন না।

অন্যজন বললো, আপনি যে তাঁর ছেলের মতন গো!

গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি তেনার সঙ্গে কাজের কথা বলতে এয়েচি। তোমরা সরে যাও।

তখন দুই রমণী গঙ্গানারায়ণের দু হাত ধরে বললো, আহা রাগ কচ্চেন কেন গো বাবু, বসে বসো! আমরা হলুম গে অবলা, আপনাদের রাগ দেকালে যে আমাদের বুক কাঁপে।

তারপর একজন তার উত্তাল বক্ষদ্বয়ের ওপর এক হাত রেখে সুমধুর হাস্যে বললো, এই দ্যাকো, কেমন বুক কাঁপচে, দোকুন, দোকুন, নিজে হাত দিয়ে দেকুন।

অন্য একজন বললো, আমরা তোমার রাগ দেকে যদি দাঁত ছিরকুট্টি হয়ে মরে যাই, তা হলে যে আপনার পাপ লাগবে।

 

গঙ্গানারায়ণের মনে হলো, সে যেন একটা ফাঁদে পড়েচে। কেন সে এখানে এলো! একবার ভাবলো, সে দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তা হলে এই মেয়েরা তার পশ্চাতে খিলখিল করে বিদ্রুপ হাস্য করবে না! সে সিংহ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হয়ে পালিয়ে যাবেই বা কেন? এই গৃহ তাদের সম্পত্তি। এখানে সে ইচ্ছে করলে আগুন লাগিয়েও দিতে পারে।

এবার সে কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললো, তোমাদের কর্ত্রীর সঙ্গে দেখ না করে আমি যাবো না। তাকে শীঘ্ৰ খবর দাও, এই আমার হুকুম।

পরিহাস প্রিয়া রমণীটি বললো, ছিঃ, আমন কথা বলতে নেই। আমাদের যদি পছন্দ না হয় তবে আর কারুকে ডাকবো তো বলুন!

সিঁড়ির কাছে বলিষ্ঠকায় কোচম্যান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গানারায়ণ তার দিকে চেয়ে বললো, করিমবক্স, টুড়িকে দেখো তো মালিকান কাঁহা—

তখনই মজলিস কক্ষের একদিকের দ্বার খুলে গেল। সেখানে এসে দাঁড়ালো কমলাসুন্দরী। শুভ্র থানকাপড় পরা সেই আগের মতই বৈধব্য বেশ, অঙ্গে একটিও অলঙ্কার নেই, পিঠের ওপর মেঘের মতন খোলা চুলের ঢাল।

কমলাসুন্দরীকে দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল গঙ্গানারায়ণ। অনেক দিন ধরেই সে এই নারীর কথা শুনে আসছে, মনে মনে কমলাসুন্দরীর রূপ সে কল্পনা করে রেখেছিল। তার সঙ্গে এই নারীর সামান্যতম মিলও নেই।

গঙ্গানারায়ণ ভেবেছিল ছলাকলা-নিপুণা এই রমণী হবে মধ্যবর্ষীয়া, অন্তত তার মা বিম্ববতীর সমবয়স্ক তো হবেই। এর ওষ্ঠ হবে তাম্বুল রঞ্জিত, দেহ ঈষৎ পৃথুলা, চক্ষু দুটি সুমা আঁকা। কিন্তু একে দেখে যেন গঙ্গানারায়ণের নিজের চেয়েও ছোট মনে হয়, যেন বিন্দুবাসিনীর সমান। বিশেষত এই বৈধব্যবেশের জন্যই বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে মিলটির কথাই গঙ্গানারায়ণের প্রথমে মনে আসে। তার বক্ষে অমনি একটি মোচড় লাগে।

কমলাসুন্দরী গঙ্গানারায়ণের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে কয়েক পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালো, তারপর খুব শান্তভাবে ধীরে ধীরে বললো, আপনি–তুমিই গঙ্গা? তোমার কথা কত শুনিচি–কত বড় বিদ্বান, কত গুণ, তুমি এয়োচো, এ বাড়ি ধন্য হলো।

গঙ্গানারায়ণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, কোনো কথা বলতে পারলো না।

কমলাসুন্দরী আবার বললো, আমি হতভাগিনী, জানি, নরকেও আমার স্থান হবে না, আমার জাত নেই, মান নেই, তবু আমি সর্বসমক্ষে বলবো, তোমার বাবা ছিলেন আমার স্বামী, আমি তাঁকে পতির চক্ষে দেকিচি গো, আর কোনো চক্ষে দেকিনি, ভগবান সাক্ষী, আমি তেনাকে কোনোদিন ছলনা করিনি…

সহচরীদের দিকে ফিরে কমলাসুন্দরী সজলনয়নে বললো, তোরা বল, তোরা তো দেকিচিস সব, কোনোদিন আমি তেনাকে ছলনা করিচি? তিনি ছিলেন দেবতুল্য মানুষ।

সহচরীরা বললো, সে কতই তো এতক্ষুণ এনাকে বোঝাচ্চিালুম, বড়বাবু ছেলেন আমাদের দেবতা, তেনার ছেলেকে আমরা খাতির যত্ন করবো না?

কমলাসুন্দরী বললো, আমি অসহায়, দীনহীনা, ভাগ্যহীনা, ছেড়াকপালী। তিনি আমায় অকুল পাথারে ভাস্যে চলে গেলেন এই যে এখেনে, ঠিক এই ঘরটায়, মিত্যুর আগে আমার পানে চেয়ে তিনি বললেন, কমল, আমি চললুম, তুমি এখানেই থেকে, আমি ওপর থেকে তোমাকে দেকবো! সেই থেকে আমি এ বাড়ি ছেড়ে এক পা বেরোইনি-গঙ্গা, তোমায় দেকে আমার বুকের মধ্যে উথালি পাথালি কচ্চে, অবিকল যেন সেই মুখখানা বসানো, সেইরকম চাউনি…

গঙ্গানারায়ণ একটি তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। বাল্যকালে অনেকেই বলতে যে তার মুখের আদলে তার পিতার মুখের খুব মিল আছে। তখন বোধহয় তারা জানতো না যে গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে তার পিতা রামকমল সিংহের কোনো রক্তসম্পর্ক নেই। এই নারীও হয়তো সে কথা জানে না।

কমলাসুন্দরী বললো, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো?

গঙ্গানারায়ণ বললো, না, বসবার প্রয়োজন নেই।

কমলাসুন্দরী বললো, তুমি যে এয়োচো, এই আমাদের কত ভাগ্যি। তোমায় দেকে তবু চক্ষু জুড়োলো। যেন তোমার মধ্যে তেনাকে দেকলুম। তিনি এ বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ফেলেচেন, এ বাড়ি আমার কাশী-বৃন্দাবন, আমি আমার শেষ দিনটি পর্যন্ত এখেনে থেকে তেনার ইস্মৃতি পুজো করবো।

বয়সে প্রায় সমান হলেও কমলাসুন্দরী এমনভাবে কথা বলছে, যেন সে কত বড়। এই রমণীর স্মৃতি জুড়ে এখনো রয়েছেন রামকমল। গঙ্গানারায়ণ ওর দিকে চেয়ে থাকলেও তার বেশী করে মনে পড়তে লাগলো, বিন্দুবাসিনীর কথা। এই নারীও যেন বিন্দুরই মতন অসহায়। বিন্দুকে একা জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দূর বিদেশে, অথচ বিন্দুর তো কোনো দোষ ছিল না। আর কি কোনোদিন দেখা হবে বিন্দুর সঙ্গে?

কমলাসুন্দরী বললো, পাইক বীরকন্দাজরা এসে জোর করে টানাটানি করলেও আমি যাবো না, আমি এই পুণ্যভূমিতে বিষ খেয়ে মর্বো। আদালতের প্যায়দারা এসে যদি আমার মাথায় লাঠি মেরে

গঙ্গানারায়ণকে তবুও নীরব দেখে কমলাসুন্দরী হঠাৎ থেমে গেল। তারপর কণ্ঠস্বর খুব সহজ করে সে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমাকে এ বাড়ি থেকে দূর করে দেবার জন্য নিজে এয়োচো? তুমি চুপ করে রয়োচো, লজ্জায় সে কতা বলতে পাচ্চো না? বলো, সে কতা বলো, তুমি মুখ ফুটে একবার বললে, আমি এই দণ্ডে এক কাপড়ে এই ভিটে ছেড়ে চলে যাবো, একবারও পেচুন পানে তাকাবো না। আর কোনোদিন তোমরা আমায় দোকতে পাবে না। যদিও এ-কতা উচ্চারণ করলে আমার জিভ খসে যাওয়া উচিত, তবু আমি বলবো, গঙ্গা, তুমি আমার ছেলের মতন। তুমি বললে আমি সব শুনতে রাজি আচি, তুমি যদি আমায় আস্তাকুঁড়ে যেতে বলো—

গঙ্গানারায়ণ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। আবেগকম্পিত স্বরে বললো, মা, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আপনি এ বাড়িতেই থাকবেন।

কমলাসুন্দরী প্রায় চিৎকার করে উঠলো। হাসি-কান্না মেশানো সুরে বললো, মা? তুমি আমায় মা বললে? ওগো, আমার মতন মহাপাতকীও যে উদ্ধার হয়ে গেল!

সহচরীদের দিকে তাকিয়ে কমলাসুন্দরী বললো, ওরে, তোরা সব শুনিচিস? মা বলেচে, আমার প্ৰাণপতির ছেলে আমায় মা বলেচে, আমি ধন্য!

কমলাসুন্দরী গঙ্গানারায়ণের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো তীব্ৰ আনন্দে।

 

গঙ্গানারায়ণ অনভিজ্ঞ, জীবনের কতখানিই বা সে দেখেছে, নারীগণের আকস্মিক হাসি বা কান্নার মৰ্ম সে বিশেষ কিছুই বোঝে না। কমলাসুন্দরীর অঝোর কান্না দেখে তারও চোখে জল এসে যাচ্ছিল, অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে সে বললো, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, কেউ আপনাকে এখেন থেকে সরাতে পারবে না। আমি কথা দিয়ে যাচ্চি।

পাশের যে ঘরটিতে রামকমল সিংহ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন কমলাসুন্দরী সেই ঘরটিতে গিয়ে কাঁধে আঁচলের খুঁট জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তারপর মেঝেতে কপাল ছুঁইয়ে বললো, ওগো, তুমি শুনচো? তুমি দেকচো? তোমার ছেলে নিজের মুখে বলেচে, আমি এখেনে থাকবো, তোমার সুযোগ্য ছেলে, হীরের টুকরো ছেলে, সে আমায় মা বলেচে।

গঙ্গানারায়ণ সিঁড়ির দিকে এগোতে যেতেই তিন সহচরী তাকে বললো, আপনি মানুষ নন। গো, আপনি দেবতা। কতা দিন, আপনি মাঝে মাঝে আসবেন, আমাদের একটু সেবা কত্তে দেবেন গো।

গঙ্গানারায়ণ বললো, না, সে-রকম কথা দিতে পারি না। তবে ভয় নেই, তোমাদের কেউ বিরক্ত করবে না।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় গঙ্গানারায়ণ অনুভব করলো, তার সর্ব শরীর কাঁপছে। কেন কাঁপছে, তা সে নিজেই বুঝতে পারলো না। স্বল্পবাসা, উন্মুক্ত স্বভাবের এতগুলি রমণীকে এত কাছ থেকে সে কখনো দেখেনি, এদের প্রতি তার অত্যন্ত ঘৃণা ছিল, অথচ আজ এদের মুখোমুখি এসে তো তেমন ঘৃণা জাগলো না। তার মনে হলো, এরা সবাই যেন বিন্দুবাসিনীর মতন নিয়তির প্রহারে এরকম অবস্থার মধ্যে পড়েছে।

সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গঙ্গানারায়ণ জুড়িগাড়িতে উঠে বললো, গাড়ি ঘোরাও। কোচম্যান জিজ্ঞেস করলো, হুজুর, এবার কোন দিকে যাবো?

গঙ্গানারায়ণ একটুক্ষণ ইতস্তত করলো। সত্যিই তো, সে কোথায় যাবে এখন? এখনই গৃহে ফিরে যেতে তার ইচ্ছে হলো না। তার মনে এখন তীব্র আসঙ্গ লিন্সা। শুধু মনে পড়ছে বিন্দুবাসিনীর কথা। কিন্তু বিন্দুর সঙ্গে তার আর দেখা হবার উপায় নেই।

কোচম্যানকে সে নির্দেশ দিল কেল্লার কাছে গঙ্গার ধারে গাড়ি নিয়ে যেতে। সে মুক্তবায়ু সেবন করে শরীর জুড়োবে।

 

এখন প্রতিদিনই সকালে বিধুশেখর এবং গঙ্গানারায়ণ কয়েক ঘণ্টার জন্য আলোচনায় বসে। রামকমল সিংহের বিস্তীর্ণ সম্পত্তি কোনটি কোথায় কী অবস্থায় আছে, তা গঙ্গানারায়ণের বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে গঙ্গানারায়ণ নিজেই ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছে। কিছুদিন আগেও বিষয়-আসয় সম্পর্কে তার কোনো মোহ ছিল না, কিন্তু উইলে সে নিজে বঞ্চিত হয়েছে বলেই যেন হঠাৎ তার আগ্ৰহ বেড়ে গেছে। সে নিজে কিছু চায় না, কিন্তু বিধুশেখরের কর্তৃত্ব সে খর্ব করবেই। ভবিষ্যতে নবীনকুমার যখন সাবালক হবে তখন গঙ্গানারায়ণ সম্পূর্ণ সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেবে। সিংহ পরিবারকে সে বিধুশেখরের রাহুগ্ৰাস থেকে মুক্ত করবেই।

কথাবার্তা হয় অতি শুষ্কভাবে, আগেকার সেই স্নেহ। শ্রদ্ধার সম্পর্ক আর নেই। বিধুশেখর এখনো তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব খাঁটিয়ে গঙ্গানারায়ণকে জালে আবদ্ধ করতে চান, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ আর কোনদিন সে-রকমভাবে অভিভূত হবে না।

আলোচনা শেষ হবার পর বিধুশেখর বললেন, এই পর্যন্ত মোটামুটি তুমি বুঝলে। এবার তুমি ইব্রাহিমপুরের তালুকটা ঘুরে দেকে এসো। সেখানকার প্রজারা বেগড়বাই করচে। আমি বলি কী, ওদিককার নীল চাষের কারবারটা সাহেবদের কাছে বেচে দেওয়াই ভালো। সাহেবদের সঙ্গে নীল চাষের ব্যাপারে আমরা যুঝতে পারবো না। গঙ্গানারায়ণ বললো, দেখি, আমি নিজে একবার দেকে আসি।

তারপর গঙ্গানারায়ণ অকস্মাৎ খুব সংক্ষিপ্তভাবে বললো, জানবাজারের বাড়িটা আমরা ছেড়ে দিচ্চি।

কথাটা বলেই গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়ালো। যেন এ বিষয়ে আর কিছু আলোচনার প্রয়োজন নেই।

বিধুশেখর বিস্মিতভাবে বললেন, জানবাজারের বাড়ি? কোন বাড়ি? যে বাড়ি ডম আণ্টুনির কাচ থেকে কেনা হয়েছেল?

গঙ্গানারায়ণ বললো, হাঁ। সে বাড়ি আমার পিতা আমাদের ভোগে লাগাবার জন্য কেনেননি। সে বাড়ি তিনি অন্য একজনকে দিয়ে গ্যাচেন!

–অন্য একজনকে দিয়ে গ্যাচেন? কাকে? কাগজপত্তরে কোথাও তার উল্লেখ রয়েচে? আমাকে দ্যাখাও দিদি!

—লেখা না থাক, তাঁর মুখের কথাই যথেষ্ট।

বিধুশেখর গঙ্গানারায়ণের কথাটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে জোর দিয়ে বললেন, না, না, ওসব কোনো কাজের কতা নয়। দেব-দ্বিজে দান করলেও না হয়। পরকালের কাজে লাগতো। না দেবায়, না। ধমায়, এক বেশ্যা মাগীর ভোগে লাগবে ঐ অতবড় বাড়ি? ছ্যাঃ! একটা মামলা ঠুকে দিলেই মাগী বাপ বাপ বলে পালাবে।

গঙ্গানারায়ণ বিধুশেখরের মুখর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল না। অকম্পিত গলায় বললো, না, মামলা ঠোকবার দরকার নেই। আমি কথা দিইচি, ও বাড়ি আমরা দখল নিতে যাবো না।

—কথা দিয়োচো! কাকে কথা দিয়োচো?

—আপনি তার নাম জানেন। আমার পিতার মৃত্যুর সময় আপনি তাকে দেকোচিলেন।

—কমলা বলে সেই ছুড়িটা? তাকে তুমি কতা দিয়োচো? তাকে তুমি কোতায় দেকালে?

—আমি গিয়েচিলুম ও বাড়িতে।

—তুমি গেসলে? তুমি কি আজকাল ঐ সব পাড়ায় যাতায়াত শুরু করেচো নাকি?

–হ্যাঁ। ভাবচি মাঝে মাঝেই যাবো। এ বিষয়ে তো আমি আপনার কাছে কোনো শপথ করিনি।

গঙ্গানারায়ণ ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, বিধুশেখর বীজগম্ভীর কণ্ঠে ডেকে বললেন, শোনো। তুমি ঐ কমলা ছুড়িটাকে কতা দিয়োচো কোন এক্তিয়ারে? এমন যাকে তাকে কতা দেবার অধিকার তোমায় কে দিয়েচে?

দ্বারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে গঙ্গানারায়ণ শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বললো, আমি মায়ের অনুমতি নিইচ। মা বলেচেন, ও সম্পত্তিতে আমাদের প্রয়োজন নেই। পিপড়ের পেট টিপে মধু বার না। করলেও আমাদের চলে যাবে।

—তোমার মাকে বলোচো যে তুমি রাতের বেলায় অবিদ্যাদের বাড়িতে যাতায়াত করচো?

–হ্যাঁ বলিচি।

—তোমার মা তো আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কখোনো কোনো বিষয়ে মত দেননি।

—খুড়োমশাই, আপনি জানেন যে আমি মিথ্যে ভাষণ করি না। আপনার সন্দেহ হয় আপনি মাকে জিজ্ঞেস করে দোকবেন।

—দাঁড়াও। তোমার মা বলে থাকলেও তিনি ভুল বুঝে বলেচেন। আমি বলচি, এ মামলা হবেই।

—আমার মা যতদিন রয়েচেন, ততদিন আমার মতামতের একটা মূল্য থাকবে, এমনই দলিল করা হয়েচে। আমার মা যদি আমার ওপর থেকে বিশ্বাস ফিরিয়ে নেন, তবে সেদিন, সেই মুহূর্তেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো! আমি বলচি, এ মামলা হবে না।

–বেয়াদব! আমার মুখে মুখে কতা! তোর মা আমার চেয়ে তোর কতা বেশী শুনবে?

–তা আমি জানি না। সে কতা। আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন তাঁর কাছ থেকে।

—ঐ একটা নচ্ছার মেয়েমানুষ-বিষধর সাপ-এর মধ্যেই আবার খদের জুটিয়েচে…ঐ হারামজাদা জগমোহন সরকার ওর কাছে নিয়মিত যায়, সব খবর আসে আমার কানে-সেই কালনাগিনীকে আমরা একটা বাড়ি ছেড়ে দেবো? কক্ষনো না। এ মামলা হবেই।

গঙ্গানারায়ণ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। তার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠলো কমলাসুন্দরীর বৈধব্য বেশ, শুদ্ধা সতীর মতন মুখশ্ৰী। যেন কমলাসুন্দরী নয়, বিন্দুবাসিনীরই ঐ আর এক রূপ। সে আবার বললো, আমি কতা দিইচি, ও বাড়ি ওরই থাকবে।

 

আর কোনো মন্তব্য না করে গঙ্গানারায়ণ চলে গেল সেখান থেকে। তার বুকের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা, সরাসরি এই প্রথম সে বিধুশেখরের ইচ্ছার বিরুদ্ধতা করলো। তবে এই তো সবে শুরু। একটা মোহময় সুখও অনুভব করলে সে। যেন সে আজ বিধুশেখরের কাছে বিন্দুবাসিনীর ওপর অত্যাচারেরই শোধ নিল।

বৈঠকখানা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গঙ্গানারায়ণ সহিসদের ডেকে গাড়িতে ঘোড়া যুতবার হুকুম দিল। আজ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে ব্ৰাহ্ম ভক্তরা মিলিত হবে, গঙ্গানারায়ণের বন্ধু রাজনারায়ণ তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে। সেখানে যেতে। ব্ৰাহ্মদের সঙ্গ গঙ্গানারায়ণের ভালো লাগে। এক সঙ্গে এত সুন্দর রুচিসম্পন্ন বিদগ্ধ মানুষের সমাবেশ গঙ্গানারায়ণ আর কখনো দেখেনি।

রাজনারায়ণ তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে ব্ৰাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করবার জন্য। মনের দিক থেকে গঙ্গানারায়ণের কোনো রাধা নেই। সে শান্তি চায়। জ্ঞানমাগী ধর্ম আলোচনায় ও সমাজ-সংস্কারের চিন্তায় নিযুক্ত রয়েছে ব্ৰাহ্মরা, তাদের সংসর্গে গঙ্গানারায়ণ বিশেষ উৎসাহবোধ করে। এক একবার তার ইচ্ছে জাগে, সব ছেড়েছুঁড়ে ঐ কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

কিন্তু গঙ্গানারায়ণের জননী হয়তো গঙ্গানারায়ণের বারনারীগমনও মনে নিতে পারবেন। গঙ্গানারায়ণের যদি সত্যিই বাসনা হয়, তা হলে সে অনায়াসেই একটি নিজস্ব রক্ষিতার সঙ্গে বিলাসে ড়ুবে থাকতে পারে, তার জন্য সে খুব সহজেই এস্টেট থেকে টাকা নিতে পারবে। অথচ গঙ্গানারায়ণ যদি ব্ৰাহ্ম হতে চায় তা হলে হুলুস্কুলু বেধে যাবে, বিম্ববতী হয়তো আত্মহত্যাই করে বসবেন। ব্ৰাহ্মীরা। ঠাকুর দেবতা মানে না একথা শুনে একদিন বিম্ববতী বলেছিলেন, কোনো ছেলে যদি আমন অনাছিষ্ট করে তবে তার মুখ দেখার চেয়ে তার বাপ মায়ের মরে যাওয়াই ভালো। গঙ্গানারায়ণ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, বিম্ববতী কানে আঙুল দিয়ে বলেছিলেন, না, বলিসনি, আমন কতা শোনাও পাপ। সেই দৃশ্য গঙ্গানারায়ণের মনে পড়ে। এই মাতৃদায় সে এড়াবে কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *