উহুদ ও আহযাব যুদ্ধের মধ্যবর্তী সারিয়্যাহ ও অভিযানসমূহ
উহুদের অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক পরিস্থিতি মুসলিমগণের সুখ্যাতি ও শক্তি সামর্থ্যের উপর দারুণ প্রতিক্রিয়ার সূচনা করে। এতে তাঁদের মনোবলের জোয়ার ধারায় কিছুটা ভাটার সৃষ্টি হয়ে যায় এবং এর ফলে বিরুদ্ধবাদীগণের অন্তর থেকে ক্রমান্বয়ে মুসলিম ভীতি হ্রাস পেতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে মুসলিমগণের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যাদি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে থাকে এবং বিভিন্ন দিক থেকে মদীনার উপর বিপদাপদ ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়ে যায়। ইহুদী, মুনাফিক্ব এবং বেদুঈনগণ প্রকাশ্য শত্রুতায় লিপ্ত হয় এবং মুসলিমগণকে অপমান করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। তাদের এ চক্রান্ত ও শত্রুদের উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবে ইসলামের মূলোৎপাটন করে ফেলা যাতে কোনদিনই মুসলিমগণ আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। উহুদের পর দুই মাস অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ লক্ষে বনু আসাদ গোত্র মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
অন্যদিকে চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে ‘আযাল এবং ক্বারাহ গোত্র এমন এক চক্রান্তমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যার ফলে ১০ জন সাহাবীকে শাহাদতের পেয়ালা পান করতে হয়। অধিকন্তু, এ সফর মাসেই বনু ‘আমির প্রধান হীন চক্রান্ত ও শঠতার মাধ্যমে ৭০ জন সাহাবী (রাযি.)-কে শহীদ করে। এ ঘটনাকে ‘বীরে মাউনাহর ঘটনা’ বলা হয়। ঐ সময়ে বনু নাজিরও প্রকাশ্যে শত্রুতা আরম্ভ করে দেয়। এমনকি ৪র্থ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার জন্যও চেষ্টা করে। এদিকে বনু গাতফানের সাহস এতই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় যে, চতুর্থ হিজরীর জমাদাল উলা মাসে মদীনা আক্রমণের সময়সূচি নির্ধারণ করে বসে।
মূল কথা হচ্ছে, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণের যে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল তারই প্রেক্ষাপটে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের একের পর এক নানা বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা প্রসূত পরিচালনার মাধ্যমে সকল প্রকার চক্রান্ত, শঠতা ও বৈরিতা অতিক্রম করে পুনরায় গৌরব ও মর্যাদার সু্উচ্চ আসনে মুসলিমগণকে প্রতিষ্ঠিত করতে পুরোপুরি সক্ষম হন। এ ব্যাপারে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সর্ব প্রথম পদক্ষেপ ছিল হামরাউল আসাদ পর্যন্ত মুশরিকগণের পশ্চাদ্ধাবন করা। এ পদক্ষেপের ফলে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সৈন্যদলের মর্যাদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কারণ, এ পদক্ষেপ এতই গুরুত্ব ও বীরত্বপূর্ণ ছিল যে, এর ফলে প্রতিপক্ষগণ, অর্থাৎ মুশরিক, মুনাফিক্ব ও ইহুদীগণ একদম স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে যায়। অতঃপর রাসূলে কারীম (ﷺ) আরও এমন সব সামারিক পদক্ষেপ অবলম্বন করেছিলেন যা শুধু মুসলিমগণের হৃতগৌরব পুন: প্রতিষ্ঠায় সাহায্যই করে নি, বরং তার বৃদ্ধিপ্রাপ্তিতেও প্রভূত সাহায্য করেছিল। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে এ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে।
(১) আবূ সালামাহর অভিযান (سَرِيَّةُ أَبِيْ سَلَمَةَ):
উহুদ যুদ্ধের পর সর্ব প্রথম মুসলিমগণের বিরুদ্ধাচরণ করে বনু আসাদ বিন খুযায়মাহ গোত্র। মদীনায় এ মর্মে খবর পৌঁছায় যে, খুওয়াইলিদের দু’ ছেলে ত্বালহাহ ও সালামাহ নিজদলের লোকজন এবং অনুসারীদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য বনু আসাদকে আহবান জানাচ্ছে। এ সংবাদ অবগত হয়ে নাবী কারীম (ﷺ) অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আনসার ও মুহাজিরদের সমন্বয়ে দেড় শত সৈন্যের এক বাহিনী গঠন করেন এবং আবূ সালামাহর হস্তে পতাকা প্রদান করে তাঁর নেতৃত্বাধীনে সেই বাহিনী প্রেরণ করেন। বনু আসাদের প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বেই আবূ সালামাহ (রাঃ) অতর্কিতভাবে তাদের আক্রমণ করেন, যার ফলে তারা হতচকিত হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পলায়ন করে। মুসলিম বাহিনী তাদের পরিত্যক্ত উট ও বকরীর পাল এবং প্রাপ্ত গণীমতের মালামালসহ নিরাপদে মদীনা ফিরে আসেন। এ অভিযানে মুসলিম বাহিনীকে মুখোমুখী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় নি।
এ অভিযান সংঘটিত হয়েছিল চতুর্থ হিজরী মুহাররম মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর। এ অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবূ সালামাহ (রাঃ)-এর উহুদ যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে প্রাপ্ত ব্যথা পুনরায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং অল্প কালের মধ্যেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।[1]
[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১০৮ পৃঃ।
(২) আব্দুল্লাহ বিন উনাইস (রাঃ)-এর অভিযান (بَعْثُ عَبْدِ اللهِ بْنِ أُنَيْسٍ):
চতুর্থ হিজরীর মুহাররম মাসের ৫ তারীখে এ মর্মে একটি সংবাদ পাওয়া যায় যে, খালিদ বিন সুফইয়ান হুযালী মুসলিমগণকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে সৈন্য সংগ্রহ করছে। শত্রুপক্ষের এ দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন।
আব্দুল্লাহ বিন উনাইস (রাঃ) মদীনার বাইরে ১৮ দিন অবস্থানের পর মুহাররমের ২৩ তারীখে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি খালিদকে হত্যা করে তার মস্তক সঙ্গে নিয়ে আসেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তিনি যখন মস্তকটি তাঁর সম্মুখে উপস্থাপন করেন তখন তিনি তাঁর হাতে একটি ‘আসা’ (লাঠি) প্রদান করে বলেন, ‘এটা কিয়ামতের দিন আমার ও তোমার মাঝে একটি নিদর্শন হয়ে থাকবে। যখন তাঁর মৃত্যুর সময় নিকবর্তী হল এ প্রেক্ষিতে তিনি সেই আসাটিকে তাঁর লাশের সঙ্গে কবরে দেয়ার জন্য অসিয়ত করলেন।[1]
[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১০৯ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬১৯-৬২০ পৃঃ।
(৩) রাযী’র ঘটনা (بَعْثُ الرَّجِيْعِ):
চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে ‘আযাল’ এবং ‘ক্বারাহ’ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করে যে, তাদের মধ্যে কিছু কিছু ইসলামের চর্চা রয়েছে। কাজেই, কুরআন ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য তাদের সঙ্গে কয়েকজন সাহাবী (রাঃ)-কে পাঠালে ভাল হয়। সে মোতাবেক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইতিহাসবিদ ইবনু ইসহাক্বের মতে ছয় জন এবং সহীহুল বুখারীর বর্ণনা মতে দশ জন সাহাবা কিরাম (রাঃ)-কে তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেন। ইবনে ইসহাক্বের মতে মুরশেদ বিন আবূ মুরশেদ গানাভীকে এবং সহীহুল বুখারীর বর্ণনা মতে ‘আসিম বিন উমার বিন খাত্তাবের নানা ‘আসিম বিন সাবেতকে এ দলের নেতৃত্বে প্রদান করা হয়। এরা যখন রাবেগ এবং জেদ্দাহর মধ্যবর্তী স্থানের হোযাইল গোত্রের ‘রাযী’ নামক ঝর্ণার নিকটে পৌঁছান তখন আযাল এবং ক্বারাহর উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ হুযাইল গোত্রের শাখা বানু লাহয়ানকে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য লেলিয়ে দেয়।
এ গোত্রের একশত তীরন্দাজ তাঁদের অনুসন্ধান করতে থাকে। পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে গিয়ে নাগালের মধ্যে তাদের পেয়ে যায়। সাহাবাগণ একটি পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় বনু লাহয়ান তাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলার পর বলতে থাকে, ‘তোমাদের সঙ্গে এ মর্মে আমরা ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে তোমরা যদি নীচে নেমে আস তাহলে আমরা কাউকেও হত্যা করব না। ‘আসিম তাদের প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের অবিরাম তীর বর্ষণের ফলে ৭ জন শাহাদতবরণ করেন। জীবত রইলেন ৩ জন। তারা হচ্ছেন খুবাইব (রাঃ), যায়দ বিন দাসিন্নাহ (রাঃ) এবং আরও একজন। আবারও বনু লাহয়ান তাদের ওয়াদা পুনর্ব্যক্ত করলে তাঁরা নীচে নেমে আসেন।
কিন্তু নাগালের মধ্যে পেয়েই তারা ওয়াদা ভঙ্গ করে ধনুকের ছিলা দ্বারা তাঁদের বেঁধে ফেলে। অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তৃতীয় সাহাবী তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করেন। তারা তাঁকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করে। এদিকে খুবাইব (রাঃ) এবং যায়দ বিন দাসিন্নাহকে (রাঃ) মক্কায় নিয়ে গিয়ে বিক্রয় করে দেয়। এ সাহাবীদ্বয় বদরের যুদ্ধে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করেছিলেন।
খুবাইব (রাঃ) কিছু দিন যাবৎ বন্দী অবস্থায় মক্কাবাসীদের নিকট থাকেন। অতঃপর মক্কাবাসীগণ তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হারাম শরীফের বাইরে তানঈমে নিয়ে যায়। তাঁকে শূলে চড়ানোর পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেন, ‘দু’ রাকআত সালাত পড়ার জন্য সময় ও সুযোগ আমাকে দেয়া হোক।’ তাঁকে সময় দেয়া হলে তিনি দু’ রাকআত সালাত আদায় করেন। সালাতান্তে সালাম ফেরানোর পর তিনি বলেন, ‘যদি তোমাদের এ বলার ভয় না থাকত যে আমি যা কিছু করছি তা ভয় পাওয়ার কারণে করছি তাহলে আরও দীর্ঘ সময় যাবৎ এ সালাত আদায় করতাম।’
এরপর তিনি বলেন,
(اللهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا)
‘হে আল্লাহ! তাদেরকে এক এক করে গুণে নাও। অতঃপর তাদেরকে বিক্ষিপ্তভাবে মৃত্যু দাও এবং কাউকেও অবশিষ্ট রেখো না।
এ কথার পর তিনি নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন:
অর্থ: আমার শত্রুগণ তাদের দলবল ও তাদের গোত্রসমূহকে আমার চারদিকে একত্রিত করেছে এবং তাদের সকলেই এক স্থানে একত্রিত হয়েছে।
তারা আমার হত্যার দৃশ্য অবলোকন করার জন্য তাদের সন্তান-সন্ততি এবং নারীদেরকেও একত্রিত করেছে। আর আমাকে হত্যা করার জন্য প্রকান্ড ও সুদৃঢ় এক খেজুর বৃক্ষের নিকটবর্তী করা হয়েছে।
অর্থঃ হে আরশের মালিক (আল্লাহ)! আমাকে হত্যার ব্যাপারে আমার সঙ্গে তারা যা করতে চায় তুমি আমাকে তাতে ধৈর্য্য ধারণের শক্তি দান কর। কারণ, অল্প সময়ের মধ্যেই তারা আমার মাংসগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে এবং মৃত্যুর মাধ্যমে আমার সকল আশা আকাঙ্ক্ষার নিরসন ঘটাবে।
আমাকে হত্যার পূর্বে কুফরী গ্রহণ করা কিংবা মৃত্যুবরণ করা এ দুয়ের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণ করার সুযোগ তারা দিয়েছিল, কিন্তু কুফরী গ্রহণ না করে ধর্মের পথে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছি। তখন আমার নয়ন যুগল বিনা অস্থিরতায় অশ্রু প্রবাহিত করেছে, অর্থাৎ মৃত্যুর ভয়ে আমি অস্থির হই নি, বরং তাদের অন্যায় আচরণ ও নির্বুদ্ধিতার কারণে ক্ষোভে দুঃখে আমার নয়ন যুগল অশ্রু-সিক্ত হয়েছে।
لَسْتُ أُبَالِيْ حِيْنَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا عَلٰى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ لِلهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِيْ ذَاتِ الْإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ يُبَارِكْ عَلٰى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
আমি যখন মুসলিম হিসেবে আল্লাহর পথে কাফিরদের হাতে নিহত হচ্ছি তখন আমার হত্যা যে কোন অবস্থায়ই হোক না কেন, আমি কোন কিছুকে ভয় করি না।
আমি জানি যে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই আমার মৃত্যু হচ্ছে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমার শরীরের বিখন্ডীকৃত প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গেই বরকত দান করতে পারেন।’
এরপর খুবাইব (রাঃ)-কে আবূ সুফইয়ান বলল, ‘তোমার নিকট এটা কি পছন্দনীয় যে, তোমার পরিবর্তে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আমাদের এখানে পেয়ে তার গ্রীবা কর্তন করা হবে আর তুমি নিজ আত্মীয় স্বজনসহ জীবিত থাকবে?’ তিনি বললেন, ‘না, আল্লাহর শপথ! আমার নিকট এটাই তো সহনীয় নয় যে, আমি আপন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বেঁচে থাকি এবং তার পরিবর্তে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে যেখানে তিনি অবস্থান করছেন একটি কাঁটার আঘাত লেগে যায় এবং সে আঘাতে তিনি ব্যথিত হন।’
এরপর মুশরিকরা তাঁকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করল এবং তাঁর লাশ দেখানোর জন্য লোক নিযুক্ত করে দিল। কিন্তু ‘আমির বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) তথায় আগমন করলেন এবং রাত্রিবেলা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে লাশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কাফন-দাফন করলেন। খুবাইব (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল উক্ববাহ বিন হারিস। খুবাইব (রাঃ) তার পিতা হারিসকে বদর যুদ্ধে হত্যা করেছিলেন।
সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, খুবাইব (রাঃ) সর্বপ্রথম সম্মানিত ব্যক্তি যিনি হত্যার মুহূর্তে দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করার প্রথা চালু করেছিলেন। বন্দী অবস্থায় তাঁকে আঙ্গুর ফল খেতে দেখা গিয়েছিল, অথচ সেই সময় মক্কায় খেজুরও পাওয়া যাচ্ছিল না।
দ্বিতীয় সাহাবী যাকে এ ঘটনায় ধরা হয়েছিল তিনি ছিলেন যায়দ বিন দাসিন্নাহ। সাফওয়ান বিন উমাইয়া তাকে ক্রয় করে নিয়ে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
কুরাইশগণ ‘আসিম (রাঃ)-এর দেহের অংশ বিশেষ আনয়নের জন্য লোক প্রেরণ করে। উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে সনাক্ত করা। কারণ বদর যুদ্ধে তিনি বিশিষ্ট কোন এক কুরাইশ প্রধানকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর এমন এক ভীমরুলের ঝাঁক প্রেরণ করলেন যারা কুরাইশ লোকজনদের দুরভিসন্ধি থেকে এ লাশ হেফাজত করল। কুরাইশদের পক্ষে লাশের কোন অংশ গ্রহণ করা সম্ভব হল না। ‘আসিম আল্লাহর দরবারে প্রকৃতই এ প্রার্থনা করেছিলেন যে, তাঁকে যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনিও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। উমার যখন এ ঘটনা অবগত হলেন তখন বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাকে তাঁর মৃত্যুর পরেও হেফাজত করেন যেমনটি করেন জীবিত অবস্থায়।[1]
[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ১৬৯-১৭৯ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৯৯ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৬৮-৫৬৯, ৫৮৫ পৃঃ।
(৪) বি’রে মাউনাহর মর্মান্তিক ঘটনা (مَأْسَاةُ بِئْرِ مَعُوْنَةِ):
যে মাসে রাযী এর ঘটনা সংঘটিত হয় ঠিক সেই মাসেই বি’রে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনাও সংঘটিত হয়। এ ঘটনা রাযী’র ঘটনার চাইতেও কঠিন ও বেদনাদায়ক।
এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবূ বারা’ ‘আমির বিন মালিক যিনি ‘মুলায়েবুল আসিন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন (বর্শা নিয়ে যিনি খেলা করেন) এক দফা মদীনায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন। নাবী কারীম (ﷺ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না কিংবা তা থেকে সরেও গেলেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সাহাবীগণকে (রাঃ) নাজদবাসীগণের নিকট প্রেরণ করেন তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে বলে আশা করি।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْهِمْ أَهْلَ نَجْدٍ) ‘নাজদবাসীদের থেকে নিজ সাহাবীগণ সম্পর্কে আমি ভয় করছি।’
আবূ বারা‘ বললেন, ‘তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন।’
এ কারণে ইতিহাসবিদ ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা মতে ৪০ জন এবং সহীহুল বুখারীর তথ্য মোতাবেক ৭০ জন সাহাবাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সঙ্গে প্রেরণ। ৭০ জনের সংখ্যাটি সঠিক বলে প্রমাণিত। মুনযির বিন আমিরকে (বনু সায়েদা গোত্রের সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল এবং ‘মু’নিক লিইয়ামূত’ (মৃত্যুর জন্য স্বাধীনকৃত) উপাধিতে ভূষিত ছিলেন, দলের নেতা নিযুক্ত করেন। এ সাহাবাবৃন্দ (রাঃ) ছিলেন বিজ্ঞ, ক্কারী, এবং শীর্ষ স্থানীয়। তাঁরা দিবা ভাগে জঙ্গল থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করে তার বিনিময়ে আহলে সুফফাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন ও কুরআন শিক্ষা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন এবং রাত্রি বেলা আল্লাহর সমীপে মুনাজাত ও সালাতের জন্য দন্ডায়মান থাকতেন। এ ধারা অবলম্বনের মাধ্যমে তাঁরা মাউনার কূপের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এ কূপটি বনু ‘আমির এবং হাররাহ বনু সুলাইমের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল।
সেই স্থানে শিবির স্থাপনের পর এ সাহাবীগণ (রাঃ) উম্মু সুলাইমের ভ্রাতা হারাম বিন মিলহানকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পত্রসহ আল্লাহর শত্রু ‘আমির বিন তোফাইলের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু পত্রটি পাঠ করা তো দূরের কথা তার ইঙ্গিতে এক ব্যক্তি হারামকে পিছন দিক থেকে এত জোরে বর্শা দ্বারা আঘাত করল যে, দেহের অপর দিক দিয়ে ফুটা হয়ে বের হয়ে গেল। বর্শা-বিদ্ধ রক্তাক্তদেহী হারাম বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর মহান! কাবার প্রভূর কসম! আমি কৃতকার্য হয়েছি।’
এরপর পরই আল্লাহর শত্রু আমির অবশিষ্ট সাহাবাদের (রাঃ) আক্রমণ করার জন্য তার গোত্র বনু আমিরকে আহবান জানাল। কিন্তু যেহেতু তাঁরা আবূ বারা’র আশ্রয়ে ছিলেন সেহেতু তারা সেই আহবানে সাড়া দিল না। এদিক থেকে সাড়া না পেয়ে সে বনু সুলাইমকে আহবান জানাল। বুন সুলাইমের তিনটি গোত্র উমাউয়া, রে’ল এবং যাকওয়ান। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ সাহাবীগণ (রাঃ)-কে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। প্রত্যুত্তরে সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং একজন বাদে সকলেই শাহাদত বরণ করলেন। কেবলমাত্র কা‘ব বিন যায়দ (রাঃ) জীবিত ছিলেন। তাঁকে শহীদগণের মধ্য থেকে উঠিয়ে আনা হয়। খন্দকের যু্দ্ধ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।
তাছাড়া আরও দু’জন সাহাবী- ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) এবং মুনযির বিন উক্ববা বিন আমির (রাঃ) উট চরাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তাঁরা পাখী উড়তে দেখে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর মুনযির তাঁর বন্ধুগণের সংখ্যা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদতবরণ করেন। ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীকে বন্দী করা হয়। কিন্তু যখন তারা অবগত হয়ে যে, মুযার গোত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে তখন আমির তার কপালের চুল কেটে দিয়ে তার মায়ের পক্ষ হতে- যার উপর একটি দাসকে স্বাধীন করার মানত ছিল- তাঁকে মুক্ত করে দেয়।
‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) এ বেদনা-দায়ক ঘটনার খবর নিয়ে মদীনায় পৌঁছলেন। ৭০ জন বিজ্ঞ মুসলিমের এ হৃদয় বিদারক শাহাদাত উহুদ যুদ্ধের ক্ষতকে আরও বহুগুণে বর্ধিত করে তোলে। কিন্তু উহুদের তুলনায় এ ঘটনা আরও মর্মান্তিক ছিল এ কারণে যে, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণ শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখী যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলিমগণ চরম এক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) প্রত্যাবর্তন কালে কানাত উপত্যাকার প্রান্তভাবে অবস্থিত কারকারা নামক স্থানে পৌঁছে একটি বৃক্ষের ছায়ায় অবতরণ করেন। বনু কিলাব গোত্রের দু’ ব্যক্তিও তথায় অবস্থান গ্রহণ করে। তারা উভয়েই যখন ঘুমে নিমগ্ন হয়ে পড়ে তখন ‘আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলল। তাঁর ধারণা ছিল যে, এদের হত্যা করে তার সঙ্গীদের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন। অথচ তাদের দু’ জনের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে অঙ্গীকার ছিল, কিন্তু ‘আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) তা জানতেন না। কাজেই, মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ব্যাপারটি অবহিত করেন তখন তিনি বললেন যে, (لَقَدْ قَتَلْتَ قَتِيْلَيْنِ لَأَدِيَنَّهُمَا) ‘তুমি এমন দুজনকে হত্যা করেছ যাদের শোনিত পাতের খেসারত অবশ্যই আমাকে করতে হবে।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিম এবং তাঁদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ইহুদীদের নিকট থেকে শোনিত পাতের খেসারত একত্রিত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটাই পরিণামে বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।[1] এর বিবরণ পরবর্তীতে আসছে।
মা’উনাহ এবং রাযী’র উল্লেখিত বেদনা-দায়ক ঘটনাবলীতে যা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এতই ব্যথিত[2] হয়েছিলেন এবং এ পরিমাণ চিন্তিত ও মর্মাহত[3] হন যে, যে সকল গোত্র ও সম্প্রদায় বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে সাহাবীগণকে (রাঃ) হত্যা করে নাবী কারীম (ﷺ) এক মাস যাবৎ তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সমীপে বদ দু‘আ করতে থাকেন। তিনি ফজরের সালাতে রে’ল যেকওয়ান, লাহইয়ান এবং উসাইয়া গোত্রের বিরুদ্ধে বদ্-দোয়া করেন এবং বললেন যে, (عُصَيَّةٌ عَصَتْ اللهَ وَرَسُوْلَهُ) ‘উসাইয়া আল্লাহ এবং তার রাসূলের নাফারমানী করেছে।’
আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে স্বীয় নাবীর উপর আয়াত অবতীর্ণ করেন যা পরবর্তী কালে মানসুখ হয়ে যায়। সেই আয়াত ছিল এইরূপ- (بَلِّغُوْا عَنَّا قَوْمَنَا أَنَا لَقِيْنَا رَبَّنَا فَرَضِيَ عَنَّا وَرَضِيْنَا عَنْهُ) ‘আমার সম্প্রদায়কে এ কথা বলে দাও যে, আমরা আপন প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, আমারও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুনুত পাঠ করা ছেড়ে দেন।[4]
[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ১৮৩-১৮৫ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১০৯-১১০ পৃ: এবং সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৪ ও ৪৮৬ পৃঃ।
[2] ইমাম ওয়াক্বিদী লিখেছেন যে, ‘রাযী’’ এবং ‘মউনা’ ঘটনার সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট একই রাত্রিতে পৌঁছেছিল।
[3] আনাস (রাঃ) হতে ইবনে সা‘দ বর্ণনা করেন যে, বীরে মাউনার মর্মান্তিক ঘটনায় নাবী কারীম (সাঃ)-কে যে পরিমাণ ব্যথিত ও মর্মাহত হতে দেখা গিয়েছিল অন্য কোন ব্যাপারেই তাঁকে এত অধিক পরিমাণে মর্মাহত হতে দেখি নাই। শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস সীরাহ ২৬০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৬-৫৮৮।
(৫) বনু নাযীর যুদ্ধ (غَزْوَةُ بَنِيْ النَّضِيْرِ):
ইতোপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম এবং মুসলিমগণের নামে ‘ইহুদীগণ জ্বলে পুড়ে’ যেতে থাকে। কিন্তু যেহেতু তারা ছিল ভীরু ও কারপুরুষ এবং যুদ্ধের ময়দানে পেরে ওঠার ক্ষমতা তাদের ছিল না, সেহেতু তারা শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করত। যুদ্ধের পরিবর্তে তারা ষড়যন্ত্র ও হীন কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নানাভাবে দুঃখ-কষ্ট দেয়ার কাজে লিপ্ত থাকত। অবশ্য বনু ক্বায়নুক্বার দেশত্যাগ এবং কা‘ব বিন আশরাফির হত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ফলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের চক্রান্তমূলক কাজকর্মে কিছুটা ভাটা পড়ে যায়। কিন্তু উহুদের যুদ্ধের পর তাদের পূর্বের আচরণ ধারায় আবার তারা ফিরে আসে, অর্থাৎ চক্রান্তমূলক ক্রিয়াকর্ম পুনরায় শুরু করে দেয়। তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা আরম্ভ করে, অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং মদীনার মুনাফিক্ব ও মক্কার মুশরিকদের সাহায্য করতে থাকে।[1]
সব কিছু অবগত হওয়া সত্ত্বেও নাবী কারীম (ﷺ) অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে চলতে থাকেন। কিন্তু রাযী ও মউনার বেদনাদায়ক ঘটনাবলীর মাধ্যমে তারা সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে খতম করার এমন এক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে যা নিম্নে উল্লেখিত হল :
কয়েকজন সাহাবা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইহুদীদের নিকট গমন করে বনু কিলাব গোত্রের সেই দু’ ব্যক্তির শোনিতপাতের খেসারত সম্পর্কে কথোপকথন করছিলেন ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী ভুলক্রমে যাদের হত্যা করেছিলেন। তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কারণে এ ব্যাপারে সহায়তা করা ছিল আশু কর্তব্য।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাদের সঙ্গে কথোপকথনরত ছিলেন তারা বলল, ‘আবুল কাশেম! আমরা আপনার কথা মতোই কাজ করব। আপনি এখানে অবস্থান করুন, আমরা আপনার প্রয়োজন পূরণ করছি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের এক বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসে পড়লেন এবং তাদের ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় রইলেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), আলী (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবা কেরামের (রাঃ) একটি দল।
এদিকে ইহুদীগণ গোপনে একত্রিত হলে শয়তান তাদের পেয়ে বসল এবং তাদের ভাগ্য লিখনে যে দুভার্গ্যের প্রসঙ্গটি লিপিবিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে তাকে আরও সুশোভন করে উপস্থাপন করল। এ প্রেক্ষিতে তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পরস্পর বলাবলি করল, ‘কে এমন আছে যে, এই চাকীটা নিয়ে দেয়ালের উপর উঠে যাবে, অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ)-এর মাথার উপর তা নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করবে?’
দুর্ভাগা ইহুদী ‘আমর বিন জাহহাশ বলল, ‘আমি’।
তাদের মধ্যে থেকে সালাম বিন মুশকিম বলল, ‘তোমরা এমন কর না, কারণ আল্লাহর কসম! তোমরা যা করতে চাচ্ছ সে সম্পর্কে তাঁকে অবগত করিয়ে দেয়া হবে। অধিকন্তু, আমাদের এবং তাঁদের মধ্য যে অঙ্গীকারনামা রয়েছে, এ কাজ হবে তারও বিপরীত।’
কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত না করে তাদের চক্রান্তমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ব্যাপারে অটল রইল। এদিকে মহান রাববুল আলামীনের পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আঃ) আগমন করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে ইহুদী চক্রান্তের ব্যাপারটি অবগত করিয়ে দিলেন। তিনি সেখান থেকে দ্রুত গাত্রোত্থান করে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। পরে সাহাবাবৃন্দ এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি সেখান থেকে চলে এলেন, অথচ আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইহুদী চক্রান্তের বিষয়টি তখন তাঁদের নিকট ব্যক্ত করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘ইহুদীগণ এক ভয়ংকর চক্রান্ত করেছিল যা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে অবগত করেছেন।’
মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর পরই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাৎক্ষণিকভাবে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে বনু নাযীরের নিকট এ নির্দেশসহ প্রেরণ করেন যে, তারা যেন অবিলম্বে মদীনা থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। মুসলিমগণের সঙ্গে তারা আর বসবাস করতে পারবে না। মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়ার জন্য তাদের দশ দিন সময় দেয়া হল। এ নির্ধারিত সময়ের পরে তাদের মধ্য থেকে যাকে মদীনায় পাওয়া যাবে তার গ্রীবা কর্তন করা হবে। এ নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়া ছাড়া ইহুদীদের আর কোন গত্যন্তর রইল না।
নাবী কারীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগের জন্য তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তুমুনাফিক্ব নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই উল্লেখিত সময়ের মধ্যেই মদীনা ত্যাগ না করে আপন আপন স্থানে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান করতে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। সে বলে যে, তার নিকট দুই হাজার সাহসী সৈন্য রয়েছে, যারা তাদের দূর্গাভ্যন্তরে থেকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি থাকবে। অধিকন্তু, যদি তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে তাদের সঙ্গে তারাও দেশত্যাগ করবে, যদি তাদের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় তারা তাদের সাহায্য করবে এবং তাদের কোন ব্যাপারেই তারা কারো নিকট মাথা নত করবে না। তাছাড়া বনু কুরাইযাহ এবং বনু গাত্বাফান যারা তোমাদের ‘হালীফ’ (সহযোগী) তারাও তাদের সাহায্য করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيْعُ فِيْكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوْتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ) [الحشر:11]
‘তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব, আর তোমাদের ব্যাপারে আমরা কক্ষনো কারো কথা মেনে নেব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্য অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১১]
আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব পাওয়ার পর ইহুদীদের মনোবল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মদীনা পরিত্যাগ না করে বরং মুসলিমগণকে মোকাবেলা করবে। তাদের নেতা হুওয়াই বিন আখতাবের বিশ্বাস ছিল যে, মুনাফিক্ব নেতা যা বলেছে তা সে পূরণ করবে। এ কারণে প্রত্যুত্তরে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলে পাঠাল যে তারা কিছুতেই তাদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে যাবে না। তিনি যা করতে চান তা করতে পারেন।
এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলিমগণের জন্যে এ পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, ইতিহাসের সংকটপূর্ণ অধ্যায়ে শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করার ব্যাপারটি তেমন আশা কিংবা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। এর পরিণতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। তখন সমগ্র আরব জাহান ছিল মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এবং মুসলিমগণের দুটি প্রচারক দলকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছিল। তাছাড়া বনু নাযীরের ইহুদীগণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, তাদের হাত হতে অস্ত্রশস্ত্র নামানো মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। অধিকন্তু তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারটিও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আশঙ্কামুক্ত ছিল না। কিন্তু ‘বীরে মাউনার’ বেদনাদায়ক ঘটনার পূর্বে ও পরে পরিস্থিতি যে ভাবে মোড় নিয়েছিল যার ফলশ্রুতি ছিল অঙ্গীকার ভঙ্গ ও মুসলিমগণকে নির্মমভাবে হত্যা এবং যা মুসলিমগণের মনে এ সকল অপরাধ সম্পর্কে অভূতপূর্ব এক সচেতনতা ও চৈতন্যের উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তার ফলে মুসলিমগণের মনে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুভূতি এবং ইচ্ছা ও হয়েছিল তীব্র।
এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, যেহেতু বনু নাযীর নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল সেহেতু যে কোন মূল্যে যুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাতে ফলাফল যাই হোক না কেন।
এমনি এক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (ﷺ) যখন হুওয়াই বিন আখতাবের নিকট থেকে তার নির্দেশনার প্রত্যুত্তর প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি এবং তাঁর উপস্থিত সাহাবীগণ (রাঃ) আল্লাহ আকবার ধ্বনিতে ফেটে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধ প্রস্তুতি। আব্দুল্লাহ বিন উম্মু মাকতুমের উপর মদীনার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণের পর বনু নাযীর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন মুসলিম বাহিনী। পতাকা ছিল আলী বিন আবূ ত্বালীবের হাতে। বনু নাযীর এলাকায় পৌঁছে মুসলিম বাহিনী তাদের দূর্গ অবরোধ করেন।
এদিকে বনু নাযীর দূর্গ অভ্যন্তরে অবস্থান গ্রহণ করে দূর্গ প্রাচীর থেকে তীর এবং প্রস্তর নিক্ষেপ করতে থাকে। যেহেতু খেজুর বাগানগুলো তাদের ঢাল বা যুদ্ধাবরণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল সেহেতু সেগুলোকে কেটে ফেলার কিংবা পুড়িয়ে ফেলার জন্য নাবী কারীম (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেন। পরে এর প্রতি ইঙ্গিত করে হাসসান (রাঃ) বলেছেন,
وهان عَلٰى سَرَاةِ بني لُؤي ** حـريـق بالبُوَيْرَةِ مسـتطيـر
অর্থ: বনু লুওয়াইদের নেতাদের জন্য এটা অতি সাধারণ কথা ছিল যে, বুওয়াইরাতে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হবে (বনু নাযীরের খেজুরের বাগানের নাম ছিল বুওয়াইরা) এর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন,
(مَا قَطَعْتُمْ مِّن لِّيْنَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوْهَا قَائِمَةً عَلٰى أُصُوْلِهَا فَبِإِذْنِ اللهِ) [الحشر: 5]
‘তোমরা খেজুরের যে গাছগুলো কেটেছ আর যেগুলোকে তাদের মূলকান্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই (করেছ)।’ [আল-হাশর (৫৯) : ৫]
যাহোক, যখন তাদের অবরোধ করা হল তখন বনু কুরাইযাহ তাদের থেকে পৃথক রইল। আব্দুল্লাহ বিন উবাইও প্রতিশ্রুতি পালন করল না। তাছাড়া, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ গাত্বাফান গোত্রও সাহায্যার্থে এগিয়ে এল না। মোট কথা, তাদের এ সংকট কালে কেউই তাদের কোনভাবেই সাহায্য করল না। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ ঘটনার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে আয়াত নাযিল করেন,
(كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّنْكَ) [الحشر: 16]
‘(তাদের মিত্ররা তাদেরকে প্রতারিত করেছে) শয়ত্বানের মত। মানুষকে সে বলে- ‘কুফুরী কর’। অতঃপর মানুষ যখন কুফুরী করে তখন শয়ত্বান বলে- ‘তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১৬]
অবরোধ বেশী দীর্ঘদিন হয় নি, অবরোধ অব্যাহত ছিল ছয় রাত্রি মতান্তরে পনের রাত্রি। এর মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেন। যার ফলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা অস্ত্র সংবরণ করতে সম্মত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তারা প্রস্তাব করে যে মদীনা পরিত্যাগ করে তারা অন্যত্র চলে যেতে প্রস্তুত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে এ নির্দেশ প্রদান করেন যে, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্যান্য যে সব দ্রব্য তারা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে যাবে। পরিবার পরিজনও তাদের সঙ্গে যেতে পারবে।
এ স্বীকৃতির পর বনু নাযীর অস্ত্র সমর্পণ করে। অতঃপর গৃহাদির জানালা দরজাগুলো যাতে উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে নিজ হাতে নিজ নিজ ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস করে ফেলে। এদের কোন কোন লোককে ছাদের কড়া এবং দেয়ালের খুঁটি নিয়ে যেতেও দেখা যায়। অতঃপর শিশু ও মহিলাদের উটের পিঠে সওয়ার করিয়ে ছয়শত উটের উপর সব কিছু বোঝাই করে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। অধিক সংখ্যক ইহুদী এবং তাদের প্রধানগণ যেমন হুয়াই বিন আখতাব এবং সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্ব খায়বার অভিমুখে যায়। এক দল যায় সিরিয়া অভিমুখে। শুধু ইয়ামিন বিন ‘আমর এবং আবূ সাঈদ বিন ওয়াহাব ইসলাম গ্রহণ করে। কাজেই, তাদের মালামালের উপর হাত দেয়া হয় নি।
আরোপিত শর্তাদির পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু নাযীরের অস্ত্রশস্ত্র, জমিজমা ও বাড়িঘর নিজ অধিকারভুক্ত করে নেন। অস্ত্রশস্ত্র মধ্যে ছিল ৫০টি লৌহ বর্ম, ৫০টি হেলমেট এবং ৩৪০টি তরবারী।
বনু নাযীরের ঘরবাড়ি জমিজমা ও বাগ বাগিচার উপর একমাত্র নাবী কারীম (ﷺ)-এর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর এতটুকু স্বাধীনতা ছিল যে, ইচ্ছা করলে তিনি সব নিজ অধিকারে রেখে দিতে পারেন, কিংবা যাকে ইচ্ছা দিয়েও দিতে পারেন। ফলে তিনি যুদ্ধ লব্ধ অর্থ সম্পদের ন্যায় এ সবের এক পঞ্চমাংশ বাহির করেন নি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘ফাই’ (ফাও) সম্পদের ন্যায় সে সব সম্পদ দান করেছিলেন। উট, ঘোড়া কিংবা তরবারী ব্যবহার করে তা জয় করা হয় নি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিশেষ অধিকার বলে পূর্বে হিজরতকারীগণের মধ্যে সেই সম্পদ বন্টন করে দেন। তবে অভাবগ্রস্ত থাকার কারণে আনসারী সাহাবী আবূ দুজানাহ (রাঃ) এবং সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ)-কে কিছু অংশ প্রদান করেন। অধিকন্তু, একটি ছোট অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ করেন যদ্দ্বারা নিজ পবিত্র বিবিগণের পূর্ণ এক বছরের ব্যয় করতেন। অবশিষ্টাংশ যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যয় করেন।
বনু নাযীর যুদ্ধ ৪র্থ হিজরীর রবিউল আওয়াল মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে সংঘটিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা‘আলা পুরো সূরাহ হাশর অবতীর্ণ করেন। এতে ইহুদীগণের দেশান্তর পর্বটি চিত্রায়ন করে মুনাফিক্বগণের শঠতাপূর্ণ ক্রিয়াকর্মের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে এবং লব্ধ সম্পদের হুকুমসমূহ উল্লেখ প্রসঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণের প্রশংসা করা হয়েছে। অধিকন্তু, এও বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের প্রয়োজনে শত্রুদের বৃক্ষ কর্তন কিংবা তাতে অগ্নি সংযোগ করে তা জ্বালিয়ে দেয়া যেতে পারে। এরূপ করাকে ভূপৃষ্টে বিপর্যয় সৃষ্টি করা বলা চলে না। অতঃপর ঈমানদারদের জন্য তাকওয়ার অপরিহার্যতা এবং পরকাল প্রস্তুতির জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখিত বিষয়াদি বর্ণনার পর আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় হামদ ও সানা বর্ণনার পর নিজ নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে সূরাহটি সমাপ্ত করেন।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূরাহ হাশর সম্পর্কে বলতেন, এ সূরাহটিকে সূরাহ বনী নাযীর বল।[2]
ইবনু ইসহাক্ব এবং অধিকাংশ সীরাত রচয়িতাদের বর্ণনামতে এটাই হচ্ছে বনু নাযার যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত সার।
অন্যপক্ষে আবূ দাউদ, আব্দুর রাজ্জাক এবং অন্যান্য সীরাত রচয়িতাগণ এ যুদ্ধের চিত্র অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন তা হলো-
বদর যুদ্ধের পর কাফির মুরাইশগণ ইহুদীদের নিকট এ মর্মে একখানা পত্র লেখে যে, আপনারা হলেন সুদক্ষ তীরন্দায ও সুরক্ষিত দুর্গের অধিবাসী। আপনারা আমাদের কুরাইশ ভাইদের সাথে হয়তো যুদ্ধ করবেন নয়তো আমরা যা করবার তা করে বসবো। আর এতে আমাদের ও আপনাদের সম্রান্ত মহিলাদের মধ্যে কোন বাধা থাকবেন অর্থাৎ তাদের ইযযত লুণ্ঠন করা হবে। কুরাইশদের এ পত্র পাওয়ার সাথে সাথে বনু রাযী’র গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দূত পাঠিয়ে খবর দেয় যে, আপনি আপনার ত্রিশজন সাৰ্থীসহ আমাদের কাছে আগমন করুন এবং আমরাও আমাদের ত্রিশজন পণ্ডিতকে প্রেরণ করবো। এরপর আমরা অমুক স্থানে একত্রিত হবো। এতে তারা আমাদের এবং আপনাদের মাঝে ফায়সালাকারী হবে। তারা আপনার কথা শ্রবণ করবে। অতঃপর যদি আমাদের পণ্ডিতগণ আপনার কথাকে সত্যায়ন করে এবং আপনার প্রতি ঈমান আনে তবে আমরা সকলেই আপনার প্রতি ঈমান আনবো। এ কথা মোতাবেক নাবী (ﷺ) তাঁর ত্রিশজন সাহাবা (রাঃ)-কে নিয়ে বের হলেন। অন্যদিকে ইহুদীদেরও ত্রিশজন পণ্ডিত বের হলো। এমতাবস্থায় তারা কোন এক উন্মুক্ত প্রাস্তরে একত্রিত হবেন, তখন কতক ইহুদী পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো যে, তোমরা কিভাবে তাদের মোকাবালায় পেরে উঠবে অথচ তার সাথে ত্রিশজন জানবাজ সাহাবা (রাঃ) রয়েছেন? যারা সকলেই মুহাম্মাদের মৃত্যুর পূর্বে নিজেদের মৃত্যুকে পছন্দ করে। সুতরাং তোমরা মুহাম্মাদের নিকট এ বলে খরব পাঠাও যে, আমরাই কিভাবে বুঝবো বা তারাই বা কিভাবে বুঝবে অথচ তারা ত্রিশজন লোক। অর্থাৎ এসাথে বেশিসংখ্যক লোক হলো বিষয় বুঝতে কষ্টকর হবে। তাই আপনার সাখীদের থেকে কেবল তিনজনকে সাথে নিয়ে আসেন এবং আমাদেরও তিন পণ্ডিত গিয়ে আপনার সাথে কথাবার্তা বলবে। তারা আপনার উপর ঈমান নিয়ে আসলে আমরা সকলে আপনার প্রতি ঈমান নিয়ে আসবো এবং আপনাকে সত্য নাবী বলে বিশ্বাস করবো। এ কথামতো নাবী (ﷺ) তিনজন সাহাবা (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন এবং ইহুদীরা খানাযিয নামক স্থানে মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অকস্যাৎ আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত করতে লাগল। এ সংবাদ অবগত হয়ে বনু নাযীরের এক ইহুদী শুভাকাঙ্ক্ষী মহিলা তার ভাইকে খবর প্রেরণ করে। সে ছিল একজন মুসলিম আনসার। ঐ মহিলা তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে বনু নাযীরের দূরভীসন্ধামূলক চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত করে। অতঃপর তার ভাই দ্রুতগতিতে আগমন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু নাযীরের লোকেদের কাছে পৌছার পূর্বেই তাঁকে ইহুদী চক্রান্ত সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পথিমধ্যে হতে ফিরে যান। পরদিন সকালেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যবাহিনী নিয়ে বনু নাযীরকে অবরোধ করে। তিনি তাদেরকে এ নির্দেশ দেন যে, তোমরা আমাদের সাথে কোন প্রকার অন্যায় আচরণ না করার মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সন্ধি সম্পাদন ব্যতীত নিরাপদে বসবাস করতে পারবে না। কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে। ফলে তিনি মুসলমানদের নিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। পরদিন সকালে তিনি (ড°) বনু নায়ীরকে ছেড়ে দিয়ে বাহিনীসহ বনু কুরাইযাহর উপর আক্রমন করেন এবং তাদেরকেও একই আহবান জানান। তারা এতে রাযি হয়ে যায়। ফলে তিনি পরদিন সকালে সেখান হতে ফিরে এসে আবার বনু নাযীরকে আক্রমন করেন। শেষ পর্যন্ত তারা অস্ত্র ব্যতীত উটের পিঠে যা বহন করে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে যাওয়ান অনুমতি সাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর বনু নায়ীর উটের পিঠে তাদের মালসীমানা, ঘর-বাড়ি, দরজা-জানালা ইত্যাদি চাপিয়ে বহন করে নিয়ে যায়। তারা বের হয়ে যাওয়ার সময় নিজ হাতে তাদের বাড়িঘরকে ধ্বংশ করে দেয়। তারা সিরিয়া অভিমুখে চলে যায় এবং তাদের কোন কাফেলা এই প্রথম সিরিয়া গমন করে।
[1] সুনানে আবূ দাউদ শারাহ আওনূল মা’বূদ সহ ৩য় খন্ড ১১৬-১১৭ পৃঃ, ‘খবরে নাযীর’ অধ্যায়ের বর্ণনা হতে এ কথা গৃহীত হয়েছে। দ্র: সুনানে আবূ দাউদ।
[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ১৯০-১৯২ পৃঃ। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৭১ ও ১১০ পৃ: এবং সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৪-৫৭৫ পৃঃ।
(৬) নাজদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ نَجْدٍ):
কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই বুন নাযীর যুদ্ধে মুসলিমগণের এক চমৎকার সাফল্য লাভ সম্ভব হয়। এর ফলে মদীনায় বসবাসকারী মুসলিমগণের অবস্থা বেশ মজবুত হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে মুনাফিক্বগণ বহুলাংশে হীনবল হয়ে পড়ে। এরপর থেকে প্রকাশ্যে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ সকল বেদুঈনের খবরাখবর নেয়ার জন্য উদ্যোগী হন যারা উহুদ যুদ্ধের পর মুসলিমগণকে এক কঠিন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল এবং অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ইসলাম প্রচারকদের উপর হামলা চালিয়ে তাঁদের হত্যা করেছিল। এমনি এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাদের সাহস এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা মদীনা আক্রমণেরও চিন্তা ভাবনা করছিল।
বনু নাযীর যুদ্ধ হতে মুক্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সেই ওয়াদাভঙ্গকারী বেদুঈনদের শায়েস্তা করার কথা চিন্তা ভাবনা করছিলেন এমন সময় হঠাৎ সংবাদ প্রাপ্ত হন যে, বুন গাতফানের দু’টি গোত্র বুন মোহারেব এবং বনু সালাবাহ মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বেদুঈন ও পল্লীবাসীদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করছে। এ সংবাদ প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাবী কারীম (ﷺ) নাজ্দ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল সেই সকল পাষাণ হৃদয় বেদুঈনদের মনে এমন ভাবে ভীতির সঞ্চার করা যাতে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে পূর্বের ন্যায় কোন কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি করতে তারা সাহসী না হয়।
এদিকে উদ্ধত বেদুঈনদের মধ্য থেকে যারা লুণ্ঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল মুসলিমগণের আকস্মিক আক্রমণে তারা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিমগণ এ সকল লুণ্ঠনকারী গোত্র সমূহের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর নিরাপদে মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন।
জীবনী লেখকগণ এ সময়ে একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন যা ৪র্থ হিজরীর রবিউল আখের কিংবা জুমাদাল উলা মাসে নাজদে সংঘটিত হয়েছিল। তাঁরা এ যুদ্ধকেই ‘যাতুর রিক্বা’ বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এ সময় নাজদ ভূমিতে একটি যুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, তখন মদীনার পরিস্থিতি ঠিক সেই রূপই ছিল। উহুদ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় পরবর্তী বছর মদীনা প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য আবূ সুফইয়ান যে আহবান জানিয়েছিল এবং মুসলিমরা মঞ্জুর করে নিয়েছিলেন সেই সময়টা ক্রমেই নিকটবর্তী হয়ে আসছিল। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কোনক্রমেই সমীচীন ছিল না যে, বেদুঈন ও গ্রামবাসীদেরকে তাদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতার উপর প্রতিষ্ঠিত রেখে দিয়ে বদরের মতো ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য মদীনাকে মুজাহিদশূন্য অবস্থায় রাখা হবে। বরং এটাই অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার ছিল যে, বদর প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বেই ঐ সকল বেদুঈনের উপর এমনভাবে আঘাত হানা যাতে তারা কোন অবস্থাতেই মদীনামুখী হওয়ার সাহস না পায়।
প্রসঙ্গক্রমে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৪র্থ হিজরীর রবিউল আখের কিংবা জুমাদাল উলা মাসে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাকে যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধ বলে যে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে আমার অনুসন্ধান মোতাবেক তা বিশুদ্ধ নয়। কারণ, যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) এবং আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন এবং আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) খায়বার যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণের পর খায়বারেই নাবী (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়েছিলেন। গাযওয়ায়ে যাতুর রিক্বা যে খায়বার যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
৪র্থ হিজরীর বেশ কিছু কাল পর যে যাতুর রিকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খাওফের সালাত[1] আদায় করেছিলেন। খাওফের সালাত সর্ব প্রথম আদায় করা হয় গাযওয়ায়ে আসফানে। আর গাযওয়ায়ে ‘উসফান যে খন্দক যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৫ম হিজরীর শেষ ভাগে। প্রকৃতপক্ষে গাযওয়ায়ে আসফান ছিল হুদায়রিয়া সফরের একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা। আর হুদায়বিয়াহ সফর ছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষ ভাগের ঘটনা। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) খায়বার অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। এ সূত্র থেকেও প্রমাণিত হচ্ছে যে, যাতুর রিকা যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধের পরেই সংঘটিত হয়েছিল।
[1] যুদ্ধাবস্থায সালাতকে খওফের সালাত বলা হয়। এ সালাতের একটা নিয়ম হচ্ছে অর্ধসংখ্যক সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থাতেই ইমামের পিছনে সালাত আদায় করবেন আর বাকী অর্ধেক সৈন্য অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় শত্রুদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। এক রাকায়াত সালাতের পর দ্বিতীয় অর্ধেক ইমামের পিছনে চলে আসবেন এবং প্রথম অর্ধেক শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য চলে যাবেন। ইমাম দ্বিতীয় রাকায়াত পুরো করে নেবেন এবং সেনাবাহিনীর উভয় দল নিজ নিজ সালাত পালাক্রমে পুরো করে নেবেন। এর সঙ্গে সঙ্গতিশীল এ সালাতের আরও কয়েকটি নিয়ম রয়েছে যা যুদ্ধের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আদায় করা হয়ে থাকে। বিস্তারিত বিবরণের জন্য হাদীসের কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য।
(৭) দ্বিতীয় বদর যুদ্ধ (غَزْوَةُ بَدْرِ الثَّانِيَةِ):
মরুচারী আরবদের প্রভাব প্রতিপত্তির মূল উৎপাটন করা এবং বেদুঈনদের অনিষ্ট থেকে স্বস্তিলাভের পর মুসলিমগণ তাদের প্রবল পরাক্রান্ত শত্রু কুরাইশদের সঙ্গে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেন। কারণ বছর দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল এবং উহুদ যুদ্ধ শেষে এক পক্ষের ঘোষিত এবং অন্য পক্ষের সমর্থিত সময় ক্রমেই ঘনিয়ে আসছিল। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এবং সাহাবা কিরাম (রাঃ)-এর জন্য এটা অবশ্য কর্তব্য ছিল যে, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আবূ সুফইয়ান এবং কওমের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এবং হিকমত ও কৌশলের সঙ্গে যুদ্ধে যাঁতা ঘোরাবেন যে, যে দল বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত এবং স্থায়িত্ব লাভের উপযুক্ত, অবস্থার মোড় সঙ্গতভাবে তাদের দিকেই ফিরে যাবে।
সুতরাং ৪র্থ হিজরীর শা‘বান মোতাবেক ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ)-এর উপর ন্যস্ত করে বিঘোষিত বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেড় হাজার সাহাবী এবং ঘোড়া ছিল দশটি। তিনি পতাকা প্রদান করেন আলী (রাঃ)-এর হস্তে। অতঃপর বদরে পৌঁছে মুশরিকদের অপেক্ষায় শিবির সন্নিবেশ করেন। অপর দিকে আবূ সুফইয়ান পঞ্চাশ জন ঘোড়সওয়ার সহ দুই হাজার মুশরিক সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হয়। অতঃপর মক্কা হতে এক মরহালা দূরত্বে মাররুয্যাহরান নামক স্থানে পৌঁছে মাজিন্নাহ নামক প্রসিদ্ধ ঝর্ণার নিকট শিবির স্থাপন করে, কিন্তু মক্কা হতে রওয়ানা হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধের ব্যাপারে সে নিরুৎসাহিত বোধ করতে থাকে। মুসলিমগণের সঙ্গে বারংবার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কথা চিন্তা করে অন্তঃকরণ ভয়ে প্রকম্পিত হতে থাকে। মাররুয্যাহরানে পৌঁছিয়ে সে সম্পূর্ণরূপে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং মক্কা প্রত্যাবর্তনের অজুহাত খুঁজতে থাকে। অবশেষে সে নিজ সঙ্গী সাথীদের বলল, ‘হে কুরাইশগণ, এ সময়টি যুদ্ধের উপযুক্ত সময় নয়। ঐ সময় হচ্ছে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত যখন ভূমি সজীব থাকবে, জীবজানোয়ার ঘাস খেতে পাবে এবং তোমরাও দুগ্ধ পান করতে পারবে। এখন শুষ্ক অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। অতএব আমি প্রত্যাবর্তন করার মনস্থ করেছি, তোমরাও আমার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন কর।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যে সৈন্যদের সকলেই যেন ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল। কারণ, কোন প্রকার বিরোধিতা ছাড়াই সকলেই ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করল। সফর অব্যাহত রাখা কিংবা মুসলিমগণের সঙ্গে যুদ্ধ করার ব্যাপারে কেউই মত দেয়নি।
এদিকে মুসলিমগণ আট দিন পর্যন্ত বদর প্রান্তরে শত্রুদের প্রতীক্ষায় থাকেন এবং এরই মধ্যে ব্যবসায়ের পণ্যাদি বিক্রয় করে এক দিরহামকে দু’ দিরহামে পরিণত করতে থাকেন। এরপর অত্যন্ত শান শওকাতের সঙ্গে তাঁরা মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন। এ যুদ্ধকে ‘গাযওয়ায়ে বদরে মাওঊদ (ওয়াদাকৃত বদর যুদ্ধ), বদরে সানিয়াহ (দ্বিতীয় বদর যুদ্ধ), বদরে আখির (শেষ বদর যুদ্ধ) এবং বদরে সুগরা (ছোট বদর যুদ্ধ) নামে পরিচিত।[1]
[1] এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য দ্রষ্টব্য,ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ২০৯ ও ২১০ পৃঃ, যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১১২ পৃঃ।
(৮) গাযওয়ায়ে দুমাতুল জানদাল (غَزْوَةُ دُوَمَةِ الْجَنْدَلِ):
বদর হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর চতুর্দিকে শান্তি ও নিরাপত্তার এক সুন্দর বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে যায় এবং সমগ্র ইসলামী হুকুমাতের মধ্যে শান্তি স্বস্তির বাসন্তী হাওয়া প্রবাহিত হতে থাকে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরবের শেষ সীমা পর্যন্ত মনোযোগ দানের উপযোগী মানসিক প্রশান্তি ও অবকাশ লাভ করেন। পরিস্থিতির উপর মুসলিমগণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং শত্রু-মিত্র সকলেরই তা উপলব্ধি এবং স্বীকৃতি প্রদানের প্রেক্ষিত সৃষ্টির কারণে এর বিশেষ প্রয়োজনও ছিল।
কাজেই দ্বিতীয় বদর যুদ্ধের পর ছয় মাস পর্যন্ত পরিপূর্ণ প্রশান্তির মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি অবগত হন যে, সিরিয়ার নিকটবর্তী দুমাতুল জানদাল নামক স্থানের আশপাশে বসবাসরত গোত্রগুলো ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে গমনাগমনকারী লোকজনদের উপর চড়াও হয়ে তাদের মালপত্রাদি লুটপাট করে নিয়ে যায়। অধিকন্তু তিনি এ সংবাদও অবগত হন যে, মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে তারা এক বিরাট সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ করেছে।
এ প্রেক্ষিতে সে’বা বিন ‘উরফুতাহ গিফারী (রাঃ)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে এক হাজার মুসলিম সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীসহ নাবী কারীম (ﷺ) অকূস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। এটি ছিল ৫ম হিজরী ২৫শে রবিউল আওয়ালের ঘটনা। পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নেয়া হয়েছিল বনু ‘উযরাহ গোত্রের মাযকূর নামক এক ব্যক্তিকে।
এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রি বেলায় পথ চলতেন এবং দিবাভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুপক্ষের উপর আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করা। তাঁরা যখন লক্ষ্যস্থানের নিকটবর্তী হলেন তখন জানতে পারলেন যে, তারা বাইরে গেছে। কাজেই, তাদের গবাদি পাল ও রাখালদের উপর আক্রমণ চালিয়ে কিছু সংখ্যক গবাদি পশু হস্তগত করা হয়। অন্যগুলো নিয়ে রাখালেরা পলায়ন করে।
যতদূর পর্যন্ত দুমাতুল জানদালের অধিবাসীদের সংবাদ জানা গেছে তা হচ্ছে, যে দিকে সুযোগ পেল সে সেদিকে পলায়ন করল। দুমাতুল জানদাল উপস্থিত হয়ে মুসলিমগণ কাউকেও পেলেন না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে কয়েক দিন অবস্থান করে এদিক সেদিক লোক পাঠালেন, কিন্তু কেউ তাদের নাগালের মধ্যে পড়ে নি। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন। এ অভিযান কালে উয়াইনা বিন হাসানের সহিত সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয়। দুমাতুল জানদাল হচ্ছে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত একটি শহর। এখান থেকে দামেশকের দূরত্ব পাঁচ রাত্রির পথ এবং মদীনার দূরত্ব পনের রাত্রির পথ।
এ আকস্মিক ও মীমাংসাসূচক অভিযান এবং কূটনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেন; এর ফলে যুগ প্রবাহের মোড় মুসলিমগণের অনুকূলে পরিবর্তিত হয় এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরস্থ বিপদাপদের কাঠিন্য, যা তাঁদের চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করে রেখেছিল তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। মুনাফিক্বেরা নীরব এবং নিরাশ হয়ে বসে পড়ে। ইহুদীদের একটি গোত্রকে দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়। অন্যান্যরা সত্যের সমর্থন ও চুক্তিবন্ধতার প্রতি বিশ্বস্ততা প্রদর্শণ। বেদুঈন এবং কুরাইশেরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সব কিছুর প্রেক্ষাপটে মুসলিমগণ ইসলাম প্রচার করার এবং রাববুল আলামীনের পয়গাম দেশ দেশান্তরে পৌঁছে দেয়ার এক অভূতপূর্ব সুযোগ লাভ করেন।