ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের কাছে হলদে রংয়ের একতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে বললেন নটবর মিত্র। নিচু গলায় সোমনাথকে বললেন, আপনি গাড়িতেই বসুন। একেবারে ভদ্রলোকের পাড়া। কারুর সন্দেহ হলেই মুশকিল। মিসেস গাঙ্গুলীও জেনুইন ফল গেরস্ত। স্বামী কর্পোরেশনের ক্লাক—একটু মদ খাবার অভ্যাস আছে, তাই মাইনের টাকায় চালাতে পারেন না।”
সোমনাথ গাড়িতে বসে রইলো। মিস্টার মিটার দরজার কলিং বেল টিপলেন এবং ভিতরে ঢকে গেলেন। একটু পরে হাসি মুখে বেরিয়ে এসে সোমনাথকে বললেন, “চলুন। মিসেস গাঙ্গুলীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই!” নটবর এবার ফিসফিস করলেন, “একেবারে টাইট নারকুলে বাঁধাকপির মতো বক—গোয়েঙ্কার খুব পছন্দ হবে।”
নটবরের পিছন পিছন সোমনাথ ঘরের মধ্যে ঢুকলো। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন বসবার ঘর। সফট-লেদার মোড়া নরম সোফাসেটে সোমনাথ বসলো। ঘরের এককোণে কিছু বাংলা এবং ইংরিজী বই। দেওয়ালে দু-তিনজন শ্রদ্ধেয় মনীষীর ছবি। এক কোণে একটা টাইমপিস ঘড়ি। এবং তার পাশেই নিকেল-করা সুদৃশ্য ফোল্ডিং-ফ্রেমে মিসেস গাঙ্গুলী ও আর-এক ভদ্রলোকের ছবি। নিশ্চয় মিস্টার গাঙ্গুলী হবেন।
মিসেস গাঙ্গুলীর বয়স একত্রিশ-বত্রিশের বেশি নয়। বেশ লম্বা এবং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মখটি বেশ সরল-গহবধুর মতোই। কোথাও পাপের ছায়া নেই। মলিনা বোধহয় সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। কারণ চোখদুটোতে এখনও দিবানিদ্রার রেশ রয়েছে। হাল্কা নীল রংয়ের ফল ভয়েল শাড়ি পরেছেন মিসেস গাঙ্গুলী—সেই সঙ্গে চোলি টাইপের টাইট সাদা সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ, ফলে বুকের অনেকখানি দশ্যমান।
ভদ্রমহিলা আড়চোখে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। সোমনাথ চোখ নামিয়ে নিলো। নটবর বললেন, “ইনিই আমার বন্ধু, মিস্টার ব্যানার্জি। বুঝতেই পারছেন।”
মিসেস গাঙ্গুলী হাত দুটো তুলে এমনভাবে আলতো করে নমস্কার করলেন যে আন্দাজ করা যায় বালিকা-বয়সে তিনি নাচের চর্চা করতেন।
“এবার একটা টেলিফোন নিন, মিসেস গাঙ্গুলী। টেলিফোন ছাড়া আপনাকে আর মানায় না। অভিযোগ করলেন নটবরবাবু।
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। ডান কাঁধে ব্রা-এর যে স্ট্র্যাপ উঁকি মারছিল, সেটা ব্লাউজের মধ্যে ঠেলে দিতে দিতে ভদ্রমহিলা বললেন, “ওঁর ইচ্ছে নয়। বলেন, ফোন হলেই তোমাকে সব সময় জ্বালাবে। আজেবাজে লোকের তো অভাব নেই।”
নটবরবাবু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আজেবাজে লোকের সঙ্গে আপনার কাজ কোথায়? আমি তো জানি, একদম হাইয়েস্ট লেভেলে খুব জানাশোনা পার্টি ছাড়া আপনাকে পাওয়াই যায় না।”
খুশী হলেন মিসেস গাঙ্গুলী। দেহ দুলিয়ে বললেন, “মুড়ি-মিছরির তফাত যারা বোঝে তারা আমার কাছে আসে। আপনি তো জানেন, শুধু মচমচে গতর থাকলেই এ-লাইনে কাজ হয় না। আজকালকার মানুষের কত উদ্বেগ, মাথায় তাঁদের কত দুশ্চিন্তা। এইসব মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দুশ্চিন্তা ভুলিয়ে দেওয়া, আদর আপ্যায়ন করে দু দণ্ডের শাস্তি দেওয়া, একটু প্রশ্রয় দিয়ে খেলায় নামানো কি সোজা কাজ! পেটে একটু বিদ্যে না থাকলে, এসব লাইনে নাম করা যায় না।”
“তা তো বটেই!” মিসেস গাঙ্গুলীর সঙ্গে নটবর একমত হলেন।
ঠোঁট উল্টে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “আজকাল আনাড়ি যেসব মেয়ে আসছে, তারা পুরষমানুষের মনের খিদের কথাই জানে না। তারা কী করে ভিতরের খবর বার করবে? টাকা খরচ করে যে বিজনেসম্যান গেস্ট পাঠালেন তাঁর কোনো লাভ হয় না।”
নটবর মিত্তির বললেন, “তা তো বটেই।”
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। তারপর নটবরকে আক্রমণ করলেন। বললেন, “আপনার তো কোনো পাত্তাই নেই।”
“কাজকর্ম তেমন কই? শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।” নটবর বেশ বিব্রত হয়ে পড়লেন।
বিশ্বাস করলেন না মিসেস গাঙ্গুলী। মুখে হাত চাপা দিয়ে ছোট্ট হাই তুললেন, তারপর আবার ফিক করে হেসে বললেন, “আমি ভাবলাম মিসেস বিশ্বাসকে সব কাজকর্ম দিচ্ছেন। আমাকে ভুলেই গেলেন।”
“তা কখনো সম্ভব?” নটবরবাবু সুন্দর অভিনয় করলেন। আমাদের বরং আপনাকে কাজ দিতে সঙ্কোচ হয়—আপনি ক্রমশ যে লেভেলে উঠে যাচ্ছেন। খোদ মিস্টার বাজোরিয়ার প্যানেলে ঢুকেছেন আপনি, সে খবর পেয়েছি আমি। আমাদের যেসব পাটি তাদের বেশির ভাগ মড়ি কিনতে চায়। আজ যেমনি শনলাম এই বন্ধুটির মিছরি দরকার, সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে পাকড়াও করে আনলম। একবার ভাবলমে চিঠি লিখে দিই।”
“না দিয়ে ভালোই করেছেন।” লাল পাথর-বসানো কানের দুল নাড়িয়ে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “তাজানা-অচেনা লোকের সঙ্গে আমি কথা পর্যন্ত বলি না। যা আজকাল অবস্থা হয়েছে। আপনার মিসেস বিশ্বাস গোপনে পুলিশে খবর দিয়ে, আমাদের জানাশোনা একটা মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছেন। অজন্তা মিত্র খুব ভালো কাজকর্ম করছিল। মিসেস বিশ্বাসের সহ্য হলো না। এত হিংসের কী আছে বাবা? না-হয় তোমার দুজন রেগলার খদ্দের অজন্তার কাছে যাচ্ছিল। কই, আমি তো হিংসে করি না মিসেস বিশ্বাসকে। আমার একটা সায়েব খদ্দেরকে উনি তো কৰ্জা করেছেন।”
নটবর মিত্তির তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে চান। তাই বললেন, “তাহলে আমার এই বন্ধুর?”
“কবে?” হাই তুলে মুখের সামনে তিনবার টসকি দিলেন মিসেস গাঙ্গুলী।
আজকেই শুনে মিসেস গাঙ্গুলী বিশেষ উৎসাহিত বোধ করলেন না। বললেন, “এ যে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে হয়ে গেলো, মিত্তির মশাই। আজ একটু বিশ্রাম নেবো ভাবছিলাম। পর পর কদিন বড় বেশি খাটাখাটনি চলেছে।”
“আজকের দিনটা চালিয়ে দিন।” অনুরোধ করলেন নটবর মিত্তির। “কাছাকাছি ব্যাপার।”
বুকের আঁচল সামলাতে সামলাতে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “বেশি রাতের কাজকৰ্ম্ম আজকাল নিই না, নটবরবাবু। উনি বিরক্ত হন।
এবার খুশী হলেন নটবরবাবু “রাতের ব্যাপার হলে আপনাকে বলতামই না। পার্টি নিজেই দশটার মধ্যে ফাঁকা হয়ে যাবে।”
এবার টাকার অঙ্কটা জানতে চাইলেন নটবরবাবু।
‘বসবেন কে?” সুগিঠত দেহটি পাতলা কাপড় দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে প্রশ্ন করলেন . মিসেস গাঙ্গুলী।
“খুবই ফার্স্ট ক্লাস ভদ্রলোক—আমাদের ছোট ভাই-এর মতো। মিস্টার গোয়েঙ্কা।”
মুখ বেকালেন মিসেস গাঙ্গুলী। “লোকগুলো বড় পাজী হয়।”
“যা ভাবছেন—তা মোটেই নয়। কার্তিকের মতো চেহারা। অতি অমায়িক ভদ্রলোক।”
মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “গেস্ট হাউস বা বাড়ি হলে দুশো টাকা। এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে এবং পৌঁছে দিতে হবে। হোটেল হলে কিন্তু তিরিশ টাকা বেশি লাগবে, আগে থেকে বলে রাখছি।”
“আপনার সব কথা মেনে নিচ্ছি, মিসেস গাঙ্গুলী। আপনি তো জানেন আমি দরদাম পছন্দ করি না। কিন্তু ওই হোটেলের জন্য রেট বাড়িয়ে দেওয়াটা কেমন যেন লাগছে।”
রেগে উঠলেন মিসেস গাঙ্গুলী। ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “হোটেলে আমাদের বাড়তি খরচ আছে, নটবরবাবু। অকট্রয় দিতে হয়। একদিনের কাজ তো নয়—দারোয়ান থেকে আরম্ভ করে ম্যানেজারবাবু পর্যত হোটেলের সবাইকে সন্তুষ্ট করতে তিরিশ টাকা লেগে যায়। ওরা আমাদের মুখ চিনে গেছে-বিনা কাজে কোনো গেস্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও বিশ্বাস করে না। আজ যদি টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট না করি, তাহলে আগামীকাল হোটেলে কতেই দেবে না। টকতে দিলেও, ঘরে গিয়ে হাঙ্গামা বাধাবে। আগে থেকে বলে রাখা ভালো—না হলে অনেকে ভাবে, তালে পেয়ে তিরিশটা টাকা ঠকাচ্ছি।”
ঘড়ির দিকে তাকালেন মিসেস গাঙ্গুলী। জিজ্ঞেস করলেন, “একটু চা খাবেন?”
সোমনাথ রাজী হলো না। নটবরবাবু বললেন, “আরেকদিন হবে। শুধু চা কেন লুচি মাংস খেয়ে যাবো। মিস্টার গাঙ্গুলীকে বলবেন, পছন্দ মতো বাজার করে রাখতে।”
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। তারপর বললেন, “তাহলে ঘণ্টাখানেক পরে আসন। আমি তৈরি হয়ে নিই।”
সোমনাথকে সঙ্গে নিয়ে নটবর মিত্র সার্কুলার রোডে এসে দাঁড়ালেন। নটবর মিত্র এবার বিদায় নিতে চান। সোমনাথকে বললেন, “আপনার সমস্যা তো সমাধান হয়ে গেলো। ঘণ্টাখানেক পরে এসে মিসেস গাঙ্গুলীকে নিয়ে সোজা গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে চলে যাবেন।”
কিন্তু সোমনাথের ইচ্ছে নটবর যেন চলে না যান। সোমনাথের অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না নটবরবাবু। বললেন, “আমার যে অনেক কাজ! এক নম্বর পার্টির এখনও ব্যবস্থা হলো না।”
সোমনাথ ভেবেছিল কোনো চায়ের দোকানে বসে একটা ঘণ্টা কাটিয়ে দেবে। কিন্তু নটবরবাবু; বললেন, “কোথায় বসে থাকবেন? চলুন, আমার সঙ্গে ঘরে আসবেন।”
নটবরবাবুর সত্যিই দুশ্চিন্ত! বিরক্তভাবে বললেন, “এ-লাইনে বাঙালী মেয়েদের এতো সুনাম—আজকাল এক্সপোর্ট পর্যন্ত হচ্ছে। অথচ আমার ফ্রেন্ডের পাটি অদ্ভুত এক বায়না ধরেছে। পাঞ্জাবী, গুজরাতী, সিন্ধি মেয়ে পর্যন্ত সাপ্লাই করেছি কিন্তু উনি চান বড়বাজারী মেয়ে। কোথায় পাবো বলুন তো? এ-লাইনে সাপ্লাই নেই। অনেক কষ্টে একজন ফ্রেন্ডের কাছে উষা জৈন বলে একটা মেয়ের খবর পেয়েছি। সায়েবপাড়ায় থাকে। যাই একবার দেখে আসি।”
রডন স্ট্রীটে গাড়ি থামলো। নটবরবাবু নাকে নস্যি গুঁজে বললেন, “চলুন না? আপনারও জানাশোনা হয়ে থাকবে।”
সোমনাথ রাজী হলো না। তার মাথা ধরেছে। কপালটা টিপে ধরে সে গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নটবরবাবু ঊষা জৈনের কাছ থেকে ফিরে এলেন। বিরক্তভাবে বললেন, “ভীষণ ডাঁট মশাই! স্নান করছিলো, আধঘণ্টা বসিয়ে রাখলো। আমি ভাবলুম, না জানি কি ডানাকাটা পরী হবেন! সাজগোজ করে যখন অ্যাপিয়ারেন্স দিলেন তখন দেখলম, মোস্ট অর্ডিনারি। গায়ের রংটা ফর্সা, কিন্তু কেমন যেন টলটলে ঢলঢলে চেহারা কোনো বাঁধনি নেই। মিনিমাম ছত্রিশ বছর বয়স হবে, অথচ আমাকে বললে কিনা সবে পঁচিশে পড়েছে। নিজের টাকে নটবরবাবু একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। “ঐ গতর নিয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে! মিস্টার রামসহায় মোরে ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে জয়পর থেকে এই মেয়েকে আট মাস আগে কলকাতায় আনিয়েছিলেন। খরচাপাতি আধা-আধি বখরা হচ্ছিল। বন্ধুর ব্লাডপ্রেসার বাড়ায়, ভদ্রলোককে দমি কমাতে হয়েছে। তাই এখন মেয়েটা কিছু কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছে। স্বয়ং মিস্টার মোরে টেলিফোনে আমাকে ইনট্রোডিউস করে দিয়েছেন, বলেছেন আমার বুজম ফ্রেন্ড। তবু ঊষা জৈন সাতশ’ টাকার কমে রাজী হলো না। বললো, বম্বেতে নাকি এখন হাজার টাকা রোট। তা মশাই, লঙ্কাতে সোনার দাম চড়া হলে আমার কী বলুন তো? অন্য সময় হলে কোন শালা রাজী হতো—নেহাত ঐ উষা জৈন নামটার জন্যে। আমার কোনো চয়েস নেই। লোকাল মেয়ে হলে ছড়ী একশ টাকা পেতো না।”