আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : গৌরব ও বাস্তব
বাঙালি চরিত্রের মস্ত একটা বৈশিষ্ট্য; ঘরে বসে আসার অহঙ্কার করা। শুনে যতোই খারাপ লাগুক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে আমাদের গর্বও আসলে এমনি একটা অসার অহঙ্কার। কারণ, এই দিবসের সঙ্গে বাংলা ভাষার বলতে গেলে কোনো যোগ নেই। জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা-সংস্কৃতি সংস্থা— ইউনেস্কো— একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিশেবে ঘোষণা করে সত্যি সত্যি বাংলা ভাষাকে কোনো বিশেষ মর্যাদা দেয়নি। বাংলার সঙ্গে এ দিবসের একমাত্ৰ যোগাযোগ: একুশে ফেব্রুয়ারি–এই তারিখটার। পূর্ব বাংলায় এই দিনে মাতৃভাষার দাবিতে একটা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়েছিলো, সেই ঘটনার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়েই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিশেবে নির্বাচিত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি–এই দিবসের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ এই পর্যন্ত।
পৃথিবীতে এখনো প্রায় সাড়ে ছ হাজার ভাষায় লোকেরা কথা বলেন। কিন্তু এর মধ্যে তিন হাজার ভাষাই প্ৰধান প্ৰধান ভাষার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার অন্তত আংশিক প্রতিকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে। ইউনেস্কার উদ্দেশ্য ছিলো: এ দিন যাতে পৃথিবীর সকল মানুষ মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং মাতৃভাষা যে অমূল্য সম্পদ সে কথাটা উপলব্ধি করেন। তারিখ হিশেবে যাতে একুশে ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়, সে জন্যে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন ক্যানাডার দুজন কৃতী বাঙালিরফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম।
তারপর ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কো প্রতি বছর এই দিনটি উদযাপন করে আসছে। এই উপলক্ষে প্রতি বছর একটি করে পোস্টার প্রকাশ করে ইউনেস্কো। তা ছাড়া, এই প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে একটি বাণীও দেওয়া হয়। ২০০২ সালের পোস্টারটি ছিলো ভাষার বৈচিত্ৰ্য সম্পর্কে। এই পোস্টারে নানা ভাষার হরফ ছিলো। কিন্তু তাতে কোনো বাংলা হরফ ছিলো না। এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক প্রতি বছর যে-বাণী প্ৰদান করেন, তা করেন ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, চীনা এবং রুশ ভাষায়। এমন কি, আরবি ভাষাতেও এ বাণী প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা–বাংলায় একবারও এই বাণী দেওয়া হয়নি। এ থেকেই বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ কতো ক্ষীণ।
আমার ধারণা, খোদ বাংলাদেশেও এ দিবসটির প্রতি সত্যিকারের সম্মান দেওয়া হয় না। অথবা এ দিনটি উদযাপনের পেছনে যে-মহান উদ্দেশ্য ছিলো, তার প্রতিও কোনো শ্ৰদ্ধা দেখানো হয় না। বরং এই শ্রদ্ধাবোধ আরও কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিবাচক ফলগুলোর দিকে যদি নজর দিই, তা হলে প্রথমেই বলতে হয় একদিন রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের লোকেরা নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করেছিলেন। তার প্রথম ফলই হয়েছিলো বাংলা ভাষা সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানদের মনে যে-দ্বিধা এবং বিদ্বেষ ছিলো, তা দূর হয়ে যায় এবং তাঁরা বাংলা ভাষাকে নিজেদের ভাষা হিশেবে ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। কেবল তাই নয়, নিজেদেরও তারা শনাক্ত করেন বাঙালি বলে। সেই সচেতনতা থেকেই–বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়— মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাঙালি মুসলমানরা স্বদেশে ফিরে আসেন। তা ছাড়া, এই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিশেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং তার চর্চা অনেক বৃদ্ধি পায়। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ: এই আন্দোলন থেকে যেভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, তা-ই শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়। একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিশেবে এখন বাংলাদেশে ংলা ভাষার চর্চা ক্ৰমাগত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায় এবং এ ভাষা হয়তো পৃথিবীর ভাষা-মানচিত্রে কালে কালে বাংলাদেশের ভাষা হিশেবেই টিকে থাকবে।
সে দিক থেকে বিবেচনা করলে ভাষা আন্দোলনের অর্জন অসীম। কিন্তু এর যে কোনো নেতিবাচক ফল হয়নি, তা নয়। ভাষার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের শতকরা ৯৮ জন লোকের মাতৃভাষাই বাংলা। এ রকম এক-ভাষী জাতির মধ্যে যেমন এক ধরনের ঐক্য এবং সংহতির মনোভাব তৈরি হয়, তেমনি এই পরিবেশে সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর লোকেদের পক্ষে তাদের ভাষিক পরিচয় বঁচিয়ে রাখা শক্ত হয়। তা ছাড়া, এর ফলে জন্ম নিতে পারে এক ধরনের অন্ধ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ। সে রকমের জাতীয়তাবাদের তোড়ের মুখে দেশে কেবল ভাষিকসংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নয়, ধর্মীয় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিও অসহিষ্ণুতার মনোভাব দানা বঁধতে পারে। তাদের ওপর অবিচার হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। যেমন হয়েছিলো, ধরা যাক, হিটলারের জর্মেনিতে। বাংলাদেশেও গত তিন দশকে ভাষিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতি অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের পরিচয়কে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এই যে অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা এবং বিদ্বেষের মনোভাব–বাংলাদেশে এটা প্ৰকাশ পেয়েছে নানাভাবে এবং গোড়া থেকেই। আমরা সবাই বাংলায় কথা বলি–এই চেতনার বশবর্তী হয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে আমাদের নাগরিকত্বের নাম দেওয়া হয়েছিলো “বাঙালি”। তার মানে বাংলা যাদের মাতৃভাষা নয়, তারাও এই সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে বাধ্য। তা ছাড়া, স্বাধীনতার পর থেকে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রতিও সুবিচারের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা এবং মগ-সহ অন্যান্য আদিবাসীরা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে পড়লাম, কিভাবে খাসিয়াদের ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে। এই অত্যাচারের শিকার সকল খাসিয়া, তবে বিশেষ করে খাসিয়া মেয়েরা। স্বাধীনতার পর থেকেই চাকমা-অঞ্চলের একটা বড়ো অংশ বাংলাভাষীরা দখল করে নিয়েছেন। কেবল তাই নয়, সরকারী কাজেকর্মে বাংলার ওপর অগ্ৰাধিকার দেওয়ায় শিক্ষা, চাকরিবাকরি ইত্যাদিতেও তারা দেশের নাগরিক হিশেবে নিজেদের ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
বাংলাদেশে তিরিশটিরও বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে। এসব গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। নিচের পীঠিকা থেকে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সংখ্যা দেখা যাবে।
আদিবাসী ভাষার নাম — ভাষাভাষীর সংখ্যা
চাকমা — ২৫২,২৫৮
সাঁওতালী –- ২০২,১৬১
মার্মা –- ১৫৭,৩০১
ওরাওঁ – প্রায় ১০০,০০০
তিপরা –৭৯,৭৭২
গারো — ৬৪,২৮০
হাজং – ৫০,০০০
মনিপুরী – ২৪,৮৮২
মুরোং – ২২,১৭৮
মুণ্ডা – ১৭,৫০০
রাখাইন – ১৬,৯৩২
মালপাহাড়ী – ৯,০০০
মালো, গাঞ্জ, খাসিয়া ইত্যাদি – ৫০,০০০
উপরের পীঠিকায় যে-সংখ্যা দেখানো হয়েছে, তা ১৯৯১ সালের লোকগণণার হিশেবে অনুযায়ী। তখন আদিবাসীর সংখ্যা ছিলো বারো লাখ। এতো দিনে তা কুড়ি লাখে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হয়। এঁদের প্রায় শতকরা পঁচিশ ভাগ বাস করেন খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবনে। কিন্তু দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও আদিবাসীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, বিশেষ করে ময়মনসিং, সিলেট, রাজশাহী এবং রংপুরে। তা ছাড়া, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি অঞ্চলেও আদিবাসীদের দেখতে পাওয়া যায়।
আদিবাসীদের ওপর সবচেয়ে অবিচার করা হয়েছে তাদের ভাষা শিক্ষার প্রশ্নে। দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের অধিকার তত্ত্বত সমান। কিন্তু বাংলাভাষীরা তাদের ভাষা শিক্ষার জন্যে যে-ধরনের আর্থিক আনুকূল্য এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা লাভ করেন, আদিবাসীরা তা পান না। এমন কি, বাংলাদেশে বিহারী নামে পরিচিত যে-জনগোষ্ঠী আছে, তাদেরও নিজেদের ভাষা শেখার সুযোগ নেই। কেবল তাই নয়, এখন ঢাকায় উর্দু ভাষায় মুদ্রণের ব্যবস্থা আছে কিনা অথবা উর্দু বইপত্র পাওয়া যাবে কিনা, সে সম্পর্কেও আমি নিশ্চিত নই।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো গোষ্ঠী হলো চাকমাদের। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন চাকমা ভাষায়। এ ভাষা যথেষ্ট উন্নত এবং এর নিজস্ব লিপিমালা আছে। মগ ভাষারও লিপি আছে। অথচ এই দুই ভাষায় লেখাপড়া শেখানোর কোনো ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ফলে জীবিকার প্রয়োজনে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে চাকমা এবং মগরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বাংলাকেই প্ৰধান ভাষা হিশেবে গ্ৰহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। চাকমাদের পরেই সবচেয়ে বড়ো ভাষাগোষ্ঠী হলো সাঁওতালী। সেদিক দিয়ে তাদের ভাষাও টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিলো অনেক বেশি। কিন্তু বিরাট সংখ্যক লোক সাঁওতালী ভাষায় কথা বললেও সে ভাষা চর্চা করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তাদের নেই। নেই। এ ভাষা শেখার জন্যে সরকারী কোনো সহায়তা। (যেটকু সহায়তা আছে, তা আসে খৃস্টান মিশনারিদের তরফ থেকে ) বস্তুত, সংখ্যালঘু আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণের জন্যে বাংলাদেশে সরকারী কোনো প্ৰয়াস লক্ষ্য করা যায় না। বরং এসব সম্প্রদায়কে বাংলা শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। সাওতালরাও তাই নিজেদের ভাষা বিসর্জন দিয়ে বাংলা শিখছেন। কয়েক দশক পরে এ ভাষার অস্তিত্ব থাকবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
সাঁওতালী ভাষার সঙ্গে কোল এবং মুণ্ডা ভাষার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। এক সময়ে মুণ্ডা ভাষা কতো ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো, তার পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় বাং ভাষায় মুণ্ডা শব্দের প্রাচুর্য থেকে। অথচ সেই মুণ্ডা ভাষা এখন বাংলাদেশ থেকে লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পারভেজ শুভর একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সাতক্ষীরার একটি অঞ্চলে মুণ্ডাভাষীরা এবং কুষ্টিয়ার মীরপুরের কোল ভাষীরা কেউই প্ৰায় তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলেন না। কমবয়সীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ভাষা ভুলে যাচ্ছেন এবং লেখাপড়া শিখছেন বাংলা ভাষায়। কেবল বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কেউ কেউ এখনো তাদের পুরোনো ভাষা আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষা দুটিরও মৃত্যু হবে–অন্তত বাংলাদেশের ঐ দুটি অঞ্চলে। বেদে এবং রাজবংশীরাও এমনি আদিবাসী। তাদেরও নিজস্ব ভাষা ছিলো। কিন্তু তাঁরা ইতিমধ্যে সেই ভাষা ভুলে গিয়ে বর্তমানে বাংলাতেই কথা বলেন। একটা ভাষা পৃথিবী থেকে লোপ পাওয়ার অর্থ হলো মানুষের ঐশ্বর্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আংশিকভাবে বিলুপ্ত হওয়া।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইণ্ডিয়ানরা অনেকগুলো ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু এসব ভাষা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তেমনি, এস্কিমোদের ভাষাগুলোও লুপ্তির পথে। ১৯৯০ সালের হিশেব থেকে দেখা যায়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু লাখ বিরাশি হাজার রেড ইন্ডিয়ান ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন। এসব ভাষাভাষীর সংখ্যা এতো কম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সমানাধিকারের ভিত্তিতে এসব ভাষা শেখার সুযোগ পান। তবে কালে কালে ইংরেজির চাপের মুখে এসব ভাষা লোপ যাবে–এ প্রায় ভবিষ্যৎ বাণীর মতো বলা দেওয়া যায়।
ভাষিক সংখ্যালঘুদের জন্যে ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা ব্রিটেনেও যথেষ্ট রয়েছে। ওয়েলশ ভাষা একটি ছোটো ভাষা। এই ভাষাভাষীর সংখ্যা এখন ৫০৮,০৯৮। বহু বছর ধরে আস্তে আস্তে এঁদের সংখ্যা কমে যাচ্চিলো। কিন্তু ২০০৩ সালে প্রথম বারের মতো এঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করা হয়। ওয়েলশ ভাষা শিক্ষা করার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। এ ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। চাকরিবাকরিতে এই ভাষা জানার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে যে-ভাষা ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, সেই ভাষাই আবার নতুন প্ৰাণ লাভ করতে আরম্ভ করেছে। এই ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে রয়েছে ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং আর্থিক পৃষ্ঠপোষণা।
একই কথা বলা যায়, ব্রিটেনের অন্যান্য ভাষিক সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে। দৃষ্টান্ত হিশেবে বাংলার কথা বলতে পারি। ব্রিটেনে বাংলাভাষীর সংখ্যা লাখ তিনেকের কিছু বেশি; হিন্দী এবং উর্দুভাষীদের তুলনায় যা অনেক কম। তা ছাড়া, বহু বাঙালি পরিবারে বাংলার কোনো চৰ্চা নেই। তা সত্ত্বেও স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বাংলাকে একটি বিষয় হিশেবে বেছে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ রকম আরও আঠারোটি ভাষা আছে আধুনিক ভাষাসমূহের তালিকায়। (তার মধ্যে পাঞ্জাবী, হিন্দী, গুজরাটি এবং উর্দুও রয়েছে।) স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বাংলাকে নির্বাচন করে মাত্র হাজার দুয়েক ছাত্রছাত্রী। আর, উচ্চমাধ্যমিক এ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র শখানেক প্রার্থী। ংলার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এতো কম হওয়া সত্ত্বেও অনেকগুলো মাধ্যমিক স্কুলে বাংলা পড়ানো হয়। বাংলা পড়ানো এবং বাংলায় পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় হয়। কিন্তু তবু তা পড়ানো হয় এবং এ ভাষা জানলে কোনো কোনো চাকরিতে অগ্ৰাধিকারও দেওয়া হয়।
এ ধরনের সরকারী পৃষ্ঠপোষণা সত্ত্বেও, ইউরোপের প্রায় চল্লিশটি ভাষা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। দক্ষিণ অ্যামেরিকায় লুপ্ত হতে চলেছে প্রায় পৌনে চার শো ভাষা। এক সময়ে আফ্রিকায় বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় দু হাজার ভাষা প্রচলিত ছিলো। কিন্তু ব্যাপক উপনিবেশ গড়ে ওঠার মূল্য দিতে গিয়ে শত শত ভাষা লোপ পেয়েছে। এখন সেখানে চোদ্দো শো ভাষা টিকে আছে; তবে বেশির ভাগই নামে মাত্র। অতীতে জুলু ভাষা ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বড়ো ভাষা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যে-ভাষা, তার নাম আফ্রিকানার। এ ভাষা হলো স্থানীয় ভাষার সঙ্গে সামান্য সমন্বয়ের ফলে উপনিবেশ স্থাপনকারী ডাচদের যে-ভাষা তৈরি হয়েছে, সেই ভাষা। স্থানীয় ভাষাগুলোর বদলে ফরাসি ভাষাও প্রচলিত হয়েছে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে। তা ছাড়া, নাইজেরিয়ার মতো দেশে প্রচলিত হয়েছে পিজিন ইংরেজি। খোদ আফ্রিকার ভাষার মধ্যে যেভাষাগুলো জোরের সঙ্গে টিকে আছে, সেগুলো কোনো একটি দেশের ভাষা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ভাষা। এগুলো হলো: আরবি, সোয়াহিলি আর হাউসা। এরা স্থানীয় ভাষাগুলোকে বিলীন করে দিয়েছে। তবে দুৰ্দশা সত্ত্বেও এখনো অনেকগুলো স্থানীয় ভাষা শেখার ব্যবস্থা আছে— স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সাম্প্রতিক কালে জাতীয়তাবাদের উত্থানই নয়, বিশ্বায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নব্য-সাম্রাজ্যবাদ বিচ্চার লাভের ফলেও ইংরেজি, চীনা অথবা আরবির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা ক্রমবর্ধমান মাত্রায় গুরুত্ব লাভ করছে। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে। কোনো ব্যতিক্রম নয়। সেখানে শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এখন বাংলার বদলে ইংরেজি শিখতে চেষ্টা করছে। এরা ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করতে গিয়ে মৌখিক ইংরেজি ছাড়া সত্যিকার ইংরেজি ভাষা কতোটুকু শিখছে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে; কিন্তু তারা যে বাংলা যথেষ্ট শিখছে না, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। সরকারী কর্মকর্তা-সহ বয়স্ক লোকদের মধ্যেও অনেকে যে-ভাষায় কথা বলেন, তা ভুল। ইংরেজি এবং ভুল বাংলার একটা জগাখিচুড়ি।
ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ এবং মৌলবাদ প্রসার লাভ করার ফলেও বাংলাদেশে বাংলা ভাষার চর্চা হ্রাস পাচ্ছে। একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিশেবে স্বাধীন হলেও, স্বাধীনতার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থে বাংলাদেশে মাদ্রাসার প্রসার ঘটেছে মূলধারার স্কুল-কলেজের তুলনায় অনেক বেশি। দাবি করা হয় যে, এসব মাদ্রাসায় বাংলাইংরেজি-বিজ্ঞান ইত্যাদিও পড়ানো হয়। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেখানে আসলে জোর দেওয়া হয়। ধ্রুপদী আরবিতে কোরান-হাদিস শিক্ষার প্রতি। এমন কি, মাদ্রাসার ছাত্ররা আধুনিক আরবিও শেখে না। চলতি আরবি তো নয়ই। কিন্তু মৃত ধ্রুপদী ভাষার বদলে জীবন্ত ভাষার চর্চা প্রাত্যহিক জীবনের জন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না-করে শিক্ষার্থীরা প্রাচীনমুখী শিক্ষা গ্ৰহণ করছে। এর ফলেও বাংলাদেশের তরুণদের একটা বড়ো অংশ বাংলা ভাষা ভালো করে শেখার সুযোগ পাচ্ছে না।
এমন কি, মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় যে-বাংলা শেখানো হয়, তাও যথেষ্ট নয়। যারা বাংলা শেখানোর দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁরা নিজেরাই কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষায় এবং আঞ্চলিক উচ্চারণে। এই শিক্ষকদের অনেকে সঠিক বানানে একটা ছোটো রচনা লিখতে পারবেন। কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং পরীক্ষার মূল্যায়নের পদ্ধতিও খুবই পুরোনো। এমন কি, যে-সব পাঠ্যপুস্তক সরকারী উদ্যোগে লিখিত হচ্ছে, তার ভাষা এবং বানানও অস্থির। অনেক ক্ষেত্রে এই ভাষা হলো পারিভাষিক, আঞ্চলিক, অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ এবং সাধু ভাষার এক অবিশ্বাস্য মিশ্রণ। এর মধ্যে যদি কিছু দেখা যায়, তা হলে তা হলো: ভাষাকে বাংলাদেশীকরণের একটা সক্রিয় প্ৰয়াস।
তা ছাড়া, বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যে-সূক্ষ্ম এবং স্কুল সাম্প্রদায়িকতা লক্ষ্য করা যায়, তা থেকেও ছাত্রছাত্রীরা ভুল শিক্ষা পায়। বাংলা পাঠ্যপুস্তকের গোড়াতেই যদি থাকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটি রচনা, তা হলে অমুসলমানরা সে বিষয় পড়তে কেন আগ্রহী হবে, আমি যুক্তি দিয়ে তা বুঝতে পারিনে। এমন রচনা কি থাকতে পারে না, যা সকল ধর্মাবলম্বী পড়তে পারে এবং তা পড়ে ভাষা শিখতে পারে? বাংলা ভাষার পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করলে সন্দেহ হয়, তা ধর্ম শেখানোর বই, না ভাষা শেখানোর। এসব পাঠ্যবইয়ে যেসব গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ নির্বাচিত হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই নিকৃষ্ট মানের। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা কেবল যে ভালো বাংলা শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তাই নয়, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অমূল্য ঐহিত্য সম্পর্কেও সচেতন হতে পারে না। এসব পাঠ্য বইয়ে যে ইতিহাস বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়, তা যেমন নির্লজ্জ, তেমনি ন্যক্কারজনক। পাছে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকে, সে জন্যে বলছি: ন্যক্কারজনীক শব্দটার মানে হলো–যা থেকে বমি আসে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। মাতৃভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ কেবল যে সুস্থ আবেগ প্রকাশের ভাষা শেখে তাই নয়, কোনো শিক্ষা কার্যকরভাবে দিতে হলে তা দেওয়া দরকার মাতৃভাষারই মাধ্যমে। তা ছাড়া, মাতৃভাষা নিয়ে যে গর্ব করতে পারে না, সে নিজের পরিচয়কেই অস্বীকার করে। আমাদের দেশের মাইকেল মধুসূদনরা নিজেরা ভুল করে এই সত্যের দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন। এখন নতুন করে ভুল করে সত্যের অনুসন্ধান করার দরকার নেই। আমরা যদি কেবল নিজেদের ভাষাকে ভালো না-বেসে, মাতৃভাষাকেই শ্রদ্ধা জানাতে পারি, তা হলেই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা সাৰ্থক হবে। তার জন্যে বাংলার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করা আবশ্যিক। নয়তো, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে আমাদের গর্ব হবে নিতান্ত ফাঁপা, অর্থহীন।
(যুগান্তর, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)