২৬। ক্রীড়নক
শ্বেতপুষ্পের গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে অগস্ত্য। নীলাভ আলোয় চতুর্দিক ভরে থাকলেও ঘন শাখাপ্রশাখা ভেদ করে সেই আলোর সামান্য অংশই বৃক্ষের নীচে এসে পৌঁছেছে। সেই ছায়াভরা মাটির উপরে বাদামি কালো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। রক্তের তীব্র গন্ধে অগস্ত্য ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। কিছুটা দূরে সে দেখছে এক মানুষের শরীরকে পড়ে থাকতে, কে ও? অগস্ত্যর মনে হল অনিকাদেবীর মৃতদেহ সেখানে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার ভ্রম ভাঙল, না তো, অনিকাদেবী নন, এ তো…
সহসা নিজের বাম হাতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল অগস্ত্য, প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে সেই যন্ত্রণা তার চেতনাকে ফিরিয়ে আনল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল সে। চোখ খুলেই সে দেখতে পেল উপলকে। উপলের চোয়াল শক্ত, সে দু’আঙুল দিয়ে অগস্ত্যর বাম হাতের ক্ষতের মধ্য থেকে একটি পাথরকে বার করে আনল, আবার তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠল অগস্ত্য। কিন্তু তার চিৎকার পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
মাথাটি সামান্য তুলে অগস্ত্য দেখল সে শুয়ে রয়েছে সিন্ধুদেবীর গর্ভ মন্দিরের মেঝের উপরে! তার দু’হাত এবং পা কঠিন বন্ধনীতে বাঁধা। বাম হাতের ক্ষতচিহ্নের জায়গায় একটি টাটকা দীর্ঘ ক্ষত, তা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পাথুরে মেঝের উপরে এসে পড়ছে। উপল একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে ক্ষতটিকে ঢেকে দেওয়া শুরু করল।
অগস্ত্য উপলকে চিনতে পারছিল না। যেন সম্পূর্ণ অচেনা এক মানুষ তার সামনে বসে আছে। একেই সে শৈশবকাল থেকে নিজের ভাই বলে ভেবে এসেছে? এর সঙ্গেই কেটেছে তার কৈশোরের দিনগুলি? এই উপলই খরস্রতা পয়োষ্ণী নদীতে তাকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল? এই উপলকেই সে দেখেছে ইরতেনসেনুর গলা টিপে ধরতে?
‘ইরতেনসেনু কোথায়? কী হয়েছে তার!’
আকুল কণ্ঠে বলে উঠল অগস্ত্য। হাতের তীব্র ব্যথাকে উপেক্ষা করে উঠে বসতে চাইল। উপল বলিষ্ঠ হাতে তাকে আবার শুইয়ে দিল।
‘তোমার প্রেয়সী জ্ঞান হারিয়েছিল মাত্র, তাকে উপল খুন করেনি। তার মৃত্যুর সময় এখনও আসেনি অগস্ত্য, তবে আর বেশি দেরীও নেই। সে তোমার কাছেই আছে দেখো।’
বাকারির গলায় বিদ্রুপের ছাপ স্পষ্ট। উপল রক্তমাখা রত্নখণ্ডটিকে বাকারির হাতে দিল। বাকারি নীচু হয়ে বসে গর্ভমন্দিরের মাঝের বর্তুলাকার যে গর্তে হ্রদের জল জমে আছে, তাতে রত্নখণ্ডটিকে ধুতে লাগল। অগস্ত্য শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ঘাড় কিছুটা ঘুরিয়ে দেখল সামান্য দূরে ইরতেনসেনুও শুয়ে রয়েছে। তারও হাত এবং পা শক্ত রজ্জু দ্বারা বাঁধা। তার জ্ঞান হয়তো কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে, অসহায় চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে অগস্ত্যর দিকে। অগস্ত্য আবার একবার উপলের দিকে চাইল। উপল যেন ওকেই দেখছিল, চোখ নামিয়ে নিল সে। কাতর কণ্ঠে অগস্ত্য উপলকে বলল, ‘কেন উপল? কেন?’
‘আর কোন উপায় ছিল না অগস্ত্য। রত্নখণ্ডটিকে তুমি কোনভাবে ফিরিয়ে দিতে রাজি হতে না।
‘কিন্তু তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করবে এইভাবে? এক রাত্রের মধ্যে?’
অগস্ত্যর এই প্রশ্নে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল বাকারি। তার চোখ মুখ দেখে এখন মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ শয়তান যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। শান্ত মিতভাষী বাকারি কোথাও যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বাকারি হাসি থামিয়ে বলল, ‘এক রাত্রের মধ্যে? তোমার বন্ধুটি শুধু এই একটি রাত্রেই তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে ভেবেছ?’
বাকারির কথার অর্থ অগস্ত্য বুঝতে পারল না, সে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল তার দিকে।
‘অবশ্য একে বিশ্বাসঘাতকতা আমি বলব না। উপল যা করেছে তা নিজের কাছে ঠিক মনে হয়েছে বলেই করেছে। কিছুক্ষণ আগের তোমাদের রুদ্ধদ্বার আলোচনার কথা উপল আমাকে বলেছে। কী যেন বলেছিলে তুমি? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, তুমি দৈবে বিশ্বাস করো না। এই শ্বেতপুষ্পের সন্ধানে এসে গর্ভরত্নের খোঁজ পাওয়াটা একেবারেই কাকতালীয় নয়! তাই তো? তুমি ঠিকই ভেবেছিলে, কাকতালীয় তো নয়ই। গোটাটাই অনেক আগে থেকে খুব যত্ন নিয়ে লেখা একটি নাটিকার অংশ। তুমি আর ইরতেনসেনু তার কুশীলব মাত্র।’
‘কী বলছ বাকারি? এই ষড়যন্ত্র তোমার করা!’ ইরতেনসেনু অবসন্ন গলায় বলল।
‘চুপ করো বিধর্মী!’ চিৎকার করে বলে উঠল বাকারি। শুয়ে থাকা ইরতেনসেনুর সামনে এগিয়ে গেল সে, তারপর প্রবল ঘৃণার সুরে বলল, ‘যেদিন থেকে আমার পিতা তোমাকে দত্তক নিয়ে এসেছে সেইদিন থেকে আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তোমার জন্য আমার ভালোবাসা বিভক্ত হয়েছিল। যখন দেখতাম পিতা পরম আগ্রহ ভরে তোমাকে ওই গোপন ভাষার পাঠ করাচ্ছে অথচ তা জানার কোন অধিকার আমার নেই, তখনই আমার হৃদয় বিষিয়ে উঠত।
‘পিতার কাছ থেকে বারবার শুনে এসেছি, তুমিই যোগ্যতমা! দেখো আজকে তোমার কী পরিণতি হয়েছে! নিজের হাতে সেই পিতার নিজের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করা গোপন ধন আমার হাতে তুলে দিলে!’
‘তাহলে পিতাকে তুমিই…!’
‘হ্যাঁ আমি, আমিই হত্যা করেছি তাঁকে।’
‘কিন্তু কেন? কীভাবে?’
‘এই কাজ অগস্ত্যর এই বন্ধুটি না থাকলে সম্ভব হতো না।’
এই বলে উপলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল বাকারি। উপল মাথা নীচু করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘এই রত্নের কাছে পৌঁছনোর জন্য বাকারিকে আমাকে সাহায্য করতেই হতো।
‘কিন্তু এই রত্নের খোঁজ তুমি পেলে কী ভাবে!
‘বাকারির থেকেই। আজ থেকে তিন মাস আগে। অসিরিয় দেশে বাণিজ্যের আদান প্রদান শেষ করে আমি থীবস নগরীতে বাণিজ্যের কাজে আসি। এমন আগেও কয়েকবার এসেছি। সেইবার তিনদিন ছিলাম থীবসে। প্রথম দিনের রাত্রিতে এক পানশালায় আমার সঙ্গে আলাপ হয় বাকারির। সেদিন প্রচুর নেশা করেছিল ও।
‘নেশার ঘোরে বাকারি আমাকে বলতে থাকে সে তার পিতাকে ঘৃণা করে, তার মধ্যে সব রকমের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এই বৃদ্ধ পিতার জন্য সে থীবসের মহামন্ত্রীর পদ লাভ করতে পারছে না। তার সেই পিতা নাকি মিশরীয় নয়, বিধর্মী। থীবসের মানুষকে ঠকিয়ে সে ফারাওয়ের সভাসদের আসন নিয়েছে।’
‘কিন্তু সেনেনমুতের আসল পরিচয় বাকারি জানল কীভাবে?’ অগস্ত্য জিজ্ঞাসা করল। সে বুঝতে পেরেছিল সেনেনমুত খুন হয়েছেন, কিন্তু সেই খুনি যে বাকারিই, তা সে যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘আমার বৃদ্ধ পিতাই একবার দুর্বল মুহূর্তে তাঁর জীয়নকাঠি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একবার পিতার প্রবল জ্বর হয়, সেই সময় আমি তাঁর শুশ্রূষা করছিলাম। জ্বরের ঘোরে তিনি স্বজ্ঞানে ছিলেন না দু’দিন। সেই অবস্থায় তিনি বলছিলেন পুন্তের কথা, মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার কথা, সিন্ধুদেবীর গর্ভে থাকা আশ্চর্য রত্নের কথা। যেন পুন্তের কোন নাগরিকের সঙ্গেই বাক্যালাপ করছিলেন তিনি।
‘জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর অবশ্য আমি তাঁকে এর কিছুই জানাইনি। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল পিতা প্রলাপ বকছেন। কিন্তু কিছুদিন তা নিয়ে ভাবার পর আমার মনে হল সত্যিই কথাগুলির মধ্যে যোগসূত্র আছে! শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষ যে পুন্ত থেকে আহরিত তা থীবসের এক শিশুও জানে। আমি যখন উপলকে পিতার কথাগুলি বলি তখনই উপল আমাকে বলে সে আমাকে সাহায্য করবে মহামন্ত্রী পদে আসীন হতে, যদি আমি তাকে পুন্ত শহরের হদিশ দিতে পারি।’
এই সময় উপল বলল, ‘বাকারির কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল এই একমাত্র সুযোগ রত্নখণ্ড দুটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার! কিন্তু মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার পাঠ সেনেনমুত তাঁর জীবদ্দশায় করতে রাজি হতেন না।
‘তাই তাঁকে মরতে হল। উপল আমাকে গন্ধক দিয়েছিল বেশ কিছুটা। ভারতবর্ষ থেকে এই গন্ধক ও রপ্তানি করে অসিরিয়দের কাছে, তারা নাকি তা চিকিৎসায় ব্যবহার করে। উপলের দেওয়া গন্ধক আমি মিশিয়ে দিই পিতার খাদ্যে। কিছুদিনের মধ্যেই পিতা মারা যান, তাঁর মৃত্যুর কারণ থীবসের রাজবৈদ্যও বুঝতে পারেনি। গন্ধকের ব্যবহারই যে মিশরীয়রা জানে না। এতে আমার সুবিধাই হল।’
ইরতেনসেনু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেমন অবলীলায় পিতৃহত্যার কথা বলে চলেছে বাকারি। তার গলার স্বর একটুও কাঁপছে না। সে বলতে লাগল, ‘পিতার মৃত্যুর পর মহামন্ত্রী হওয়া আমার জন্য খুবই সহজ ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি সেই পদ পাই। কিন্তু উপলকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমাকে পালন করতে হতো। পিতার মৃত্যুর পর আর একজনই ছিল যে মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার পাঠ করতে পারবে, সে ছিলে তুমি ইরতেনসেনু। তোমাকে তাই মিশরে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। এক রাত্রের অন্ধকারে আমি ফারাও হাতসেপসুতের মন্দিরের বাইরের বৃক্ষটির মাটিতে মিশিয়ে দিলাম উপলের দেওয়া বাকি গন্ধকটুকু।
সেই বৃক্ষটিও অচিরেই শুকিয়ে গেল। ফারাও এই খবরে যে অস্থির হয়ে উঠবেন তা আমি জানতাম। ফারাওয়ের সিংহাসনই যে আর সুরক্ষিত নয় তখন। তখন আমিই ফারাওকে জানালাম যে মেন্তুহোতেপের যে প্রহেলিকা ছ’শো বছর ধরে রাজগ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে তাতেই পাওয়া যাবে পুন্ত নগরীর ঠিকানা, আর সেই প্রহেলিকা যে ভাষায় লেখা তার পাঠ করতে পারবে একমাত্র তুমি। তারপর বাকিটা তো তুমি জানোই।’
এই কথা বলতে বলতে বাকারি উপলের দিকে এগিয়ে গেল, উপলের চোখে তখন জল। সে অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করো ভাই। জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য, তবুও এই জগতে তোমার চেয়ে আপন আমার আর কেউ নেই। এই রত্নখণ্ডের ভার আমি আর বইতে পারছিলাম না। তাই এই ছলের আশ্রয় নেওয়া।
‘কিন্তু এর জন্য তুমি খুন করতেও দু’বার ভাবলে না উপল!’
‘এই রত্নের জন্য সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অগস্ত্য। আরও একটি প্রাণের বলি তার কাছে তুচ্ছ! আর কোন উপায় ছিল না। সেনেনমুত বেঁচে থাকলে পুন্তের খোঁজ আমরা কোনভাবেই পেতাম না। কুন্দিনাপুরীতে আমি ফিরে আসার পর অপেক্ষা করছিলাম কখন ফারাওয়ের বার্তা এসে পৌঁছবে ইরতেনসেনুর কাছে। আমি জানতাম ফারাওয়ের অনুরোধকে সে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। আর সেই যাত্রার সঙ্গী হবে তুমিও। রত্নের আরেকটি খণ্ডের জন্য তোমাকেও এখানে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল।’
‘আর তোমার আসা সুনিশ্চিত করতে ফারাওয়ের সম্পুটে তোমার নামটিও যোগ করার মন্ত্রণা আমিই হাতসেপসুতকে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম এই কার্যে আমাদের অগস্ত্যর বুদ্ধিরও প্রয়োজন হবে। নাহ, এবারে এখনকার কাজে মন দেওয়া যাক।’
এই বলতে বলতে বাকারি এবার উপলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। উপল গুহামন্দিরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে নিজের ডান হাত বুকের বাম দিকে নিয়ে এসে নত হয়ে প্রণাম জানাল সিন্ধুদেবীকে। পরম ভক্তিভরে দেবীর উদ্দ্যেশে বলল, ‘হে দেবী! সহস্র বছর আগে যে পাপ সৌমিররা করেছিল তার প্রায়শ্চিত্ত আমি আজ করতে চলেছি। রত্নখণ্ডদুটিকে আজ আমি আপনার গর্ভে ফিরিয়ে দেব। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন।’
এই বলে দু’পা ভাঁজ করে মেঝের উপরে বসল সে। হাতের ছুরিটি সে দিল বাকারিকে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে সে নির্দেশ করল বামকাঁধের উপরের ক্ষতচিহ্নের দিকে। বাকারি ছুরি হাতে নিয়ে ঝুঁকে এল উপলের কাছে। তারপর ছুরিটার ধারালো ডগা দিয়ে একটানে কেটে ফেলল কাঁধের চামড়া। চোয়াল শক্ত করে ছিল উপল, তার মধ্যেও যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে।
উপলের ক্ষতের মধ্য থেকে একটি ছোট রত্নখণ্ড বার করে আনল বাকারি। তারপর উপলের ডান হাতে খণ্ডটিকে দিল। নিজের চোখের সামনে নিয়ে এসে রত্নখণ্ডটিকে দেখতে লাগল উপল, তার মুখে প্রশান্তির আনন্দ ফুটে উঠেছে। এবার সে দুটি খণ্ডই দেবীর গর্ভে স্থাপন করে পাপমুক্ত হবে!
সহসাই অগস্ত্য চিৎকার করে উঠল, ‘উপল! সাবধান!’
উপল অগস্ত্যের চিৎকার শুনে সম্বিত ফিরে পাওয়ার আগেই দেখল বাকারি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! সে সামান্যতম প্রতিরোধ করার আগেই উপলের বুকের বাম দিকে ছুরিটি আমূল বসিয়ে দিল বাকারি! যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল উপল! সেই আর্তনাদের সঙ্গে মিশে গেল অগস্ত্যর আর্ত চিৎকার। তার চোখের সামনে উপলকে খুন করল বাকারি! ইরতেনসেনুও কঁকিয়ে কেঁদে উঠল এবার। কিন্তু সেই দিকে বাকারির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
মাটিতে এলিয়ে পড়া উপলের হাতের তালু থেকে রত্নখণ্ডটিকে তুলে নিল বাকারি। তারপর নিজের কোমর বন্ধের ভিতর থেকে বার করে আনল অন্য রত্নখণ্ডটিকে। তীর্যক হেসে বলল, ‘তোমার এই বন্ধুটি বড়ই বোকা অগস্ত্য। প্রথমে যখন ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল তখন ভেবেছিলাম মন্ত্রীত্বেই আমি খুশি, ওই রত্নখণ্ড নিয়ে ও যা ইচ্ছা তাই করুক। কিন্তু পরে মনে হল ওই রত্নের যে আশ্চর্য ক্ষমতার কথা ও বলেছে তাকে তো অন্য কাজে ব্যবহার যায়! মিশরের সিংহাসনে এক নারী ফারাও হয়ে বসে আছে, এক নারী! যার অধিকার কেবল ফারাওয়ের বিছানায় এবং অন্তঃপুরে!
‘আমি গোপনে প্রতিবেশী দেশ হিতাইতের রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। এই গর্ভরত্ন নিয়ে আমি হিতাইতদের দেশে ফিরব। উপলের বানানো নকশা দেখে সেশেনুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলতে আর কোন অসুবিধা হবে না আমার। হিতাইতরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করবে থীবসকে। তার আগে আমি নগরীতে প্রচার করে দেব শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষটির নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা।
‘যুদ্ধের দেবতা মন্তু রুষ্ঠ হয়েছে শুনলে বোকা মিশরীয়রা আর মেরুদণ্ড তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এই অলৌকিক রত্নের ঔজ্জ্বল্যের সামনে তারা হিতাইতদের বশ্যতা শিকার করবে। ওই নারী হাতসেপসুতকে আমি নিজের হাতে বধ করব সেদিন, তারপর থীবসের উপরাজা হয়ে রাজত্ব করব!’
‘পাষণ্ড! নরকেও স্থান হবে না তোমার!’
চিৎকার করে বলে উঠল অগস্ত্য। তার কথায় বাকারি হাসতে লাগল। তারপর সামনে এসে তার ওপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘নরক বলে যে কিছু আছে তা আমি মানি না অগস্ত্য। পাপ বলেও কিছু হয় না। যা আছে তা এই জীবন, যাকে আমি অনুভব করতে পারছি আমার শরীর দিয়ে। এই এক জীবনকেই আমি ভোগ করব আমার ইচ্ছা মতো!’
নিজের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অসহায়ের মতো মেঝের উপরে পড়েছিল ইরতেনসেনু। চোখের সামনে উপলকে খুন হয়ে যেতে দেখেও সে কিছু করতে পারেনি। নিষ্ফল কণ্ঠে সে বলল, ‘তুমি কী ভাবছ? তুমি এই রত্ন নিয়ে পালাতে পারবে? তার আগেই পুন্তের অধিবাসীরা তোমাকে ধরে ফেলবে।’
‘সে আর সম্ভব নয় তো। গোটা পুন্ত শহর এখন ঘুমোচ্ছে, আমি তাদের নৈশাহারে যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম তাতে কয়েক প্রহরের আগে কারোর ঘুম ভাঙবে না। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন ওই বৃদ্ধা অনিকাদেবী। তাঁর চোখ দেখে মনে হয়েছিল তিনি যেন আমার মনের ভিতরটাকে পড়তে পারছেন। তাই সন্ধ্যাতেই আমি তাঁকে শেষ ঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাঁর মৃতদেহ তো তোমরা নিজেরাই দেখেছ।’
এই কথা বলতে বলতে বাকারি এগিয়ে গেল দেবীর আসনের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। অসহায় চোখে অগস্ত্য আর ইরতেনসেনু দেখল তাচ্ছিল্য ভরে নিজের বাম হাতে সিন্ধুদেবীর গর্ভ থেকে রত্নটিকে তুলে আনল সে। তারপর ডান হাতে ধরা রত্নখণ্ড দুটি তার উপরে বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রত্নটি যেন শতগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠল! তীব্র নীলাভ সাদা আলোয় ভরে উঠল গর্ভমন্দির। রত্নটিকে দু’হাতে মাথার উপরে ধরে উন্মাদের মতো হাসতে লাগল বাকারি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও মানুষ নয়, সাক্ষাৎ শয়তান বিশ্রীভাবে হেসে চলেছে। ক্ষমতার লোভ লেগে রয়েছে তার চোখ মুখে।
সহসাই এক গর্জন ভেসে এল গুহা মন্দিরের বাইরে থেকে। সেই জান্তব গর্জন ছাপিয়ে গেল বাকারির উন্মত্ত হাসিকে। অগস্ত্যর রক্ত যেন শীতল হয়ে গেল এই আওয়াজে। জান্তব ধ্বনির তীব্রতা দ্রুত বাড়তে লাগল। নিমেষের মধ্যে গুহামন্দিরের ভিতর প্রবেশ করল একটি প্রাণী এবং অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকারির উপরে। একটি ছোট আর্তনাদ বেরিয়ে এল বাকারির মুখ থেকে, তারপরই শোনা যেতে লাগল হাড় ভাঙার শব্দ।
জন্তুটি বাকারিকে জড়িয়ে সিঁড়ির নীচে নেমে এসেছে। একে আগে দেখেছে ইরতেনসেনু এবং অগস্ত্য। রাজা মেন্তুহোতেপের মন্দির গাত্রে, এই গুহার অলিন্দে! এর শরীর চিতাবাঘের মতো, গাঢ় হলুদ চামড়ার উপরে গোলাকার কালো সাদা দাগ। পায়ের পাতায় নখর থাকলেও আঙুলগুলি পাতলা চামড়া দিয়ে জোড়া। কাঁধের কাছে একটি লম্বা ফাঁক, সেখানে মাছের ফুলকার মতো দেখতে এক দেহ যন্ত্র। দানবটির কাঁধের পরের অংশ একটি ভয়াল ময়াল সাপের। সাক্ষাৎ কামারু দাঁড়িয়ে রয়েছে অগস্ত্যদের সামনে!
দানবের শরীর বেয়ে এখনও ঝরে পড়ছে হ্রদের জল। সে বেশ কয়েকটি পাকে পেঁচিয়ে ফেলেছে বাকারিকে। তার বাঁধন যত শক্ত হচ্ছে ততই বাকারির শরীরে একটি করে হাড় ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ে এবং শ্বাসকষ্টে বাকারির চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে, চোখের কোটর থেকে যেন তারা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একসময়ে মটমট শব্দে ভেঙে গেল বাকারির পাঁজরের সব কটি হাড়। এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে এল বাকারির মুখ দিয়ে, তারপরই তার প্রাণহীন মুণ্ডটি কাত হয়ে এলিয়ে পড়ল।
কামারু তার বাঁধন আলগা করল। বাকারির যে শরীরটা পাথরের মেঝেতে ধপ করে পড়ল তাকে আর চেনা যাচ্ছিল না। দুমড়ে মুচড়ে গেছে শরীরটি। কামারু এবার তাকাল অগস্ত্যর দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে এল। তার ময়াল সাপের মতো মুখটি নীচু হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা অগস্ত্যর মুখের কাছে এল। দু’দিকে চেরা জিভ মুখের বাইরে ভিতরে আসা যাওয়া করছে। মাথাটি স্থির হয়ে আছে অগস্ত্যর সামনে। সাপের গরম শ্বাস অগস্ত্যর মুখের উপরে এসে পড়ছিল। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কামারুর দিকে। কামারুর চোখদুটি অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখার মতো জ্বলছে! প্রতিটি মুহূর্তকে যেন মনে হচ্ছে এক একটি বছর।
কতক্ষণ কামারু এইভাবে অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে ছিল তা সে জানে না। এক সময় সেই দানব মুখ ঘুরিয়ে ইরতেনসেনুর দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে গেল মাটিতে পড়ে থাকা বাকারির শরীরের কাছে। কামারু এবার মুখে করে বাকারির ঘাড়টিকে ধরে ধীর পায়ে গুহামন্দির থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অগস্ত্যরা শুনল জলের আওয়াজ। সিন্ধুদেবীর গর্ভরত্নটি তখন পড়ে আছে দেবীর আসনের কাছে। তার উজ্জ্বল ছ’টায় তখনও ভেসে যাচ্ছে গর্ভমন্দির।