1 of 2

২৫. হীরা বুলবুলের তীর্থ দর্শনের সাধ

হীরা বুলবুলের তীর্থ দর্শনের সাধ দিন দিন বেড়েই চলছিল। রাইমোহন নানারূপ ওজর আপত্তি তুলে টালবাহনা করছিল বলে এক সময় জেদ ধরল যে রাইমোহনকে বাদ দিয়ে সে নিজেই সব ব্যবস্থা করবে। এখনো তার অর্থের অকুলান নেই। দেহ-ব্যবসায় এবং সংগীত-বৃত্তি পরিত্যাগ করার পর এখন সে তার বেশভুষার প্রতি কোনো মনোযোগ দেয় না, সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে বাড়িতে থাকে। কলকাতার মাথা মাথা বাবুদের দেওয়া বেশ কিছু স্বৰ্ণালঙ্কার তার কাছে রয়ে গেছে। রাইমোহনের অগোচরেই একদিন সে তার অনেকগুলি বিক্রয় করে দিয়ে এলো গুপী স্যাকরার দোকানে। এই অর্থ দিয়ে সে এবার বজরা ও লোক-লস্কর ভাড়া করবে। সে মনস্থ করেছে, সে যাবে জগন্নাথধামে। পতিতপাবন সকলকেই আশ্রয় দেন, তার মতন পতিতাকেও কি তিনি উদ্ধার করবেন না!

যথাসময়ে সব জানতে পেরে রাইমোহন একেবারে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। হীরা বুলবুলকে সে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলো যে এই সময় কি কেউ বিদেশ বির্ভূয়ে যায়! সেপাইদের হেঙ্গামা চলছে। চতুর্দিকে নানা রকম উৎপাত, দেশে একেবারে যেন অরাজক অবস্থা। এই সময় পথে-ঘাটে পদে পদে বিপদের ভয়। কিন্তু হীরা বুলবুল এসব কিছুই বুঝবে না। সে অনাথিনী, তীর্থযাত্ৰিণী, তার আবার ভয় কি!

এই পড়ন্ত যৌবনেও যে তার শরীরে মোহ উদ্রেককারী রূপ রয়েছে, সে বিষয়ে সে একেবারেই উদাসীন।

শেষ পর্যন্ত হীরা বুলবুলের একওঁয়েপনার কাছে রাইমোহনকে বশ্যতা স্বীকার করতে হলো। বিদ্যোৎসাহিনী সভায় ইদানীং তার যাতায়াত একটু কমে গিয়েছে, সেখানকার নাট্য-অভিনয় কিছুদিনের জন্য স্থগিত আছে। সিপাহী যুদ্ধের যে-কোনো রকম নিষ্পত্তি না হলে নতুন করে কিছু শুরু করা যাবে না। রাইমোহন নিজে কখনো শ্ৰীরামপুরের ওদিকে কোথাও যায়নি। সুতরাং হীরার সঙ্গে যাওয়াই সে মনস্থ করল। জগন্নাথক্ষেত্র অতি প্ৰাচীন তীর্থস্থান, দেখাই যাক না গিয়ে একবার।

রাইমোহনের খুব একটা দেব-দ্বিজে ভক্তি নেই। জীবনের বহু রকম ঘূৰ্ণিপাকে পড়ে সে বুঝেছে যে যথাসময়ে যথারীতি কৌশল প্রয়োগ করাই জীবন ধারণের প্রকৃষ্ট পন্থা। যার পুরুষকার থাকে, সে সমাজের তুঙ্গে ওঠে, যার থাকে না, কোনো ঠাকুর দেবতা তার কান ধরে টেনেও তাকে ওপরে তুলতে পারে না। যে-যাতে আমোদ পায়। তাই নিয়েই সারা জীবন মজে থাকে। কেউ ভালোবাসে যুদ্ধ বিগ্ৰহ, কেউ অর্থ, কেউ সন্তান উৎপাদন, কারুর থাকে রূপ-লালসা, কারুর বা শুধুই ফককুড়ি। রাইমোহনের ঝোঁক এই শেষোক্ত দুটির দিকেই। তাই নিয়েই তো প্ৰায় এতখানি জীবন কাটলো।

একটা বড় বাসনা ছিল রাইমোহনের, কিন্তু হীরা বুলবুলের জন্য সেটি পূর্ণ হলো না। সে চেয়েছিল সর্বসমক্ষে এই শহরের কিছু বড় মানুষের মুখোশ খুলে দিতে। তাদের কীর্তি কাহিনী নিয়ে সে গান বাঁধবে, আর হীরা বুলবুল গাইবে। জনসাধারণ ধিক্কার দেবে তাদের, এইভাবে হীরা বুলবুলের পুত্র চন্দ্রনাথের প্রতি অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া যেত। কিন্তু হীরা বুলবুলের আর ওসবে মন নেই, গান গাওয়াও সে সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে। পুত্রশোক তার বুকে শেল হয়ে বিধে আছে, জীবনের আর কিছুতেই তার আর সাধ নেই, কথাবার্তার মধ্যেও একটু যেন পাগল পাগল ভাব।

রাইমোহনের নিজের কণ্ঠ সুরেলা নয়, সে সঙ্গীত শিক্ষক, কিন্তু গায়ক নয়, তার গান কেউ শুনবে না। সেইজন্য সে এখন মধ্যে মধ্যে ভাবে যে বড় মানুষের কেচ্ছ সমন্বিত গানগুলি সে লিখে পুস্তকাকারে ছাপাবে বেনামীতে, তারপর হাটে-বাজারে বিলি করবে।

একটি বজরা ভাড়া করা হলো আসা-যাওয়ার চুক্তিতে। দুজন হিন্দুস্থানী বরকন্দাজও নেওয়া হলো সঙ্গে। শুভদিন শুভ লগ্ন দেখে এবার বেরিয়ে পড়লেই হয়। যাত্রার প্রাক্কালে হীরা বুলবুল রাইমোহনকে বললো, তুমিযে আমার আঁচল ধরে যাচ্চো,একটা কতা কিন্তু মনে রেকো, আমি আর না ফিত্তেও পারি। যদি মন চায়,আমি সেখানেই ঠাকুরের চরণে পড়ে থাকবো।

রাইমোহন বললো, তুই কি জগন্নাথ ক্ষেত্তরে গিয়ে চৈতন্য ঠাকুর হবি নাকি রে বেটী? না ফেরার কতা বলচিস! যাবো, দেকবো, ফুত্তি করবো, ফিরে আসবো, এই হলো গে কতা!

—তিথ্যির এস্থানে গে ফুত্তি? ফের। ও-কতা বললে ঠেঙ্গিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবো একেবারে।

—আরো ফুত্তি তো তোর সঙ্গে, অন্য কারুর কতা কি বলচি! আরো শোন, তিথ্যিস্থানে বেশী দিন থাকলে পুণ্যের ফল হয় না। কতায় বলে তিথ্যি দর্শন, তিথ্যি থাকন। কেউ বলে?

—তোমার ওসব ছেদো কতায় আমি ভুলচিনি। আমার মন না চাইলে আমি আর ফিরবো না। এই আস্তাকুড়ের জায়গায় আমার কি ফেরার ঠেকা? তোমার খুশী হয় তুমি ফিরো।

—আমায় ছেড়ে তুই থাকতে পারবি? তোর মন কাঁদবে না?

—মরে যাই, মরে যাই! থুথু থু! তোমায় দোকলে আমার অঙ্গ জ্বলে যায়। অলপ্লেয়ে, ঢ্যামনা! বেম্মদৈত্যির মতন আমার ওপর চেপে আচে, সারাটা জেবন একেবারে জ্বালিয়ে খেলে গা! কতায় বলে, যে বেটা রাঁড়ের ভাতার, তার নেই গুণের ওধার!

—আহা রে, মধু, মধু! আরও বল! রাগলে তোর মুক দিয়ে মণি মুক্ত ঝরে, কান যেন জুড়িয়ে যায়। একেই বলে শ্রবণ সাত্থক, নয়ন সাত্থক!

—তোমার তো দু কান কাটা, নাকও কাঁটা। ঐ হাড়গিলের মতন চোক দুটো যদি কেউ গেলে দিত!

—এ যে সেই গান হলো গে, ওরে প্রাণ প্ৰাণ রে বাকি নেই। আর। নাক কাটাতে নাক কান কাটা প্ৰাণ তোমার হলো লাজে মরে যাই- একটু শোনাবি?

—চোপ। যা বললুম মনে রেকো, পরে যেন আমায় দুষো না। আমি যদি আর না ফিরি…

–ওরে আমার হীরেমণি, তুই না ফিরলে কি আমি ফিরতে পারি? তোর ছিচরণে প্ৰাণ মন সঁপে একবার যখন ঠাঁই নিয়িচি, তখন তোর সঙ্গে তো আমি নরকেও যাবো! তিথ্যিস্থান তো ভাগ্যের কতা।

—ঠিক আচে, দেকো বাবু, যেন তখন পেচপাও হোয়ো না।

—তোকে যদি আমি ফিরিয়ে আনতে না পারি তা হলে আমার নাম রাইমোহন ঘোষালই নয়। তখন দেকিস, আমি সত্যিই নাক কান কাটবো!

শরৎকাল, ঝড় বাদলার তেমন ভয় নেই, বজরা চললো তরতরিয়ে। একবার ভাবা হয়েছিল, জলপথের বদলে স্থলপথে গেলে কেমন হয়। রাজা সুখময় রায় পুরী যাত্রীদের জন্য উলুবেড়ে থেকে কটক পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। মধ্যে মধ্যে ধর্মশালা। স্নান ও পানীয়ের জন্য পুষ্করিণী ও কুপ-ও খনন করিয়েছেন অনেকগুলি, সেইজন্য এখন স্থলপথ দিয়েই জগন্নাথ ক্ষেত্রে যাওয়া সুবিধাজনক। কিন্তু হীরা বুলবুল এবং রাইমোহন দুজনেই বেশ কয়েকবার বাবুদের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে বজরা ভ্ৰমণে এসেছে, জলপথে তারা অভ্যস্ত, সেই তুলনায় ড়ুলি-পাল্কিতে যাত্রা তাদের কাছে আরামদায়কও মনে হয়নি।

রাইমোহন আশা করেছিল যাত্ৰাপথটি বজরা বিহারের মতন মনোরম হয়ে উঠবে। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কোন বাবু নেই, কিন্তু সে নিজেই বা কম কী, বিশেষত হীরা বুলবুলের মতন সঙ্গিনী রয়েছে যখন। জ্যোৎসার রাতে হীরা বুলবুল আবার আগেকার মতন জড়ির চুমকি বসানো গাঢ় নীল রঙের শাড়িতে সজ্জিত হবে, কপালে থাকবে চন্দনের টিপ। আর সে নিজে কোঁচানো ধুতি ও হলুদ রেশমী বেনিয়ানটি পরে বসবে। হাতে গোড়ের মালা, সামনে সুরার পাত্র। মুখের রঙ জ্বলে গেছে, ত্বক কুঞ্চিত হয়েছে, তবু এই বৃদ্ধ বয়েসেও তার চেহারাটি একেবারে ফেলে দেবার মতন নয়। হীরা বুলবুল গানে বাতাস মাতোয়ারা করবে, আর সে নেশার ঝোঁকে, মেরে ফেল, মেরে ফেল, মেরি জান বলে উঠবে। হীরেমণির কণ্ঠে সুরের তিন লহরী খেললে সে মোহর ছুঁড়ে উপহার দেবে তাকে। এই উপলক্ষে সে বেশ কয়েক বোতল ব্র্যাণ্ডি এবং একজন তবলিয়াকেও সঙ্গে করে এনেছে।

কিন্তু হীরা বুলবুল এর কিছুই হতে দিল না। সে একখানা সামান্য কস্তা ড়ুরে তাঁতের শাড়ি পরে থাকে। কিছুতেই আগের মতন বসন ভূষণ অঙ্গে চাপাতে রাজি নয়। গানের কথা শুনলে সে মুখ ঝামটা দেয়। এমনকি, এক রাত্রে দীপ্ত নক্ষত্রময় নীল আকাশ দেখে মোহিত হয়ে রাইমোহন ব্র্যাণ্ডি ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে যেই নিজের ভাঙ্গা গলায় একটা গান গেয়ে উঠলো, অমনি বিরক্ত ক্রুদ্ধ হয়ে হীরা বুলবুল তার হাত থেকে ব্র্যাণ্ডির বোতল কেড়ে নিয়ে শূন্যে তুললো। রাইমোহন আহা হা করচিস কী, করচিস কী বলতে বলতেই হীরা বুলবুল সে বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে। রাইমোহন কোনো ভর্ৎসনা না করে একদৃষ্টি চেয়ে রইলো হীরা বুলবুলের দিকে। তার চোখে অন্য দৃশ্য ভেসে উঠলো। দু-তিন পাত্র সুরা পান করলেই একেবারে চনমনে হয়ে উঠতে হীরেমণি, গান গাইতে গাইতে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে কোমর দোলাতো, ওষ্ঠাধর একটু স্ফীত, স্বেচ্ছায় ওড়না খসিয়ে দিত বুক থেকে। দু চোখে যেন দুটি বাগদাদের ছুরি, সুরার পাত্রটি একহাতে মাথার ওপর ধরা…। মাত্র তো কয়েক বৎসর আগেকার কথা, সেই রমণীর এ রকম পরিবর্তন!

কলকাতা থেকে যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ততই উতলা হয়ে উঠছে হীরা বুলবুল, কতক্ষণে পৌঁছোবে। এখন জগন্নাথদেবই তার ধ্যান জ্ঞান, মুখে আর অন্য কথা নেই। মাঝে মাঝে সে ব্যাকুল ভাবে রাইমোহনকে প্রশ্ন করে, হ্যাঁ গা, যদি আমি ঠাকুরের কাচে হত্যে দিই, যদি বুক চিরে রক্ত দিয়ে ঠাকুরের পুজো দিই, তবু কি ঠাকুর আমার বুকের ধন চাঁদুকে ফেরৎ দেবেন না? বলো না গো?

রাইমোহন শুষ্ক কণ্ঠে সান্ত্বনা দেয়। গত দুতিন বৎসর অনেক অনুসন্ধান করেও চন্দ্রনাথের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাইমোহনের ধারণা, চন্দ্রনাথ শহর ত্যাগ করে পশ্চিমে পালিয়েছে। এই যুদ্ধের ডামাডোলে তার ভাগ্যে কী ঘটেছে কে জানে!

বজরা যাবে কটক পর্যন্ত, তারপরে পদব্ৰজে যাত্রা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। মাঝি-মাল্লারা যেদিন জানালো যে কটক আর মাত্র তিন বেলার পথ দূরে, সেইদিন শেষ রাত্রেই চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে গেল। দুটি ছিপ নৌকো ভর্তি ডাকাত পড়লো এ বজরায়। বরকন্দাজ দুজন যথানিয়মে বন্দুক পাশে রেখে নিদ্রিত ছিল, তারা কোনো বাধা দেবার আগেই মৃত্যু বরণ করলো। অন্য লোক-লস্কররা কেউ বা আহত হলো, কেউ ভয়ে লাফিয়ে পড়লো জলে। হীরা বুলবুলের সঙ্গে এক কামরাতেই শুয়ে ছিল রাইমোহন। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখলো, দ্বারের কাছে মশালধারী কয়েকটি যমদূত। কোনোক্রমে উঠে দাঁড়াবার আগেই মস্তকে প্ৰবল আঘাত পেয়ে সে সংজ্ঞাহীন হলো। নিশীথের স্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল হীরা বুলবুলের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে।

মার্জারের মতন বোধহয় নয়টি জীবন রাইমোহনের। তাই সে প্ৰাণে বেঁচে গেল। পরদিন সকালে সে জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখলো বজরাটি একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থায় মহানন্দা নদীর বক্ষে ভাসছে। বাইরে পাটাতনের ওপর একটি মৃতদেহ ও দুটি মুমূর্ষ শরীর আর দুজন লোক জবুথবু হয়ে গলুইয়ের কাছে বসে আছে। হীরা বুলবুলের কোনো চিহ্ন নেই। কিংবা তার একটি মাত্র চিহ্নই পড়ে আছে। তার দক্ষিণ হস্তের একটি লাল রঙের ভাঙ্গা বালা।

রাইমোহনের সর্বাঙ্গ রক্তে মাখামাখি। কাঁধের ওপর মাথাটি যেন অতিশয় ভারী হয়ে গেছে। একদিনেই, মুখের মধ্যে বমনের স্বাদ। তবু কোনো রকমে হামাগুঁড়ি দিয়ে এসে সে গলুইয়ের কাছে বসে থাকা লোক দুটিকে উদ্দেশ্য করে বললো, বাপধনরা, বোটটাকে একটু কিনারে নিয়ে যাবার চেষ্টা কর, নইলে যে পচে গলে মরবো।

বজরা যেখানে তীরে ভিড়লো, সে স্থল জনমানবশূন্য। অক্ষত লোক দুটি ভয়ে এমন আধমরা হয়ে আছে যে তাদের উদ্যোগে কোনো সাহায্যের জন্য কোথাও যাবার আশা নেই। ওদের মধ্যে একজনের জ্যেষ্ঠভ্রাতা নিহত হয়েছে, সেইজন্য এই সময় সে বিকট স্বরে জুড়ে দিল কান্না। ইতিমধ্যে রাইমোহনের চেতনা আবার লুপ্ত হয়েছে।

 

খানিক বাদে দুটি খড়ের নৌকো এলো সেই পথে। তার মাঝিরা চিৎকারে আড়ষ্ট হয়ে বজরার নিকটবর্তী হলো এবং সব বৃত্তান্ত শুনে বজরাটি তারা বেঁধে নিল তাদের নৌকের সঙ্গে। অপরাহ্ন তারা পৌঁছোলো একটি ছোট গঞ্জে। সেখানে একটি পুলিসচৌকি আছে। গঞ্জে সেদিন হাটবার, শত শত লোক ভিড় ভেঙ্গে ছুটে এলো দস্যু-লুন্ঠিত বজরাটি দেখতে। এক সহৃদয় ওড়িয়া বণিক দয়াপরবশ রাইমোহনকে স্থান দিলেন নিজের গৃহে। এবং শুশ্রুষার গুণে সে পরদিনই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। হীরা বুলবুলকে দুদিন পর পাওয়া গেল মহানন্দার পার্শ্ববর্তী এক মনুষ্যবসতিহীন জঙ্গলে। কাঠুরেরা তাকে দেখতে পেয়েছিল। তার শরীরে কোনো বস্ত্র নেই, কোনো হিংস্র পশু যেন তার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। যদিও কাঠুরেদের অভিমত এই যে, সে অরণ্যে কোনো হিংস্র পশু থাকে না।

হীরা বুলবুলও অবশ্য প্ৰাণে মরলো না। তাকেও চিকিৎসার জন্য আনা হলো গঞ্জটিতে। খবর পেয়ে রাইমোহন যখন তাকে দেখতে গেল, তখন হীরা বুলবুল শয্যায় উঠে বসেছে বটে। কিন্তু নির্বাক, নিষ্পন্দ। দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই। পুলিসের লোক শত চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে একটি কথাও বলতে পারেনি। রাইমোহন তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, হীরে, আমি এসিচি! যা হবার তো হয়েচে, তবু যে প্ৰাণটা যায়নি…

হীরা বুলবুল রাইমোহনকে চিনতে পারার কোনো ভাব প্রদর্শন করলো না, যেমন দেয়ালের দিকে চেয়ে ছিল, তেমনই রইলো। রাইমোহনের চক্ষে জল এলো, কিন্তু হীরা বুলবুলের দু চক্ষু শুষ্ক।

তারপর রাইমোহন অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু হীরা বুলবুলের মধ্যে কোনো বোধের সঞ্চার করানো গেল না। এর আগে অনেক পেড়াপোড়ি করেও তাকে কবিরাজি ওষুধ খাওয়ানো যায়নি। যে বাড়িতে সে রয়েচে, সেখানকার গৃহকর্তাটি বললেন, আহা, দেখলেই বোঝা যায়, কোনো বড় ঘরের বউ। তাঁর এমন দুর্দশা!

অচেনা, অজানা স্থানে এই অবস্থায় বেশীদিন থাকা যায় না। আশ্রয়দাতা ওড়িয়া বণিকটির কাছ থেকে রাইমোহন কিছু টাকা ঋণ নিয়ে পাল্কি ভাড়া করে আবার রওনা হলো কলকাতার দিকে।

পাল্কির মধ্যে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলো রাইমোহন। সে অতি পোড়খাওয়া কুশলী মানুষ, সহজে ভেঙ্গে পড়ে না। কিন্তু এখন যেন সে আর পারছে না। হীরা বুলবুলকে জড়িয়ে ধরে ড়ুকরে কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগলো, হীরে, একবার আমার পানে চা, একটা কতা বল, ওরে, দু-পাঁচটা গুণ্ডো তোর শরীর ছেড়াছিড়ি করেচে, সে সব ভুলে যা, আমি তো রয়িচি, আবার ঠিক হয়ে যাবে সব। আমি তোকে বাহান্ন। তিথ্যি ঘুরিয়ে দেকাবো, হীরে, অমন অবুঝপনা করিসনি। হীরে, দ্যাক, আমাকেও ওরা কেমন মেরেচে, আমার মাতাটা একবার দ্যাক, হীরে, ওরে আমার হীরে–।

হীরা বুলবুল তবু কোনো শব্দ করে না। তার দেহে একটি শাড়ি কোনোক্রমে আলুথালুভাবে জড়ানো, তার কোনো হায়া বোধ নেই। রাইমোহন জোর করে তার হাত দুটি তুলে, নিজের গালে ঠেকায়, হীরা বুলবুল বাধা দেয় না। আবার রাইমোহন ছেড়ে দিলেই ঝপ করে পড়ে যায়।

ধর্মশালায় হীরা বুলবুলকে নিয়ে রাত্রি যাপন করাও হলো এক সমস্যা। পাল্কি থেকে তাকে নামিয়ে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হয়, তার গায়ের কাপড় খসে পড়ে। অন্য লোকেরা কৌতূহলী হয়ে তাকায়। নানা প্রশ্ন করে। লোকচক্ষে হীরা বুলবুল এখনো এক আকর্ষণীয়া রমণী। তার অঙ্গ থেকে শাড়ি খসে পড়লে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। বারিপদার ধর্মশালায় এক সুরাপায়ী অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে পড়ে। দুটি পাশাপাশি ছোট খুপরির একটিতে রাইমোহন অন্যটিতে হীরা বুলবুল রয়েচে। ধর্মশালার দুটি বড় ঘরে একসঙ্গে অনেক যাত্রী থাকে। সেখানে হীরা বুলবুলকে রাখা যায় না। সুরাপায়ীটি হীরা বুলবুলের কক্ষের সামনে ঘুরঘুর করে, সেজন্য রাইমোহনকে সারারাত জেগে বসে থাকতে হয়। তার শরীর যেন আর বয় না।

 

মধ্যপথে, মেদিনীপুর দিয়ে আসবার সময় একবার সিপাহী-সন্ত্রাসের গুজব উঠলো। পাল্কিবাহকরা ভয় পেয়ে রাজপথ ছেড়ে আশ্রয় নিল পার্শ্ববতী এক গ্রামে। সেখানে একটি দিন গেল।

পঞ্চম দিন সকালে হঠাৎ আবার এক পরিবর্তন হলো হীরা বুলবুলের। রাইমোহন ওর পাশে বসে বিমোচ্ছিল। হঠাৎ এক চিৎকারে তার চটকা ভেঙ্গে গেল। তারপর বিস্ময়ে অনেকখানি ফাঁক হয়ে গেল তার মুখ।

বাঁ কান একহাতে চেপে ডান হাত সামনের দিকে ছড়িয়ে জোরালো গলায় গান ধরেছে। হীরা বুলবুল :

সিঙ্গিবাগানে মাথা মুড়োলো এ কোন ভৃঙ্গীরে
কানে ধরে তাদের চর্কি নাচায় সে কোন ধিঙ্গি রে

আহ্লাদে তখন রাইমোহনের নিজেরই যেন নাচতে ইচ্ছে করলো। এ যে তারই রচিত। তারই শেখানো। শত চেষ্টা করেও কয়েক বছর ধরে সে হীরা বুলবুলকে দিয়ে এই গান গাওয়াতে পারেনি।

সে হীরা বুলবুলের উরুতে চাপড় মেরে বললো, বাহবা, গা, গা, আর একবার গা—

হীরা বুলবুল আবার অন্য গান ধরলে,—

ভিতরেতে ভোয়া ফলে
কত কষ্টে দিন চলে
কোনোদিন অর্ধাশন,
কভু রহে শুকায়ে ।
পরিধেয় বাস যাহা,
রজকে দেখে না তাহা
তথাপি কি উঁচু চাল
চলে বুক ফুলায়ে
মরি, মরি, চলে বুক ফুলায়ে

অতি উৎসাহে রাইমোহন হীরা বুলবুলকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললো, আহা হা, আর কোনো চিন্তে নেই। হীরে, তুই গান ধরিচিস, তোর গলা শুনে আবার বুক জুড়োলো—।

সঙ্গে সঙ্গে যেন আগুন জ্বলে উঠলো হীরা বুলবুলের চক্ষে। কাকাতুয়ার মতন কর্কশ কণ্ঠে বললো, তুই কে রে আবাণীর পুত? কে তুই গতর খেকো! কোন হতচ্ছাড়া মিনসে আমার গায়ে হাত দেয়! যা, দূর হয়ে যা।

তারপরই সে সজোরে এক লাথি কষালো রাইমোহনকে। দুহাতের নোখ দিয়ে তার চোখ গালতে এলো। রাইমোহন অনেক প্রকারে শান্ত করার চেষ্টা করলো তাকে। কিন্তু হীরা বুলবুল আঁচড়ে কামড়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করলে তাকে। সে এখন অতি হিংস্র এক বদ্ধ উন্মাদ। শেষ পর্যন্ত পাল্কি বেহারাদের সাহায্য নিয়ে রাইমোহন কোনোক্রমে বেঁধে ফেললো তাকে।

প্রকৃতি কিংবা নিয়তির বিচিত্র পরিহাসে হীরা বুলবুল এবং রাইমোহন এই দুজনের কথাই সত্য হল। হীরা বুলবুল চেয়েছিল, সে আর কলকাতায় ফিরবে না, তাই সে ফিরে এলো না। রাইমোহন শপথ করেছিল, হীরা বুলবুলকে সে যে-কোনো প্রকারে ফিরিয়ে আনবেই, সত্যিই সে ফিরিয়ে আনলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *