২৫. হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা

হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় মীর্জা কামরানকে প্রাসাদের এক প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। প্রকোষ্ঠের বাইরে অস্ত্ৰধারী সৈনিকরা পাহারায় আছে। সম্রাটের নির্দেশে জওহর মীর্জা কামরানের কাছে এসেছে। জওহরকে বলা হয়েছে সে যেন কামরানকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।

কামরান বললেন, তুমি কি আগে কখনো আমার নফর ছিলে?

জওহর বলল, না জনাব। আমি সবসময়ই সম্রাটের আবিতাবচি ছিলাম। এখনো আছি।

কামরান বললেন, আমার কয়েকদিনের রোজা রাখা হয় নি। তুমি কি আমার হয়ে কাজা রোজা রাখতে পারবে?

জওহর বলল, অবশ্যই পারব। তবে আপনার রোজা আপনারই রাখা উচিত।

শিকলের কারণে আমি নামাজ পড়তে পারছি না। তুমি সম্রাটকে বলে আমার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করে দাও।

জওহর বললেন, ইশারায় নামাজ পড়ার বিধান আছে। আপনি ইশারায় নামাজ পড়ুন।

আরে বুরবাক, ইশারায় নামাজ না হয় পড়লাম, ইশারায় অজু করব কীভাবে?

কঠিন দুঃসময়ের নামাজে অজু লাগে না।

কামরান বললেন, তাও ঠিক। তুমি আমার বিষয়ে কী শুনেছ? আমার কি মৃত্যুদণ্ড হবে?

আমি অতি তুচ্ছ একজন পানিবাহক। আমার সঙ্গে এই বিষয়ে কারোর কথা কেন হবে?

তাও ঠিক। আচ্ছা শোনো, মীর্জা আসকারিকে কি শাস্তি দেওয়া হয়েছে?

আপনি তো জানেন তাকে কী শান্তি দেওয়া হয়েছে।

আমি কিছুই জানি না। আমাকে কিছু জানানো হয় না।

জওহর বলল, সম্রাট তাকে ক্ষমা করেছেন। নিজ খরচায় তাকে মক্কা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন।

মীর্জা কামরান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আবারও তোমার সম্রাট ভুল করলেন। সে যে মক্কা থেকে ফিরে আসবে না এবং সৈন্য সংগ্ৰহ করবে না। এই নিশ্চয়তা কি? আমি সম্রাট হলে তাকে মক্কা পাঠাতাম, তবে আগে চোখ তুলে নিতাম।

জওহর বলল, কেউ কারও মতো না।

তা ঠিক। আমাকে কবে সম্রাটের কাছে নেওয়া হবে তা কি জানো?

জনাব, আমি আপনাকে আগেই বলেছি। আমি একজন তুচ্ছ আবতাবচি।

মীর্জা কামরান বললেন, তুচ্ছও মাঝে মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়। এই বিষয়ে একটা শের শুনতে চাও?

আপনি শোনাতে চাইলে আগ্রহ নিয়ে শুনব।

ধুলার একটি তুচ্ছ কণা
চোখকে আচল করে দিতে সক্ষম।

জওহর বলল, অতি উত্তম শের। মারহাবা।

তোমার সম্রাট হুমায়ূনের শের কি আমার চেয়ে উত্তম?

দুজনের শের বিবেচনার যোগ্যতা আমার নেই জনাব।

কামরান বললেন, তোমার যোগ্যতা পানির মশক বগলে নিয়ে ঘোরাঘুরিতে সীমাবদ্ধ।

জওহর বলল, একেক জনের কাজ একেক রকম।

মীর্জা কামরান বললেন, অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে বকবক করেছি। আমার মাথা ধরে গেছে, তুমি বিদায় হও।

জওহর ঘর থেকে বের হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্ৰধান কারারক্ষী মীর্জা কামরানের ঘরে ঢুকল। কামরান বললেন, আমাকে কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে?

প্রধান কারারক্ষী বলল, না। সম্রাট আপনাকে জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন।

শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। তবে আপনার চোখ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনাকেও পাঠিয়ে দেওয়া হবে মক্কায়।

হতভম্ব কামরান বললেন, চোখ কখন তোলা হবে?

এখনই। আমি কি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারব না?

না। আপনাকে দেখলে আপনার ভাই দুর্বল হয়ে যাবেন। আপনার শাস্তি মওকুফ হয়ে যেতে পারে। কেউ তা চাচ্ছে না।

মীর্জা বললেন, কেউটা কে?

প্রধান কারারক্ষী বললেন, কেউ-এর মধ্যে সবাই আছেন। আপনার নিজের মা মহামান্য গুলারুখ বেগমও আছেন।

মীর্জা কামরান বললেন, আমাকে নিয়ে চলো। চোখ তোলো।

মীর্জা কামরানের চোখ উৎপাটনের একটি প্রত্যক্ষদশী বিবরণ জওহরের বইয়ে আছে। এই রোমহর্ষক বীভৎস বর্ণনা বাদ থাকুক। ছোট্ট একটা অংশ বলা যেতে পারে।

চোখ তোলার জন্যে একজনকে চাকু হাতে মীর্জা কামরানের হাঁটুর উপর বসতে হলো। কামরান তাকে ধমক দিয়ে বললেন, চোখ তুলতে এসেছ চোখ তোলো। হাঁটুতে ব্যথা দিচ্ছ কেন বুরবাক!

 

মক্কা যাওয়ার দিন কামরানের সঙ্গে হুমায়ূনের দেখা হলো। কামরান তাঁর কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন।

সম্রাট বললেন, ভাই, তুমি কবিতা পড়ো।

মীর্জা কামরান দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করলেন।

কবিতাটির শুরু এরকম—

মাটির ভাণ্ডে অমৃত ধারণ করা যায় না।
আমি মীর্জা কামরান মাটির ভাণ্ড ছাড়া কিছু না।
আমি গরল ধারণ করতে পারি
অমৃত কখনো না।
হুমায়ূন স্বর্ণভাণ্ড
তিনি একারণেই হৃদয়ে অমৃত
ধারণ করতে পেরেছেন।…

সম্রাট হুমায়ূন কবিতা শুনে শিশুদের মতো হাউমাউ করে কাঁদলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *