পঁচিশ
লোকটা বলেছিল, ‘জানি’। কী জানে লোকটা? রাত আটটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে নেমে বিভু ভিড়ের মধ্যে লোকটার পিছু নেয়। লোকটার ডান হাতে সুটকেস, বাঁ বগলে শতরঞ্জিতে বাঁধা ছোট বিছানা, মফস্সলির মতো হাবভাব। কিন্তু ও কিছু একটা জানে। নিশ্চিত। গতকাল থেকেই বিভুর মন ভাল নেই। মানুষ কত সহজেই টুক করে মরে যায়! এই তো একটু আগে বর্ধমানের কাছে কাটা পড়ল একটা লোক, এই লম্বা লোকটা গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল, কয়েক পলক এই লোকটার দিকে চেয়ে কাটা-পড়া মানুষটা মরে গেল। কী সহজ ব্যাপার! গতকাল আর-একটা লোক ঠিক ও-রকমই সহজভাবে মারা গেছে দুর্গাপুরে। ইউনিয়নের সেই লোকটা কীরকম ছিল কে জানে! বিভু তাকে চেনেও না। লোকটা সকালের শিফ্টে ডিউটিতে যাচ্ছিল, অল্প কুয়াশায় আবছা মাঠের ভিতর দিয়ে, একটা টিফিন-ক্যারিয়ার আর একটা থলে হাতে চলে আসছিল সে, সদ্য ঘুমভাঙা চোখে তখনও বোধ হয় বউ কি বাচ্চার মুখখানা ভাসছিল তার। অতশত জানে না বিভু, সে কেবল লোকটিকে আসতে দেখেছিল। লোকটা থেমে একটা বিড়ি ধরাচ্ছিল, বিভু হাতে বাঁধা বোমাটা টপকে দিয়ে দৌড় দিল। রেল লাইনের ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল জিপ গাড়িটা, তাকে তুলে নিল। জিপ গাড়িতেই টাকার লেনদেন হয়ে গেছে। এখন পকেট গরম, বিভু ফিরছে কলকাতায়। কিন্তু তবু গতকাল থেকেই তার মন ভাল নেই। দুনিয়াভর এত মানুষ, তার মধ্যে দু’-একজন মরে গেলে কী হয়! কিছুই না, তেমন কিছুই হয় না। এই যে বর্ধমানের কাছে কাটা পড়ল লোকটা তার জন্য কী হয়েছে। ট্রেনটা আধ ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট দেরিতে এসেছে, তার বেশি কিছুই হয়নি। কামরার মধ্যে মানুষেরা ‘আহা, উঁহু’ করছিল বটে, কিন্তু দুঃখের চেয়েও তারা বিরক্তই হচ্ছিল বেশি ট্রেনটা লেট হচ্ছে বলে। কেবল ওই লম্বা লোকটা যার হাতে টিনের সুটকেস, বগলে বিছানা, কেবল ওই লোকটাকেই অন্য রকম দেখেছিল বিভু। কাটা ছেঁড়া থ্যাঁতলানো হয়ে যাওয়া মানুষটাকে বুকে জাপটে ধরেছিল। বিভুর মনে ভাল লাগেনি। অত আদরের কী আছে? পৃথিবীর দু’-চারজন লোক কমে গেলে ক্ষতি কী? কালকের ইউনিয়নের সেই লোকটাই বিভুর প্রথম ‘কেস’ নয়। এর আগে আর একজন তার হাতে গেছে কলকাতায়। দু’বারই দুই ঘটনার সময়ে বিভুর একটা অদ্ভুত দৃশ্য মনে পড়েছিল। অনেক দিন আগে দেশের বাড়িতে বাবা খেতের কাজ করতে যেত। বেলাশেষে তার জন্য ভাত বয়ে নিয়ে যেত বিভু। একদিন ভাত দিয়ে ফেরার সময়ে আলপথে খেলতে খেলতে অন্যমনে ফিরছিল বিভু। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ভীষণ চিৎকার করে ডাকল, ভাই রে-এ। পিছন ফিরে সে দেখল একজন মুসলমান লোক লম্বা লাঠি উঁচু করে ধরে চেঁচিয়ে বলছে, ভাই রে, তুই এঁকেবেঁকে ছোট, এঁকেবেঁকে ছোট… আর তখন বিভু দেখতে পেয়েছিল চষা জমির ওপর দিয়ে তার পিছু নিয়েছে কাল-কেউটে… বিভু ছুটেছিল। আর তার ছায়ায় ছোবল মারতে মারতে পিছু পিছু সাপটা। ‘ভয় নাই রে, এসে গেছি…’ বলতে বলতে মাঠটা কোনাকুনি পার হয়ে এল সেই মুসলমান লোকটা, লম্বা লাঠির এক ঘায়ে সাপটাকে নিশ্চল করে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সাপটাকে বলল, আর একটু হলিই আমার ভাইটারে খেয়েছিলি শালা…। অনেক দিন আগের সেই ঘটনা তবু দু’ বারই বিভুর সেই দৃশ্যটা মনে পড়েছে। চষা নিষ্ফলা জমির ওপারে উঁচু আলের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ বেলার ম্লান আলোর ছায়ার মতো একজন মুসলমান লোক লম্বা লাঠি উঁচু করে তাকে চেঁচিয়ে বলছে, ভাই রে, তুই এঁকেবেঁকে ছোট, এঁকেবেঁকে ছোট… বিভুর মন ভাল লাগে না। গতকাল সকালবেলা লোকটাকে বোমা মেরে যখন জিপ গাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে বিভু তখনও হুবহু সেই দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল, নিস্তেজ বিকেলে তার পিছু নেওয়া সেই সাপ, দুরে আলের ওপর দাঁড়ানো সেই লাঠি-হাতে মুসলমান লোকটা চেঁচিয়ে বলছে, ভাই—রে-এ-এ—
এই লম্বা চেহারার লোকটা বলেছিল, ‘জানে’। কী জানে ও? কেমন করে জানে?
হাওড়া স্টেশনের প্রকাণ্ড হলঘর আর চাতাল পার হয়ে সিঁড়িতে পা দেওয়ার মুখে সে পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে স্পর্শ করল।
রমেন মুখ ঘুরিয়ে দেখল, দুর্গাপুরের সেই ছেলেটা।
কোন দিকে যাবেন? ছেলেটা জিজ্ঞেস করে।
রমেন মৃদু স্বরে বলে, যাদবপুরের দিকে।
আমিও, ওই দিকেই। ট্যাক্সি নেব, আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। যাবেন?
না, বিভু যাদবপুরের দিকে যাবে না, সে যাবে বেহালা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সে বরং ঘুরপথে লোকটাকে যাদবপুরে নামিয়ে দিয়েই যাবে। জানা দরকার এ-লোকটা কী জানে! কতটুকু জানে!
রমেন হাসল। তারপর মাথা নেড়ে জানাল, যাবে।
ট্যাক্সিতে ছেলেটা রমেনকে সিগারেট দিল। দু’-একটা মামুলি কথাবার্তা বলল। তারপর চুপ করে রইল।
বাইরে কলকাতা। আরও পুরনো আরও ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। যেন প্রাণপণে রুজ-পাউডার মেখে আছে এক বুড়ি ট্যাঁশ মেম! ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছে বাজার করার চটের থলে। মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে ট্রাফিকের সুন্দর হলুদ বাতিটি। বিধাতার মতো আত্মবিশ্বাসে হাত বাড়ায় মোড়ের পুলিশ। মতলববাজ মানুষের চোখ জোনাকি পোকার মতো জ্বলে উঠেই ভিড়ের মধ্যে নিবে যায়।
রমেন বাইরের দিকে চেয়ে ছিল।
ছেলেটা তার দিকে একটু ঝুঁকে বলল, আমার চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায়?
রমেন একটু নড়ল। তারপর তার স্বচ্ছ সুন্দর মুখখানা ফেরাল ছেলেটির দিকে। নরম গলায় বলল, চেহারায় মানুষের কর্মের কিছু কিছু ছাপ থাকে।
আমার আছে?
রমেন মাথা নাড়ল, আছে।
আছে। তবে আছে। অধৈর্য বিভু সিগারেট বাইরে ছুড়ে দেয়। তার চেহারায় ছাপ পড়ে গেছে। আসলে এ-সবের জন্য দায়ী একটি মেয়ে। মৃদুলা। দেখতে এমন কিছু সুন্দর ছিল না। রং ময়লা, গালে এক-আধটা ব্রণ, নাক ভোঁতা। তবু কী যে টান ছিল তার। বিভু কথা বলতে পারেনি কোনও দিন, তার বুক কাঁপত। সে বিয়ে করতে চেয়েছিল, মৃদুলার বাপ জাত দেখাল। তারপর সরিয়ে নিয়ে গেল মৃদুলাকে কোথায়! তার হাতের বাইরে। আক্রোশে বিভুর সমস্ত শরীর ঝিনঝিন করে, মাথায় রক্ত উঠে আসে ছল ছল করে। তার কাছে মানুষের মূল্য কমে যায়। পৃথিবীতে এত মেয়ে আছে, তার মধ্যে সে একজন সামান্য মৃদুলাকে চেয়েছিল— যার নাক ভোঁতা, গালে ব্রণ, রং ময়লা। সে ওই ব্রণগুলিতে আদরের হাত বুলিয়ে দিত, ঠোঁট ছোঁয়াত চাপা নাকটিতে, নিজের গায়ে মেখে নিত ওর ময়লা রং। কত কথা মৃদুলাকে বলবার জন্য মনে মনে তৈরি করেছিল সে, যখন একমাত্র মৃদুলাকে চায় সে, তখন একমাত্র সেই মৃদুলাকেই পাচার করে দেওয়া হল অন্য জায়গায়। সে জানে মাস দেড়েক আগে মৃদুলার বিয়ে হয়ে গেছে। তাকে পাত্তা দিল না মেয়েটা। ঠিক আছে। তবে এবার পাত্তা দাও বিভুকে, পৃথিবীর মানুষ। বুটের লাথি খেয়ে পাত্তা দাও, ছোরা খেয়ে ঢলে পড়তে পড়তে, আচমকা বোমা খেয়ে উড়ে যেতে যেতে…। দেখো হে, আমি বিভু—বিভু মাস্তান। বাপের সুপুত্র। কোথায় যাবে মৃদুলা? একদিন ঠিক দেখা হয়ে যাবে। বিভু জানে।
খ্যাপাটে চোখে বিভু তার দিকে তাকাল, কীসের ছাপ পড়েছে আমার চেহারায়?
হাত বাড়িয়ে রমেন তার হাতখানা ধরল। ম্লান মুখে বলল, আপনি তো জানেন।
বিভু হাত টেনে নেয়, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন? ওস্তাদের মতো বললেন জানি! কী জানেন আপনি? আপনি কি জ্যোতিষ?
রমেন মাথা নাড়ল, না।
তবে? বিভু বিহ্বলভাবে চারদিকে চায়। বলে, আপনি তবে কোথাও আমাকে দেখেছেন! কোথায়?
একটি কিংবা দু’টি খুন করার পর মানুষের চোখ স্থির হয়ে যায়। বাইরে থেকে দেখায় শান্ত, কিন্তু আসলে তা শান্ত নয়। তখন চোখের পাতার একটা গাঢ় ছায়া পড়ে মণিতে। রমেন তা জানে। কিন্তু কী করে তা বলবে রমেন, অত আন্দাজি কিছু বলা যায়!
রমেন একটু কাশল। তারপর ঘুরিয়ে দিল কথাটা, না, আপনাকে এর আগে কোথাও দেখিনি। তবে আপনার চেহারা দেখে মনে হয় সম্প্রতি আপনার কোনও আপনজন মারা গেছেন।
মুহূর্তে আত্মবিস্মৃত হয়ে যায় বিভু, হঠকারীর মতো বলে ফেলে, না, না, তারা কেউ আমার আপনজন ছিল না। আমি তাদের চিনতামই না।
রমেন বুঝতে পারে ছেলেটা প্রকৃতিস্থ নেই। সে ত্বরিতে ওর হাত নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে বলে, ঠিক আছে, আমি বুঝেছি। ইঙ্গিতে ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলে, ও শুনতে পাবে; চুপ করুন…
বিভু হকচকিয়ে চুপ করে যায়। তারপর চুপ করে থাকে।
রমেন ওর হাতে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর খুব মৃদু গলায় বলে, কে বলল যে, তারা আপনার আপনজন ছিল না?
আর কথাবার্তা তেমন কিছু হল না। বিভু সারাক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। আর ওর হাতখানা কোলে নিয়ে বসে রইল রমেন।
অনেক দিন আগে, রমেনের বয়স যখন দশ-এগারো, তখন যুদ্ধ চলছে। তাদের তিনটে বন্দুক তখন সরকারে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। তাই সেই বয়সেই তাড়াতাড়ি বন্দুক শেখানোর জন্য তাদের পুরনো চাকর উদ্ধব আর ড্রাইভার আশু তাকে নিয়ে গেল কেওটখালির মাঠে। দূরে রাখল তিনপায়া একটা ব্ল্যাক বোর্ড, তাতে দুটো বৃত্ত আঁকল, তারপর তার হাতে তুলে দিল কারুকার্যকরা ভারী বন্দুকখানা। বলল, মারো, মাঝখানের গোল্লাটায় মারো। রমেন মেরেছিল, ভীষণ শব্দে প্রথমবার হাত থেকে প্রায় ছিটকে গেল বন্দুকখানা, গুলিটা কোথাও লাগেনি, উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর কয়েক বারের চেষ্টাতেই সে ঠিক মাঝখানের বৃত্তটাকে ফুটো করে দিল। উদ্ধব বলল, আর জন্মে তুমি অর্জুন ছিলে। তারপর বন্দুক চালানো নেশার মতো পেয়ে বসল তাকে। উদ্ধব দ্রোণাচার্যের মতো বোর্ডে পাখি এঁকে চোখ বসিয়ে বলত, চোখে মারো তো। রমেন মারত। যখন এই ভীষণ নেশা তাকে প্রতি দিন বিকেল বেলা ঘর ছেড়ে বন্দুক হাতে বেরোনোর জন্য অস্থির করে তুলত, সেই সময়ে একদিন বন্দুকগুলো জমা পড়ে গেল। সন্ধেবেলা ভীষণ দুঃখে দাদুর ইজিচেয়ারের পাশে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল রমেন, দাদু তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এ তো ভালই হল। এর পরে একদিন তোমাকে দেখলে অবোধ জন্তুরা ভয় পেত। রমেন বোঝেনি। অনেকক্ষণ পর একসময়ে দাদু মৃদু স্বরে আপনমনে বলল, তুমিই আমার অস্ত্র।
সে-কথাটার অর্থ রমেন এখন খানিকটা বোঝে। এই অচেনা ছেলেটা তার পাশে বসে আছে, এর ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে হয়তো রয়েছে হাতে-বাঁধা বোমা, তলপেটের কাছে লুকানো ছোরা—তবু কত নিরস্ত্র, অসহায় দেখাচ্ছে একে। এ জানে না অস্ত্রের ব্যবহার, কিংবা প্রকৃত অস্ত্র কাকে বলে। একদিন এ নিজের হাতে মারা যাবে।
রমেন বড় মায়ায় ছেলেটির হাতে হাত বুলোয়।
যাদবপুরের কাছে ট্যাক্সি থেকে নেমে জানালা দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল রমেন, আবার কোনও দিন দেখা হয়ে যাবে। আচ্ছা ভাই…
আচ্ছা… ছেলেটা হাত তুলল।
ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিল ট্যাক্সিওয়ালা।
রমেন একা একটু হাসে। মানুষের কাছ থেকে মানুষের কাছে, ক্রমে আরওতর মানুষের কাছে চলেছে সে। এইভাবেই দিন কাটে তার।
যাদবপুরের কিছুই আর চেনা যায় না। যখন প্রথম এখানে প্রজারা বসত নিয়েছিল, তখন মাঝে মধ্যে আসত রমেন। দুপুরেও ঝিঁঝির শব্দ শোনা যেত। শোনা যেত মাটি কাটার শব্দ। জমির দখল নিয়ে লাগত কাজিয়া, লাঠি সড়কি বেরোত। ঝগড়া লাগত কমিটিতে কমিটিতে। ফড়ে আর দালালদের গতায়াত ছিল খুব। উচ্ছেদের হুমকি দিতে আসত দারোগা। তখন সারা দিন প্রজাদের কাছে কাছে থাকত রমেন। সঙ্গে থাকত উদ্ধব আর লব। তাদের হাতে লাঠি। বাইরের হাঙ্গামার জন্য তারা ছিল, রমেন দেখত জমির বন্টন। যাদবপুর থেকে পুঁটিয়ারি, বারাসাত, দমদম, হাবড়া, কখনও বা সুন্দরবনের দিকে ঘুরে ঘুরে সে বেরিয়েছে। নতুন জায়গায় এসে দিশেহারা প্রজারা তাকে দেখে বল-ভরসা পেয়েছে আবার। কখনও কখনও জিপ গাড়িতে নিশান উড়িয়ে কাজ দেখাতে আসত পার্টির লোক, জমির লোভ দেখিয়ে ঘুষ চাইত কমিটির মেম্বার, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠত কো-অপারেটিভ সোসাইটি। রমেন তার প্রজাদের আড়াল দিয়ে দাঁড়াত।
এখনকার আলো ঝলমলে যাদবপুর দেখে খুশি হয় রমেন। গায়ে গায়ে দোকান, ট্যাক্সির স্ট্যান্ড, কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়। একটু অচেনা লাগে তার। কিন্তু চেনা রাস্তা খুব কমই হেঁটেছে সে জীবনে।
রিকশাওয়ালা ক্রিং করে বেলের শব্দ করে বলে, যাবেন বাবু—
রমেন সুন্দর শান্ত হাসি হেসে বলে, না ভাই।
রেল লাইন পেরিয়েও অনেকটা হাঁটতে হল রমেনকে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করতে হল। কলোনির একদম শেষ দিকে উদ্ধৰ জমি নিয়ে ঘর করেছিল, সেটা রমেনের মনে আছে। কিন্তু এখন আর কলোনির কোনও শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। রেল লাইনটা এক দিকে আটকে রেখেছে, অন্য আর সবদিকে বাড়ির পর বাড়ি। সব প্রাকৃতিক দৃশ্য মুছে গেছে।
উদ্ধবের ছোট মেয়েটি কুপি উঁচু করে ধরে আগলের ও-পার থেকে জিজ্ঞেস করে, কে?
উদ্ধবের বাড়ি এটা?
অন্ধকারে, কুপির আলোর আবছায়ায় প্রকাণ্ড লম্বা লোকটিকে অবাক আর ভিতু চোখে দেখে শিশু মেয়েটি। তারপর ফিরে গিয়ে মাকে ডেকে আনে।
ঘোমটা টেনে উদ্ধবের বউ সামনে আসে, কাকে চান?
উদ্ধব কি বাড়িতে নেই!
না। ফিরতে তিনির রাত হয়। আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বউটি ঠিক বুঝতে পারে না।
রমেন একটু ইতস্তত করে বহুদিনকার পুরনো ভুলে-যাওয়া এক নাম বলে, রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
অমনি চঞ্চল হয়ে ওঠে বউটি। কী করবে বুঝতে পারে না। প্রথমেই তার মুখ দিয়ে বেরোয়, ওঃ মা!
আগল খুলে হাট করে দেয় বউটি। অভ্যর্থনার কোনও ভাষা মুখ দিয়ে বেরোয় না। মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে প্রণাম করে। এ যে বুড়োকর্তার নাতির নাম! এ নাম যে তার শিশুবয়সের সংস্কার!
পর দিন সকালে উদ্ধবের উঠোন ভরে যায় মানুষে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ টাকা রেখে প্রণাম করে। দেখে অনেক দিন আগেকার কথা মনে পড়ে যায় বলে রমেন হাসে। টাকা ফিরিয়ে দেয়। বলে, চিরকাল তোমরা আমাকে অনেক দিয়েছ। এবার বলো তোমাদের আমি কী দিতে পারি?
উদ্ধব চেঁচিয়ে বলে, তুমি আমাদের কাছে থাকো। আমরা সবাই মিলে তোমাকে বসত করে দেব, বিয়ে দেব, সংসারী করব। তার বদলে তুমি আমাদের দেখবে, যেমন বুড়ো কর্তা দেখত।
কিন্তু এক জায়গায় থাকে না রমেন। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গা। বাইরে থেকে শান্ত দেখায় তাকে। কিন্তু তার ভিতরে ভিতরে এক তীব্র আনন্দময় উত্তেজনা থরথর করে কাঁপে।
অনন্ত মণ্ডলের বাড়ি পশ্চিম পুঁটিয়ারি। তার নেশা জমি। দেশে থাকতে চাষ করত, এখন আর তা করে না, কিন্তু জমিরই ব্যবসা তার। কোনও কোনও জায়গা, দেখলেই সে বুঝতে পারে যে এখানে একদিন বসত হবে। অমনি এক লপ্তে জমি কেনে, মাটি ফেলে উঁচু করে, তার দিয়ে ঘিরে ফেলে রাখে। দু’-তিন বছরের মধ্যেই বিঘার দর কাঠার দরের নীচে চলে যায়। ঘোড়েল দু’খানা চোখ অনন্তর, জমি তার চোখে চোখে কথা বলে। এখন তার ঘরে ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বলে, রেডিয়োর আওয়াজ হয়, বাগানে ফুটে থাকে রজনীগন্ধা। তার দুটো বউ আজকাল ঝগড়া কাজিয়া কম করে। ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে যায়।
ছোটকর্তার লম্বা চেহারাখানা তার বারান্দায় সকালের রোদে ছায়া ফেলতেই চমকে ওঠে অনন্ত, পাগলের মতো দু’ হাত ওপরে তুলে চেঁচায়, ছোটকর্তা না? আাঁ?
রমেন দেশি সুরে কথা বলে, অনন্ত কেমন?
মুহূর্তে তুলকালাম কাণ্ড করতে থাকে অনন্ত। দুই বউকে টেনে নিয়ে আসে, নড়া ধরে আনে ছানাপোনাদের, রমেনের পায়ের কাছে ফেলে আর চেঁচায়, ভগবান, ভগবান!
ছেলেপুলেরা এখন বুঝতে শিখেছে। তারা ব্যাপারটা পছন্দ করে না। দেশ ভাগের সময়ে হয় তারা শিশু ছিল, নয়তো জন্মায়নি। কাজেই একটা অচেনা লোককে নিয়ে বাবার লাফালাফি তাদের আত্মসম্মানে ঘা দেয়। কিন্তু দুই বউ পায়ে লুটিয়ে পড়ে, তাদের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রমেন হাত জোড় করে চোখ বুজে তাদের প্রণাম নেয়।
রমেন বারান্দায় থামে ঠেস দিয়ে বসে। তাকে ঘিরে বসে অনন্ত, দুই বউ, আর শিশু ছেলেমেয়েরা। তদগতভাবে চেয়ে থাকে অনন্ত, আপনমনে হাসে, চোখ মোছে।
অনন্তর বড় ছেলে পার্টি করে, সে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করতেই অনন্ত ঝাঁকি মেরে ওঠে, পায়ে হাত দে। রমেন উঠে দু’ হাতে ছেলেটিকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, ঠিক আছে, ও-ই যথেষ্ট।
সবাই গোল হয়ে বসে রমেনের গল্প শোনে। বড়রা সবাই দেখেছে ছোটকর্তাকে গাড়ি চালাতে, বন্দুক ছুড়তে। কিন্তু এখন এ কী চেহারা ছোটকর্তার? তাদের চোখ ছল ছল করে।
আপনাদের কাছে কত সুখে ছিলাম, ছোটকর্তা!
রমেন হাসে, কেন সুখে ছিলে?
আপনারা ছিলেন আমাদের আপনজন, যেন আত্মীয়।
রমেন একটু চুপ করে থেকে বলে, কিন্তু এখন তো আমি ভিক্ষুক।
অনন্ত সোজা হয়ে বসে, কী কন ছোটকর্তা! আমরা আছি না? কীসের অভাব আপনার, বলেন!
রমেনের মনে আছে অনেক দিন আগে তার পৈতের সময়ে দণ্ডী ঘরে যাওয়ার আগে গায়ে গেরুয়া উত্তরীয়, হাতে দণ্ড আর ঝোলা, কামানো মাথা—এই রকম চেহারায় সে সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর কাছে তার গেরুয়া ঝোলা বাড়িয়ে ধরে ভিক্ষে করছে, ভবতি ভিক্ষাং দেহি। ভবান্ ভিক্ষাং দেহি। সঙ্গে তার কাঁধে হাত রেখে দাদু আর কুলপুরোহিত সতীশ ভরদ্বাজ। ভদ্রজনের কাছে ভিক্ষা চাওয়া শেষ হলে দাদু তার হাত ধরে বাইরের উঠোনে নামিয়ে আনল। সেখানে হাজার প্রজা দাঁড়িয়ে। সে ঝোলা সামনে বাড়িয়ে ‘ভিক্ষাং দেহি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কী চঞ্চলতা পড়ে গেল সেই সহস্র লোকের মধ্যে। যেন বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল মানুষের ভিতরে। তারা আশা করেনি ছোটকর্তা ভিক্ষে চাইবে তাদের কাছেও। মুহূর্তে ঠেলাঠেলি পড়ে যায়। তাদের হাত কঁপে, মুখে উত্তেজনার চাপা উজ্জ্বলতা। তারা যে যা এনেছিল সব ঢেলে দেয় রমেনের ঝোলায়। তারা ছোট্ট রমেনের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে, চেঁচিয়ে ডাকে, কাছে আসতে চায়, দাদু কানের কাছে গুনগুন করে বলে, বলো, ভবান্ ভিক্ষাং দেহি, বলো চেঁচিয়ে, বলো অন্তর থেকে। ছোট্ট রমেন চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ভিক্ষা দাও, আমাকে ভিক্ষা দাও। আবেগে তার গলা কাঁপে, চোখে জল আসে। ঝোলার ভারে কাঁধ ছিঁড়ে পড়ে, তাই টেনে টেনে রমেন হাঁটে, ভিক্ষে চায়। মানুষ ঘিরে ধরে তাকে। চোখের জল মুছে ভিক্ষে দেয়। রমেনের আর খেয়াল থাকে না সে কী করছে, কিংবা সে আসলে কে। তার বিমুগ্ধ মন কেবল ভাবে যে সে এক মহান ভিক্ষুক। নেশার মতো ওই ভিক্ষাবৃত্তি তাকে টেনে নিয়ে যায়, সে ফিরে আসতে পারে না। আর ফিরে আসার দরকারই বা কী! সে কখন যেন ভিক্ষে চাইতে চাইতে দেউড়ি পার হয়, লাল ধুলোর রাস্তায় পড়ে। দু’ধারে জয়ধ্বনির মতো চেঁচিয়ে ওঠে মানুষ, তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
দেউড়ি পার হতেই কে যেন তার হাত ধরেছিল। ব্যস আর না, এবার ফিরে এসো। ছোট্ট রমেন অভিভূত চোখে চেয়ে ছিল। কোথায় ফিরবে সে? কেন ফিরবে?
আজ রমেন জানে, তারা যে সৎ জমিদার সেটা প্রমাণ করার জন্যই যে দাদু প্রজাদের কাছে তাকে দিয়ে ভিক্ষে করিয়েছিল তা নয়। দাদুর অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় দণ্ডীঘরে এসে তাকে আহ্নিক করার পদ্ধতি শেখাবার পর দাদু বলেছিল, রমেন, ব্ৰহ্ম মানে বিস্তার। ব্রাহ্মণ তাই তার ক্ষুদ্র বাড়িতে বা সংসারে আবদ্ধ থাকেন না। তুমি যদি ব্রাহ্মণ তবে যেন একদিন সেই বিস্তার লাভ কোরো। আজ দরদালান থেকে ভিক্ষে করতে করতে তুমি দেউড়ি পার হয়ে গিয়েছিলে, ভিক্ষে চাওয়ার সময়ে তুমি কাঁদছিলে, কেন বলো তো? কারণ, ওই একটুতেই তুমি টের পেয়েছিলে বিস্তার কাকে বলে।
দাদু এসে দিনের অনেকটা সময় থাকত তার আবছা অন্ধকারে দণ্ডী ঘরে। বলত, তুমি মনেও কোরো না যে তুমি জমিদারের ছেলে বলে লোকে তোমাকে ভিক্ষা দিয়ে কেঁদেছে। তা নয়। আসলে তারা কেঁদেছে সেই ব্রাহ্মণের জন্য যে একদিন ভারতবর্ষকে ধর্ম দান করেছিল। শিখিয়েছিল কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়, কীভাবে বেড়ে উঠতে হয়। তারা ভিক্ষার ছলে ছলে যেত মানুষের কাছাকাছি, তাদের দাওয়ায় বসত, দুঃখের কথা শুনত, ভাগীদার হত তার মনের। এইরকম করেছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও। তারা যাজনে ছেয়ে ফেলেছিল দেশ, ভিক্ষার ছলে ছলে তারা ভারতবর্ষের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল বুদ্ধের বাণী। মনে রেখো, ভিক্ষুকের পাত্র থেকে শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষের বিপ্লব। কারণ ভিক্ষা থেকেই এসেছিল জন-সংযোগ, জন-জাগরণ। মানুষের পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া। ভিক্ষুকরাই তা করেছিল।
তারপর দাদু অনেকক্ষণ ভেবে বলেছিল, কিন্তু আমি তোমাকে ভিক্ষে করতে বলতে পারি না। খামোখা তুমি ভিক্ষে করবে কেন? কিন্তু যদি তাঁর দেখা পাও, যিনি তোমাকে অন্ধ করে দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন তোমার বল, তারপর আবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যদি তাঁকে কোনও দিন পাও, আর তিনি যদি তোমাকে ভিক্ষা করতে পাঠান তবে প্রসন্ন মনে তা কোরো। কিন্তু তুমি কি তাকে কোনও দিন খুঁজবে রমেন?
দাদু চুপ করে অন্যমনস্ক থেকেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, দুঃখে কাতর মানুষই কেবল তাঁর অনুসন্ধান করে। রমেন আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি তোমার জীবনে যেন দুঃখ তাড়াতাড়ি আসে।
অনন্ত আর তার ছেলে, বউয়ের কাছে সেই সব গল্প করছিল রমেন।
হঠাৎ চোখ মুছে অনন্ত বলে, হ্যাঁ, মনে আছে কর্তা, কী সুন্দর আছিল আপনার ব্রহ্মচারীর পোশাক। আমি ভিক্ষা দিছিলাম। আঙুল থিক্যা খুইল্যা দিছিলাম রুপার আংটি আর কোমরের কষি থিক্যা দুইটা টাকা। আইজ আমি আরও বেশি দিতে পারি। বলেন কী চাই!
আমি তোমারে কী দিচ্ছি?
এই তো দিলেন! এই যে আসলেন অধমের বাড়িতে, চোখ জুড়াইয়া গেল।
রমেন মাথা নাড়ে, হাসে। বলে, আবার আসুম হে, আবার—
অনন্তর বড় ছেলে, একুশ কি বাইশ বছর বয়স, রমেনের পিছু নিয়ে রাস্তায় আসে। চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে, আপনি কি তাঁকে পেয়েছিলেন?
সতীশ ভরদ্বাজ, সেই কালো বেঁটে তেজি ব্রাহ্মণ, এখন শয্যাগত। ছেলেদের সঙ্গে বনিবনা হয়নি, তারা আলাদা থাকে, সামান্য কিছু দেয়। দুই মেয়ের একজন প্রেম করে বিয়ে করেছে, অন্যজন বিধবা, শ্বশুরবাড়িতে আঁকড়ে পড়ে আছে।
বুকচাপা, অন্ধকার, ভ্যাপসা টিনের ঘরটায় রমেন ঢুকে দেখে বিছানায় একখানা ছায়া পড়ে আছে। দু’খানা চোখ জ্বলজ্বল করে প্রত্যাশায়।
কষ্টে উঠে বসে সতীশ ভরদ্বাজ। বলে, আমার বুড়িটার কপালে তখনও সিন্দূর—বুঝলা? বসো হে, তোমারও তো সব গেছে!
রমেন পায়ের দিকটায় বসে। সতীশ ভরদ্বাজ, সেই অহংকারী তেজি লোকটা, আক্ষেপ করে, আমি তো সদ্ব্রাহ্মণ, তবে ক্যান আমার এই অকাল মৃত্যু? ক্যান আমার বংশে অনাচার, অলক্ষ্মী? ইষ্ট কই?
বুড়ি একটা মোড়া পেতে সামনে বসে। গোদা পা দু’খানা দেখলেই বোঝা যায় শরীরে জল এসেছে। সিঁদুরের তলায় সিঁথিতে ঘা দেখা যায়। কপাল চাপড়ায় বুড়ি, সব গেল গিয়া।
কিছুই যায়নি। শতগুণে ফিরে আসছে সব। আর কয়েকটা দিন মানুষ তার সম্পূর্ণ ভুলগুলো বুঝে নিতে যতটা সময় নেবে, তারপরই বিপ্লবী ব্রাহ্মণ ভিক্ষুকে ছেয়ে যাবে দেশ। জীবন বৃদ্ধির ধর্ম দান করে বেড়াবে মানুষকে। তেমন ভিখারিকে সর্বস্ব দেওয়ার জন্য ছুটবে মানুষ।
রমেনের শান্ত তৃপ্ত মুখখানা দেখে হঠাৎ যেন সতীশ ভরদ্বাজ কেমন একটু আশান্বিত হয়ে ওঠে। সর্বস্বই কি গেছে ছেলেটার? না কি আবার কিছু পেয়েছে!
ঘর অন্ধকার করে সন্ধেবেলায় শুয়ে ছিল রমণীমোহন। পুত্রশোক দু’টি গেছে পর পর। আগে নদীর তলা থেকে এক ডুবে খামচি দিয়ে মাটি তুলে আনত, এখন হাঁপানিতে হাঁফায় সারা দিন। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে। কীরকম উদ্দন্ত কীর্তন করত রমণী তা আর এখন কারও মনে নেই। বিধবার সম্পত্তি, গ্রাস করে করেছে ছোট্ট বাড়িখানা, তারপর থেকে পাপবোধে ভুগছে।
কই হে, রমণী।
ছোটকর্তার গলা না? রমণী চমকে ওঠে। তারপরেই বুঝতে পারে ওটা ভুল। কর্তারা কোথায় চলে গেছে! কে জানে বেঁচে আছে কি না! রমণী পাশ ফিরে শোয়।
কে যেন হাত ধরে তাকে তুলে বসায়। আবছা অন্ধকারে মুখোমুখি ছোটকর্তার মুখ। যেন ঘুম ভাঙার পরে স্বপ্ন।
রমেন চলতে চলতে মাঝে মাঝে দাঁড়ায়। চারদিকের আবহাওয়ায় কিছু একটা অনুভব করতে চেষ্টা করে। প্রতি জনপদেরই একটা বিশিষ্টতা আছে। অনেক মানুষ এক জায়গায় বসবাস করতে করতে কিছুটা একে অন্যের মতো হয়ে যায়। তাদের যৌথ চিন্তার বিকিরণ সেই জায়গার আবহাওয়াকে সম্মোহিত করে রাখে। কখনও রমেন মফস্সলের কোনও ছোট্ট শহরে পা দিয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়েছে, এ-জায়গা অর্থলিপ্সুদের অধিকারে। প্রায় সময়েই দেখা গেছে যে তার ভুল হয়নি।
মানুষের চারধারে জ্যোতির্বলয় নেই। না থাক, কিন্তু তার অস্তিত্বের একটা বলয় সে তার চারধারে নিয়ে বেড়ায়। সেটা হয়তো তার গায়ের উত্তাপ, রক্তের স্পন্দন, গায়ের বিশেষ গন্ধ। দেহ সবসময়েই বিকিরণ করছে তার অস্তিত্বের সংবাদ। ঠিক সে-রকম, মানুষ তার সারা জীবনের যা কিছু কাজ তার স্বভাব এবং চিন্তারও একটি বলয় তৈরি করে নিজের অজান্তে। একে অন্যের বলয়ের মধ্যে এসে কী একটা টের পায়, কিন্তু সঠিক বোঝে না। তার নিজের অস্তিত্ব তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে বলেই সে অন্যকে সঠিক চিনতে পারে না।
কিন্তু রমেন পারে। সে স্পষ্টতই মানুষের চারধারে সেই বিশেষ বলয়টিকে অনুভব করে। যত মানুষ তার কাছাকাছি আসে, রাস্তায় মুখোমুখি এসে পেরিয়ে যায়। কিংবা রেলগাড়িতে বসে থাকে মুখোমুখি, তাদের প্রত্যেককেই বুভুক্ষু ভালবাসায় লক্ষ করে রমেন। সবসময়েই সে মানুষের সেই বলয়টির নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করে।
মানুষেরা জোটবদ্ধ হয়, হতে থাকে তার চারপাশে। প্রজারা পাড়ার প্রতিবেশীদের ডেকে আনে ছোটকর্তাকে দেখাবার জন্য। রমেন তাদের কাছাকাছি যায়, দাওয়ায় বসে, বহু দূর হেঁটে যায় একসঙ্গে। মানুষ সংগ্রহ করতে থাকে সে, সংগ্রহ করতে থাকে মানুষের সর্বস্ব। একদিন এই বিপুল ভিক্ষা সে নিয়ে যাবে তাঁর কাছে, যিনি একদিন তাঁকে নিশির ডাকের মতো ডেকে নিয়েছিলেন।
ভাদ্রের শেষ এখন। বাংলাদেশের প্রকৃতি সেজে উঠেছে এই সময়ে। অনেক দূর দেশের পাখি আর বাতাস আর সুন্দর পালের নৌকোর মতো মেঘ আসে। গত বর্ষার স্মৃতি মানুষ ভুলে যায়। ঠিক ওই পাখি বা মেঘের মতোই নূতন একটি জিনিস দেখতে পায় লোক—পুটিয়ারি, বারাসাত, চব্বিশ পরগনা, হুগলিতে। তারা দেখে গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় রমেনকে। সঙ্গে তার দুঃখী মানুষেরা। লোকটাকে দেখলেই বড় ভাল লাগে মানুষের, এক পলকের জন্য সংসারের সুখ-দুঃখের কথা ভুল পড়ে যায়। মানুষের মাথার চারদিকে জ্যোতির্বলয় নেই— এ তো ঠিক কথাই। কিন্তু কাউকে কাউকে দেখলে মনে হয়, এর মাথার চারদিকে ও-রকম অদৃশ্য কিছু একটা রয়েছে।
কীভাবে সেই বিপ্লব শুরু হবে তা মাঝে মাঝে ভাবে রমেন। কেবলই মনে হয় পারাপার জুড়ে শুয়ে আছে কর্ষিত ভূমি। তার হাতে বীজ।
ছাব্বিশ
রমেনের জীবনে দুঃখ তাড়াতাড়ি এসেছিল, যেমন ছিল তার দাদুর আশীর্বাদ।
মাঝে মাঝে একটা বুড়ো ময়ূর আর একটা পুরনো মোটর গাড়ির কথা রমেনের মনে পড়ে। তাদের বারবাড়ির উঠোন ছিল কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু। সেই সবুজ ঢালু মাঠে ধূসর রঙের ময়ুরটা এক বোঝা পেখম টেনে আস্তে আস্তে চরে বেড়াচ্ছে। কিংবা লজঝড়ে, পুরনো, ক্যাম্বিসের হুডওয়ালা তাদের গাড়িটা বৃষ্টির দিনে পাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভিজছে। কখনও বা মনে পড়ে, প্রকাণ্ড ভাঙা পিয়ানোর ওপর ধুলোর আস্তরণ, তার ওপর আঙুল দিয়ে রমেন তার নাম লিখছে, রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। কিংবা মনে পড়ে, তাদের ভূতগ্রস্ত, প্রকাণ্ড বাড়িটার পশ্চিমের ভিতের কাছে একটা আতসকাচ হাতে দাদু বসে আছে। চোখাচোখি হলে দাদু হেসে বলতেন, দেখো রমেন, পিঁপড়ে কেমন মাটি তুলেছে! তারপর চিন্তিতমুখে মাথা নেড়ে বলতেন তিনি, দেখো, পশ্চিমের ভিত থেকেই বাড়িটার ভাঙন শুরু হবে। এই দিক থেকেই বাড়িটা গাঁথা শুরু হয়েছিল, আমার মনে আছে।
রমেন অবাক হয়ে বলেছে, সে তো একশো বছর আগেকার কথা! তুমি তখন কোথায়?
তখন দাদু বিব্রত মুখে আতসকাচখানা রেখে দু’হাতে চোখ মুছে নিয়েছেন। অপ্রতিভ হাসিমুখে বলেছেন, আমার মনে হয় আমি তখনও ছিলাম। এইখানেই। আমি দেখেছি এ-বাড়ির ভিত গাঁথা হতে।
কী করে?
পশ্চিমের নির্জন চত্বরে তারা দু’জন— রমেন আর তার প্রায়-অন্ধ দাদু দু’টি শিশুর মতো বসেছে পা ঝুলিয়ে। দাদু বলছে, তখন আমি আসতাম ব্রহ্মপুত্রের ও-পার থেকে, নৌকোয় পার হয়ে। আমার ছিল মাটিমজুরের কাজ। এখন যেখানে মুকুন্দর মাটি ফেলেছি এই ভিত গাঁথার সময়ে—এ-রকম আমার মনে পড়ে। তখন মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হত যে, এইখানে যে বড় বাড়িটা একদিন তৈরি হবে আমি যেন সেই বাড়িতে একদিন জন্মাই।
সত্যি? রমেন ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করেছে।
দাদু হেসে বলেছেন, কী জানি! আমার এ-রকম মনে হয়।
দাদুর চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলে রমেন তাঁকে হাত ধরে নিয়ে যেত পুবের দালানের বারান্দায়, খুব ভোরবেলা সূর্য প্রণাম করতে। কখনও নিয়ে যেত ছাদে, সন্ধেবেলায় খোলা আকাশের নীচে। দাদু কখনও ক্কচিৎ চারদিকের পরিদৃশ্যমান জগতের কথা তার কাছে জানতে চাইতেন। কিন্তু দাদুকে অন্ধ বলে কখনও মনে হত না রমেনের। বরং মনে হত খুব গভীর ধ্যানস্থ মানুষটি চারপাশের দৃশ্যমানতার অনেক গভীরে ডুবে আছেন তাই তাঁর অন্যমনস্ক হাত তামাকের নলটা খুঁজে পাচ্ছে না।
একদিন সন্ধেবেলা দাদু হাতড়ে তার মাথাটা খুঁজে নিয়ে ডান হাতখানা মাথায় রেখে জিজ্ঞেস করলেন, রমেন, খুব ছেলেবেলার কোনও কথা তোমার মনে পড়ে?
রমেনের বয়স তখন বারো কি তেরো। সে একটু ভেবে বলল, পড়ে।
কী রকম?
রমেনের মনে পড়েছিল তার বাবার মৃত্যুর কথা। বয়ড়ার আবাদ থেকে ফেরার পথে ঘোড়াসুদ্ধ বাবাকে ধরেছিল কানাওলায়। বড় হয়ে রমেন জেনেছে কানাওলা আসলে ভূত নয়, এক ধরনের আবল্যি, মানুষের বোধবুদ্ধি কিছুক্ষণের জন্য নষ্ট করে দেয়। বয়ড়া থেকে ফেরার পথে কালীজয়দের বৈঠকখানায় কিছুক্ষণ পাশা খেলে রাতে ফিরছিল বাবা। ঘোড়া ছুটেছিল, কিন্তু কোথাও পৌঁছুতে পারছিল না। তখন যুদ্ধের সময় মাঠে মাঠে কাটা হয়েছে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ ট্রেঞ্চ, রাস্তার আলো নেই। ঘোড়া রাস্তা চিনত। ক্ষীণদৃষ্টি বাবা ঘোড়ার ভরসায় সওয়ার হয়ে বসে ছিল, কোনও দিকে ঘোড়াকে চালানোর চেষ্টা করেনি। কিন্তু ঘোড়াটা রাস্তা ঠিক করতে পারছিল না। তাকে ধরেছিল কানাওলা। কেউ কেউ দেখেছে মেজোকৰ্তার ঘোড়া সে-রাতে বড় রাস্তা ছেড়ে কেওটখালির মাঠে নেমে যাচ্ছে। তারা চিৎকার করে ডেকেছে বাবাকে। দূর মাঠ থেকে বাবা উত্তর দিয়েছে। কিন্তু অন্ধকারে তাকে আর দেখা যায়নি। বাবা চেঁচিয়ে বলেছিল যে রাস্তা ঠিক করতে পারছে না। যারা দেখেছিল মেজোকর্তাকে তাদের কেউ এসে খবর দিয়েছিল বাড়িতে। মুহূর্তে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল, কানাওলা কানাওলা। রমেনের মনে পড়ে, সে তখন খুব ছোট, কাছারি বাড়ির উঁচু বারান্দায় উদ্ধবের হাত ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে ব্রহ্মপুত্রের ঢালু পার দিয়ে মুকুন্দের ঘানিঘরের পিছনের মাঠ দিয়ে অনেক হ্যারিকেন দুলতে দুলতে যাচ্ছে বাবাকে খুঁজে বের করতে। বিশাল চরাচর জুড়ে অন্ধকারে অসহায় টিমটিমে হ্যারিকেনগুলো চলে যাচ্ছে দূরে। দূরাগত মানুষের কণ্ঠস্বর হাহাকারের মতো ডাকছে, মেজোকর্তা—আ—। বাবাকে পাওয়া গিয়েছিল একটি অগভীর ট্রেঞ্চের মধ্যে, ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেঞ্চের ধারে। বাবার মৃতদেহ কীরকম দেখেছিল তা রমেনের মনে নেই, কিন্তু মনে আছে পরদিন সকালবেলায় সে দেখেছিল সেই অপরাধী ঘোড়াটাকে, সকালের আলোয় যখন তাকে বাইরের উঠোনে হাঁটিয়ে আনা হল। কী লজ্জিত বিমর্ষ ছিল তার চলার ভঙ্গি।
দাদুকে সে সেই ঘটনার কথা বলতেই দাদু তামাকের নল টেনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তখন তোমার বয়স পাঁচ কি ছয়। ও-বয়সের অনেক কথাই মানুষের মনে থাকে। তোমার আরও ছেলেবেলার কথা মনে নেই!
রামেন আবার ভেবেছিল।
তখন সে কত ছোট কে জানে, তবে একবার অনেক ছোট বয়সে, তার মনে পড়েছিল ভীষণ জ্বরের ঘোরে সে শুয়ে আছে। চারপাশটা আবছা দেখাচ্ছিল। কেউ একজন তার জিবের তলায় থার্মোমিটার গুঁজে দিয়েছিল, আর সে কড়মড় করে চিবিয়ে ফেলেছিল সেটা। তারপর তাকে উপুড় করে বমি করানো হয়েছিল।
সেই ঘটনার কথা শুনে দাদু প্রসন্ন হাসলেন, হ্যাঁ, তখন তোমার বয়স তিন। বাঃ রমেন, তোমার স্মৃতিশক্তি সুন্দর। কিন্তু আরও ছেলেবেলার কথা তোমার মনে পড়ে কি?
এরপর রমেনকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়েছিল। আরও ছেলেবেলা! আরও ছোট বয়সের কথা!
তারপর তার হঠাৎ মনে পড়েছিল খুব ছেলেবেলায় হয়তো স্মৃতি, হয়তো বা কল্পনা, কিন্তু বহুদিন আগে সে যেন তার মায়ের হাতে একটা নীল রঙের কেটলি দেখেছিল।
শুনে দাদু নড়ে-চড়ে বসলেন। তামাকের নল নামিয়ে রেখে উত্তেজিত গলায় বললেন, তোমার দু’ বছর বয়সে সেই কেটলিটা ভেঙে যায়। কিন্তু সেটা কল্পনা নয়, সত্যিই একটা নীল রঙের কেটলি আমাদের ছিল রমেন, তোমার ভুল হয়নি। কিন্তু তুমি আর-একটু চেষ্টা করো, দেখো তো আরও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে কি না!
রামেন আবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে, হাত শক্ত মুঠো করে। সে দেখতে পেয়েছিল সেই ছেলেবেলা যেন এক কুয়াশার জগৎ, আবছায়ার মায়ারাজ্য। কিছুই মনে পড়ে না, কিন্তু কেমন যেন আভাস পাওয়া যায়।
দাদু উগ্র আগ্রহে তার মুখের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। জিজ্ঞেস করছিলেন, মনে পড়ে না রমেন। কিছুই মনে পড়ে না?
রমেন মাথা নেড়ে হেসে বলল, না।
খুব তুচ্ছ সামান্য কিছুও না?
রমেন বলল, না তো।
দাদু মৃদু হাসলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি আজকাল এই খেলাটা খেলি। এই মনে পড়ার খেলা।
তোমার কত ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে?
দাদু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, অনেক দূর পর্যন্ত মনে পড়ে।
কত দূর।
দাদু একটু দ্বিধা করলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, অনেক দূর। রমেন, মানুষ চেষ্টা করলে জন্ম-মুহূর্তটিও মনে করতে পারে।
তোমার মনে আছে?
দাদু হেসে চুপ করে রইলেন।
কেমন ছিল তোমার জন্ম-মুহূর্ত?
দাদু ধীর গম্ভীর গলায় বললেন, অন্য রকম। সেই মুহূর্তটি অন্য সব দিনের মতো নয়।
শুনে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল রমেনের।
তবু বলো।
দাদু মাথা নেড়ে বললেন, বললে তুমি ঠিক বুঝবে না রমেন, কিন্তু তুমি নিজে কোনও দিন সেই মুহূর্তটির কথা মনে করার চেষ্টা কোরো। তুমি নিরন্তর স্মৃতিব্যক্ত থেকো, তা হলে কোনও দিন না কোনও দিন তোমার ঠিক মনে পড়বে। তোমার মন যদি স্বচ্ছ থাকে, যদি তুমি কখনও পাপবোধে কষ্ট না পাও, যদি তোমার মন কখনও কারও অনিষ্টচিন্তা না করে, যদি তুমি অসদাচরণ না করো, তা হলে সেই পবিত্র মুহূর্তটি একদিন ঠিক তোমার কাছে ধরা পড়বে।
বহুকাল ধরে সেই চেষ্টা করেছিল রমেন। বহু বার। যখন নদীতে সাঁতার দিত, বল নিয়ে দৌড়ত, গান গাইত, কিংবা চালাত মোটর গাড়ি, যখন একা থাকত কিংবা ঘর অন্ধকার করে বসত মাঝে মাঝে তখন কত বার এই খেলা খেলেছে রমেন। তারপর আপনমনে হেসে উঠেছে। কখনও তার ফাঁকা মাথার ভিতর দিয়ে গড়িয়ে গেছে ছেলেবেলায় হারানো তিনটে মার্বেল, মনে পড়েছে ছেলেবেলায় কিশোরীদের প্রিয় মুখগুলি যাদের সঙ্গে ফের দেখা হয়নি।
তার বাবার নামে দাদু একটা স্কুল খুলেছিলেন ব্রহ্মপুত্রের ধার ঘেঁষে। নরেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল স্কুল। সেই স্কুলের বেয়ারার চাকরির জন্য দাদুর পায়ে এসে পড়ল একটা জাত-ভিখিরি। সঙ্গে কালো একটা রোগা বউ, রোগা রোগা গোটা দুই ছেলেমেয়ে, তাদের বগলে ন্যাকড়ার পুঁটুলি। বড় মেয়েটার বয়স বছর দশেক। লোকটা কবুল করল যে, সে হচ্ছে সেই অশ্বিনী যে জাতে ছোট হয়েও কুলীন কায়স্থের বিধবাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বয়রার গ্রাম থেকে। এক বছর বাদে গ্রামে ফিরে আসার পর পণ্ডিতেরা খড়ম পেটা করে গ্রাম-ছাড়া করে। গত দশ বছর সে সেই কায়স্থের বিধবাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এখন তাদের গুটি দুই ছেলেমেয়ে। বুড়ো কর্তার জমিদারির বাইরে পৃথিবীটা নরক। সে এই স্বর্গরাজ্য ছাড়তে চায় না।
দাদুর মন তখন দূরে নিবদ্ধ। ব্রহ্মপুত্রের ও-পারের দিকে চোখ। কিন্তু দৃষ্টি আরও দূরপ্রসারী, কেননা সেই চোখ জোড়া তখন কোনও বস্তুকেই সঠিক দেখে না। নরেন্দ্রনারায়ণ মরে যাওয়ার পর দাদুর ও-রকমই হয়েছিল। মাঝে মাঝে অন্ধকারে বসে-থাকা দাদুর মাথার পিছনে হঠাৎ কখনও রমেন সাদা আলোর মতো কিছু দপদপিয়ে উঠতে দেখেছে।
অশ্বিনীর উপুড়-হওয়া শরীরের তলা থেকে পা টেনে নিয়ে দাদু বললেন, তোমার ছেলেমেয়েরা বর্ণসংকর। ওদের কী গতি হবে? আমার এলাকায় তোমরা পতিত। স্বজাতের বিধবাকে বিয়ে করলে আমি তোমায় চাকরি দিতাম, জমিও দিতাম। তুমি তোমার চেয়েও নিচু জাতের মেয়ে বিয়ে করলে সমাজের উপকার হত। কিন্তু এ যে প্রতিলোম।
অশ্বিনী অশিক্ষিত মানুষ, এত সব কথা বুঝল না। কিন্তু সে যে ভয়ংকর পাপ করেছে তা বুঝতে পেরে কাঁদতে লাগল। দাদু তখন ওর বউকে ডাকলেন। সে কাছে এসে আড়ষ্টভাবে আলগা প্রণাম করল, পা ছুঁল না। দাদু তাকে বললেন, এই যে অশ্বিনী, এর প্রতি তোমার কোনও শ্রদ্ধা আছে?
মেয়েটা চুপ করে থাকে।
এর প্রতি তোমার কীসের আকর্ষণ? বিয়ে করার ইচ্ছে হলে আমাকে এসে বলোনি কেন? আমি তোমার বিয়ে দিতাম। দরকার হলে ব্রাহ্মণের সাথেও।
মেয়েটি হঠাৎ বলল, তাতে কী হয়েছে?
দাদু উত্তর শুনে একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তোমার গলার স্বর শুনে মনে হয় তুমি স্বাধীনচেতা। আমার এলাকায় মেয়েরা ততখানি স্বাধীন যতখানি মেয়েদের পক্ষে হওয়া সম্ভব। তারা পুরুষের মতো স্বাধীন নয়। আমি তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তোমার পুরুষালি স্বর শুনে মনে হয় তোমার চরিত্রও পুরুষের মতো। তুমি মেয়ে হয়ে তোমার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারোনি, তাই তুমি অসহিষ্ণু, অসুখী।
মেয়েটা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
দাদু ধীর অনুত্তেজিত স্বরে বললেন, বিয়ের উদ্দেশ্য প্রজাবৃদ্ধি। তাই প্রজাপতি বিয়ের দেবতা। বিয়ের একটা অনুশাসন আছে। যাঁরা মনুষ্য-বিজ্ঞান জানতেন তাঁরা এই নিয়ম তৈরি করেছিলেন। তুমি সেই নিয়ম ভেঙে জাতিনষ্টকারী পাপ করেছ।
মেয়েটি সামান্য বিদ্রোহের ভঙ্গিতে বলল, আমি জাত বিচার করিনি। মানুষ দেখেছিলাম।
দাদু সামান্য হাসলেন, তুমি বিচার করার কে? মানুষের তুমি কতটুকু জানো? মানুষের বিচার হয় তার বংশগতি তার বর্ণবৈশিষ্ট্যের ওপর। তোমরা আমার এলাকায় থাকতে পারো, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হয়ে নয়। আমি তোমাদের সম্পর্ক ভেঙে দিলাম। তোমরা আলাদা-থাকবে, অনাত্মীয়ের মতো। আর, তোমার ছেলেমেয়েরা কোনও দিন বিয়ে করতে পারবে না। তাদের প্রজাবৃদ্ধির অধিকার নেই।
মেয়েটি অপমানিত মুখে চুপ করেই ছিল।
দাদু তার নীরবতার মধ্যে কোনও একটি প্রশ্ন আন্দাজ করে বললেন, নিম্নবর্ণের মেয়ের উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হলে জাতি উন্নত হয়, আর উচ্চবর্ণের মেয়ের নিম্নবর্ণের পুরুষের সঙ্গে বিয়েতে জাতি অধঃপতিত হয়। তুমি নিম্ন সহবাস করেছ। তোমার ছেলেমেয়েরা বর্ণসংকর। আমি তাদের প্রতি নিষ্ঠুর নই, কিন্তু সকলের ভালর জন্য আমি তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চাই। তাতে ওদের হয়তো একটু কষ্ট হবে, কিন্তু বৃহত্তর কারণে ওরা সে কষ্টুটুকু মেনে নেবে।
এরপর নরেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল স্কুলে ঠুনঠুন করে ঘণ্টা বাজাত অশ্বিনী। একা থাকত স্কুলঘরের পিছনের দিকে খুপরিতে। বউ বা ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তাতে তাকে অসুখী মনে হত না। বরং কায়স্থের বিধবাকে নষ্ট করার জন্য যে পাপবোধে সে কষ্ট পাচ্ছিল তা থেকে বেঁচে যাওয়ায় সে বুড়োকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করত।
সেই কায়স্থ বিধবাটি বাড়ির পিছন দিকে যে ছোট্ট দাতব্য ডিসপেনসারিটি ছিল তার শিশি বোতল ধোয়ার কাজ করত। মাঝে মাঝে সে বাড়ির ঝি-দাসীদের কাছে তার বীভৎস বিতাড়িত জীবনের গল্প করত।
তাদের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছেলেটি ছোট। মেয়েটি বড়, বছর দশেক বয়স তখন তার। তারা সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করত। জল বা খাবার ছোঁয়া তাদের বারণ ছিল। বারণ বাইরে যাওয়া। রমেনের মাঝে মাঝে চোখে পড়ত মেয়েটি তার পড়ার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখছে। কখনও বা নীচের বারান্দা ঝাঁট দিতে দিতে হঠাৎ থেমে হাঁ করে চেয়ে থেকেছে। পিছনের ঘেরা পাঁচিলের দিকে যার ওপর দিয়ে দু’ হাত দু’ দিকে ছড়িয়ে টালমাটাল হাঁটছে রমেন।
উদ্ধব মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে বলত, ওই মেয়েটা ছোটকর্তার দিকে চেয়ে থাকে কেন! ওই রে মেয়েটা, এই হটে যা—
কিন্তু মেয়েটা ছিল স্বভাবে বাধ্য। রমেন যা করতে বলত তা তৎক্ষণাৎ করত, তার মুখে খুশির আভা দেখা যেত। ক্রমে সে রমেনের পোষা কুকুরের মতো হয়ে গেল। যেখানে রমেন সেখানেই ইরাবতী। পায়ে পায়ে ফিরত সে। তার করুণ কৃশ, শ্যামলা এবং সুন্দর মুখখানায় রমেনের প্রতি একটা কাঙাল ভাব ফুটে থাকত। ড্যাঙভাঙে রোগা হাত-পা আর মস্ত খোঁপায় তাকে একই সঙ্গে ছেলেমানুষ আর বয়স্ক দেখাত। আর তার দু’ চোখে সব সময়েই বাস করত একটা হরিণের মতো সন্ত্রস্তভাব।
দাদু মাঝে মাঝে পায়ের শব্দ পেয়ে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, রমেন, তোমার সঙ্গে কে?
ইরা।
দাদু ভ্রূ কুঁচকে চুপ করে থাকতেন।
মুখ-বেঁকা লৰ ছিল রমেনের খাস চাকর। তার ছিল নাড়ী-জ্ঞান, আর জানা ছিল হোমিওপ্যাথি। সে ইরাকে প্রায়ই রমেনের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলত, বামন হয়ে চাঁদ ধরার মতলব, অ্যাঁ? কেন তুমি পায়ে পায়ে ঘোরো?
একা খুব সুখেই ছিল অশ্বিনী। সে বউ ছেলেমেয়ের নামও করত না। ছুটির পর ব্রহ্মপুত্রের দিকে চেয়ে বসে থাকত। মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে তার তাড়ি-খাওয়া মেজাজি গানের রেশ শুনতে পাওয়া যেত। ইরার মা’র সঙ্গে কখনও দেখা হলে দূর থেকে হাতজোড় করে নমস্কার করত সে। রমেন তার কাছে সাঁতার শিখেছিল।
মাঝেমধ্যে ইরার মা’র সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলে কখনও-সখনও চমকে উঠত রমেন। মনে হত এই মহিলার চোখ কথা বলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে দাদু মারা গেলেন। খুব শান্তভাবে। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে খড়মের শব্দ তুলে দরদালানের ভিতর দিয়ে চলে গেলেন শোওয়ার ঘরে। তারপর শুয়ে পড়লেন। খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই মারা গেলেন তিনি। সেই সময়ে রমেন বাবার সাদা ঘোড়াটায় চড়ে কেওটখালির মাঠে ট্রেঞ্চের গর্তগুলো লাফিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছিল।
যুদ্ধের পর বিশাল পরিবর্তন এসেছিল পৃথিবীতে।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা মাঝে মাঝে ভূত দেখতেন। ওই দেখাটা তাঁর নেশার মতো ছিল। সাতচল্লিশ সালের শেষ দিকে যখন রমেন কাশীপুরে আসে তখন মাকে জোর করে নিয়ে আসতে হয়েছিল। তার ধারণা ছিল কলকাতায় গেলে বাবার আত্মা আর তাকে দেখা দেবেন না।
নিঃসন্তান জ্যাঠামশাই মারা গিয়েছিলেন বাবারও আগে। জ্যাঠাইমা চলে গেলেন গোবরদিতে তাঁর বাপের বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মা ছাড়া রমেনের আর কোনও আত্মীয় নেই। তখন তার দু’ধারে দাঁড়াল প্রাচীন গাছের মতো দু’জন লোক৷ উদ্ধব আর লব। চারা গাছটিকে তারা বেড়ার মতো ঘিরে রাখার চেষ্টা করছিল। পারেনি।
অশ্বিনী থেকে গিয়েছিল। নরেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল স্কুলের পিছনের খুপরিতে বসে ব্রহ্মপুত্র দেখার নেশা তাকে ছাড়েনি। একা সে তখন সুখী ছিল। বড়কর্তার দয়ার কথা লোককে বলত। ইরার মা তার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিল। কাশীপুরের বাড়ির রান্নাঘরের পাশে তাদের জন্য টিনের ঘর তুলে দিয়েছিল উদ্ধব আর লব, শাসিয়ে দিয়েছিল যেন তারা ভিতর-বাড়িতে না আসে। কিন্তু ইরা আসত। মাঝে মাঝে ইরার মা থানকাপড়ের ঘোমটার ভিতর থেকে অতীব তীব্র চোখে দেখত রমেশকে। তার ছেলেমেয়েকে বুড়োকর্তা সকলের সামনে বর্ণসংকর বলে আলাদা করে দিয়েছিল, নিষেধ করেছিল বিয়ে দিতে। সেই অপমান বোধ হয় সে ভোলেনি।
তখন কলেজে পড়ে রমেন। ম্যাগাজিনে ললিত ভট্টাচার্য নামে একজনের প্রবন্ধ বেরোল— ভারতে সাম্যবাদ এবং কয়েকটি অসুবিধা। সেই প্রবন্ধে খুব জোরালো যুক্তিতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে প্রাচীন আর্যরা অর্থনৈতিক কারণে মানুষকে বর্ণাশ্রমে ভাগ করেছিল। আপাতদৃষ্টিতে বর্ণাশ্রমকে বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তা নয়। এ ছিল শোষণের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা। যে-ব্যবস্থা আজও কার্যকরী রয়েছে ভারতবর্ষে। ইত্যাদি।
তখন ইরার বয়স বোধ হয় যোলো-সতেরো। স্নিগ্ধ শরীর। শ্যামলা নরম রং। মায়ের কাছে বসে দুপুরে ফ্রেমে আঁটা সাদা কাপড়ে গোলাপ ফুলের নকশা তোলে। রমেনের পায়ের শব্দ পেলে নিঃসাড়ে উঠে আসে। জামা-জুতো ঠিক করে দেয়। রমেনের মাঝে মাঝে তাকে দয়া করতে ইচ্ছে হত। মাঝে মাঝে ভালবাসতেও। তাই ললিত ভট্টাচার্যের সেই প্রবন্ধটা বড় ভাল লেগেছিল রমেনের। সে তখন নিজের সমর্থনে একটা যুক্তি দাঁড় করাতে চাইছিল। আলাপ হওয়ার পর ললিত নামে সেই ছেলেটি আবেগতপ্ত স্বরে মানুষের মুক্তির কথা বলত। সেগুলো বিশ্বাস করেছিল রমেন। ক্রমে সে নিজেও মানুষের মুক্তির কথা বলতে শুরু করে।
বছর দুয়েক বাদে পাকিস্তান থেকে চলে এল অশ্বিনী। সে খুব একা বোধ করছিল সেখানে, তা ছাড়া বুড়ো বয়সের চিন্তাও ধরেছিল তাকে। সে কাশীপুরের বাড়িতে কয়েক দিন থেকে তারপর যাদবপুরের দক্ষিণে কোথায় খানিকটা জমি পেয়ে গেল, তুলে ফেলল দু’খানা ঘর। একদিন উদ্ধব চেঁচিয়ে রমেনের কাছে নালিশ করল, অশ্বিনী লুকিয়ে ইরার মা’র সঙ্গে দেখা করে, তাকে নিয়ে যেতে চায়। বুড়োকর্তার নিষেধ মানছে না অশ্বিনী, তার নাকি একা একা লাগে, বউ ছেলেমেয়ের জন্য প্রাণ কাঁদে। ইরার মাও পালাবার তালে আছে।
তখন মানুষের মুক্তির কথা ভাবে রমেন। তাই উদারভাবে বলল, ওর বউ ছেলেমেয়ে, ওর তো নেওয়াই উচিত। যদি যেতে চায়, তবে ইরার মাকে ছেড়ে দিয়ো।
তখন রমেন আর ছোট নয়। বিশাল লম্বা তার চেহারা, গলার স্বর গুরুগম্ভীর। উদ্ধব আর লব তাকে তখন সমীহ করতে শুরু করেছে। তারা দু’-একবার বুড়োকর্তার দোহাই দিল, কিন্তু তারপর একদিন অশ্বিনী তাদের চোখের সামনে দিয়েই নিয়ে গেল ইরার মাকে তার দুই ছেলেমেয়েসহ।
তখন প্রজারা আসত রমেনের কাছে। রমেন তাদের চেয়ারে বসতে বললে বসত না, উবু হয়ে মাটিতে কিংবা পিঁড়িতে বসে কথা বলত। তারা রমেনকে সম্মান করতে ভালবাসত। রমেন অনেক দিন ভেবেছে ওটা অন্তর্নিহিত দাসত্ব না সত্যিই ভালবাসা! প্রজারা আসত হাজার সমস্যা নিয়ে। কখনও জমি কিনবার আগে সেই জমি কেনা উচিত কি না তা জানতে, কখনও মেয়ের বিয়ে ঠিক করার সময়ে পরামর্শ চাইতে। অসুখে ডাক্তারের যে প্রেসক্রিপশন তা ঠিক হয়েছে কি না তাও দেখাতে আসত কেউ কেউ। এ ছাড়া টাকার সাহায্য, ছেলের চাকরি কিংবা নিছক পেটের কিছু না-জুটলে খাদ্যপ্রার্থী প্রজারা আসতই। দাদু বেঁচে ছিল বলে এতকাল প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়নি রমেনের। কিন্তু রমেন দেখেছে তাদের দেশের বাড়িতে প্রজাদের নিরন্তর আনাগোনা। তারা কত বিষয়-সমস্যা নিয়ে আসত দাদুর কাছে। দাদু তাদের বরাবর সঠিক পরামর্শ দিয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পরও কাশীপুরের বাড়িতে প্রজাদের আনাগোনা দেখে সে অবাক হয়েছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারত যে প্রজারা তাদের পুরনো অভ্যাস মতো আসে, বুড়ো কর্তার জায়গায় ঠিক ওইরকম একজন সর্বজ্ঞ লোক চায় যে সঠিক পথ বলে দেবে। দাদু কখনও ভুল পরামর্শ দিতেন না। তবে কি দাদু সর্বজ্ঞ ছিলেন? না, তা নয়। দাদু তাঁর পূর্বপুরুষের কাছ থেকে প্রজাপালন শিখেছিলেন। ফলে যুবাবয়স থেকেই তিনি প্রজাদের সংস্পর্শে আসতে শুরু করেন। প্রজাদের যা সমস্যা তা তিনি জানতে শুরু করেন। আর সব কিছুর সমাধানের জন্য তিনি শিখেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যা, চাষবাস, কামার কুমোরের কাজ, তাঁত চালানো, তিনি জানতেন মাছের গতিবিধি, তা ছাড়া জানতেন ফৌজদারি আইন, সর্বোপরি মনু পাতঞ্জল, গীতা ভাগবত, তাঁর প্রায় মুখস্থ ছিল বছরকার পাঁজি। আরও বোধ হয় অনেক কিছুই জানতেন দাদু, তাঁর না-জানা বিষয় ছিলই না। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য দাদু অতখানি শিখেছিলেন, তাই প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। এখন প্রজারা সেই অপরিহার্য বুড়োকার্তার খোঁজে রমেনের কাছে আসতে লাগল। রমেন প্রথমে দিশেহারা বোধ করত খুব। কিন্তু সে সবাইকেই সৎ এবং আন্তরিক পরামর্শ দিতে চেষ্টা করত। কিন্তু দেখতে পেত তার সাংসারিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বড় কম। তা ছাড়া প্রজাদের সমস্যা হাজার রকমের। জমিদারি না পেলেও একটা বিপুল সংখ্যক প্রজাকে সে পেয়েছিল, আর পেয়েছিল দায়িত্বের উত্তরাধিকার। মানুষগুলোকে সে ফিরিয়ে দিতে পারত না, বরং সে দেখতে চাইত দাদুর কাছে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ কী পেয়েছিল, এবং সে সেটা দিতে পারে কি না। ফলে অবসর সময়ে বা ছুটির দিনে রমেন গাঁ-গ্রামে ঘুরতে শুরু করে, প্রজাদের বাড়ি বাড়ি যেতে থাকে, জমি চেনে, রাত জেগে লবের কাছে শেখে হোমিওপ্যাথি, পড়ে আইনের বই। আর প্রতি সকালে-বিকালে কারও-না-কারও কোনও-না-কোনও সমস্যার সমাধান তাকে দিতে হয়। প্রজারা প্রায়ই আনত তরিতরকারি, প্রণামী দিত টাকা, এক নিঃসন্তান বুড়ো তার বিঘা তিনেক জমি উইল করে দিয়ে গেল মরার আগে। যাদবপুরের দক্ষিণে একটা জায়গায় রমেনদের প্রজারা বেশি জোট বেঁধে ছিল। সেখানে রমেন গিয়ে দাঁড়ালে একটা হইচই পড়ে যেত। এই অভিভাবকত্ব আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করে রমেনের। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দৈন্যের বিরুদ্ধে সে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। এই সময়ে কলেজ ইউনিয়নের চোখা চালাক জেনারেল সেক্রেটারি ললিত আসত তাদের বাড়িতে। তাকে দেখত ঘুরে ফিরে, দেখত আসবাব, শুনত পিয়ানো বাজিয়ে রমেনের গান, তারপর মৃদু হেসে বলত, তোমার গা থেকে এখনও গন্ধ গেল না। এখনও তোমাকে সবাই ছোটকর্তা ডাকে।
রমেন লজ্জা পেত। অন্য দিকে রমেন তখন সাম্যবাদের ইশতেহার পড়েছে, কলেজ ইলেকশনে পোস্টার এঁকেছে রাত জেগে, চেঁচিয়ে বক্তৃতা করেছে, জিতিয়ে দিয়েছে ললিতকে। সে তখন মানুষের সাম্যের কথা, মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা ভাবে, তর্ক উঠলে কথায় কথায় ললিতের মতো বলে, রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখো।
এই দুই রকম বোধ তাকে কিছুদিন খুব দোলাচলে রাখল। এক দিকে তার মধ্যে ক্রমে ক্রমে বুড়োকর্তার ছাপ পড়েছে, অন্য দিকে ললিতের। দুটোকে মেলাবার একটা চেষ্টা করছিল সে। পারছিল না।
ঠিক এ-রকম সময়ে এক দিন হারু দত্ত নামে এক প্রজা এসে জানাল যে অশ্বিনীর মেয়ে ইরাবতী তাদের পাড়ার ছেলেগুলোর মাথা খাচ্ছে। তার ছেলে পরাণ ধরেছে ইরাকে বিয়ে করবে। অশ্বিনী আর সেই কায়স্থের বিধবাও সেই তালে আছে, মেয়েকে কারও ঘাড়ে গছাতে চায়। অথচ বুড়োকর্তার নিধেষ ছিল। ওদের জন্মের দোষ…
শুনে হঠাৎ রেগে গেল রামেন। ‘জন্মের দোষ’ কথাটা সে সহ্য করতে পারল না। এই লোকগুলো সেই কবেকার কথা মনে রেখেছে। বুড়োকর্তার কথা, তাই এরা ভুলতে পারছে না।
সেই মুহূর্তে রমেনের মন দাদুর দিক থেকে সরে এসেছিল। সে ভেবেছিল মানুষ জন্মমাত্রই স্বাধীন, মুক্ত, তার আবার শ্রেণীভাগ কীসের! তার মন দুলছিল। কতগুলো বিষয়ে সে দাদুকে স্বীকার করতে পারছিল না। ইরার মায়ের প্রতি দাদুর নিষ্ঠুর আদেশ এবং কয়েক বছর আগের সেই সন্ধ্যায় মেয়েটির ম্লান মুখখানা তার মনে পড়ছিল।
হঠাৎ একটা আবেগবশত সে হারু দত্তকে বলল, তোমরা কি ওদের ঘেন্না করো? কিন্তু আমি যদি ইরাবতীকে বিয়ে করি?
হারু সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে বলল, কর্তা, আপনি বিষ খেলেও কিছু হবে না। পাপ আপনাদের ছোঁয় না। কিন্তু আমরা কি তা পারি!
শুনে সামান্য একটু অহংকার বোধ করেছিল রমেন।
তারপর একদিন সে সোজা গিয়ে হাজির হল অশ্বিনীর বাড়িতে। তখন দুপুরবেলা। রমেনকে দেখেই অশ্বিনী গা ঢাকা দেওয়ার জন্য পিছ-দরজা দিয়ে পুকুর-ঘাটের দিকে রওনা হয়েছিল। রমেন প্রচণ্ড হাঁক মেরে ডাকল তাকে। সে বশংবদভাবে সামনে দাঁড়াতেই বলল, আমি তোমার মেয়েকে বিয়ে করব।
কপাটের আড়াল থেকে লালপেড়ে শাড়ির ঘোমটায় ঢাকা একখানা মুখ খুব উদগ্রীবভাবে কথাটা শুনল, তার চুড়িপরা হাতের একটা ঝনাৎ শব্দ শোনা গেল শুধু।
কেন যেন তখনই রমেনের মনে হয়েছিল সে কাজটা ভাল করল না।
বিয়েটা খুব সহজ হল না। রমেনের মায়ের ভূতরোগ থেকে তখন মাথায় ছিট দেখা দিচ্ছে। তবু মা শুনে কেঁদেকেটে একশা করলেন। লব গম্ভীর হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে বুড়োকর্তার তফাত এই যে, তুমি বেশি দূর দেখতে পাও না, বুড়োকর্তা অনেক দূর দেখতে পেতেন।
প্রজারাও শুনে খুশি হল না কেউ। কেবল তাদের ছেলেদের মধ্যে যারা কলেজটলেজে পড়ছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ রমেনকে খুব বাহবা দিল।
উদ্ধব খুব বিষন্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, অশনা তা হলে তোমার শ্বশুর হচ্ছে! দেখো, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কোরো না যেন।
সকলেরই অসন্তোষের কারণ ঘটিয়ে একদিন বিনা সমারোহে ইরাকে বিয়ে করে আনল রমেন। আর সেই সঙ্গে প্রজাদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমে গেল অনেক। তারা দেখল, বুড়োকর্তা— যিনি অনেক দূর দেখতে পেতেন— তাঁর কথা রমেন শুনল না।
বিয়ের পরেই রমেন ইরাকে সঠিক বুঝতে পারল। এ সেই নিরীহ অবোধ কিশোরী নয়, এ অন্য রকমের। ঝাঁঝালো শরীর ছিল ইরার, যতখানি ঝাঁঝ রমেনের ছিল না। প্রথমে অমিল হল সেইখানে। আর-একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল এই যে প্রতি দিন সকালে উঠে রমেন কেমন অবসাদ বোধ করত।
রমেন একদিন ইরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার কি কোনও অসুখ আছে?
না তো! কেন?
কী জানি! আমার কেমন দুর্বল লাগে। মনে হয় একটা সংক্রামক কিছু তোমার কাছ থেকে এসেছে। আমার এ-রকম হত না তো।
আর একটা ব্যাপার রমেন লক্ষ করত, ইরা কখনও কারও ‘মা’ ডাক সহ্য করতে পারত না। প্রজারা তখনও কিছু আসে, তারা ‘মা’ বলে ইরাকে ডাক দেয়, আর ইরা কেমন কুঁকড়ে যায়। অস্থির বোধ করে। রমেন জিজ্ঞেস করলে বলত, মা-টা শুনলে আমার কেমন যেন নিজেকে অপরাধী লাগে।
ইরার মা বুদ্ধিমতী ছিল। বিয়ের পর শাশুড়ি সেজে কখনও এ-বাড়িতে আসত না। অশ্বিনী মাঝে মাঝে চুপিচুপি এসে বাইরে দেখা করত। রমেনের সঙ্গে দেখা হলে সে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে ডাকত ‘ছোটকর্তা’। সম্পর্কটা ছিল আগের মতোই। কিন্তু একটা অসম্ভব হাস্যকর সম্পর্ক। লোকে এ-নিয়ে বলাবলি করত।
ইরা সারা দিন অস্থির বোধ করত। একটু নির্বোধ ছিল সে, স্বভাব ছিল ঢিলেঢালা, কথা বুঝতে সময় নিত। কিন্তু সে কিছুতেই নিজেকে রমেনের স্ত্রী বলে বিশ্বাস করতে পারত না। সম্ভবত ছেলেবেলায় ছোটখাটো জিনিস চুরি করা অভ্যাস ছিল ইরার। একদিন উদ্ধব এসে নালিশ করল যে, ইরা গোপনে কিছু জিনিসপত্র অশ্বিনীকে দিয়েছে। তার নিজের চোখে দেখা। সে ইরাকে ধরতেই ইরা কেঁদে ফেলেছে, আর অশনা পালিয়েছে।
রমেন শান্তভাবে উদ্ধবকে বলল, তাতে কী! ও ওর নিজের জিনিস দিয়েছে।
কথাটা উদ্ধব বিশ্বাসই করতে পারল না। ঠোঁট উলটে বলল, ওঃ! নিজের জিনিস!
এক বছর এ-রকমভাবেই রইল ইরা। তখন রমেন খুব ব্যস্ত মানুষ। আইন পড়ে, আর পার্টি করে, প্রজাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কমিউন তৈরির চেষ্টা করে। কখনও প্রবীণ প্রজাদের মধ্যে কেউ তার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলে সাম্যের কথা শোনায় রমেন। কিন্তু সে স্পষ্টই বুঝতে পারত তার জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। সাধারণ মানুষের বুঝেছিল যে বুড়োকর্তার মুখ থেকে যা বেরোয় তা বেদবাণী। কিন্তু রমেন বুড়োকর্তার আদেশ লঙ্ঘন করেছে।
রমেন খুবই হতাশ বোধ করত। প্রজাদের মধ্যে প্রথম নিজের নেতৃত্ব বোধ করতে শুরু করে তার নেশা লেগে গিয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল তার পূর্বপুরুষদের মতো, দাদুর মতো সেও এদের সুখে-দুঃখে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে প্রজারা তাকে বলেছে, আমাদের এলাকা থেকে আপনি ইলেকশনে দাঁড়ান। আমরা জিতিয়ে দেব।
ঠিক যে সময়ে সে দাদুর আসন নিতে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তেই ইরাকে বিয়ে করায় তার ছবি ম্লান হয়ে গেল। অথচ ওদিকে সাম্যবাদের প্রতি বিশ্বাসও তার দানা বেঁধে ওঠেনি।
তখন দাদুর ক্ষমতা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে রমেন। যার মুখের কথার একটু অনুশাসন ভেঙে একজন একঘরেকে উদ্ধার করতে গিয়ে তার জনপ্রিয়তা কমে গেল। সে আশ্চর্য হয়ে সেই বিশাল গাছের মতো মানুষটির কথা ভাবত, যার ডালপালায় প্রজারা নিরাপদ নীড় বেঁধে আছে। যিনি জমিদার এবং নেতা। যিনি প্রজাদের সব ভালমন্দ জানতেন। রমেন এও বুঝতে পারে যে, প্রজারা তাকে যেটুকু মানে তা তার পূর্বপুরুষদের সুকৃতির গুণে। সে নিজে থেকে কিছুই অর্জন করেনি। তাই আজ যদি সে পূর্বপুরুষদের অনুশাসন ভাঙে তবে প্রজারা আর তার কথা শুনবে না।
রমেন তাই তখন মাঝে মাঝে মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠত। অস্থির বোধ করত। সাধারণ মানুষের জীবন, স্ত্রীর সঙ্গে বিছানা ভাগ করে শুয়ে সন্তান পালন করে, ঘর গোছানো সংসার করে জীবন কাটানোর কথা মনে করতেই তার মন খারাপ হয়ে যেত। সে কিছুতেই ভাবতে পারত না যে সে তার পূর্বপুরুষের মতো জীবন যাপন করবে না। বরং তার মনে হত একটা বৃহত্তর জীবনই তার জন্য অপেক্ষা করছে। যে জীবন বিশাল, যে জীবনের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে, মানুষের ভালবাসা না পেলে সে বাঁচবে না। কে তাকে সেই অসাধারণ জীবন দেবে? কে তাকে দেবে সর্বজ্ঞত্ব? রমেন মনে মনে সেইরকম একজনকে খুঁজত। দাদু তাকে খুঁজতে বলেছিল।
বিয়ের এক বছর বাদে যখন ইরা মাত্র মাস দুয়েকের গর্ভবতী তখনই একদিন সে পালিয়ে গেল। উদ্ধব খবর দিল হারু দত্তর ছেলে পরাণ মাঝে মাঝে আসত এ-বাড়িতে। ইরার সঙ্গে বসে গল্প করত অনেক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল পরাণও নেই।
লব তার বিষন্নতা আর লজ্জা দেখে বলল, তোমার নারীজ্ঞান নেই। যে উদ্ধার পেতে চায় না তাকে জোর করে উদ্ধার করেছিলে। বুড়োকর্তা কি মিছে বলেছিলেন? তিনি জানতেন।
তিনি জানতেন। ওই কথাই ছড়িয়ে গেল চারদিকে। রমেন দেখতে পেল প্রজাদের চোখ অন্ধ করে দাদুর ছবি ঝুলছে। তিনি জানতেন।
তারপর সেই জানাটাকেই অনেকভাবে জানতে চেষ্টা করেছে রমেন।
ইরাকে কেউ খুঁজল না। সে নিজেও নয়। তেমন কোনও অস্থিরতাও প্রকাশ করল না রমেন। তখন তার মন জুড়ে দাদুর ছবি।
কেবল মাঝে মাঝে সে প্রচণ্ড জোরে তার পুরনো মোটর গাড়িখানা চালিয়ে নিয়ে যেত উদ্দেশ্যহীনভাবে। ওই সময়েই একবার সে দুর্ঘটনায় পড়ে।
সাতাশ
ইরা চলে গেলে রমেন বাইরে বেরোনো প্রায় বন্ধ করে দিল। বন্ধুরা মাঝে মধ্যে আসত, রমেন তাদের দেখে ভয় পেত, পাছে তারা ইরার কথা জিজ্ঞেস করে। চেনা মানুষ দেখলে ভয় পেত রমেন, একা থাকতে ভালবাসত। পুরনো ভাঙা পিয়ানোটার তখন ঠিকমতো আওয়াজ হয় না, তবু রমেন সেটা বাজাত মাঝে মাঝে, গাইত পূর্ব বাংলার মাল্লাদের গান। কখনও গাড়িখানা নিয়ে চলে যেত দূরে। গঙ্গার ধার ঘেঁষে দাঁড় করাত গাড়ি, জামা খুলে ঝাঁপ দিত জলে। অনেক দূর সাঁতরে আসত। প্রজাদের আনাগোনা কমে গিয়েছিল অনেক। সারাটা দিন ফাঁকা পড়ে থাকত রমেনের। হাতে কোনও কাজ ছিল না। রমেন এম এ পরীক্ষা দিলই না। নিতান্ত অনিচ্ছায় দিল আইনের দ্বিতীয় পরীক্ষা, পাশ করতে পারল না। কোনও দুঃখই সে বোধ করল না তার জন্য। মাঝে মাঝে খুব ভোরবেলা উঠত রমেন। বল নিয়ে সে আর আগের মতো দৌড়ত না। সে খেলা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু ভোরবেলা উঠে সে মাঝে মাঝে বাইরে আসত। কাশীপুরের বাড়ির সামনের দিকে একটু ছাড়া জমি ছিল বাগান করার জন্য। বাগান হয়নি, লব আর উদ্ধবের তখন বয়স হয়েছে, গাছের শখ কারও ছিল না, কে বাগান করবে। সেই ছাড়া জমিতে কিছু আগাছা আর লম্বা ঘাস জন্মেছিল, একটা বেল গাছ থেকে মাঝে মাঝে তক্ষকের ডাক শোনা যেত। সেই ফাঁকা জমির ওপর দিয়ে রমেন খামোখা চক্কর দিয়ে ঘুরত। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে চোখ বুজত সে, ছেলেবেলায় ফেরার চেষ্টা করত। নির্জন রাস্তায় পায়ের শব্দ পাওয়া যেত স্নানার্থীর। তারা গঙ্গার দিকে চলে যেত। রমেনের হঠাৎ মনে পড়ত ছেলেবেলার মতো পুবের দালানে দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে যেমন সূর্য প্রণাম করত সে, তেমন অনেককাল করে না। এক-আধদিন প্রণাম করার চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কোনও রোমাঞ্চ বোধ না করায় ছেড়ে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সে ইরার কথা ভাবত। কেন ইরা তাকে পছন্দ করল না? সে মাঝে মাঝে নিজের কথা ভাবত। সে কীরকম জীবন-যাপন করবে এরপর?
এই সময়ে দু’টি ঘটনা ঘটে পর পর।
গঙ্গার ঘাটে শেষ দুপুরের নির্জনতায় একটি বাচ্চা ছেলে জলের তোড়ে কোথা থেকে এসে ভেসে যাচ্ছিল। কিছু লোক দেখতে পেয়ে তাকে টেনে তুলেছে। রমেন গিয়ে দেখে বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে খালি গায়ে নতুন পইতে, পরনে নেভি ব্লু প্যান্ট, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। জলে থেকে সাদা হয়ে গেছে গা। জ্ঞান নেই। যারা তুলেছিল তারা হতবুদ্ধির মতো চেঁচাচ্ছিল, কী করতে হবে বুঝতে পারছিল না। লোকজন ছুটে আসছিল চারদিক থেকে, কিন্তু তাদের একজনও জানত না কী করতে হবে। ভিড় সরিয়ে রমেন ছেলেটাকে ধরেই বুঝতে পারল শরীরে প্রাণ আছে। সে জানত কী করে জলে-ডোবা মানুষ বাঁচাতে হয়। যা করতে হয় সে তাই করছিল। ছেলেটাকে ঠিকমতো শুইয়ে হাঁটুর চাপ দিয়ে ধরে লঘু দ্রুত হাতে মালিশ করে দিচ্ছিল শরীর। নিঃশব্দে ভিড়ের অত লোক তাকে দেখছিল সে একটা ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে আনছে। কাজেই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছিল রমেন। বাইরের জ্ঞান ছিল না। একজন চেঁচিয়ে বলল, জল বেরোচ্ছে, বেঁচে যাবে! একজন শান্ত প্রকৃতির লোক উবু হয়ে পাশে বসে দেখছিল, সে গায়ে হাত দিয়ে দেখে বলে ওঠে, গা গরম লাগছে যেন একটু। অনেকক্ষণ ধরে ডুবে ছিল ছেলেটা, গভীর অজ্ঞানতার মধ্যে চলে গিয়েছিল। সময় লাগছিল অনেক। অনভ্যাসে রমেনের হাত টাটিয়ে গেল, ঘাম দিচ্ছিল তার শরীরে, উত্তেজনায় মুখে-চোখে গরম রক্তের আঁচ। অতগুলো লোকের সামনে একজনকে বাঁচিয়ে তোলার একটা তীব্র উত্তেজনায় সে থামছিল না। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন রমেনকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। সে ডেকে এনেছিল ডাক্তার। হঠাৎ রমেন শুনতে পেল ‘ও কী করছেন।’ এই প্রশ্নে মুখ তুলে দেখল হাতে ব্যাগ, স্টেথসকোপওলা ডাক্তারকে, প্রবীণ মুখ। হতবুদ্ধির মতো চেয়ে থেকে রমেন বলল, কী করব! ডাক্তার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, ওভাবে নয়। ওকে চিত করে শোওয়ান, তারপর মালিশ। একপলকের জন্য রমেনের মনে হল, ডাক্তার ভুল বলছে। সে জানে, সে দেখেছে জলে-ডোবা মানুষ বাঁচাতে। তবু কেমন দিশেহারা বোধ করল রমেন। এতগুলো লোক সাক্ষী, যদি ডাক্তারের কথা সে না-শোনে, আর যদি তার হাতেই ছেলেটা মারা যায়? ভুল হয়েছিল। ডাক্তারের কথামতো ছেলেটাকে নতুন করে শোওয়াল রমেন, পনেরো মিনিটের মধ্যেই তার হাত টের পেল ছেলেটার কচি শরীর শক্ত হয়ে আসছে। সে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে তার বিব্রত মুখ দেখল, মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বলল, ঠিক হচ্ছে না। ডাক্তার ঝুঁকে ছেলেটার নাড়ি দেখলেন, ইতস্তত করে বললেন, তা হলে আবার আগের মতো করুন তো দেখি। কী জানি, বোধ হয়…। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। একদম কাঠের মতো হয়ে গেল ছেলেটার শরীর। অনেকক্ষণ সেই মৃতদেহটা দু’হাতে আকুলভাবে খুঁজে দেখল রমেন।
ডাক্তার ভুল বলেছিল। অতগুলো লোকের সামনে সে ডাক্তার, তাকে একটা কিছু করতে হয়। নইলে তার সম্মান থাকে না। ডাক্তার জানত না কী করে জলে-ডোবা মানুষ বাঁচাতে হয়। হয়তো পড়েছিল কোনও দিন, কাজে লাগেনি বলে ভুলে গেছে। আর রমেন ঠিকই জানত কী করে বাঁচাতে হয়, তবু সে পারল না। একা একা ঘুরে বেড়াত রমেন আর মাঝে মাঝে চমকে উঠত ভয়ে। ভুল জেনেও সে কেন ভুল করেছিল! অত মানুষ সামনে ছিল বলে সে কি এই ভয় পেয়েছিল যে, ছেলেটা মারা গেলে অত মানুষ তাকে দুয়ো দেবে, না কি সে ভেবেছিল ডাক্তার, যেহেতু ডাক্তার সেইহেতু তার চেয়ে ভাল জানে? না কি সে অন্তরে বিশ্বাস করেনি যে সে সত্যিই ছেলেটাকে বাঁচাতে পারে। এ কেমন যে সে তার অধীত বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারছে না? কেন ওইরকম টানা-পোড়েন মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হল তার?
এই সময় একদিন মুনির বুড়ো বাপ এসে বলল, ছোটকর্তা, এক মুসলমানের জমি নিচ্ছি। শরিকি জমি, একটু গন্ডগোল আছে, তার ওপর পাকিস্তানের জমির সঙ্গে বদল করছি। কাগজপত্রগুলো একটু দেখে দেন।
মুনির বুড়ো বাপ দলিল-টলিল দেখতে দিল। অনেকক্ষণ ধরে দেখল রমেন। জমির কাগজ তার ছেলেবেলা থেকে চেনা। যে মুসলমান লোকটি মুনির বাপের সঙ্গে এসেছিল তার সঙ্গেও কথাবার্তা বলল রমেন। বুঝল জমিতে গন্ডগোল নেই। সব ভাই এককাট্টা হয়ে জমি ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু তবু রমেন অনেকক্ষণ ভাবল। দলিলটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, আমার যদি ভুল হয়। তুমি কোনও উকিলকে দেখাও।
আপনি তো উকিলের বাবা।
তবু রমেন মাথা নাড়ল, না হে, যদি আমার ভুল হয়ে থাকে?
মুনির বাপ অনেকক্ষণ চেয়ে রইল রমেনের দিকে। বুড়োকর্তার নাতির মুখ থেকে কথাটা বেরোল না! তবে সে কার কাছে ভরসা করে যাবে?
একদিন একটা বার-এর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সামান্য একটু হুইস্কি খেয়েছিল রমেন। তখন মাঝে মাঝে খেত। সঙ্গে ছিল সঞ্জয়। সেই রাত্রে সঞ্জয় হুইস্কির গ্লাস সামনে রেখে তাকে বুঝিয়েছিল যে, সে একটা মোটর-সারাইয়ের কারখানা খুলতে চায়। তার টাকা নেই, রমেন টাকা দিলে সে অংশীদারিতে ব্যবসা করবে। রমেন ব্যবসা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু বলেছিল, তুই ব্যবসা কর আমি বরং কিছু ধার দেব।
সঞ্জয় হেসে বলল, তোর জীবন-সংগ্রাম বলে কিছু নেই। দূর, তুই একটা মরা মানুষ।
সেই রাতের কথা স্পষ্ট মনে আছে রমেনের। সঞ্জয়কে একটা চেক লিখে দিয়েছিল রমেন, এবং খুব সহজ বোধ করেছিল নিজের মধ্যে। অনেক রাতে একা গাড়ি চালিয়ে ফেরার সময়েও সেই মহত্ত্বের বোধ কাজ করছিল তার মধ্যে। সে গুনগুন করে ভাবছিল তার একটি প্রিয় ফরাসি গান—ও-লাল-লা- ও-লা-লা…। ঝরঝর ছড়ছড় করে শব্দ করছিল অবিরল পুরনো মোটরগাড়ি। গভীর রাত্রের প্রাঞ্জল রাস্তা-ঘাট দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিল সে। খুব সামান্য নেশা হয়েছিল তার। সে ডালহৌসি স্কোয়ারের ভিতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে সেই নির্জনতায় অনুভব করেছিল তার চারপাশে প্রকাণ্ড সব গাছের অরণ্য। তার ভিতর দিয়ে ঝরনার মতো ঝরঝর করে বয়ে যাচ্ছে তার গাড়ি। তার মাঝে মাঝে শৈশবের কথা মনে পড়ছিল। তার ফাঁকা মাথার ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে গেল কবেকার হারানো তিনটে মার্বেল। যে-মার্বেলগুলো কখনও খুঁজে পায়নি বলে তার মনে রয়ে গেছে। মনে পড়েছিল ছেলেবেলার কিশোরীদের মুখ। সেই মুখগুলি তার প্রিয় ছিল, কেননা ফের দেখা হয়নি। কখনও বা মনে পড়েছিল একঢল সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে পেখমের বোঝা টেনে চরে বেড়াচ্ছে ধূসর রঙের ময়ুর। আর পাম গাছের ছায়ায় বাড়ির পশ্চিমের ভিতের কাছে আতসকাচ হাতে বসে আছে তার জ্ঞানী দাদু। মনে পড়েছিল মুকুন্দর ঘানিঘরের পিছনের মাঠটায় এক অন্ধকার সকালে সে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদছে। কাঁদছে হয়তো বা হারানো বলটির জন্য, হয়তো বা ঘরে ফেরার পথটির জন্য, কিংবা অলি নামে যে-মেয়েটি তাকে চুমু খেয়েছিল তার জন্য, হয়তো বা গাছপালা আকাশ এবং মায়ের মুখের জন্য। এইভাবেই টেরিটিবাজার ছাড়িয়ে গেল তার গাড়ি। শৈশব চিন্তায় অন্যমনস্ক রমেন এক বার লক্ষ করল পুরনো মোটর গাড়িটা গর্জন করছে অস্থিরভাবে, অভিভাবকের মতো বলছে, ঠিক মতো চালাও। নইলে বিপদ। আপনমনে হাসল রমেন। কী হয়, যদি সে এখন সেই শৈশবের মতো একবার চোখ বুজে দিক নির্ণয়ের খেলা খেলে? সেই চোখ-বুজে চলার খেলা সে বহু কষ্টে শিখেছিল, এ তার অধীত বিদ্যা, তবু একবার এক অন্ধকার ভোরে সেই খেলা সে ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়ে কেঁদেছিল মর্তের মানুষের মতো। এখন আর-এক বার তার পরীক্ষা করে দেখার সাধ হল। একবার সাবধানে চোখের পলক একটু বেশিক্ষণের জন্য ফেলল রমেন। তার গাড়ি কেঁপে উঠে সাবধান করে দিল তাকে। কোন দূরে পাখা ঝাপটাল একটা ময়ূর। দাদু পিঁপড়ের সারি থেকে চোখ তুলে তাকাল যেন। হাসল রমেন। আবার চোখ বন্ধ করে দিল। মনে মনে বলল, খুলব না। গাড়ি টাল খেল। কখনও ডান দিকে কখনও বাঁয়ে দুলতে লাগল। চোখ বন্ধ করে রইল রমেন। প্রাণপণে। সে মনে মনে এই কথা বলেছিল, আমি আর-এক বার ফিরে যাব সেই পাম গাছের ছায়ায় যেখানে চরে বেড়াচ্ছে ধূসর ময়ূর, ইজিচেয়ারে বসে-থাকা দাদুর পায়ের কাছে আমি বসব। তিনি অন্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে বলবেন, রমেন চোখ বড় মায়ার সৃষ্টি করে। রমেন বিড়বিড় করে বলল, শৈশবেই আমি ভাল ছিলাম। আমি জীবন-সংগ্রাম চাই না। আমি আর-এক বার জন্ম নিতে চাই। আমি শিশু হয়ে আসব, আবার খুব বড় হওয়ার আগেই আমি ফিরে যাব মায়ের জঠরে। ফিরে যাই। আমি জীবন-সংগ্রাম চাই না।
হঠাৎ যেন একমুখী স্রোতের নদী থেমে গেল, তারপর স্রোত বইতে লাগল উলটো দিকে। পশ্চাৎগামী এক রেল গাড়ির মতো ফিরে যেতে লাগল রমেন। মনে মনে তীব্র ইচ্ছাশক্তির বলে বন্ধ করে রইল চোখ। অলীক কয়েকটি মুহূর্তে সে সত্যিই ফিরে গিয়েছিল শৈশবে। আলো-আঁধারির এক ঝুঁঝকো বেলা, নিস্তব্ধ পৃথিবী শ্বাস বন্ধ করে প্রত্যক্ষ করছে এক শিশুর জন্ম। রমেন জন্মাচ্ছে। এক অব্যক্ত জগৎ থেকে ব্যক্ত জগতে চলে আসছে সে। টের পাচ্ছে ক্ষুধাতৃষ্ণা, শীত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মৃত্যু। টের পেয়ে শিশু রমেন কাঁদছে। জন্মমুহূর্ত! ওই তার জন্মমুহূর্ত।
গাড়িটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল, যেমন বিপদ দেখলে সওয়ারিকে অন্যমনস্ক টের পেলে লাফিয়ে উঠে সাবধান করে দিত তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটা। রমেন চোখ চেয়ে দেখল বাঁকের মুখে তার গাড়ি, সামনে গাছ, ফুটপাথ, ঘুমন্ত মানুষ, দেয়াল। প্রচণ্ড জোরে ব্রেক চেপে ধরেছিল রমেন। স্টিয়ারিঙের সঙ্গে লেগে মট করে ভেঙে গেল তার পাঁজরের একখানা হাড়। রমেন অস্ফুট স্বরে গাল দিল, ইডিয়েট। হেডলাইটের আলোয় আর গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে ফুটপাথে তাদের ছেঁড়া বিছানায় উঠে বসেছিল কয়েকজন ভিখিরি মানুষ। তারা অসহায়ভাবে নিয়তিকে প্রত্যক্ষ করল একবার, তারপর হাই তুলে আবার শুয়ে পড়ল।
বুকে প্লাস্টার নিয়ে শুয়ে থাকত রমেন, মাঝে মাঝে আপনমনে বলত, ইডিয়েট!
সে বছর মা লবকে ডেকে বলল, দেশ ছাড়ার পর আমরা আর দুর্গার পুজো দিইনি। সে জন্যেই এতসব অমঙ্গল ঘটছে। এ বার আমি পুজো দেব। তোমরা ব্যবস্থা করো।
সেবার পুজোয় খুব ধুম লেগেছিল। দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম বড়বাড়ির পুজো। প্রজারা এসেছিল জোট বেঁধে দিগ্বিদিক থেকে। অষ্টমী পুজোর দিন কাশীপুরের বাড়ি ফেটে পড়ছিল ঢাকের আওয়াজে আর লোকজনে।
মায়ের ছিল হার্টের অসুখ। মহাত্মা গান্ধী গডসের গুলিতে মারা গেলে সেই সংবাদ যখন চোঙায় প্রচার করা হয়েছিল, তখন মা অজ্ঞান হয়ে যায়, যদিও মা জানত না, গান্ধী আসলে কে ছিলেন। দাদু মারা যাওয়ার পরও বহু দিনের জন্য শয্যা নিয়েছিল মা। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মায়ের হার্টের অসুখের সৃষ্টি হয়। তারপর রমেনের অদ্ভুত বিয়ের সময়, ইরা যখন পালিয়ে যায়, আর রমেন যখন দুর্ঘটনায় পড়ে তখনও মায়ের শয্যাশায়ী অবস্থা হয়েছিল। রমেন মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে শুনত পাশের ঘরে মা একা একা কথা বলছে গুনগুন করে। মার ধারণা ছিল বাবার আত্মা তার কাছে আসে।
অষ্টমী পুজোর দিন দুপুরবেলা মা গোপনে গিয়েছিল মণ্ডপে প্রতিমাকে বুকের রক্ত নিবেদন করতে। রমেনের জন্য তার মানত ছিল। ছোট্ট একটা ব্লেডের টুকরো ডান হাতের আঙুলে ধরে বুকে সামান্য টান দিয়েছিল মা, তার আগে থেকেই তার মুখ-চোখ সাদা দেখাচ্ছিল। দু’ ফোঁটা রক্ত নেমে সেমিজে পড়তেই মা মুখ নিচু করে তা দেখেছিল। তারপরই ঢলে পড়ল মা। পুরুতঠাকুর সতীশ ভরদ্বাজ আসনের ওপর দাঁড়িয়ে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছিল, তার আসনের কাছেই পড়েছিল মা’র ঘোমটায় ঢাকা মাথাটা। তখন রমেনের প্লাস্টার করা বুক, তবু সে মাকে দু’ হাতে তুলে নিয়েছিল কোলে, কিন্তু স্পর্শমাত্র বুঝতে পেরেছিল সারা দিনের উপবাসী তৃষ্ণার্ত সেই রোগা দেহখানায় প্রাণ নেই।
এখন উৎসবের কলকাতা। মা’র মৃতদেহের অনুগমন করেছিল রমেন। ভিড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে তার মনে হয়েছিল যে সে অসম্ভব এক নির্জনতার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েকজন পথ-চলতি মানুষ মৃতদেহ দেখে সংস্কারবশত জোড়হাতে নমস্কার করেছিল মাকে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় রমেনের চোখে জল এল। সেদিন মর্মান্তিক পথ কীর্তন করেছিল রমণীমোহন, যে ছিল দাঙ্গাবাজ, জেলে-চাষা, করুণ কান্নার সুরে তার ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ শুনে কত লোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
ভিতরে বাইরে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল রমেন। মাঝ রাত্রে ঘুম ভাঙত রোজ। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই লব রোজ শুত রমেনের ঘরের দরজায়। শোওয়ার আগে সে রোজ মন্ত্র পড়ে বাড়ি-বন্ধন করে আসত। লবের দাঁত ছিল না, মুখখানাও ছিল বাঁকা, তাই ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত শব্দ করত সে। ঘুম ভেঙে সেই শব্দ শুনত রমেন। শব্দটা ছিল এমনিতে বিরক্তিকর, কিন্তু সেই একাকিত্বের মধ্যে লব কাছেই আছে জেনে তার ভাল লাগত। কখনও সে শুনত দেয়াল ঘড়ির চলমানতার প্রবল শব্দ, কখনও শুনত টুং টাং আওয়াজ করে ইঁদুর তাদের প্রকাণ্ড গ্র্যান্ডপিয়ানোর তার কাটছে। সেই সময়েই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে একজন কচি উদ্বাস্তু মেয়েকে বিয়ে করে লজ্জাবশত আলাদা হয়ে গেল উদ্ধব। আর লব আরও বুড়ো হয়ে গেল একদিন। তার কাছে রমেনের কোষ্ঠীটা জমা ছিল। বুড়ো-চোখে নিবিষ্ট মনে সে সেইটে দেখত সারা দিন। দেখতে দেখতে চিট হয়ে গিয়েছিল লম্বা কাগজখানা। লব মাথা নেড়ে বলত, কোষ্ঠীতে আছে তুমি ভাল গুরু পাবে। তোমার শনি প্রবল।
রমেন পড়ত বই। কখনও রাজনীতির। কখনও ধর্মের। দুটোকে মেলাতে চেষ্টা করত। সে সময়ে একবার ললিত এসে বলল, চলো, একটু গ্রামের দিকে যাই। আমরা বড় বেশি থিওরিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছি, একটু জন-সংযোগ দরকার।
রমেন আনন্দে রাজি হয়ে কয়েক দিন ঘুরল ললিতের সঙ্গে। ললিত গ্রামে লোক জড়ো করে বক্তৃতা করত। কয়েক দিন ধরে রমেন শুনে বুঝতে পারল, ললিত সেই একই কথা বলছে যা সে কলকাতায় মাঝে মাঝে স্ট্রিটকর্নার করার সময়ে বলেছিল, কিংবা যা বলেছে কলেজের নির্বাচনে, লোকে শুনত। বুঝবার চেষ্টা করত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করত না। তাই একদিন সে ললিতকে বলল, তুই যা বলিস তার ওপর তোর নিজেরই গভীর বিশ্বাস নেই।
ললিত অবাক হয়ে বলল, নেই? কী করে বুঝলি?
রমেন মাথা নেড়ে বলল, যে প্রকৃত বিশ্বাসী তার একটা হাত নাড়ার ভিতর দিয়েও সেটা বোঝা যায়, তাকে অত বলতে হয় না।
ললিত থমকে গিয়ে বলল, সেটা কী রকম?
একটু ইতস্তত করে রমেন উত্তর দিল, আমার দাদুকে দেখেছি যখন তামাকের নলটি বাঁ হাতে টেনে নিতেন তখন তাঁর সেই ভঙ্গির মধ্যেও কোথায় যেন একটা প্রবল ভালবাসার ভঙ্গি ফুটে উঠত, আর বোঝা যেত লোকটির মন বড় স্থির।
ললিত হাসল, তোর সেই জমিদার-দাদু!
রমেন হাসেনি। একটু ভেবে বলেছিল, যদি দাদু জমিদারি ছেড়ে দিতেন এবং প্রজাদের বলতেন তোমরা তোমাদের জমিদার নির্বাচন করে নাও— আমার মনে হয়, দাদুকে তারা বিপুল ভোটে আবার জিতিয়ে দিত। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক নেতা, প্রজারা তাঁর কথাকে বেদবাক্য বলে মানত।
ললিত হেসেছে। মানুষের দেবতা হওয়ার কত অসুবিধে তা বুঝিয়েছে রমেনকে।
রমেন বোঝেনি। কারণ ইতিমধ্যে সে নিজের ভিতরে দেখেছে দাদুর ছায়া। প্রজারা চাইছে তার মধ্যে তাদের জ্ঞানী বুড়োকর্তাকে দেখতে।
একদিন দুপুরে মেডিক্যাল কলেজের সামনের ফুটপাথে একটা বুড়ো লোককে পড়ে থাকতে দেখল রমেন। এ-রকম হামেশা কলকাতায় দেখা যায়। লোকটার গায়ে চিট ময়লা, খোলা মুখের কাছে মাছি উড়ছে, বিজবিজ করছে সাদা কালো দাড়ি। মাথার কাছে উপুড় করা একটা অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটি। বোঝা যায় ওই বাটির ওপর মাথা রেখে শুয়ে ছিল, কোনও কারণে বাটি সরে গিয়ে মাথাটা ফুটপাথে পড়ে গেছে। বে-খেয়াল লোকটাকে পেরিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিরে এল একটু, আবার হেঁটে গেল খানিক দূর। তার ইচ্ছে হচ্ছিল একবার লোকটার নাড়ি ধরে দেখে লোকটা মরে গেছে কি না। ফিরে এল রমেন। লোকটার নিজের পায়খানা পেচ্ছাপের ওপর শুয়ে আছে। হাতে পায়ে লেগে শুকিয়ে আছে সেই সব। গালের পাশে চাপ হয়ে আছে বাসি বমি। দীনতম ভিখিরি একটা, দুরারোগ্য অসুখে ভুগে হয়তো মারা গেছে। রমেন উবু হয়ে বসল তার কাছে, তারপর প্রশ্ন করল নিজেকে, আমি কি এই লোকটাকে ভালবাসতে পারি? সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল যে সে তা পারে না। বরং প্রবল ঘৃণা এবং উদাসীনতা বোধ করল সে। উঠে চলে যেতে ইচ্ছে হল। তবু নিজের ওপর জোর খাটাল রমেন। শরীরের ভিতর থেকে বমির ভাব উঠে আসছিল, ঘেন্নায় কাঁপছিল শরীর, তবু সে লোকটার পড়ে থাকা বাঁ হাতখানা তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল। আশ্চর্য এই যে, লোকটা বেঁচে ছিল। লক্ষ করে লোকটার ছেঁড়া জামার তলায় বুকের ওঠা- নামাও লক্ষ করল রমেন। তারপরই প্রবল ভয় তাকে পেয়ে বসল। এখন সে কী করবে? লোকটা মরে গিয়ে থাকলে তার কোনও দায়িত্ব ছিল না, কিন্তু এখন যখন লোকটা বেঁচেই আছে তখন তার কিছু করা দরকার। অন্তত উচিত একে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ততক্ষণে সমস্ত শরীরে ঘাম দিয়ে দুর্বল বোধ করছে রমেন, বমি আসছে। সে চোখ তুলে দেখতে পেল কিছু কৌতূহলী লোক তার চার ধারে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা দেখছে বিশাল সুন্দর চেহারার এক দয়ালু পুরুষ বসে আছে রাস্তার ভিখিরির পাশে। মহান দৃশ্য। তারা দেখতে চায় সেই দয়ালু মানুষটি কী করেন ভিখিরির জন্য। সবাই অপেক্ষা করছে। তারা পথ-চলতি মানুষ, নিজের কাজে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠেছে মানুষের প্রতি সহানুভূতি। রমেন তাদের চোখে এইসব দেখতে পেল। কিন্তু প্রবল ভয়ে কাঠ হয়ে গেল তার হাত-পা। না, সে এদের সামনে কোনও উদাহরণ স্থাপন করতে পারল না, কেননা সে তত দূর শক্তিমান নয়।
কে একজন জিজ্ঞেস করল, কী বুঝলেন দাদা, বেঁচে আছে?
রমেন নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। না। উঠে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে সে পালিয়ে এল।
ডান হাতখানা অনেক বার ধুয়েছিল রমেন, কিন্তু তবু বহু দিন ধরে তাতে একটা শিরশিরানি অনুভূতি থেকে গিয়েছিল; মনে হত মানুষকে ভালবাসা কত কঠিন।
আর-একবার রমেন প্রবল ভিড়ের ট্রামে যেতে যেতে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। একটা স্টপে বেঁধেছে ট্রাম, রমেন দেখছে একদল স্কুল-ফেরতা বাচ্চা মেয়ে বিকেলের ভিড়ের ট্রামটায় উঠতে চেষ্টা করছে। তাদের মুখ দেখলে বোঝা যায় অনেকক্ষণ তারা দাঁড়িয়ে ছিল গ্রীষ্মের রৌদ্রে, তাদের চুল ধুলোয় ধূসর, মুখ লালচে, চোখে উৎকণ্ঠা। তারা অনেকক্ষণ খায়নি, তারা শিশু তাই বাড়িতে যেতে চাইছে তাড়াতাড়ি, অনেকক্ষণ মাকে দেখেনি। কিন্তু সেই ভিড়ে তারা কেউ উঠতে পারল না। ট্রাম ছেড়ে দিলে একটা বছর সাতেকের মেয়ে তবু প্রাণপণে দৌড়ে আসছিল। সে হোঁচট খেল, হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল হ্যান্ডেল। তারপর ট্রামটা হু-হু করে তাকে ছাড়িয়ে গেল দেখে সে রাগ করে কান্নামুখে চেঁচিয়ে বলল, আমরা কি আজ বাড়ি যাব না?
‘রোখ্কে’ বলে উঠে পড়ল রমেন। ভিড় ঠেলে পরের স্টপে সে নেমে পড়ল ট্রাম থেকে, আবেগবশত। কিন্তু নেমেই বুঝতে পারল যে বোকার মতো একটা কাজ করেছে। এত সামান্য কারণে ট্রাম থেকে নেমে পড়ার কোনও কারণ নেই। সে আবার নিজেকে গাল দিল, ইডিয়েট।
তখন কখনও-সখনও ইরার কথা মনে পড়ে রমেনের। ইরা গর্ভবতী অবস্থায় চলে গিয়েছিল। যদি গর্ভপাত না করে থাকে তবে এত দিনে রমেনের সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। সেই সন্তান হয়তো কোনও দিনই জানবে না যে রমেন তার বাবা। ইরা তাকে সেই কথা বলবে না কখনও। সে হয়তো ছেলেবেলা থেকে হারুর ছেলেকে ডাকবে ‘বাবা’ বলে। এইসব কথা ভেবে মাঝে মাঝে অস্থির হত রমেন।
মাঝে মাঝে ছাদে শুয়ে থেকে সে দেখত আকাশ জুড়ে পড়ে আছে আকীর্ণ ধুলারাশির মতো ছায়াপথ। দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যেত। মনে হত এই পথ গেছে তার পূর্বপুরুষদের কাছে।
তখন রমেন বড় বেশি স্পর্শকাতর। ঠিক বুঝতে পারে না, তবে মাঝে মাঝে মনে হয় খুব সাধারণ জীবন যাপনের জন্য সে জন্মায়নি। তার জন্মের একটা কোনও উদ্দেশ্য আছে। এক-একদিন সে মাঝরাতে উঠে দরজা খুলে লবের ঘুমন্ত দেহ পার হয়ে যেত। কিন্তু চলে যেতে পারত না। ঘর ও বাইরের মধ্যে কী এক অদৃশ্য বাধা আছে যা মনে মনে পেরোতে পারত না সে। কখনও বা সে চোখ বুজে দিকনির্ণয়ের খেলা খেলত আপনমনে, ঘুরে বেড়াত একা একা, চোখ বুজে ঘর থেকে ঘরে ফিরে যেত শৈশবে।
তারপর একদিন সে বুঝতে পারল যে, যেতে হবে।
হাওড়া স্টেশনে তাকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিল লব। বিদায়ের মুহূর্তে খুব জ্ঞানী পুরুষের মতো সে বলেছিল, একেবারে চলে যেয়ো না। একদিন ফিরে এসো। আমাদের তো আর কেউ নেই।
আটাশ
পলাশপুরে ভদ্রলোকের বসত যত বাড়ে ততই ভাল। গাঁখানা ছেলেবেলা থেকেই রক্তে মিশে আছে। আগে একেবারেই চাষাভুষোর গাঁ ছিল। এখন ধানকল, বি ডি ও-র অফিস, জাতীয় সড়ক আর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল হয়েছে। আরও ভদ্রলোক আসুক, বসত বাড়ুক। বর্ণ হিন্দুরা না থাকলে গাঁ গ্রামের মধ্যে নিরেট একটা অন্ধকার টের পাওয়া যায়। বউ পেটানো, ছেলেকান্না, মুখখিস্তি। বসন্ত সিংহি জন্মকালেও এ-গাঁয়ের বাতাসে একছত্র সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারিত হতে শোনেনি। চালচলনে কারও সহবত ছিল না। লোকে বুঝত তালের রস মানেই তাড়ি। এখন গাঁয়ের চেহারা পালটেছে। ভদ্রলোক এবং সত্যিকারের ভদ্রলোক আরও আসুক। ঝলমল করে উঠুক গাঁখানা।
তুলসীকে তাই নিজের বাড়িখানা সযত্নে ঘুরে ঘুরে দেখাল বসন্ত সিংহি। উঠোনে টিউবওয়েল, পাকা পায়খানা, উঁচু ভিতের বাড়ি। বিধবার সম্পত্তি। খুড়িমা শেষ জীবনটা বসন্ত সিংহির ঘাড়ে পড়েছিল। বদলে লিখে দিয়েছিল জমিখানা। উনিশশো পঞ্চাশে তুলেছিল বাড়িখানা। টিনের চালওলা দু’খানা পাকা ঘর, পাকা ভিত। সরকারি অফিসকে ভাড়া দেওয়ার মতলব ছিল। কিছু দিন ব্রিজ-কনস্ট্রাকশনের অফিসাররা থেকেছিল। তারপর এক সময়ে জুনিয়ার হাইস্কুলটা এক লাফে হাই হয়ে গেল, বাঙালদের আগমনে বসতি বেড়েছিল কিছু, স্কুলে ছেলে ধরে না। তখন উঁচু দিকের কয়েকটা ক্লাস বসত এইখানে। মাগনাই ছেড়ে দিয়েছিল বসন্ত। আহা, বিদ্যাশিক্ষা হলে বাড়ি পবিত্র হয়।
তুলসী উঠোনের পিছন দিকটা ঘেরা নেই বলে ভ্রূ কোঁচকাল, ও-পাশ থেকে বাড়ির ভিতরটা যে দেখা যায়!
বসন্ত সিংহি হাসে, দেখা যায়! কিন্তু দেখবে কে? ওদিকটা পতিত জমি, জঙ্গল।
শেয়াল-ফেয়াল ঢুকে পড়তে পারে।
ঘিরে দেব। ভাববেন না।
ভদ্রলোক আসছে পলাশপুরে। তার জন্য না হয় খরচা একটু হলই।
ভাড়া মাত্র ত্রিশ। তুলসী মনে মনে খুশিই হচ্ছিল। এই বাসাখানা তার হবে। একান্তই তার আর মৃদুলার। সে পরিবারের কর্তা। ব্যাপারটা ভাবাই যায় না। এতকাল পরে স্বাধীন হচ্ছে তুলসী।
তুলসী তবু বলল, একদিন আমার ওয়াইফকে নিয়ে আসব। সে পছন্দ করলে তবে—
বসন্ত সিংহি হাসে, মা লক্ষ্মী কলকাতার মানুষ। পছন্দ হবে না জানি। তবে দেখবেন থাকতে থাকতে অসুবিধেগুলো আর লাগবে না।
সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে মৃদুলাকে গোপনে বাসাটার বর্ণনা দিল তুলসী।
মৃদুলা ম্লানমুখে বলল, আমার এ অবস্থায় টিউবওয়েল পাম্প করা কি সম্ভব হবে?
দূর! ও তো আমি করে দেব। তখন হাতে কত সময় পাওয়া যাবে। সকাল থেকে পৌনে এগারোটা পর্যন্ত ছুটি। আবার বিকেলে তিনটে কি চারটে থেকে। অত সময় নিয়ে আমি করব কী? কত ঘরের কাজ করে দেব দেখো।
মৃদুলা তারপর শুকনো মুখে বলে, দাদাকে কীভাবে বলবে? মুখোমুখি বলতে পারবে?
তুলসীর দাদা নারায়ণ গম্ভীর মানুষ। একটু বোকাও। ছেলেবেলায় সবাই বলত বোকা নারাণ। গবেট ছাত্র ছিল। কিন্তু ঘষে ঘষে বেরিয়ে গেল ঠিকই। যে বছর পাকিস্তান হয় সে বছর পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান দু’ জায়গায় ম্যাট্রিক দিয়েছিল নারায়ণ। দুটোতেই পাশ করেছিল থার্ড ডিভিশনে। তারপর বি এ পর্যন্ত পাশ করে ফেলল ব্যাঙ্কে কেরানির চাকরি করতে করতে। নোয়াখালি ব্যাঙ্ক ফেল করলে চাকরি পেল রেলে। দুরে বদলি করায় চাকরি ছেড়ে ঢুকল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাজনা বিভাগে। সবাই বলত নারায়ণের কপালটাই ভাল। সেই তুলনায় ছাত্র ভাল ছিল তুলসীই। কিন্তু কার্যকালে তুলসী মফস্সলের মাস্টার। দাদা অফিসার, নাকতলায় দেড় কাঠা জমি কিনেছে। এখন খুব গম্ভীর দেখায় দাদাকে। মুখোমুখি আলাদা বাসা করার কথা বলতে ভরসা পায় না সে। বিয়ের পর এখনও মাস দুয়েক কাটেনি, এর মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা বলাই যায় না।
তবু বলতেই হবে।
তুলসী একটু ভেবে বলে, টেলিফোনে বলব।
মৃদুলা হেসে ওঠে, কী বুদ্ধি!
তবে?
মৃদুলা ম্লানমুখে বলল, যে ভাবেই আলাদা হও ঠিক আমার ঘাড়ে দোষ পড়বে।
অনেক দিন হয় মৃদুলা তার মা আর ভাইকে দেখে না। বাবাও সময় পান না আসার। এক-একবার ইচ্ছে করে বেহালার বাসায় যায়। কাপড়ের ঢাকনা-দেওয়া তানপুরাটা এখনও দাঁড় করানো আছে শোওয়ার ঘরের বেঞ্চিটার এক কোণে। পাশে রাখা আছে গদিতে ঢাকা তবলা আর পেতলের ডুগি। ধুলো পড়ছে। বাবাকে বলেছিল ওগুলো দিয়ে যেতে। বাবা আনেনি। পলাশপুরে চলে যাওয়ার আগে একবার বেহালার বাসায় ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে খুব। কত কালের পুরনো বাসা তাদের, চোখ বেঁধে দিলেও মৃদুলা ঠিক এ-ঘর ও-ঘর চলে যেতে পারবে। কিন্তু যাওয়া যায় না। এখনও বিভুর দলবল ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে।
রাত্রে শোওয়ার আগে মৃদুলা একটা পোস্টকার্ডে মাকে চিঠি লিখে জানাল যে তারা শিগগিরই পলাশপুরে বাসা নিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষে লিখল, একবার পলাশপুর এসো। কলকাতায় তো আর দেখা হবে না। আমার খবর তো জানোই। আর সাত-আট মাস পরে কী হবে ভাবতেই ভয় করে। যদি না-বাঁচি তবে আর দেখাই হবে না। পলাশপুরে কিছু দিন গিয়ে থেকে এসো বাবা আর টুপুকে নিয়ে…
লিখতে লিখতে কয়েক বার চোখের জল মুছল মৃদুলা।
রাত্রে পাশাপাশি খেতে বসে তুলসী কাঁপা বুকে একসময়ে দুম করে কথাটা বলে ফেলল। আশ্চর্য এই, নারায়ণকে খুব দুঃখিত বা ভেঙে পড়া দেখাল না। বরং মুখের রেখাগুলো সহজ আর চোখ দুটোয় একটু অবিশ্বাসের ভাব দেখা গেল। যেন স্বস্তি।
বলল, কীরকম বাসা? ভাল?
খুব। এক্কেবারে আলাদা।
কেবল পিতু ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল, কাকিমাকে নিয়ে যাবে?
তুলসী মাথা নিচু করে রইল।
বউদি ধমক দিয়ে বলল, না তো কী! হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে দু’ বেলা? তারপর তুলসীর দিকে চেয়ে হেসে বলল, একটা তবু জায়গা হল বেড়াতে যাওয়ার।
বউমার যত্ন-টত্ন নিতে পারবি তো!
খামোখাই মৃদুলাকে বউমা ডাকে নারায়ণ। ওর মুখে বেমানান আর বুড়োটে লাগে। নাম ধরে ডাকলেই তো পারে। আসলে নারায়ণের ধারণা বাবার অভাবে সে-ই তুলসীর বাবার জায়গা দখল করে আছে।
খুবই নিশ্চিন্ত লাগল তুলসীর। কথাটা বলে ফেলা গেছে।
রাতে মৃদুলা ঘুমোয়। দুশ্চিন্তায় জেগে থাকে তুলসী। দেখে, কেমন লাবণ্যহীন হয়ে গেছে মৃদুলার মুখ। ঠোঁট শুকনো, চোখের কোল কালো, হনুর হাড় দুটো জেগে উঠছে। রাতে খাওয়ার পরই বমি হয়ে গেছে। ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে বিকেলে দুটো চপ এনেছিল তুলসী। মশারির মধ্যে বসে সেই চপ দুটো খাচ্ছিল যখন তখনই মৃদুলাকে খারাপ দেখাচ্ছিল। আজ সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিল মৃদুলা, মুখখানা হাঁ করা, গাল বসা, শরীরটা যেন মুচড়ে আছে ব্যথা-বেদনায়। ওর খোলামেলা বিশৃঙ্খল শরীর দেখে একটুও কাম জাগেনি তুলসীর। বরং বড় উদোম মাঠের মধ্যে যখন হাওয়া বয়ে যায় তেমনি হা-হা করে উঠেছিল তার বুক, মৃদুলা কি বাঁচবে?
তুলসী ঠিক করল এবার থেকে সে ভিখিরিকে ভিক্ষে দেবে, যথাসম্ভব ভাল কাজ করবে রোজ দু’-একটা, পবিত্র থাকবে। থাকা দরকার। মাঝে মাঝে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যাবে মৃদুলাকে।
পলাশপুরে নিয়ে গিয়ে একটুও কাজ করতে দেবে না মৃদুলাকে। সে জল তুলবে নিজে, বিছানা পাড়বে, রান্নার লোক রাখবে একজন, যদি পয়সায় কুলোয়। পলাশপুরে গেলে সব হবে।
ললিত একদিন হাসপাতাল থেকে চেক-আপ করিয়ে এল। অল্পবয়সি ডাক্তারটি হেসে বললেন, শরীর তো ঠিক আছে। এবার কাজকর্মে লেগে পড়ুন। ঘরে বসে থাকার আর দরকার নেই।
আবার যেন সেই পুরনো দিনে ফিরে গেছে ললিত। ক্লাস-ঘরের নোংরা দেয়ালে পেন্সিলে লেখা জ্যামিতির উপপাদ্য, ইতিহাসের রাজাগজার নাম আর সন-তারিখ, বিজ্ঞানের যন্ত্রের ছবি, কিংবা সরল অঙ্ক, ভূগোলের জলবায়ু। যত দূর হাত পৌঁছেছে তত দূর দেয়ালে যথাসম্ভব লিখেছে ছেলেরা। হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা গেছে কিছু দিন আগেই।
পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায় ললিত। ছেলেদের মুখগুলি বাতাসে ভেসে ভেসে হঠাৎ কতগুলি শূন্য হয়ে যায়। পড়ানো থামিয়ে ললিত জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। পশ্চিমের আকাশে মেঘস্তর। কখনও বা দেখে তিনতলার ছাদ থেকে উড়ছে মেরুন রঙের শাড়ি। কখনও বা জানালার পাশের দেয়াল বেয়ে একটা বেড়াল কেমন নিঃশব্দে হেঁটে লাফ দিয়ে কার্নিসে উঠে যায়। কত হাজার দৃশ্য দেখা যায়।
আজকাল তার ক্লাসে ছেলেরা খুব একটা শব্দ করে না। আগে গল্প বলুন স্যার বলে জ্বালিয়ে খেত, আজকাল নিঃশব্দে চেয়ে থাকে। ললিত স্যার তাদের বড় প্রিয় ছিল। কেউ হয়তো তাদের বলে দিয়েছে যে, ললিত স্যার আর বেশি দিন থাকবেন না। তাই কখনও কখনও ললিত টের পায় মুখের ভিড়ের ভিতরে একটি-দু’টি চোখ যেন তার দিকে চেয়ে ছলছলিয়ে ওঠে।
গিরিজা হালদার ক্যাশ ক্লার্ক। জালে-ঘেরা কাউন্টারের ও-পাশে বসে থাকে, তার গম্ভীর হিসাবমনস্ক মুখ। আগে মাঝে মাঝে কাউন্টারের ঘুলঘুলির সামনে ক্লাসে যাওয়ার পথে ললিত দাঁড়িয়ে দেখত হালদার কালেকশনের টাকা গুনছে। সে ঘুলঘুলির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে অদৃশ্য রিভলভার উঁচিয়ে বলত, হ্যান্ডস আপ। হালদার হাসত। কখনও বা অকারণে হালদারের সামনে রাখা রবার স্ট্যাম্প তুলে দেয়ালে ছাপ বসাত। হালদার চেঁচিয়ে কপট রাগ দেখাত।
পোলাপান আর কারে কয়? আপনে কি ছ্যামরাগো পড়াইতে আহেন, না তাম্শা করতে? তবু ললিতের এই ছেলেমানুষি হালদারের প্রিয় ছিল। বিনা দরখাস্তে অনেক বার ললিতের ক্যাজুয়াল ছুটি মঞ্জুর হয়েছে, যা ললিত টেরও পায়নি। আজকালও ঘুলঘুলির সামনে দাঁড়ায় ললিত। হালদার শরীর ঠিক রাখার উপদেশ দেয়, চোখে চোখ রাখে না। রবার স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে আগের মতোই দেয়ালে ছাপ বসায় ললিত, হালদার আপত্তি করে না, কেড়ে নিতে হাত বাড়ায় না। যত খুশি স্ট্যাম্প মারো, ইচ্ছেমতো মেরে নাও। আর কী কী করতে ইচ্ছে করে তোমার? খেলাটা তাই জমে না। রবার স্ট্যাম্পটা রেখে দেয় ললিত। মায়ের সঙ্গে সেই লুডো খেলাটাও জমেনি। এখন সবাই তাকে দান ছেড়ে দেয়।
তবু সেই পুরনো স্কুলবাড়িতে সেই পুরনো দিনগুলির স্মৃতি ছায়ার মতো দোল খায়। টিচার্স রুম-এর দেয়ালে বিখ্যাত মনীষীদের উইয়ে-খাওয়া ফোটো। সেই আলমারির ওপরে গ্লোব। মেয়ে-দেখা চেয়ার, যে-চেয়ারে বসলে রাস্তার পথ-চলতি মেয়েদের দেখা যায়। বিভূতিবাবুর সঙ্গে অনেক বার চেয়ারটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে ললিত। এখন চেয়ারটা তার জন্য খালি রাখা হয়। ললিত বসে না।
ক্লাস এইটের মাধব মুকুন্দ-বেয়ারার ছেলে। টিফিনে সে ক্লাস থেকে এসে মাস্টারমশাইদের চা দিয়ে যায়। ছেলেরা সেই কারণে তাকে খেপায়। মাধব এখন বড় হয়ে গেছে একটু। স্কুলের ফুটবল টিমে খেলছে। বাপ তাকে ক্রমশ সমীহ করছে। ললিত লক্ষ করে এ-সব।
ক্লাস নাইনের হরেনকে দেখে অনেক দিন আগেকার একটা দৃশ্য মনে পড়ে যায়। হরেনকে ভরতি করতে এসেছিল ফরসা গোলগাল সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। পোশাকে বনেদিয়ানা, স্কুলের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। লোকটাকে চিনতে পেরেছিল ললিত। একসময়ের বন্ধু। ললিত পরিচয় দিতেই লোকটা একটু ঘাবড়ে গেল, হেসেটেসে বলল, তুমি এই স্কুলে! বাঃ বেশ ভালই হল।
ললিত জিজ্ঞেস করল, কাকে ভরতি করতে এসেছ?
লোকটা খুব অপ্রস্তুত হয়ে লাজুক অপরাধী গলায় বলল, আমি তো জানতাম না যে, তুমি এই স্কুলে আছে। আমি—
গলা খুব নিচু করে ললিতের কানে কানে বলল, যাকে ভরতি করতে এনেছি সে আমার ডোমেস্টিক সার্ভেন্ট। পড়াশুনোয় ঝোঁক আছে বলে— বলতে বলতে লাল হয়ে গেল লোকটা।
সাম্যবাদে বিশ্বাসী ললিত। তবু হঠাৎ তার মনে একটা কোথাও ধাক্কা লেগেছিল। সেটা নিশ্চয় দুর্বলতা। আমি শালা তোমার চাকরকে পড়াব? পরমুহূর্তেই দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে অতিরিক্ত উৎসাহে ললিত চেঁচিয়ে উঠেছিল, খুব ভাল, এই তো চাই।
ললিত হরেনকে বেশিরকম নজরে রাখত। লাভ হয়নি। হরেনের মাথা ভাল না, বোকা। কিন্তু বহুকাল হরেনের কাছে সহজ হতে পারেনি ললিত।
মাঝে মাঝে সঞ্জয়ের টেলিফোন আসে। ললিতকে ক্লাস থেকে ডেকে আনে বেয়ারা, হেডমাস্টার হাত বাড়িয়ে রিসিভার তার হাতে দেয়, তারপর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। নিয়ম হল, ফোন এলে কাউকেই ক্লাস থেকে ডেকে দেওয়া হবে না, তাতে ক্লাসের ক্ষতি। শুধু ‘ফোন এসেছিল’ এই খবরটা দেওয়া হবে। কিন্তু ললিতের বেলায় এই নিয়মটা ভাঙা হয়েছে। হেডমাস্টারের যে-চোখে ললিতের দিকে তাকানো উচিত ঠিক সেইভাবে উনি আজকাল তাকান না, বরং তাঁর চোখে একটা ‘আহা’ ভাব।
এ-সবই হয়তো সত্য। কিংবা ললিত কল্পনা করে। আজকাল সে বড় স্পর্শকাতর হয়ে গেছে।
অক্টোবরের প্রথম থেকেই শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধেবেলা কুয়াশা হয় আজকাল। রাত গভীর হলে জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে একটা বিদেশি রহস্যময়তাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। পুজোর ছুটির আর দেরি নেই।
একদিন টিফিনের আগে তুলসী এসে হাজির।
চল, একটা সিনেমা যাই।
সিনেমা!
ললিত সিনেমার কথা ভুলেই গিয়েছিল। কতকাল আর সিনেমা দেখা হয়নি।
তুলসী বিমর্ষ মুখে বলে, পলাশপুরের বাসার ভাড়া আগাম দিয়ে এলাম। পুজোর ক’টা দিন কাটিয়ে লক্ষ্মীপুজোর পর চলে যাচ্ছি। আর সিনেমা-ফিনেমা দেখা হবেই না।
টিফিনেই বেরিয়ে পড়ল দু’জন। ললিত হেডমাস্টারকে বলতেই উনি ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, চলে যান, ক্লাস ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে।
ম্যাটিনিতে একটা বেলেল্লা ছবি দেখল দু’জনে। ললিতের মনটা খারাপ ছিল। তুলসীটা দূরে চলে যাচ্ছে। এখন কেউ একটু দূরে যাচ্ছে শুনলে কেমন যেন হাহাকারে ভরে যায় বুক। আর কয়েকটা মাস থেকে যেতে পারলি না তুলসী? আমার খাটের এক কোণে তোর কাঁধ দেওয়ার কথা ছিল যে! দিবি না? অতদূরে কে তোকে খবর দেবে সময়মতো?
পর্দার চলন্ত ছবির দিকে চেয়ে দু’ চোখ ভরে জল আসছিল। হয়তো বহুকাল পরে দেখছে বলেই পরদার আলো চোখে সহ্য হচ্ছে না, কিংবা হয়তো মন অজান্তে তুলসীর চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। চেয়ারের হাতলে রাখা তুলসীর রোগা হাতখানার ওপর নিজের হাতখানা রাখে ললিত। অন্যমনস্কভাবে বসে থাকে। অনুভব করে সুখে দুঃখে তাদের পুরনো বন্ধুত্ব।
সিনেমার পর তুলসী বলল, চল একটু হাতিবাগানে গিয়ে পুজোর জামা-কাপড় কয়েকটা কিনে আনি। সাউথে বড্ড দাম।
তুলসীর পকেট গরম। সিনেমা হলের সামনে ছ’টার শোয়ের একটা দল নামছিল ট্যাক্সি থেকে। খোলা দরজা দিয়ে ফুড়ুত করে ট্যাক্সির মধ্যে চলে গিয়ে তুলসী ডাকল, আয়।
সেই পুরনো দিনের মতো। অবিকল পুরনো দিনের মতো।
ট্যাক্সি থামিয়ে মিষ্টির দোকানে তারা ছানার মিষ্টি খায়।
তুলসী খুশি গলায় বলে, খা। যা খুশি খা।
ফাঁসির খাওয়া খাওয়াচ্ছিস!
মৃদুলার জন্য একটা বিষ্ণুপুরি সিল্কের শাড়ি কিনল তুলসী। লাজুক গলায় বলল, আমি ওকে সোনাদানা কিচ্ছু দিইনি। প্রথম পুজোটা বিয়ের পর, তাই। নইলে তাঁত-ফাঁত দিতাম।
ললিতের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। অনেককাল মাকে কাপড়-চোপড় দেওয়া হয়নি। মা কখনও কিছু বলে না। আগেকার পাড়ওলা শাড়িগুলোই এখনও পরে।
কে জানে তার জীবনের এটাই শেষ পুজো কি না। একটা সরু কালোপেড়ে কাপড় মায়ের জন্য কিনল ললিত। আর একটা সুন্দর ছাপা শাড়ি কিনল।
তুলসী অবাক হয়ে বলে, শাড়ি কার জন্য?
তোর বউয়ের জন্য। চল, আজ তোর বউকে দেখে আসি। তুই তো শালা ডাকলিই না।
তুলসী ভীষণ খুশি হয়, বলে, চল শালা, মালটা দেখিয়ে দিই।
বড় মিষ্টি বউটি তুলসীর। ললিতের নাম শুনে প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। একটু অবাক চোখে দেখল ললিতকে। তারপর হাতজোড় করে বলল, ওঃ—আপনিই—আপনিই—
এর চেয়ে বেশি কিছু তার বলার নেই। ললিত বোঝে।
শাড়িটা দিতেই ভীষণ লজ্জা পায় মৃদুলা। ‘এ-সব কেন’ বলে মৃদু আপত্তি করে আদরে শাড়িখানা নিয়ে বুকের কাছে ধরে রাখে একটু। ললিত নামে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর দেওয়া বলে শাড়িখানাকে মনে মনে সম্মান করে সে। এ-সবই বুঝতে পারে ললিত।
পিতু এসে ললিতের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বলে, ললিতকাকা, সেই কবে বলেছিলে একটা সিনেমা দেখাবে—
তুলসীর বউদি আসে। চোখ বড় করে বলে, ওঃ মা! কী ভাগ্যি ঠাকুরপো! কী একটু অসুখ হয়েছিল শুনলাম, তারপর থেকে দেখা নেই!
বাচ্চারা ঘরে এসে ভিড় করে।
এ-রকম চমৎকার দিন আসে এক-একটা। ঠিক সেই আগেকার মতো স্বাভাবিক, সুন্দর, হালকা দিন। তখন ব্যাধিটার কথা মনেও থাকে না।
তুলসীর বউ দুধের গ্লাস আর সন্দেশ নিয়ে এসেছিল। তাকে ফিরিয়ে দিল ললিত। বলল, ও-সব নয়। চা খাব। অনেককাল খাই না।
মৃদুলা ইতস্তত করছিল, তুলসীর দিকে তাকিয়েছিল একটু, ললিত হালকা ধমক দিল, চা আনুন।
অনেকক্ষণ সময় কাটাল ললিত।
মৃদুলা বলল, একবার পলাশপুরে আসবেন। ওখানে তো আমাদের সময় কাটবে না।
যাবে। ললিত যাবে।
বেরোবার মুখে তুলসী সঙ্গ ধরে বলল, চল পৌঁছে দিয়ে আসি। ললিত তাকে ফিরিয়ে দেয়, দূর শালা, নিজেকে একটু নর্মাল ভাবতে দে আমাকে।
একা একা রাস্তায় খানিক ঘুরল ললিত। স্বপ্নের মতো এক-একটা দিন আসে, যখন আগেকার সবকিছু ফিরে পাওয়া যায়।
সন্ধে পার করে ফেরার পথে বাসায় না ফিরে বিমানকে দেখতে গিয়েছিল ললিত।
বন্ধ দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পেল, ভিতরে বিমান একা একা অনর্গল কথা বলছে।
আজ বিমানের চোখ অনেকটা ঘোলাটে লাল হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে কথার তাল থাকছে না।
সে জোর করে মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করছিল। ললিতকে দেখে ক্ষীণ শুকনো হাসি হাসল একটু। এনে বসাল বিছানার ওপর। তারপর নিজের হাতে চা করতে বসল। অনেক বার চায়ের বাসনকোসন কেটলি, চামচ, জমাট দুধের কৌটো গোলমাল করে ফেলছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় আধ ঘণ্টার চেষ্টায় সে দু’ কাপ চা বানিয়ে ফেলল। চা বানাবার সময়ে অনর্গল কথা বলছিল সে, কাকে বলছে তা সবসময়ে খেয়াল থাকছিল না। মাঝে মাঝে হাসছিল।
ললিত তাকে জোর করে পাশে বসাল। কাঁধে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে বিমান?
বিমান কথার তাল রাখতে পারছে না। কেবল বড় কষ্টের সঙ্গে বলে, সব ব্যাপারই কেমন খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে দেখছ! অথচ কত সুন্দর হতে পারত সবকিছু!
অনেকক্ষণ তারপর চুপ করে থাকে বিমান। আস্তে আস্তে বলে, এবার আমার একদম ইচ্ছে করছে না।
কী? ললিত আকুল প্রশ্ন করে।
এই পাগল হয়ে যেতে।
বড় কষ্ট হয় ললিতের। চুপ করে থাকে।
ফেরার পথে অশ্বত্থ গাছটার তলায় ঝুঁঝকো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় ললিত। ভাবে। সে নাড়াবুনে হয়েও একদিন সেজেছিল কীর্তনীয়া। মানুষের মুক্তির কথা বলেছে কত! হায়, এই পাগলের জন্য সে কিছুই করতে পারে না।
রাতে ঘরে ফিরে ললিত শুয়ে ছিল একা। চুপচাপ। শরীর ভাল ছিল না, তার চেয়েও খারাপ ছিল তার মন। কোনও একটা দিনই সম্পূর্ণ ভাল যায় না কখনও। তার মাথার মধ্যে বিমানের কথা দু’টি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এইবার আমার একটুও ইচ্ছে করছে না, পাগল হয়ে যেতে।
কত কথা ভাবে ললিত। এক দুঃখবোধ আরও দুঃখের ঝরনা খুলে নেয়। বুকের ভিতরে কী একটা খামচে ওঠে। আর কত দিন! কত দিন আর! সে মরে যাওয়ার পরও সবাই থেকে যাবে। তুলসী হাঁটুর ওপর ধুতি তুলে স্কুলে যাবে। সঞ্জয় গাড়ি চালিয়ে ফিরবে তার রিনি আর পিকলুর কাছে। শাশ্বতী হয়তো তার প্রেমিকের সঙ্গে হেঁটে যাবে দোকানের আলোয়, ফুটপাথ ধরে, অনির্দিষ্টভাবে। কিংবা আদিত্যই ফিরে আসবে নাকি! আহা আদিত্য! কত দিনের বন্ধু তার! কেটে গেল শালা। আবার আসবে কি ফিরে! ললিত মরার আগে এসে ডাকবে, কী রে লোলিটা?
শম্ভু এসে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, ললিতদা, একজন আপনাকে খুঁজছে।
আলসেমি ভেঙে উঠল ললিত।
গলির মুখে এসে দেখল আবছায়ায় একটা লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টিনের সুটকেস আর ছোট্ট বিছানা।
কে?
ললিত, আমি রে, আমি রমেন। তোর কাছে এলাম।
হঠাৎ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল ললিতের বুক। কতকাল…কতকাল দূর থেকে তার কাছে কেউ আসেনি!
রমেন! দু’হাত বাড়িয়ে ললিত বলল, আয়।
উনত্রিশ
যে-রমেন চলে গিয়েছিল, ললিত জানে, সে-রমেন ফিরে আসেনি। এ অনেক দূরের একজন মানুষ। কোন রহস্যময় অচেনা জগৎ থেকে এসেছে। এ হয়তো এমন কিছু জানে যা ললিতের এতকাল জানা ছিল না। যে রমেন গাড়ি চালাত, সাঁতার দিত, ফুটবল খেলত কিংবা পিয়ানো বাজিয়ে গাইত পুব বাংলার মাঝিদের গান, সে এ নয়।
উঠোনের এক কোণে আধো-অন্ধকারে যখন কুঁজো হয়ে রমেন হাত-মুখ ধুচ্ছে, তখন ললিত দরজায় দাঁড়িয়ে সেই আবছায়া দীর্ঘ মূর্তিটিকে দেখছিল। বড় অচেনা লাগে। বড় দূরের। এর সঙ্গে হয়তো আর আড্ডা জমবে না।
রমেন আলোতে এলে তার সুন্দর মুখে নিস্পৃহতা লক্ষ করে ললিত। শান্ত ভাব। আত্মস্থ। হয়তো এ-রকমই ছিল বুদ্ধের মুখ। না কি এ-মুখ নির্বোধের? যে যা নেই তাকেই বিশ্বাস করে বৃথা আয়ুক্ষয় করে! যে প্রজাদের বর্ণাশ্রম মানতে শেখায়! শেখায় বিবাহ-সংস্কার! ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেজে মানুষকে তার সংগ্রামের ইতিহাস থেকে প্রান্তর-প্রান্তর দূরে নিয়ে যায়!
রমেন ললিতের মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। বলে, তোর চিঠি পেয়ে এলাম। টাকা শোধ দিতে ডেকেছিস!
ললিত লজ্জা পায়। বলে, না রে। টাকা তো মানিঅর্ডার করেও পাঠাতে পারতাম।
তবে!
ললিত ইতস্তত করে বলে, তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। কেমন আছিস রমেন?
রমেন মিটিমিটি হাসে।
ক্যান্সারের কথা রমেনকে লিখেছিল ললিত। কিন্তু রমেন তার ব্যাধির কথা জিজ্ঞেসও করল না। বলল না, কেমন আছিস!
মা এলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাকে প্রণাম করে রমেন। এ-রকম প্রণাম ললিত আর দেখেনি। তার বন্ধুরা বিজয়ার পর ছাড়া বড় একটা প্রণাম করে না মাকে। তাও দায়সারা, পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকানো।
চিনতে পারছেন?
মা চিনতে পারল না।
ললিত বলল, ও অনেক বার এসেছে আমাদের বাসায়। রমেনকে তুমি কত দেখেছ!
মা বলে, তখন হয়তো ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
রাতে পাশাপাশি বালিশে মুখোমুখি শুয়ে অনেক কথা বলল তারা। কত কথা জমে ছিল ললিতের। বলতে বলতে বহুবার উঠে সিগারেট ধরাল ললিত, উত্তেজিত হয়ে উঠল, ক্লান্ত হল। অবশেষে ঘুমে জড়িয়ে এল চোখ। তখন একসময়ে ক্লান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার অসুখের কথা জিজ্ঞেস করলি না, রমেন?
সে-কথার উত্তর দিল না রমেন। তার একখানা হাত অন্ধকারে ললিতের কাঁধে এসে পড়ল। রমেন বলল, আয় ললিত, আগের মতো আবার আমরা একটা কমিউন তৈরি করতে চেষ্টা করি।
কমিউন! ভীষণ অবাক হয় ললিত। কমিউন! একটা অতীত স্বপ্নের ছায়া তার চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যায়। একপলক পরে সে সচেতন হয়ে বলে, ঠাট্টা করছিস?
রমেন ধীর গলায় বলে, না রে।
ললিত মৃদু হেসে বলে, তবে, সে কি হবে ধর্মীয় কমিউন! সেখানে কি গরিবকে বলা হবে, তোমরা এই জাগতিক দুঃখ হাসিমুখে বহন করো, পরকালে স্বর্গলাভ করবে! আর ধনীকে বলা হবে, তোমাদের সঞ্চিত সম্পদ কিছু কিছু দান করো, তোমরাও স্বর্গের অধিকারী হবে! এইভাবেই ধর্ম সাম্য আনার চেষ্টা করেছে, আমরাও তাই করব?
রমেন আস্তে করে বলে, তা নয়।
ললিত হাসে। বলে, তুই কর। আমাকে ছেড়ে দে। লাতন হয়ে পড়ে আছি। দুম করে একদিন রওনা দেব।
রমেন হাসে। বলে, যতই তোকে আয়ু দেওয়া যাক, ততই তুই আরও আড্ডা দিবি, চা খাবি, দায়সারা চাকরি করবি— কিন্তু তারপরও তো একদিন মরতেই হত! আয়ু দিয়ে কী করবি ললিত?
ললিত ঘুমচোখে হাসে। বলে, কী করব… কী করব… অনেককিছু করব রে! বিকেলে আমাদের উঠোনে একটা অদ্ভুত আলো এসে পড়ে, কোনও দিন লক্ষ করিনি, সেই আলোটুকু রোজ চুপ করে বসে দেখব একা-একা।…ঠিক দুপুরবেলা, মা যখন একা থাকে, সেই সময়ে ওই জানালার পাশে চৌকিতে বসে লুডো খেলব মায়ের সঙ্গে, পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে একটু রোদ এসে পড়বে মায়ের মুখে। …একটা প্রেম করব, বুঝলি? সন্ধের পর কলকাতার রাস্তায় দোকানের যে আলো পড়ে, সেই আলোয় তার পাশে পাশে হাঁটব…বিয়ে করব। …প্রথমে একটা মেয়ে হবে। তার শিশুমুখের গন্ধ নেব বুক ভরে।…তারপর আস্তে আস্তে বুড়ো হব…অসুখ হবে…মরে যাব…
রমেন, আস্তে হাসল। বলল, তার চেয়ে এই তো ভাল।
কী ভাল?
মৃত্যুর সময়টা জানা থাকা ভাল। এটা তো একরকমের সৌভাগ্য, যখন মানুষ জানতে পারে আর ঠিক ক’টা দিন তার হাতে আছে।
তাতে কী হয়?
আয়ু ফুরিয়ে আসছে জানলে মানুষ খুব চনমনে হয়ে ওঠে। সচেতন হয়। তখন চেষ্টা করলে সে সাত দিনে একশো বছরের জ্ঞান লাভ করে চলে যায়।
ললিত অলসভাবে হাসে। বলে, কে চায় জ্ঞানলাভ করতে?
রমেন হঠাৎ একটা উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে, কারও কারও মৃত্যু পালকের মতো হালকা। কারও কারও মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী।
ললিতকে কথাটা চাবুকের মতো স্পর্শ করে। সে চুপ করে থাকে। এটা কার উদ্ধৃতি তা তার মনে পড়ে যায়।
রমেন ধীর স্বরে বলে, মৃত্যুটা দুঃখের নয়। ও তো আছেই। দুঃখের সেটা যখন মানুষ কর্তব্য না করে চলে যায়। সে যে-খাদ্য খেয়েছিল, যে-পোশাক পরেছিল, পেয়েছিল যত ভাল ব্যবহার, তার সবকিছুর ঋণ রেখে চলে যায়। …ললিত, মনে পড়ে?
ললিত চুপ করে থাকে।
রমেন বলে, অকৃতজ্ঞ মানুষই সভ্যতার সব ফসল ভোগ করে নির্লজ্জের মতো, বদলে সভ্যতাকে কিছুই দেয় না।
ললিত হাসে ঘুমচোখে। তারপর মাথাটা এগিয়ে দেয় রমেনের বুকের কাছে। রমেন একখানা হাত রাখে ললিতের মাথা স্পর্শ করে। বলে, ঘুমো।
ললিত ঘুমোয়। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেই বিদ্যুতের মতো কী যেন স্পর্শ করে তাকে। অন্ধকারে পাশ ফেরার সময়ে সে অস্ফুট গলায় ডাকে, রমেন!
সঙ্গে সঙ্গে শান্ত ধীর গলায় উত্তর পায়, এই তো আমি। জেগে আছি। তুই ঘুমো।
ললিত ঘুমোয়। কিন্তু সারা রাত ধরে সে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে। অজান্তে রমেনকে খোঁজে। সাড়া পেয়ে আবার নিশ্চিন্তে ঘুমোয়।
সকালবেলা সে রমেনকে জিজ্ঞেস করে, তুই কাল রাতে ঘুমোসনি?
রমেন মিটিমিটি হাসে। বলে, কেমন যেন মনে হয়েছিল রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে গেলে তুই আমাকে খুঁজবি।
ললিত লজ্জা পেয়ে বলে, তার জন্য ঘুমোসনি? তুই কী রে শালা! অত দূর ঘুরেটুরে এলি, তোর টায়ার্ড লাগছিল না?
রমেন মাথা নাড়ে, আমি কম ঘুমোই। তাই আমার দিন তোর দিনের চাইতে অনেক বড়!
কাল রাত থেকেই ললিতের মায়ের মনে একটা সন্দেহ ঢুকেছে। এই যে রমেন নামে ছেলেটা এসেছে ললিতের কাছে, এর রকমটা কী? সাজেগোজে দীনদরিদ্র, কিন্তু মুখখানা দেখে মনে হয় বড়ঘরের ছেলে। বড় সুন্দর মুখখানা। চেনা-চেনা লাগছিল। ললিত বলছিল বটে, রমেন এ-বাসাতে অনেক এসেছে মা! ওকে তুমি কত বার দেখেছ। কিন্তু আজকাল চোখে একটা ঘোলা-ঘোলা ভাব, কোনও কিছুই ঠিকমতো নজরে আসে না। তা ছাড়া কত দিন আগে দেখা, অত কি মনে থাকে?
সে যাই হোক, কিন্তু ললিত বলছিল, ছেলেটা নাকি সন্ন্যাসী। কোন আশ্রমে থাকে। এটা শোনার পর থেকেই মনটা কেমন খচখচ করছে। ওই সন্ন্যাসী ছেলেটা ললিতের কাছে কেন এসেছে! কী দরকার! বড় ভয় করে ললিতের মায়ের। এ-ছেলেটা আবার তুক করে যাবে না তো ললিতকে! একেই তো ললিত উদাসী ছেলে! আধা-সন্ন্যাসী হয়েই আছে তো।
কাল রাতে এক বিছানায় শুয়ে ওরা দু’জন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কথা বলছিল। কী যে অত কথা ওদের। ললিতের মা অনেক চেষ্টা করেছে শুনতে। কিন্তু গুনগুন শব্দ, দেশলাই জ্বালবার খস ছাড়া কিছুই কানে আসেনি। সারা রাত জেগে ওই ছেলেটা কী যেন বুঝিয়েছে ললিতকে। বিবাগী ছেলেদের বড় ভয় ললিতের মায়ের। কী কথা হয়েছিল ওদের কাল রাতে? একেই বুড়ি নাচুনি, তার ওপর আবার ঢাকের বাদ্যি।
সকালে ললিত বাথরুমে গিয়েছিল, সে সময়ে রমেনকে একা পেয়ে ললিতের মা এসে বলল, বুঝলে বাবা, ললিতের তো সংসারে মতি নেই, তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে যেয়ো তো! দেখো, যেন ওর আর-একটু সংসারে ঝোঁক হয়, টাকাকড়ির দিকে মন দেয়। আর দেখো, ও মেয়ে দেখলে কানা হয়, চোখ তুলে তাকায় না, কিন্তু এ-বয়সে ও-রকম স্বভাব কি ভাল? তরতাজা বয়স, এ-বয়সে বয়সের গুণ থাকবে না? তুমি ওকে একটু দেখো তো—
দেখব।
দেখো। ওর যেন সংসারে মন হয়। আমি ওর জন্য মেয়ে দেখে রেখেছি। বেশ মেয়েটি। বড় লক্ষ্মীমন্ত।