পঞ্চবিংশ অধ্যায় – সৃষ্টি কথন
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–”কাল” নামক দেবতাই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারী; প্রলয় তাহারই কিয়দংশে বিভক্ত। ১
কালের প্রলয় ভাগ অতীত হইলে, জ্ঞানস্বরূপ প্রভু পরম ব্রহ্মের সৃজনেচ্ছা হইল। ২
অনন্তর, পরমেশ্বর, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে ইচ্ছামত্রে বিক্ষোভিত করিলে ঐ প্রকৃতিই সৰ্ব্ব-কার্যের উপযোগিনী হইলেন। ৩
যেমন গন্ধ সন্নিহিত হইলেই মনের ক্ষোভ অর্থাৎ অবস্থা পরিবর্তন হয়, কিন্তু ঐ অবস্থা পরিবর্তনের কর্তা নহে, নিমিত্তমাত্র; প্রকৃতির ক্ষোভ সম্বন্ধে পরমেশ্বরও ঠিক তাহাই। ৪
সেই ব্রহ্ম পরমেশ্বরই ক্ষোভক, আবার তিনিই সঙ্কোচ-বিকাশ-শালিনী প্রকৃতিরূপে ক্ষোভ্য। ৫
জগৎপতি পরমেশ্বর সৃষ্টির জন্য পুরুষদিগকে (জীবাত্মাকে) ইচ্ছামাত্রে ক্ষোভিত করিলেন। ৬
সেই সাম্যাবস্থাপন্ন-ত্রিগুণাত্মিক, প্রকৃতিতে ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা) গণ অধিষ্ঠিত হইলে গুণ-বৈষম্য হইল। ৭
তখন ঈশ্বরেচ্ছা-পরিচালিত প্রকৃতি, তাহাকে আবরণ করিলেন। ৮
প্রধানসংবৃত মহত্তত্ত্ব হইতে সাত্ত্বিক রাজসিক তামসিক এই ত্রিবিধ অহঙ্কার উৎপন্ন হইল। ৯
অহঙ্কার–পঞ্চভূত ও ইন্দ্রিয়গণের চিরন্তন হেতু; তন্মধ্যে তামস অহঙ্কারই পঞ্চভূতের কারণ। ১০
অহঙ্কার উৎপন্ন হইবামাত্র মহত্তত্ত্ব তাহাকে আবরণ করিল। মহত্তত্ত্বাবৃত অহঙ্কার হইতে পঞ্চতন্মাত্র উৎপন্ন হইল। ১১
প্রথমে শব্দতন্মাত্র, তৎপরে স্পর্শতন্মাত্র, অনন্তর রূপতন্মাত্র, তাহার পর রসতন্মাত্ৰ, সৰ্বশেষে গন্ধতন্মাত্র–এইরূপ যথাক্রমে পঞ্চতন্মত্রের উৎপত্তি। অহঙ্কার সকল তন্মাত্রকে পৃথক পৃথক আবরণ করিল। ১২-১৩
শব্দতন্মাত্র হইতে শব্দের প্রথম উপাদান আকাশ উদ্ভূত হইল। তামস অহঙ্কার, শব্দতন্মাত্রসহ আকাশ আবৃত করিল। ১৪
আকাশসহ স্পর্শতন্মাত্র হইতে স্পর্শের প্রথম উপাদান শব্দ-গুণান্বিত বায়ু উৎপন্ন হইল। ১৫
আকাশ-বায়ু-সহকৃত রূপতন্মাত্র হইতে প্রদীপ্ত তেজ উৎপন্ন হইয়া সর্বত্র বিস্তৃত হইল। ১৬
তাহা রূপের প্রথম উপাদান কারণ আর শব্দস্পর্শেরও অন্যতম উপাদান বটে। ১৭
আকাশ-বায়ু-তেজঃ সমন্বিত রসতন্মাত্র হইতে জল উৎপন্ন হইয়া সৰ্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত হইল। ১৮
অমিত-তেজা বিষ্ণুর আধারশক্তি, অনিলান্দোলিত নিরাধার জলরাশি ধারণ করিলেন। ১৯
পরমেশ্বর, প্রথমতঃ তাহাতেই বীজধারণ করেন; সেই বীজ সূৰ্য্য-সন্নিভ সুবর্ণময় অণ্ডাকারে পরিণত হইল। ২০
ঐ অণ্ড মহতত্ত্ব প্রভৃতি পদার্থদ্বারা নির্মিত এবং তদ্বারা চতুর্দিকে সংবৃত। ২১
জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, অহঙ্কার এবং মহত্তত্ত্ব–দশ দশ গুণ অধিক বিস্তৃতভাবে ক্রম-বহির্ভূত এই সকল পদার্থ দ্বারা ব্রহ্মাণ্ডের গঠন। ২২
সুতরাং পরমেশ্বরের স্থাপিত বীজসকল পদার্থের মধ্যবর্তী; দ্বিজগণ! এই রূপ এই ব্রহ্মাণ্ডও আবার জল প্রভৃতি তৎসমস্ত বস্তুদ্বারাই যথাক্রমে আবৃত ২৩
স্বয়ং বিষ্ণু সেই অণ্ডমধ্যে-ব্ৰহ্মস্বরূপ দেহ স্থাপনপূর্বক দিব্যমানে একবৎসর অবস্থিতি করিয়া স্বয়ং বুদ্ধিবলে সমস্ত বীজ সংগ্রহ করিলেন। ২৪
ইচ্ছামাত্র সেই অণ্ডভেদ করিয়া ক্ষণকাল তথায় অবস্থিতি করিলেন। তখনই অন্যান্য চতুর্ভুত-সহকৃত গন্ধতন্মাত্র দ্বারা পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। ২৫
এই নিখিল পৃথিবী, সকল তন্মাত্র সাহায্যে নির্মিত বলিয়া শব্দ, স্পর্শ, সমুদায় রূপ, রস এবং গন্ধ–সকলই ইহাতে বর্তমান। ২৬
সেই ব্রহ্মাণ্ডের কমলে সুমেরু, জরায়ুদ্বারা পৰ্বত-সমূহ এবং গর্ভ-সলিলে সপ্ত সমুদ্র আর স্কন্ধদ্বয় স্বর্গ উৎপন্ন হয়। ২৭
অপর দেশ-সম্ভূত স্কন্ধযুগল মহাসুখকর সপ্ত-নাগালয় পাতাল উৎপন্ন হয়, তন্নিম্নে স্বয়ং পরমেশ্বর বিরাজমান। ২৮
ব্রহ্মাণ্ডের তেজোরাশিতে মহর্লোক, ব্রহ্মাণ্ডগর্ভস্থ পবনে জনলোক, ঈশ্বরেচ্ছা-বলে শ্রেষ্ঠলোক তপোলোক এবং ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বগতি দ্বারা সত্যলোক উৎপন্ন হইল; সর্বোপরি স্বয়ং অচ্যুত বিষ্ণু অবস্থিত; এই বিষ্ণু লোককেই ধীরগণ জ্ঞানগম্য চরম পরম-পদ বলিয়া থাকেন। ২৯-৩০
সেই ঈশ্বর, ব্ৰহ্মা-রূপে জগৎ নিৰ্মাণ করিয়া জগৎ-স্থিতির জন্য বিষ্ণুরূপী হইলেন; স্বয়ং উৎপন্ন দেহ বলিয়া বিষ্ণু “স্বভু” নাম প্রাপ্ত হইলেন। ৩১
অনন্তর তিনি পৃথিবী উদ্ধারের জন্য পীবর যজ্ঞ-বরাহ-দেহ অবলম্বন নিমগ্ন প্রায় পৃথিবীকে ধারণ করিতে তাহার মধ্যস্থল ভেদ করিয়া অতিবেগে অধোদেশে গমন করিলেন। ৩২
কিছুকাল পরে তিনি পৃথিবীকে দংষ্ট্রার অগ্রভাগে স্থাপনপূর্বক সমস্ত জলরাশি অতিক্রম করিয়া উত্থিত হইলেন। অনন্তর, পৃথিবীকে ধারণ করিয়া রাখিবার জন্য সপ্তফণা-সমন্বিত অনন্তরূপী হইলেন। ৩৩
জলস্থিত অনন্ত, ছয় ফণা প্রসারিত করিয়া মধ্যবর্তী একটী ফণার উপরে পৃথিবী ধারণ করিলে যজ্ঞ বরাহ পৃথিবী হইতে দন্ত খুলিয়া লইলেন। ৩৪
অনন্ত যে ছয় ফণা প্রসারিত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে একটি পূর্বদিকে, একটি পশ্চিমদিকে, একটী দক্ষিণদিকে, একটি উত্তরদিকে, একটী ঈশানকোণে আর অন্যটী অগ্নিকোণে আছে। অবশিষ্ট ফণা পৃথিবীমধ্যে আর তদীয় দেহ নৈর্ঋতকোণে অবস্থিত। ৩৫-৩৬।
বায়ুকোণে–শূন্য, এই জন্য সেই দিকে, পৃথিবী কিঞ্চিৎ নম্র। ৩৭
সেই দীর্ঘ-দেহ অনন্ত, যখন জলোপরি নিরবলম্বনে থাকিতে অপারগ হইলেন, তখন বিষ্ণু, কুৰ্ম্মরূপী হইয়া অনন্ত-দেহ ধারণ করিলেন। ৩৮
অনন্তর কচ্ছপ, বহু চরণ দ্বারা ব্রহ্মাণ্ডখণ্ড আক্রমণপূর্বক বায়ুকোণে গ্রীবা বিস্তার করিয়া পৃষ্ঠ দ্বারা অনন্তকে ধারণ করিলেন। ৩৯
দীর্ঘকায় অনন্ত কুৰ্ম্মপৃষ্ঠে নয়টি কুণ্ডলী করিয়া অনায়াসে পৃথিবী ধারণ করিলেন। তখনও পৃথিবী, অনন্ত-ফণোপরি অবস্থিত হইয়াও স্থির হইল না, বিচলিত হইতে লাগিল। তাই যজ্ঞবরাহ পৃথিবীকে অচল করিবার জন্য পৰ্বতকুলকে দৃঢ় করিতে লাগিলেন। ৪০-৪১
তিনি সুমেরু-পৰ্ব্বতকে ভূতলে প্রোথিত করিবার জন্য খুরপ্রহার করিলে সুমেরু পৃথিবী ভেদ করিয়া অন্তরে প্রবিষ্ট হইল। ৪২
বরাহের পদাঘাতে উক্ত মহাশৈল, ষোড়শ-সহস্র-যোজন রসাতলে প্রবেশ করিল। ৪৩
হে দ্বিজোত্তমগণ! সেই প্রহার হওয়ার সুমেরুর উৰ্দ্ধভাগ দ্বাত্রিংশৎ সহস্র যোজন বিস্তৃত রহিল। ৪৪
সেই পৃথিবীধর সুমেরু পৰ্বত, যাহাতে বিচলিত না হয়, এই জন্য বরাহ তাহার পার্শ্বে কতিপয় সীমা পৰ্ব্বত স্থাপন করিলেন। ৪৫
বরাহ, পদাঘাতে হিমালয় প্রভৃতি সেই সকল পৰ্ব্বতের–উচ্চে পাঁচভাগের এক ভাগ করিয়া ভূতলমধ্যে প্রোথিত করিলেন। ৪৬
অনন্তর ব্রহ্মা, মহাতেজা বরাহকে নমস্কার করিয়া অর্ধনারী-অর্ধনর মহাদেবকে নিজ দেহ হইতে উৎপাদন করিতে লাগিলেন। ৪৭
তিনি উৎপন্ন হইয়াই প্রথমে মহাশব্দে রোদন করিতে লাগিলেন। অনন্তর ব্রহ্মা তাহাকে বলিলেন, “রোদন করিতেছ কেন?” ৪৮
তখন মহেশ্বর বলিলেন,–“আমার নামকরণ কর।” “মহাশয়! তুমি রোদন করিয়াছ বলিয়া তোমার নাম ‘রুদ্র’ থাকিল।” ৪৯
ব্ৰহ্মা এই কথা বলিলে, রুদ্র আরও সাতবার রোদন করিলেন। তৎপরে, ব্ৰহ্মা আরও তাহার সাতটী নাম রাখিলেন যথা,শৰ্ব্ব, ভব, ভীম, মহাদেব, উগ্র, ঈশান এবং পশুপতি। ৫০-৫১
মায়া, যেরূপে তোমা হইতে বিভক্ত হন, তুমি জগতে সৃষ্টি করিবার জন্য এইরূপে আত্মাকে বিভক্ত কর; তুমিও একজন প্রজাপতি। ৫২
অনন্তর, প্রভু ব্ৰহ্মা, অৰ্দ্ধশরীরে পুরুষ ও অর্ধশরীরে নারী হইয়া–সেই নারীর গর্ভে বিরাট পুরুষকে উৎপাদন করিলেন। ৫৩
ভগবান ব্রহ্মা তাহাকে বলিলেন, ‘প্রজাপতি। সৃষ্টি কর।’ অনন্তর বিরাট পুরুষ তপস্যা করিয়া স্বায়ম্ভর মনুকে সৃষ্টি করিলেন। ৫৪
স্বায়ম্ভুব মনু, তপস্যাপ্রভাবে ব্রহ্মাকে পরিতুষ্ট করিলেন। ব্রহ্মা, তৎকর্তৃক পরিতোষিত হইয়া সৃষ্টির জন্য মনের সাহায্যে দক্ষকে উৎপাদন করিলেন। ৫৫
দক্ষ উৎপন্ন হইলে, মনু, বিথিকে দশবার প্রণাম করিলেন; তখন ব্রহ্মা, আরও দশজন মানসপুত্ৰ উৎপাদন করিলেন। ৫৬
তাঁহাদিগের নাম-মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বসি, ভৃগু এবং নারদ। ৫৭
ব্ৰহ্মা মনের দ্বারা ইহাদিগকে মনু হইতে উৎপাদন করিয়া স্বায়ম্ভুব মনুকে ও ইহাদিগকে “তোমরা সৃষ্টি কর” এই আজ্ঞা প্রদানপূর্বক তথা হইতে অন্তর্হিত হইলেন। ৫৮
এদিকে পরমেশ্বর বরাহ, মুখ দ্বারা খনন করিয়া পৃথিবীর চতুর্দিকে বলয়াকারে সপ্তসাগর নির্মাণ করিলেন। ৫৯
বরাহ, সাতবার ভ্রমণে-সপ্তসমুদ্র নির্মাণ ও সপ্তদ্বীপ বিভাগ করিয়া পৃথিবীর শেষভাগে গমন করিলেন। ৬০
তিনি, পরিমাণে দুই লক্ষ যোজন উন্নত লোকালোক পৰ্ব্বতকে ভূমণ্ডলের চতুর্দিকে বেষ্টিত প্রাচীর করিলেন। এইরূপে বরাহ, গৃহের ন্যায় পৃথিবী মণ্ডলের পার্শ্বে সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করিলেন। ৬১
বিপ্রগণ! আমি এই–তোমাদিগের নিকট আদিসৃষ্টির কথা কীৰ্ত্তন করিলাম; এক্ষণে প্রতিসর্গ (দক্ষাদিকৃতসৃষ্টি) কীৰ্তন করিতেছি, মহর্ষিগণ শ্রবণ করুন। ৬২
পঞ্চবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ২৫।