২৫
সুরিনাম দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে অবস্থিত একটা ছোট্ট দেশ। উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর, পাশে গায়েনা, দক্ষিণে ব্রাজিল। প্রাচীনকাল থেকে এই দেশে বাস করত আরাওয়াক, কারিবের মতো উপজাতির মানুষেরা। তাদের জীবিকা ছিল মূলত শিকার আর মাছ ধরা। আবাস ছিল একেবারে সুরিনাম সীমান্তে মারুন নদীর গায়ে। আরাওয়াক, কারিব ছাড়াও যে ছোট ছোট কিছু উপজাতি ছিল, তারা বাস করত দেশের ভেতরের ছোট ছোট নদীগুলোর দু’পাশের অরণ্যে।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ইউরোপিয়ান নাবিকদের নজরে পড়ল দক্ষিণ আমেরিকার এই উপকূল দেশগুলোর ওপরে। ফরাসি, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ ও ব্রিটিশ নাবিকদের আনাগোনা বাড়তে লাগল। এখানকার মাইলের পর মাইল উর্বর জমি, খাঁটি সোনার মতো আখক্ষেত দেখে তাদের লোভী জিহ্বা চকচক করে উঠল।
অবশেষে আরো প্রায় একশো বছর পর এইসব দেশে নিজেদের কলোনি স্থাপন করল ওলন্দাজ আর ব্রিটিশরা। দুই জাতিতে শীঘ্রই বাধল বিবাদ, অবশেষে ব্রেডা চুক্তির পর ইংরেজরা সুরিনাম থেকে সরে গেল, তারা কলোনি গড়ল পাশের গায়েনা দেশে। আর সুরিনামে জাঁকিয়ে বসল ওলন্দাজরা।
নদীমাতৃক দেশগুলোর ছোটবড় নদীর পাড়ে তারা গড়ে তুলল তাদের খামার। তখন দাসপ্রথা চলছে রমরমিয়ে। স্থানীয় উপজাতির মানুষগুলোকে তারা যথেচ্ছভাবে কাজে লাগাল নিজেদের খামারে। দাসদের রক্ত, ঘাম মেশানো পরিশ্রমে ফলানো ফসল স্বদেশে রপ্তানি করে খামারমালিকেরা রাতারাতি টাকার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। কিন্তু দাসরা রইল অমানুষিক পরিশ্রম আর অপমানে ভরা তিমিরেই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলল সেখানে।
পরিস্থিতি পাল্টালো আরো প্রায় দুশো বছর পর। দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হল গোটা পৃথিবীতে। হঠাৎ করে স্বাধীন হয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস, যাদের ঊর্ধতন কয়েক পুরুষ জন্মেছে ও মরেছে দাস হয়ে। খামারের খোঁয়াড় থেকে মুক্তি পেলেও তারা জন্মভূমি ত্যাগ করতে পারল না। ত্যাগ করবেই বা কেন। তারা স্বাধীনভাবে চাষবাস বা অন্য কিছু করে সেখানে বাস করতে লাগল।
কিন্তু এবার যে আরো বড় সমস্যা। এই দিগন্তবিস্তৃত শস্যখেত, তাতে শ্রমিক কোথায়? চাষবাস বন্ধ। খামারমালিকদের মাথায় হাত। সুখের দিন যে শেষ হয় হয়!
যাদের তারা আগে চাবুকের ওপর রাখত, কথায় কথায় যাদের ঊরুতে চেপে ধরত জ্বলন্ত কাঠ, সেই দেশীয় মানুষগুলোর সামনেই তারা আবার গিয়ে দাঁড়াল।
এবার চাবুক হাতে নয়, করজোড়ে।
‘আমরা তোমাদের ভালো মাইনে দেব, খাওয়া-পরা সব পাবে। খামারে চলো।’
দিন সবারই আসে। একদিন যারা চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেত না, সেই চিরবঞ্চিত মানুষগুলো হা হা করে হেসে ওঠে খামারমালিকদের প্রস্তাবে। তারা বহুপ্রজন্ম ধরে দাসত্বের গ্লানি, পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী ছিল। কোনো মূল্যেই স্বাধীনতা খোয়াতে তারা আর রাজি নয়। বিপাকে পড়ে খামারমালিকদের এই অনুরোধ যে আসলে কুম্ভীরাশ্রু, তাও বুঝতে বাকি নেই তাদের। নিজেদের স্বার্থের জন্য তারা এখন শুধু চায় ভুলিয়ে ভালিয়ে শ্রমিক জোগাড় করতে, কাজ হয়ে গেলেই শুরু হবে অত্যাচার আর নিপীড়ন।
কৌতুকপূর্ণ চোখে তারা বলে, ‘মাইনে দেবে? তা কত? পাঁচ ডলার না দশ ডলার?’
খামারমালিকরা অনেক কষ্টে নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে। আগে যাদের হাতে ভিক্ষা দেওয়ার মতো করে গুঁজে দিত দশ কি বিশ সেন্ট, তাদের এই বাড়বাড়ন্তে মালিকদের বাক্যস্ফূর্তি হয় না।
কৃষ্ণাঙ্গরা সমবেত হয়ে আরো বলে, ‘আর তোমরা আমাদের মাইনে দেবে? কেন, আমাদের কি নিজস্ব খেত নেই? ওই তো, দ্যাখো না। কত সুন্দর ফসল ফলিয়েছি। আমরা কালো মানুষ, অনেক বেশি খাটতে পারি। চাও তো, তোমরা আমাদের খেতে এসে কাজ করতে পারো। ভালো মাইনে দেব। একেবারে পঞ্চাশ সেন্ট। সঙ্গে খাওয়া-পরাও। হা হা!’
খামারমালিকেরা শুকনো মুখে ফিরে যায়। তাদের চোখের সামনে তাদের উর্বর জমি খালি পড়ে থাকে। আর ওদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের খেত ভরে যায় সোনালি ফসলে।
স্বদেশ থেকে তাগাদা আসে। ইউরোপ থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। কী হল। জাহাজ ভর্তি আখ আর আসছে না কেন?
তারা উত্তর দিতে পারে না। ম্লানমুখে বসে থাকে এই অজানা বিদেশে।
আগেই বলেছি, অতঃপর এইসব খামারমালিকদের বিপদ থেকে বাঁচাতে শুরু হয় ইনডেনচার অর্থাৎ চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আমদানি।
গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো থেকে যথেচ্ছভাবে যাকে যেভাবে হোক বুঝিয়ে নিয়ে আসা হতে লাগে শ্রমিক। সেই এজেন্ট এবং আড়কাঠিদের মাধ্যমে।
যেমন এসেছিলেন কৃষ্ণসুন্দররা।
প্রথম যেদিন সারিবদ্ধভাবে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা হল শস্যখেতে, কৃষ্ণসুন্দররা হিমচোখে দেখলেন, হাঁটু পর্যন্ত বুট, মাথায় টুপি, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে চাবুক নিয়ে সেখানে ঘোরাফেরা করছে খামারমালিকের ওভারসিয়াররা।
প্রথমেই বুঝিয়ে দেওয়া হল কাজ। নরম মাটিতে আখ বসানোর জন্য গর্ত করতে হবে। যেমন তেমন গর্ত, নয়, একেবারে মাপজোক করে পাঁচ ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া, পাঁচ ফুট গভীর গর্ত।
অনভ্যস্ত হাতে কৃষ্ণসুন্দর শাবল হাতে কাজ শুরু করলেন। তাঁর দেখাদেখি তোতারাম, পরেশ কৈবর্ত, বিনয়রাও খোঁড়াখুঁড়িতে নামল।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের পিঠে এসে পড়ল লাঠির গুঁতো।
কী ব্যাপার? কৃষ্ণসুন্দর সভয়ে পেছনে তাকাতেই হুঙ্কার। কী না, ধীরেসুস্থে কাজ করলে চলবে না। প্রত্যেককে সারাদিনে অন্তত আশি থেকে নব্বইটা গর্ত করতে হবে। খেত থেকে বেরনো তো যাবেই না, একটু থামলেই পিঠে পড়বে চাবুকের বাড়ি।
‘হেইডা কিমুন কথা হইল? ইট্টু না জিরাইলে চলে?’ ফুঁসে উঠল তোতারাম, ‘মাইনষের তো পানি-পুনি খাওয়া লাগে, পেশাব-পায়খানাও করা লাগে, লাগে না?’
শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার তোতারামের ভাষা বুঝতে পারল না, আঙুল উঁচিয়ে গর্ত খোঁড়ার হুমকি দিল।
তোতারাম ছাড়ার পাত্র নয়, সে বলল, ‘টানা কাম করতে পারুম না। হাত টনটন করতাছে।’
কিন্তু বাক্যটা সে শেষ করতে পারল না। তার আগেই তার পিঠে এসে পড়ল সাপের মতো হিলহিলে চাবুকের ঘা।
তোতারামের পরিত্রাহী চিৎকারে কোনো হেলদোল হল না ওভারসিয়ারের। ‘প্রথম রাতেই বিড়াল মারা’র শিক্ষায় শিক্ষিত সে। প্রথমেই এই সব শ্রমিকদের মারের ভয় দেখিয়ে শিরদাঁড়াটা ভেঙে দিতে পারলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তোতারামের আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদের মধ্যেই সে নির্বিকারভাবে চাবুক চালিয়ে যেতে লাগল।
টানা পঞ্চাশ ঘা মারার পর থামল সে। ততক্ষণে তোতারামের পরিত্রাহী চিৎকার পরিণত হয়েছে চাপা গোঙানিতে। মাটিতে উপুড় হয়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছে।
তবু সেই অবস্থাতেই উঠে শাবল ধরতে বাধ্য করা হল তাকে। যন্ত্রচালিতের মতো তাকেও গর্ত খোঁড়া শুরু করতে হল।
সন্ধ্যাবেলা পাখিরা যখন ঘরে ফিরে যাচ্ছে একে একে, তখন কৃষ্ণসুন্দররাও টলতে টলতে ঘরে ফিরছিলেন। কৃষ্ণসুন্দরের দেহ আর কিছুতেই চলছিল না, অনভ্যাসের এই প্রচণ্ড পরিশ্রমে তার হাড়গুলো যেন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এলিয়ে পড়তে চাইছিল মাটিতে। কিন্তু তা করলে চলবে না। ফিরতে হবে কোঠাঘরে। সেখানে পথ চেয়ে আছেন ব্রহ্মময়ী।
এই অমানুষিক পরিশ্রম থেকে মেয়েদেরও নিষ্কৃতি নেই। গর্ত খোঁড়ার সময় তাদের প্রয়োজন না হলেও কয়েকদিন পর থেকেই তাদের ডাক পড়বে জল দেওয়ার কাজে। তখন ব্রহ্মময়ীকেও নামতে হবে খেতের কাজে। একটু শৈথিল্য এলে খেতে হবে চাবুক। কিংবা সম্মুখীন হতে হবে আরো কদর্য কোনো নিগ্রহের।
সেই চিন্তা মাথায় আসামাত্র কৃষ্ণসুন্দরের অন্তরাত্মা আবারও ভয়ে দুলে উঠল।
বিনয় পাশে পাশে হাঁটছিল। বলল, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন ঠাকুরমশাই? চুক্তিনামায় লেখা ছিল, রোজ কাজ করতে হবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কিন্তু মাঝের ওই সামান্য খাবারের সময়টুকু বাদ দিলে বাস্তবে কাজ হবে পনেরোঘণ্টা ধরে, একটানা।’
‘হুম। দেখেছি।’ নীচুস্বরে বললেন কৃষ্ণসুন্দর।
পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এক শ্রমিক এসেছিল আরো দুইমাস আসে। তার নাম বলাই। সে কৃষ্ণসুন্দরদের চেয়ে অভিজ্ঞ। থাকেও একই জায়গার কোঠাঘরে। আসার পরই সে যেচে এসে পরিচয় করেছিল স্বদেশ থেকে আসা নতুন মানুষগুলোর সঙ্গে।
এখন সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আইজকা আর কি দ্যাকলেন। মাড়াইয়ের মরশুম যখন শুরু হইব, তহন সারা রাত ধইরা কাম করাইব ওই পাষাণগুলান। ব্যথায় অজ্ঞান হয়া যাবেন, তবু ছাড়ব না।’
‘সারা রাত?’ বিস্ময়ে শিউরে উঠেল বিনয়।
‘হ। আর তার লগে কোনো বোনাস নাই। সাড়ে পাঁচ টাকা তো সেই সাড়ে পাঁচ টাকাই।’
‘সাড়ে পাঁচ টাকা?’ কৃষ্ণসুন্দর হরিহর আড়কাঠিকে মনে করার চেষ্টা করেন, ‘আমাকে বলেছিল দশটাকা মাসমাইনে।’
‘হ। ঠিকই কইসে।’ বলাই মাথা নাড়ে, ‘কিন্তু পেত্থম বছরে ওই পাঁচ-সাড়ে পাঁচ কইরাই পাবেন। আপনাকে যে আড়কাঠি জালে তুলেছিল, তার আগাম আছে, এজেন্টদের দেওয়া আগাম আছে, ডিপোয় খাওন-দাওনের খরচ আছে, সেসব শোধ হবে এখন এক বৎসর ধইরা।’
কৃষ্ণসুন্দরের মুখে আর কোনো কথা সরল না। পরেশ কৈবর্ত শুধু চাপাস্বরে একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে উঠল।
তোতারাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। তার পিঠের রক্তাক্ত আঘাতগুলো থেকে রক্তপাত বন্ধ হলেও ব্যথায় সেখানগুলো ফুলে উঠেছে। তবু তার কথা বলায় বিরাম নেই। এখনো সোৎসাহে সে কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ গায়ের একেবারে পাশে কী একটা সড়সড় করে উঠতে সে ‘আই বাপ!’ বলে সরে এল খানিকটা।
সূর্যদেব অস্তাচলে গিয়েছেন অনেকক্ষণ আগে। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশের ঝোপঝাড়ে। দূরে দেখা যাচ্ছে কোঠাবাড়ির টিমটিমে প্রদীপের আলো। এর মধ্যেই সবাই লক্ষ করল, পায়ে চলা এই সরু পথের একপাশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে চার-পাঁচটা লোক। তাদের গাত্রবর্ণ এতই কালো, যে অন্ধকারে ঠিকমতো তাদের দেখা যাচ্ছে না। শুধু চকচক করছে তাদের হাতের লম্বা বর্শা আর সাদা দাঁত। সেই দাঁতের উচ্চতা থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে, লোকগুলো বিশালদেহী।
নিকষ কালো অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে লোকগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে। তাদের মাথার বুনো আদিম ঝোপের মতো চুল থেকে পায়ের নখ, কিছুই যেন নড়ছে না। নির্নিমেষ নয়নে তারা প্রত্যক্ষ করছে খেতের নতুন শ্রমিকদের।
বিনয় ফিসফিস করে বলল, ‘এখানকার আদি বাসিন্দা এরা। বর্শাগুলো দেখেছেন। একটা ছুড়ে মারলে সঙ্গে সঙ্গে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাব।’
কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘সবাই চুপচাপ এগিয়ে চলো। আমরা ওদের কোনো ক্ষতি না করলে ওরাও করবে না।’
কৃষ্ণসুন্দরের কথামতো সবাই চুপচাপ দলবদ্ধভাবে এগিয়ে গেল। নিজেদের কোঠার কাছাকাছি পৌঁছতে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
তোতারাম বলল, ‘কারা ওইগুলান? বাপরে! একেকটা কালাপাহাড় যেন!’
বলাই বলল, ‘চুপ চুপ! ওসব কোয়ো না। ওদের আমাদের ওপর খুব রাগ। একা পেলে মারধোর করতে পারে।’
‘কেন?’ কৃষ্ণসুন্দর প্রশ্ন করলেন, ‘কীসের রাগ আমাদের ওপর?’
‘বাহ! ওদের লগে তো অ্যাদ্দিন ঝুলাঝুলি করতাছিল সাহেবরা, তাতে ওরা বেশ মজা পেত, উলটাপালটা কয়ে রাগায়ে দিত মালিকদের। কিন্তু আমরা আসার পর থিকা তো আর সাহেবরা ওদের লগে জাইতাসে না। তাই ওরা রেগে গ্যাসে।’
‘কী করে বুঝলে, ওরা রেগে গেছে? কখনো তেমন কিছু করেছে ওরা?’
‘হ। একবার তো লড়াই হইয়া গেল।’ বলাই বলল, ‘সাহেবরা ওদের একটা খ্যাত দখল করল, ওরা বাধা দিতে এসে তিরধনুক লইয়া ঝাঁপায়ে পড়ল, আমরাও লড়লাম। শ্যাসে ওরা গোহারা হেরে চলি গেল। তারপর থেকে আর কিছু করে না। খালি দূর থিকা ভূতের মতো দ্যাখে।’
কৃষ্ণসুন্দর চুপ করে গেলেন। দূরে তার কোঠাঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে ভেসে আসছে প্রদীপের ক্ষীণ আলো।
তাঁর মনে পড়ে গেল, মশাটে থাকার সময় সারাদিনের চতুষ্পাঠী সামলে বিকেলে যেতেন জমিদারবাড়িতে সান্ধ্যবৈঠকে। সেখান থেকে যখন ফিরতেন, ঠিক এমনভাবেই দূর থেকে দেখতে পেতেন, উঠোনে ব্রহ্মময়ী সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়েছেন। গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করছে গৃহদেবতাকে।
সেদিন আর আজ—কত তফাত! আলাদা দেশ, আলাদা বাসস্থান, আলাদা পরিস্থিতি। তফাত আরো একটা বড় বিষয়ে। দারিদ্র্য থাক, অনিশ্চয়তা থাক, বিপদ থাক, সেদিন তাঁরা ছিলেন স্বাধীন। আর আজ নিয়মমাফিক চাল ডাল জুটলেও তাঁরা পরাধীন।
কৃষ্ণসুন্দর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘চলো ঘরে যাওয়া যাক। রাত অনেক হল।’
২৬
‘আচ্ছা চাচা, ভালোবাসা বলে কি সত্যিই কিছু আছে?’ নদীতে একটা বড় ঢিল ছুড়ে প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চন্দ্রনাথ।
বুলবুল মিয়াঁ অনেক ক’টা রঙিন পাখি নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসেছিল।
পাখিগুলো খোলা থাকলেও সেগুলো অদ্ভুতভাবে কিছুতেই উড়ে যাচ্ছে না। একটু করে ডানা ঝাপটেই আবার এসে উড়ে বসছে বুলবুল মিয়াঁর কাঁধে। বুলবুল মিয়াঁ একটু করে বাদামগুঁড়ো হাতের তালুতে ধরছে, ওরা ভিড় করে এসে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। একটু করে খাওয়া হয়ে গেলেই নদীর দিকে উড়ে যাচ্ছে অনেকখানি, তারপর আবার উড়ে এসে বসছে বুলবুল মিয়াঁর কাঁধে।
‘অচানক ইয়ে বাত?’ বুলবুল মিয়াঁ চোখ নাচিয়ে বলল, ‘কার প্রেমে পড়েছ ভায়া?’
চন্দ্রনাথ বলল, ‘আহ, কথা ঘুরিও না। বলো না চাচা।’
‘বিলকুল আছে। ভালোবাসা না থাকলে এই পাখিগুলো খোলা আকাশে আজাদ হওয়ার সুযোগ পেয়েও যাচ্ছে না কেন? আমাকে ভালোবাসে বলেই তো। আবার তুমিও যে পিঁয়াজুবাঈয়ের নাচের জলসা ছেড়ে এই বুঢঢার সঙ্গে এখানে বসে আছ, আমাকে ভালোবাস বলেই তো! প্যারই তো সবচেয়ে সাচ, এই দুনিয়ায় বেটা!’
‘আচ্ছা, ভালোবাসা তো নিঃশর্ত হওয়া উচিত, তাই না?’
‘বিলকুল! আমি একজনকে ভালোবাসি, তার সাদা কালো সবটাকেই ভালোবাসব, শুধু ভালাইটাকে তো নয়।’
‘তবে মেটিয়াবুরুজে যে এত এত বাঈজি, এত কসবি, এদের বিয়ে হয় না কেন?’ চন্দ্রনাথ জিগ্যেস করল, ‘একটার পর একটা বাবু বাঁধা রাখে, একবছর, দু-বছর, তিনবছর। তারপরই পুরনো হয়ে যায়, তখন বাবু চলে যায় অন্য মেয়ের কাছে।’
‘কারণ তারা তো মানুষটাকে ভালোবাসে না।’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘তারা ভালোবাসে একটা জিসমকে। সেই জিসম যখনই একঘেয়ে হয় যায়, ফেলে দেয়। আসলি প্যার হলে তারা যেতে পারত না।’
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলবে না বলবে না করে বলেই ফেলল, ‘নবাবের খুশনবিস হাফিজ নুরুল্লা বলছিল, তুমি নাকি আগে হিন্দু ছিলে চাচা। সত্যি?’
বুলবুল মিয়াঁ এতক্ষণ বেশ হৃষ্টমুখে কথা বলছিল। কিন্তু এইবার হঠাৎ একটু চুপ হয়ে গেল। গম্ভীরমুখে দানা খাওয়াতে লাগল পাখিগুলোকে।
‘বলো না চাচা। তুমি আগে হিন্দু ছিলে?’
বুলবুল মিয়াঁ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘ছিলাম। হিন্দু ব্রাহ্মণ।’
‘মুসলমান হলে কেন চাচা?’
বুলবুল মিয়াঁ একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর পাখিগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, ‘ওই যে, তুমি একটু আগে জিগ্যেস করলে। ভালোবাসা।’
চন্দ্রনাথ ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল।
বুলবুল মিয়াঁ আবার বলল, ‘তার নিকাহ হয়েছিল মাত্র তেরোবছরে। বর মরে গেল তিন বছর পর। বাড়ি দখলের জন্য এক রাতে পরিবারের লোকজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। মুসলমান বিধবাদের হরবখত এমন করে মেরে ফেলে আত্মীয়রা। ও জিন্দা বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু সারা শরীর পুড়ে কদাকার হয়ে গেল। আমি থাকতাম পাশের গলিতে। কী থেকে কী হয়ে গেল, ওকে ভালোবেসে ফেললাম। তো কী, ওর পোড়া চামড়াটাকে তো ভালোবাসিনি। বেসেছি তো তার ফুলের মতো মনটাকে। তার সঙ্গে চামড়ার কী লেনদেন?’
চন্দ্রনাথের গা শিরশির করে উঠল।
‘রেশমা ইমানদার মুসলিম। বলল নিকাহ করতে গেলে মুসলিম হতে হবে। হয়ে গেলাম। জন্মেছিলাম হিন্দু হয়ে, এতকাল বিদেশে থেকে কেমন বিদেশি হয়ে গেছি। বাংলার চেয়ে হিন্দি বেশি বলি।’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘তো কী এমন বড়ি বাত? আরে ভাই যখন হিন্দু ছিলাম, তখনো এই ধরতিতেই শ্বাস নিতাম, জল খেতাম, এখনো তাই করছি। আর মরার পর? আমরা কী তোমরা কী সাহেবরা, সব একজায়গাতেই যাব। আমার ছোট্ট একটা পরি আছে। নাম রেখেছি ভালোবাসা। কি আজিব নাম না? না হিঁদু না মুসলিম। তাকেও সেটাই বোঝাই। তুমি হিঁদুও নও, মুসলমানও নও। তুমি হলে একটা মানুষ। খোলামনে বড় হও। শেষে তো সবাই এক হয়ে যাব।’
চন্দ্রনাথ শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে পড়ছিল। সে আবেগপ্রবণ তরুণ, একটুতেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। বলল, ‘মোতি বলে একটা মেয়ে আছে চাচা। আমার মনে হচ্ছে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
বুলবুল মিয়াঁ মুহূর্তে বদলে গেল। তার দৃষ্টিতে আবার ফিরে এল কৌতুক। ‘আরে ক্যা বাত! বধাই হো। মোতি মতলব উয়ো দত্তজিকা জো…।’
চন্দ্রনাথ বুঝতে পারল, বুলবুল মিয়াঁ ইচ্ছা করেই মাঝপথে থেমে গেল। ও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ । তোমার ব্যবসার সঙ্গী হতে পারে চাচা, কিন্তু না বলে পারছি না, দত্তজি লোকটা খুব শয়তান।’
‘হুম।’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘আমার নিজেরও মনে হয় সেটা চন্দরনাথ। বেওসা ছাড়া তেমন কথা হয় না তবু বুঝতে তো পারি। লোকটা খালি মাগিবাজি করে বেড়ায়। ঘরে পাল পাল বিবি, বাইরে পাল পাল রন্ডি, এই বুঢঢা বয়সেও খালি লুচ্চামি। ছো-ছো।’
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ উদাসচোখে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘মোতি নবাবেরই এক মুতআ বেগমের মেয়ে, জানো চাচা?’
‘বহত খুউব!’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘তবে আবার কী! নহবত লাগিয়ে দাও।’
‘তুমি বুঝতে পারছ না।’ চন্দ্রনাথ বলল, ‘একটা বড় সমস্যা আছে।’
‘কী সমস্যা? তুমি হিন্দু ও মুসলিম?’ বুলবুল মিয়াঁ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘যব তক তু ইধার হ্যায়, ইয়ে কোঈ দিক্কত নেহি। মেটিয়াবুরুজে কেউ নাচাগানা ছাড়া কিছুতেই মাথা খারাপ করে না। সমাজপতি নেই, মৌলবী নেই, কিস্যু নেই।’
‘নানা, সেই ব্যাপার নয়। আমার চিন্তা দত্তজিকে নিয়ে।’ চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলতে লাগল। একবার সহজ হয়ে গেলে সঙ্কোচটা কেটে যায়। আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে সে ধীরে ধীরে বলল, কীভাবে নবকিশোর দত্ত পাশবিক নির্যাতন করে মোতিকে।
শুনতে শুনতে বুলবুল মিয়াঁ থ হয়ে গেল। নবকিশোর তার ব্যবসার অংশীদার, তারা দুজনে মিলেই নবাবের চিড়িয়াখানায় পাখি চালান করে। চারিত্রিক দোষের কথা জানা ছিল, কিন্তু সে যে এমন বিকৃতকাম, তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
বুলবুল মিয়াঁ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘মোতির কষ্টে তোমার কষ্ট হয়?’
‘হয়।’ খুব আস্তে করে বলল চন্দ্রনাথ। বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল মোতির পিঠের সেই দাগগুলো।
বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল ওর। বলল, ‘নবাবকে বলে ওর মাইনেটা বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব ভাবছি।’
‘তবে আর ভেবো না। বলে ফ্যালো। তুমি এখন নবাবের খুশনজরে আছ, উনি মঞ্জুর করবেন।’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘ভাই আমি একটা জিনিস সাফ সাফ বুঝি। হিন্দু বলো মুসলিম বলো, সব ধর্মে মেয়েদের ওপর জোর খাটিয়ে, কষ্ট দিয়ে আমরা তাকত দেখাই। এটা বুঝি না যে মায়ের জাতকে তকলিফ দিয়ে কখনো মরদ হওয়া যায় না।’
২৭
সহবাস সম্মতি আইনের স্বপক্ষে ও বিরুদ্ধে আন্দোলন দেশে অব্যাহত। ‘অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী’ নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় সনাতন সমাজ ক্ষোভে কাঁপছে থরোথরো। মনু, পরাশর কি মিথ্যা হয়ে যাবে নাকি? সমাজপতিরা হতাশায় ম্রিয়মাণ, তবু এখানে ওখানে সভার বিরাম নেই। সেই সভায় উদ্ধৃত হচ্ছে একের পরে এক প্রাচীন শ্লোক, তুলে আনা হচ্ছে বাল্যবিবাহের স্বপক্ষে অগুণতি যুক্তি।
ওদিকে মহারাষ্ট্রে তিলক পূর্বের মতোই অনমনীয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিল-বিরোধী মনোভাব দেখে রাণাডেও বেশ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ। তাই ন্যাশনাল সোশ্যাল কনফারেন্সের কলকাতা অধিবেশনে সহবাস সম্মতির স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতা পেশ করা হলেও ঠিক সুবিধা হল না।
সৌরেন্দ্র সক্রিয়ভাবে কলকাতা অধিবেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু সে ক্রমেই বুঝতে পারছিল, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও তাঁরা রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিরাগভাজন হতে চাইছেন না। তবু সে আশা ছাড়ল না। ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকায় সবকিছু খোলাখুলি লেখা যায় না, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সে প্রচণ্ড উৎসাহে একখানা পত্রিকা চালু করে ফেলল। নাম রাখল, ‘নির্ভীক নারী’।
সেখানে নিজের পরিচয় না প্রকাশ করে প্রথম পুরুষে সে মনের সুখে লিখতে লাগল জ্বালাময়ী সব বক্তব্য।
লিখল, ওহে ভারতকন্যারা, এখনো সময় আছে। আমরা নিজেদের অধিকার নিজেরা না আদায় করে নিলে কেউ এসে তা উপহার দেবে না। আমরা আর কতকাল এভাবে পুরুষের পদানত হয়ে থাকব? এসো, সবাই আমরা জেগে উঠি। আদর্শ করি প্রাচীন গার্গী, মৈত্রেয়ীদের। অশিক্ষা এবং কুসংস্কারের পাঁক থেকে তুলে আনি নিজেদের।
দ্বারকানাথের নিজের পত্রিকা ‘অবলাবান্ধব’ ততদিনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তিনিও তাই সৌরেন্দ্রর এই উদ্যোগে খুব উৎসাহ দিলেন। নিজে উদ্যোগ নিয়ে জোগাড়ও করে দিলেন কিছু অনুদান।
মহিলার জন্য অন্য আরেকটি পত্রিকা রয়েছে। তার নাম ‘বামাবোধিনী’। কিন্তু সেই পত্রিকা মেয়েদের ব্রত, পূজার্চনা এইসব নিয়েই তাদের পৃষ্ঠা ভরায়। হিন্দু পতিব্রতা নারীর কী কী কর্তব্য সংসারের কল্যাণে করা উচিত—তারা মূলত সেইসব নিয়ে লেখে।
মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মেয়েদের সম্মানার্থে কোনো পত্রিকা তখনো সাধারণ মানুষের কল্পনার অতীত। তাই ‘নির্ভীক নারী’ খুব অল্পদিনেই শহরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
ওদিকে দেশের মোট দু-হাজার বিশিষ্ট ভারতীয় মহিলা ভাইসরয়ের কাছে আবেদন জানালেন, বারো নয়, সহবাসের জন্য মেয়েদের ন্যূনতম বয়স করা হোক চোদ্দো বছর। সেটাই স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে উপযুক্ত সময়।
গোঁড়াহিন্দুরা আরো খেপে উঠলেন। বিপরীতে ব্রাহ্মরাও গর্জাচ্ছেন। চলছে শ্লোকের উত্তরে শ্লোক। তর্কের উত্তরে বিতর্ক। সেই তর্কবিতর্ক অহরহ শালীনতা অতিক্রম করছে। অশ্লীলতায় মগ্ন চারপাশ।
ঠিক এইরকম সময়ে হঠাৎ করেই সৌরেন্দ্ররা কয়েক কদম এগিয়ে গেল।
আকস্মিক সেই অগ্রগতির পেছনে যে ঘটনাটি ছিল, তা যেমনই হৃদয়বিদারক, তেমনই মর্মন্তুদ।
ঘটনার কেন্দ্রে একটি বাঙালি কিশোরী। তার নাম ফুলমণি।
কিশোরী না বলে শিশু বলাই শ্রেয়। কোনো কাগজ লিখছে তার বয়স নয়, কেউ লিখছে দশ।
নয়-দশ বছরের ফুলমণির বিবাহ হয়েছিল পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক হরিমোহন মাইতির সঙ্গে। ফুলশয্যার রাতে স্বামীর আদরের তীব্রতা তার কচি দেহ সহ্য করতে পারল না। রক্তে ভেসে যেতে লাগল তার অপরিণত যৌনাঙ্গ। সাড়ে তেরো ঘণ্টা ধরে লড়াই করে শেষে ফুলমণি হার মানল মৃত্যুর কাছে।
আর এই নিয়ে তোলপাড় উঠল সমাজে। পুলিশ — কাছারি। হাইকোর্টে মামলা। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড আন্দোলন।
কিন্তু বিচারে হরি মাইতির কোনো শাস্তি হল না। কারণ, প্রমাণ মিলল, সেই ফুলশয্যার মাত্র কয়েকদিন আগেই ফুলমণির দশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। আর প্রচলিত আইনে দশোর্ধ্ব বালিকার সঙ্গে সহবাস বৈধ। কাজেই, বেকসুর খালাস পেল কামার্ত হরিমোহন।
এই নিয়ে প্রচণ্ড তীব্র হয়ে উঠল বিলের স্বপক্ষে আন্দোলন। রক্ষণশীলরা যতই বলুন যে হরিমোহন মাইতি ব্যতিক্রম, এমন অমানবিক পাষণ্ড কোনো বাঙালি পুরুষই নয়, নব্যপন্থীরা পরিসংখ্যান দিয়ে নস্যাৎ করে দিলেন। বললেন, ফুলমণির ঘটনাটা প্রচারের আলোয় এসেছে মাত্র, এমন ঘটনা শহরে বা গ্রামে ঘটে প্রায়ই। কেউ জানতে পারে না।
সৌরেন্দ্র লিখল, ফুলমণি তার স্বল্পায়ু জীবন দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে গেল যে অবিলম্বে সহবাস সম্মতি আইন দেশে বলবৎ করা কতটা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে নারীজীবনের মূল্য এতটাই কম, এইরকম ন্যক্কারজনক হত্যাকারী ছাড়া পেয়ে গেল। আমরা ভুলে যাই, যতই সমাজ প্রগতিশীল হোক, একটি ডানায় ভর দিয়ে কোনো পাখি উড়তে পারে না।
ভুবনমণি সেদিন পাশে বসে সাগ্রহে দেখছিল লেখাটা। সে এখন অনেক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রাখে নিজেকে। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে ‘কল’ এলেই সে কাদম্বিনীর সঙ্গিনী হয়। কাদম্বিনীর সঙ্গে গিয়ে গিয়ে সে এখন প্রাথমিক চিকিৎসার অনেক কিছু আয়ত্ত করে ফেলেছে। কীভাবে ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হয়, কীভাবে কোনো স্ফোটকে সেঁক দিতে হয়, সব সে শিখেছে।
অবশিষ্ট দিনগুলো সে এই ব্রাহ্মসমাজের দপ্তরে চলে আসে। বাড়ির পাশেই এই দপ্তর। প্রথম কয়েকদিন একরকম সৌরেন্দ্র, গগনচন্দ্র হোম এবং দ্বারকানাথের জোরাজুরিতেই এসেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার আড়ষ্টতা কেটেছে।
এখন সে আগের মতো আবক্ষ অবগুন্ঠন টানে না। মাথায় ঘোমটা থাকলেও তাতে সে মুখ ঢাকে না।
এখানে যারা আসেন, তাদের প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত ব্রাহ্ম পরিবারের মহিলা। তাঁদের কথাবার্তা, চালচলন খুবই পরিশীলিত, ভুবনমণি তাঁদের ধারেকাছেও যায় না। কিন্তু সে গভীর আগ্রহের সঙ্গে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে, ব্লটিং কাগজের মতো শুষে নিতে চায় যা কিছু শিক্ষণীয়।
গগনচন্দ্রও লক্ষ্য করেছেন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই তুতো ভগ্নিটির জানার ইচ্ছা অদম্য। যে গ্রাম্য তরুণীটি জড়োসড়ো পায়ে এসেছিল, সে যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ভুবনমণি এখন ইংরেজি বাংলা দুই-ই গড়গড় করে পড়তে পারে। এখন প্রায়ই ব্রাহ্মসমাজের গ্রন্থাগার থেকে সে বই নিয়ে যায়। দেশী-বিদেশি সাহিত্য গেলে গোগ্রাসে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে পড়তে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
ভুবনমণির নিজেরও মনে হয়, সে যেন এতদিন মশাট গ্রামে একটা অন্ধকার কুয়োর মধ্যে পড়েছিল। হঠাৎ করেই এসে পড়েছে প্রকাণ্ড সমুদ্রে।
মাঝে মাঝে ত্রাসজাগানো অতীত তার মনে যে একেবারেই হানা দেয় না, তা নয়। মধ্যরাতে নিজের শরীরের ওপর পাশবিক অত্যাচারের স্বপ্ন দেখে সে চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর ভাবে এ নেহাতই দুঃস্বপ্ন।
কোনোদিন আর যার পুনরাবৃত্তি হবে না।
আশার এই আলো দেখার সময় যে ভয়ে ওর বুক একেবারেই কাঁপে না, তা নয়। ওর যে অদৃষ্টই মন্দ। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। নাহলে একটার পর একটা বিপর্যয় কী এইভাবে ঘটতে পারে?
নতুন বউদিদিকে সে সব খুলে বলেছে। সব জানার পর কাদম্বিনী তাকে যেন আরো বেশি কাছে টেনে নিয়েছেন। বুঝিয়েছেন, দেহ একটা খোলসমাত্র। তার ওপর কেউ আক্রমণ করলেই তা অশুচি হয়ে যায় না। শুচিতা লুকিয়ে থাকে মনের মধ্যে।
কোনো অলস দুপুরে যখন বাড়িতে কেউ থাকে না, তখন ভুবনমণির খুব মনে পড়ে দাদার কথা। বউদিদির কথা। অপা-লোপা-দিব্যর কথা। দাদা-বউদি-দিব্য সেই ভিনদেশে গিয়ে কী করছে? ওদের কি খুব খাটাচ্ছে সেই আখখেতের মালিকরা?
আর অপা? সে কেমন সতীনঘর করছে? কী আশ্চর্য! দুই ভাইঝি আর সে একই শহরে রয়েছে, অথচ কতদিন দেখা নেই। দেখতে ইচ্ছে হলেও সে চলতে পারে না, নবকিশোর দত্তের সেই হুমকির কথা মনে পড়ে যায়।
আচ্ছা, নতুন বউদিদিকে তো এখন মাঝে মধ্যেই কলকাতার নানা ধনীবাড়িতে রুগি দেখতে ডাকে, এমন তো হতেও পারে, কখনো অপার শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাকল? ভুবনমণি গিয়ে অন্দরমহলে দেখতে পেল, অপা গিন্নীবান্নি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে?
ওহ, কী মজাই না হবে তাহলে!
সৌরেন্দ্র বলল, ‘দেখো তো, কেমন লিখলুম।’
চমক ভেঙে ভুবনমণি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। পড়তে পড়তে বলে উঠল, ‘কিন্তু আইন বলবৎ হলেও তা প্রয়োগ করা তো শক্ত। কার ঘরে কী হচ্ছে তা সরকার কীভাবে জানবেন? বিয়ে তো নিষিদ্ধ হচ্ছে না। এমনকী কেউ অন্যায় করে সাজা পেলেও সে তার স্ত্রীর স্বামীই থাকবে।’
সৌরেন্দ্র ভুবনমণির মতামতে বিস্মিত হল না। মেয়েটা এমনই সুচিন্তিত মতামত দেয় ইদানীং। সত্যি বলতে কি, ভুবনমণি এখন হাজার হাজার বাঙালি মেয়ের কাছে আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। শত শত কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে ডেকে দেখানো যেতে পারে, সঠিক শিক্ষা এবং সুপরিবেশ পেলে কত অল্পদিনে একজন আলোকপ্রাপ্তা হতে পারে।
সৌরেন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। কারুর ঘরে উঁকি দিয়ে অপরাধী ধরা সম্ভব নয়। কিন্তু, এই আইনকে আমরা শিক্ষামূলক হিসাবেই বেশি দেখতে চেষ্টা করছি ভুবন। বাল্যবিবাহ, শিশু বা কিশোরীর সঙ্গে সহবাস যে অনাচার, সেটা বোঝানোর জন্যই এই আইন বেশি করে লাগু হওয়া প্রয়োজন। তারপর ধরো, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতারাও কিছু বেশি সময় পাবেন। সমাজপতিরা তাদের চট করে একঘরে করতে পারবেন না, ভাববেন এই আইনের জন্যই বিলম্ব হচ্ছে।’
ভুবনমণি চুপ করে রইল। কিন্তু অল্প ঘাড় নেড়ে বোঝাতে চাইল, সৌরেন্দ্র ঠিকই বলছে।
ওদিকের একটা টেবিলে বসে কাজ করছিলেন গগনচন্দ্র। তিনি নাকে এঁটে বসে থাকা চশমা কিছুটা ওপরে তুলে বললেন, ‘অত সহজ নয় ভায়া। তোমার নির্ভীক নারী যতই গলা তুলুক, সমাজপতিরা আছেন সেই তিমিরেই। এইতো, আজকের কাগজে দেখলুম, কোথাকার কোন পাঁচকড়ি মুখুজ্জে নিজের খরচে ভাটপাড়া থেকে একশো জন পণ্ডিতকে আনিয়েছেন। সেই পণ্ডিতরা দিনরাত মুখুজ্জেমশাইয়ের জনাই গ্রামের বাসস্থানে থেকে শাস্ত্র থেকে বাল্যবিবাহের সমর্থনে কঠিন কঠিন সব শ্লোক খুঁজে বের করছেন। তারপর নাকি সেসব তর্জমা করে পাঠানো হবে বড়লাটের কাছে।’
সৌরেন্দ্র কিছু বলার আগেই ভুবনমণি বলল, ‘জনাইয়ের পাঁচকড়ি মুখুজ্জে!’
‘হ্যাঁ ।’ গগনচন্দ্র অপাঙ্গে তাকালেন, ‘কেন, তুমি চেনো নাকি তাঁকে। হুগলীরই বামুন তো, কেউ হয় নাকি তোমার?’
‘না না!’ তৎক্ষণাৎ বলল ভুবনমণি। তার বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াস ধড়াস করছে।
চাইলেও সে বলতে পারল না, প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাকে ওই পাঁচকড়ি মুখার্জির অঙ্কশায়িনী হতে একসময় প্রায় বাধ্য করা হচ্ছিল। দাদা-বউদিদি শুধুমাত্র তাকে বাঁচাতে একবস্ত্রে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। আর তার ফলস্বরূপ তাদের এখনকার দুর্গতি।
বলতে পারল না, ওই পাঁচকড়ি মুখুজ্জের জন্যই ওদের পরিবারটা আজ এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে গেল।
ভাবতে ভাবতে তার মনটা অপরিসীম ক্রোধে ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা তো এই আইনের বিরুদ্ধাচরণ করবেনই, নাহলে প্রৌঢ়ত্বেও উপনীত হয়েও কিশোরীকন্যা বিবাহ করবেন কী করে!
আর কতকাল এইরকম মানুষগুলো পৃথিবীতে থাকবে?
ঠিক এইসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল একটা লোক।
ব্রাহ্মসমাজের এই দপ্তরে প্রধানত ভেতরের কাজ হয়। কর্মীরা ছাড়া সেভাবে কেউ আসে না। এই লোকটার পরনে খেটো ধুতি, হাতে লাঠি। বেশ পুরুষ্টু গোঁফ। দেখলেই মনে হয় সে কোথাও দ্বাররক্ষীর কাজ করে।
কথোপকথন শুরু হতেই বোঝা গেল অনুমান সঠিক। আধা বাংলা আধা দেহাতি হিন্দিতে সে বলল, ‘নমস্তে বাবুসাব। হামারা মাঈজি আয়ি হ্যায়, ইধার যো বাহাদুর অঊরত রেহতি হ্যায়, উসকি সাথ মিলনা চাহতি হ্যায়। কৃপয়া উসকো জারা বুলা দিজিয়ে।’
বাহাদুর অউরৎ? সে আবার কে?
সৌরেন্দ্র আর গগনচন্দ্র ভ্রু কুঁচকে একে অন্যের দিকে তাকালেন।
পরক্ষণেই সৌরেন্দ্র বলল, ‘ওহো, বুঝলেন না? আমার কাগজে তো লেখকের নাম থাকে না, এঁর মাঈজি ভেবেছেন তা বোধহয় কোন স্ত্রীলোকের লেখা। নির্ভীক নারী থেকে বাহাদুর অউরৎ। এবার বুঝলেন কি?’
কথাটা বলে ও উঠে দাঁড়াল। এত অল্পদিনের পত্রিকা, এই প্রথম একেবারে অচেনা কেউ এসেছেন সন্ধানে। তাও আবার সম্ভ্রান্ত ঘরের স্ত্রীলোক। তার মানে অন্তঃপুরচারিণীরাও এখন তার লেখা পড়ছেন?
পুলকিত হৃদয়ে শশব্যস্ত হয়ে সে আনতে গেল বাইরে গাড়িতে অপেক্ষারত সেই অপরিচিতা মাঈজিকে।
গগনচন্দ্র ভুবনমণির দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘দ্যাখো, তোমাকেই না এবার নির্ভীক নারী সাজতে হয়!’
দয়াময়ী গাড়ি থেকে নেমে সৌরেন্দ্রর পিছুপিছু দপ্তরে ঢুকল।
ঢুকে অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকেই বেশ বিস্মিত হল।
একজন বিধবা যুবতী স্বচ্ছন্দভাবে বসে আছে ঘরের মাঝখানে। অন্য আরেকদিকে টেবিলে কাজ করছেন এক ভদ্রলোক। পাশের কোনো ঘরে শব্দ হচ্ছে খুটখাট।
ঠিক জায়গায় এসেছে তো ও আদৌ?
সৌরেন্দ্র দয়াময়ীর মনের ভাব আন্দাজ করে দ্রুত বলল, ‘আপনি বসুন মা। এটাই নির্ভীক নারীর দপ্তর। আমিই ওই পত্রিকার সম্পাদক।’
দয়াময়ী মুখে বলল, ‘তুমি লেখো? আমি ভেবেচিলুম কোন মেয়েমানুষ বুঝি!’
সৌরেন্দ্র স্মিতমুখে বলল, ‘মেয়েরাই তো লেখেন মা। মেয়েদের মনের দুঃখ, কষ্টই তো ফুটে ওঠে সেখানে। আমি তো কলমচি মাত্র। আপনি বসুন।’
দয়াময়ী আড়ষ্টভাবে গিয়ে বসে ভুবনমণির পাশে। অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে।
যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে এই প্রথম সে জীবদ্দশায় একা একা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে। তাও আবার এসে উপস্থিত হয়েছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক স্থানে। তার জন্য তাকে নিতে হয়েছে অনেক মিথ্যা ও শঠতার আশ্রয়। উৎকোচে হাত করতে হয়েছে গাড়ির কোচোয়ানকে।
কিন্তু কিছু করার নেই।
কখনো কখনো প্রয়োজনের গুরুত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে লজ্জা, সংকোচ এইসবই ম্লান হয়ে যায়। প্রয়োজন পড়ে মিথ্যা কথা বলে বাইরে বেরোনোরও।
সৌরেন্দ্র বলল, ‘বলুন মা।’
দয়াময়ী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কীভাবে যে ও শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সাত পাঁচ না ভেবে ও বাড়ি থেকে কিছুটা ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন একটু অপ্রতিভ ঠেকছে।
সৌরেন্দ্র আর পীড়াপীড়ি করল না। দয়াময়ীকে সময় দিল একটু থিতু হয়ে নেওয়ার জন্য।
প্রায় অর্ধেক দণ্ড পর দয়াময়ী অস্ফুটে বলল, ‘আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ। বড়ঘরের মেয়ে ছিলুম, এখন বড়ঘরের বউ। লেখাপড়া জানিনে। কিন্তু জানতে সাধ জাগে। তাই আমাদের বাড়ির সরকারমশাইয়ের ছেলে মহিম আমাকে অবসরে পড়ে শোনায়। লক্ষ্মীর পাঁচালি, ব্রতকথা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, এইসব। শোনানো হয়ে গেলে একদিন মহিম উঠে চলে যাচ্চে, দেখি তার ঝোলায় একটা খবরের কাগজ। তকনই জানলুম আপনার কাগজের কথা। মহিম পড়ে শোনালে। শুনতে শুনতে কেঁপে উঠলুম। এ যে আমারই মনের কথা!’
সৌরেন্দ্র মৃদু মাথা নাড়ল।
দয়াময়ী বলে চলেছিল, ‘মনে হল আমাদের দেশে মেয়েদের অবস্থান যে সত্যিই কতটা নীচে, তা এইভাবে চোখে আঙুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়নি। আমাদের জন্মই বাড়িতে দুঃখ আনে। জন্মানোর পরের মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে যায় কোনোভাবে বেড়াল পার করার চেষ্টাচরিত্তির। ঠিকমতো জ্ঞান হবার আগেই সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হয় শ্বশুরবাড়ি। সেখানে নতুন মানুষ। নতুন পরিবেশ। খাপ খাওয়ানোর আগেই গঞ্জনা, লাঞ্ছনা। তারপর শুরু আমাদের একমাত্র কাজ। পরের পর ছেলে বিয়নো। পারলে ঠিক আছে, না পারলেই তুমি বাঁজা। তুমি অপয়া। এই যেমন আমি।’
শুধু সৌরেন্দ্র নয়, দয়াময়ীর কথার মধ্যে এমনকিছু ছিল, কখন যেন গগনচন্দ্রও হাতের কাজ থামিয়ে শুনতে শুরু করেছিলেন সামনের প্রৌঢ়া মহিলাটির অনুচ্চ কথাগুলো। ভুবনমণিও শুনছিল মন দিয়ে।
এইভাবে কোনো অন্তঃপুরচারিণীর আত্মজৈবনিক বক্তব্য তাঁরা সম্ভবত এর আগে কখনো শোনার সুযোগ পাননি।
‘সারাটা জীবন আমাদের কেটে যায় পতিসেবা করতে। আমাদের আসল ভগবান নাকি আমাদের সোয়ামি। কিন্তু সোয়ামি যদি ভগবান হয়, সে কী করে বউকে মেরে ফেলতে পারে?’
সৌরেন্দ্রকে চমকে উঠতে দেখে দয়াময়ী বলল, ‘আমি ওই হরিমোহন মাইতির কথা বলচি। ওই খবরটা শোনার পর থেকে আমার বুকের ভেতরটা উথাল পাথাল করচে।’
‘সে তো করাটাই স্বাভাবিক মা।’ সৌরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল, ‘ওইটুকু একটা ফুলের মতো শিশুকে যে অপরিসীম যন্ত্রণা ভোগ করে পৃথিবী ছাড়তে হল, তা শুনে পাষাণও গলে যাবে। আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল মেয়েদের অবদমিত করে রাখা। অশিক্ষা, কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, নির্যাতন এইসব এখন প্রায় প্রতিটা বাঙালি মেয়ের জীবনে ফোঁড়ার মতো জাঁকিয়ে বসেছে। আমার দিদি প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক হয়েছেন। হতে পেরেছেন কারণ তাঁকে ছোট থেকে শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া হয়েছিল। মুক্তমনে বেড়ে ওঠার পরিকাঠামো দেওয়া হয়েছিল। ফুলমণি নামের ওই বাচ্চা মেয়েটিও যদি তেমন পরিবেশ পেত, কে বলতে পারে, যে সেও সমাজের একজন মান্যগণ্য হত না?’
শুনতে শুনতে কখন যেন দয়াময়ীর ঘোমটার আড়াল খসে পড়েছিল। প্রকাশ্যে জ্বলজ্বল করছিল প্রৌঢ়ার অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকা দেহটা। অসূর্যম্পশ্যা নারীর সীমন্তরঞ্জিত মুখে এসে পড়ছিল দিনের আলো।
কিন্তু দয়াময়ী তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না। তার ঠোঁটদুটো ইতস্তত কাঁপছে। চোখ রক্তাভ। চাপাস্বরে বলল, ‘শোনো বাবা! আমিও একজনকে চিনতুম যার মাথা ছিল খুব পরিষ্কার। কিন্তু তাকেও ঠিক ফুলমণির মতোই মরে যেতে হয়েছে। অকালে। কাকপক্ষীতেও টের পায়নি।’
‘কে সে?’ সৌরেন্দ্র প্রশ্ন করল।
‘আ-আমার সতিন।’ দয়াময়ী কয়েকমুহূর্ত দম নিল মাত্র। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘সতিন বলচি বটে, কিন্তু সে ছিল আমার মেয়েরই মতো। আমার সোয়ামির চতুর্থ পক্ষ। বে’র পর যখন বাড়িতে এসেচিল, তখন তার বোধ হয় ওই দশ বছরই বয়স। তেরাত্তিরও সে রেহাই পায়নি, আমার সোয়ামির সোহাগে এক হপ্তার মধ্যে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্মশান যাত্রা করেচিল। আমার সোয়ামি আর তার লোকলস্কর মিলে খুব গোপনে তার সৎকার করেচিলেন। কারণটা তখন জানতুম না। তোমার কাগজ পড়ে জানতে পেরেই ছুটে এসেচি।’
সৌরেন্দ্র হতভম্ব মুখে শুনছিল। গত কয়েকদিন ধরে তারা ফুলমণির জন্য ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াই চালাচ্ছে। সংবাদপত্র, আদালত থেকে শুরু করে পাড়ার মজলিশ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র এই মামলার রায় নিয়ে জল্পনা-আলোচনা।
অথচ কেউ কল্পনাও করতে পারছে না, এই শহরেরই বুকে সবার অলক্ষ্যে নীরবে প্রাণ দিয়েছে আর এক ফুলমণি! হত্যা করা হয়েছে আরো একটি শিশুকন্যাকে।
ও বলল, ‘এটা কবে হয়েছে মা?’
‘তা আজ প্রায় মাসছয়েক হতে চলল বাবা!’ দয়াময়ীর চোখ জলে ভরে উঠল, ‘সেই পোড়ারমুখীকে আমি ওই ক’দিনেই বড্ড ভালোবেসে ফেলেচিলুম! আমি ডাকতুম অবলা বলে। সে ওই অবস্থাতেই মুখে একরাশ হাসি নিয়ে বলত, সে অবলা নয়। তার মাথা নাকি খুব পরিষ্কার, তাই তার নাম অপলা। পুরোনো যুগের এক পণ্ডিত মেয়েমানুষের নামে।’
ভুবনমণি এতক্ষণ সাগ্রহে শুনছিল কথোপকথন। শুনতে শুনতে সে আলগোছে দপ্তরের গতসংখ্যার পত্রিকার পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছিল।
নামোচ্চারণে দয়াময়ী ভুল করলেও সে উল্কার গতিতে মুখ তুলল। বলল, ‘অপালা?’
‘হ্যাঁ । হ্যাঁ । অপালা।’ দয়াময়ী জিভ কাটল, ‘মুখ্যু মেয়েমানুষ, ভুল বলে ফেলিচি। তারা দু’বোন। দুজনের নামই বড্ড খটোমটো, ওই পুরনো মেয়েপণ্ডিতের নামে। ছোটোটার নাম আরো শক্ত, আমি লোপু বলে ডাকি। তাদের বাপ পাড়াগাঁয়ে পণ্ডিত ছিল তো, সেই নাকি রেকেচিল।’
দয়াময়ীর ভ্রান্তিস্বীকার সম্পূর্ণ হল না। তার আগেই ভুবনমণি প্রচণ্ড বিস্ময়ে কাঁপতে শুরু করল। সৌরেন্দ্র বা গগনচন্দ্র কিছু বুঝতে পারার আগেই কাঁপতে কাঁপতে অস্ফুট সে এলিয়ে পড়ল দপ্তরের শানবাঁধানো মেঝেতে।
জ্ঞান হারানোর পূর্বক্ষণে সে শুধু উচ্চারণ করতে পারল, ‘অপা!’
২৮
কাদম্বিনী বাড়িতেই ছিলেন সেদিন। পূর্ণগর্ভা বলে নয়, তিনি প্রসবের আগের দিন পর্যন্তও হাসপাতালে ছুটি নেন না।
কিন্তু হিমানীর শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। দিনদিন মেয়েটা অসুখে ভুগে ভুগে রোগা হয়ে যাচ্ছে। যেদিন তার শরীর খুব খারাপ থাকে, সেদিন যতই দিদি বিধুমুখী থাকুক বা পিসিমা ভুবনমণি, মা’কে সে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। চুপচাপ মায়ের কোল আঁকড়ে পড়ে থাকে।
কাদম্বিনী হিমানীকে মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের দেখিয়েছেন। সবাই প্রায় একমত। হিমানীর পেটে একটি গ্রন্থি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এত ছোট শিশুর ক্ষেত্রে প্রথমেই টিউমারটি অপারেশন করে বাদ না দিয়ে ওষুধ দিয়ে গ্রন্থিটির বৃদ্ধি রোধ করাই প্রচলিত নিয়ম।
সেই চেষ্টাই চলছে, কিন্তু হিমানী ক্রমশই জীর্ণ হয়ে পড়ছে।
তার আপেলের মতো টুকটুকে গালদুটো কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, চেহারাটা ভেঙে গিয়েছে অনেক। সারাক্ষণই তার মুখে অরুচি, খেতে অনীহা।
সেই প্রাণোচ্ছল শিশুটি যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
কাদম্বিনী অন্যমনস্কভাবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর মন খুবই বিক্ষিপ্ত। প্রতিদিন তিনি এত রুগী দেখেন, টিউমারের বৃদ্ধি স্থগিত করার ওষুধ তিনি প্রায়ই রুগিদের প্রেসক্রিপশনে লেখেন। কিন্তু নিজের গর্ভজাত সন্তান এভাবে দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে, তা তিনি মা হিসেবে সহ্য করতে পারছেন না।
তিনি নিজে ভালো করে হিমানীকে পরীক্ষা করেছেন। তার পেটের নানাস্থানে চাপ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছেন টিউমারটির আয়তন। তাতে তাঁর মনে হয়েছে, এইভাবে ওষুধ দিয়ে টিউমারটিকে হয়ত আটকানো যাচ্ছে না।
কাদম্বিনী মনেপ্রাণে চাইছেন কোনো ভালো সার্জেন অপারেশন করুন। স্বামীকেও জানিয়েছেন তাঁর এই অস্থিরতার কথা।
দ্বারকানাথ অবশ্য এতটা উতলা হননি। তিনি স্ত্রীকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘এত বড় বড় ডাক্তার যখন ওষুধের ওপর ভরসা করছেন, তুমি একটু ধৈর্য ধরো। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। হিমু ভালো হয়ে উঠবে।’
দ্বারকানাথ ডাক্তার নন। সাধারণ মানুষ কাটাছেঁড়া, রক্তপাত সবসময়েই এড়াতে চায়। কিন্তু একজন চিকিৎসক হয়ে কাদম্বিনী শান্ত থাকতে পারছেন না। নিজের দুশ্চিন্তার কথা তিনি খুলে বলতে গিয়েছিলেন বন্ধু অবলাকে। কিন্তু সেখানেও লাভ হয়নি।
দুর্গামোহন দাসের দুই কন্যা সরলা ও অবলা তাঁর পুরনো বন্ধু। অবলা কাদম্বিনীর আগেই মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু অন্তিম বর্ষে পড়া অসম্পূর্ণ রেখে সে ফিরে এসেছে। তার শরীর নাকি মাদ্রাজের জলহাওয়ায় মানাতে পারছে না।
কাদম্বিনী প্রথমে খুব রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুই এটা কী করলি? এতদিন ধরে পড়ে ফাইনাল ইয়ারে ছেড়ে দিয়ে এলি?’
অবলা প্রথমে বেশি কিছু বলতে চায়নি। তারপর অনেক পীড়াপীড়িতে বলেছিল, সে বিবাহ করতে চায়। বিদেশে নিঃসঙ্গ জীবন তার আর ভালো লাগছে না।
কাদম্বিনী হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কাকে?’
অবলা তখন জানিয়েছিল, ব্রাহ্ম সমাজেরই সদস্য ভগবান বসুর সুদর্শন মেধাবী পুত্র জগদীশচন্দ্রের কথা। সে এখন বিলেতে পড়াশুনো করে। অবলাকেও বিয়ে করে সেখানেই নিয়ে যেতে চায়।
‘ওর আমাকে পাশে পাওয়াটা এখন দরকার।’ অবলা মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘আমার ডাক্তার হওয়ার চেয়েও সেই প্রয়োজনটা অনেক বেশি রে!’
কাদম্বিনী আর কিছু বলেননি। তাঁর আর ইচ্ছা করেনি নিজের সমস্যার কথা বলতেও। শুধু ভেবেছিলেন তাঁর সঙ্গে অবলার কত তফাত! তিনি স্বামী-পুত্র-ভরা সংসার নিয়েও নিজের স্বপ্নপূরণের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, আর অবলা সব পেয়েও হেলায় ছেড়ে দিচ্ছে, শুধু ভালোবাসার জন্য।
মেয়েরাই হয়ত পারে এমন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে!
হিমানীর জন্য কাদম্বিনী ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেন। নিজে হাসপাতালে শ্বেতাঙ্গ চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্যে সার্জারিতে হাত পাকানোর কোনো সুযোগই পান না, ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি এই বিষয়ে তাই রীতিমতো অপটু। আর সেইজন্যই হয়ত শহরের নামী শল্যচিকিৎসকরা এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে তেমন আলোচনাও দীর্ঘায়িত করতে চান না। কাদম্বিনী স্পষ্ট বুঝতে পারেন, মুখে কিছু না বললেও তাঁদের মুখে ফুটে ওঠে তাচ্ছিল্যের প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি।
একে তো মহিলা বলে তাকে সাধারণ মানুষ সেভাবে গুরুত্বই দেয় না। ভুবনমণিকে নিয়ে গতসপ্তাহে একটি অভিজাত গৃহে গৃহকর্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলেন। চিকিৎসা অন্তে তাঁকে ও ভুবনমণিকে বসতে দেওয়া হল বাড়ির পরিচারকদের জন্য নির্দিষ্ট বারান্দায়। তিনি নিজে যতই পারদর্শিতার পরিচয় দিন, সাধারণ মানুষ ভাবে তিনি যোগ্যতায় অনেক নিকৃষ্ট।
শহরের নামী চিকিৎসকরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হয়ত সেটাই ভাবেন। যে এম. বি ডিগ্রিই পায়নি, এল. এম. এস. পাশ করে ডাক্তার হয়েছে, যার সার্জারিতে সেভাবে কোনো ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাই নেই, তার সঙ্গে আলোচনা তাঁদের কাছে হয়ত সময়াপচয় মনে হয়।
অথচ কাদম্বিনীর মনপ্রাণ পড়ে থাকে অপারেশন থিয়েটারের ভেতর। তাঁর প্রকৃত আগ্রহ সার্জারিতেই। ছাত্রাবস্থায় তিনি যে ক’টা অপারেশনে সহকারীর কাজ করেছিলেন, প্রতিটাতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব আর কে মনে রাখে!
অসুস্থ মেয়েকে আঁকড়ে বসে থাকতে থাকতে কাদম্বিনীর চোখ জলে ভরে যায়। তিনি অত্যন্ত শক্ত মেয়ে, শত বাধাতেও মাথা নোয়ান না। কিন্তু নিজেকে ইদানীং যেন বড় অসহায় মনে হয় তাঁর!
মনে হয়, কোনো একটা হাসপাতালে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেতেন, যদি সার্জারিতে একটু পোক্ত হতেন, কারুর পরোয়া করতেন না তিনি। নিজেই অপারেশন করে ঠিক বাদ দিতেন হিমানীর টিউমারটা। আবার হাসত খেলত তাঁর মেয়েটা।
সৌরেন্দ্রর কাছ থেকে ভুবনমণির জ্ঞান হারানোর সংবাদ পেয়ে বিধুমুখী যখন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল, তখনো কাদম্বিনী আকাশপাতাল ভেবে চলেছিলেন। হিমানী ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বিধুমুখীর মুখে ঘটনাটা শুনে কাদম্বিনী এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। নিজের চিকিৎসার বাক্সটা হাতে নিয়ে চললেন ব্রাহ্ম সমাজের দপ্তরে। তাঁর গর্ভাবস্থার এখন নয় মাস চলছে। এইসময় চলার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে আসে, ক্লান্তিতে বুজে আসে দেহ। মেয়েরা বিশ্রামে থাকতে চায়।
কিন্তু কাদম্বিনী যেন অন্য ধাতুতে গড়া। বিধুমুখী বারবার পালকিতে যেতে বললেও তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বললেন, ‘কাহারদের খবর দিতে দিতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এইটুকু তো রাস্তা, এক্ষুনি পৌঁছে যাব।’
বাধ্য হয়ে বিধুমুখীও চলল সঙ্গে।
সৌরেন্দ্র আর গগনচন্দ্র মিলে ভুবনমণির চোখে মুখে বারবার জলের ছিটে দিচ্ছিল। ভুবনমণির মাথাখানা নিজের কোলে টেনে নিয়েছিল দয়াময়ী। সে এখনো অবশ্য জানে না এই বিধবা যুবতীটি কোন জাতের, কিন্তু অপালা চলে যাওয়ার পর থেকে তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। সারাজীবন যে ছোঁয়াছুঁয়ি, জাতপাতের জন্য ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত, সবকিছু হঠাৎ করেই যেন ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে উঠছে তার কাছে।
এই বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথম দর্শনেই মেয়েটির প্রতি তার এক অদ্ভুত বাৎসল্যবোধ জেগে উঠেছিল। মেয়েটি অনিন্দ্যসুন্দরী, পরনের শ্বেতশুভ্র পোশাক যেন তার সৌন্দর্যকে আরো পবিত্র করে তুলছিল। মেয়েটি সাদা থানের নীচে ঊর্ধাঙ্গে পরে আছে একটি সাদা জামা। জামাটা ঠিক বিলিতি মেমদের মতো নয়, আবার এমনভাবে শাড়ির নীচে জামা পরতে দয়াময়ী কাউকে দেখেনি। তারা অন্দরমহলে আদুর গায়ে শাড়ি পরতেই অভ্যস্ত। আজ এই প্রথম সে বাইরে বেরিয়েছে, তাই শাড়ির ওপর তাকে চড়াতে হয়েছে একটি বহুমূল্য কাশ্মীরি শাল।
কাদম্বিনী পৌঁছনোর আগেই ভুবনমণির জ্ঞান ফিরে এল। জলসিক্ত চোখমুখ নিয়ে ধীরে ধীরে সে উঠে বসল। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে ফেলল।
‘কী হয়েছে ভুবন?’ গগনচন্দ্র বললেন, ‘তোমার কি শরীরে কোনো কষ্ট হচ্ছে?’
নতনেত্র ভুবনমণি উত্তর দিল না। কিন্তু তার কান্নার দমক ক্রমেই তীব্র হতে লাগল।
দয়াময়ী কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু জীবনে প্রথমবার হঠাৎ করে এতগুলো অপরিচিত মানুষের মধ্যে বসে থেকেও তার সংকোচবোধ যেন লোপ পেয়েছিল। কী মনে হল, সে ভুবনমণির পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কাঁদচিস কেন মা?’
তার স্নেহার্দ্র মাতৃসম ভাষণে কাজ হল। ভুবনমণি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, ‘তোমার ওই মরে যাওয়া সতিন আমার নিজের ভাইঝি গো! আমার অপা! আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি তাকে। ডিপো থেকে বিয়ে করে নিয়ে গেল নব দত্ত। তারপর মরে গেল?’
প্রচণ্ড কান্নায় তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। সবাই বিস্ময়ে এতটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যে কোনো কথা বলতে পারছিল না।
ভুবনমণি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘কোনো শাস্তি হবে না ওই পাষণ্ডটার? এইভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে?’
সৌরেন্দ্র কিছু বলার আগেই দয়াময়ী ম্লান হাসল। অদ্ভুত বেদনাব্যঞ্জক সেই হাসি।
অস্ফুটে বলল, ‘ছাড়া না পেলে তিনি পঞ্চম পক্ষ করবেন কী করে মা! ধনঞ্জয় পণ্ডিতের বুদ্ধিতে এবার তো তিনি তোমার ছোট ভাইঝির দিকে নজর দিয়েচেন।’
‘কি!’
‘হ্যাঁ । এই হপ্তাতেই বে’টা সেরে ফেলবেন। ওই মেয়েটারও যাতে অমন দশা না হয়, তাই তোমাদের কাছে বলতে এসেচিলুম। থানা, পুলিশ সব ওঁর পকেটে, অন্যভাবে যদি কিচু করা যায়! নাহলে লোপাকেও বাঁচানো যাবে না। তার তো বয়স মোটে নয়! আমার সোয়ামির সোহাগ সহ্যি করার ক্ষমতা তার নেই। আর অন্যভাবে বাড়ি থেকে বেরও করা যাবে না। কড়া নজর রয়েচে তার ওপর।’
ভুবনমণি ফ্যাকাসে চোখে তাকাল দয়াময়ীর দিকে।
২৯
কিছু কিছু দিন কী সুন্দরভাবে যে শুরু হয়!
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেতে চন্দ্রনাথের প্রথম এই কথাটাই মনে হল।
মোতির ঘরের পূর্বদিকের জানালাটা অল্প খোলা, তা দিয়ে নরম রোদ ঢুকছে ঘরে। সেই রোদের একটুকরো আলো এসে পড়েছে ঘুমন্ত মোতির মুখে। রৌদ্রস্নাত মোতির সেই মুখটা এখন লাগছে একটি অপাপবিদ্ধ কিশোরীর মতো।
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ গাঢ়চোখে তাকিয়ে রইল সেইদিকে। তারপর ঝুঁকে পড়ে মোতির প্রসাধনহীন ঠোঁটে আলতো একটা চুম্বন করল।
মোতির তাতে ঘুম ভাঙল না। কিন্তু তার টানা টানা আঁখিপল্লবগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল।
চন্দ্রনাথ আরো কিছুক্ষণ কেমন মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে নেমে এল বিছানা থেকে। দিনের প্রথম আলোয় একটু যেন সংকুচিতও হয়ে পড়ল।
কাব্য করে বলতে গেলে, গত রাতে সে প্রথম একজন পরিপূর্ণ পুরুষে উত্তীর্ণ হয়েছে। ক্ষুধার্ত যাযাবরের মতো সন্ধান করেছে নানা গুপ্ত রহস্যের। জীবনে প্রথমবার আশ্লেষে পান করেছে কোনো যুবতীর অধরসুধা। উপনীত হয়েছে সেই গোপন উপত্যকায়, যার বর্ণনায় মহাকবি কালিদাস বলেছিলেন, ‘নতনভিরন্দ্রং ররাজ তন্বী নবরোমরাজি।’
আকস্মিক সেই উত্তরণের পেছনে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নবাব কাল ছিলেন খোশমেজাজে। মোতির জন্য চারগুণ বেশি মাসোহারার প্রতিশ্রুতি আদায় করে চন্দ্রনাথ পাখির মতো উড়তে উড়তে এসেছিল মোতির ঘরে। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এরপর থেকে মোতিকে আর কারুর শয্যাসঙ্গিনী হতে হবে না। যন্ত্রণা সহ্য করতে নিজেকে তুলে দিতে হবে না কোনো কামুক পুরুষের কাছে।
এরপর থেকে মোতি সারাদিন গান গাইবে। আর চন্দ্রনাথ সেতার বাজিয়ে সঙ্গত করবে তার সঙ্গে।
ঘরে মোতি একলাই ছিল। চন্দ্রনাথের মুখ থেকে সব শুনে সে বনের পাখির মতো উচ্ছল হয়ে জড়িয়ে ধরেছিল চন্দ্রনাথকে। কর্ণমূলে ফিসফিস করেছিল, ‘আপকো বহত বহত শুক্রিয়া জাহাঁপনা!’
চন্দ্রনাথ মোতির পদ্মপাতার মতো মুখখানা নিজের দু’হাতে ধরে বলেছিল, ‘এবার থেকে সারাদিন রেওয়াজ। কোন ফাঁকি কিন্তু আমি বরদাস্ত করব না।’
মোতি কপট ভয় পাওয়ার ভান করে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, ‘হায় আল্লাহ! এ কোন মাষ্টারের হাতে পড়লাম আমি!’
‘আল্লাহ, শিব, দুর্গা, যীশুখ্রিষ্ট কেউ এসে বাঁচাতে পারবে না।’ চন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে আরো জোরে নিজের দিকে আকর্ষণ করেছিল মোতিকে।
মনে মনে এক মুহূর্তের জন্য সে ধন্যবাদ দিয়েছিল নবাবকে। ভাগ্যে কলকাতার বুকে মেটিয়াবুরুজ ছিল। এখানে জাতপাত, ধর্ম, ছোঁয়াছুঁয়ি, সতীত্ব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এখানকার মানুষের একটাই ধর্ম। বেশক পেয়ার। সে মানুষের প্রতি হোক বা গানবাজনা, নানারকম খেলার প্রতি।
চন্দ্রনাথও এই ক’দিনে মেটিয়াবুরুজের বাতাসে শ্বাস নিয়ে তেমনই হয়ে গিয়েছে।
এখানে না এলে সে কি মোতিকে পেত? নাকি পেত এই মুক্ত আকাশটাকে!
ও মোতিকে জড়িয়ে থেকে বলেছিল, ‘মাষ্টার নয়। তোমার মরদ!’
মোতি লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল চন্দ্রনাথের বুকে।
চন্দ্রনাথ ঘুমন্ত মোতিকে আরো একবার চুম্বন করল। তারপর সন্তর্পণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সদর দরজাটা আলতো করে ভিজিয়ে দিয়ে সে হাঁটতে লাগল নিজের কোঠাবাড়ির দিকে।
দূরের গঙ্গা থেকে এই ভোরবেলা ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। সেই বাতাসে তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যেতে লাগল। পিরানটা ভালো করে জড়িয়ে নিল ঊর্ধাঙ্গে।
নবাবের আত্মজীবনী লেখা প্রায় শেষ। আর হয়ত এক সপ্তাহ লাগবে। এই কাজটা সে একেবারেই যান্ত্রিকভাবে করেনি, বরং নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এমনভাবে উপস্থাপনা করেছে যাতে প্রেমিক ওয়াজেদ আলী শাহকে, নবাবকে মানুষ মনে রাখে। ভালোবাসে তাঁকে তাঁর মতো করেই।
কাজটা সম্পূর্ণ হলেই সে নবাবকে উপহার দেবে সেই খাতা। তারপর বিবাহ করে ঘরে নিয়ে আসবে মোতিকে।
আচ্ছা, মোতিকে সে কি বিবাহ করবে? না নিকাহ?
ছোট থেকে নিজের গ্রামে বিবাহের যে সমস্ত আচার উপাচার সে দেখেছে, সেই গাত্রহরিদ্রা, শুভদৃষ্টি, সপ্তপদী, সেইসব কি কিছু হবে? নাকি নবাবি ঘরানায় শাদি হবে?
যা হয় হোক, মোতিকে চন্দ্রনাথ জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাবে, সেই যথেষ্ট।
আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে সে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়ালো মেটিয়াবুরুজের অলিতে গলিতে। মেটিয়াবুরুজের ঘুম ভাঙে অবশ্য বেশ দেরিতে, তাই দোকানপাট এখনো সব বন্ধ। যে সব উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রাত অবধি মুশাইরা চলেছে, সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে নানা খাদ্যদ্রব্যের উচ্ছিষ্ট। শহরের ঘুম ভাঙলেই সেসব পরিষ্কার হয়ে যাবে। মেটিয়াবুরুজের কোথাও এতটুকু মলিনতা নেই।
দূরে ভোঁ বাজিয়ে মৃদুমন্দ গতিতে উত্তরদিকে এগোচ্ছে একখানা বিশালাকৃতি জাহাজ। তার ক্রমাগত ভোঁ ভোঁ শব্দে একটু দূরে হাওড়া ব্রিজটা খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। একটু পরেই ব্রিজের মাঝের অনেকটা অংশ খুলে যাবে, সেখান দিয়ে আওয়াজ করতে করতে বেরিয়ে যাবে জাহাজটা। চলে যাবে দৃষ্টিপথের বাইরে।
কলকাতায় আসার পর একদিন বুলবুল মিয়াঁ তাকে নিয়ে গিয়েছিল হাওড়া ব্রিজের ওদিকে। চন্দ্রনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত বড় নদী মা গঙ্গা, এত প্রশস্ত তার এপার ওপারের মধ্যবর্তী দূরত্ব, তার ওপর সেতু? এমনও হয়!
ওর মনে পড়ে গিয়েছিল, খাদাকুঁড়ি গ্রামের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তুলসীর বলা কথাগুলো।
‘কলকাতায় মা গঙ্গার বুক চিরে সাহেবরা জুতো মসমসিয়ে হেঁটে যায়। মাগো! মনে করলেই পাপ হয়।’
চিন্তায় পাপ হয়, প্রত্যক্ষ দর্শনে নিশ্চয়ই সেই পাপের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। ভাবছিল চন্দ্রনাথ।
বুলবুল মিয়াঁ ওকে দেখাচ্ছিল, কেমনভাবে সার সার উল্টনো নৌকোর ওপর বানানো হয়েছে ভাসমান সেতু। নৌকোগুলো জলের ওপর ভেসে সুন্দরভাবে গোটা সেতুর ভারসাম্য রক্ষা করছে। এর নাম নাকি পন্টুন ব্রিজ।
দেখেশুনে ওর মুখ দিয়ে সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘সাহেবরা বলেই এসব পারে, বলো চাচা?’
‘কেন?’ মুহূর্তে ফোঁস করে উঠেছিল বুলবুল মিয়াঁ, ‘আর আমরা বুঝি পারি না? বামুনের ছেলে হয়ে রামায়ণটাও পড়োনি নাকি? রাবণের কবল থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে রামচন্দ্র যখন সমুদ্রতীরে উপস্থিত হলেন, বানরসেনারা পাথর দিয়ে সমুদ্রের ওপর সেতু বানায়নি? কবেকার কথা বলো দিকি? তোমরা এখনকার ছেলেছোকরারা সাহেবদের যাই দেখো গলে যাও। এটা বোঝো না যে পূর্বপুরুষরা অনেক আগেই সেসব করে গিয়েছেন।’
চন্দ্রনাথ আর কোনো কথা খুঁজে পায়নি।
বুলবুল মিয়াঁ এক আশ্চর্য মানুষ। কী তার পূর্বপরিচয়, তা চন্দ্রনাথ এখনো জানতে পারেনি। শুধু এইটুকু জানে, সে এক ধর্মান্তরিত মুসলিম, নবাবের চিড়িয়াখানায় পাখি রপ্তানি করে নানা শহর থেকে। মাঝেমাঝে আসে, কয়েকদিন থাকে। আবার হঠাৎ বেশ কিছুদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়।
জাহাজটা সেতু পেরিয়ে ওদিকে চলে যেতে চন্দ্রনাথ বাস্তবে ফিরে এল। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে।
কাছাকাছি হতেই সে ফণীকে দেখতে পেল। তার বাড়ি থেকে কয়েকগজ দূরেই পুকুর, সেখান থেকে জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে।
চোখাচোখি হতে সে বলল, ‘তোমার জন্য কাফি চাচা এসে বসে আচে ভেতরে।’
চন্দ্রনাথ একটু বিস্মিত হল। যদিও এর মধ্যে সূর্যদেব অনেকটাই ওপরে উঠে গিয়েছেন, রোদের তাপও বাড়ছে চড়চড় করে, তবু সকালবেলা কাফি খাঁ তার বাড়িতে কেন? তার তো এখন থাকার কথা সুলতানখানায়।
জিজ্ঞাসু মনে বাড়িতে প্রবেশমাত্র একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল।
যে ঘটনার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
মূর্তিমান ঝঞ্ঝার মতো তার দিকে ধেয়ে এল কাফি খাঁ। তার মুখচোখ ক্রোধে টকটক করছে। উদ্ধতকণ্ঠে বলল, ‘কাল রাতে কোথায় ছিলে তুমি?’
চন্দ্রনাথ বিস্মিত হল। এতদিন হয়ে গেল সে মেটিয়াবুরুজে এসেছে, কাফি খাঁর এই রূপ সে কখনো দেখেনি। একটু থমকে গিয়ে সে বলল, ‘কেন চাচা?’
‘উত্তর দাও।’ কাফি খাঁর নাকের পাটা ফুলছিল, ‘কাল নবাবের ওখানে তোমার কাজ ছিল না আমি জানি। নবাব আলিপুর থেকে ফিরে ক্লান্ত ছিলেন। তুমি কোথায় ছিলে?’
কাফি খাঁ-র ভাবভঙ্গি দেখে চন্দ্রনাথের ভয় লাগলেও ভেতর থেকে উঠে আসা বিরক্তি তার ভয়বোধকে চাপা দিয়ে দিল। সকাল থেকে সে একটা সুন্দর মায়াজালের পৃথিবীতে যেন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। হঠাৎ এই কর্কশ জেরা তাকে যেন আছড়ে ফেলল বাস্তবের মাটিতে।
বিরক্ত কণ্ঠে সে উত্তর দিল, ‘কেন চাচা? যেখানেই থাকি, তাতে তোমার কি প্রয়োজন?’
‘প্রয়োজন আছে।’ কাফি খাঁ চিৎকার করল, ‘আমি জানি, তুমি কাল রাতে ওই মোতি কসবির বাড়ি ছিলে। শালি রন্ডি একটা! অতবার করে সাবধান করে এলাম।’
‘তমিজসে বাত করো চাচা!’ চন্দ্রনাথও এবার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি আমার বাপের দোস্ত না হলে তোমাকে আমি এখুনি কেটে ফেলতাম!’
‘আরে রাখ!’ কাফি খাঁ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তেড়ে এল আবার, ‘তোর মতো ছুঁচোর তড়পানিকে কাফি খাঁ ভয় পায় না। তোকে আমি শেষবারের জন্য সাবধান করছি চাঁদ, তুই যদি আর একবার ওই রন্ডির বাড়ি গিয়েছিস, তোর গলা কেটে আমি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব। ওসব আমার বাঁ হাতের খেল।’
চন্দ্রনাথের এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। কাফি খাঁর রমণীলোলুপতা নেই জেনেও সে আঘাত দেওয়ার জন্যই কেটে কেটে বলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো চাচা? মোতি কি তোমার এই বুনো শুয়োরের মতো মুখে কখনো লাথ মেরেছিল নাকি? তোমার মতো বুঢঢাকে পাত্তা দেয়নি বলে এত গুসসা তোমার? তবে শুনে রাখো, মোতি আমার বিবি। খুব শীগগিরই আমরা শাদি করছি। নবাবও জানেন। তোমার এইসব হল্লাবাজি নিজের বাড়িতে গিয়ে করো।’
বলতে বলতে চন্দ্রনাথ লক্ষ করল, কাফি খাঁ কাঁপতে শুরু করেছে। মৃগী রুগির মতো থরথর করে কাঁপছে সে। তার হাতের আঙুলগুলো ঠকঠক করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে এখুনি সে উল্টে পড়ে যাবে মাটিতে।
চন্দ্রনাথ ধরতে গেল, কিন্তু কাফি খাঁ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল তাকে।
জ্বোরো রুগির মতো লাল চোখে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘মোতির বাপ কে, তা তো তুই জানিস? মোতির মা’কে চিনিস কি?’
‘চিনব না কেন?’ উদ্ধত স্বরে বলল চন্দ্রনাথ, ‘তসবির দেখেছি। বাহারুন্নিসা বেগম। তাতে কি এল গেল তোমার?’
কাফি খাঁর শরীরের কাঁপুনি ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কাঁপতে কাঁপতে সে বলে চলেছে, ‘বাহারুন্নিসাকে নবাব মুতআ করে শাদি করেছিলেন প্রায় বিশ সাল আগে। মোতি হওয়ার পর বাহারুন্নিসা আর সুলতানখানায় ঢুকতে পায়নি। সে নাচতে পারত না। তাই জায়গা হয়নি পরিখানায়।’
‘জানি আমি। তো?’ চন্দ্রনাথ তেরিয়া চোখে তাকায়।
উত্তেজনায় কাফি খাঁর শরীরের শিরা থেকে যেন রক্ত ফেটে বেরিয়ে পড়বে এবার। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘মোতির আগে নবাবের সঙ্গে বাহারুন্নিসার একটা ছেলেও হয়েছিল। সেই ছেলের গানের গলা বহত মিঠা ছিল। ইধার উধার খেলে বেড়াত। আড়াই তিন সাল যখন তার উমর, তাঁর গান শুনে তাক লেগে গেল হরেন্দ্রনাথ ভটচাযের। হরেন ভটচায আমার জিগরি দোস্ত ছিল তখন, তার বিবির ছেলেপুলে হওয়ার আগেই ইন্তেকাল হয়ে গেছল। নবাবের ইজাজত নিয়ে সে ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল তার দেশে।’
শুনতে শুনতে চন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই অনুভব করছিল, তাঁর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমস্রোত নামতে শুরু করেছে।
কাফি খাঁর মতো তারও যেন ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছে।
চোখ জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে। চন্দ্রনাথ ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু কিছুতেই দৌড়ে যেন বেরোতে পারার শক্তি আর তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।
মাটি থেকে যেন অদৃশ্য কোনো সুতো আষ্টেপৃষ্ঠে ক্রমশ বেঁধে ফেলছে তাকে!
মুখের ভেতরটা অসম্ভব তেতো স্বাদে ভরে যাচ্ছে ওর। গোটা গা-টা গুলোচ্ছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে। হড়হড় করে বমি করতে লাগল ও।
শুনতে পেল কাফি খাঁ-র কথা।
‘মোতি তোর বেহেন! নিজের মায়ের পেটের বহেন! ইয়ে তুনে ক্যা কিয়া চাঁদ!’