২৫. শেষ গল্প

শেষ গল্প

আগের দিন মিউজিয়াম থেকে ধর্মতলার মোড় অবদি হেঁটে আসতে আসতেই মনে হচ্ছিল রানি তলাপাত্র নামটা কোথায় যেন শুনেছি। অনাদির মোগলাইতে কামড় দিয়েই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল! তলাপাত্র… ব্লু নাইল বার… বসির খান!!

‘জুলফিকার! গট ইট!’

উত্তেজনার চোটে এত জোরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম যে টেবিলে রাখা সসের বোতলটাই উলটে গেল। পিজি, সেতু, ভবেশদা তিনজনেই হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।

‘কী রে স্পন্দন! পাগল হলি নাকি!’

‘ইয়ে… মানে সরি… একটু এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম।’

ভবেশদা আবার মাথা নীচু করে খাওয়ার দিকে মন দিয়েছিলেন। কাঁটা চামচে গাঁথা মোগলাইয়ের টুকরোতে কামড় দিয়ে বলেছিলেন,

‘স্পন্দন ভাই কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে।’

‘কী ধরে ফেলেছে?’ পিজির মুখে-চোখে প্রশ্ন তখনও।

‘রানি তলাপাত্র! ধরে ফেলেছি!’

‘কে সে? বুঝতে পারলি?’

‘সৃজিত মুখার্জির জুলফিকার, মনে করে দেখ, তুই আর সেতু একসঙ্গে প্রিয়াতে দেখতে গিয়েছিলি, মনে আছে? আমাকে ডজ করে। আমি তখন বর্ধমানে ছিলাম। তারপরে আমাকে সেকেন্ড ইয়ারের অনীকের সঙ্গে…’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে, এত কিছু না বললেও চলবে, তোর গার্লফ্রেন্ড নেই তো আমি কী করব? জুলফিকারে রানি তলাপাত্র ছিল? কোনটা বল তো? ও ও! মনে পড়েছে! নুসরত জাহান করেছিল না ক্যারেক্টারটা?’

‘হ্যাঁ, এবারে ভাব সৃজিত জুলফিকারটা কোন প্লে দুটোর আদলে বানিয়েছিল।’

‘ওই তো, জুলিয়াস সিজার আর অ্যান্তনি ও…’

‘ক্লিওপেট্রা! রানি তলাপাত্রর রোলটা তো ক্লিওপেট্রার আদলেই ছিল, না!’

সেতু পিজির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল।

‘স্পট অন! কী ভবেশদা, ঠিক বলিনি?’

‘একদম ঠিক ধরেছ। এবারে মন দিয়ে খাও। এসব জিনিস ঠান্ডা হলে খেতে ভালো লাগে না অত।’

‘তাহলে ক্লিওপেট্রার গল্পটা কবে বলছেন!!’

image26.jpg

সেদিনই ঠিক হল ভবেশদার বাড়িতেই সেই গল্প হবে। সেইমতো আগের রবিবার আমরা দু-জনে সোনারপুরে ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। লাঞ্চের নেমন্তন্নও ছিল। সেতুরও যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ওর মাসতুতো দাদার বিয়ে থাকায় যেতে পারেনি।

ভবেশদার বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতেই দুপুর আড়াইটে বেজে গিয়েছিল। খিদের চোটে পেটে ছুঁচোর রিলে রেস চলছিল, তাই গিয়েই বসে পড়লাম লাঞ্চের টেবিলে। ভবেশদাও আমাদের সঙ্গেই বসলেন।

‘ভাতের সঙ্গে মুগের ডাল, মাছের ডিমের বড়া, পাঁঠার মাংস আর চাটনি, ব্যস। এই আজকের মেনু। চলবে তো?’

‘চলবে মানে! দৌড়োবে!’

ভবেশদা যে রান্নাটা ফাটাফাটি করেন সেটা জানতামই। নিমেষের মধ্যে ডাল, ডিমের বড়া উড়িয়ে দিয়ে এসে পড়লাম মাংসের সমুদ্রে। খেতে খেতেই মনে পড়ল ক্লিওপেট্রার গল্পটা তো শোনা হচ্ছে না!

‘ও হ্যাঁ, ওইটা আজকে বলব বলেছিলাম, না? এটা বললেই আমার স্টক মোটামুটি শেষ, বুঝলে।’

‘যা! মানে, আর গল্প বলবেন না?’

‘অনেক তো শুনলে কয়েক মাস ধরে। এবারে না হয় নিজেরাও একটু পড়বে। যাই হোক, ক্লিওপেট্রার গল্পটা তাহলে শুরু করা যাক, নাকি? আগে বলো দেখি কতজন ক্লিওপেট্রা ছিলেন?’

‘কতজন মানে? আমি তো একজনকেই চিনি। সেই অ্যান্তনি আর ক্লিওপেট্রার গল্প। উফফ আবার মনে পড়ে গেল… লিজ টেলর…’

পিজি এর বেশি এগোবার আগেই আমি টেবিলের নীচে ওর পা-টা মাড়িয়ে দিলাম। বেটা বুঝতে পেরে থামল। আমি এবারে ভবেশদাকে বললাম,

‘একই নামের অনেক মানুষ ছিলেন নাকি?’

‘হ্যাঁ, ভাই। মিশরের ইতিহাসে তো এরকম অনেক উদাহরণ আছে। যেমন, রামেসিস প্রথম, দ্বিতীয়, আমেনহোতেপ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ। তেমনই আমাদের এই ক্লিওপেট্রাও আসলে সপ্তম। মানে তার আগে ওই নামের আরও ছ-জন ছিলেন। গ্রিক ভাষায় ক্লিওস মানে গর্ব, আর পাট্রোস মানে পিতা। ক্লিওপেট্রা মানে হল পিতার গর্ব। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বোনের নাম ছিল ক্লিওপেট্রা। তাই অনেক টলেমি রাজাই নিজের কন্যার নাম ওই নামে রাখতেন। যদিও সপ্তম ক্লিওপেট্রার নিজেরও একটা নাম ছিল, ফিলোপাটোর।’

‘আচ্ছা, ক্লিওপেট্রাই মিশরের শেষ ফারাও ছিলেন, না?’

‘হ্যাঁ, টলেমিদের সঙ্গে সঙ্গেই মিশরে ফারাওদের রাজত্ব শেষ হয়। ক্লিওপেট্রার বাবা ছিলেন টুয়েলভথ টলেমি, তিনি যখন মারা যান তখন মিশরের সিংহাসনে একসঙ্গে রাজত্ব করতে শুরু করেন আঠেরো বছর বয়সের ক্লিওপেট্রা আর ওঁর ভাই থার্টিন্থ টলেমি। তবে একসময় দিদিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে সিংহাসনে টলেমি একা বসে পড়েন। ক্লিওপেট্রা তখন সিরিয়াতে পালিয়ে যান, সেখানে গোপনে নিজের সেনাদল তৈরি করতে থাকেন। 

‘আগের দিন তোমাদের পম্পেইয়ের কথা বলেছিলাম মনে আছে? যে মিশরে আশ্রয় নেওয়ার পরে সিজার আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করেন ৪৮ বিসি-তে?’

‘হ্যাঁ, বলেছিলেন তো। তখনই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির একটা বড়ো অংশ পুড়ে যায়।’

‘ঠিক বলেছ। কিন্তু সিজার তারপরে কী করেন সেটা তো বলিনি। টলেমি প্রথমে পম্পেইকে আশ্রয় দিলেও সিজারের আক্রমণে ভয় পেয়ে ওঁকে হত্যা করেন। কিন্তু এতে জুলিয়াসের রাগ কমেনি। আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেই সিজার শমন পাঠান। লক্ষ্য ছিল দুই ভাইবোনকেই দমন করে মিশরের দখল নেওয়া। ফারাও টলেমি আর ওদের আরও এক বোন আরসিনোই আর ফর্টিন্থ টলেমিকে বন্দি করা হল। বাকি রইল ক্লিওপেট্রা।’

image218.jpg
image219.jpg

অ্যাসটেরিক্স ও ক্লিওপেট্রা

‘একদিন জাহাজে করে সিরিয়া থেকে সিজারের জন্য একটা উপহার এল। একটা দারুণ সুন্দর কার্পেট। সেই কার্পেটকে সিজারের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সিজারের বন্ধ ঘরে সেই গোটানো কার্পেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলেন ক্লিওপেট্রা। রাতারাতি ক্লিওপেট্রা হয়ে গেলেন সিজারের প্রেমিকা। তখন ওর বয়স একুশ, আর সিজারের বয়স বাহান্ন। সিজার তখন বিবাহিত।’

‘সিজারের ওপরে কেমন জাদু করে ফেলেছিলেন না ক্লিওপেট্রা! শুনেছিলাম নাকি ফাটাফাটি রকমের সুন্দরী ছিলেন!’

পিজি এবারে আমার কথার রেশ টেনে বলল,

‘হ্যাঁ, ‘‘অ্যাসটেরিক্স ও ক্লিওপেট্রা’’ কমিক্সটা পড়েছিলি তো। ওতে তো এটাসেটামিক্স বার বার বলছে ক্লিওপেট্রা দারুণ সুন্দরী। আর ওঁর নাকটা নাকি সবচেয়ে সুন্দর।’

‘তবে, সত্যি বলতে কী, চেহারায় কিন্তু রানি ক্লিওপেট্রা মোটেই মারকাটারি সুন্দরী ছিলেন না।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ ভাই, সৌন্দর্য তো আর শুধু শরীরে হয় না। ব্যক্তিত্বেও হয়। রানির ব্যক্তিত্বই নাকি তাঁরকে মোহময়ী করে তুলেছিল। প্লুটার্ক নামের এক হিস্টোরিয়ানের লেখাতে ক্লিওপেট্রার সম্পর্কে অনেকটা জানা যায়। তাঁরর মতে রানির মধ্যে নাকি একটা অদ্ভুত চার্ম ছিল। তিনি কথা বললে নাকি মনে হত বাদ্যযন্ত্রের অনেকগুলো তার পর পর কেঁপে উঠছে। এমনই মিষ্টি ছিল সেই গলার স্বর। তার সঙ্গে সঙ্গে ক্লিওপেট্রা ছিলেন দারুণ বিদুষীও। ম্যাথ, ফিলোজফি, অ্যাস্ট্রোলজিতে নাকি ছিল গভীর জ্ঞান। তা ছাড়া সাতটা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। ক্লিওপেট্রাই টলেমিদের মধ্যে প্রথম যিনি মিশরীয়দের ভাষায় লিখতে পড়তে পারতেন। এবারে তোমরাই বলো, এহেন মহিলার আকর্ষণ উপেক্ষা করা কি সম্ভব কারোর পক্ষে?’

‘বাপ রে! সিজারকে দোষ দেওয়া যাবে না তাহলে দেখছি।’

image220.jpg

জুলিয়াস সিজার ও ক্লিওপেট্রা

‘না, একদমই দেওয়া যাবে না। ক্লিওপেট্রা কৌশলে নিজের শত্রুকে বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের প্রেমিক। থার্টিন্থ টলেমি সিজারের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই যুদ্ধে সিজার সহজেই জিতে যান আর পালাবার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে যান টলেমি। মিশরের সিংহাসনে সিজার বসান ক্লিওপেট্রাকে। 

‘ফারাও হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই ক্লিওপেট্রা নিজের কৌশলে দেশের মানুষের মন জয় করে নেন। নিজেকে ঘোষণা করেন দেবী আইসিসের অবতার হিসেবে। নিজের পোশাকও পরতে থাকেন আইসিসের মতোই। মিশরের মানুষ ওঁকে পুজো করতে থাকে। সিজার আর ক্লিওপেট্রার এক সন্তানও হয়। তার নাম রাখা হয় টলেমি সিজার। দেশের মানুষ আদর করে তার নাম রাখে সিজারিওন, মানে লিটল সিজার। 

‘৪৬ বিসি-তে নিজের ছেলেকে নিয়ে ক্লিওপেট্রা এলেন রোমে সিজারের কাছে। সিজার সেইসময়ে ওঁর প্রেমে এতটাই পাগল যে রোমে ভেনাসের মন্দিরে আইসিস রূপী ক্লিওপেট্রার মূর্তি বসান। সেই মূর্তি ছিল সোনার তৈরি। পবিত্র মন্দিরে ভিন দেশের দেবীর মূর্তি, তাও রাজার উপপত্নীর আদলে। রোমে সেইসময় ঝড় উঠলেও সিজার পাত্তা দেননি। 

‘তবে রানির সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, বুঝলে। আইডিস অফ মার্চের নাম শুনেছ?’

‘হ্যাঁ, এটা শুনব না! এই দিনেই জুলিয়াস সিজারকে খুন করা হয় তো।’

‘হ্যাঁ, ১৫ মার্চ, ৪৪ বিসি। রোমান সেনেটের মধ্যে সিজারকে খুন করল ষাট জন মিলে। তাদের নেতৃত্ব দিল ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস। ক্লিওপেট্রা সেইসময় রোমেই ছিলেন। সিজার মারা যাওয়ার পরেই আবার চলে এলেন মিশরে। তার কিছুদিন পরে ক্লিওপেট্রার আরেক ছোটোভাই ফর্টিন্থ টলেমি মারা গেল অস্বাভাবিকভাবে। অনেকে মনে করেন রানি নিজেই ওকে খুন করিয়েছিলেন।’

আমরা খাওয়া শেষ করে বসবার ঘরের সোফায় এসে বসলাম, ভবেশদা মুখে মৌরি নিয়ে চিবোতে চিবোতে আবার বলা শুরু করলেন, 

‘সিজার মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সিজারের বন্ধু অ্যান্তনি আর সিজারের উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়ান ওর হত্যাকারীদের খোঁজা শুরু করল। ওরা ক্লিওপেট্রার কাছে সাহায্য চাইল। রানিও নিজের যুদ্ধজাহাজগুলো নিয়ে রওনা দিলেন, কিন্তু পথে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে অনেক জাহাজ নষ্ট হল। ক্লিওপেট্রাকে মিশরে ফিরে আসতে হল। অন্যদিকে ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস আত্মহত্যা করল। রোমান সাম্রাজ্যর অধিপতি হয়ে বসলেন অক্টাভিয়ান আর অ্যান্তনি।

image221.jpg

অ্যান্তনি ও ক্লিওপেট্রা 

‘অ্যান্তনির রাগ এবারে গিয়ে পড়ল ক্লিওপেট্রার ওপরে। যুদ্ধের সময় সাহায্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। এর শাস্তি মিশরের ফারাওকে পেতেই হবে। অ্যান্তনি ডেকে পাঠালেন ক্লিওপেট্রাকে। এবারে রানিকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য কিছু একটা করতেই হত।’

‘ক্লিওপেট্রা এবারে অ্যান্তনিকে বশ করে ফেললেন, তাই তো?’

‘একদম তাই। এই অংশটা আর এর পরিণতি নিয়েই শেক্সপিয়রের প্লে আছে। ১৯৬৩ সালে রিলিজ হওয়া সেই বিখ্যাত সিনেমাটা আছে। ক্লিওপেট্রা অ্যান্তনির সঙ্গে দেখা করার জন্য যে জাহাজে করে গেলেন তা ছিল সোনায় মোড়ানো। তার দাঁড়গুলো ছিল রুপোর। পাল ছিল গোলাপি। স্বয়ং রানি অ্যান্তনির সামনে এলেন দেবী আইসিসের বেশে। ব্যস, এবারে অ্যান্তনির মুগ্ধ হওয়ার পালা। এবং সেটাই হলও। ক্লিওপেট্রা রাজি হলেন অ্যান্তনিকে প্রয়োজনে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য। তার বদলে ওঁর বোন আরসিনোইকে খুন করতে হবে।’

‘ক্লিওপেট্রা নিজের বোনকেও ছাড়েননি!’

‘না, কেন ছাড়বে? সিংহাসনের দাবিদারদের সরিয়ে দিতে হবে না! অ্যান্তনির নির্দেশে রোমে মন্দিরের সিঁড়িতে খুন করা হল আরসিনোইকে। অ্যান্তনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গেই বেশ কয়েক বছর কাটালেন ইজিপ্টে। অ্যান্তনির খুব শখ ছিল নিজেকে রোমান দেবতা বাক্কাসের মতো দেখার। ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ক্লিওপেট্রা এবারে বাক্কাসের স্ত্রী দেবী অ্যাফ্রোদিতির মতো সাজতে লাগলেন। দু-জনে মিলে সমাজের উঁচু অংশের মানুষদের নিয়ে একটা দল খুললেন, সেই দলের কাজই ছিল মদ খাওয়া, ফুর্তি করা আর জুয়ো খেলা। সেইসময় ওঁদের দুটি সন্তানও হয়, তাদের নাম ছিল আলেকজান্ডার হেলিওস আর ক্লিওপেট্রা সিলিন। গ্রিক হেলিওস মানে সূর্য আর সিলিন মানে চাঁদ। এর দু-বছর বাদে ওদের আরেকজন পুত্রসন্তান জন্মায়। দ্বিতীয় টলেমির নামে ক্লিওপেট্রা তার নাম রাখেন ফিলাডেলফাস।

‘এমন সময়ই হঠাৎ অ্যান্তনির ভাই লুসিয়াস অক্টাভিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। সেই যুদ্ধে লুসিয়াস হেরে গেলেও অ্যান্তনির সঙ্গে অক্টাভিয়ানের সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে।

‘৩২ বিসি-তে অক্টাভিয়ান অ্যান্তনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিখ্যাত ‘‘ব্যাটেল অফ অ্যাক্টিয়াম’’ নামে। ক্লিওপেট্রা আর অ্যান্তনির সামরিক শক্তি ছিল অক্টাভিয়ানের দ্বিগুণ। কিন্তু তার পরেও ওরা হেরে বসে অক্টাভিয়ানের কাছে।’

‘কেন?’

‘কারণ ভালো নেতৃত্বের অভাব। প্রচুর সৈন্য থাকলেও ভালো সেনাপতি ছিল না ওদের। অন্যদিকে অক্টাভিয়ানের সেনাপতি ছিল আগ্রিপ্পা। ওর ওয়ার স্ট্র্যাটেজির কাছে বিশ্রীভাবে হেরে যায় অ্যান্তনি আর ক্লিওপেট্রা। তারপরেই দু-জনে পালিয়ে আসে ইজিপ্টে। পিছনে ধাওয়া করতে করতে আসেন অক্টাভিয়ান।

‘অক্টাভিয়ান মিশরে পৌঁছোনোর পরে অ্যান্তনি আরও একবার চেষ্টা করেন যুদ্ধে জেতবার। এবারেও ফল হয় এক। অ্যান্তনি এবারে আত্মহত্যা করার জন্য নিজের পেটে তলোয়ার বসিয়ে দেন। রক্তাক্ত অ্যান্তনিকে আনা হয় ক্লিওপেট্রার কাছে। ওঁর কোলেই অ্যান্তনি মারা যান। কিন্তু ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করার আগেই সেখানে অক্টাভিয়ানের সৈন্যরা চলে আসে। বন্দি করা হয় ওঁকে। 

‘ক্লিওপেট্রাকে বাঁচিয়ে রাখার পিছনে অক্টাভিয়ানের একটা উদ্দেশ্য ছিল। তিনি ভেবেছিলেন রোমের রাস্তা দিয়ে বন্দিনী ফারাওকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই খবর কোনোভাবে ক্লিওপেট্রার কাছে পৌঁছে যায়। তার পরেই ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেন।’

image222.jpg

অক্টাভিয়ান ও ক্লিওপেট্রা

আমি এবারে বললাম,

‘ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যাটাও একটা মিথ না ! শুনেছিলাম সাপের বিষে তিনি মারা যান।’

image223.jpg

ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা

‘বিষের ব্যাপারে রানির অনেক জ্ঞান ছিল, বুঝলে ভায়া। যতরকমের বিষ হয় তার সব রকমের প্রয়োগ তিনি করতেন মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের ওপরে। তারপরে দেখতেন কোন বিষ কত জলদি কাজ করে, কোনটায় ব্যথা হয়, কোনটায় ব্যথা হয় না। জেলখানার প্রহরীদের চোখে ধুলো দিয়ে রানির জন্য একঝুড়ি ভরতি মিষ্টি ডুমুর ফল আনা হয়। তার ভিতরে লুকোনো ছিল বিষাক্ত অ্যাস্প সাপ। এটা একরকমের ইজিপশিয়ান কোবরা, বুঝলে। এই সাপেরই ছোবল নিজের বুকে নেন রানি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওঁর শরীর ঘামতে থাকে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়। ঘুম এসে যায়। ক্লিওপেট্রার গোটা শরীরের নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে যায়।’

‘হুমম, কোবরার বিষ তো নিউরোটক্সিন, ফরেনসিক মেডিসিনে পড়েছিলাম, একটা ছোবলে প্রায় আড়াইশো মিলিগ্রাম বিষ থাকে। আর মাত্র পনেরো মিলিগ্রামই একটা মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।’

জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ পেলে পিজি ছাড়ে না।

ভবেশদা পিজির দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচকভাবে ঘাড় নেড়ে এবারে বললেন,

‘আত্মহত্যার খবর পেয়ে অক্টাভিয়ান যখন ক্লিওপেট্রার কাছে পৌঁছোলেন তখনও ওঁর দেহে ক্ষীণ হলেও প্রাণ আছে। রাজা নাকি তখন বিষ বের করার জন্য ওঝাদের ডেকে পাঠান কিন্তু তারা এসে পৌঁছোনোর আগেই সব শেষ হয়ে যায়। মিশরের শেষ ফারাও মারা যান ১২ অগাস্ট, ৩০ বিসি। এর পরেই মিশরে শুরু হয় রোমানদের রাজত্ব। এই অগাস্ট মাসের নামকরণের সঙ্গেও ক্লিওপেট্রা জড়িয়ে আছেন, জানো!’

‘সেটা কীরকম?’

‘অক্টাভিয়ান যুদ্ধ জিতে দেশে ফিরে রোমান সাম্রাজ্যের রাজা হয়ে বসেন নতুন উপাধি নিয়ে, অগাস্টাস। এই সময় সম্রাটকে নিজের পছন্দমতো একটা মাসের নামকরণ করতে দেওয়া হয়। অগাস্টাস নবম মাসে জন্মালেও কিন্তু নিজের জন্ম মাসকে বেছে নেননি। নিয়েছিলেন অষ্টম মাসকে। কারণ সেই মাসেই ক্লিওপেট্রা মারা যান। যেটা সম্রাটের কাছে বেশি গর্বের বিষয় ছিল।’

‘আচ্ছা, একটা কথা বললেন না, ক্লিওপেট্রার সন্তানদের কী হল?’

‘ক্লিওপেট্রা মারা যাওয়ার সতেরো দিনের মাথায় সিজারিয়নকে খুন করেন অক্টাভিয়ান। কারণ ওর শরীরে ছিল সিজারের রক্ত। তাই বড়ো হয়ে রোমের মসনদের দাবি করতেই পারত। ক্লিওপেট্রার বাকি দুই ছেলে আর এক মেয়েকে রোমে নিয়ে আসেন অক্টাভিয়ান।’

‘আর ক্লিওপেট্রার সমাধি?’

‘ওইটা এখনও পর্যন্ত একটা রহস্যই রয়ে গেছে, বুঝলে। অ্যান্তনি আর ক্লিওপেট্রাকে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটার খোঁজ আজ অবদি কেউ পায়নি। ’

image26.jpg

সেদিন যখন ভবেশদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি তখন ভবেশদা হঠাৎ বললেন,

‘আরে এক মিনিট ওয়েট করে যাও, একটা জিনিস ভুলেই গেছি।’

এই বলে আমাদের বাড়ির চৌকাঠেই দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরের ঘরে গেল। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করিয়ে রাখার পরে বেরিয়ে এলেন হাতে একটা বাক্সমতো নিয়ে। লাল চকচকে কাগজ দিয়ে মোড়ানো। গিফট র‌্যাপের মতো। সেইটা পিজির হাতে দিয়ে বললেন,

‘এইটা তোমাদের জন্য।’

‘কী এটা?’

‘একটা বই, জয়েস টিলডেসলির লেখা। ইজিপশিয়ান আর্কিয়োলজির নাম করা প্রফেসর। এই বইটা এখন দুষ্প্রাপ্য, আউট অফ প্রিন্ট। কিন্তু তোমাদের ইজিপ্ট নিয়ে যা আগ্রহ দেখলাম তাতে মনে হল এটা তোমাদের পড়া উচিত।’

‘কিন্তু এত দামি একটা বই গিফট করে দেওয়ার কী দরকার ছিল? আমরা না হয় পড়ে আপনাকে ফেরত দিয়ে দিতাম।’

‘আরে না না, বইটা আমার পড়া, আর দাদা কি ভাইদের কিছু দিতে পারে না নাকি? এখন মুখ বুজে এটা নিয়ে বাড়ি যাও দেখি।’

হোস্টেলের ঘরে ঢুকেই দু-জনে মিলে বসে গেলাম গিফটটা নিয়ে। লাল র‌্যাপটা সরাতেই বেরিয়ে এল ভেতরের বইটা। বেশ মোটা, কালো রঙের মলাট। মলাটের ওপরে দ্বিতীয় রামেসিসের ছবি। বইটার নাম ‘ফারাওস’। 

বইটাতে ফারাওয়ের সময়ের প্রথম দিন থেকে ডাইনেস্টি অনুযায়ী তাদের কথা লেখা আছে দেখলাম। তার সঙ্গে দারুণ দারুণ হাই ডেফিনিশন ছবি! এক ঝলকের জন্য পিজি পাতা উলটে উলটে দেখছিল, আমি ওর পাশে বসে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা কিছু দেখতে পেলাম যেটার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না!

বইটাকে বাইরে থেকে দেখে বুঝতেই পারিনি যে ওর প্রথম পঞ্চাশটা পাতার পরের পাতাগুলোর মধ্যে একটা চৌকো গর্ত করা! দেখে মনে হচ্ছিল কেউ খুব যত্ন নিয়ে পাতার মাঝখানগুলো কেটে গর্তটা বানিয়েছে। গর্তের ভিতরে রাখা একটা ভাঁজ করা কাগজ আর একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্স। মেয়েদের আংটি বা কানের দুলের বাক্স যেমন হয়।

আমরা হতভম্বের মতো মুখ নিয়ে দু-জন দু-জনের দিকে তাকালাম। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা নিয়ে পিজি পড়তে শুরু করল,

‘আর হয়তো কোনদিনও তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। আমি নিজে আর কতদিন বেঁচে থাকব সেটাই জানি না। যেকোনোদিন খুন হয়ে যেতে পারি…’

এতটা পড়েই সঙ্গেসঙ্গে পিজি ফোনটা নিয়ে ভবেশদাকে কল করল, বারকয়েক চেষ্টা করার পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সুইচড অফ বলছে! এক্ষুনি ওর বাড়ি যেতে হবে, কুইক!’

‘পাবি না ওঁকে বাড়িতে গেলে, দেখ কী লেখা আছে।’

চিঠির বাকিটা ছিল এরকম,

…তোমরা যখন এই চিঠিটা পড়ছ ততক্ষণে আমি কলকাতা এয়ারপোর্টে, আমাকে খোঁজার চেষ্টা কোরো না, প্লিজ। তোমাদের দায়িত্ব আজ থেকে অনেক বেড়ে গেল। আমার একটা সম্পদ তোমাদেরকে দিয়ে গেলাম। আর কারোর ওপরে ভরসা করতে পারলাম না। খুব সাবধানে রেখো নিজের কাছে। কাউকে বিশ্বাস কোরো না, কাউকে না। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমি নিজেই যোগাযোগ করব তোমাদের সঙ্গে।’

চিঠিটার মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। কীসের দায়িত্ব? কে খুন করতে চাইবে ভবেশদাকে? কোন সম্পদের কথা বলছেন উনি?

তখনই খেয়াল হল লাল বাক্সটার কথা, 

কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট্ট বাক্সটা খুলে দেখলাম ভিতরে ফোমের আস্তরণ । সেটা সরাতেই বেরিয়ে এল একটা সাদা পাথরের টুকরো। কিন্তু কালচে হয়ে এসেছে। বোঝা যায় এর বয়স অনেক।

টুকরোটা চকচকে, মসৃণ। মাকুর মতো আকার। তার মাঝখানে কালো গোল দাগ, সেই দাগের চারিদিকে একটা গাঢ় বাদামি রিং। ওটাকে চেনার জন্য ডাক্তারির ছাত্রের দরকার নেই।

আমার হাতের তালুতে যেটা ছিল সেটা একটা পাথরের চোখ!

image224.jpg

রানি নেফারতিতির চোখ ভবেশদার কাছে কী করে এল?

কোথায় গেল ভবেশদা?

পিজি ও স্পন্দন কি পারল ভবেশদাকে খুঁজে বের করতে?

আসছে এমন এক অ্যাডভেঞ্চার যাতে জুড়ে আছে 

আমাদের শহর কলকাতা, 

টেমস আর স্প্রি নদীর পাড়ের

দুটো শহর আর 

হায়রোগ্লিফের দেশটা। 

image225.jpg
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *