২৫. শীতটা কমে এসেছে

পঁচিশ

শীতটা কমে এসেছে, তবে এখনও কামড়ে আছে। কলকাতার ডিসেম্বরের চেয়েও বেশি শীত।

সেদিন রবিবার। সকালে বারান্দাতে বসেছিলাম কাগজ নিয়ে। মাঝে-মাঝে খবরের কাগজ আনিয়ে পড়ি ডালটনগঞ্জ থেকে। রোজকার কাগজ প্রায়ই পড়া হয় না। কাগজ পড়া ভুলেই গেছি। রবিবারের কাগজ আনাই মালদেও বাবুদের ট্রাক ড্রাইভার মারফত। একদিনের কাগজেই গত সাত দিনের খবর আস্বাদন করি।

যশোয়ন্ত বলত, পৃথিবীর কোন কোণায় যুদ্ধ হচ্ছে, কোথায় লোক না খেতে পেয়ে মরছে, কোথায় লোক বেশি খেতে পেয়ে মরছে, এত সব খবরে তোমার কী দরকার ইয়ার? খাও-দাও, কাম পেতে মৌটুসি পাখির শিস শোনো, নয়তো চলো বন্দুক কাঁধে করে বনে-পাহাড়ে এক চক্কর ঘুরে আসি। দেখবে দিল খুশ হয়ে যাবে। আমরা না করছি রাজনীতি, না বসছি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউতে। কী হবে এই ছোট মাথায় অত সব অবান্তর প্রসঙ্গ চাপিয়ে?

প্রথম প্রথম ওর সঙ্গে তর্ক করেছি—তারপর নিজের অজান্তে কখন দেখেছি—কাগজের জন্যে আর তেমন অভাবই বোধ করিনি, যেমন কলকাতায় করতাম। ভোরবেলায় চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ না পড়লে মনে হত কী একটা কর্তব্যকর্মই করা হল না। সব কাগজওয়ালাই তো ব্যবসাদার। টাকা রোজগার করাই তাঁদের মোক্ষ। রাজ্যের বাজে খবরে পাতার কিছুটা ভর্তি করে, বাকিটা বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দিয়েই তো তাঁরা দেশ ও দশের সেবা করেন। নীতি, বিবেক অথবা সততা এখন আর ক’টি খবরের কাগজের আছে? এমনকী, চক্ষুলজ্জাও তো নেই। একটি বাজে অভ্যাসের হাত থেকে মুক্ত হয়েছি, বাঁচা গেছে। তা ছাড়া, এখানে খবরের কি অভাব নাকি? কার গরু মরছে সাপের কামড়ে, কোন কূপে কপিসিং ফেলিং শুরু হয়েছে, কোথায় বাঘের অত্যাচারে বাঁশ কাটার কাজ পুরোপুরি বন্ধ আছে; কোথায় কোন বুড়ো ওঁরাও হাঁড়িয়া খেয়ে কার মাথায় টাঙ্গি বসিয়েছে, কোথায় কোন মেয়েকে ভেঙ্কানাচের পর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—এমনই কত শত খবর। কেবল কাগজই ছাপা হয় না—কিন্তু খবরের অভাব কোথায়?

গেটে একটি ট্রাক থামল। ড্রাইভার নেমে এসে আমার হাতে একটি চিঠি দিয়ে গেল। শিরিণবুরু থেকে মারিয়ানা লিখেছে ছোট্ট চিঠি।

লাল সাহেব,

আগামিকাল কি কোনও জরুরি কাজ আছে? একবার আসেন যদি, তো খুব ভাল হয়। বড় একা একা লাগে। রাতে থেকে পরদিন বিকেলেই আবার রওনা হয়ে চলে যাবেন। কোনও খবর পাঠানোর দরকার নেই। চলে আসবেন। আসতে পারলে খুব খুশি হব। আপনার মারিয়ানা।

কিছুই ভাল লাগছিল না। চুপচাপ বসে ভাবছিলাম যে, এক মুহূর্তবাহী হঠকারিতার পরিণাম হিসাবে হয়তো রুমান্ডি ছেড়ে চলেও যেতে হবে। কেন জানি না, আস্তে আস্তে অবচেতন মনে কেমন একটা ভয় জন্মেছে যে, ওরা আমাকে ছাড়িয়ে দেবেই। রাখবে না। বিশেষ করে আমার ইমিডিয়েট বস ঘোষদা যখন আমাকে তাড়াতে চান। অন্তত যশোয়ন্ত তো এ ব্যাপারে ঘোষদার উপর একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। জানি না, হয়তো এর পেছনে আরও বড় কোনও হাত আছে, যে হাত কলকাতার হুইটলি সাহেব পর্যন্ত প্রসারিত হয়। আর একসটেনশান পাব বলে ভরসা নেই।

কলকাতাতেই যদি এই চাকরি করতাম, তবে হয়তো বিষাদ আসত না। সেখানে বেশির ভাগ বেসরকারি অফিসের চাকরি তো ছাড়ার জন্যেই। কিন্তু তবু সেখানে আমার আজন্ম পরিবেশ, আমার আশৈশব অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি হত।

কিন্তু এই রুমান্ডিতে যে নির্জনতা, যে প্রাকৃতিক ঔদার্য, যে সবুজ শালীনতায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে উৎসারিত আনন্দের আমি অংশীদার হয়েছি, তা থেকে রাতারাতি আমাকে কেউ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ফেললে আমার কষ্ট হবে। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে ডিজেলের ধোঁয়ায়। মেকি ভদ্রতায় দম বন্ধ হয়ে যাবে।

ছাব্বিশ

মোড়োয়াই থেকে বেরুতে প্রায় চারটে বেজে গেল। শেষ শীতের বিকেল—চারটে অনেক বেলা।

সোনালি রোদের বালাপোশ মুড়ে বন-পাহাড় শেষবারের মতো গা তাতিয়ে নিচ্ছে। খেতে খেতে কিতারী, বাজরা, ধান, গেঁহু সবকিছুই প্রায় কেটে নেওয়া হয়েছে। ফুড়ুত ফুড়ুত করে চড়ুইগুলো তবু শূন্য ক্ষেতে দল বেঁধে সারা দুপুর চঞ্চল ভাবনার মতো মুঠো মুঠো উড়ো বেড়ায়। বুলবুলি পাখিরা কেলাউন্দার ঝোপের ডালে বসে শিস দেয়—ছোট ছোট মৌটুসি পাখি সুন্দরী মেয়ের চোখের তারার মতো স্পন্দিত হয় ফুলে ফুলে। টুনটুনি পাখির বড় দেমাক। গান গায় কি গায় না।

জিপ বেশ জোরে চালিয়ে চলেছি। শিরিণবুরুতে এখন মারিয়ানার বাংলো অবধি জিপ যায়। আমরা প্রথম গিয়েছিলাম বর্ষাকালে—তখন পথ অতি দুর্গম ছিল এবং পথের একটি নদী পেরুনো যেত না। পুজোর পর থেকেই সে নদীর উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে চলে যাওয়া যায় সহজেই।

রাত সাড়ে সাতটা বাজে। মারিয়ানার বাংলোর দোতালায় আলো জ্বলছিল। একতলার সব বাতি নিবানো। গেটের কাছে জিপটি থামাতেই কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে উঠল। মারিয়ানা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। চৌকিদার গেট খুলল।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মারিয়ানা নেমে এল। একতলার বারান্দার বাতি জ্বালল। একটি ফলসা-পেড়ে সাদা শাড়িতে মারিয়ানাকে রোগা, করুণ ও খুব সুন্দরী বলে মনে হল।

ও বলল, সত্যিই এলেন! ভেবেছিলাম, আসবেন না।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে শুধোলাম, এ রকম ভাবনার কারণ?

কোনও কারণ নেই। এমনই ভেবেছিলেম। এক্ষুনি খাবেন? না এখন কফি-টফি কিছু খেয়ে রাতের খাবার পরে খাবেন? রোজ কখন খান রাতে?

রোজ তো ন’টার সময় খেয়ে দেয়ে শয়নে পদ্মনাভ। আজকে এখন কফি খেয়ে পরেও খাওয়া চলতে পারে।

মারিয়ানা, যে ঘরে ঘোষদা-বউদি প্রথমবার থেকেছিলেন, সে ঘরে আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছে। ওর ঘরের পাশেই।

বলল, জামা-কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে আসুন। ধুলোয় তো গা-মাথা ভরে গেছে। আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি।

মারিয়ানা নিজের হাতে ওমলেট ও কফি বানিয়ে দিল খাবার ঘরে স্টোভ ধরিয়ে। আমরা দোতলার খাবার ঘরেই বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। বাইরে এখনও বেশ ঠাণ্ডা।

শুধোলাম, হঠাৎ তলব করলেন যে? খুব একা একা লাগে, না?

একা একা তো বেশ অনেকদিন থেকেই আছি। একা থাকতে তো অভ্যস্তই হয়ে গেছি। কিন্তু এবারে কলকাতা থেকে ফিরে এসে একেবারে অসহ্য লাগছে, একেবারে অসহ্য। সুগতকে পুড়িয়ে এলাম।

আমি একটু আশ্চর্যরকম কঠিন হয়েই বললাম, ভদ্রলোক যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আপনি কিন্তু রানীর মতো মাথা উঁচু করে বেড়াতেন। আজ উনি যখন নেই, আপনাকে কাঙালিনীর মতো মনে হচ্ছে কেন?

আমার কথাতে মারিয়ানা খুব অবাক ও বিব্রত হয়ে আমার চোখে তাকাল। কিন্তু উত্তরে কিছু বলবার আগেই আমি কোটের পকেট থেকে সুগতবাবুর রক্তমাখা চিঠিখানা বের করে ওর হাতে দিলাম।

বললাম, নিন। এই সুগতবাবুর শেষ চিঠি। আপনাকে লেখা।

মারিয়ানা ভীষণ আশ্চর্য ও কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে আমার দিকে তাকাল—তারপর কম্পমান হাতে চিঠিটা খুলল। কালো কালো দাগ দেখে শুধোল, এগুলো কীসের দাগ?

আমি নিষ্ঠুর গলায় বললাম, সুগতবাবুর রক্তের।

কেন এবং কী করে এমন নিষ্ঠুর হলাম, আমি আজও জানি না।

ঝরঝরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মারিয়ানা চিঠিটা পড়তে লাগল। মারিয়ানা যখন সুগতবাবুর মাথা কোলে নিয়ে জিপে বসেছিল কুট্‌কু থেকে ডালটনগঞ্জ যাবার সময় তখনও এমনভাবে কাঁদেনি।

তারপর ও চিঠিটা পড়া শেষ করে, ভাঁজ করে নিজের সামনে রাখল। জলভরা চোখে আমাকে শুধোল, আপনি তাহলে সব জানেন?

আমি বললাম, সব জানি কিনা জানি না। তবে এর আগে আমাকে পাঠানো বইয়ের মধ্যে অসাবধানে রাখা যে চিঠি দুটি ছিল, সে দুটি পড়েছিলাম এবং এইটি দেখলাম। তাতে যতটুকু জানা যায় জেনেছি। আমার ধারণা, এর চেয়ে বেশি কিছু জানার নেই। সেই চিঠি দুটো পড়ে খুব অন্যায় করেছিলাম সত্যিই, কিন্তু পড়েছিলাম বলেই আজকে আপনার দুঃখের গভীরতা বোঝার জন্য অন্তত একজন লোকও এখানে পেলেন। সেইটে নিশ্চয়ই কম কথা নয়। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। এ কথা অন্য কেউই জানবে না।

মারিয়ানার চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। ইউক্যালিপটাস গাছের মতো সোজা হয়ে বসে বলল, আমি কাউকে কেয়ার করি না।

তখন ওদের দেখে আমার হাসি পেল; আমি বললাম, তাই বুঝি! এত সাহস সুগতবাবু বেঁচে থাকতে কোথায় ছিল? তখন এ সাহসের ছিটেফোঁটা থাকলে উনি হয়তো মরতেন না।

মারিয়ানা কথা বলল না। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। সুগতবাবুর চিঠিটা আর একবার খুলল, আবার বন্ধ করে রাখল।

মারিয়ানা তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল, আপনারা বোঝেন না, বোঝবার চেষ্টাও করেন না।

কোন উত্তর দিলাম না। ঘড়িটার টিক-টিক-টিক শুনতে লাগলাম।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম মারিয়ানা জানে না যে, নিজের সঙ্গে, নিজের ঠুনকো বিবেকের সঙ্গে, নিজের আজন্ম সংস্কারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ও একসময় হেরে গেছে। কিন্তু সেই পরাজয়টা বড় দেরিতে এল।

শুলাম যখন, তখন প্রায় বারোটা। বাইরে নিশুতি রাত। গ্রামের কুকুরগুলো সমস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে—শম্বর-টম্বর দেখে থাকবে। অনেকখানি জিপ চালিয়ে এসেছি, তা ছাড়া এত রাত করা অভ্যেস নেই। গাঢ় ঘুমে এলিয়ে পড়লাম।

রাত কত জানি না, হঠাৎই দরজায় ধাক্কা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। মারিয়ানার গলা। দরজায় বেশ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে আর আমার নাম ধরে ডাকছে।

ধড়মড়িয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখলাম, মারিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে।

আমি শুধোলাম, কী হল?

মারিয়ানা চারদিকে তাকিয়ে বলল, সুগত এসেছিল।

আমি ধমকের সুরে বললাম, চলুন তো ঘরে চলুন! বলে ওকে প্রায় জোর করে খোলা বারান্দা থেকে ওর ঘরে নিয়ে গেলাম।

ঘরে ঢুকে ওকে দৃঢ় গলায় বললাম, বসুন। খাটে বসুন। বলুন আমাকে,কী হয়েছিল।

মারিয়ানা কথা বলতে পারছিল না।

আমি ঘরের ইজি-চেয়ারে বসলাম।

একটু সামলে নিয়ে মারিয়ানা বলল, এই ঘরে সুগত এসেছিল একটু আগে।

আমি বললাম, আপনি স্বপ্ন দেখছিলেন। কি যা তা বলছেন! লেখাপড়া শেখা মেয়ে, অমন বোকার মতো কথা বললে আমার রাগ হয়ে যাবে কিন্তু।

মারিয়ানা বলল, না না প্লিজ শুনুন, আমার কথা শুনুন। সুগতকে একটু আগে দেখলাম।

আমি বললাম, সত্যি। আপনি না…

মারিয়ানার মুখটা আতঙ্কে কুঁচকে উঠল। বলল, ভাবতে পারি না। সুগত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। শাল জড়িয়ে। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামিয়েছিল দেখলাম।

ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার কেমন গা-ছমছম করতে লাগল। মনে হল, চোখ খুললেই ভয় পাব। আপনি যে ইজি-চেয়ারে বসে আছেন, মনে হল, কে যেন সেখানে বসে আছে। চোখ মেলতেই দেখি সুগত। উঠে বসলাম। ঘরের নীল আলোটা জ্বলছিল। ওই আলোয় ওকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল।

আমি চোখ মেলতেই হেসে বলল, খুব অবাক হলে তো? তোমাকে দেখতে এলাম।

আমি ভুলে গেলাম যে ও মরে গেছে। ওকে আমরা পুড়িয়ে এসেছি।

আমি কথা বললাম, আমি ওর নাম ধরে বললাম, সুগত, আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি ভালবাসি।

সুগত একটু হাসল। বলল, এ কথাটা তখন বললে না? এ কথাটা শোনার জন্যে কতদিন অপেক্ষা করে থাকলাম। তখন বললে না?

আমি বলতে গেলাম—আমি বুঝতে পারিনি যে, তুমি এমন ছেলেমানুষ। আমার যা আছে সব দিতে পারি তোমাকে, তুমি যেমন করে চাও।

সুগত বলল, সত্যি, সত্যি।

সুগত আমার কাছে এগিয়ে এল। মনে হল আমাকে আদর করবে বলে। আমি যেন কেমন হসে গেলাম। তখনও ভয় পাইনি। তখনও একটুও ভয় পাইনি—খুব ভাল লাগছিল, সুগতকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ভাবছিলাম, এতদিনে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। এমন সময় যেই সুগত কাছে এল, দেখি—সেই রক্তমাখা মুখটা! সেই গলার কাছে ফুটো দিয়ে নিশ্বাসের সঙ্গে ফেনা বেরোচ্ছে। আমি…আমি আঁতকে উঠলাম, ওকে দেখে ঘেন্না হল; কেঁদে ফেললাম। মনে হল, সুগত বীভৎসভাবে হেসে উঠল। তারপর কী হল জানি না, দেখলাম সুগত নেই। আমি একা ঘরের মেঝেয় দাঁড়িয়ে আছি। যেই দেখলাম সুগত নেই, অমনি ভয় পেলাম—ভীষণ ভয় পেলাম, ভাবলাম, মরেই যাব ভয়ে। তারপর কোনওরকমে আপনার দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম। তারপর…জানি না। এই যে এখন আপনার সামনে বসে আছি।

আমি বললাম, আপনি একটু বসুন, আমার ঘরে ব্র্যান্ডি আছে ব্যাগে, যশোয়ন্ত রাখতে দিয়েছিল সঙ্গে। নিয়ে আসি। গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে একটু খান, সুস্থ বোধ করবেন।

উঠতে যেতেই মারিয়ানা বলল, না আমি একা ঘরে থাকব না।

আমার সঙ্গে সঙ্গে ও আমার ঘরে এল। বাইরে বড় শীত। ব্র্যান্ডিটা বের করলাম। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তারপর আমার পিছু পিছু—যেন এটা আমারই বাড়ি, ও-ই আমার অতিথি—এমনভাবে সঙ্গে সঙ্গে খাবার ঘরে এল। এসে একটা চেয়ার টেনে বসে চুপ করে আমাকে দেখতে লাগল।

খুঁজে খুঁজে স্টোভ বের করে, স্টোভ ধরিয়ে একটু জল গরম করলাম। গ্লাসে করে জল এবং ব্র্যান্ডি মিশিয়ে মারিয়ানার কাছে এসে গ্লাসটি ধরে দাঁড়ালাম। এতক্ষণ আমাকে রাতজাগা জল-ভেজা চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে অপ্রকৃতিস্থভাবে দেখছিল—আমি কাছে যেতেই আমার হাত থেকে গেলাসটি টেবিলে নামিয়ে রেখে আমার হাতটি ও দু-হাতে জড়িয়ে ধরল।

ঘটনার আকস্মিকতায় এত অভিভূত হয়ে গেলাম যে, বলতে পারি না।

আমার হাত দিয়ে সযত্নে ওকে সরিয়ে চেয়ারে বসালাম।

বললাম, পাগলি মেয়ে। নিন ব্র্যান্ডিটা খেয়ে নিন।

মারিয়ানা ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে আস্তে আস্তে ব্র্যান্ডিটা খেল। তারপর গ্লাসটা নামিয়ে রেখে ধরা গলায় বলল, একজনের কাছে অকৃতজ্ঞতার গ্লানি জীবনময় বয়ে বেড়াব। এ ভুল যাতে আর না করি, তারই পাঠ নিলাম। চুমু খেলেই, বা আবেগ প্রকাশ করলেই বা নিজেকে এক্সপ্রেস করলেই মানুষ যে ছোট হয়ে যায় না, সেটা আমি যে আজ মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, তাই আপনাকে দেখালাম।

আমি বললাম, ওসব পরে হবে, এখন চলুন। লক্ষ্মী মেয়ের মতো এবারে শুয়ে পড়বেন।

তবু ও কিছুতেই একা শুতে রাজি হল না। অগত্যা আমার ঘরের খাট থেকে বিছানা এনে ওর ঘরে পাতলাম। ও কিছুতেই আমাকে মাটিতে শুতে দিল না। ও মাটিতে শুল। আমি ওর খাটে শুলাম। ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে ওর গায়ে কম্বল টেনে দিলাম। আশ্চর্য! শোকে মানুষ কীরকম শিশু হয়ে যায়। ভাবা যায় না।

সারা রাত মারিয়ানার মিষ্টি শরীরের গন্ধভরা বিছানায় শুয়ে আমার ভাল করে ঘুম হল না। ঘরের আধো অন্ধকারে মারিয়ানাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। নিজের জন্যেও বোধহয়। খুব ইচ্ছে করছিল, খাট থেকে নেমে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুই। ওর দুঃখকে আমার বুকে শুষে নিই।

পরদিন সকালে মারিয়ানা একেবারে স্বাভাবিক।

সলজ্জ হাসি হেসে বলল, আপনাকে বেড়াতে আসতে বলে কাল খুব জ্বালাতন করেছি, না?

আমি বললাম, ভীষণ। কিন্তু এরকম একা একা তো আপনার থাকা চলবে না। হয় আপনি কলকাতায় যান, নয়তো আপনি এখানে কোনও আত্মীয়-টাত্মিয়কে আনান। নইলে একটা বিয়ে করুন। এরকম একা একা জঙ্গলে মানুষ দিনের পর দিন থাকতে পারে?

মারিয়ানা দুঃখিত গলায় আমাকে বলল, এতদিনে আমাকে আপনি এই বুঝলেন? এখন আমি বিয়ে করলে সুগতর কাছে কী জবাবদিহি করব? তা ছাড়া, মহুয়ার কাছেও যে বড় ছোট হয়ে যাব।

আমি বললাম, অন্য লোকে কী বলবে না বলবে, ভেবেই তো এই অবস্থা আজকে—আবারও সেই ভুল করবেন না। সুগতবাবুর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তা বলে এখন থেকে অমন ধনুকভাঙা পণ করে বসবেন না।

মারিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, না না, এসব বলবেন না লালসাহেব, আপনি আমাকে যেমন করে জানেন, এক সুগত ছাড়া আর কেউ বোধ হয়, আমাকে এত কাছ থেকে জানেনি। জানে না। আপনি অমন কথা বলবেন না। একজনকে বড় মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়েছি। আমার আর এসব ভাল লাগে না। এখন আমি মুক্ত। সুগত সংস্কারমুক্তির কথা বলত। তা যে এমনভাবে ঘটবে কখনও ভাবিনি। আমাদের সমাজে বিয়েটা সত্যিই একটা বাঁধন, মুক্তি নয়। যে যাই বলুক।

গেট অবধি পৌঁছে দিতে এল মারিয়ানা। বলল, আপনার চাকরি যদি সত্যি যায়ই, তবে এখানে এসে আমার কাছেই থাকবেন।

আমি হেসে বললাম—আজীবন?

মারিয়ানা সিরিয়াসলি বলল, আজীবন। খুশি হয়ে থাকতে দেব।

আর খেতে পরতে?

হ্যাঁ, তাও দেব।

আর কিছু তো দেবেন না।

ও হেসে ফেলল। বলল, না।

জিপটা স্টার্ট করলাম। মারিয়ানা কপাল থেকে চুল সরাতে সরাতে বলল, সত্যি, আপনার জন্যে কী প্রার্থনা করা যায় বলুন তো?

আমি বললাম, পরের জন্মে যেন আপনার সুগত হয়ে জন্মাই।

মারিয়ানার চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

পরক্ষণেই লাজুক চোখ নামিয়ে ও বলল, ভারী খারাপ আপনি।

সাতাশ

এই বন পাহাড়ের সব কিছুই কেমন অদ্ভুত। লোকগুলোও যেন থাকতে থাকতে অদ্ভুত হয়ে যায়। এই যে এত বড় কাণ্ডটা ঘটে গেল, জগদীশ পাণ্ডের দলবলকে যে নদীতে ফেলে দিল যশোয়ন্ত, তার জন্যে ওরা পুলিশে ডাইরি পর্যন্ত করল না। শুনেছি, জগদীশ পাণ্ডের একটা পা ভেঙে গেছে। ওর বন্ধুর পাঁজরে চোট লেগেছে। অন্যজনের কলার বোন ভেঙে গেছে। অথচ তবু যেন কিছুই হয়নি; এমনি ভাব করে, নেহাতই জিপগাড়ি ব্রেক ফেল করে নদীতে পড়ে গেছে, এই বলে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিল।

ওরা পুলিশে ডাইরি না করায় যশোয়ন্ত বেশ চিন্তিত আছে। সত্যি কথা বলতে কী, ওকে আগে কখনও এত চিন্তিত দেখিনি। আজকাল যখনি বাড়ি থেকে বাইরে বেরোয়, ও পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। কোমরে গোঁজা থাকে, ওর হাফহাতা খাকি বুশ শার্টের নীচে। আমিও যখনই বাড়ি থেকে বাইরে বেরোই, তখনই বন্দুকটা নিয়ে বেরোই। অবশ্য বন্দুক দিয়ে শিকার করা চলে, ডাকাতি করা চলে, মানে আক্রমণাত্মক অস্ত্র হিসেবে বন্দুক ভাল, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্যে বন্দুক অচল। বনের রাস্তার মোড়ে অথবা জঙ্গলের গুঁড়ি পথে কোথায় যে জগদীশের দলবল লুকিয়ে থাকবে, তা পূর্বমুহূর্তেও জানা যাবে না। সময়ও পাওয়া যাবে না। পিস্তলে এই সুবিধা। এই সব সময়ে মুহূর্তের মধ্যে পিস্তল থেকে কাছাকাছি গুলি ছোঁড়া যায়।

জানি না কেন, যশোয়ন্ত প্রায়ই বলছে আজকাল যে, জগদীশ পাণ্ডের কাছ থেকে আমার বোধ হয় কোনও ভয় নেই। প্রথম কারণ এই যে, যশোয়ন্ত নিশ্চিতভাবে জেনেছে যে, আমার চাকরি শিগগিরই যাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, ঝগড়াটা এখন নাকি যশোয়ন্ত আর জগদীশ পাণ্ডে এই দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে। এ ব্যাপারে বোধহয় দু’পক্ষেরই মতামত এই যে, অন্য কাউকে এর মধ্যে না জড়ানোই ভাল। কবে কখন এই দুই শত্রু এমন বোঝাপড়ায় এল, তা অবশ্য জানি না।

তাই যদি হয়ে থাকে, তবে এর পরিণাম খারাপ। খুবই খারাপ। জগদীশ পাণ্ডের যতটুকু পরিচয় পেয়েছি, তাতে সে করতে পারে না এমন কাজ সত্যিই নেই। যশোয়ন্তের বেলাতেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। অতএব এরা দুজনে যদি এ ব্যাপারে একা একা ফয়সালা করতে চায়, তবে যে কী ঘটনা ঘটবে ঠিক ভাবা যায় না।

জগদীশ পাণ্ডের সঙ্গে ওর ঝগড়া যে শুধু শিকার নিয়েই নয়, তার একটু আভাস পেয়েছিলাম গতকাল।

আমি আর যশোয়ন্ত নইহার থেকে জিপে ফিরছিলাম। হঠাৎ লালতির সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। এক ঝুড়ি মহুয়া মাথায় নিয়ে লালতি শাল-বনের পথে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। যশোয়ন্ত জিপটা প্রায় ওর গায়ের কাছে ভিড়িয়ে ওকে জাপটে ধরে কোলে তুলে চুমু খেয়েছিল—ঝুড়িভর্তি লালতির সব মহুয়া রাস্তায় পড়ে গেছিল। লালতি কপট ক্রোধে হাত-পা ছুঁড়েছিল। তারপর তাকে জিপের বনেটের উপর বসিয়ে দিয়ে যশোয়ন্ত আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল—বলেছিল, ঈ হ্যায় মেরে দিল, জান দোস্ত—লালসাব। ঔর ঈ—লালতি। মেরে মুন্নী।

যশোয়ন্ত লালতির দিকে চেয়ে বলল, এক রাত কি লিয়ে দুলহন বনেগী লালসাব কি? নহী, নহী। বলেই লালতি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।

যশোয়ন্ত চুট্টায় আগুন দিয়ে বলেছিল, কিঁউ। মেরা দোস্ত খুবসুরৎ নহী?

নহী, নহী, উস লিয়ে নহী।

তো? কিস লিয়ে?

উত্তরে লালতি চুপ করে রইল।

অমনি যশোয়ন্ত আবার ওকে জড়িয়ে ধরে ওর সারা গায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল।

লালতি কিত কিত করে হাসতে হাসতে বলল, ছোড়ো ছোড়া, গুদগুদি লাগ রহা হ্যায়।

যশোয়ন্ত ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুম জানতে হো, মেরা দোস্ত আভিতক কিসীসে মুহব্বত নেহি কিয়া?

লালতি আবার হাসল। বলল, ধেৎ। ঝুট বাত হ্যায়।

সেই প্রথম আমি লালতির দিকে ভাল করে তাকালাম। কুড়ি-একুশ বছর বয়স হবে। গায়ের রঙ তামাটে। খুব টানা-টানা চোখ। ঠোঁট দুটো দারুণ। কটা কটা একমাথা চুল। অত্যন্ত নোংরা। গায়ে গন্ধ। কিন্তু দারুণ ফিগার। সত্যিই দারুণ।

ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।

লালতির পক্ষে বিশ্বাস করাই সম্ভব নয় যে, আমার বয়সের আমার মতো একজন যুবক এখনও কাউকে বুকে নিয়ে ঘুমোয়নি। হাসি পেল। মাঝে মাঝে আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে অনিচ্ছে হয়।

তারপর আমি আর যশোয়ন্ত দুজনে লালতির ঝুড়ি থেকে পড়ে যাওয়া মহুয়াগুলি সব আবার কুড়িয়ে দিলাম। লালতি হাসতে হাসতে যশোয়ন্তকে চোখ ঠেরে, ঝুড়ি মাথায় চলে গেল।

জিপের স্টিয়ারিং-এ বসা যশোয়ন্তকে শুধোলাম, ওর মধ্যে তুমি কী এমন দেখছ যশোয়ন্ত?

যশোয়ন্ত হাসল। বলল, ইস লিয়েই তো ম্যায় শহরবাঁলোসে ডরতা। তারপর বলল, ওর মধ্যে গভীরে দেখার তো কিছু নেই। ওর মধ্যে শুধু একটি নিমকিন লাজোয়াব শরীর দেখেছি। শরীর ছাড়িয়ে ওর মধ্যে তো আমি আর কিছু দেখতে যাইনি লালসাহেব। তোমরা পড়ে-লিখে আদমিরা সবসময় দিগন্তের ওপারে কী আছে তার খোঁজ করো। সবসময় তোমরা সামান্যকে ছাড়িয়ে অসামান্য কিছু খুঁজতে যাও। তাই বোধহয় কিছুই পাও না। আমি আমার সামান্য দিগন্তরেখার মধ্যে বন্দি আছি; বন্দি থাকতে চাই। এই বেতলা, বাগেচম্পা, ছিপাদোহর, রুদ, চাহাল-চুংরুর জঙ্গলের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাই। লালতির নাংগা শরীরে বুঁদ হয়ে থাকতে চাই। এই আমার দিগন্ত। মধুর দিগন্ত। এর বাইরে কী আছে আমি কখনো দেখতে যাইনি লালসাহেব। যদি কিছু থেকে থাকেও, তা জানার লোভ বা আগ্রহও আমার নেই। আমি নিজেকে নিয়ে খুব সুখে আছি। তোমরা দুরের শহরের লোকরা, বাইরের পৃথিবীর লোকরা এলোমেলো কথা বলে আমার এই সুখ নষ্ট করে দিয়ো না।

জিপটা একটা কজওয়ে পেরুল গোঁ-গোঁ-গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে। আওয়াজ কমলে আমি শুধোলাম, তুমি কি বলতে চাও, লালতিকে তুমি ভালবাসো?

যশোয়ন্ত আবারও হাসল। মাঝে মাঝে গোঁফের ফাঁকে ও কেমন দুর্জ্ঞেয় হাসি হাসে। বলল, নিশ্চয়ই ভালবাসি। শরীরের ভালবাসা।

আর মনের ভালবাসা?

যশোয়ন্ত হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে বলল, মনের ভালবাসা তো সবাইকে বাসা যায় না লালসাহেব। সে একজনকেই বাসি। তবে কী জানো, সে ভালবাসার তো গাঁ বদল হয় না; সে ভালবাসা এক গাঁয়েই থাকে। জীবনে একজনকেই তেমন করে ভালবাসা যায়। জীবনের অন্য ভালবাসাগুলো সব সেই একই ভালবাসার ভেঙে যাওয়া আয়নার টুকরো-টাকরা। টুকরোগুলো এক জীবনে দু’হাতে কুড়িয়ে জড়ো করেও আর সে ভাঙা আয়না জোড়া লাগে না। যে আয়না ভাঙে; তা ভাঙেই।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। আমার জংলি দোস্ত যশোয়ন্ত মাঝে মাঝে এমন এমন কথা বলে ফেলে যে, উত্তরে কথা না বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে ভাবতে ইচ্ছে করে।

একটু পরে যশোয়ন্ত নিজেই বলল, আর সবচেয়ে মজার কথা কী জানো দোস্ত, এই মনের ভালবাসা আর শরীরের ভালবাসা কখনও একজনের কাছ থেকে তুমি পাবে না। যদি তা কখনও ঘটে, সে এক দুর্ঘটনা বটে। তা না হওয়াই ভাল। আমাকে একশো একটা গুলি করলেও আমি বিশ্বাস করি না যে, কেউ একই সঙ্গে শরীর আর মনের ভালবাসার চাহিদা মেটাতে পারে।

আমি বললাম, তা হলে আর ভালবাসা ভালবাসা বলছ কেন? বললা, শরীরের চাহিদা। যশোয়ন্ত খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল—বলল, বিলকুল নহী। চাহিদা বড় নোংরা শব্দ। জিনিসটা নোংরা। তোমাকে কী করে বোঝাব যে, শরীরেরও ভালবাসা আছে—শরীরও বুলবুলি পাখির মতো কথা বলে। তারপর হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, তোমার মতো গাধা সতী ব্যাচেলারকে এসব কথা বোঝানো আমার কম্ম নয়।

জিপটা একটা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বাঁ দিকে একটা ন্যাড়া পাহাড়। পত্রশূন্য গাছগুলো আকাশে হাত বাড়িয়ে কী যেন চাইছে। হাওয়ায় হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ছে মচমচানি আওয়াজ তুলে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে যশোয়ন্ত বলল; এই লালতি যখন যোলো বছরের ছিল, তখন থেকে আমি ওর শরীরকে ভালবাসি। কিছুদিন আগে এক রাতে লালতি আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল। দেখলাম, ওর বুকে কে যেন দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। ওর বাঁদিকের বুকে একটা ছোট্ট লাল তিল আছে। তাই আমি ওর নাম দিয়েছিলাম লালতি। ওর আসল নাম অন্য। কী করে এমন হল জিজ্ঞেস করতে, লালতি আমাকে সব বলল। কী বলব লালসাহেব, সে রাতে আমার বড় কষ্ট ও রাগ হয়েছিল। যে শরীরকে আমি ভালবাসি, সেই শরীরে কেউ হায়নার মতো দাঁত বসাবে এ আমি ভাবতে পারি না। তা ছাড়া যে সব কামবকত পুরুষ মেয়েদের কী করে আদর করতে হয় তাই শেখেনি, সেগুলোর কোনও অধিকারই নেই কোনও সুন্দর শরীরে হাত ছোঁয়াবার। তবু একটা খাটাশ, একটা বদবু হায়না আমার লালতির লাল তিলের উপর দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। সেদিন থেকে খাটাশটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার শরীরের ভালবাসার শরিকের গালে ও দাঁত ছুঁইয়েছে। আমি একদিন ওর জান নিয়ে নেব লালসাহেব। তুমি দেখো। ওকে একদিন আমি জানে খতম করব।

আমি অবাক হয়ে শুধোলাম, কে সে লোক? কার এত দুঃসাহস?

যশোয়ন্ত এক অদ্ভুত শান্ত হাসি হাসল। তারপর জিপের গিয়ার বদলাতে বদলাতে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, হামলোঁগোকা দোস্ত। জগদীশ পাণ্ডে।

আঠাশ

হুটার আর কুজরুমের কাছের এক ওঁরাও বস্তির ছেলেরা নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। সোমবারে সারহুল উৎসব। মার্চের শেষে শালবনে ওরা সারহুল উৎসব করে।

মারিয়ানা অনেকদিন আগে একটি সারহুল গান শুনিয়েছিল—

‘হালফিলের মেয়েরা প্রজাপতির মতো নরম।

হাত ছুঁইয়ে দেখো—

কী নরম—

ইস্ প্রজাপতির মতো নরম।’

বললাম, যাব, নিশ্চয়ই যাব। এমনিতে হয়তো নেমন্তন্ন করত না। আমিই ওদের বলে রেখেছিলাম, সারহুল উৎসবের সময় আমাকে যেন একবার বলে, দেখতে যাব।

এই উৎসব মার্চের শেষেই যে হবে, এমন কোনও কথা নেই। শাল গাছে যখন থোকা থোকা ফুল ধরে, হাওয়ায় হাওয়ায় যখন সেই গন্ধ ভেসে আসে—ঋতুরানি বসন্ত যখন বনে জঙ্গলে অসীম মহিমায় অধিষ্ঠিত হন, তখন ওরা এই উৎসব করে।

যখন আমি প্রথম রুমান্ডিতে আসি, তখন প্রখর গ্রীষ্ম। বসন্ত অপগত। তাই যখন বন জঙ্গলের বাসন্তী ভুবনমোহিনী রূপ দেখতে পাইনি। এ রূপ এখন দেখছি। এ রূপ বর্ণনা করি, সে সাধ্য আমার নেই।

প্রকৃতির মতো সুগন্ধি, সুবেশা, সুন্দরী মেয়ে আর দেখলাম না। এই ক্ষণে ক্ষণে শাড়ি বদলানো। এখন শীতের সবুজ গাড়োয়াল ছেড়ে বসন্তের ফিকে হলুদ বেগমবাহার পরেছেন। শ্যাম্পু করা শুকনো পাতার চুলে চুড়ো বেঁধেছেন। আর আতর কী আতর। সর্বক্ষণ শরীর অবশ করা গন্ধে হাওয়া ম’ ম’ করে।

দেখতে দেখতে সোমবার এসে গেল। গেলাম হুটারে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে। রোদটা এখনও মিষ্টি মিষ্টি লাগলেও ভরদুপুরে একটু গরমই লাগে।

এপ্রিলের প্রথম থেকে বেশ গরম পড়ে যাবে। তবে হাওয়াটা এখনও গরম হয়নি—বনের পাতায় পাতায় পাহাড়ি নদী-নালায় আমাদের নয়াতালাওয়ে সর্বত্রই এখনও আর্দ্রতা আছে—থাকবে বেশ কিছুদিন। তারপর মে মাসে বনের বুক শুকিয়ে কুঁকড়ে ভিখারিণীর বুকের মতো হয়ে যাবে। জল থাকবে না কোথাও এক কণাও।

বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ কিছুটা গিয়ে বারোয়াড়ির দিকের পাহাড়ের নীচে চমৎকার একটি শালবন। বড় বড় ঋজু, সবুজ, সতেজ শালগাছ। ফুল পড়ছে উড়ে উড়ে পড়ে আছে নীচে, মাটিতে, ঘাসে, পাথরে। একটি নীলকণ্ঠ পাখি একলা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এ গাছ থেকে ও গাছে।

ওরা সকলে গাঁয়ের পাহানকে নিয়ে সাড়ুয়া বুড়ির কাছে চলল।

সাড়ুয়াবুড়ি আর কেউ নন। একটি সুন্দরীর শালগাছ; যাকে ওরা সকলে ‘বনদেওতা’ বলে মেনেছে। ওরা বিশ্বাস করে, এই সাতুয়াবুড়ির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপরেই বৃষ্টি হওয়া না হওয়া নির্ভরশীল। অশেষ তাঁর ক্ষমতা।

সকলে মিলে সেই শেষ বাসন্তী বিকেলে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে মাদল বাজাতে বাজাতে এসে সাড়ুয়াবুড়ির নীচে জমায়েত হল। তারপর গাঁয়ের পাহান পাঁচটি মোরগ নিবেদন করল বুড়িকে। পাহান বিড় বিড় করে কী সব মন্ত্রতন্ত্র বলল। হয়ে গেল পুজো।

ওরা সকলে মিলে গোছ গোছা শাল ফুল পাড়ল। তারপর সেই ফুল নিয়ে চলল গাঁয়ে। একটা জিনিস লক্ষ করলাম যে, যারা এসেছে এখানে, তাদের মধ্যে একটিও মেয়ে নেই।

পরদিন সকালে আবার গেলাম ওদের গাঁয়ে।

পাহানের সঙ্গে কয়েকজন ওঁরাও যুবা, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যাবে। প্রতি বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাড়ির মেয়েরা একগুচ্ছ শাল ফুল পেতে বসবে পাহানের সামনে। পাহান তাদের চুলে ফুল গুঁজে দেবে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাহানকে, ওরা সকলে মিলে আপাদমস্তক জল ঢেলে ভিজিয়ে দেবে।

এমনি করে পাহান গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যাবে। এত জল মাথায় ঢালাতে পাছে পাহানের সর্দি কি জ্বর হয়, তাই গাঁয়ের লোকের চিন্তার শেষ নেই। পাহানের মাথায় যত জল ঢালা হয় তার পেটে তার চেয়ে বেশি মহুয়া পড়ে সেদিন। অতএব টলতে টলতে, হাসতে হাসতে, ভেজা কাপড়ে পাহান এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যায়। মেয়েগুলি কৃষ্ণসার হরিণীর মতো দৌড়ে বেড়ায়। দোলা লাগে বুকে কাঁপতে কাঁপতে খিলখিল করে হাসে, কাঁপা কাঁপা হাতে পাহান ওদের খোঁপায় ফুল গোঁজে—মেয়েরা দুষ্টুমি করে পাহানকে আরও বেশি করে ভিজিয়ে দেয়। এমনি করতে করতে দিন ফুরায়।

রাতের খাওয়াদাওয়া হয় একসঙ্গেই। ছেলেমেয়ে বুড়ো সব যায়। তারপর শালফুলের ঘাগরা পরে, শালফুলের সুন্দর মুকুট মাথায় দিয়ে ছেলে ও মেয়েরা নাচ আরম্ভ করে। সে এক নাচের মতো নাচ।

সারা রাত মাদলের শব্দ শোনা যায়। গুড়ুক-গুড়ু-গুং গুবুক-গুরু গুং…। গুড়ুক গুড়ু গুড়ুক-গুড়ু—গুড়ুক-গুড়ু-গুং।

পেটে যত মহুয়া পড়ে, নাচের বেগ তত বেশি বাড়ে। এমনি করে পরদিন সকাল পর্যন্ত এই নাচ আর গান চলে—ছেলেমেয়েদের সম্মিলিত গলার একটানা দোলানি সুরে।

এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা! মারিয়ানার বাড়িতে ভেজ্জা নাচ দেখেছিলাম, আর বহুদিন পর এই সারহুল নাচ দেখলাম।

উনত্রিশ

নয়াতালাওর কাছে সেই আমবাগানে নাকি ভাল্লুকের মরসুম শুরু হয়েছে। সেই বুড়ো ট্রাক-ড্রাইভার ইতিমধ্যে আমাকে আরও কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়ে গেছে তার প্রয়োজনের কথা। লজ্জার সঙ্গে, কুণ্ঠার সঙ্গে; ভয়ের সঙ্গে এসে।

রামধানীয়া এসে বলছিল, সন্ধের পর আমবাগানে আমের লোভে ভাল্লুকগুলো রোজই আসছে। এখন শুক্লপক্ষ। সন্ধের পর চতুর্দিক জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করে। জঙ্গলের নীচে বহুদূর অবধি নজর চলে। মাঝে মাঝে রাতে, এখন পথে বেরোলেই হাতির দলকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ওরা দল বেঁধে নয়াতালাওর দিকে যায় জল খেতে। কোনওদিন বা দেখা যায় না। জঙ্গলে শুধু শোনা যায় ডালপালা ভাঙার শব্দ। হাতির দল কোনওদিন কাউকে কিছু বলে না। গুণ্ডা পাগলা হাতি থাকলে ভয়ের ব্যাপার। হাতির উপদ্রব বেলার দিকেই বেশি। আমাদের এদিকে উপদ্রবকারী হাতি বড় একটা আসে না।

ভাবলাম, চলে যাবার আগে একটা পুণ্যকর্ম যদি করে যেতে পারি, মন্দ কী? ট্রাক-ড্রাইভারের তৃতীয় পক্ষের বউ যদি আশীর্বাদ করে আমায়, তা না জানি কোনও না কোনও উপকারে লেগে যাবে ভবিষ্যতে।

সেদিন আটটা নাগাদ বেরিয়েই পড়লাম বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে। আজকাল সন্ধেই হয় প্রায় সাতটা নাগাদ। সূর্য আর পৃথিবীর শরীর ছেড়ে উঠতেই চায় না। যাই যাই করতে করতেও বেলা যায় না। সূর্য গেলেও তার শরীরের তাপ সারা পৃথিবীর শিথিল শরীরে ছড়িয়ে থাকে। হাওয়ার নিশ্বাসে মহুয়া আর করৌঞ্জের বাস ভাসে। রাতচরা পাখিরা খুশির ফোয়ারা ছড়ায় ছোট ছোট ঠোঁটে। জঙ্গলে পাহাড়ে এ সময় হেঁটে বেড়ানোর মতো মনোরম অভিজ্ঞতা আর নেই।

বড় রাস্তা ছেড়ে নয়াতালাওর রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। এখান থেকে আমবাগান আরও মাইলখানেক। নানা কথা ভাবতে ভাবতে বন্দুকটা কাঁধে ফেলে চলেছি। আধ মাইলটাক গেছি বড় জোর। এমন সময় পথের ডান দিকের একটি পাহাড়ি নালার বুকে শুকনো পাতা মাড়ানোর মচমচ আওয়াজ পেলাম।

একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরে তার পাশেই আবার ওরকম মচমচ আওয়াজ শুনলাম।

খুব কৌতুহল হল, কী জানোয়ার অমন করছে তা দেখার। বন্দুকটায় দুটো এল-জি পুরে নিয়ে পা টিপে টিপে ওদিকে সাবধানে এগোতে লাগলাম।

কাছাকাছি যেতেই দেখলাম, নালার বুকে আলো ছায়ার আধো-অন্ধকার। অনেকগুলো বড় বড় পাথরে একটা টিলার মতো হয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে গ্রীষ্মের পত্রবিরল গাছেদের মাথা বেয়ে ধবধবে চাঁদের আলো এসে দাবার ছকের মতো ছক পেতেছে কালো পাথরে।

নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখেও সেখানে কোনও জানোয়ার দেখতে পেলাম না। একটি টি-টি পাখি রাস্তার উপরে ঘুরে ঘুরে টিটিরটি-টিটিরটি করে উড়ে বেড়াতে লাগল। সাধারণত জঙ্গলে কোনও জানোয়ার বা মানুষকে চলাফেরা করতে দেখলেই ওই পাখিগুলো তাদের সামনে বা মাথার উপরে অমন করে উড়ে বেড়ায়।

মুখ ঘুরিয়ে আমি রাস্তার দিকে তাকালাম। রাস্তার দিকে পুরো মুখ ঘুরিয়েছি, এমন সময় সেই কালো পাথরের টিলার কাছ থেকে একটি মেয়েলি গলার চাপা হাসি শুনতে পেলাম। বেশ ভয় পেয়ে ও অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়েই ও দিকে বন্দুক তুললাম।

এমন সময় যশোয়ন্তের গম্ভীর গলা শুনলাম, ‘মত মারো ইয়ার। মাদীন হ্যায়।’

আমার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম গড়াতে লাগল। আমি ইদানিং জঙ্গলে পাহাড়ে যেখানেই সন্দেহজনক কিছু দেখি, অমনি জগদীশ পাণ্ডের কথা মাথায় খেলে যায়। আর একটু হলে হয়তো গুলিই করে ফেলতাম। এমন রসিকতা কেউ করে।

পাথরের টিলার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখি, যশোয়ন্ত এবং একটি মেয়ে টিলার উপরের মসৃণ পাথরের বুকে ভর দিয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের দুজনের গায়েই কাপড় জামার চিহ্নমাত্র নেই।

যশোয়ন্তকে দেখে এই মুহূর্তে আমার মনে হল যে, ওকে আমি চিনি না। ঠিক এ অবস্থায় আগে ওকে কোনওদিন দেখিনি। দেখব বলে ভাবিওনি। অথচ ওর পটভূমিতে ওর পাগলামির পরিপ্রেক্ষিতে, এরকম দৃশ্য যে-কোনওদিনই দেখব বলে তৈরি হয়ে থাকা আমার উচিত ছিল।

আমি কী করব, বা বলব, ভেবে না পেয়ে বললাম, যাচ্ছি। আমি চললাম।

যশোয়ন্ত একটা আদিম মানুষের মতো কালো পাথরের স্তৃপ বেয়ে চাঁদের রাতের তরল সায়ান্ধকারে নালার মধ্যে তরতরিয়ে নেমে এসে আমার হাত ধরল।

বলল, ভাগতে কিঁউ ইয়ার? আও বৈঠো। তুমসে কুছভি ছিপানা নেহী।

তারপর উপরের দিকে চেয়ে ডাকল, উতারকে আ লালতি।

লালতি সলজ্জে বলল, নেহী।

কিঁউ? নাঙ্গা? উসলিয়ে?

নেহী।

তো কিঁউ?

এইসেহি।

যশোয়ন্ত হো হো করে হাসতে লাগল। আলোছায়ার বুটিকাটা বনে একজন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মতো সমাজ সভ্যতার মুখে লাথি মেরে ও হাসতে লাগল। মনে হল, যশোয়ন্ত আজ নেশায় বেশ বেহুশ হয়ে আছে।

যশোয়ন্তের হাসি থামতে না থামতে লালতির পায়ে লেগে উপর থেকে একটা খালি বিয়ারের বোতল টুংটাং শব্দ করে পাথর গড়িয়ে এসে নীচে বালিতে ধপ করে পড়ল।

লোকে যেমন পোষা কুকুরকে ডাকে, তেমনি করে যশোয়ন্ত লালতিকে বলল, আঃ আঃ লালতি আ—মেরে দোস্ত তুম্‌কো জেরা নজদিকসে দেখেগা। আ মেরে লালতি, পেয়ারী।

লালতি আবার বলল, এ বাবু, তুম অ্যাসা করোগে তো হাম ভাগেগী।

যশোয়ন্ত আবার পাগলের মতো হাসতে লাগল।

আমি যশোয়ন্তকে কোনওদিনও এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখিনি।

যশোয়ন্ত আমার হাত ধরে এক ঝটকা টানে আমাকে নিয়ে একটা পাথরে বসল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বলল, বুঝলে লালসাহেব, নরম পাখির মতো মহুল ফুলের মতো, মেয়েদের শরীর নিয়ে অনেক নাড়লাম চাড়লাম। শিঙ্গাল হরিণের মতো হরিণীর দলের সঙ্গে ছায়ায় রোদ্দুরে অনেক খেললাম। কিন্তু সুমিতাবউদির মতো কাউকে দেখলাম না। মনের ভালবাসার গাঁ বদল আমার হল না। জানো লালসাহেব, সুমিতবউদি আমার কাছ থেকে কিছু চেয়েছিল। সুমিতাবৌদি বলেছিল, যশোয়ন্ত, তোমার দুরন্তপনার এক কণা আমাকে দিয়ে যাও। সেই এক কণা উষ্ণতা আমি চিরদিনের জন্যে, বরাবরের জন্যে আমার করে রাখব। তুমি আর কখনও পালিয়ে যেতে পারবে না আমার কাছ থেকে। লালসাহেব, একদিন সুগান সিংয়ের সুরাতীয়াও আমার কাছে কিছু চেয়েছিল; অন্য কিছু। তার জন্যে আমি কিছুই করতে পারিনি, সে ব্যথা আমার মনে আজও কাঁটার মতো লাগে। আমি জানি, তোমাদের সামাজিক বাজপাখিটা সব সময় মাথার উপর চিঁচিঁ করে ঘুরে বেড়ায়, তবু আমি যা কাউকে কোনওদিন দিইনি, তাই দিয়ে ফেললাম সুমিতাবৌদিকে।

জগদীশ পাণ্ডে, কি পৃথিবীর কোনও শালা পাণ্ডেকে আমার আর ভয় নেই। আমার যদি কিছু হয়ও, আর একটা ছোট্ট যশোয়ন্ত সুমিতাবউদির বুক জড়িয়ে থেকে যাবে। লালসাহেব, এতদিন আমি শিমুলতুলোর মতো হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়িয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি আমার দুরন্তপনার বীজ একটি দারুণ খুশবুভরা চাঁপা ফুলে বরাবরের মতো পুঁতে দিয়েছি।

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম।

মনে পড়ল, ঘোষদা আমার কাছে সাধের নেমন্তন্ন খেয়ে গেছেন। হাসিও পেল। আবার সুমিতাউদির কথা ভেবে কথাটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতেও ইচ্ছা করছিল না।

যশোয়ন্ত আমার মুখে ওর হাত চাপা দিয়ে বলল, কাউকে বোলো না দোস্ত। এ কথা কাউকে বলার নয়। কেন যে তোমাকে বলে ফেললাম, জানি না। তবে তোমাকে বলিনি, এমন কিছুই আমার নেই। তাই বলে ফেললাম। তুমি আর কিছু শুধিয়ো না। আমার খালি ভাবতে কষ্ট হয় যে, আমার ছেলে—ডাকাইত যশোয়ন্তের ছেলের বাপ বলে পরিচিত হবে ওই লোকটা। ওই নিচু মনের ভিতু, চাকরিসর্বস্ব ভুড়িওয়ালা লোকটা। এটা ভাবলেই আমার কষ্ট হয়।

আমার ছেলেকে তো আমি কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। সে যখন বড় হবে, বড় হয়ে আমার মতো জঙ্গলে পাহাড়ে রাইফেল হাতে রোদ্দুরে-চাঁদে ঘুরে বেড়াবে, তখন সে হয়তো কোনও উঁচু পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নীচের রোদ-ঝলমল উপত্যকার দিকে চেয়ে মনে মনে বলবে:

“I had an inheritance from my father,

It was the moon and the Sun.

I can move throughout the world now,

The spending of it is never done.”

হঠাৎ লালতি উপর থেকে বলে উঠল যে, তাকে অন্ধকারে সাপের কামড় খাওয়ানোর জন্যে ওইখানে একা শুইয়ে রেখে যশোয়ন্ত কোন আনজান ভাষায় গেহুঁ-বাজরার গল্প করছে দোস্তের সঙ্গে?

আমি বললাম, আমি চলি, যশোয়ন্ত। আমি চলি।

যশোয়ন্ত হাসল। তারপর অনিচ্ছার হাসি হেসে বলল, আচ্ছা।

আমি অন্ধকারের ঝুপড়ি থেকে বেরোচ্ছি, এমন সময় যশোয়ন্ত পেছন থেকে আমাকে ডেকে বলল, লালসাহেব, লজ্জাবতী লতা একা-একাই দেখা ভাল-যেদিন দেখবে। সব জিনিস অন্যের হাত ধরে দেখতে নেই।

বলেই, আবার জঙ্গল কাঁপিয়ে হাসতে লাগল—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *