অন্য সবাই চলে গেছে, ল্যাবরেটরিতে একা একা কাজ করছে অতীন। সাতটা বেজে গেছে, তার খেয়ালই নেই। কেউ অবশ্য তাকে যেতে বলবে না। দারোয়ান বা গার্ড এসে বলবে না, এবার আপনি যান, দরজা বন্ধ করবো। এখানে লাইব্রেরি খোলা থাকে রাত দুটো পর্যন্ত, যদি একজন বা দু’জন মাত্র পাঠক থাকে, তাদেরও বই সরবরাহ করার জন্য উপস্থিত থাকে একজন লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই লেবরেটরিতেও রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করা যায়। তারপরেও যদি কেউ থাকতে চায় তা হলে দরজা বন্ধ করার দায়িত্ব তার ওপর। সে বেরুবার সময় দরজাটা। টেনে দিয়ে যাবে। এত সব অ্যাপারেটাস, বীকার, বানার, টেস্ট টিউব, মাইক্রোসকোপ, রি-এজেন্ট, সল্ট, লিটমাস পেপার চতুর্দিকে ছড়ানো, তবু চুরি যাবার প্রশ্ন নেই।
সিগারেট খাওয়ার জন্য মনটা আনচান করছে অনেকক্ষণ ধরে, অতীন এক সময় কাজ থামিয়ে মুখ তুলে তাকালো। এত বড় লেবরেটরিতে সে যে একা রয়েছে তা অতীন খেয়াল করলো এইমাত্র। অনেকগুলো আলো জ্বলছে। আজ ক্যামপাস হলে কুরোসোয়ার একটা নতুন ফিলম দেখাচ্ছে, সেটা দেখতেই গেছে সবাই। কোনো একটা টেবিলে কেউ তাড়াহুড়োতে বুনসেন বানার নিবিয়ে দিতে ভুলে গেছে, সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে, অতীন সেটা নিবিয়ে দিল, তারপর সিগারেট টানার জন্য দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো।
এরমধ্যেই এটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। লেবরেটরির মধ্যে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই, সবাইকেই বাইরে যেতে হয়, কিন্তু এখন তো নিষেধ করার কেউ নেই, অতীন অনায়াসেই নিজের জায়গাতে বসেই সিগারেট খেতে পারতো, তবু সে বাইরে চলে এলো। অতীন দেখেছে, রাত তিন-চারটের সময় ফাঁকা রাস্তায় একটা মাত্র গাড়ি, আর কোনো দিকে অন্য গাড়ির চিহ্ন নেই, ট্রাফিক পুলিশ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না, তবু মোড়ের মাথায় লাল আলো দেখে সেই গাড়িটা থেমে যায়। অভ্যেস!
অতীন ড্রাইভিং লেসন নিতে শুরু করেছে দু’দিন ধরে। গাড়ি চালানো না জানলে এদেশে জীবনযাপন করা খুব শক্ত। এরপর সে একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড গাড়ি কিনবে। শ দেড়েক। ডলারের মধ্যেই মোটামুটি চলনসই গাড়ি পাওয়া যায়। পুরনো গাড়ি তো অনেকে ফেলেই দেয় এখানে। তাও যেখানে সেখানে ফেলার উপায় নেই, পুলিশ ঠিক গাড়ির মালিককে খুঁজে বার করে এত ফাইন করবে যে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। অনেক জায়গাতেই আছে পুরনো গাড়ির কবরখানা, অটোমোবিল গ্রেভ ইয়ার্ড। মানুষের কবরখানার মতন, সেখানেও গাড়ি কবর দিতে গেলে পয়সা খরচ করতে হয়।
অতীন আপাতত একটা সাইকেল কিনেছে। বাস কিংবা ট্রেন ভাড়ায় বড় খরচ পড়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই এখানে সাইকেল ব্যবহার করে। সেই বাগবাজারে থাকার সময় স্কুলজীবনে অতীন সাইকেল চালানো শিখেছিল, সেটা এখন কাজে লেগে গেল। শিলিগুড়িতেও সে মাঝে মাঝে সাইকেল ব্যবহার করেছে।
সিগারেটটা টানতে টানতে অতীন অনুভব করলো তার বেশী খিদে পেয়েছে। দুপুরে সে। ক্যান্টিনে একটা সুপ ও একটা হ্যামবার্গার খেয়েছে মাত্র। অন্তত পাঁচ দিন সে ভাত খায়নি, এইসব খেয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে। আগে তার মনে হতো, দিনে একবেলা অন্তত ভাত না খেলে পেটই ভরে না।
পেটে খিদের জ্বালাটা নিয়েই অতীন আরও এক ঘণ্টা কাজ করলো লেবরেটরিতে। এক এক সময় খিদেটাকেও নেশার মতন মনে হয়, সেটাকে মিটিয়ে না দিয়ে টিকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। শরীরটাও বেশ তরতাজা লাগে। অতীন ঠিক করে ফেললো, আজ রাত্তিরে সে আর কিছু খাবে।
খাতা-পত্র বন্ধ করে সে বাতি নেবাতে লাগলো। সবকটা টেবল ঘুরে দেখল কোথাও কোনো আগুন জ্বলছে কি না, কিংবা অ্যাসিডের বৈয়ম খোলা আছে কি না। তারপর নির্জন লম্বা। বারান্দা দিয়ে হেঁটে এলো। গেটের মুখে একটি ছোট্ট ঘরে একজন হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তি গভীর মনোযোগ দিয়ে টাইম ম্যাগাজিন পড়ছে। অতীন বললো, গুন্নাইট, জর্জ!
লোকটি মুখ তুলে বললো, ওয়ার্কিং লেট? ইউ ডোন্ট কেয়ার ফর জাপানিজ ফিল্মস? অতীন হেসে বললো, আই অ্যাম নট আ ফিলম বাফ! আই হার্ডলি স্পেন্ড মাই মানি ফর। মুভিজ। লোকটিও হেসে উত্তর দিল, গুড ফর ইয়োর হেলথ!
বাইরে এসে অতীন দেখলো টিপি টিপি বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের মধ্যে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। অতীন রেইন কোট কিংবা ছাতা আনেনি। কিন্তু একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকারও কোনো মানে হয় না, এই বৃষ্টি কখন থামবে তার ঠিক নেই। অতীন সাইকেলে চেপে বসলো।
দুপুরবেলায় বেশ গরম ছিল, কিন্তু বৃষ্টি নামলেই গা শিরশির করে। এই বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি নিঘাৎ জ্বর হবার কথা। দেখা যাক! সেই জামসেদপুরের পর আর অতীনের একবারও জ্বর হয়নি!
শর্মিলার সঙ্গে আর একবারও দেখা হয়নি সেদিনের পর। শর্মিলা ওয়াশিংটন ডি সি-তে। তার মামার কাছে আছে। সে একলা গেছে, সুমি এখানেই আছে। শর্মিলা তেমন কিছু অসুস্থ হলে একলা গ্ৰেহাউণ্ড বাসে চেপে অতদূর যেত কি? সুমির সঙ্গে চোখাচোখি হলেও অতীন কথা বলবে না ভেবেছিল, সুমি নিজেই একদিন একটা বইয়ের দোকানের সামনে অতীনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে শর্মিলার খবরটা জানালো।
অতীন ওয়াশিংটন ডি সি-তে শর্মিলার মামার ফোন নাম্বার জানে না, সুমিকে জিজ্ঞেসও। করেনি। শর্মিলা নিজে থেকেই কি ফোন করতে পারতো না? শর্মিলা হঠাৎ ওখানে চলে গেছে নিশ্চিত অতীনকেই এড়াবার জন্য। এর কী দরকার ছিল, শর্মিলা যদি চায়, অতীন। বস্টন-কেমিব্রিজ ছেড়েই চলে যেতে রাজি আছে!
বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশ, অতীন মাথাটা নিচু করে চালাচ্ছে সাইকেল, বৃষ্টির ঝাঁপটা বাঁচাবার জন্য। ক্রমশ সে স্পীড বাড়াচ্ছে। সে বাতাস কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।
কালো কুচকুচে রাস্তা, দুপাশে আলো। সামনে যতদূর দেখা যায়, রাস্তাটায় কোনো বাঁক নেই, যেন সোজা চলে গেছে অসীমে। পথিক নেই একটিও, বৃষ্টির মধ্যে সাইকেলেও কেউ যাচ্ছে না এসময়, গাড়ির অবশ্য বিরাম নেই, বৃষ্টির শব্দ আর গাড়ির গতির শব্দ মিলে একটা অন্যরকম ঝংকার। অতীনের হঠাৎ মনে হলো, এটা কোন দেশ, এখানে সে কী করছে? এখানে তো তার থাকার কথা নয়। এখানে তার কোনো কাজ নেই, কোনো প্রতিষ্ঠা নেই, কোনো বন্ধু নেই। সে কি হাওয়ায় উড়ে আসা তুলোর বীজ? সে আর এক দণ্ডও এই বিদেশে থাকবে না, এই সাইকেল চালিয়েই সে সোজা চলে যাবে বন্দরে…
বিকট আওয়াজ করে একটা গাড়ি ব্রেক কষতেই অতীন সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে গেল। কখন যেন ভুল করে সে রাস্তার বাঁ দিকে লে এসেছিল। এই ভুলটা তার প্রায়ই হয়। এদেশের রাস্তায় ডান দিক দিয়ে সব গাড়ি চলে, সেটা অতীন এখনও রপ্ত করতে পারেনি।
রাস্তায় পড়ে যাওয়ার মুহূর্তেই অতীন ভাবলো, গাড়িটা কি তাকে এবার চাপা দেবে? তেলে দেবে শরীর? না, গাড়িটা থেমে গেছে। অতীন তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তার কি হাত কিংবা পা ভেঙেছে। চোখে চোট লেগেছে? না, কিছুই হয়নি। অতীন মজুমদারকে মারা অত সহজ নয়। স্বয়ং মৃতই যেন তাকে পাহারা দেয়।
গাড়ির চালকটি একটা কথাও বললো না। এটা প্রধানত ছাত্রদের শহর, এখানে সাইকেল আরোহীদের বিশেষ অধিকার আছে। সে এক নজরে অতীনকে সুস্থ অবস্থায় দেখে নিয়ে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল।
সাইকেলটা তুলে টাল ঠিক করলো অতীন। তার জামা-প্যান্ট সম্পূর্ণ ভেজা, রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিল একবার। এইরকম সময়ে একটা সাংঘাতিক একাকিত্ব বোধ হয়! সে সাইকেল থেকে পড়ে গেল, অথচ রাস্তার একটা লোকও তার কাছে এসে একটা কথা বললো না! অবশ্য সে যদি হাত ছড়িয়ে রাস্তাতেই শুয়ে থাকতো, তাহলে প্রায় ভোজবাজির মতনই হঠাৎ এসে উপস্থিত হতো একটা পুলিশের গাড়ি, তারপর একটা অ্যাম্বুলেন্স, অনেকগুলো মুখ ঝুঁকে আসতো তার কাছে।
শরীরে কোনো আঘাত না লাগলেও মনে একটা ধাক্কা লেগেছে, অতীন আবার বাস্তবে ফিরে এসেছে। সে বন্দরে যাবে না, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরবে। এখানেই তাকে থাকতে হবে আরও অন্তত দু’তিন বছর।
বাড়িতে পৌঁছে সে সাইকেলটা উঁচু করে তুলে এনেপর্চে রেখে তালা ছিল। অন্য কিছু চুরি গেলেও এখানে সাইকেল বেশ চুরি হয়। কে কার সাইকেল নিয়ে কখন চলে যাবে, কোনো ঠিক নেই। অতীন ঠিক করে রেখেছে, তার সাইকেলটা যদি হঠাৎ চুরি যায়, তা হলে সে আর নতুন সাইকেল না কিনে সেও ক্যামপাস থেকে অন্য কারুর সাইকেল তুলে নেবে।
আজও লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছে সোমেন। ঘাড় ফিরিয়ে সে উত্তেজিত ভাবে বললো, অতীনবাবু, এদিকে দেখবেন আসুন, চট করে আসুন!
সোমেনের সঙ্গে ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও বেশ আলাপ হয়েছে অতীনের। সোমেন অর্থনীতির ছাত্র, তার কথাবার্তাও বেশ গম্ভীর গম্ভীর হলেও সে বেশ ভালো গান করে। বিশেষত পল্লীগীতি। সেগুলো শুনতে অতীনের ভালো লাগে।
অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে বসে টিভি দেখা অতীনের পছন্দ নয়। এক একজন এক একরকম মন্তব্য করে, যা শুনলে কখনো কখনো গা জ্বলে যায়। তাছাড়া চ্যানেল নিয়ে মতভেদ হয়, অতীনের সি বি এস-এর অনুষ্ঠানগুলি বেশী পছন্দ, অন্যরা অনেকেই দেখতে চায় এন বি সি, কেউ কেউ দেখতে চায় স্থানীয় প্রোগ্রাম। দুপুরবেলা সুযোগ পেলে অতীন একা টিভি দেখে, সন্ধেবেলা সাধারণত এঘরে ঢোকে না। অন্য কেউ ডাকলেও সে এড়িয়ে যায়।
আজ সে সোমেনের ডাকে সাড়া দিল। এখন নিজের ঘরে গিয়ে একা থাকতে ইচ্ছে করছে না। সারাদিন সে প্রায় মুখ বুজে কাজ করছে, এখন সে একটু মানুষের সঙ্গ চায়।
ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অতীন ভাবলো, এরা কেউ জানে না যে মাত্র মিনিট দশেক আগে তার সাইকেল একটা গাড়ির সঙ্গে প্রায় ধাক্কা মেরেছিল। আর দু’এক সেকেণ্ড এদিক ওদিক হলেই তাকে যেতে হতো হাসপাতালে কিংবা মর্গে। চিরকালের জন্য হারিয়ে যেত অতীন মজুমদার। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে এত সূক্ষ্ম একটা সুতো। তাকে দেখে এরা কেউ বুঝতে পারবে না যে সে প্রায় পুনর্জীবন পেয়ে ফিরে এলো। এখন কারুকে কিছু বলারও মানে হয় না। শর্মিলাও কোনো কিছুই জানতে পারবে না। সেদিন ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে হঠাৎ কেন বদলে গেল শর্মিলা?
সোমেন বললো, শিগগির এসে বসুন, একটা দারুণ ব্যাপার দেখাচ্ছে।
সোমেন ছাড়াও ঘরের মধ্যে রয়েছে সুরেশ আর তার বান্ধবী তিন্নি। আর আবিদ হোসেন। অতীন একটা চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। বাড়িওয়ালা উপস্থিত নেই, সুতরাং এখানে বসে অনায়াসে সিগারেট খাওয়া যায়।
সাড়ে আটটায় টক শো। জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। রয় রবসন নামে একজন অতি বুদ্ধিমান সুবক্তা, প্রতিটি অনুষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে একজন কারুকে বেছে নিয়ে আসে, তারপর তাকে নানান প্রশ্ন করে তার জীবনকাহিনীটা সবার সামনে তুলে ধরে। প্রশ্ন করার গুণে প্রতিটি জীবনকাহিনীই মনে হয় এক একটা রোমাঞ্চকর গল্প।
সোমেন ফিসফিস করে বললো, আজ রয় রবসন যে ‘অতিথি’-কে নিয়ে এসেছে তার নাম পল গ্রে। এই লোকটা জাহাজী ইঞ্জিনিয়ার, জাহাজে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। দু’মাস ওদের জাহাজ চিটাগাং-এ আটকা পড়েছিল। এই সবে শুরু হলো…
রয় রবসন : মিঃ গ্রে, আপনি যে-জাহাজে কাজ করেন, সেই জাহাজ কী ধরনের মালপত্র নিয়ে যায়?
পল গ্রে : নানা ধরনের মালপত্র, কখনো কোনো মেশিন, তারপর গাড়ি, ইয়ে, বিমানের যন্ত্রাংশ।
রয় রবসন : আপনাদের এই জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয় নিশ্চয়ই?
পল গ্রে : হ্যাঁ, কিছু কিছু হালকা ধরনের অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
রয় রবসন : কী ধরনের হালকা অস্ত্র?
পল গ্রে : সেটা বলা নিষেধ।
রয় রবসন : এবারে আপনাদের যে-জাহাজ চিটাগাং পোর্টে গিয়ে আটকে ছিল, সেটাতেও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল নিশ্চয়ই।
পল গ্রে : না, না, এবারের মালপত্র ছিল শুধু খাদ্য। শুধু গম।
রয় রবসন : গম বোঝাই জাহাজ! ও! চিটাগাং পোর্টে আপনাদের কতদিন আটকে থাকতে। হয়েছিল?
পল গ্রে : প্রায় তিন সপ্তাহ। মাল খালাস হচ্ছিল না, আমরা অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। রয় রবসন : মাল খালাস হতে দেরি হচ্ছিল কেন?
পল গ্রে : সেখানে কিছু একটা গোলমাল চলছিল, এক ধরনের বিদ্রোহ। আপনি জানেন কি না জানি না। পাকিস্তানে দুটি জাতি আছে। একটি পাকিস্তানী, আর একটি বাঙালী। এই দুই জাতির মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল।
রয় রবসন : বাঙালীরাও পাকিস্তানী। মনে করুন, আমাদের এখানেও অনেক ইতালিয়ান বা গ্রীক অরিজিনের লোক আছে। কিন্তু তারাও তো আমেরিকান তাই না? আপনি বলতে চাইছেন, সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের লড়াই চলছিল।
পল গ্রে : অনেকটা বই।
রয় রবসন : আপনারা জাহাজ ভর্তি অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করবার জন্য।
পল গ্রে : না, না, না, আমরা গম নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা তো গরিব, ওরা খেতে পায় না, তাই আমরা গম দিয়ে সাহায্য করি।
রয় রবসন : তাহলে গম খালাস করতে দেরি হচ্ছিল কেন? ক্ষুধার্ত লোকেরা তো যত তাড়াতাড়ি খাবার পাবে, ততই খুশি হবে।
পল গ্রে : হয়তো সৈন্যবাহিনী চাইছিল, সাধারণ মানুষকে না খাইয়ে রেখে জব্দ করতে। আমরা প্রথম কয়েকদিন বন্দুক ও কামানের গোলাগুলির শব্দ পেয়েছি। তারপর সব থেমে গেল। কিন্তু মাল খালাস করার জন্য বন্দরে কোনো কুলি ছিল না। বন্দর একেবারে জনমানবশূন্য ছিল।
রয় রবসন : আপনারা কি তাহলে দিনের পর দিন জাহাজে বসে থাকতেন?
পল গ্রে : মাঝে মাঝে আমরা শহরে যেতাম। অবশ্য চিটাগাং ক্লাব ছাড়া ওই শহরে আর কোনো ভালো পানাহারের জায়গা নেই, বাধ্য হয়েই যেতাম সেখানে।
রয় রবসন : মিঃ গ্রে, চিটাগাঙে এই প্রথমবার গেলেন আপনি?
পল গ্রে : না, এই নিয়ে তৃতীয়বার, প্রত্যেকবারই ঐ চিটাগাং ক্লাবে গেছি। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও হয়ে গিয়েছিল।
রয় রবসন : যাদের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোনো বাঙালী ছিল?
পল গ্রে : আগের দু’বার কয়েকজন বাঙালীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কিন্তু এবার তাদের দেখিনি। আমি একজন আর্মি ক্যাপটেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মিঃ হামিদ কোথায়? ক্যাপটেনটি ঘৃণায় নাক কুঁচকে বললো, হামিদ? সে তো একটা বেজন্মা বাঙালী! তার নাম আর উচ্চারণ করো না। ভবিষ্যতে এই চিটাগাং ক্লাবে কোনো কুকুর কিংবা বাঙালীকে ঢুকতে দেওয়া হবে না! যদিও সেই ক্লাব প্রাঙ্গণে কয়েকটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আপনি জানেন কি না জানি না, মিঃ রবসন। প্রাচ্য দেশের যে কোনো শহরেই রাস্তায় অনেক কুকুর ঘুরে বেড়ায়। তারা বড় বড় হোটেল এবং ক্লাবেও ঢুকে পড়ে।
রয় রবসন : খুবই কৌতূহলজনক, খুবই কৌতূহলজনক। আপনি চিটাগাং ক্লাবে কুকুর দেখেছেন, কিন্তু বাঙালী দেখেননি। চিটাগাং তো দেখছি বেঙ্গল-এরই একটি শহর? সানফ্রান্সিসকোর কোনো ক্লাবে সানফ্রান্সিসকোর কোনো অধিবাসী ঢুকতে পারে না, এরকম কি হতে পারে?
পল গ্রে : প্রাচ্য দেশে এরকম হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়াতে এরকম হয়। এমনকি আমাদের ফ্লোরিডার অনেক ক্লাবেও ফ্লোরিডার কালো মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয় না!
রয় রবসন : বাঙালীরা কি কালো?
পল গ্রে : পাকিস্তানী ও বাঙালীদের মধ্যে আমি গাত্রবর্ণের কোনো তফাত বুঝতে পারিনি। তবে বাঙালীদের ওপর ঐ পাকিস্তানীদের খুবই রাগ। সেই ক্যাপটেন বলেছিল যে, এরপর আর কোনো বাঙালীকে গাড়ি চড়তেও দেওয়া হবে না। যাদের গাড়ি আছে, সেইসব পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে। আর প্রত্যেক পাকিস্তানী সৈন্য একজন করে বাঙালী মেয়েকে রক্ষিত রাখবে।
রয় রবসন : ওরা বাঙালী পুরুষদের ঘৃণা করে আর বাঙালী মেয়েদের পছন্দ করে?
পল গ্রে : হয়তো তাই। ক্যাপটেনটি অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়েছিল। বাঙালীদের সংখ্যা নাবি পাকিস্তানীদের চেয়ে কিছুটা বেশি। এরা কিছু বাঙালীকে মেরে ফেলবে, আর বাঙালী রক্ষিতাদের গর্ভে যে সন্তান জন্মাবে তারাও হবে পাকিস্তানী।
রয় রবসন : তোমার সঙ্গে কোনো বাঙালীর কোনো কথাই হয়নি এবারে?
পল গ্রে : না, কোনো বাঙালীকে দেখতে পাইনি। তারা ভয় পেয়ে পালিয়েছিল। কিছু বাঙালী শহরের বাইরে থেকে লড়াই করছিল।
রয় রবসন : তোমার সঙ্গে শুধু পাকিস্তানী আর্মির লোকেদেরই কথা হয়েছে। কী করে জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করা যায়, সেই ব্যাপারে তারা আলোচনা করেছিল?
পল গ্রে : না, না, অস্ত্র-শস্ত্র নয়, গম। তাছাড়া মাল খালাসের ব্যাপারে তারা জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে আলোচনা করবে, আমার সে দায়িত্ব নয়।
রয় রবসন : ওখানে যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে, তার কোনো নমুনা তুমি নিজের চোখে দেখেছো?
পল গ্রে : একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। আমি তখন বন্দর থেকে চিটাগাং ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম। এক জায়গায় দেখি একটি ব্যারাকবাড়ির দেওয়ালের দিকে মুখ করে দশ বারো জন লোককে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনলাম তারা বিদ্রোহী পুলিশ। তাদের গুলি করে মারা। হলো, আমি তার একটা ছবিও তুলেছি।
পর্দায় ভেসে উঠলো সেই ছবি। লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে রোগা রোগা কয়েকজন মানুষ, তাদের কোনোক্রমেই পুলিশ বলে মনে হয় না। পেছন ফিরে হাত তোলা অবস্থায় গুলি খেয়ে তারা যখন পড়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ছবিটি তোলা।
আমেরিকান টিভিতে নিরুপদ্রবে কোনো অনুষ্ঠান দেখার উপায় নেই। বিশেষ বিশেষ আগ্রহের মুহূর্তেই অনুষ্ঠান থামিয়ে দিয়ে শুরু হয়ে যায় বিজ্ঞাপনমালা।
ওরা এতক্ষণ প্রায় নির্বাক হয়ে দেখছিল, এবার তিন্নি বললো, এই বীভৎস দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারি না।
সুরেশ বললো, এটা একজন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আমেরিকান টিভি-তে এটা দেখাচ্ছে সেটাই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। আমেরিকা তো পাকিস্তানী আর্মির এক নম্বর সাপোর্টরি। ঐ যে রয় রবসন ইঙ্গিত করছিল না, জাহাজটায় গম আছে না অস্ত্র আছে, আসলে আমেরিকান অস্ত্র নিয়েই তো ওরা লড়ছে।
ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে তিন্নি বললো, আমি আর দেখবো না। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
সুরেশ তাকে এগিয়ে দিতে গেল।
আবিদ হোসেন থুতনিতে হাত দিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিন-চারদিন আগেও সে পাকিস্তানের সমর্থনে তুমুল তর্ক করেছে সোমেনের সঙ্গে। তার মতে শেখ মুজিব একজন দেশদ্রোহী।
সোমেন জিজ্ঞেস করলো, আবিদ সাহেব, এবার আপনার বিশ্বাস হলো কী? নাকি, আপনি মনে করেন, পুরো প্রোগ্রামটাই ককটেড?
আবিদ হোসেন ফিসফিস করে বললো, চিটাগাং ক্লাবে কোনো বাঙ্গালী ঢোকে না? আমার ফাদার ঐ ক্লাবের সেক্রেটারি। তিনি কিছু জানান নাই।
–ক’দিন আগে তাঁর চিঠি পেয়েছেন? ২০৪
উত্তর না দিয়ে আবিদ হোসেন স্থির ভাবে চেয়ে রইলো সোমেনের দিকে। তার মুখে ছায়া ঘনিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম সম্পর্কে বেশ কয়েকটা খবর বেরিয়েছে সংবাদপত্রে, এখন শোনা গেল একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। রয় রবসনের অনুষ্ঠানে কেউ মিথ্যে কথা বলে পার পায় না।
অতীন চুপ করে বসে আছে। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট মতামত গড়ে ওঠেনি তার মনে। এটা উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে স্বৈরাচাবীদের সংঘর্ষ, এর মধ্যে কোনো পক্ষকেই সমর্থন করা যায় না। কিন্ত শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষ প্রাণ দিচ্ছে, এটাও অস্বীকার করা যায় না। আমেরিকান টিভি চ্যানেল গুলো বেসরকারী, এরা আমেরিকান সরকারের নীতি মানতে বাধ্য নয়, এরা অনেক সময় সত্যি খবর দেয়। এমন কি ভিয়েৎনামে আমেরিকান সৈন্যদের বদমায়েশীর অনেক চমকপ্রদ তথ্যও টিভিতে দেখা যায়।
সে শুকনো গলায় সোমেনকে জিজ্ঞেস করলো, এরা অনেকদিন ইণ্ডিয়ার খবর দেয় না, এরা ইণ্ডিয়াকে অ্যাভয়েড করে, তাই না?
সোমেন উত্তেজিত ভাবে বললো, কালকেই তো একটা সাঙ্ঘাতিক খবর দিয়েছে, আপনি দেখেন নি? কলকাতার খবর! দমদমে জেল ব্রেক। রিসেন্ট টাইমসে এত বড় জেল-ব্রেক আর হয়নি! দমদম জেলে নকশাল বন্দীদের সঙ্গে গার্ডদের লড়াই। নকশালীরা প্রচুর আর্মর্স-অ্যামুনিশান স্মাগল করে এনেছিল জেলের মধ্যে, ভেবে দেখুন, ওরা জেলের মধ্যে বোম চার্জ করেছে, প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে দু’পক্ষ গুলি বিনিময় করেছে, খবরে বললো যে ১৫টি ৭শাল ছেলে মারা গেছে আর ৩২ জন পালাতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত!
অতীনের সমস্ত শরীরটা কাঁপতে লাগলো। মাথায় যেন এক শো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। এরকম একটা সংবাদের ধাক্কা সে সামলাতে পারছে না। কোনোক্রমে সে বললো, ১৫ জন মারা গেছে?
সোমেন বললো, জেলের ভেতরের একটা ছবিও দেখিয়েছে। কী করে এরা এইসব ছবি পায় কে জানে! ডেড বড়ির ছবি। অবশ্য কতজন গার্ড মারা গেছে সে কথা বলেনি।
–মৃতদের নাম বলেছে?
–না, নাম বলেনি! আজকের নিউ ইয়র্ক টাইমসেও ছোট করে খবরটা বেরিয়েছে। আজকের পেপারে আরও একটা বড় খবর আছে, লক্ষ করেন নি? ইন্দিরা গান্ধী ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো ন্যাশনালাইজ করেছে। এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্টেপ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মন্তব্য করেছে যে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পুরোপুরি সোভিয়েত ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নিকসন এখনো তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
অতীনের আর কিছু শোনার মতন অবস্থা নেই। সে ঘোর লাগা মানুষের মতন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ১৫ জন নিহত। মানিকদা, কৌশিক, পমপম, তপন, অরিন্দম, এরা কি কেউ ছিল তার মধ্যে? অনেকদিন ওদের কোনো খবর জানে না অতীন!
যুদ্ধ এখনও চলছে। তার বন্ধুরা হার মানেনি। জেলের দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকতে তারা রাজি নয়, জেল ভেঙে বেরিয়ে আসছে, বাইরে এসে সঙঘবদ্ধ হয়ে তারা আবার শোষকশ্রেণীকে আঘাত হানবে!
আর সে কী করছে, সে আমেরিকায় বসে আছে? সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ধনতন্ত্রী এই দেশটির বিরুদ্ধেই তাদের প্রধান আক্রোশ, আর সে এই দেশেরই টাকায় খাচ্ছে, পরছে, ঘুরে। বেড়াচ্ছে।
দু’তিন ধাপ সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে অতীন উঠে এলো নিজের ঘরে। আর একদিনও একা থাকা চলে না। তাকে ফিরে যেতেই হবে, তারপর যা হয় হোক! ওয়ার্ডরোব থেকে সে সুটকেসটা টেনে বার করলো। খুব প্রয়োজনীয় জিনিস কটা গুছিয়ে নিতে হবে শুধু! ১৫ জন মারা গেছে! কে কে আছে তাদের মধ্যে? মানিকদা, কৌশিকদের যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়?
দরকারি কয়েকটা বই ও জামা কাপড় উত্তেজনা বশে সুটকেসে ভরতে ভরতেই তার মনে হলো, টিকিট কাটতে হবে, টাকাটা কোথায় পাওয়া যাবে? এ তো হাঁটা পথ নয়, মাঝখানে রয়েছে দুটো মহা সমুদ্র!
টাকা, অনেক টাকার ব্যাপার! কে দেবে তাকে সেই টাকা?
তাকে ফিরে যেতেই হবে, যে-কোনো উপায়ে!
জাহাজ-ফাহাজে আজকাল কেউ যায় না। প্যাসেঞ্জার লাইনারগুলো উঠে গেছে। যেতে হবে প্লেনেই। অত টাকা কোথায় পাওয়া যায়? কে ধার দিতে পারে?
এখানকার ব্যাঙ্ক টাকা ধার দেয়। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদেরও দেয়। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু অতীনের নতুন অ্যাকাউন্ট, মাত্র দশ বারো ডলার পড়ে আছে, তাকে দেবে না, শর্মিলা পেতে পারে। শর্মিলার মামা এখানে বড় চাকরি করেন, তিনি গ্যারান্টার হলে কোনো অসুবিধেই নেই। শর্মিলা? শর্মিলা তো অতীনের কেউ নয়। সে অতীনকে সহ্য করতে পারে না বলে ওয়াশিংটন ডি সি-তে পালিয়ে গেছে। শর্মিলার সঙ্গে এই ঘরে, এই বিছানায় সে রাত্রি কাটিয়েছে, শর্মিলা নিশ্চয়ই সেই স্মৃতিও মুছে ফেলতে চায়!
আর কে ধার দিতে পারে?
অতীনের হঠাৎ পাঁচুদার কথা মনে পড়লো। স্বল্পভাষী পাঁচুদাকে দেখলেই যেন একটা আস্থা। পাওয়া যায়। পাঁচুদা অতীনের মনের অবস্থাটা নিশ্চয়ই বুঝবেন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে অতীন এখানে আর কিছুদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবে! জেলখানায় তার ১৫ জন বন্ধু মারা গেছে, আর সে এখানে বসে ডিগ্রি অর্জনের বিলাসিতা করবে? আমেরিকান ডিগ্রির মুখে লাথি!
কিন্তু, পাঁচুদার সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নেই, মাত্র অল্প দিনের পরিচয়, তার কাছে কি মুখ ফুটে অতগুলো টাকা ধার চাওয়া যায়? ধার মানে কি, অতীন জীবনে কি কখনো তিন-চার হাজার ডলার শোধ দিতে পারবে? পাঁচুদার কাছে চাইবার পর তিনি যদি না বলেন, শান্তা বৌদিও খুব ভালো, কিন্তু তিনি যদি বলেন, আমাদের ভাই বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তার মধ্যে টাকা পয়সার কথা এনো না! প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারে না অতীন!
সিদ্ধার্থ, সিদ্ধার্থ দিতে পারে। সিদ্ধার্থ নতুন গাড়ি কিনেছে, অন্য অ্যাপার্টমেন্টে গেছে, ওর হাতে এখন বিশেষ পয়সা নেই, কিন্তু অফিস থেকে কিংবা ব্যাঙ্ক থেকে যোগাড় করে দেওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। ওর এক পাঞ্জাবী বন্ধুর ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে, তার কাছ থেকে বাকিতে একটা টিকিট যোগাড় করে দিতে পারবে না?
অতীনকে দেশে ফিরে যেতেই হবে।
সে খালি পায়ে তরতর করে নেমে এলো নিচে। লিভিং রুম এখন ফাঁকা, সবাই যে-যার ঘরে চলে গেছে। অতি ব্যস্তভাবে অতীন সিদ্ধার্থকে ফোন করলো। সিদ্ধার্থ বাড়িতে না থাকলেই মুশকিল।
কয়েকবার রিং হবার পর সিদ্ধার্থ এসে ফোন ধরলো। অতীনের গলা শুনে সে বেশ বিরক্তভরে বললো, তুই কি ফোন করার আর সময় পেলি না? আমি একজনকে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিলুম। তুই নিজে তো কবিতা টবিতা।
অতীন তাকে বাধা দিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললো, সিদ্ধার্থ আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। কালকেই।
সিদ্ধার্থ বললো, দেশে ফিরতে চাস! দেশ কি মামারবাড়ি নাকি? যখন ইচ্ছে যাওয়া যায়?
–সিদ্ধার্থ, আমাকে যেতেই হবে! আমাকে যেতেই হবে, আমি আর একদিনও থাকতে চাই! আমি ডিগ্রি-ফিগ্রি কিছু চাই না! এই ক্যাপিটলিস্টদের দেশে আমার অসহ্য লাগছে!
–গাধার মতন চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? আস্তে বলা যায় না? আমার কান ফেটে যাচ্ছে।
–তুই শুনেছিস, দমদম জেলে ওরা ১৫ জন নকশালকে গুলি করে মেরে ফেলেছে? টিভিতে বলেছে। কাগজে বেরিয়েছে।
–হ্যাঁ, আমি টিভিতে শুনেছি।
–তারপরেও তুই বলতে চাস, আমি এদেশে পড়ে থাকবো? আমি কি মানুষ না? তুই বুঝতে পারছিস না…
–আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। তোর বিবেক দংশন হচ্ছে। বিবেক থাকলেই তাতে মাঝে মাঝে দংশন হবে। তুই এক কাজ কর, আজ স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমো। তারপর স্বপ্নে দেশে ফিরে যা। আমি তো স্বপ্নে এরকম কত বার যাওয়া আসা করি।
–ঠাট্টা নয়রে, সিদ্ধার্থ। আমি যাবোই ঠিক করেছি। তুই আমার টিকিটের টাকাটা ধার দিবি?
–দিবি না! তোকে আমি শোধ করে দেবো, যে কোনো উপায়ে হোক। আমি মরে গেলেও তুই টাকাটা পাবি। তুই আমার একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দে।
–স্যরি ওল্ড চ্যাপ! টাকা ফাঁকা আমি দিতে পারবো না।
–সিদ্ধার্থ, আই বিসিচ ইউ, প্লীজ, তুই আমার এই লাস্ট উপকারটা কর।
–অতীন, টাকা ফাঁকার কথা আমার কাছে আর উচ্চারণ করিস না। রাত দশটার পর টাকা। কথাটাই আমার কাছে অশ্লীল বলে মনে হয়!
–চশমখোর, আমি এত করে বলছি, তুই আমাকে এই টাকাটা দিবি না! এটা আমার জীবন মরণ প্রশ্ন!
–আমি চশমখোর তো বটেই। আমি চেনাশুনো সবাইকে টেলিফোন করে বলে দেবো! কেউ যেন ভুল করেও তোকে টিকিট কাটার টাকাটা না দেয়!
–আমি ফিরতে চাইলে কে আমাকে আটকাবে?
–হনুমানের মতন লাফিয়ে সমুদ্র পার হয়ে যা! তারপর কলকাতায় গেলেই তাকে পুলিশ ক্যাঁক করে ধরবে! তোর নামে এখনও ওয়ারেন্ট ঝুলছে, তা কি আমি জানি না? সেন্টিমেন্টাল ফুলের মতন তুই দেশে ফিরে গেলেই ধরা পড়বি, আবার জেলে যাবি, হয়তো ঐ ১৫ জনের মতন তুইও গুলি খেয়ে মরবি। তাতে বিপ্লবের কী উপকারটা হবে শুনি?
–আমি ধরা পড়বো না! আমি সোজা কলকাতায় না গিয়ে দিল্লিতে নেমে, তারপর সেখান থেকে এ
–দিল্লিতে বুঝি পুলিশ নেই? ধরা তুই পড়বিই।
–শোন, সিদ্ধার্থ—
–আমার আর এসব আজে বাজে কথা শোনার সময় নেই! আমি ব্যস্ত আছি! কট করে সিদ্ধার্থ লাইন কেটে দিল। কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো অতীন। খাঁচায় বন্দী পশুর ছবিটা ফিরে এলো তার কাছে। কোনো উপায় নেই, ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। মানিকদা, কৌশিক পমপমরা তাকে কাপুরুষ, পলাতক ভাবছে!
বহুদিন বাদে অতীনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো। অসম্ভব এক নিমর্ম একাকিত্ব যেন শক্ত দড়ির মতন হাত-পা পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছে। সে শিশুর মতন দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বলতে লাগলো, মা, মা, মা।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। সারা বাড়িতে কোনো শব্দ নেই। যানবাহন হাল্কা হয়ে এসেছে রাস্তায়। অতীন এক সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। খালি পা, গেঞ্জি গায়ে। কালো রঙের রাস্তাটার মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। কোনো গাড়ি তাকে চাপা দেবে না, সে। জানে। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু নেই। কিন্তু অসুখ-বিসুখও কি তার হতে পারে না? আজ সে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজবে এখানে দাঁড়িয়ে।