বিম্ববতীর কক্ষে একদিন বিধুশেখর গঙ্গানারায়ণ এবং নবীনকুমারকে ডেকে পরলোকগত রামকমল সিংহের উইল পাঠ করে শোনালেন। নবীনকুমারের বয়েস মাত্র ছয়, সে উইলের ভাষা কিছুই বুঝবে না, আর গঙ্গানারায়ণেরও যেন বিষয়সম্পত্তি, টাকা-পয়সা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই।
বিধুশেখর জোর করে বিন্দুবাসিনীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেবার পর থেকেই গঙ্গানারায়ণ একদিকে যেমন দারুণ অনুতাপানিলে দগ্ধ হচ্ছে অন্যদিকে সারা বিশ্ব সংসারের প্রতিও একটা বিরাগ জন্মে গেছে তার। এতকাল সে বিধুশেখরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে, সে শ্রদ্ধা এখন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, এখন সে বিধুশেখরের মুখের দিকে ভালো করে চাইতেও পারে না।
কালাশৌচ পার হয়ে গেলেও গঙ্গানারায়ণ এখনো সেলাই করা বস্ত্র পরিধান করে না। গায়ে একটি তসরের চাদর জড়ানো, সে উদাসীন মুখে বসলো ঘরের মেঝেতে, হাঁটুর ওপর থুতনিটা স্থাপন করা। কিছু বুকুক না বুকুক, নবীনকুমার গম্ভীরভাবে বাবু হয়ে বসে আছে মায়ের পাশে, তার অত্যুজ্বল চোখ দুটি বিধুশেখরের দিকে স্থির। গঙ্গানারায়ণ ও নবীনকুমার দুজনেই মস্তক মুণ্ডন করেছে, গঙ্গানারায়ণের মস্তক নগ্ন, আর নবীনকুমার পরেছে একটি লাল মলমলের টুপী।
গলা খাঁকারি দিয়ে বিধুশেখর প্রথমে গঙ্গানারায়ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, গঙ্গা, তোমাকে একটি জরুরি কথা আজ জানানো প্রয়োজন। এতদিন এ কথা গোপন ছিল, কিন্তু এখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে, যথেষ্ট বিদ্যাবুদ্ধি আয়ত্ত করেছে, এখন আর গোপন রাখার কোনো কারণ দেখি না। তুমি রামকমল সিংহের ঔরসজাত পুত্র নও, বিম্ববতী তোমার গর্ভধারিণী জননী নন। তবে, এরা দুজনেই তোমাকে এত মোহ করেচেন যে আপন পিতামাতাও অনেক সময় এতখানি করে না। রামকমল দীর্ঘকাল অপুত্ৰক ছিলেন, সেই অবস্থায় দত্তক নিয়েছিলেন তোমাকে। এই বংশের রক্ত বহন করচে নবীনকুমার।
বিধুশেখর চকিতে একবার তাকালেন বিম্ববতীর দিকে। বিম্ববতীর মাথায় অনেকখানি ঘোমটা, তাঁর মুখ দেখা যায় না।
গঙ্গানারায়ণ মাটির দিকে চক্ষু রেখে চুপ করে রইলো। বিধুশেখর যা বললেন, সে তথ্য তার অজানা নয়। এসব কথা গোপন থাকে না। নিজের বাবা কিংবা মা সম্পর্কে গঙ্গানারায়ণের সামান্যতম স্মৃতিও নেই, জ্ঞান-উন্মেষের পর থেকে সে রামকমল এবং বিম্ববতীকেই পিতামাতা বলে জেনে এসেছে। কিন্তু নবীনকুমার জন্মাবার পর দাস-দাসী, স্বজন-পরিজনরা আকারে ইঙ্গিতে তাকে জানিয়ে দিয়েছে তার আসল পরিচয়। তাতে কিন্তু গঙ্গানারায়ণের বড় কোনো আঘাত লাগেনি, কারণ তার তো কোনো অভাব-বোধ ছিল না। নবীনকুমার জন্মাবার পরও বিম্ববতী এবং রামকমল তার সঙ্গে আগের মতই সমান স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করেছেন। বিম্ববতীকে সে নিজের মা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না।
বিধুশেখর বললেন, একথাগুলিন আজ তোমার বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন এই জন্য যে রামকমলের উইলে তোমার আর নবীনের ভাগে কিছু ব্যাসকম রয়েচে। পাচে তুমি দুঃখ পাও তাই তোমাকে আগে থেকেই প্ৰস্তুত করে দিলুম। বস্তুত এ পরামর্শ রামকমলকে আমিই দিয়েচি। দত্তক গ্ৰহণ করার পর যদি নিজের ধর্মপত্নীর গর্ভে সন্তান জন্মায়, তবে সেই সন্তান বিষয়-সম্পত্তির মুখ্যভাগের অধিকারী হবে এটাই কৌলিক প্রথা।
গঙ্গানারায়ণ এবার ধীর স্বরে বললো, আপনি সবকিছুই নবীনকুমারকে দিন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সে আমার ভাই, আমি আমার সবকিচু তাকেই দিতে চাই।
বিম্ববতী গঙ্গানারায়ণের বাহু ছয়ে মৃদুভাবে ডাকলেন, গঙ্গা!
গঙ্গানারায়ণ বিম্ববতীর পায়ে হাত রেখে বললো, মা—
শুধু এই দুটি ডাক, এছাড়া কেউই আর কোনো কথা বললো না।
বিধুশেখর এই ধরনের হাদিক আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্ব দেন না। তিনি আবার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করে বললেন, যাক, আগে উইলটি পাঠ করে শোনাই—শ্ৰীশ্ৰীদুর্গা শরণং উইল পত্ৰমিদং কার্যঞ্চ আপন জ্ঞানপূর্বক ও স্বেচ্ছাধীন এই উইল করিতেছি আমার পৈতৃক দৌলত শ্ৰীশ্ৰীঠাকুর ও জায়গা ও বাটী ও এলবাস পোষাক তাঁবা পিতল কাসার ও রূপা সোনার বাসন গহনাদি যাহা কিছু ইহার পঞ্চভাগের এক ভাগ আমার বিধবা অপুত্ৰক ভ্ৰাতৃজায়া হেমাঙ্গিনী দেব্যা পাইবেক অপর চারি অংশ আমার উত্তরাধিকারীতে বতাইবে আমার স্বেপার্জিত দৌলত ও সোনা রূপার বাসন ও গহনাদি ধর্মতলার বাটী বহুবাজারের বাটিদ্বয়—বিরাজিতলাওয়ের জমি ৫ বিঘা শহর কলিকাতার মধ্যে খরিদা জায়গা জেলা যশোহরের মোতালক পরগণে খালিসপুর জমিদারী কটকের তালুক হুগলীর জমিদারী…
উইলটি খুব দীর্ঘ নয়। দেখা গেল রামকমল সিংহ সাতটি পরগণায় জমিদারী ও তালুক, কলকাতায় মোট সাতখানি বাড়ি ও বেশ কয়েক বিঘা জমি, তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, বন্ধকী কারবারে নিযুক্ত সাড়ে সাত লক্ষ টাকা, একখানি জাহাজ, দুটি বৃহৎ কয়লা খনি, দশ লক্ষ টাকার সোনা জহরৎ, তিনজন সাহেবের কাছে ঋণ বাবদ প্ৰাপ্য সাড়ে ছ হাজার গিনি ইত্যাদি রেখে গেছেন। এর মধ্যে থেকে দান করা হয়েছে দাস-দাসী, পাইক-গোমস্তাদের বেতনের টাকা প্ৰতি এক শত টাকা, অর্থাৎ যার বেতন পাঁচ টাকা সে পাবে পাঁচশত টাকা, প্রধান গোমস্তা দিবাকর পাবে বেতনের টাকা প্ৰতি দুই শত টাকা, আশ্রিতদের জন্য কিছু কিছু মাসোহারা, পৈতৃক গ্রামে দেব মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বার্ষিক দুই শত টাকা, সংস্কৃত কলেজের দুটি উৎকৃষ্ট ছাত্রকে প্রতি বৎসর বৃত্তির জন্য পাঁচ হাজার টাকা জমা ইত্যাদি।
এই সমুদয় সম্পত্তির মধ্যে শুধু একটি পরগণার জমিদারী ও কলকাতার বউবাজারের একটিমাত্র বাড়ি দেওয়া হয়েছে গঙ্গানারায়ণকে,বাকি সবই নবীনকুমারের। শিশু নবীনকুমার সেই মুহূর্তে অতুল বৈভবের অধিকারী হয়ে গেল।
গঙ্গানারায়ণের দৃষ্টি মাটির দিকে, তবু তার চক্ষু জ্বালা করে উঠলো, বুক ভরে গেল প্ৰচণ্ড অভিমানে। অতিকষ্টে অশু সামলাতে সামলাতে সে অবাক হয়ে উঠলো। কেন এই অভিমান, তার তো বিষয় সম্পদে সত্যিই লোভ নেই? তার নিজের যথেষ্ট যোগ্যতা রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের নীতির পরিবর্তন হয়েছে, তারা এখন হিন্দু কলেজের ভালো ছাত্রদের ডেকে ডেকে ডেপুটি কালেকটরের চাকরি দিচ্ছে, গঙ্গানারায়ণের বেশ কয়েকজন বন্ধু সে রকম চাকরি পেয়ে সুখী। গঙ্গানারায়ণ যে-কোনো সময় ইচ্ছে করলেই সে রকম কাজ পেতে পারে। তবু কেন অভিমান? গঙ্গানারায়ণের শুধু মনে হচ্ছে, তাহলে কি রামকমল সিংহ তাকে আর ভালোবাসতেন না? যত স্নেহ দেখাতেন, তা সবই ভান? আশ্রিত পরিজনদের চেয়ে তাকে সামান্য বেশী কিছু দান করেই তিনি কর্তব্য সেরেছেন। এর বদলে রামকমল তাকে কিছুই না দিলে পারতেন।
অতটুকু ছেলে নবীনকুমার, তবু তার বেশ আমি তুমি জ্ঞান হয়েছে। বিধুশেখরের সব কথা সুযোগ দিয়ে শুন সে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলো, কার বেশী। দাদামণির বেশী না আমার বেশী?
বিধুশেখর বললেন, তোমার!
অমনি নবীনকুমার হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, আমার বেশী! আমার বেশী! দাদামণি হেরে গ্যাচে!
বিম্ববতী তাকে থামিয়ে দিয়ে বিধুশেখরকে প্রশ্ন করলেন, এ কোন উইল? এ উইলের কথা তো আমি কিছুই জানিনি। আগে তো অন্যরকম ছেল!
বিধুশেখর বললেন, মাত্র গত মাসেই রামকমল উইল বদল করেচেন। তোমাকে জানানোর কথা তার মনে আসেনি বোধহয়।
গঙ্গানারায়ণ রোষকশায়িত নেত্ৰে বিধুশেখরের দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারলো, এ সমস্তই বিধুশেখরের কারসাজি। আপনাভোলা রামকমলকে দিয়ে বিধুশেখর যা খুশী করিয়ে নিতে পারেন। বিধুশেখর এক সময় গঙ্গানারায়ণকে বেশ ভালোই বাসতেন, কিন্তু বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে সেই ঘটনার পর গঙ্গানারায়ণ বিধুশেখরের স্নেহ থেকে পতিত হয়েছে। বিধুশেখর কঠিন মানুষ, গঙ্গানারায়ণকে বঞ্চিত করে। এইভাবে তিনি শাস্তি দিলেন।
গঙ্গানারায়ণ ক্রোধের সঙ্গে বলতে যাচ্ছিল, এই উইল আমি মানি না, কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। বিধুশেখর দক্ষ আইনজ্ঞ, তিনি কোনো কাঁচা কাজ করবেন না।
গঙ্গানারায়ণ বিম্ববতীর দিকে চেয়ে বললেন, মা আমার কিছুই চাই না। সবকিছুই নবীনকুমারের হোক। আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
বিম্ববতী কেঁদে ফেললেন। গঙ্গানারায়ণের মাথায় হাত রেখে মর্ম-নিঙড়ানো কণ্ঠে বললেন, গঙ্গা, তুই কোথাও চলে গেলে আমি মাথা কুটে মরবো। তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। উইলে যা-ই লেকা থাক, সব সম্পত্তি তোদের দু জনের সমান থাকবে। তুই বড় ভাই, তুই-তো নবীনের মাথার ওপর থাকবি।
বিধুশেখর বললেন, বৌঠান, দিন কখনো সমান যায় না। বিষয় সম্পত্তি ছেলেখেলার বস্তু নয়। রামকমল বুঝেশুনেই উচিত ব্যবস্থা করে গ্যাচে। আমার মনে হয়, উইলে যেমন আছে, সেই অনুসারে গঙ্গানারায়ণের বিষয় ভাগ করে দেওয়াই কর্তব্য।
লজ্জাশীলা, মৃদুভাষিণী বিম্ববতী এই প্রথম বিধুশেখরের কথার প্রতিবাদ করে দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, না। আমি যতদিন বেঁচে রয়িচি, গঙ্গা আমার কাচেই থাকবে। নবীন নাবালক, তার বিষয় দেকাশুনো করবে কে?
বিধুশেখর বললেন, তুমি আর আমি। উইলে সেই রকমই লেখা রয়েচে।
বিম্ববতী বললেন, আমার হয়ে গঙ্গাই দোকবে সবকিচু। এটা আপনি কাগজে লেখাপড়া করে নিন। গঙ্গা, তোর কাচে আমার এই মাথার দিব্যি রইলো, তুই নবীনেতে আর তোতে কখনো পৃথগ দেখবিনি। তোরা দুজনে আমার দুই নয়নের মণি।
বিধুশেখর বিরক্তভাবে গম্ভীর হলেন।
ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে রইলো। সমগ্র সম্পত্তির ওপর গঙ্গানারায়ণের আইনত কোনো অধিকার রইলো না, কিন্তু বিম্ববতীর অছি হিসেবে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও কারবার পরিচালনার ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব থাকবে। এজন্য বিধুশেখরের সঙ্গে তার ঠকাঠকি লাগবেই। গঙ্গানারায়ণ মনে মনে বিধুশেখরের সঙ্গে টকর দেবার জন্য প্ৰস্তুত হলো। তার জন্ম থেকে সে দেখে আসছে যে এ বাড়ির সব কিছুই বিধুশেখরের নির্দেশে চলে। এখন থেকে সে বিধুশেখরের সেই অধিকার ক্ষুন্ন করার সবরকম চেষ্টা করবে।
বিধুশেখর গঙ্গানারায়ণকে বললেন, ভাইকে নিয়ে তুমি এখন একটু বাইরে যাও। বৌঠানের সঙ্গে আমার আরও দু চারটি কতা আচে।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। বিধুশেখর কোনোরকম প্রতিবাদ সহ্য করতে পারেন না। বিম্ববতী তাঁর ব্যবস্থা মানেননি, বিম্ববতী তাঁর মুখের ওপর কথা বলতে পারেন, এটাই যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না বিধুশেখর। তিনি উগ্রভাবে বললেন, কাজটা ভালো করলে না, বিম্ব। রামকমল সিংহ যা সম্পত্তি রেখে গ্যাচে, তা অনেক রাজারাজড়ারও ভাগ্যে জোটে না। এমন সম্পত্তি নিয়ে অনেক সহোদর ভাইরাও মারামারি কাটাকাটি করে। আর গঙ্গা তো। পরের ছেলে।
বিম্ববতী বললেন, ও-কতা বলবেন না। গঙ্গাকে আমি সে-চোকে কখনো দেকিনি।
—মানুষ অনেক বদলে যায়। গঙ্গা যে নবীনকে হিংসে করবে না কখনো, তা কি কেউ বলতে পারে? সেইজন্যই তার সম্পত্তি আলাদা করে দিতে চেয়েছিলুম। ওর এখন থেকে আর এ বাড়িতে না থাকাই মঙ্গল।
—গঙ্গা হীরের টুকরো ছেলে। আমার চে বেশী তো তাকে কেউ চেনে না। ওর মনের মধ্যে লোভ বলে কোনো বস্তু নেই। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ও কোনোদিন অসুহৃৎ করবে না।
বিধুশেখর ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর নিজের কন্যা বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে গঙ্গানারায়ণ যে কাণ্ডটি করেছে, সে কথা তিনি বিম্ববতীকে বলেননি। হয়তো এখনো বলার সময় আসেনি। বিম্ববতী বলছেন গঙ্গানারায়ণ হীরের টুকরো ছেলে। কিন্তু তিনি তো জানেন, গঙ্গা দুশ্চরিত্র। সে তাঁর পরিবারে কলঙ্ক আনার চেষ্টা করেছিল। সেজন্য তাঁর কাছে ওর কোনো ক্ষমা নেই।
—আমি নবীনের ভালোর জন্যই এ ব্যবস্থা করেচিলুম। নবীন যেমন তোমার, তেমন তো সে আমারও।
—আপনি বলিচিলেন, ও কথা আর কোনোদিন উচ্চারণ করবেন না। যদি কাকপক্ষীতেও টের পায়…
—না, না, আর বলবো না, কোনোদিন বলবো না।
—এমন করে আপনাতে আমাতে নিভৃতে কতা বলাও কি ঠিক? ছেলেরা এখন বড় হয়েচে—
—তুমি চাও না। আমি আর আসি?
—আপনি না এলে আমি চক্ষে অসহায় দেকবো। আমার আর কে আচে? তবে এ সময় ঘরে অন্য কেউ থাকলেই শোভন।
–বিম্ব, তুমি আর আমাকে প্রীতি করো না?
বিম্ববতী বিধুশেখরের পায়ের ওপর মাথাটা ছুঁইয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিধুশেখর তাঁকে তুলে ধরে বললেন, তোমার এই ভুবনমোহিনী রূপ, রামকমল তার কোনো মূল্য দেয়নি। সন্তানহীনা বলে তোমার অশেষ দুঃখ ছেল, সেই দুঃখ জুড়োবার জন্য আমি তোমাকে একটি ছেলে দিইচি। সে কি পাপ? জীবনে আমি কোনো ভ্ৰষ্টাচার করিনি, শুধু তোমার কাচেই হার মেনিচি আমি। দ্যাকো, মানুষের নিয়তি কী বিচিত্ৰ! আমার নিজের স্ত্রীর গর্ভে কোনো পুত্রসন্তান হলো না। আর তুমি একবার চাইতেই আমি তোমায় একটি পুত্র দিলুম। তুমি মুখ ফুটে চাওনি জানি, কিন্তু আমি বুঝিচিলুম তোমার দুঃখু, সেইজন্যই, লোভ বা কামের বশবর্তী হয়ে নয়, আমি তোমাতে উপগত হয়েচি কর্তব্যবোধে! আমি ব্ৰাহ্মণ, কুলীনশ্রেষ্ঠ, বিবাহিত রমণী ব্ৰাহ্মণ নিয়োগে সন্তান উৎপাদন দেশাচারসম্মত। তাই তোমায় বলচি, কোনো পাপ হয়নি, মনে ভয় রেকো না…। থাক, এ কতা কোনোদিন কাকপক্ষীতেও জানবে না। আমি আর একলা আসবো না তোমার কাচে।
বিম্ববতী কাঁদতেই লাগলেন।
বিধুশেখর আবার বললেন, রামকমলকে আমি ভালোবাসতুম, তার অনেক গুণ ছেল, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে। আমি তাকে কখনো ক্ষমা করতে পারিনি। তোমার মতন এমন সোনার প্রতিমা ছেড়ে সে ছাইগাদায় পড়ে থাকতো। সেই আবাগীর বেটীর আমি এবার বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বো। উইলে জানবাজারের বাড়ি কারুকে দান করার কথা লেকা নেই। এ হস্তার মধ্যেই আমি সে মাগীকে ও বাড়ি থেকে দূর করে তাড়াবো।
কান্না মুছে বিম্ববতী বললেন, আহা, সে থাক না!
বিধুশেখর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে থাকবে? কার কতা বলচো?
বিম্ববতী বললেন, ঐ যে মেয়েটি, ঐ যে কমলা না কী যেন নাম শুনিচি, সে ও বাড়িতে আচে থাক না। একটা বাড়িতে আর কী যাবে আসবে!
—কী বলচো তুমি? সাত ঘাটের জল খাওয়া বেশ্য মাগী, তার জন্য একখানা বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে? কক্ষনো না!
—আহা, আমার স্বোয়ামী তাকে পচুন্দো কত্তেন, তার মনে দুঃখ দেওয়া কী ঠিক হবে? তিনি তো ওর জন্যই বাড়িটা কিনেচিলেন। তাছাড়া শুনিচি সেটা নাকি আগে কোন চাঁড়াল না ডোমের বাড়ি ছেল। অমন বাড়ি দিয়ে আমাদের কী হবে!
—ডোম নয়, ডোম নয়, ডম অ্যান্টুনি, এক ফিরিঙ্গির বাড়ি। সেখানে তো আমরা বসত করতে যাচ্চিনে। ভাড়া দিলে কোন না বিশ পঞ্চাশ টাকা আসবে। মাগী একেবারে ডাইনী, রামকমলকে ভেড়া বানিয়ে রেকেছেল। এ হস্তাতেই তাড়াবো ওকে।
এই বিষয়টি নিয়েই প্রথম বিধুশেখরের সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের বিরোধ বাধলো।
মামলা মোকদ্দমা করবার আগে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার জন্য কমলাসুন্দরীর বাড়িতে চারজন পাইকসহ দিবাকরকে পাঠিয়ে দিলেন বিধুশেখর। যাবার সময় দিবাকরকে তিনি বলে দিলেন, কাজ উদ্ধার করে এসো, তোমার ভালোমতন ইনাম মিলবে। কী ইনাম দেবো, তা এখন বলবো না। বিধুশেখর ভালোরকমই জানেন যে দিবাকরের মতন আমলারা দু। তরফ থেকেই টাকা খায়। সেইজন্যই দিবাকরকে আগে থেকে টোপ দিয়ে রাখা দরকার।
বিধুশেখর নিজে গেলে অবশ্য এক দাবড়ানি দিয়েই স্ত্রীলোকটিকে একেবারে দেশছাড়া করে দিতে পারতেন, কিন্তু ঐ অপবিত্ৰ স্থানে তিনি মুর পূর্ণ করতে চান না। তাছাড়া ওখানে গেলেই রামকমলের স্মৃতি তাঁকে আবার বেশী করে পীড়া দেবে।
ইনামের কথা শুনেই দিবাকর আসল ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। স্ত্রীলোকটিকে ঐ বাড়ি থেকে উৎখাত না করতে পারলে বড়বাবুর কাছ থেকে ধাতানি খেতে হবে। এই ডামাডোলের মধ্যে তার চাকরি নির্ভর করছে বড়বাবুর মর্জির ওপর।
দিবাকর জানবাজারে পৌঁছে বিরাট হম্বিতম্বি শুরু করে দিল। দাসদাসী ও দু-চারজন পরগাছা ধরনের মানুষ তখনো রয়ে গেছে সে বাড়িতে। দিবাকর সামনে যাকে দেখলে তারই ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বললো, নিকালো, আভি নিকালো। দিবাকরের পেছনে ভয়াল চেহারার পাইকদের দেখে ঐ নারী-পুরুষরা প্লাবনের সময়কার ইঁদুরের মতন দৌড়ে পালাতে লাগলো। এদিক ওদিক।
দিবাকর উঠে এলো দোতলায়।
বড় মজলিশ কক্ষটির মাঝখানে কুশের আসনে নিশ্চল হয়ে বসে আছে কমলাসুন্দরী। পরনে একখানি সাদা থান, দু হাতে কিংবা কণ্ঠে কোনো অলঙ্কার নেই, খাঁটি হিন্দুর বিধবার মতন বেশ। মাথা অবশ্য মুণ্ডন করেনি কমলাসুন্দরী, দীঘল খোলা চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। কমলাসুন্দরীর মুখে এখনো শোক ও বেদনার নরম লেখা।
দিবাকরকে দেখে মুখ তুলে কমলাসুন্দরী প্রশ্ন করলো, কে?
দিবাকর কমলাসুন্দরীকে অনেকদিন থেকেই দেখছে। এই নারীকে সে এই বেশে দেখে হকচাকিয়ে গেল।
বিশেষ প্রয়োজনে দিবাকরকে রামকমল সিংহের খোঁজে। কয়েকবারই আসতে হয়েছে। এখানে। তখন সে দেখেছে। এই স্ত্রীলোকটি যেন একটি সাজানো পুতুল, রামকমল সিংহ এই মেয়েটিকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলতেন। গত কয়েক বৎসরে নৃত্যপটিয়সী হয়ে উঠেছিল কমলাসুন্দরী, সেই কারণে তার সাজ ও অলঙ্কারের মাত্রা আরও বেড়েছিল। তার এই নিরাভরণ দেহ যেন চেনাই যায় না। তাছাড়া বাবু মারা গেলে তাঁর রক্ষিতা আবার নতুন করে বাবু ধরবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনো বেশ্যা যে বিধবার রূপ ধরতে পারে, এমন কথা কেউ সাতজন্মে শোনেনি!
দিবাকর বললো, এই, ইয়ে-বড়বাবু আমায় পাঠিয়ে দিলেন।
কমলাসুন্দরী বললো, বড়বাবু-বড়বাবু কে? —সেই যে সেদিন এয়েচিলেন, আমাদের বাবুর বন্ধু, তিনিই এখন সবকিচুর মালিক। তা তিনি বললেন…
—আমি একজনকেই বড়বাবু জানি, যিনি আমাদের অকুল পাথরে ভাস্যে সগ্গে গেচেন। আর বড়বাবু কেউ নেই।
—যা হয়ে গ্যাচে তা তো আর ফেরাবার উপায় নেই। বাবু হঠাৎ চলে গ্যালেন, এখন বিধুশেখর মুকুজ্যেই দণ্ডমুণ্ডের কত্তা। তিনি বলে পাটালেন, এ বাড়ি তোমায় ছাড়তে হবে।
—আমি এ বাড়ি ছাড়বো? তারপ। আমি কোতায় যাবো? এই বাড়িই আমার বাড়ি–
—সে রকম নেকাপড়া তো কিচু করে যাননি। বাবু ছিলেন। আপনাভোলা, হঠাৎ মরে যাবেন তাও তো ভাবেননি, এখুন তো, মেয়ে, তোমার নিজের পথ নিজেকেই দোকতে হবে।
—আমি যাবো না।
—সে কতা বললে কী চলে! বাবু তোমায় আলাদা কিচু দিয়ে থুয়ে যাননি? বাবু সোনাদানা টাকাকড়ি তো কম ঢালেননি তোমার পায়ে, আলাদা বাসা ভাড়া করে নেও গে।
—আমি এখেন থেকে যাবো না!
—দেকো মেয়ে, বেশী জেদ করোনি। বিধু মুকুজ্যের কবজ থেকে এ বাড়ি তুমি ছাড়াতে পারবে না।
—আমার বাবু এখেনে মরেচেন, আমিও এখেনেই মরবো। আমি মলে তারপর তোমরা এ বাড়ির দখল নিও!
—বালাই ষাট, এমন কাঁচা বয়েসে তুমি মরবো কেন? তোমার তো গোটা জীবনটাই সামনে পড়ে আচে। তবে এ বাড়ির মায়া তোমায় ছাড়তেই হবে।
—খবর্দার, আমার সামনে এসো না!
দু পা এগিয়ে এসেও দিবাকর থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ বন বিড়ালীর মতন ফোঁস করে উঠেছে। কমলাসুন্দরী। ঈষৎ কঠিন হয়ে দিবাকর বললো, তবে কি তোমায় জোর করে তুলতে হবে? আমার ওপর যা হুকুম…কেন অবুঝাপনা করচো?
কমলাসুন্দরী বললো, তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাকো, আমি তখুনি বিষ খেয়ে আত্মঘাতিনী হবো। এই যে বিষ রেখিচি।
আসনের এক প্রান্ত তুলে দেখালো কমলাসুন্দরী, সেখানে সত্যিই একটি কাগজের পুরিয়া রয়েছে।
দিবাকর আর সাহস করলো না। স্ত্রীলোকদের ওপর জোর জবরদস্তি করা তার ঠিক পছন্দ হয় না। তাছাড়া, মাত্র তো কয়েকদিন আগেই এই রমণী ছিল তার বাবুর দুই নয়নের মণি, তখন এর মনোরঞ্জনের জন্য রামকমল সিংহের আদেশে কত কিছু জোগাড় করতে হয়েছে তাকে, আর আজ সেই রমণীকেই সামান্য কুকুর বিড়ালের মতন গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াতে দিবাকরের মতন ঘোর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও চক্ষুলজ্জা হলো।
আরও একটা কথা, হঠাৎ যদি সত্যিই বিষ-টিষ খেয়ে বসে, তখন তার হাঁপা সামলাবে কে? তখন হয়তো বিধুশেখরই তাকে বলবেন, কে তোকে বলেছেল হাত ধরে টানাটানি করতে? আমাকে আর একবার জিজ্ঞেস করে যাসনি কেন?
মুখ রক্ষার জন্য দিবাকর বললো, আমি আরও দুদিন সময় দিয়ে যাচ্চি, এর মধ্যে একটা কিচু বন্দোবস্ত করে নাও। এ বাড়ি তোমায় ছাড়তেই হবে বলে রাকলুম।
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিবাকরের আবার আফসোস হলো। কযোদ্ধার না করে গেলে বিধুশেখরের কাছে কতখানি ধাতানি খেতে হবে কে জানে? বারাঙ্গনাটির কাছে জব্দ হয়ে গেল সে। তার মনে হলো, ঐ সব বৈধব্যের বেশটেশ আসলে ভেক। আসনের নীচে বিষ পর্যন্ত রেখেছে। এসব তো ও মেয়ের নিজের বুদ্ধিতে কুলোবে না, নিশ্চয়ই ওর কানে মন্তর দিয়েছে অন্য কেউ। সহজে ও বাড়ি ছাড়বে না।
ফিরে এসে দিবাকর দেখলো, বৈঠকখানা ঘরে বিধুশেখর আর গঙ্গানারায়ণ অনেক দলিল দস্তাবেজ খুলে বসে হিসেবের কাজে ব্যস্ত। তাদের দুজনের কাছেই দিবাকর তার অভিযানের পরিণাম ব্যক্ত করলো।
বিধুশেখর চোয়াল শক্ত করে বললেন, তুমি গলাধাক্কা দাওনি ভালোই করোচে। আদালতের প্যায়দা পাঠিয়েই ও কাজটা সারা যাবে।
গঙ্গানারায়ণ বললো, কেন, সে বাড়ি ছাড়বে না কেন? ও বাড়ির ওপর তার কী হক্ক আছে? মামলা মোকদ্দমা করার দরকার কী, আমি নিজে গিয়ে তাকে তাড়িয়ে আসবো।
বিধুশেখর বললেন, না, না, ও সমস্ত জায়গায় তোমার যাবার দরকার নেই।
গঙ্গানারায়ণ বললো, কেন? বাড়ি তো আমাদেরই, সেখানে আমি যেতে পারবো না কেন?
বিধুশেখর বললেন, ঐ অবিদ্যা আগে দূর হোক, তারপর যেও। ওদের মুখ দর্শন করাও পাপ।
বিধুশেখর নিষেধ করলেন বলেই গঙ্গানারায়ণ সেখানে গেল সেদিনই সন্ধেবেলা। কারুকে কিছু না বলে, একা।