রাগাত্মিক পদ
রাগাত্মিক পদ ।।
নিত্যের আদেশে, বাশুলী চলিল,
সহজ জানাবার তরে।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে, নান্নুর গ্রামেতে,
প্রবেশ যাইয়া করে।।
বাশুলী আসিয়া, চাপড় মারিয়া,
চণ্ডীদাসে কিছু কয়।(১)
সহজ ভজন, করহ যাজন,
ইহা ছাড়া কিছু নয়।।
ছাড়ি জপতপ, করহ আরোপ,
একতা করিয়া মনে।(২)
যাহা কহি আমি, তাহা শুন তুমি,
শুনহ চৌষট্টি সনে।।(৩)
বসুতে গ্রহেতে, করিয়া একত্রে,
ভজহ তাহারে নিতি।(৪)
বাণের সহিতে,(৫) সদাই যুজিতে,
সহজের এই রীতি।।
দক্ষিণ দেশেতে, না যাবে কদাচিতে,
যাইলে প্রমাদ হবে।
এই কথা মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
আনন্দে থাকিবে তবে।।
রতি পরকীয়া, যাহারে কহিয়া,
সি সে আরোপ সার।(৬)
ভজন তোমারি,(৭) রজক ঝিয়ারি,
রামিনী নাম যাহার।।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
শুনহ দ্বিজের সুত।
একথা ল’বে না, না জানে যে জনা,
সেই সে কলির ভূত।।
————–
রসিক ভক্তগণের সাধন প্রণালীর নাম “রাগাত্মক।”
রসিক ভক্তরা “রাগানুগ” ভক্ত।
(১) জীবনী দ্রষ্টব্য।
(২) বৈধি ধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া প্রকৃতি ভাবে কৃষ্ণ ভজনা কর।
অনুরাগ–কল্পনা বা এক বস্তুতে অন্য বস্তুর স্থাপন।
যথা–রজ্জুতে সর্পারোপ। ভজন মার্গে গোপী অনুগতি বা আপনাকে গোপীজনের দাসী মনে করাই আরোপ। শ্রীকৃষ্ণকে যাঁহারা পতিরূপে ভজন করেন তাঁহাদের এরূপ আরোপ ব্যতীত উপায় নাই। ঠাকুর মহাশয় স্বীয় প্রার্থনা এবং প্রেমভক্তি চন্দ্রিকায় এই আরোপের কথা বহুস্থানে বলিয়াছেন।
(৩) চৌষট্টি রস সহিত। বিধ্যুদিত নিরসভাবে নহে, রসিক শেখরকে সরস উপাশনাই কর্ত্তব্য। তন্ত্রে ৬৪ কলার সহ ভজন বিধি কথিত আছে। কলা শব্দে–কামকলা, শিল্পকলা ইত্যাদি।
(৪) বসু ৮, গ্রহ ৯, একত্রে ১৭। খুব সতরের ঘরে অর্থাৎ বিশেষ সতর্কতার সহিত তাঁহাকে প্রত্যহ ভজন কর।
নিতি–নিত্য, প্রত্যহ।
ভাষা কথায় আছে–‘সতরর ঘরে বিনাশ নাই”।
(৫) বান, পাঁচ। মদন, মাদন, স্তম্ভন, শোষণ ও মোহন। অর্থাৎ মধুর রসে উপাসনা।
(৬) ব্রজভাবানুসারে যে ভজন তাহাই সার অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ ব্রজ গোপীর ন্যায় পরকীয়া ভাবের যে ভজন তাহাই শ্রেষ্ঠ।
(৭) চণ্ডীদাস রামিনীকে মধুর ভজনে সাহায্যকারিণী গুরুরূপিণী বলিয়া “ভজন তোমার” বলিতেছেন। বিল্বমঙ্গল ঠাকুরও এইরূপ চিন্তামণিকে গুরুরূপে বন্দনা করিয়াছেন।
—————
রাগাত্মিক পদ ।।
শুন রজকিনি রামি।
ও দুটি চরণ, শীতল বলিয়া,
শরণ লইনু আমি।।
তুমি বেদ রাগিনী, হরের ঘরণী,
তুমি সে নয়নের তারা।
তোমার ভজনে, ত্রিসন্ধা যাজনে,
তুমি সে গলার হারা।।
রজকিনী রূপ, কিশোরী স্বরূপ,
কাম গন্ধ নাহি তায়।
রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম,
বড়ু চণ্ডীদাসে গায়।।
————-
রাগাত্মিক পদ ।।
এক নিবেদন, করি পুনঃপুন,
শুন রজকিনি রামি।
যুগল চরণ, শীতল দেখিয়া,
শরণ লইলাম আমি।।
রজকিনী রূপ, কিশোরী স্বরূপ,
কাম গন্ধ নাহি তায়।
না দেখিলে মন, করে উচাটন,
দেখিলে পরাণ জুড়ায়।।
তুমি রজকিনী, আমার রমণী,
তুমি হও মাতৃ পিতৃ।
ত্রিসন্ধ্যা যাজন, তোমারি ভজন,
তুমি বেদমাতা গায়ত্রী।।
তুমি বাগবাদিনী, হরের ঘরণী,
তুমি সে গলার হারা।
তুমি স্বর্গ মর্ত্ত, পাতাল পর্ব্বত,
তুমি সে নয়ানের তারা।।
তোমা বিনা মোর, সকল আঁধার,
দেখিলে জুড়ায় আঁখি।
যে দিনে না দেখি, ও চাঁদ বদন,
মরমে মরিয়া থাকি।।(১)
ওরূপ মাধুরী, পাসরিতে নারি,
কি দিয়ে করিব বশ।
তুমি সে তন্ত্র, তুমি সে মন্ত্র,
তুমি উপাসনা রস।।
ভেবে দেখ মনে, এ তিন ভুবনে,
কে আছে আমার আর।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
ধোপানি চরণ সার।।
————–
(১) অপর একখানি হস্তলিখিত গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত।
রাগাত্মিক পদ ।।
পুন আর বার, আসি তরাতর,
রামিনী জগতমাতা।
ধরিয়া রামিনী, কহিছেন বাণী,
শুনহ আমার কথা।।
যাহা কহি বাণী, শুনহ রামিনি,
এ কথা ভুবন পার।
পরকিয়া রতি, করহ আরতি,
সেই সে ভজন সার।।
চণ্ডীদাস নামে, আছে এক জন,
তাহারে আরোপ কর।
অবশ্য করিলে, নিত্যধাম পাবে,
আমার বচন ধর।।
নেত্রে বেদ দিয়া,(১) সদাই ভজিবা,
আনন্দে থাকিবা তবে।
সমুদ্র(২) ছাড়িয়া, নরকে যাইবা,
ভজন নাহিক হবে।।
আর তিন দিয়, বেদে মিশাইয়া,(৩)
সতত তাহাই যজ।
নিত্য এক মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
মম পদ সদাভজ।।
ব্যভিচারী হইলে, প্রাপ্তি নাহি মিলে,
নরকে যাইবে তবে।
রতি স্থির মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
সহজ পাইবে তবে।।
আর এক বানী, শুনহ রামিনি,
এ কথা রাখিও মনে।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
এ কথা পাছে কেহ শুনে।।
————–
(১) “নেত্রে বেদ দিয়া” ইত্যাদি–রাধাকৃষ্ণ প্রীতি দিয়া সদাই ভজন করিলে আনন্দে থাকিবে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১০ম অধ্যায়ে ভগবানের এই প্রকার উক্তি আছে, যথা–“তেষাং সতত যুক্তানাং ভজতাং প্রীতি পূর্ব্বকম্। দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপয়ান্তি তে।।”
“নেত্র”–তিন, — পিরীতি।
“বেদ”–চারি, — রাধাকৃষ্ণ।
(২) “সমুদ্র ছাড়িয়া নরকে যাইবে” ইত্যাদি–ঐ রাধাকৃষ্ণ প্রীতি যদি ত্যাগ কর, নরকে যাইতে হইবে।
“সমুদ্র”–সাত, — রাধাকৃষ্ণ পিরীতি।
(৩) “আর তিন দিয়া বেদে মিশাইয়া” ইত্যাদি–অর্থাত শ্রীকৃষ্ণকে সদাই ভজনা কর।
“তিন”–রমণ, — শ্রীকৃষ্ণ।
“বেদ”–চারি, বৃন্দাবন — শ্রীকৃষ্ণ।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
কহিছে রজকিনী রামী, শুন চণ্ডীদাস তুমি,
নিশ্চয় মরম কহি জানে।
বাশুলী কহিছে যাহা, সত্য করি মান তাহা,
বস্তু আছে দেহ বর্ত্তমানে।।
আমি ত আশ্রয় হই, বিষয় তোমারে কই,
তমণ কালেতে গুরু তুমি।
আমার স্বভাব মন, তোমার রতি ধ্যান,
তেঞি সে তোমায় গুরু করি মানি।।
সহজ মানুষ হব, রসিক নগরে যাব,
থাকিব প্রণয় রস ঘরে।
শ্রীরাধিকা হবে রাজা, হইব তাহার প্রজা,
ডুবিব রসের সরোবরে।।
সেই সরোবরে গিয়া, মন পদ্ম প্রকাশিয়া,
হংস প্রায় হইয়া রহিব।
শ্রীরাধা মাধব সঙ্গে, আনন্দ কৌতুক রঙ্গে,
জনমে মরণে তুয়া পাব।।
শুন চণ্ডীদাস প্রভু, ভজন না হয় কভু,
মনের বিকার ধর্ম্ম জানে।
সাধন শৃঙ্গার রস, ইহাত হইবে বশ,
বস্তু আছে দেহ বর্ত্তমানে।।
—————-
রাগাত্মিক পদ ।।
চণ্ডীদাসে কহে তুমি সে গুরু।
তুমি সে আমার কল্পতরু।।
যে প্রেম রতন কহিলে মোরে।
কি ধন রতনে তুষিব তোরে।।
ধন জন দারা সোঁপিনু তোরে।
দয়া না ছাড়িও কখন মোরে।।
ধরম করম কিছু না জানি।
কেবল তোমার চরণ মানি।।
এক নিবেদন তোমারে কব।
মরিয়া দোঁহেতে কি রূপ হব।।
বাশুলী কহিছে কহিব কি।
মরিয়া হইবে রজক ঝি।।
পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবে।
এ দেহ হয়ে নিত্যতে যাবে।।
চণ্ডীদাস প্রেমে মূর্চ্ছিত হইলা।
বাশুলী চলিয়া নিত্যতে গেলা।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
চণ্ডীদাসে কহে শুনহ মাতা।
কহিলে আমারে সাধন কথা।।
সাতাশী উপরে তিনের স্থিতি।
সে তিন রহয়ে কাহার গতি।।
এ তিন দুয়ারে কি বীজ হয়।
কি বীজ সাধিয়া সাধক কয়।।
রতির আকৃতি বলিয়ে যারে।
রসের প্রকার কহিব মোরে।।
কি বীজ সাধিলে সাধিব রতি।
কি বীজ ভজিলে রসের গতি।।
সামান্য রতিতে বিশেষ সাধে।
সামান্য সাধিতে বিশেষ বাধে।।
সামান্য বিশেষ একতা রতি।
এ কথা শূনিয়া সন্দেহ মতি।।
সামান্য রতিতে কি বীজ হয়।
বিশেষ রতিতে কি বীজ কয়।।
সামান্য রসকে কি রস যজে।
কি বীজ প্রকারে বিশেষ মজে।।
তিনটি দুয়ারে থাকয়ে যে।
সেই তিন জন নিত্যের কে।।
চণ্ডীদাস কহে কহবে মোরে।
বাশুলী কহিছে কহিব তোরে।।
—————-
এ দেহে সে দেহে একই রূপ।
তবে সে জানিবে রসেরই কূপ।।
এ বীজ সে বীজে একতা হবে।
তবে সে প্রেমের সন্ধান পাবে।।
সে বীজ যজিয়ে এ বীজ ভজে।
সেই সে প্রেমের সাগরে মজে।।
রতিতে রসেতে একতা করি।
সাধিবে সাধক বিচার করি।।
বিশুদ্ধ রতিতে বিশুদ্ধ রস।
তাহাতে কিশোরা কিশোরী বশ।।
বিশুদ্ধ রতিতে করণ কি।
সাধহ সতত রজক ঝি।।
সাতাশী উপরে তাহার ঘর।
তিনটি দুয়ার তাহার পর।।
বীজে মিশাইয়া রামিনী যজ।
রসিক মণ্ডলে সতত ভজ।।
বিশুদ্ধ রতিতে বিকার পাবে।
সাধিতে নারিলে নরকে যাবে।।
বাশুলী কহয়ে এই সে হয়।
চণ্ডীদাস কহে অন্যথা নয়।।
————–
“সাতাশী”–
পঞ্চবাণ, অর্থাৎ মদন, মাদন, শোষণ, উন্মাদন ও স্তম্ভন।
পঞ্চপ্রাণ, অর্থাৎ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যাণ।
পঞ্চভূত, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম।
পঞ্চভাব, অর্থাৎ সান্ত, দাস্য, সৌখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য্য।
পঞ্চগুণ, অর্থাৎ শব্দ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ।
দশ ইন্দ্রিয়।
দশ দিক।
দশ দশা। যথা–“চিন্তাত্র জাগরূদ্বেগৌ তানবং মলিনাঙ্গতা। প্রমাদো ব্যাধিরুম্মাদৌ মোহ মৃত্যু দশাদশঃ।।
নবধাঙ্গ ভক্তি ও আত্মভাব, এই দশ। যথা–শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণ, অর্চ্চন, বন্দন, পদসেবন, দাস্য, সৌখ্য, নিবেদন, এবং স্বীয় ভাব।
অষ্টদিক। যথা–উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব্ব, পশ্চিম, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি ও ঈশান।
অষ্টকাল/অষ্টপ্রহর। যথা–প্রাতঃ, পূর্ব্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন, অপরাহ্ন, প্রদোষ, মধ্যরাত্রি, নিশান্তক।
এবং ছয় রিপু।
সাতাশী উপর “তিন”–(রতি) সামর্থা, সাধারণী ও সামঞ্জসা।
“গতি”–অধিকার।
“সামার্থা”–শ্রীরাধিকা ও গোপীগণ।
“সাধারণী”–কুব্জা ও কুব্জিকাগণ।
“সামঞ্জসা”–রুক্ষ্মিণী প্রভৃতি।
—————–
রাগাত্মিক পদ ।।
বাশুলী কহিছে শুনহ দ্বিজ।
কহিব তোমারে সাধন বীজ।।
প্রথম(১) দুয়ারে মদের গতি।
দ্বিতীয়(২) দুয়ারে আসক স্থিতি।।
তৃতীয়(৩) দুয়ারে কন্দর্প রয়।
কন্দর্প রূপেতে শ্রীকৃষ্ণ কয়।।
আসক রূপেতে শ্রীরাধা কই।
মদরূপ ধরি আমি সে হই।।
সাতাশী আখরে সাধিবে তিনে(৪)।
একত্র করিয়া আপন মনে।।
রতির আকৃতি কন্দর্প হয়।।
তিনটি(৫) আখরে রতিকে যজি।
পঞ্চম আখরে (৬) বাণকে(৭) ভজি।।
দ্বিতীয়(৮) আসকে সামান্য রতি।
তবে সে পাইবে বিশেষ স্থিতি।।
চতুর্থ(৯) আখর সামান্য রস।
তাহাতে কিশোরা কিশোরী বস।।
বাশুলী কহয়ে এই সে সার।
এ রস সমুদ্র বেদান্ত পার।।
————–
(১) “প্রথম দুয়ারে”–সামর্থা।
(২) “দ্বিতীয় দুয়ারে”–সাধারণী।
(৩) তৃতীয় দুয়ারে” সামঞ্জসা।
(৪) “তিন”–পিরীতি।
(৫) “তিনটী আখর”–কন্দর্প।
(৬) “পঞ্চম আখর”–শান্ত, দাস্য, সৌম, বাৎসল্য, ও মাধুর্য্য।
(৭) “বাণ”–মদন।
(৮) “দ্বিতীয় আসক”–রাগাত্মিক ও রাগানুগা।
(৯) “চতুর্থ আখর”–রস ও রতি।
—————-
“সাতাশী”–
পঞ্চবাণ, অর্থাৎ মদন, মাদন, শোষণ, উন্মাদন ও স্তম্ভন।
পঞ্চপ্রাণ, অর্থাৎ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যাণ।
পঞ্চভূত, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম।
পঞ্চভাব, অর্থাৎ সান্ত, দাস্য, সৌখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য্য।
পঞ্চগুণ, অর্থাৎ শব্দ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ।
দশ ইন্দ্রিয়।
দশ দিক।
দশ দশা। যথা–“চিন্তাত্র জাগরূদ্বেগৌ তানবং মলিনাঙ্গতা। প্রমাদো ব্যাধিরুম্মাদৌ মোহ মৃত্যু দশাদশঃ।।
নবধাঙ্গ ভক্তি ও আত্মভাব, এই দশ। যথা–শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণ, অর্চ্চন, বন্দন, পদসেবন, দাস্য, সৌখ্য, নিবেদন, এবং স্বীয় ভাব।
অষ্টদিক। যথা–উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব্ব, পশ্চিম, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি ও ঈশান।
অষ্টকাল/অষ্টপ্রহর। যথা–প্রাতঃ, পূর্ব্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন, অপরাহ্ন, প্রদোষ, মধ্যরাত্রি, নিশান্তক।
এবং ছয় রিপু।
সাতাশী উপর “তিন”–(রতি) সামর্থা, সাধারণী ও সামঞ্জসা।
“গতি”–অধিকার।
“সামার্থা”–শ্রীরাধিকা ও গোপীগণ।
“সাধারণী”–কুব্জা ও কুব্জিকাগণ।
“সামঞ্জসা”–রুক্ষ্মিণী প্রভৃতি।
————-
রাগাত্মিক পদ ।।
স্বরূপে আরোপ যার, রসিক নাগর তার,
প্রাপ্তি হবে মদন মোহন।
গ্রাম্য দেব বাশুলীরে, জিজ্ঞাসগে কড় যোড়ে,
রামী কহে শৃঙ্গার সাধন।।
চণ্ডীদাস কর যোড়ে, বাশুলীর পায় ধরে,
মিনতি করিয়া পুছে বাণী।
শুন মাতা ধর্ম্মমতি, বাউল হইনু অতি,
কেমনে সুবুদ্ধি হবে প্রাণী।।
হাসিয়ে বাশুলী কয়, শুনি চণ্ডী মহাশয়,
আমি থাকি রসিক নগরে।
সে গ্রাম দেবতা আমি, ইহা জানে রজকিনী,
জিজ্ঞাসগে যতনে তাহারে।।
সে দেশে রজকিনী, হয় রসের অধিকারী,
রাধিকা স্বরূপ তার প্রাণ।
তুমি ত রমণের গুরু, সেহ রসের কল্পতরু,
তার সনে দাস অভিমান।।
চণ্ডীদাস কহে মাতা, কহিলে সাধন কথা,
রামী সত্য প্রাণপ্রিয়া হৈল।
নিশ্চয় সাধন গুরু, সেহ রসের কল্পতরু,
তার প্রেমে চণ্ডীদাস মৈল।।
————–
বাউল – ক্ষিপ্ত; ব্যাকুল।
রাগাত্মিক পদ ।।
এই সে রস নিগুঢ় ধন্য।
ব্রজ বিনা ইহা না জানে অন্য।।
দুই রসিক হইলে জানে।
সেই ধন সদা যতনে আনে।।
নয়নে নয়নে রাখিবে পিরীতি।
রাগের উদয় এই সে রীতি।।
রাগের উদয় বসতি কোথা।
মদন মাদন শোষণ যথা।।
মদন বৈসে বাম নয়নে।
মাদন বৈসে দক্ষিণ কোণে।।
শোষণ বাণেতে উপান চাই।
মোহন কুচেতে ধরয়ে ভাই।।
স্তম্ভন শৃঙ্গারে সদাই স্থিতি।
চণ্ডীদাস কহে রসের রতি।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
কাম আর মদন দুই প্রকৃতি পুরুষ।
তাহার পিতার পিতা সহজ মানুষ।।
তাহা দেখে দূর নহে আছয়ে নিকটে।
ব্রহ্মাণ্ড ভিতরে তেঁহ রহে চিত্রপটে।।
সর্পের মস্তকে যদি রহে পঞ্চ মণি।
কীটের স্বভাব দোষ তাহে নহে ধনী।।
গোরোচনা জন্মে দেখ গাভীর ভাণ্ডারে।
তাহার যতেক মূল্য সে জানিতে নারে।।
সুন্দর শরীরে হয় কৈতবের বিন্দু।
কৈতব হইলে হয় গরলের সিন্ধু।।
অকৈতবের বৃক্ষ যদি রহে এক ঠাঁই।
নাড়িলে বৃক্ষের মূল ফল নাহি পাই।।
নিদ্রার আবেশে দেখ কপাল পানে চেয়ে।
চিত্রপটে নৃত্য করে তার নাম মেয়ে।।
নিশি যোগে শুক সারী যেই কথা কয়।
চণ্ডীদাস কহে কিছু বাশুলীর কৃপায়।।
————–
কৈতব – কপট।
রাগাত্মিক পদ ।।
শৃঙ্গার রস বুঝিবে কে?
সব রস সার শৃঙ্গার এ।।
শৃঙ্গার রসের মরম বুঝে।
মরম বুঝিয়া ধরম যজে।।
রসিক ভকত শৃঙ্গারে মরা।
সকল রসের শৃঙ্গার সারা।।
কিশোরা কিশোরী দুইটি জন।
শৃঙ্গার রসের মূরতি হন।।
গুরু বস্তু এবে বলিব কায়?
বিরিঞ্চি ভবাদি সীমা না পায়।।
কিশোরা কিশোরী যাহাকে ভজে।
গুরু বস্তু সেই সদা যজে।।
চণ্ডীদাস কহে না বুঝে কেহ।
যে জন রসিক বুঝয়ে সেহ।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
রসিক রসিক, সবাই কহয়ে,
কেহত রসিক নয়।
ভাবিয়া গণিয়া, বুঝিয়া দেখিলে,
কোটিতে গোটিক হয়।।
সখিহে রসিক বলিব কারে!
বিবিধ মশলা, রসেতে মিশায়,
রসিক বলি যে তারে।।
রস পরিপাটি, সুবর্নের ঘটী,
সম্মুখে পূরিয়া রাখে।
খাইতে খাইতে, পেট না ভরিবে,
তাহাতে ডুবিয়া থাকে।।
সেই রস পান, রজনী দিবসে,
অঞ্জলী পূরিয়া খায়।
খরচ করিলে, দ্বিগুণ বাড়ায়ে,
উছলিয়া বহি যায়।।
চণ্ডীদাস কহে, শুন রসবতি,
তুমি সে রসের কূপ।
রসিক জনা, রসিক না পাইলে,
দ্বিগুণ বাড়য়ে দুখ।।
রাগাত্মিক পদ ।।
রসিকা নাগরী রসের মরা।
রসিক ভ্রমর প্রেম পিয়ারা।।
অবলা মূরতি রসের বাণ।
রসে ডুবু ডুবু করে পরাণ।।
রসবতী সদা হৃদয়ে জাগে।
দরশ বাঢ়ায়া পরশ মাগে।।
দরশে পরশে রস প্রকাশ।
চণ্ডীদাস কহে রস বিলাস।।
রাগাত্মিক পদ ।।
রসের কারণ, রসিকা রসিক,
কায়াটি ঘটনে রস।
রসিক কারণ, রসিকা হোয়ত,
যাহাতে প্রেম বিলাস।।
স্থলত পুরুষে, কাম সূক্ষ্ম গতি,
স্থলত প্রকৃতি রতি।
দুঁহুক ঘটনে, যে রস হোয়াত,
এবে তাহে নাহি গতি।।
দুঁহুক যোটন, বিনহি কখন,
না হয় পুরুষ নারী।
প্রকৃতি পুরুষে, যো কছু হোয়ত,
রতি প্রেম পরচারি।।
পুরুষ অবশ, প্রকৃতি সবশ,
অধিক রস যে পিয়ে।
রতি সুখ কালে, অধিক সুখহি,
তা নাকি পুরুষে পায়ে।।
দুঁহুক নয়নে, নিকষয়ে বাণ,
বাণ যে কামের হয়।
রতির যে বাণ, নাহিক কখন,
তবে কৈছে নিকষয়।।
কাম দাবানল, রতি সে শীতল,
সলিল প্রণয় পাত্র।
কুল কাঠ খড়, প্রেম যে আধেয়,
পচনে পিরীতি মাত্র।।
পচনে পচনে, লোভ উপজিয়া,
যবে ভেল দ্রব ময়।
সেই বস্তু এবে, বিলাসে উপজে,
তাহারে রস যে কয়।।
বাশুলী আদেশে, চণ্ডীদাস তথি,
রূপ নারায়ণ সঙ্গে।
দুঁহু আলিঙ্গন, করল তখন,
ভাসল প্রেম তরঙ্গে।।
————–
পরচারি – প্রচার করি।
রাগাত্মিক পদ ।।
প্রেমের আকৃতি, দেখিয়া মূরতি,
মন যদি তাতে ধায়।
তবে ত সে জন, রসিক কেমন,
বুঝিতে বিষম তায়।।
আপন মাধুরী, দেখিতে না পাই,
সদাই অন্তর জ্বলে।
আপনা আপনি, করয়ে ভাবনি,
কি হৈল কি হৈল বলে।।
মানুষ অভাবে, মন মরিচিয়া,
তরাসে আছাড় খায়।
আছাড় খাইয়া, করে ছট ফট,
জীয়ন্তে মরিয়া যায়।।
তাহার মরণ, জানে কোন জন,
কেমন মরণ সেই।
যে জনা জানয়ে, সেই সে জীয়য়ে,
মরণ বাঁটিয়া লেই।।
বাঁটিলে মরণ, জীয়ে দুই জন,
লোকে তাহা নাহি জানে।
প্রেমের আকৃতি, করে ছট
চণ্ডীদাস ইহা ভণে।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
প্রেমের যাজন, শুন সর্ব্বজন,
অতি সে নিগূঢ় রস।
যখন সাধন, করিবা তখন,
এড়ায় টানিবা শ্বাস।।
তাহা হইলে, মন বায়ু সে,
আপনি হইবে বশ।
তা হইলে কখন, না হইবে পতন,
জগৎ ঘোষিবে যশ।।
বেদ বিধি পার, এমন আচার,
যাজন করিবে যে।
ব্রজের নিত্য ধন, পায় সেই জন,
তাহার উপর কে।।
সদানন্দ হৃদয়ে, নয়নে দেখয়ে,
যুগল কিশোর রূপ।
প্রেমের আচার, নয়ন গোচর,
জানয়ে রসের কূপ।।
চণ্ডীদাস কয়, নিত্য বিলাসময়,
হৃদয় আনন্দ ভোরা।
নয়নে নয়নে, থাকে দুই জনে,
যেন জীয়ন্তে মরা।।
————-
রাগাত্মিক পদ ।।
শুন শুন দিদি, প্রেম সুধা নিধি,
কেমন তাহার জল।
কেমন তাহার, গভীর গম্ভির,
উপরে শেহালা দল।।
কেমন ডুবারু, ডুবেছে তাহাতে,
না জানি কি লাগি ডুবে।
ডুবিয়ে রতন, চিনিতে নারিলাম,
পড়িয়া রহিলাম ভবে।।
আমি মনে করি, আছে কত ভারি,
না জানি কি ধন আছে।
নন্দের নন্দন, কিশোরা কিশোরী,
চমকি চমকি হাসে।।
সখীগণ মেলি, দেয় করতালি,
স্বরূপে মিশায়ে রয়।
স্বরূপ জানিয়ে, রূপে মিশাইলে,
ভাবিয়ে দেখিলে হয়।।
ভাবের ভাবনা, আশ্রয় যে জনা,
ডুবিয়ে রহিল সে।
আপনি তরিয়ে, জগত তরায়,
তাহারে তরাবে কে।।
চণ্ডীদাস বলে, লাখে এক মিলে,
জীবের লাগয়ে ধান্ধা।
শ্রীরূপ করুণা, হারে হইয়াছে,
সেই সে সহজ বান্ধা।।
————–
রাগাত্মিক পদ ।।
আপনা বুঝিয়া, সুজন দেখিয়া,
পিরীতি করিব তায়।
পিরীতি রতন, করিব যতন,
যদি সমানে সমানে হয়।।
সখী হে পিরীতি বিষম বড়।
যদি পরাণে পরাণে, মিশাইতে পারে,
তবে সে পিরীতি দড়।।
ভ্রমরা সমান, আছে কত জন,
মধু লোভে করে প্রীত।
মধু পান করি, উড়িয়ে পলায়,
এমতি তাহার রীত।।
বিধুর সহিত, কুমুদ পিরীতি,
বসতি অনেক দূরে।
সুজনে সুজনে, পিরীতি হইলে,
এমতি পরাণ ঝুরে।।
সুজনে কুজনে, পিরীতি হইলে,
সদাই দুখের ঘর।
আপন সুখেতে, যে করে পিরীতি,
তাহারে বাসিব পর।।
সুজনে সুজনে, অনন্ত পিরীতি,
শুনিতে বাড়ে যে আশ।
তাহার চরণে, নিছনি লৈয়া,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।
—————
রাগাত্মিক পদ ।।
সুজনের সনে, আনের পিরীতি,
কহিতে পরাণ ফাটে।
জিহ্বার সহিত, দন্তের পিরীতি,
সময় পাইলে কাটে।।
সখী হে কেমন পিরীতি লেহা।
আনের সহিত, করিয়া পিরীতি,
গরলে ভরিল দেহা।।
বিষম চাতুরী, বিষের গাগরী,
সদাই পরাধীন।
আত্ম সমর্পন, জীবন যৌবন,
তথাচ ভাবয়ে ভিন।।
সকাল লাগিয়া, ফেরয়ে ঘুরিয়া,
পর তত্ত্বে নাহি চায়।
করিয়া চাতুরী, মধু পান করি,
শেষে উড়িয়া পলায়।।
সখী না কর সে পিরীতি আশ।
ঝটিয়া পিরীতি, কেবল কুরীতি,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
শুন গো সজনি আমারি বাত।
পিরীতি করবি সুজন সাত।।
সুজন পিরীতি পাষাণ রেখ্।
পরিণামে কভু না হবে টোট্।।
ঘষিতে ঘষিতে চন্দন সার।
দ্বিগুণ সৌরভ উঠয়ে তার।।
চণ্ডীদাস কহে পিরীতি রীতি।
বুঝিয়া সজনি করহ প্রীতি।।
———–
রাগাত্মিক পদ ।।
নিজ দেহ দিয়া ভজিতে পারে।
সহজ পিরীতি বলিব তারে।।
সহজে রসিক করয়ে প্রীত।
রাগের ভজন এমন রীত।।
এখানে সেখানে এক হইলে।
সহজ পিরীতি না ছাড়ে মৈলে।।
সহজ বুঝিয়ে যে হয় রত।
তাহার মহিমা কহিব কত।।
চণ্ডীদাস কহে সহজ রীত।
বুঝিয়ে নাগরী করহ প্রীত।।
————-
রাগাত্মিক পদ ।।
পিরীতি করিয়া ভাঙ্গয়ে যে।
সাধনা অঙ্গ পায় না সে।।
প্রেমের পিরীতি মাধুরীময়।
নন্দের নন্দন কয়েক কয়।।
রাগ সাধনের এমতি রীত।
সে পথি জনার তেমতি চিত।।
সকল ছাড়িল যাহার তরে।
তাহারে ছাড়িতে সাহস করে।।
আদি চণ্ডীদাসে চারু সুবুঝান।
দাউ উঠাইল যেমন মান।।*
————–
* পদসমুদ্র
রাগাত্মিক পদ ।।
প্রেমের পিরীতি, কিসে উপজিল,
প্রেমাধরে নিব কারে!
কেবা কোথা হইল, কেবা সে দেখিল,
এ কথা কহিব কারে।।
পাতের ফুলে, ফুলের কিরণ,
আথার মাঝারে যেই।
তাহারে অনেক, যতনে নিঙ্গাড়ে,
চতুর রসিক সেই।।
প্রেমের চাতুরি, চতুর হইয়া,
তিনের কাছেতে থাকে।
চারিটি আঁখর, হরিলে পূরিলে,
তাহে যেবা বাকি থাকে।।
তাহার বাকিতে, প্রেমের আখর,
পিরীতি আখর জড়।
সকল আখর, এক করি দেখ,
প্রেমের কথাটী দড়।।
ছয়টী আখর, মূল করি দেখ,
তাহার ঘুচাই দুই।
চণ্ডীদাস কহে, এ কথা বুঝয়,
রসিক হইবে সেই।।*
————–
* পদসমুদ্র
রাগাত্মিক পদ ।।
পিরীতি উপরে, পিরীতি বৈসয়ে,
তাহার উপরে ভাব।
ভাবের উপরে, ভাবের(১) বসতি,
তাহার উপর লাভ (২)।।
প্রেমের মাঝারে,(৩) পুলকের স্থান,
পুলক উপরে ধারা(৪)।
ধারার উপরে, ধারার বসতি,
এ সুখ বুঝয়ে কারা।।(৫)
কুলের(৬) উপরে, ফুলের বসতি,
তাহার উপরে গন্ধ।।
গন্ধ উপরে, এ তিন আখর,
এ বড় বুঝিতে ধন্ধ।।
কুলের উপরে, ফুলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
ঢেউর উপরে, ঢেউই বসতি,
ইহা জানে কেউ কেউ।।
দুখের উপরে, দুখের বসতি,
কেহ কিছু ইহা জানে(৭)।
তাহার উপরে, পিরীতি বৈসয়ে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।।
————–
(১) “ভাব”–মধুর। মাধুর্য্য।
(২) “লাভ”–প্রেম।
(৩) “ধারা”–কারুণ্যামৃত, লাবণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত।
(৪) পাঠান্তর–“ভাবের মাঝারে”–বি, প্রি, প।
(৫) বিভিন্ন পাঠ–“ধারার উপরে, রসের স্থান, এমন জানিয়ে মোরা।।”-ঐ।
(৬) পাঠান্তর–“ফলের”–ঐ।
(৭) পাঠান্তর–“দুয়ের উপরে, দুয়ের বসাত, কেহ কিছু তাহা জানে।”–ঐ।
রাগাত্মিক পদ ।।
সতের সঙ্গে, পিরীরি করিলে,
সতের বরণ হয়।
অসতের বাতাস, অঙ্গেতে লাগিলে,
সকলি পলায়ে যায়।।
সোণার ভিতরে, তামার বসতি,
যেমন বরণ দেখি।
রাগের ঘরেতে, বৈদিক থাকিলে,
রসিক নাহিক লেখি।।
রসিকের প্রাণ, যেমতি করয়ে,
এমতি কহিব কারে।
টলিয়া না টলে, এমতি বুঝায়া,
মরম কহিব তারে।।
এমতি করণ, যাহার দেখিব,
তাহার নিকটে বসি।
চণ্ডীদাস কয়, জনমে জনমে,
হয়ে রব তার দাসী।।
——————
রাগাত্মিক পদ ।।
সহজ আচার, সহজ বিচার,
সহজ বলি যে কায়।
কেমন বরণ, কিসের গঠন,
বিবরিয়া কহ তায়।।
শুনি নন্দ সুত, কহিতে লাগিল,
শুন বৃষভানু ঝি।
সহজ পিরীতি, কোথা তার স্থিতি,
আমি না জেনেছি শুনেছি।।
আনন্দের আলস, ক্ষীরোদ সায়র,
প্রেম বিন্দু উপজিল।
গদ্য পদ্য হয়ে, কামের সহিতে,
বেগেতে ধাইয়া গেল।।
বিজুরী জিনিয়া, বরণ যাহার,
কুটিল স্বভাব যার।
যাহার হৃদয়ে, করয়ে উদয়,
সে অঙ্গ করয়ে ভার।।
এমতি আচার, ভজন যে করে,
শুনহ রসিক ভাই।
চণ্ডীদাস কহে, উহার উপরে,
আর দেখ কিছু নাই।।
—————-
রাগাত্মিক পদ ।।
সহজ (১) সহজ, সবাই কহয়ে,
সহজ জানিবে কে।
তিমির অন্ধকার, যে হইয়াছে পার,
সহজ জেনেছে সে।।
চান্দের (২) কাছে, অবলা (৩) আছে,
সেই সে পিরীতি সার।
বিষে অমৃতেতে, মিলন একত্রে,
কে বুঝিবে মরম তার।।
বাহিরে তাহার, একটি দুয়ার,
ভিতরে তিনটি আছে।
চতুর হইয়া, দুইকে ছাড়িয়া,
থাকিবে একের কাছে।।
যেন আম্র ফল, অতি সে রসাল,
বাহিরে কুশী ছাল কষা।
ইহার আস্বাদন, বুঝে যেই জন,
করই তাহার আশা।।
অভাগিয়া কাকে, স্বাদু নাহি জানে,
মজয়ে নিম্বের ফলে।
রসিক কোকিলা, জ্ঞানের প্রভাবে,
মজয়ে চ্যূত মুকুলে।।
নবীন মদন, আছে এক জন,
গোকুলে তাহার থানা।
কামবীজ সহ, ব্রজ বধূগণ,
করে তার উপাসনা।।
সহজ কথাটী, মনে করি রাখ,
শুনলো রজক ঝি।
বাশুলী আদেশে, জানিবে বিশেষে
আমি আর বলিব কি।।
রূপ করূনাতে, পারিবে মিলিতে, (৪)
ঘুচিবে মনেরি ধান্দা।
কহে চণ্ডীদাস, পুরিবেক আশ,
তবে ত খাইবে সুধা।।(৫)
————–
(১) প্রণয়।
(২) “চান্দ”–কৃষ্ণচন্দ্র।
(৩) “অবলা”–গোপীগণ।
(৪) পাঠান্তর–“আপনা বুঝিলে, লাখে এক মিলে”–বি, প্রি, প।
(৫) বিভিন্ন পাঠ–“চণ্ডীদাস বলে, পাবে হাতে হাতে, চারি অক্ষরে থাক বাঁধা।।”-ঐ।
রাগাত্মিক পদ ।।
ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া, আছয়ে যে জন,
কেহ না দেখয়ে তারে।
প্রেমের পিরীতি, যে জন জানয়ে,
সেই সে পাইতে পারে।।
পিরীতি পিরীতি, তিনটী আখর,
জানিবে ভজন সার।
রাগ মার্গে যেই, ভজন করয়ে,
প্রাপ্তি হইবে তার।।
মৃত্তিকার উপরে, জলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
তাহার উপরে পিরীতি বসতি,
তাহা কি জানয়ে কেউ।।
রসের পিরীতি, রসিক জানয়ে,
রস উদ্গারিল কে?
সকল ত্যজিয়া যুগল হইয়া,
গোলোকে রহিল সে।
পুত্র পরিজন, সংসার আপন,
সকল ত্যজিয়া লেখ।
পিরীতি করিলে, তাহারে পাইবে,
মনেতে ভাবিয়া দেখ।।
পিরীতি পিরীতি, তিনটী আখর,
পিরীতি ত্রিবিধ মত।
ভজিতে ভজিতে, নিগূঢ় হইলে,
হইবে একই মত।।
পরকীয়া ধন, সকল প্রধান,
যতন কইয়া লই।
নৈষ্ঠিক হইয়া, ভজন করিলে,
পদ্ধতি সাধক হই।।
পদ্ধতি হইয়া, রস আস্বাদিয়া,
নৈষ্ঠিকে প্রবৃত্ত হয়।
তাহার চরণ, হৃদয়ে ধরিয়া,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।
————–
রাগাত্মিক পদ ।।
সাধন শরণ, এ বড় কঠিন,
বড়ই বিষম দায়।
নব সাধু সঙ্গ, যদি হয় ভঙ্গ,
জীবের জনম তার।।
অনর্থ নিবৃত্তি, সভে দুরগতি,
ভজন ক্রিয়াতে রতি।
প্রেম গাঢ় রতি, হয় দিবা রাতি,
হয়ে যে যাহাতে প্রীতি।।
আসক উকত, সবে দুরগত,
সদগুরু আশ্রয়ে হবে।
রতি আস্বাদন, করহ বতন,
সখীর সঙ্গিনী হবে।।
দেহ রতি ক্ষয়, কুপত রতি হয়,
সাধক সাধন পাকে।
চণ্ডীদাসে কয়, বিনা দুঃখে নয়,
কিশোরী চরণ দেখে।।
—————–
রাগাত্মিক পদ ।।
কাতরা অধিকা, দেখিয়া রাধিকা,
বিশাখা কহিল তায়।
চিতে এত ধনি, ব্যাকুল হইলে,
ধরম সরম যায়।।
পাইয়া কামরতি, হবে অন্য পতি,
তাহাতে বলাব সতী।।
স্নান না করিব, জল না ছুঁইব
আলাইয়া মাথার কেশ।
সমুদ্রে পশিব, নীরে না তিতিব,
নাহি সুখ দ্যঃখ ক্লেশ।।
রজনী দিবসে, হবে পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা।
একত্র থাকিব, নাহি পরশিব,
ভাবিনী ভাবের দেহা।।
অন্যের পরশে, সিনান করিব,
তবে সে রীতি সাজে।
কহে চণ্ডীদাস, এ বড় উল্লাস,
থাকিব যুবতী মাঝে।।
————–
অন্য পতি – প্রেম।
সমুদ্রে – প্রেম সমুদ্রে।
পরবশে–শ্রীকৃষ্ণের বশে।
অন্যের পরশে সিনান করিব – অন্যের স্পর্শে তৎক্ষণাৎ দান করিব অর্থাৎ ভ্রষ্টা হইব না।
রাগাত্মিক পদ ।।
হইলে সুজাতি, পুরুষেরি রীতি,
যে জাতি নায়িকা হয়।
আশ্রয় লইলে, সিদ্ধ রতি মিলে,
কখন বিফল নয়।।
তেমতি নায়িকা, হইলে রসিকা,
হীন জাতি পুরুষেরে।
স্বভাব লওয়ায়, স্বজাতি ধরায়,
যেমত কাচপোকা করে।।
সহজ করণ, রতি নিরুপণ,
যে জন পরীক্ষা জানে।
সেইত রসিক, হয় ব্যবসিক,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভনে।।
রাগাত্মিক পদ ।।
মিলা অমিলা দুই রসের লক্ষণ।
নায়ক নায়িকা নাম লক্ষণ কথন।।
পূর্ব্বরাগ হইতে সীমা সমৃদ্ধিমান আদি।
রসের ভঞ্জিত ক্রমে যতেক অবধি।।
পতি উপপতি ভাবে দ্বাদশ যে রস।
পুন যে দ্বিগুণ হইয়া করয়ে প্রকাশ।।
কন্যার বিবাহ আর অন্যের উপপতি।
ভাব ভেদে এই হয় চব্বিশ রস রীতি।।
পুন চারি গুণ করি হয় ছেয়ানই।
অনুকূল দক্ষিণ ধৃষ্ট আর শট তাই।।
এই সব নাম ভেদে নায়কের ভেদ।
পুন হয় তাহার লক্ষণ বিভেদ।।
এই সব্র গুণ কৃষ্ণ চন্দ্রে একা বর্ত্তে।
চণ্ডীদাস কহে রস ভেদ এক পাত্রে।।
রাগাত্মিক পদ ।।
প্রবর্ত্ত দেহের সাধনা করিলে কোন্ বরণ হব।
কোন্ কর্ম্ম যাজন করিলে কোন্ বৃন্দাবনে যাব।।
নব বৃন্দাবনে নব নাম হয়, সকল আনন্দময়।
কোন্ বৃন্দাবনে ঈশ্বর মানুষে মিলিত হইয়া রয়।।
কোন্ বৃন্দাবনে বিরজা বিলাসে, তরুলতা চারি পাশে।
কোন্ বৃন্দাবনে কিশোর কিশোরী, শ্রীরূপমঞ্জরী সাথে।।
কোন্ বৃন্দাবনে রস উপজয়ে সুধার জনম তায়।
কোন্ বৃন্দাবনে বিকশিত পদ্ম, ভ্রমরা পশিছে তায়।।
গোপতের পথ, না হয় বেকত রসিক জনার সনে।
উপাসনা ভেদ যাহার হয়েছে সেই সে মরম জানে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাস না জানিয়ে তত্ত্ব কেমনে হইবে পার।
উত্তম কুলেতে, লভিয়ে জনম ছি নীচ সহ ব্যবহার।।*
————–
* পদসমুদ্র
রাগাত্মিক পদ ।।
নায়িকা সাধন, শুনহ লক্ষণ,
যে রূপে সাধিতে হয়।
শুষ্ক কাষ্ঠের সম,
আপন দেহ করিতে হয়।।
সে কালে রমণ, অতি নিত্য করণ,
তাহাতে যে সাধন হবে।
মেঘের বরণ, রতির গঠন,
তখন দেখিতে পাবে।।
সে রতি সাধন, করেন যে জন,
সেই সে রসিক সার।
ভ্রমর হইয়া, সন্ধান পুরিয়া,
মরম বুঝয়ে তার।।
তাহার উপর, জলদ বরণ,
রতির বরণ হয়।
সাধিতে সে রতি, কাহার শকতি,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।
—————–
রাগাত্মিক পদ ।।
সজনি শুনগো মানুষের কাজ।
এ তিন ভুবনে, সে সব বচনে,
কহিতে বাসিবেক লাজ।।
কমল উপরে, জলের বসতি,
তাহাতে বসিল তারা।
তাহাদের তাহাদের, রসিক মানুষ,
পরাণে হানিছে হারা।।
সুমেরু উপরে, ভ্রমর পশিল,
ভ্রমর ধরি ফুল।
তাহাদের তাহাদের, রসিক মানুষ,
হারায়েছে জাতি কুল।।
হরিণ দেখিয়া, বেয়াধ পলায়,
কমলে গেল সে ভৃঙ্গ।
যমের ভিতরে, আলসের বসতি,
রাহুতে গিলিছে চন্দ্র।।
সুমেরু উপরে, ভ্রমর পশিল,
এ কথা বুঝিবে কে?
চণ্ডীদাস কহে, রসিক হইলে,
বুঝিতে পারিবে সে।।
————-
রাগাত্মিক পদ ।।
সে কেমন যুবতী, কুলবতী সতী,
সুন্দর সুমতি সার।
হিয়ার মাঝারে, নায়কে লুকাইয়া,
ভব নদী হয় পার।।
ব্যভিচারী নারী, না হবে কাণ্ডারী,
নায়কে বাচিয়া লবে।
তার অবছায়া, পরশ করিলে,
পুরুষ-ধরম যাবে।।
সে কেমন পুরুষ, পরশ রতন,
সেবা কোন্ গুণে হয়।
সাতের বাড়ীতে, পাষাণ পড়িলে,
পরশ পাষাণময়।।
সাতের বাড়িতে, ক্ষীরোদ নদী,
নারায়ণ শুভ যোগ।
সেই যোগেতে, স্থাপন কইলে,
হয় রকনী মনহ যোগ।।
রমণ ও রমণী, তারা দুই জন,
কাঁচা পাকা দুটী থাকে।
এক রজ্জু, খসিয়া পড়িলে,
রসিক মিলয়ে তারে।।
মনের আগুন, উঠিছে দ্বিগুণ,
তোলা পাড়া হবে সার।
চণ্ডীদাস কহে, ধন্য সে নারী,
তলাটে নাহিক আর।।
রাগাত্মিক ।।
নারীর সৃজন, সে অতি কঠিন,
কেবা সে জানিবে তায়।
জানিতে অবধি, নারিলেক বিধি,
বিষামৃতে একত্রে রয়।।
যেমত দ্বীপিকা, উজরে অধিকা,
ভিতরে অনল-শিখা।
পতঙ্গ দেখিয়া, পড়য়ে ঘুরিয়া,
পুড়িয়া মরয়ে পাখা।।
জগত ঘুরিয়া, তেমতি পড়িয়া,
কামানলে পুড়ি মরে।
রসজ্ঞ যেজন, সে করয়ে পান,
বিষ ছাড়ি অমৃতেরে।।
হংস চক্রবাক, ছাড়িয়া উদক,
মৃণাল দুগ্ধ সদা খায়।
তেমতি নাহিলে, কোথা প্রেম মিলে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।।
রাগাত্মিক ।।
এ তিন ভুবনে ঈশ্বর গতি।
ঈশ্বর ছাড়িতে পরে শকতি।।
ঈশ্বর ছাড়িলে দেহ না রয়।
মানুষ ভজন কেমনে হয়।।
সাক্ষাত নহিলে কিছুই নয়।
মনেতে ভাবিলে স্বরূপ হয়।।
কহয়ে চণ্ডীদাস বুঝয়ে ঞে।
ইহার অধিক পুছয়ে যে।।
রাগাত্মিক ।।
রাগের ভজন, শুনিয়া বিষম,
বেদের আচার ছাড়ে।
রাগানুগমেতে, লোভ বাড়ে চিতে,
সে সব গ্রহণ করে।।
ছাড়িতে বিষম, তাহার করণ,
আচার বিষম না পারে।
অতি অসম্ভব, অলৌকিক সব,
লৌকিকে কেমনে করে।। (১)
করিয়া গ্রহণ, না করে যাজন,
সে কেন সাধন করে।
বুঝিতে না পারে, আনা গোনা করে,
ফাঁফরে পড়িয়া মরে।।
তার একুল ওকুল, দুকুল গেল,
পাথারে পড়িল সে।
চণ্ডীদাস কয়, সে দেব নয়,
তাহারে তরাবে কে।।
—————–
(১) বিভিন্ন পাঠ—
“যজিতে বিষম, করণ তাহার,
আচার বিষম বড়।
দেখিয়া শুনিয়া, মায়াতে ভুলিয়া,
করিতে না পারে দিঢ়।।”
-হ, লি, পু।
রাগাত্মিক ।।
এরূপ মাধুরী যাহার মনে।
তাহার মরম সেই সে জানে।।
তিনটী দুয়ারে যাহার আশ।
আনন্দ নগরে তাহার বাস।।
প্রেম সরোবরে দুইটী ধারা।
আস্বাদন করে রসিক যারা।।
দুই ধারা যখন একত্রে থাকে।
তখন রসিক যুগল দেখে।।
প্রেমে ভোর হয়ে করয়ে আন।
নিরবধি রসিক করয়ে পান।।
কহে চণ্ডীদাস ইহার সাক্ষী।
এরূপ সাগরে ডুবিয়া থাকি।।
———-
রাগাত্মিক ।।
স্বরূপ বিহনে, রূপের জনম,
কখন নাহিক হয়।
অনুগত বিহনে, কার্য্য সিদ্ধি,
কেমনে সাধকে কয়।।
কেবা অনুগত, কাহার সহিত,
জানিব কেমনে শুনে।
মনে অনুগত, মুঞ্জরী সহিত,
ভাবিয়া দেখহ মনে।।
দুই চারি করি, আটটা আঁখর,
তিনের তিনের জনম তায়।
এগার আঁখরে, মূল বস্তু জানিলে,
একটি আঁখর হয়।।
চণ্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই।
সবার উপর, মানুষ সত্য,
তাহার উপর নাই।।
——————-
স্বরূপ – প্রকৃতি পুরুষ—রাধাকৃষ্ণ।
আটটা আখর – অষ্ট সখী। ললিতা, বিশাখা, চম্পকলতা, চিত্রা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, রঙ্গদেবী, ও সুদেবী—এই অষ্টসখী।
তিন – পিরীতি।
এগার আখর – দশ ইন্দ্রিয় ও মন।
মূল বস্তু – সেবা।
একটি আখর – ক, (কৃষ্ণ)।
রাগাত্মিক ।।
প্রবর্ত সাধিতে বস্তু অনায়াসে উঠে।
নামাইতে বস্তু সাধক বিষম সঙ্কটে।।
নামান আনন্দ মন কহিয়া নির্দ্ধারি।
পৌষ মাঘ মাসের শিশির কুম্ভে ভরি।।
সেই পূর্ণ কুম্ভ যৈছে সেবে পাতে ঢালি।
সর্ব্বাঙ্গে মস্তকে পাদ করয়ে শীতলি।।
তৈছে সাধকের সেই সন্ধানের কার্য্য।
তারণ্যামৃত ধারা তার নাম কৈল ধার্য্য।।
লাবণ্যামৃত ধারা কহি সিদ্ধে সঙ্কেতে।
কারুণ্যামৃত স্নান কহি প্রবর্ত্ত দশাতে।।
সংক্ষেপে কহিল তিন স্নানের বিধান।
সম্যক্ কহিতে নারি বিদরে পরাণ।।
অটল পরেতে এই পদ গুরু মর্ম্ম।
চণ্ডীদাস লেখে ব্যক্ত আপনার ধর্ম্ম।। *
——————-
* শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী মহাশয়ের শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যখণ্ড অষ্টম পরিচ্ছেদের মহাভাব বর্ণনের বোধ হয় ইহাই অবলম্বন।
রাগাত্মিক ।।
পুরুষ প্রকৃতি, দোঁহে এক রীতি,
সে রতি সাধিতে হয়।
পুরুষেরি যুতে, নায়িকার রীতে,
যেমতে সংযোগ পায়।।
পুরুষ সিংহেতে, পদ্মিনী নারীতে,
সে সাধন উপজয়।
স্বজাতি অনুগা, সোণাতে সোহাগা,
পাইলে গলিয়া যায়।।
যে জাতি যুবতী, সাধিতে সে রতি,
কুজাতি পুরুষে ধরে।
কণ্টকে যেমত, পুষ্প হয় ক্ষত,
হৃদয় ফাটিয়া মরে।।
পুরুষ তেমতি, নারী হীন জাতি,
রতির আশ্রয় লয়।
ভূতে ধরে তারে, মরে ঘুরে ফিরে,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।
রাগাত্মিক ।।
আমার পরাণ, পুতলী লইয়া,
নাগর করে পূজা।
নাগর পরাণ, পুতলী আমার,
হৃদয় মাঝারে রাজা।।
আনের পরান, আনে করে চুরি,
তিন আনে নাহি জানে।
আগন নিগম, দুর্গম সুগম,
শ্রবণ নয়ন মনে।।
এই সাত নদী, অনন্ত অবধি,
এই সাত যে দেশে নাই।
সে দেশে তাহার, বসতি নগর,
এ দেশে কি মতে পাই।।
এ সব করণ, করে যেই জন,
সে জন মাথার মণি।
মরিলে সেজন, জীয়াতে পারে,
অমৃত রস আনি।।
হ্রীং সে অক্ষর, তাহার উপর,
নাচে এক বাজীকর।
এক কুমুদিনী, দুন্দুভি বাজায়,
বাঁশী জিনি তার স্বর।
দুন্দুভি বাঁশীটী, যখন বাজিবে,
তা শুনে মরিবে যে।
রসিক ভকত, ভুবনে ব্যক্ত,
সখীর সঙ্গিনী সে।।
এ সব ব্যবহার, দেখিব যাবার,
তাহার চরণ সার।
মন-সূতা দিয়া, তাহার চরণ,
গাথিয়া পরিব হার।।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে,
কাঁচা পাকা দুই ফল।
যে ফল লইবে, সে ফল পাইবে,
তেমতি তাহা বিরল।।
————–
রাগাত্মিক ।।
সদা বল তত্ত্ব তত্ত্ব কত তত্ত্ব শুন।
চব্বিশ তত্ত্বে হয় দেহের গঠন।।
পঞ্চভূত ক্ষেত্র তেজ মরুৎ ব্যোম আপ।
ষড় রিপু কাম ক্রোধ লোভ মদ মাৎসর্য্য দম্ভ।।
দশ ইন্দ্র ক্ষত তারা হয়ত পৃথক্।
জ্ঞানেন্দ্রিয় কর্ম্মেন্দ্রিয় দ্বিবিধ নামাত্মক।।
জ্ঞানেন্দ্রিয় জীহ্বা কর্ণ নাসাত্বক চক্ষু।
কর্ম্মেন্দ্রিয় হস্ত পদ গুহ্য লিঙ্গ বপু।।
মহ্যভূত অহঙ্কার আর হয় জ্ঞান।
এইত হয় চব্বিশ তত্ত্ব নিরূপণ।।
কিবা কারিকরের আজব কারিকুরি।
তার মধ্যে ছয় পদ্ম রাখিয়াছে পুরি।।
সহস্রারে হয় পদ্ম সহস্রক দল।
তার তলে মণিপুর পরম শিবের স্থল।।
নাসামূলে দ্বিদল পদ্ম খঞ্জনাক্ষী।
কণ্ঠে গাঁথি ষোড়শ দল পদ্ম দিল রাখি।।
হৃদ-পদ্ম নির্ম্মিত আছে শত দলে।
কুল কুণ্ডলিনী দশ দল হয় নাভি মূলে।।
নাভির নিম্নভাগে প্রেম সরোবর।
অষ্টদল পদ্ম হয় তাহার ভিতর।।
তস্য পরে নাড়ী ধরে সার্দ্ধ তিন কোটি।
স্থূল সূক্ষ্ম বত্রিশ তারা কিবা পরিপাটি।।
লিঙ্গ মূলে ষড়দলাম্বূজ নিযোজিত।
গুহ্য মূলে চতুর্দ্দল পদ্ম বিরাজিত।।
এই অষ্ট পদ্ম দেহ মধ্যেতে আছয়।
মতান্তরে হৃদপদ্ম দ্বাদশ দল কয়।।
সহস্র দল অষ্টদল দেহ মধ্যে নয়।
এই দুই পদ্ম নিত্য বস্তুর আধার হয়।।
ষট চক্রের মূল মৃণাল হয় মেরুদণ্ড।
শিরসি পর্য্যন্ত সে ভেদ করি অণ্ড।।
দন্ত দুই পার্শ্বেতে ঈড়া পিঙ্গলা রহে।
মধ্যেস্থিত সুষমণা সদা প্রবল বহে।।
মূল চক্র হয় হংস যোগের আধার।
অষ্টদল চক্রে লীলার সঞ্চার।।
দ্বিদল চক্রেতে হয় অমৃত নির্ভর।
আর পঞ্চ চক্রে পঞ্চ বায়ুর সঞ্চার।।
প্রাণ অপান ব্যান উদান সমান।
কণ্ঠাম্বুজবধি চতুর্দ্দলে অবস্থান।।
কণ্ঠ পরে উদান হৃদিতে বহে প্রাণ।
নাভির ভিতরে সমান করে সমাধান।।
চতুর্দ্দলে অপান সর্বভূতেতে ব্যান।
মুখ্য অনুলোম বিলোম সকল প্রধান।।
অজপা নামেতে তারা কুম্ভক রেচক।
অনুলোম ঊর্দ্ধরেতা বিলোম প্রবর্ত্তক।।
প্রবর্ত্ত সাধক হৃদ-নাভি পদ্মের আশ্রয়।
সিদ্ধার্থ সহস্রারে আছয়ে নিশ্চয়।।
রতি স্থির প্রেম সরোবর অষ্টদলে।
সাধনের মূল এই চণ্ডীদাসে বলে।।
————
রাগাত্মিক ।।
মতান্তরে যে কহয়ে শুনহ নিশ্চয়।
মস্তক উপরে সহস্র দল পদ্ম কয়।।
ভ্রূ মধ্যে দ্বিদল কণ্ঠে ষোলদল।
হৃদি মধ্যে দ্বাদশ নাভিমূলে দশদল।।
লিঙ্গমূলে ষড়দল চতুর্দ্দশ গুহ্যমূলে।
বস্তু ভেদ আছে তার চণ্ডীদাস বলে।।
সাধন তত্ত্বে তার যোগ নাহি হয়।
বৈধিযোগ এই তত্ত্বে হয় ত নিশ্চয়।।
————–
রাগাত্মিক ।।
চৌদ্দ ভুবনে ভুবন তিন।
সপ্ত আখর তাহার চিন।।
দুইটী আখরে সদা পিরীতি।
তিনটী পরশে উপজে রতি।।
নির্জ্জন কাননে আছয়ে ঘর।
দুইটী আখর পাঁচের পর।।
কনক আসন আছয়ে তাতে।
মনসিজ রাজা বৈসয়ে যাতে।।
কর্পূর চন্দন শীতল জলে।
যেমন আনন্দ লেপন কালে।।
তাপিত জনে সে আনন্দ পায়।
শীত ভীত জন ভয়ে পলায়।।
পঞ্চ রস আদি একত্রে মেলি।
যে যার স্বভাব আনন্দে কেলি।।
অষ্ট আখর একত্র যবে।
কনক আসন জানিবে তবে।।
পঞ্চ রস অনুবাদ যে হয়।
আদি চণ্ডীদাস বিধেয় কয়।।
——————-
বীরভূম জেলার অন্তঃপাতি সিউড়ি নিবাসী শ্রীযুক্ত কুঞ্জলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এইরূপ, যথা—
চৌদ্দ ভুবন – সপ্ত স্বর্গ ও সপ্ত পাতাল।
ভুবন তিন – ব্রজ, গোলক ও দ্বারকা।
সপ্ত আখর – রাধা, রমণ, কুঞ্জ।
দুইটী আখর – রাধা।
তিনটী আখর – রমণ।
নির্জ্জন কানন – রাধারমণ, পরে কুঞ্জ।
অষ্টম আখর – “স্থ” অর্থাৎ রাধারমণ কুঞ্জস্থ।
শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এই :—
চৌদ্দ ভুবন – চতুর্দ্দশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট দেহ। চতুর্দ্দশ ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয়, চারি অন্তরেন্দ্রিয়।
ভুবন তিন – ভাব, কান্তি ও বিলাস। ইহা সপ্তাক্ষর বিশিষ্ট। কবির রীত্যানুসারে এ স্থলে অক্ষর গণনা হইয়াছে; তৎপ্রমাণ “পিরীতি—আখর তিন”।
দুইটী আখর – ভাব। ইহাএ সর্ব্বদা প্রীতি বিরাজ করে।
তিনটী আখর – বিলাস। ইহাই রতির কারণ।
নির্জ্জন কানন ইত্যাদি – হৃদয়রূপ নির্জ্জন কাননস্থিত পঞ্চভূত আত্মার পর; বা কান্তি বিলাসের পর দুইটী আখর “ভাব”।
কনক আসন ইত্যাদি – ষট্চক্রমতে হৃদয়স্থিত রত্নবেদিকায় অভিন্ন মদন শ্রীকৃষ্ণ রাধা সহ বিরাজ করেন।
পঞ্চ রস – শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য, মাধুর্য্য।
অষ্টম আখর – ভাব কান্তি বিলাসের পর “জ্ঞা” এই বর্ণ যুক্ত হইয়া “ভাব কান্তি বিলাসজ্ঞ” শ্রীকৃষ্ণকেই বুঝাইতেছেন এবং তদীয় অধিষ্ঠান বশতঃই হৃদয় “কনক আসন” রূপে ব্যক্ত হয়।
পঞ্চ রস ইত্যাদি – প্রাগুক্ত পঞ্চরস মধ্যে, চণ্ডীদাসের মতে মাধুর্য্য বা শৃঙ্গার রস প্রধান। তৎপ্রমাণ, “সব রস সার শৃঙ্গার এ” ইত্যাদি পদ।
বীরভূমের অন্তর্গত সাঁকুলিপুর গ্রামবাসী শ্রীযুক্ত জীউলাল মজুমদারের প্রতিপাদিক অর্থের কতকাংশ এই :—
চৌদ্দ ভুবন – সপ্ত স্বর্গ ও সপ্ত পাতাল। ভূলোক, ভূবর্লোক, স্বর্লোক, মহল্লোক, জনলোক, তপলোক ও সত্যলোক, এই সপ্ত স্বর্গ। অতল, বিতল, সুতল, তল, তলাতল, রসাতল ও পাতাল, এই সপ্ত পাতাল।
ভুবন তিন – গোলোক, বৈকুণ্ঠ, শ্রীবৃন্দাবন।
মনসিজ রাজা – অপ্রাকৃত মদন শ্রীকৃষ্ণ।
রাগাত্মিক ।।
ব্রহ্ম রন্ধ্রে সহস্র দল পদ্মে রূপের আশ্রয়।
ইষ্টে অধিষ্ঠাতা তার স্বরূপ লক্ষণ হয়।।
সেই ইষ্টে যাহার হয় গাঢ় অনুরাগ।
সেই জন লোক ধর্ম্মাদি সব করে ত্যাগ।।
কায় মন বাক্যে করে গুরুর সাধন।
সেই ত করণে উপজয়ে প্রেম ধন।।
তাতে যদি কোন বাধা মনে উপজিবে।
চণ্ডীদাস বলে সে নরকে ডুবিবে।। *
——————-
* পদসমুদ্র।
আপনাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
আমার একটি জিজ্ঞাসা আছে।
চণ্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই।
সবার উপর, মানুষ সত্য,
তাহার উপর নাই॥
এখানে ’মানুষ’ বলতে কাকে চণ্ডীদাস মূলত কাকে নির্দেশ করেছেন। পরমাত্মা (শ্রীকৃষ্ণ)?লালন যাকে বলেছেন ‘মনের মানুষ’। নাকি গণমানুষ, সাধারণ মানুষ। পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটি লিখেছেন :
গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।
শুভেচ্ছা
আসলাম আহসান
ঢাকা, বাংলাদেশ
দীনেশচন্দ্র সেনের মতে এখানে মানুষ বলতে গুরুকে বোঝানো হয়েছে।
এখানে মানুষ বলতে বিরযো অর্থাত্ বিজওরুপে কৃষ্ণ উর্ধ্বমুখী গুরু