২৫. মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে কলকাতায়

আপনে খাহিশ-এ মুর্দহ্-কো রোঈয়ে
থী হমকো উসসে স্যাঁকাড়ো উম্মীদবারিয়াঁ।
(নিজের মৃত বাসনার কান্না কাঁদো,
ওর কাছ থেকে কতশত না আশা ছিল আমার মনে।)

মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে কলকাতায় গিয়ে যখন পৌঁছলুম, তখন সেখানে বসন্ত। মনপ্রাণ আমার জুড়িয়ে গেল মান্টোভাই, দিল্লিতে তো বাহারকে সেভাবে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু কলকাতা বাংলা, শুধু সবুজ আর সবুজ, একই সবুজ রংয়ের কত যে লীলা প্রকৃতিতে, তা বাংলায় না। গেলে জানতেই পারতুম না। বসন্তে এক আশ্চর্য বাতাস বয় সেখানে, আমার দোস্তরা বলত, সেই হাওয়ায় নাকি প্রেমের নেশা মিশে থাকে। আমিও টের পেয়েছি। মসলিনের স্পর্শের মতো সেই হাওয়া আপনাকে ছুঁয়ে গেলেই বেচায়েন হয়ে উঠবেন, মনে হবে, অধরা কেউ আপনার জন্য কোথাও অপেক্ষা করে আছে। আর তখন বসন্তের হাওয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হবে। মনে হবে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে যাই। মীরসাবের সেই শেরটা মনে পড়ত :

জ্যায়সে নসীম হর শহর তৈরী করূহুঁ জুস্তজু,
খান বখানহ্ দর বদর শহর বহ্ শহর কূ বহ্‌ কূ।
(যেন আমি সমীরণ, প্রতি প্রত্যুষে তোমাকে খুঁজে বেড়াই
ঘরে ঘরে, দুয়ারে দুয়ারে, অলিতে গলিতে, নগর নগরান্তরে।)

আমার দোস্ত রাজা শোহনলাল সিমলা বাজেরে মির্জা আলি সওদাগরের হাভেলিতে ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ভাড়া মাসে দশ টাকা। সঙ্গের ঘোড়াটাকে বেচে দিয়ে যাতায়াতের জন্য একটা পালকি ভাড়া নিলুম। ঠিক করলুম, পঞ্চাশ টাকার বেশি কিছুতেই মাসে খরচ করব না। কী মান্টোভাই, আপনার এই মির্জাকে চিনতে পারছেন? শাহজাহানাবাদ থেকে বেরিয়ে কলকাতায় আসতে আসতেই আমি বুঝতে পারছিলুম, একের পর এক সমঝোতা না করে গেলে, জীবনটাকে টেনে নিয়ে যাওয়াই অসম্ভব। আর আমাকে তো সমঝোতা করতেই হবে। মাথায় দেনার বোঝা নিয়ে আমি কলকাতায় এসেছি পেনশনের ব্যাপারটা ফয়সালা করতে। কিছু হল না। ভাইজানেরা আমি যে ফকির, সেই ফকির হয়েই ফিরে গেলাম দিল্লিতে। ইংরেজের কাছে বিচার পাব বলে কলকাতায় গিয়েছিলুম, পাথরে মাথা কুটে আমাকে ফিরে যেতে হল। সে সব কথা বলে আপনাদের মন ভার করতে চাই না। মোট কথা বছরে পাঁচ হাজার টাকা পেনশনই মেনে নিতে হল।

কিন্তু কলকাতা আমাকে যা দিল, তা কী করে ভুলব বলুন, ভাইজানেরা। দুনিয়াতে এমন তরতাজা এক শহর, এ-তো আল্লারই দান। সম্রাটের সিংহাসনে বসার চেয়েও ময়দানের সবুজ ঘাসে বসে থাকা যে কী আনন্দের, আহা গঙ্গা থেকে ভেসে আসা ওই হাওয়া আর কোথায় পাব বলুন! সকালে বিকেলে গোরা মেয়েরা ঘোড়ায় চেপে ময়দানে ঘুরছে, যেমন তাগড়াই আরবি ঘোরা, তেমনই গোরাসুন্দরীরা, মনে হত, সবুজ মাঠে যেন এক -একটা ছবি আঁকা হচ্ছে। ঘোড়ার গতির সঙ্গে বদলে যায় তাদের শরীরের ভঙ্গিমা, যেন একেকটা তীর বুকে এসে বেঁধে। তেমন জবরদস্ত লাটসাহেবের বাড়ি, আর চৌরঙ্গি অঞ্চলের বাগানঘেরা বাড়িগুলো দেখে কী যে লোভ হত। সে সব সাহেবদের বাড়ি। বিশ্বাস করুন মান্টোভাই, পরিবারের দায় না থাকলে। আমি ওই শহরেই থেকে যেতুম। গোরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এমন নির্মল হাওয়া আর জল তো শাহজাহানাবাদে নেই। জন্নত, একেবারে জন্নত।

কলকত্তে কো যে জিকর কিয়া তুনে হমনশীঁ
এক তীর মেরে সিনে মে মারা কে হায় হায়।
উয়ো সবজ জার হায় মর্তরা কে হ্যায় গজব।
উয়ো নাজনিন্ বতান-এ খুদ আরা, কে হায় হায়।
সবর আজমাঁ উয়ো উন্ কী নিগাহ হ্যাঁয় কে হ নজর
তাকতরুবা উয়ো উন্ কা ইশারা কে হায় হায়।
উয়ো মেওয়ে হায় তাজহ্ শিরিন্ কে ওয়াহ্ ওয়াহ্
উয়ো বা হায় না-এ-নওয়ারা কে হায় হায়।
(কলকাতার কথা যেই তুমি বললে হে বন্ধু,
আমার হৃদয় যেন তিরের আঘাতে রক্তাক্ত হল।
সেই নিবিড়, সবুজ শ্যামলিকা,
সেই নারীদের রূপ,
সে কটাক্ষ, সে ইশারা
সবলতম বক্ষকেও বিদ্ধ করল।
ধন্য তার তাজা মধুর ফল,
অবিস্মরণীয় তার মদিরা রসাল।)

কলকাতার মত ভাল শরাব আগে কখনও খাইনি। আর আম। কলকাতায় এসেই আমি আমের প্রেমে পড়লুম। আগেও আম খেয়েছি। কিন্তু বাংলার আম যেন দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আশিকের চুম্বন। দেখলেই আমার জীব লক লক করে উঠত। এক একটা টুকরো মুখে ফেলে চোখ বুজে আসত আমার, জন্নতের সব ফলও যদি আপনার সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয়, কলকাতার আমের কথা আপনি কখনও ভুলতে পারবেন না, মান্টোভাই। এমনই পেটুক আমি যে একবার হুগলির ইমামবাড়ার মুতাল্লিকেও আম পাঠানোর জন্য চিঠি লিখে ফেললুম। মুতাল্লিসাব, আমি চাই সেই ফল, দস্তরখানে যাকে সাজালে যেমন সুন্দর লাগে, তেমনই মনপ্রাণ ভরে ওঠে। আপনি তো জানেনই, একমাত্র আমেরই সেই গুণ আছে। আর হুগলির আমের তো তুলনা। নেই, যেন বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা ফুল। আমের মরশুম শেষ হওয়ার আগেই দু – তিনবার যদি আমার কথা স্মরণ করেন, তবে কৃতার্থ হব। মুতাল্লিসাব আমার আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন। আমার চাকরেরা রাত থেকে আম জলে ভিজিয়ে রাখত, সকালে একবার খেতুম, তারপর আবার দুপুরের পরে। ঠাণ্ডা আমের স্বাদ কেমন জানেন, মান্টোভাই? যেন আপনি। সবচেয়ে প্রিয় নারীর সারা শরীর লেহন করছেন।

আমের কথা এল বলে দু -একটা কিস্সা বলি আপনাদের। আসলে কিস্সা নয়। কিন্তু আমার জীবন তো এখন একটা কিস্যাই। শাহজাহানাবাদের হাকিম রাজিউদ্দিন খাঁ আমার খুব দোস্ত ছিলেন, তিনি আবার আম খেতেন না। একদিন হাভেলির বারান্দায় আমরা দুজনে বসে আছি। গলি দিয়ে একটা লোক গাধা নিয়ে যাচ্ছিল। গলিতে আমের অনেক খোসা পড়েছিল। গাধাটা খোসার গন্ধ শুকল, কিন্তু খেল না, হাকিমসাব হেসে বললেন, দেখুন, মির্জা, এত যে আম আম করেন, গাধাও তা খায় না।

আমি শুধু বললুম, সহি বাত। গাধার পক্ষে তো আমের স্বাদ বোঝা সম্ভব নয় হাকিমসাব।

হাকিমসাব প্রথমে হাসলেন, তারপর গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন মতলব?

আমি হাসতে হাসতে বললুম, কোনও গাধা-ই আম খায় না।

বুঝেছি, বলেই তিনি উঠে পড়লেন।

আমের ক্ষেত্রে আমি দুটো জিনিসই বুঝি, মান্টোভাই, খুবমিষ্টি হতে হবে আর যতক্ষণ খেতে চাইব, যেন খেতে পারি। কলকাতায় আমি দুটোই উপভোগ করেছি। শুধু তো খাওয়া নয়, জলে ভেজানো আমে মাঝে মাঝে গিয়ে হাত বোলাতুম, তাতে যে কী সুখ! চোখেরও কত আরাম। জলের ভেতর শুয়ে আছে ওরা। হিমসাগর, সূর্যোদয়ের হাল্কা কমলা রং ছড়িয়ে আছে তার। শরীরে; আবার ল্যাংড়া দেখুন, একেবারে সবুজ, মাঝে মাঝে হাল্কা হলুদের ছটা; গোলাপখাসের শরীরে কোথাও টকটকে লাল, কোথাও সবুজ বা হলুদ। আর কোনও ফলে এত রংয়ের খেলা নেই, মান্টোভাই। আমসুন্দরীদের কথা যেন বলে শেষ করা যায় না। আমার নেশা দেখে দূর দূর থেকে দোস্ত, শাগির্দরা কতরকম যে আম পাঠাত। বেগম একবার বলেছিল, এতই যখন আম ভালবাসেন, শরাব তো ছেড়ে দিতে পারেন।

-আমার বাইরের জীবন তো তুমি জানো, বেগম। তবু তোমাকে কি ছাড়তে পেরেছি? আমার দুই-ই চাই।

-আর আমার চাওয়া?

-তুমি তো চাও, ঠিক ঠিক শওহর হয়ে উঠব। এ জীবনে আর হবে না বেগম। কিন্তু তোমাকেও আমি ছাড়তে পারব না। নইলে কবেই তো তালাক দিতুম।

-কেন পারবেন না, মির্জাসাব?

-আমার বদখেয়ালির জীবনের আশ্রয় তো তুমি।

-তাই?

– না হলে সবকিছুর পরে এই হাভেলিতে কেন ফিরে আসি আমি? তোমার সঙ্গে সারাদিন একটা কথা না হলেও কেন মনে হয়, এখনও আমার ঘর আছে?

মান্টোভাই, বেগমকে আমি এসব কিছুই বলিনি। সব আমার খোয়াব-খোয়াবে বলা কথা। উমরাও বেগমের সঙ্গে স্বপ্নেই কথা বলতুম আমি। বেগমও নিশ্চয় একই ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলত। নইলে আর এতগুলো বছর কী করে একসঙ্গে থেকে গেলুম আমরা! কোথাও তো প্রাণ ছিল, আমরা দুজনেই চিনতে পারিনি।

প্রাণ! কী অলীক এক শব্দ। কলকাতায় গিয়েই শব্দটি শিখেছিলুম আমি। নবাব সিরাজুদ্দিন আহমদ, আমার কলকাতার দোস্ত, একদিন এসে বললেন, চলুন মির্জা, আপনাকে আজ এমন একজনের কাছে নিয়ে যাব, আপনার মন খুশ হয়ে যাবে।

-কে?

-নিধুবাবু।

ইনি কোথাকার বাবু?

-না, না, বাবু নন। তবে সবাই নিধুবাবুই বলে। আসল নাম রামনিধি গুপ্ত। তিনি গান লেখেন, গান করেন। তবে এখন আর গাইতে পারেন না।

-তবে গিয়ে কী হবে?

-কথা বলে আনন্দ পাবেন, মির্জা।

দিনের বেলাতেও অন্ধকার গলির ভেতরে দোতলা বাড়ির ছোট একটা ঘর। আমরা দুপুরের একটু পরে গিয়ে পৌঁছলুম। তখনও তিনি ঘুমিয়ে আছেন। চাকর গিয়ে তাঁকে ডাকতে তিনি আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। সিরাজুদ্দিনসাবের দিকে তাকিয়ে বললেন, হঠাৎ অবেলায় কেন নবাবসাব?

-আমার এক দোস্তকে নিয়ে এসেছি।

-গানবাজনা করেন?

-শায়র। দিল্লিতে থাকেন।

তিনি দুহাত তুলে নমস্কার করলেন, নবাবসাব আপনাকে নিয়ে এসেছেন। আমার বয়স আজ নব্বইয়ের কাছাকাছি। আপনাকে খুশ করার মতো আর কিছু নেই এই বান্দার জীবনে। গান তো এখন গাইতে পারি না।

-যদি ইচ্ছে হয়, দুটো-একটা শোনাবেন। সিরাজুদ্দিনসাব বললেন।

-ইচ্ছে হয়। কিন্তু গলা তো খোলে না নবাবসাব; যে গায়নে প্রাণ আসে না, তা কি গাওয়া যায়? আপনি তো জানেন।

-আপনি গাইলেই জন্নত নেমে আসবে।

-তা হয় না, নবাবসাব। আপনিও জানেন, আমিও জানি। কেন মিথ্যে বলছেন? নাভি থেকে স্বর আসে-স্বর থেকে সুর হয়-নাভি শুকিয়ে গেলে সুর কী করে জন্মাবে? আপনি তো জানেন, কাকের গলায় গান গেয়ে লোকভোলানো আমার পেশা নয়। আপনারা বসুন, বসুন-এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

সে ঘরে বসার আর কোনও ব্যবস্থা ছিল না; আমরা নিধুবাবুর বিছানাতেই গিয়ে বসলুম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় কোন কাজে এসেছেন?

আমি তাঁকে সব বললুম। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই হারামজাদারা এখানে এসেছে দেশটাকে শুষে খাবার জন্য। আপনার-আমার জন্য ওরা কিছু করবে না। আপনি সাধক রামপ্রসাদের গান তো শোনেন নি। নবাবসাব, আপনার মনে আছে?

আমার আশা আশা কেবল আসা মাত্র হল।

চিত্রের কমলে যেমন ভৃঙ্গ ভুলে গেল।

খেলব বলে ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতল।

এবার যে খেলা খেলালে মা গো আশা না পুরিল।

মির্জাসাব, ওই সায়েবদের মতো এই শহরেরও হৃদয় নেই। আপনি এখানে কিছু পাবেন না। দিল্লিতেই ফিরে যান। এ শহরে এখন নতুন বাবুদের উদয় হয়েছে, তারা বলে, নিধুবাবুর সব গান অশ্লীল। আরে গুখেগোর ব্যাটারা, তোর ইংরেজ ঠিক করে দেবে কোনটা শ্লীল আর অশ্লীল? তা হলে কবি ভরতচন্দ্রকে কোথায় জায়গা দিবি তোরা? বিদ্যাসুন্দরকে ধুয়েমুছে ফেলবি? ওই এক সায়েব শালা ডিরোজিও -মদ, মাংস খাইয়ে সবাইকে শেখাচ্ছে, ইংরেজের বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। আরে মদ -মাংস কি আমরা কম খেয়েছি? রাঁঢ়ও রেখেছি। তা বলে কি আমরা উচ্ছন্নে গেছি? একটা গান শুনুন তবে :

প্রাণ তুমি বুঝিলে না, আমার বাসনা।
ঐ খেদে মরি আমি, তুমি তা বুঝ না।
হৃদয় সরোজে থাক, মোর দুঃখ নাই দেখ,
প্রাণ গেলে সদায়তে, কি গুণ বল না।

বলুন নিধুবাবুর এই গান অশ্লীল?

পর পর টপ্পা গেয়ে চললেন তিনি। আর প্রতিটি গানেই ওই একটা শব্দ, প্রাণ। শব্দটি যখন তিনি উচ্চারণ করছিলেন, মনে হচ্ছিল, ফুটে-ওঠা পদ্ম যেন তুলে দিচ্ছেন আমাদের হাতে। গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে অনেকক্ষণ তিনি চুপচাপ বসে রইলেন।

সিরাজউদ্দিনসাব বলে উঠলেন, কি নসিব আমার। কতদিন পর আপনার গলায় গান শুনতে পেলাম।

নিধুবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, ফিরে যান মিঞা, দিল্লিতে ফিরে যান। কলকাতা আপনাকে কিছু দেবে না। শুধু অপমান পাবেন। যারা অন্ধ, তারা সবচেয়ে বেশী দেখে আজ। এখানকার মানুষ কেচ্ছা ছাড়া আর কিছু জানে না। মুর্শিদাবাদের মহারাজ মহানন্দ রায় বাহাদুর এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকতেন। শ্রীমতী নামে তাঁর এক বাঁধা রাঁঢ় ছিল। আমি রোজ সন্ধেবেলা গিয়ে গান গেয়ে মহারাজকে আনন্দ দান করতাম। কেন কে জানে, শ্রীমতীও। আমাকে ভালবাসতেন, আমি যতক্ষণ থাকতাম, যাতে অযত্ন না হয়, লক্ষ রাখতেন। সবাই রটিয়ে দিল, শ্রীমতী আমার রাঁঢ়। আমি তাঁকে মনে রেখে অনেক গান বেঁধেছিলাম, তাই বলে তিনি আমার রাঁঢ়? কলকাতা এ ভাবেই সবকিছু বোঝে। আরও কিছুদিন থাকুন, বুঝতে পারবেন। এখানে গুণের কদর নেই, শুধু ফটফটিয়ে কথা বলতে জানতে হবে। সব ইংরেজী শিক্ষার ফল মির্জা, ওরা নিজেদের বাইরে কাউকে মানুষ বলেই জ্ঞান করে না।

ফিরে আসার সময় কাঁধে হাত রেখে নিধুবাবু বললেন, হতাশ হবেন না মিঞাসাব, আপনার সামনে অনেক পথ। আমি তো শেষ হয়ে গেছি। তাই কিছু আজেবাজে কথা বললাম। নিধুবাবুর কথা যখন বললুম, তখন আরেক কবির গানের কথাও বলতে হবে। নিধুবাবুর অনেক আগেই এন্তেকাল হয়েছিল কবি রামপ্রসাদ সেনের। তিনি সাধক কবি, মান্টোভাই। শুনেছিলুম, মা কালি নাকি তাঁর মেয়ের রূপ ধরে এসে বাড়ির বেড়া বাঁধার কাজে হাত। লাগিয়েছিলেন। আরও কত যে কিস্সা তাঁকে নিয়ে। কাশীর দেবী অন্নপূর্ণা এসেছিলেন তাঁর গান শুনবেন বলে। যে বাবুর সেরেস্তায় তিনি চাকরি করতেন, সেখানকার হিসেবের খাতাতেই গান লিখতেন। তাঁর একটা গানের পিলু-বাহারের সুর অনেকদিন ভ্রমরের মতো মনের ভেতরে ঘুরে বেড়িয়েছিল, তা-ও একদিন হারিয়ে গেছে; ধীরে ধীরে সব রং, সব সুরই তো আমাকে। আলবিদা জানিয়েছে।

নিধুবাবাবুর কথা শুনে, তাঁর চোখ দিয়ে আমি আরেক কলকাতা দেখতে পেলুম মান্টোভাই। আর সেই কলকাতা-বুজুর্গের সম্মান দিতে যে জানে না -কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও পাঁকের মধ্যে এনে ফেলল। মাসের প্রথম রবিবার বড় একটা মুশায়েরা হত। একবার সেই মুশায়েরা-য় ফারসি গজল পড়তে আমাকে নেমন্তন্ন করা হল। অতবড় মুশায়েরা দিল্লিতেও হত না। প্রায় হাজার পাঁচেক লোকের জমায়েত। আমার গজল শুনে একদল লোক কতিলের নাম করে আমার গজলের ভাষা ও শৈলী নিয়ে প্রশ্ন তুলল। যে যাই বলুক, কতিলকে আমি কোনওদিনই বড় ফারসি কবি হিসেবে মানিনি। মনাব কী করে বলুন? সে তো আসলে ফরিদাবাদের ক্ষত্রী দিলওয়ালি সিং। পরে মুসলমান হয়েছিল। হ্যাঁ, আমির খসরু-র কথা বলুন, মানতে পারি। মুশায়েরা-য় এসব বলতেই তো চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আমার মনে পড়ে গেল। নিধুবাবুর কথা। তর্ক না বাড়িয়ে মুশায়েরা থেকে চলে এলুম। কিন্তু আমি চুপ করে থাকলে কী হবে? কতিলসাবের ভক্তরা কেন ছেড়ে দেবে আমায়? তারা পেছনে লেগে পড়ল। ভেবে। দেখলুম, আমি তো পেনশনের সুরাহা করতে এখানে এসেছি, লোকজনকে খেপিয়ে লাভ কী, কে কোন কাজে লাগবে, বলা তো যায় না। বাদ-এ-মুখালিফ নামে একটা কবিতা লিখে ক্ষমাপ্রার্থনা করলুম। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে সরে আসিনি, মান্টোভাই। সবাই খুব অবাক হয়ে গেল। রাজা শাহনলাল জিজ্ঞেস করলেন, এ কী করলেন মির্জাসাব?

-কেন?

-আপনি নিজেকে এতখানি ছোট করলেন কেন?

-হাতি গর্তে পড়লে পিপড়েও লাথি মারে, জানেন না? তখন ওঠবার জন্য পিঁপড়ের কাছেও মিনতি জানাতে হয়।

-তবু আপনি–

-আমি কেউ নই। বলতে পারেন অনন্তকাল ধরে পড়ে থাকা একটা ঘুম।

-মানে?

মানে কী ছাই, আমিও জানতাম। কথা মুখে আসে, বলে দিই। সবদিক ভেবে যদি কথা বলতে পারতুম, মান্টোভাই, তা হলে জীবনটা মখমল-মোড়া বিছানা হয়ে যেত। আমি তা চাইওনি। কলকাতা থেকে হতাশা নিয়ে দিল্লিতে ফিরলুম, তবু কলকাতার কথা ভুলতে পারলুম কোথায় বলুন? অনেক ছোট ছোট কথা মনে পড়ে জানেন। পেনশনের জন্য কত বড় বড় সায়েসুবোর সঙ্গে দেখা করেছি, তাদের কথা আর মনে নেই। অথচ এক মেছুনির কথা এখনও ভুলতে পারি না। আমি রোজ একজন চাকরকে নিয়ে সিমলাবাজারে যেতুম, ঘুরে ঘুরে মাছ- তরিতরকারি-ফল কিনতুম। তো সেই বাজারে এক মেছুনির সঙ্গে ভাব হয়ে গেছিল আমার। সে আমার জন্য প্রায়ই তোপসে মাছ নিয়ে আসত; সায়েবরা বলত ম্যাঙ্গো ফিস। কমলা রঙের ছোট ছোট মাছ। তোপসে মাছ ভাজা খেতে খুব ভালো লাগত। বিশেষ করে, শরাবের সঙ্গে তো জবাব নেই। সেই মেছুনির দু-এক কথার পর রোজ আমাকে একটা কিস্সা শোনাত। তখন কেউ মাছ কিনতে এলেও সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলত, যাও দিকিনি, দেকছো না, মিঞার সঙ্গে মনের কথা বলতিছি।

খদ্দের বলত, মনের কথা? তাহলে মাছ বেচবে না?

-না, বেচব না। আমার মাছ আমি বেচব না, তাতে তোমার কী? তার পর আমার দিকে ফিরে বলত, শোনো মিঞা, ভটচায বামুনের কথা শুনলে তুমি হাসতে হাসতে বাজারে গড়াগড়ি খাবে।

কিস্সার নেশায় আমিও তার পাশে বসে পড়তুম।

-ভটচায বামুনেরা তো শুধু পুঁথি পড়ে আর আকাশপানে তাকিয়ে ভাবে। দুনিয়ার কিছুই। তেনাদের চোখে পড়ে না। এক ভটচাযের গিন্নি ডাল রাঁধছিল। হঠাৎ দেখে ঘরে জল নেই। সোয়ামিকে রান্নাঘরে বসিয়ে জল আনতে গেল। বউ তো গেছে জল আনতে, এদিকে ডাল উথলে উঠেছে। বামুন তো ভেবেই পায় না, উথলানো ডাল সামলাবে কী করে? এ যে বিষম বিপদ। শেষপর্যন্ত করল কী জানো? হাতে পৈতে জড়িয়ে সেই হাত ডালের ওপর মেলে চণ্ডীপাঠ করতে লাগল। মিঞা, এমন মজার কথা কখনও শুনেছো? চণ্ডীপাঠে ডাল উথলানো সামলায়?

-তারপর?

-গিন্নি ফিরে এসে ব্যাপার দেখে বলে, এ কী? ডালে একটু তেল ফেলে দিতে পারনি? তেল ফেলতেই উথলানো থেমে গেল। তারপর ভটচায কী করল জানো মিঞা? -কী?

মেছুনি হাসতে হাসতে আমার গায়ে ঢলে পড়ল। তার কোনও লাজ লজ্জা নেই। আমার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, বামুন তখন বৌয়ের পা ধরে বলতে লাগল, তুমি কে মা, আমি যেখানে হার মানলাম, একফোঁটা তেল ছিটিয়ে তুমি সব জয় করলে।

-তারপর?

-তারপর আবার কী? বৌটা আ মরণ বলে এক ঝামটা দিয়ে চলে গেল। মেছুনি হাসতে হাসতে বলল, মিঞা, মেয়েছেলের সঙ্গে বেটাছেলে কখনও পারে?

পুরুষকারের কথাই যদি বলেন, মান্টোভাই, তবে একজনের কথাই আমার মনে পড়ে, তিনি রামমোহন রায়। তাঁকে আমি দেখিনি। সারা কলকাতায় তাঁর নাম শুনেছি। তার বাড়ির ভোজসভায় নাকি বাইজি নাচত। কত বিখ্যাত সব বাইজি তখন কলকাতায়। বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপজান, জিন্নাৎ, সৈয়দ বক্স। না, না ভাইজানেরা এঁদের আমি দেখিনি। কলকাতার বড় বড় বাবুদের কাছে বাঁধা ছিল তারা। আমার তো বাবুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। শুনেছিলাম, বাবু রামমোহন, মিরাত-উল-আস্ফার নামে একটা ফারসি খবরের কাগজ বের করেছিলেন। আমি কলকাতায় যাবার অনেক আগেই তা অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ফারসিতে জামিজাহানুমা নামে একটা খবরের কাগজ বেরুত। তা ছাড়া ইংরেজি, বাংলায় কত যে কাগজ। কলকাতা আমার ভেতরে খবরের কাগজ পড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন তো দিল্লিতে খবরের কাগজ আসে নি। আসবেই বা কী করে? ছাপাখানা তৈরি হলে তো খবরের কাগজের কথা আসে। আর কলকাতায় তখন কত ছাপাখানা। সিরাজউদ্দিনসাব আমাকে একটা বই দেখিয়েছিলেন। কবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল; বলেছিলেন, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নামে কেউ একজন বইটা ছাপিয়েছিল। পঞ্চানন কর্মকার বলে একজনের নামও শুনেছিলুম। ছাপাখানার জন্য প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেছিল সে।

মান্টোভাই, আমি রামমোহনের কথাই বলছিলুম না? এই মানুষটাকে আমি চোখে দেখিনি, তাঁর সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা শুনেছি, সতীদাহের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের কথা শুনে আমি আর কিছু মনে রাখিনি। নিমতলা ঘাট শ্মশানে সতীদাহ আমি দেখেছি। আর দেখেছি গঙ্গাযাত্রীদের। মৃতপ্রায় লোকদের গঙ্গার ধারে নিয়ে যাওয়া হত, সেখানে একটা ঘরে তাদের রেখে দেওয়া হত, রোজ জোয়ারের সময় আত্মীয়-স্বজনরা ঘর থেকে বার করে তার শরীরের অনেকখানি গঙ্গার জলের ভিতর ডুবিয়ে রেখে দিত। এর নাম অন্তর্জলী যাত্রা, মান্টোভাই। দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, বৃস্টিতে ভিজে, শীতে কষ্ট পেয়ে তারা মারা যেত। তখন একটু মুখাগ্নি করে তাকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। আর সতীদাহের সময় চন্দন কাঠ, ঘি দিয়ে জ্বালানো হত চিতা; স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে মারা হত স্ত্রীকে। চলত মন্ত্রোচ্চারণ, বাজত কাঁসর ঘন্টা-ঢোল, যেন এক উৎসব। জীবন্ত নারী পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা কেউ শুনতেও পেত না। এই দৃশ্য যেদিন দেখি, আমার বুক জুড়ে নিধুবাবুর সেই শব্দটাই ঘুরে ফিরে এসেছিল, প্রাণ..ওগো…প্রাণ। পরে শুনেছিলুম রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছিল।

সব আশা ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়েছিলুম। শুধু এইরকম কয়েকটা স্মৃতি নিয়ে। হ্যাঁ, মান্টোভাই, সেখানে আশ্চর্য বসন্তের বাতাস বয় ঠিকই, কিন্তু সেই শহরেই পাথরে মাথা কুটতে – কুটতে রক্তাক্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসতে হয়। দিল্লিতে যখন ফিরলুম, আমার মাথায় তখন হাজার চল্লিশেক টাকার দেনার বোঝা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *