মাধাই ভেবেছিলো গাড়ি থেকে সোজাসুজি গঙ্গায় গিয়ে নামবে। তার গাড়ি যখন গঙ্গার চড়ায় গিয়ে আটকালো তখন প্রভাতের সূচনা হচ্ছে। সারা রাত জেগে আসতে হয়েছে, চরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা বাতাসে তার শীত শীত করে উঠলো। গঙ্গার বুকে কুয়াশার মতো দেখা যাচ্ছে। ওপারের পাহাড়ের গায়ে সিঁদুরে সূর্য ধাপে ধাপে পা ফেলে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার ইচ্ছা হলো তার। একবার মনে মনে সে বললো, সবই পবিত্র দেখি। কিন্তু উদীয়মান সূর্যের আলো তার চোখে বিধলো, জাগরণক্লান্ত চোখ করকর করে উঠলো।
তখন সে বাঁশের চাচাড়ি আর খড়ের তৈরি একটি নোংরা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। সেখানে লোকজনের মধ্যে বসে হলুদ রঙের চা কাঁচের গ্লাস থেকে খেতে খেতে সে আরাম বোধ করলো। একটা সিগারেট ধরালো। দ্বিতীয়বার চা খাওয়ার পরে দেহে সে বল পেলো।
চায়ের দোকানে বসে সে স্থির করেছিলো একটু বেলা হলে স্নান করবে। কিন্তু খানিকটা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তার মনে হলো চা খাওয়ার পর স্নানটা কীরকম হবে? এখানে স্নানের একমাত্র ব্যবস্থাই এই গঙ্গা, কিন্তু সব ম্লান মুক্তিমান নয়।
কিন্তু এসবের ব্যবস্থা করতে হলে আশ্রয় জোগাড় করে নিতে হবে।
মাধাই স্টেশনে গেলো। তার সম্বল বলতে যা কিছু সব একটি পেয়াদা-ঝোলায় কাধ থেকে ঝুলছে। মাধাই স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার রেল কোম্পানির বোম তার পরিচয় করিয়ে দিলো। বাঙালি টালি ক্লার্ক আগ্রহ করে তার সঙ্গে আলাপ করলো।
মাধাই তার কাছে খোঁজ খবর নিলো, নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে পরামর্শ চাইলো। টালিক্লার্ক বলল, পুজো যদি করতে হয়, কিংবা পিণ্ড দিতে চাও, আমাদের একজন লোক আছে, সেই সব করায়। জোগাড়যন্ত্র সব সে-ই করে দেয়, তুমি কিছু টাকা ধরে দিলেই হলো। টালিক্লার্ক শুধু খোঁজ বলে দিলো না, পুরোহিতকে ডেকে মাধাইয়ের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিলো। লোকটি কুলিদের মেট। সে ব্যবস্থা দিলল, দুদিনে বাপ-মায়ের পিণ্ড দেন, তিনদিনে শুধু স্নান করেন। সব রোগতাপ দূর হয়ে যাবে।
মাধাই কৃতজ্ঞের মতো বললো, আপনে যা কহা খুব আচ্ছা কহা, কিন্তু পাঁচ রূপেয়া না। লেকে তিন রূপেয়া নেন।
আপসে মুক্তিস্নানের দাম ঠিক করে শান্তি এলো মাধাইয়ের মনে। তার চোখের সম্মুখে সে যেন বারকয়েক সুরতুনকে দেখতে পেলো। একসময়ে তার মনে হলো পাগলিটাকে নিয়ে এলেও ভালো ছিলো, সেও স্নানের আনন্দ পেতে।
সন্ধ্যার সময়ে মাধাই ইতস্তত ঘুরতে বেরিয়েছিলো। অনেকসময়ে নিজেকে সহসা শক্তিমান বলে মানুষের মনে হয়। আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে, কখনোবা হাত মুঠো করে সে শক্তিটুকুর পরিমাপ করার চেষ্টা করে। মাধাইয়ের পদক্ষেপে তেমনি একটা কিছু ছিলো।
এখানে স্টেশনের কোনো নির্দিষ্ট চৌহদ্দি নেই। নড়বড়ে জোড়াতাড়া দেওয়া সাময়িক বন্দোবস্ত। দিঘার পোর্টার মাধাইয়ের বিস্ময় বোধ হচ্ছিলো যে এর উপর দিয়েও যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলে। পোর্টার হিসাবে লাইনের জোড়গুলি সম্বন্ধেই তার কৌতূহল হলো। এরকম এক জোড়ার মুখ পর্যবেক্ষণে যখন সে কৌতুক অনুভব করছে, তার কানে গানের শব্দ এলো।
এদিক ওদিক লক্ষ্য করে মাধাই দেখলো, রেললাইন থেকে কিছু দূরে কয়েকটা বাবলা গাছ যেখানে একত্রে একটি ঝোঁপ তৈরি করেছে তার কাছে রেলওয়ে স্লিপারের একটা স্তূপের আড়ালে কয়েকজন লোককে দেখা যাচ্ছে। সেখানে গান হচ্ছে। মাধাই আর-একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো, একটি মেয়ে গান করছে। একটা ছোটো হারমোনিয়াম বেসুরো শব্দ করে বাজছে। কয়েকজন দেহাতি কৃষক শ্রোতা। হারমোনিয়ামের সুর যতই বেসুরো হোক, মেয়েটির হিন্দুস্থানী ভাষা যতই দুর্বোধ্য হোক, তার চড়া মিষ্টি সুরে মাধাই আকৃষ্ট হলো। কৃষকদের মধ্যে একজন একটি ঢোল নিয়ে বসেছিলো, চাটিও দিচ্ছিলো, কিন্তু মাধাইয়ের মনে হলো বেতালা বাজিয়ে বরং গানকেইনষ্ট করে দিচ্ছে। গান থামলে যখন মেয়েটি আর-একটির জন্য গুনগুন সুর ধরেছে, মাধাই ভয়ে ভয়ে বললো, ওসকো মৎ বাজাইয়ে। তার কথায় ঢোলকওয়ালা লোকটি থতমত খেয়ে থেমে গেলো। মেয়েটিও গান বন্ধ করলো।
মাধাই সংকুচিত হয়ে বললো, ব্যাতালিক হোতা হ্যাঁয়।
দেহাতি লোকগুলি রেলের কোটকে সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে। সেজন্যই বোধহয় তাদের একজন বললো, আপ বাজাইয়ে।
মেয়েটিও প্রত্যাশার দৃষ্টিতেই যেন চাইলো।
মাধাইয়ের বাবা ছিলো ছিনাথ ঢুলি। মাধাই এই নতুন চেহারার ঢোলটা ভয়ে ভয়ে কোলে তুলে নিয়ে বসলো।
বলা বাহুল্য গানটি আগেকার তুলনায় অনেক ভালো শোনালো। মেয়েটি কৃতজ্ঞচিত্তে দু একটা কথা বললো, তারপরই হাত পাতলো। অন্যান্য শ্রোতারা এক আনা দু আনা করে পয়সা দিলো। মাধাই তখনো ঢোল কোলে করে বসে আছে। মেয়েটি মাধাইয়ের সম্মুখেও হাত পাতলো। মাধাই তার রেল কামিজের পকেট থেকে মনিব্যাগ বার করে একটা আধুলি দিলো মেয়েটির হাতে। আনন্দে ও বিস্ময়ে মেয়েটির চোখ দুটি চকচক করে উঠলো।
সন্ধ্যার পর মাধাই একটা চায়ের দোকানে বসে ছিলো। সেই গায়িকা মেয়েটি একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটি হাতে করে সেই দোকানের কাছে এসে দাঁড়ালো, চা চেয়ে নিয়ে গেলো।
মাধাইকে দেখতে পেয়ে সে যেন একটু থমকে দাঁড়ালো, তারপর আপন হওয়ার সুর করে বললো, গান শুনিয়ে গা?
মাধাই উত্তর না দিয়ে চা খেতে লাগলো। মেয়েটি চলে গেলো, কিন্তু মাধাই দোকান থেকে নেমে হোটেল লক্ষ্য করে কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময় মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়ালো। এমন নিঃশব্দ তার গতি যে গলার শব্দে মাধাই চমকে উঠলো। মেয়েটি বললো, আভি চলিয়ে গা বড়োবাবু।
কোথায় যায়ে গা? যে-স্ফুর্তির ঝেকে মাধাই তাকে লক্ষ্য করেনি সেই ঝেকেই যেন সে প্রশ্ন করলো।
মেয়েটি আবার গানের কথা বললো। তার মুখে ভাঙা ভাঙা হিন্দি শুনে মনে হলো যেন সে মাধাইয়ের বুঝবার সুবিধার জন্যই অমন ভাষা ব্যবহার করছে। সে যেন মাধাইকে বললো–তার বাজনা শুনেই মাধাইয়ের বাজনার সঙ্গে তার গাইবার সখ হয়েছে।
মুক্তির আস্বাদন করছে মাধাই অন্তরে। সে-আনন্দে বাজনা বাজাবার মতো মনের অবস্থা হয় না শুধু, বাজাতেও ইচ্ছা করে। মাধাই আশা করেছিলো রাত্রিতে আরও শ্রোতা থাকবে। আলোর ব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু মেয়েটির ডেরায় পৌঁছে মাধাই বিস্মিত হলো, একটা কুপি পর্যন্ত জ্বলছে না। মাধাই দেশলাই জ্বাললো। মেয়েটি একটা হারিকেন বার করে নিয়ে এসে জ্বালালো। দিনের বেলায় মাধাই অন্যান্য শ্রোতাদের সঙ্গে ঘাসের উপরে বসেছিলো। এখন মেয়েটি একটি মাদুর পেতে দিলো।
মাধাই প্রশ্ন করলো, তুমি এখানে একা একা থাকো?
মেয়েটি হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বললো, বড়োবাবু, আমার স্বামী জেলে গেছে। ওরা তাকে চোর বলে। আমার একটি লড়কি ছিলো, আমার স্বামীর বোন নিয়ে গেছে তাকে। আমি একা একা থাকি।
কিন্তু তোমার স্বামী কী করতো?
আমরা নাট্। আমরা গান গেয়ে বেড়াই। মেয়েটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললল। সে উঠেও দাঁড়ালো। একেবারে প্রথমে যা লক্ষ্যে আসেনি, পরে যেটা সবসময়েই চোখের সম্মুখে ভাসছিলো, এখন সেটাই যেন আকস্মিকভাবে প্রবল হয়ে উঠলো। মেয়েটিও যেন সর্বাঙ্গে হিল্লোলিত করে কয়েক পা মাধাইয়ের দিকে এগিয়ে এলো।
মাধাই লক্ষ্য করলে মেয়েটির পরনে হলদে জমিতে লাল ছোপ দেওয়া অতি পাতলা ঘাগরা, গায়ে তততধিক সূক্ষ্মবস্ত্রের পাঞ্জাবি, পিঠে দোলানো ঝুমকোবাঁধা বেণী, চোখে সুর্মা। তার মনে হলো একটা উষ্ণগন্ধী সুঘ্রাণ আসছে আতরের। দিঘার স্টেশনে বসে দেখা অনেক ইরানীর কথা মনে হলো মাধাইয়ের। তাদের দেখে যে অনুভবগুলি তার মনে উঠে মুহূর্তপরে মনের অতল গভীরে মিশে গেছে সেসবগুলি যেন একত্র হয়ে একটা স্কুল বস্তুর মতো মাধাইয়ের বুকের মধ্যে চাপ দিতে লাগলো এবং সেগুলি একটা বিশিষ্ট মনোভাবের রূপ নিতে লাগলো।
চারিদিকে অন্ধকারের মধ্যে হারিকেনের ম্লান আলোতে এ যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কিছু। মাধাইয়ের ভয় ভয় করতে লাগলো। দু-এক বার সেশিউরে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ সে বলে বসলো, মদ হ্যাঁয়, দারু? মেয়েটি ফিসফিস করে বললো, গ্রামের মধ্যে তাড়িখানা আছে, মাধাইকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু মদের অন্বেষণে বেরিয়ে পথ চলতে চলতে আলোতে পৌঁছে মাধাই একটা ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রায় দশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মাধাই পিঠ থেকে ঝোলা নামিয়ে কম্বল বার করে বিছিয়ে ঘরটার বারান্দাতেই বসে পড়লো। উচিংড়ে লাফিয়ে এসে পড়ছে গায়ে।কাছের আলোটা থেকে শ্যামা পোকা কিছু কিছু চোখেমুখে এসে পড়ছে, তবু মাধাই রাতটা এই দগদগে আলোর নিচে কাটানোই স্থির করলো।
পরদিন সকালে মাধাইয়ের ঘুম চটে গেলো। কে যেন তাকে ধাক্কা দিচ্ছে এই অনুভব নিয়ে উঠে বসে সে দেখলো, তার পুরোহিত হাতে একগোছা কুশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাধাই উঠে বসলো। এই সকালে এত বড়ো স্টেশনে তাকে খুঁজে বার করা খোট্টা পুরোহিতের পক্ষেও বিস্ময়কর বটে।
পূর্বনির্দিষ্ট স্নান-পিণ্ডাদি হয়ে গেলো কিন্তু চাঁদমালাকে বিস্মৃত হতে পারলো না সে। বরং নিঃসঙ্গ,শীর্ণা,দীঘল চেহারার সেইনা মেয়েটি যেন তাকে এক নতুন লোভে জড়িয়ে ফেলেছে। ছুটি শেষ হতে দেরি ছিলো। মাধাই দিঘার বিপরীত দিকে যাওয়ার ট্রেনে উঠে বসলো।
স্নান শেষ হওয়ার পরও দুদিন সে ঘাটেই ছিলো। এ দুদিনে সে গায়িকার সম্বন্ধে কিছু কিছু খবর শুনেছে। প্রায় পাঁচ-ছ মাস হলো স্টেশনের কাছাকাছি বাস করছে মেয়েটি। আগে ওর দলে একজন পুরুষ আর একটি স্ত্রীলোক এবং একটি শিশু সত্যিই ছিলো। পুরুষটি অন্য স্ত্রীলোকটি ও শিশুটিকে নিয়ে চলে গেছে। কেউ বলে মেয়েটির স্বভাবের জন্যই ঝগড়া হয়েছে। আর একজন বললো, আগে স্টেশনের বাবুদের অনেকে যেত ওর কাছে। এখন তাদের সন্দেহ হয়েছে মেয়েটার কুষ্ঠ আছে। দাম পড়ে গেছে বলেই ওকে এখন হাঁটাহাঁটি করে ফঁদ পাততে হয়। সেই টালি ক্লার্ক বাবুটি বললো, এ কথা মাধাইকে আগে থেকে বলে দেওয়াই উচিত ছিলো তার। তা যা-ই বলো, কুষ্ঠ হলেই তো খিদে মরে যায় না। ফাঁদ না পেতেই বা কী উপায়।
এখন ফিরে গিয়ে সুরতুনকে বলা যায় বিবাহের কথা। সুরতুন তো মনের ভেতরটা দেখতে পাবেনা। কিন্তু রাত্রির স্মৃতিগুলি তার একার বুকের মধ্যে জ্বালা করতে থাকবে।এখানে কথাগুলি মাধাইয়ের মনের মধ্যে স্বগতোক্তির মতো ফুটতে লাগলো-যে-আগুনে তার দেহ পুড়বি, তার সঙ্গে মনের জ্বালাও আরো জ্বলে উঠে ফুরায়ে যাবি। লোকে কলো গানওয়ালি ফাঁদ পাতে। কিন্তু নিজের মন কার অগোচর কও?অভ্যাসনা স্বভাব।মনেকয় অভ্যাস পাকা-ধরা ধরছে।চাঁদমালার কথা ভোলা গেলো কই? এ-ফাঁদ না পাতলেই বা কী?
পাশের লোকটি মাধাইকে বললো, নড়াচড়া করছেন কেন?
মাধাই বললল লজ্জিত স্বরে, এরপরে কোন স্টেশন?
বর্ধমান।
মাধাই বিজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা করে বললো, সেই যেখানে সীতাভোগ মিহিদানা?