২৫. মস্ত গোল চাঁদ

পঁচিশ

আজ পূর্ণিমা। মস্ত গোল চাঁদ উঠেছে আকাশে। খাণ্ডববনের ধারে, যমুনার কুলে, খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছে কৃষ্ণ। কৃষ্ণর পাশে সুভদ্রা। তার পাশে অর্জুন। অর্জুনের ডানদিকে, একেবারে শেষে কৃষ্ণা। তিনটি কষ্টিপাথরের মূর্তির মাঝে একটি শ্বেতপাথরের।

গ্রীষ্মকাল। যমুনার স্নিগ্ধ হাওয়ায় গা জুড়িয়ে নেবে বলে তারা এসেছিল বনভ্রমণে। আর কিছুদিন পরেই এই খাণ্ডববন আর থাকবে না। কৃষ্ণ আর অর্জুন পুড়িয়ে ফেলবে এ বন। আজ সকালে যখন গাইয়ে-বাজিয়ের দল নিয়ে তারা এ বনে পৌঁছয়, তখন ব্রাহ্মণের বেশে স্বয়ং অগ্নি এসে তাদের কাছে সাহায্য চেয়ে গিয়েছে। এ কাজে সফল হলে অর্জুন পাবে অনেক কিছু। পাবে গাণ্ডীব ধনুক, পাবে অক্ষয় তূণ আর কপিধ্বজ রথ। আর কৃষ্ণ পাবে কৌমদকী গদা ও সুদর্শন চক্র।

এ পোড়ানো সহজ নয়। বনের গভীরে থাকে যত দানব, তারা বাধা দেবে। কিন্তু কৃষ্ণ আর অর্জুনের মিলিত শক্তির সঙ্গে কে পেরে উঠবে?

ইন্দ্রপ্রস্থ সমৃদ্ধ ও জনবহুল হয়ে উঠছে ক্রমশ। বন পুড়িয়ে যে-জায়গা পাওয়া যাবে, তাতে গড়ে উঠবে নতুন ও সুপরিকল্পিত মহানগরী।

আজ পূর্ণিমা। মস্ত গোল চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোত্স্নার স্নিগ্ধ আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে চৌদিক। আজ থেকে এক বছরের জন্য দ্রৌপদী অর্জুনের বউ। দু’টি আবর্তন শূন্যতার পর আজ অর্জুনের পাশটিতে শুয়ে আছে দ্রৌপদী। গাইয়ে-বাজিয়ের দল নগরে ফিরে গিয়েছে। তারা রয়ে গেল জ্যোত্স্নাবিধৌত নির্জনতায়।

কৃষ্ণ আর সুভদ্রা ঘুমিয়ে আছে ভেবে পাঞ্চালীর হাতটি ধরে যমুনাতীরে একটি ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে এসে দাঁড়াল অর্জুন। সুভদ্রা ঘুমোয়নি। দেখছিল। আনন্দে চোখে জল এসে গেল তার। আজ প্রাণ জুড়োবে দ্রৌপদীর। কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সে পাশ করে শুল। কৃষ্ণও ঘুমোয়নি। এমন একটি দৃশ্যর অপেক্ষা তাকেও জাগিয়ে রেখেছিল। সে প্রিয় সুভদ্রাকে বুকের কাছে টেনে অনুচ্চে বলল, “চিত্রা, কষ্ট হচ্ছে?” সুভদ্রা কৃষ্ণর বুকের কাছে ঘন হয়ে বলল, “না কৃষ্ণ। অর্জুনের সুখেই যে আমার সুখ।”

কৃষ্ণ সুভদ্রার পিঠে আলতো চাপড় মেরে ঘুম পাড়াতে লাগল, যেমন পাড়াত তার ছোটবেলায়। আর দেখতে লাগল, মস্ত চাঁদের আলোয়, কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়, যমুনার জল সাক্ষী করে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ আর এক নারী। কৃষ্ণর মনে পড়তে লাগল অনেক অনেকদিন আগেকার কথা। এভাবেই, যমুনার পারে, কদমগাছের তলায়, কত— কত রাত্রি দাঁড়িয়ে থাকত এক কৈশোরগন্ধী পুরুষ আর যৌবনবতী নারী। তারা সমাজ পরোয়া করেনি। সম্পর্ক বুঝতে চায়নি। পরিণতি নিয়ে ভাবেনি। নিন্দা উপেক্ষা করেছে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ঝরা পাতার মতো। শুধু উন্মত্ত প্রেমে দু’জন দু’জনে মুগ্ধ হয়ে থাকত। দেখে দেখে আশ মিটত না। কখন একসময় পরস্পর মিলে যেত তারা, যেমন এখন মিলে যাচ্ছে দ্রৌপদী আর অর্জুন।

সেই বৃন্দাবনের দিনগুলি আজ ভুলে যেতে থাকা স্মৃতি মাত্র। দশ নিয়ে যার দিন কাটে, এক না ভুলে তার উপায় নেই। পিছনপানে চেয়ে যেমন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় না, তেমনি পিছুটানগুলি ভুলতে ভুলতে এগিয়ে চলে জীবন।

কৃষ্ণ আজ তৃপ্ত। সুখী। পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে না পেয়ে অর্জুনের যে-পাগল করা অতৃপ্তি, আজ তার মুক্তি হল। আর ওই আগুন দিয়ে তৈরি করা মেয়ে? ওই কৃষ্ণা? অর্জুনকে পেয়েও কি পূর্ণ হবে সে? যদি না হয়, তবে তার ঊষর মরুগ্রাসে সে খেয়ে ফেলবে অর্জুনকে। কিন্তু কৃষ্ণ তা হতে দেবে না। কৃষ্ণার মনে কৃষ্ণ সখা হয়ে প্রবেশ করবে। সহায়। বন্ধু। কাম নয়। প্রেম নয়। প্রীতিময় বন্ধুত্ব কেবল। অর্জুনকে রক্ষা করবে কৃষ্ণ। যে-প্রেম না নরের না নারীর, যে-প্রীতি না ভাইয়ের না সন্তানের, যে-আস্থা না প্রজার না ভক্তের— সব সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে, সব আধারের চেয়ে বড় এক আশ্চর্য ভালবাসা কৃষ্ণ আর অর্জুনের। পরম ভাগ্যে মানব এমন ভালবাসা পায়। কৃষ্ণ জানে, আর কোনও নারীকে দেখে বাসনাপীড়িত হয়ে উঠবে না অর্জুন। নারীর মধ্যে একজন পুরুষ যা যা চায়, তার সব পেয়েছে সে। উলূপীর মধ্যে পেয়েছে মাকে, চিত্রাঙ্গদার মধ্যে পেয়েছে চপলচঞ্চল কৌতুকিনী প্রেয়সী, সুভদ্রা তার স্নিগ্ধ দিঘি বনাঞ্চলছায়া বউটি— যার মধ্যে অর্জুন পেয়েছে সেবা, সঙ্গ, আত্মনিবেদন। আর দ্রৌপদী সেই এক নারী অর্জুনের— যে দৃপ্ত, প্রবল, ব্যক্তিত্বশালিনী, রহস্যময়ী। এ রহস্য পাগল করে। এ রহস্য অমোঘ। অনধিগম্য। এ রহস্যের টানে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছে পুরুষ। ছুটবে আরও অনন্তকাল কারণ, সেই তার নিয়তি। পুরুষোত্তম কৃষ্ণ আর পরমপুরুষ অর্জুনেরও ধাবিত না হয়ে উপায় নেই। তবু, সেই ধাবনকালেও তারা হাত ছাড়বে না। ধরে থাকবে শক্ত করে। কারণ, কৃষ্ণ যেমন জানে, অর্জুনও তেমনি জানে, শেষ পর্যন্ত অর্জুন শুধু কৃষ্ণর। সে আর কারও হবে না কোনওদিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *