বাবুরামবাবুর সকল বিষয় অপেক্ষা যশোহরের তালুকখানি লাভের বিষয় ছিল। দশসালা বন্দোবস্তের সময়ে ঐ তালুকে অনেক পতিত জমি থাকে –তাহার জমা ডৌলে মুসমা ছিল পরে ঐ সকল জমি হাঁসিল হইয়া মাঠ-হারে বিলি হয় ও ক্রমেই জমির এত গুমর হইয়াছিল যে, প্রায় এক কাঠাও খামার বা পতিত ছিল না, প্রজালোকও কিছুদিন চাষাবাদ করিয়া হরবিরূ ফসলের দ্বারা বিলক্ষণ যোত্র করিয়াছিল কিন্তু ঠকচাচার পরামর্শে অনেকের উপর পীড়ন হওয়াতে প্রজারা সিকস্ত হইয়া পড়িল –অনেকে লাখেরাজদারের জমি বাজেয়াপ্ত হওয়াতে ও তাহাদিগের সনন্দ না থাকাতে
তাহারা কেবল আনাগোনা করিয়া ও নজর সেলামী দিয়া ক্রমে ক্রমে প্রস্থান করিল ও অনেক গাঁতিদারও জাল ও জুলুমে ভাজাভাজা হইয়া বিনি মূল্যে আপন আপন জমির স্বত্ব ত্যাগ করত অন্য অন্য অধিকারে পলায়ন করিল। এই কারণে তালুকের আয় দুই-এক বৎসর বৃদ্ধি হওয়াতে ঠকচাচা গোঁপে চাড়া দিয়া হাত ঘুরাইয়া বাবুরামবাবুর নিকট বলিতেন –”মোর কেমন কারদানি দেখো” কিন্তু “ধর্মস্য সূক্ষ্মা গতিঃ” –অল্পদিনের মধ্যেই অনেক প্রজা ভয়ক্রমে হেলে গোরু ও বীজধান লইয়া প্রস্থান করিল। তাহাদিগের জমি বিলি করা ভার হইল, সকলেরই মনে এই ভয় হইতে লাগিল আমরা প্রাণপণ পরিশ্রমে চাষাবাস করিব দু-টাকা দু-সিকি লাভ করিয়া যে একটু শাঁসালো হবে তাহাকেই জমিদার বল বা ছলক্রমে গ্রাস করবেন –তবে আমাদিগের এ অধিকার থাকার কি প্রয়োজন ? তালুকের নায়েব বাপু-বাছা বলিয়াও প্রজালোককে থামাইতে পারিল না। অনেক জমি গরবিলি থাকিল –ঠিকে হারে বিলি হওয়া দূরে থাকুক কম দস্তুরেও কেহ লইতে চাহে না ও নিজ আবাদে খরচ খরচা বাদে খাজনা উঠানো ভার হইল। নায়েব সর্বদাই জমিদারকে এত্তেলা দিতেন, জমিদার সুদামতো পাঠ লিখিতেন –”গোগেস্তা সুরত খাজনা আদায় না হইলে তোমার রুটি যাইবে –তোমার কোনো ওজর শুনা যাইবে না।” সময়বিশেষ বিষয় বুঝিয়া ধমক দিলে কর্মে লাগে। যে স্থলে উৎপাত ধমকের অধিন নহে সে স্থলে ধমক কি কর্মে আসিতে পারে ? নায়েব ফাঁপরে পড়িয়া গয়ং গচ্ছরূপে আমতা আমতা করিয়া চলিতে লাগিল –এদিকে মহল দুই-তিন বৎসর বাকি পড়াতে লাটবন্দী হইল সুতরাং বিষয় রক্ষার্থে গিরিবি লিখিয়া দিয়া বাবুরামবাবু দেনা করিয়া সরকারের মালগুজারি দাখিল করিতেন।
এক্ষণে মতিলাল দলবল সহিত মহলে আসিয়া অবস্থিতি করিল। তাহার মানস এই যে, তালুক থেকে কষে টাকা আদায় করিয়া দেনা-টেনা পরিশোধ করিয়া সাবেক ঠাট বজায় রাখিবে। বাবু জমিদারী কাগজ কখন দৃষ্টি করেন নাই, কাহাকে বলে চিঠা, কাহাকে বলে গোসোয়ারা, কাহাকে বলে জমাওয়াসিল বাকি কিছুই বোধ নাই। নায়েব বলে –হুজুর ! একবার লতাগুলান দেখুন –বাবু কাগজের লতার উপর দৃষ্টি না করিয়া কাছারিবাটীর তরুলতার দিকে ফেল্ ফেল্ করিয়া দেখে ! নায়েব বলে, মহশয় ! এক্ষণে গাঁতি অর্থাৎ খোদকস্তা প্রজা এত ও পাইকস্তা এত। বাবু বলেন― আমি খোদকস্তা, পাইকস্তা শুনতে চাই না –আমি সব এককস্তা করিব। বড়োবাবু ডিহির কাছারিতে আসিয়াছেন এই সংবাদ শুনিয়া যাবতীয় প্রজা একেবারে ধেয়ে আইল ও মনে করিল বদ্জাত নেড়ে বেটা গিয়েছে, বুঝি এত দিনের পর আমাদিগের কপাল ফিরিল। এই কারণে আহ্লাদিতচিত্তে ও সহাস্যবদনে রুক্ষচুলো, শুখনোপেটা ও তলাখাঁক্তি প্রজারা নিকটে আসিয়া সেলামী দিয়া “রবধান” ও “স্যালাম” করিতে লাগিল। মতিলাল ঝনাঝন্ শব্দে স্তুব্ধ হইয়া লিক্ লিক্ করিয়া হাসিতেছেন। বাবুকে খুশি দেখিয়া প্রজারা দাদ্খাই করিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলে, অমুক আমার জমির আল ভাঙিয়া লাঙ্গল চষিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার খেজুরগাছে ভাঁড় বাঁধিয়া রস চুরি করিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার বাগানে গোরু ছাড়িয়া দিয়া তচ্নচ্ করিয়াছে –কেহ বলে, অমুকের হাঁস আমার ধান খাইয়াছে –কেহ বলে, আমি আজ তিন বৎসর কবজ পাই না –কেহ বলে, আমি খতের টাকা আদায় করিয়াছি, আমার খত ফেরত দাও –কেহ বলে –আমি বাবলা গাছটি কেটে বিক্রি করিয়া ঘরখানি সারাইব –আমাকে চৌট মাফ করিতে হুকুম হউক –কেহ বলে, আমার জমির খারিজ দাখিল হয় নাই আমি তার সেলামি দিতে পারিব না –কেহ বলে, আমার জোতের জমি হাল জরিপে কম হইয়াছে –আমার খজনা মুসমা দেও, তা না হয় তো পরতাল করে দেখো –মতিলাল এ সকল কথার বিন্দু বিসর্গ না বুঝিয়া চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া থাকিলেন। সঙ্গী বাবুরা দুই-একটা অন্খা শব্দ লইয়া রঙ্গ করত খিল্ খিল্ হাসিয়া কাছারিবাটী ছেয়ে দিতে লাগিল ও মধ্যে মধ্যে “উড়ে যায় পাখী তার পাখা গুণি” গান করিতে লাগিল। নায়েব একেবারে কাষ্ঠ, প্রজারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
যেখানে মনিব চৌকস, সেখানে চাকরের কারিকুরি বড়ো চলে না। নায়েব মতিলালকে গোমুর্খ দেখিয়া নিজমূর্তি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে লাগিল। অনেক মামলা উপস্থিত হইল, বাবু তাহার ভিতর কিছুই প্রবেশ করিতে পারিলেন না, নায়েব তাঁহার চক্ষে ধুলা দিয়া আপন ইষ্ট সিদ্ধ করিতে লাগিল আর প্রজারাও জানিল যে, বাবুর সহিত দেখা করা কেবল অরণ্যে রোদন করা –নায়েবই সর্বময় কর্তা।
যশোহরে নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে কারণ ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছেন, তাহার দফা একেবারে রফা হয়। প্রজারা প্রাণপণে নীল আবাদ করিয়া দাদনের টাকা পরিশোধ করে বটে কিন্তু হিসাবের লাঙ্গুল বৎসর বৃদ্ধি হয় ও কুঠেলের গোমস্তা ও অন্যান্য কারপরদাজের পেট অল্পে পুরে না। এইজন্য যে প্রজা একবার নীলকরের দাদনের সুধামৃত পান করিয়াছে সে আর প্রাণান্তে কুঠির মুখো হইতে চায় না কিন্তু নীলকরের নীল না তৈয়ার হইলে ভারি বিপত্তি। সম্বৎসর কলিকাতার কোনো না কোনো সৌদাগরের কুঠি হইতে টাকা কর্জ লওয়া হইয়াছে এক্ষণে যদ্যপি নীল তৈয়ার না হয় তবে কর্জ বৃদ্ধি হইবে ও পরে কুঠি উঠিয়া গেলেও যাইতে পারিবে। অপর যে সকল ইংরাজ কুঠির কর্ম কাজ দেখে তাহারা বিলাতে অতি সামান্য লোক কিন্তু কুঠিতে শাজাদার চেলে চলে –কুঠির কর্মের ব্যাঘাত হইলে তাহদিগের এই ভয় যে, পাছে তাহাদিগের আবার ইঁদুর হইতে হয়। এই কারণে নীল তৈয়ার করণার্থ তাহারা সর্বপ্রকারে, সর্বতোভাবে, সবসময়ে যত্নবান হয়।
মতিলাল সঙ্গীগণকে লইয়া হো হো করিতেছেন –নায়েব নাকে চশমা দিয়া দপ্তর খুলিয়া লিখিতেছে ও চুনো বুলাইতেছে, এমতো সময়ে কয়েকজন প্রজা দৌড়ে আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল –মোশাই গো ! কুঠেল বেটা মোদের সর্বনাশ করলে –বেটা সরে জমিতে আপনি এসে মোদের বুননি জমির উপর লাঙ্গল দিতেছে ও হাল-গরু সব ছিনিয়ে নিয়েছে –মোশাই গো ! বেটা কি বুননি নষ্ট করলে। শালা মোদের পাকা ধানে মই দিলে। নায়েব অমনি শতাবধি পাক-সিক জড়ো করিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখে কুঠেল এক শোলার টুপি মাথায় –মুখে চুরুট –হাতে বন্দুক –খাড়া হইয়া হাঁকাহাঁকি করতেছে। নায়েব নিকটে যাইয়া মেঁও মেঁও করিয়া দুই-একটা কথা বলিল, কুঠেল হাঁকায় দেও হাঁকায় দেও, মার মার হুকুম দিল। অমনি দুই পক্ষের লোক লাঠি চালাইতে লাগিল –কুঠেল আপনি তেড়ে এসে গুলী ছুঁড়িবার উপক্রম করিল –নায়েব সরে গিয়া একটা রাংচিত্রের বেড়ার পার্শ্বে লুকাইল। ক্ষণেক কাল মারামারি লাঠালাঠি হইলে পর জমিদারের লোক ভেগে গেল ও কয়েক জন ঘায়েল হইল। কুঠেল আপন বল প্রকাশ করিয়া ডেংডেং করিয়া কুঠিতে চলে গেল ও দাদখায়ী প্রজারা বাটিতে আসিয়া “কি সর্বনাশ” “কি সর্বনাশ” বলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
নীলকরসাহেব দাঙ্গা করিয়া কুঠিতে যাইয়া বিলাতি পানি ফটাস্ করিয়া ব্রান্ডি দিয়া খাইয়া শিস দিতে দিতে “তাজা বতাজা” গান করিতে লাগিলেন –কুকুরটা সম্মুখে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করিতেছে। তিনি মনে জানেন তাহাকে কাবু করা বড় কঠিন, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ্ তাঁহার ঘরে সর্বদা আসিয়া খানা খান ও তাঁহাদিগের সহিত সহবাস করাতে পুলিসের ও আদালতের লোক তাঁহাকে যম দেখে আর যদিও তদারক হয় তবু খুন অথবা অন্য প্রকার গুরুতর দোষ করিলে মফস্বল আদালতে তাহাদিগের সদ্য বিচার হইয়া সাজা হয় –গোরা লোক ঐ সকল দোষ করিলে সুপ্রিম কোর্টে চালান হয় তাহাতে সাক্ষী অথবা ফৈরাদিরা ব্যয়, ক্লেশ ও কর্মক্ষতি জন্য নাচার হইয়া অস্পষ্ট হয় সুতরাং বড়ো আদালতে উক্ত ব্যক্তিদের মকদ্দমা বিচার হইলেও ফেঁসে যায়।
নীলকর যা মনে করিয়াছেন, তাহাই ঘটিল। পরদিন প্রাতে দারোগা আসিয়া জমিদারের কাছারি ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্বল হওয়া বড়ো আপদ্ –সবল ব্যক্তির নিকট কেহই এগুতে পারে না। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া ঘরের ভিতর যাইয়া দ্বার বন্ধ করিল। নায়েব সম্মুখে আসিয়া মোটমাট চুক্তি করিয়া অনেকের বাঁধন খুলিয়া দেওয়াইল। দারোগা বড়োই সোরসারাবত করিতেছিল –টাকা পাইবামাত্র যেন আগুনে জল পড়িল। পরে তদারক করিয়া দারোগা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দু-দিক বাঁচাইয়া রিপোর্ট করিল –এদিকে লোভ ওদিকে ভয়। নীলকর অমনি নানা প্রকার জোগাড়ে ব্যস্ত হইল ও ম্যাজিস্ট্রেটের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইতে লাগিল যে, নীলকর ইংরাজ খ্রীষ্টিয়ান –মন্দ কর্ম কখনই করিবে না –কেবল কালা লোক যাবতীয় দুষ্কর্ম করে। এই অবকাশে সেরেস্তাদার ও পেস্কার নিলকরের নিকট হইতে জেয়াদা ঘুষ লইয়া তাহার বিপক্ষে জবানবন্দী চাপিয়া স্বপক্ষীয় কথা সকল পড়িতে আরম্ভ করিল ও ক্রমশ ছুঁচ চালাইতে চালাইতে বেটে চালাইতে লাগিল। এই অবকাশে নীলকর বক্তৃতা করিল –আমি এ স্থানে আসিয়া বাঙালীদিগের নানা প্রকার উপকার করিতেছি – আমি তাহাদিগের লেখাপড়া ও ঔষধপত্রের জন্য বিশেষ ব্যয় করিতেছি –আবার আমার উপর এই তহমত? বাঙালীরা বড়ো বেঈমান ও দাঙ্গাবাজ। ম্যাজিস্ট্রেট এই সকল কথা শুনিয়া টিফিন করিতে গেলেন। টিফিনের পর খুব চুর্চুরে মধুপান করিয়া চুরুট খাইতে খাইতে আদালতে আইলেন –মকদ্দমা পেশ হইলে সাহেব কাগজ পত্রকে বাঘ দেখিয়া সেরেস্তাদারকে একেবারে বলিলেন –”এ মামলা ডিসমিস করো” এই হুকুমে নীলকরের মুখটা একেবারে ফুলিয়া উঠিল, নায়েবের প্রতি তিনি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। নায়েব অধোবদনে ঢিকুতে ঢিকুতে –ভুঁড়ি নাড়িতে নাড়িতে বলিতে বলিতে চলিলেন –বাঙালীদের জমিদারী রাখা ভার হইল –নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল –প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ্য হইয়া পড়ে আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদের পালাইবার পথও বিলক্ষণ আছে। লোকে বলে জমিদারের দৌরাত্ন্যে প্রজার প্রাণ গেল–এটি বড়ো ভুল। জমিদারেরা জুলুম করে বটে কিন্তু প্রজাকে যতনে বজায় রেখে করে, প্রজা জমিদারের বেগুনক্ষেত। নীলকর সে রকমে চলে না –প্রজা মরুক বা বাঁচুক তাহাতে তাহার বড়ো এসে যায় না –নীলের চাষ বেড়ে গেলেই সব হইল –প্রজা নীলকরের প্রকৃত মূলার ক্ষেত।