২৫. ভরা পূর্ণিমায় নৃত্যের ছবি

মোসাদ্দেক সাহেব পেইনটিংটা শেষ করেছেন। তিনি ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখ ক্লান্ত না। তিনি প্রায় পলকহীন চোখে তাঁর শিল্পকর্মের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছবিটা এত সুন্দর হবে তিনি ভাবেননি। সাজ্জাদ যেমন বলেছিল। তিনি ছবিটা তেমন আঁকেননি। প্রহর শেষের রাঙা আলোয় নৃত্যের দৃশ্য নয়–তিনি এঁকেছেন ভরা পূর্ণিমায় নৃত্যের ছবি।

এতে একটা বড় লাভ হয়েছে–মেয়েটির শরীরে তিনি জোছনার কাপড় পরিয়ে দিতে পেরেছেন। মেয়েটি নগ্ন, তারপরেও তাকে নগ্ন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে প্রকৃতির একটা অংশ। মোসাদ্দেক সাহেবের মনে হল, এই ছবিটি এক্সিবিশনে পাঠাতে পারলে অনেকেই অপূর্ব একটা শিল্পকর্ম দেখতে পারত। তিনি ছবির শিরোনাম দিতেন–

আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে

ছবির মূল্য তালিকায় লিখে দিতেন—বিক্রয়ের জন্যে নয়। কিছু কিছু ছবির ভেতর আত্মা জেগে উঠে। আত্মা বিক্রি হয় না বলে সেই সব ছবির মূল্য ত লিখতে হয়–বিক্রয়ের জন্যে নয়।

আত্মা বিক্রয়ের জন্যে নয়–তাও কি ঠিক? আত্মাও বিক্রি হয়। কে যেন তার নিজের আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করল। কি নাম তার–

ড: ফস্টাস?

নাকি মেসিস্টোফিলিস? সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

তিনি নিজেও কি তাঁর আত্মা বিক্রি করে দেননি? হ্যাঁ, বিক্রি করেছেন। খুব অল্প দামে বিক্রি করেছেন। মোসাদ্দেক সাহেব খাটের নিচ থেকে হুইস্কির বোতল বের করলেন। তিনি ক্ষুধার্তা। সকাল থেকে কিছু খাননি। এখন প্রায় তিনটার মত বাজে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় র হুইস্কি দ্রুত কাজ করবে। অতি অল্প সময়ে তিনি ঘোর এবং আচ্ছন্নতার একটা জগতে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে তিনি তার আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ছবিটা প্রাণভরে দেখে নিতে হবে। কারণ সাজ্জাদ সন্ধ্যার দিকে এসে ছবিটা নিয়ে যাবে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আত্মার একটা অংশও চলে যাবে। তাকে আর কখনো পাওয়া যাবে না।

মোসাদ্দেক সাহেব এক চুমুকে অনেকখানি হুইস্কি খেয়ে ফেললেন। মাথার শিরা দপদপ করছে। হাতের আঙ্গুলগুলি মনে হচ্ছে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ধূক ধূক শব্দ হচ্ছে–কিসের শব্দ? হৃদপিণ্ডের শব্দ? নেশাগ্ৰস্ত অবস্থায় হৃদপিণ্ডের শব্দ এত স্পষ্ট হয়— আগে লক্ষ্য করেননি তো! তিনি আরো খানিকটা হুইস্পিক গলায় ঢাললেন। তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল–তার কাছে মনে হল ক্যানভাসে আঁকা মেয়েটা নাচছে। হেলো সিনেশন তো বটেই। প্রচুর মদ্যপান করলে এ রকম হয়–একটা মানুষকে দুটা দেখা যায়। এই ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। মন্দ না তো। মেয়েটা তো ভারি সুন্দর করে নাচছে। নূপুরের শব্দ হচ্ছে না কেন? নাচলে নূপুরের শব্দ তো হবার কথা। নূপুরের শব্দ না হবার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হল। মেয়েটির পায়ে তিনি নূপুর আঁকেননি। নূপুর এঁকে দেয়া যাক। কতক্ষণ আর লাগবে। তাঁর হাত অবশ্যি কাঁপছে। তবে এই কম্পন তুলি হাতে নেয়ামাত্র থেমে যাবে।

তিনি তুলি হাতে নিলেন। নৃত্যরতা মেয়েটি মনে হল তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। নূপুর ছাড়া নেচে সেও বোধহয় আরাম পাচ্ছে না। মোসাদ্দেক সাহেব নূপুর আঁকতে বসলেন।

 

সাজ্জাদের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে। সাজ্জাদ হাত বাড়ালেই টেলিফোন ধরতে পারে। তার ধরতে ইচ্ছা করছে না। টেলিফোনের শব্দে তার বিরক্তিও লাগছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে টেলিফোনটা খুব করুণ সুরে বাজছে। কান্নার একটা সুর আসছে। যন্ত্রটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে–প্লীজ, আমাকে হাতে নাও। আমার প্রতি দয়া কর, তুমি আমাকে হাতে নাও।

সাজ্জাদ টেলিফোন হাতে নিয়ে সত্যি সত্যি কান্না শুনল–ওপাশ থেকে ফুপিয়ে ফাঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে।

সাজ্জাদ বলল, কে?

আপনার উপহার পেয়েছি। লজ্জা, দুঃখ এবং অপমানে কাঁদছি।

ছবিটা তো খুব সুন্দর।

সাজ্জাদ ভাই–আপনি একজন ভয়ংকর অসুস্থ মানুষ। ভয়ংকর অসুস্থ।

সুস্থ-অসুস্থ পুরো ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। আমার কাছে অন্যদের অসুস্থ মনে হয়।

সাজ্জাদ ভাই!

বল। কান্না থামাও, কান্না থামিয়ে বল। কান্নার জন্যে আমি তোমার কোন কথাই শুনতে পারছি না।

আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় কখন থেকে আপনি জানেন?

মনে নেই। অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমার মনে থাকে না।

আমার তখন তের বছর বয়স। মাত্র তের বছর।

আনলাকি থার্টিন?

আনলাকি তো বটেই, নয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে কেন? সেদিন আপনার সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছিল মনে আছে?

না।

আমার মনে আছে। শুধু সেদিন না–এই পর্যন্ত আপনার সঙ্গে আমি যে কটা কথা বলেছি আমার সব মনে আছে। আমার প্রতিটি বাক্য দাড়ি-কমাসহ মুখস্থ আছে। আপনার স্মৃতিশক্তি আমার চেয়ে হাজারগুণে ভাল। কিছু কিছু মানুষের স্মৃতিশক্তি অপ্রয়োজনীয় তথ্য মনে রাখার জন্যে অসম্ভব ভাল। আমি সেই রকম একটা মেয়ে।

কান্না বন্ধ করে কথা বল লীলাবতী। আমি বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পারছি না।

আপনার সব কথা না বুঝলেও হবে। আমার কথাগুলি বলা দরকার। আমি বলব তারপর টেলিফোন রেখে দেব।

আচ্ছ বেশ।

তের বছর বয়স থেকে আমার একটাই স্বপ্ন–আপনাকে পাশে পাওয়া। কত হাস্যকর ব্যাপার তার জন্যে করেছি। শুনবেন? কার কাছে যেন শুনলাম আজমীর শরীফে গিয়ে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়। আমি মাকে নিয়ে আজমীর শরীফ গেলাম। আপনি কি হাসছেন না?

না, হাসছি না। সিগারেট ধরিয়েছি। তারপর বল…

থাক, আর বলব না। শুনুন সাজ্জাদ ভাই, আপনি আমাকে কঠিন অপমান করেছেন। সেই অধিকার আপনার ছিল না। আপনি জানেন না–আমার জন্মদিনে এসে আমার খাটে ঠিক যে জায়গাটায় বসেছিলেন বাকি রাতটা আমি সেখানে বসেছিলাম–কারণ সেখানে আপনার গায়ের গন্ধ লেগে ছিল। আপনি কি হাসছেন। সাজ্জাদ ভাই?

না। সিগারেট-নিভে গিয়েছিল আবার ধরিয়েছি।

সাজ্জাদ ভাই!

বল।

আমি নাচ শিখেছিলাম। শুধু আপনার জন্যে?

জানতাম না তো?

এগারো বছর বয়সে আপনার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা তখন আপনি আমাকে বললেন–তুমি যে ড্রেসটা পরে আছ সেটা কি নাচের ড্রেস? তুমি কি এই অনুষ্ঠানে নাচবে? আমি বললাম, না। আপনি বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সুন্দর নাচতে পার।

ও, আচ্ছা।

সাজ্জাদ ভাই!

বল।

আপনি আর কোনদিন আমাদের বাসায় আসবেন না।

সেটা তো আগে একবার বলেছি।

আবার বললাম। আপনার দেয়ালে যে টেলিফোন নাম্পারটা লিখে রেখে এসেছি সেটা মুছে ফেলবেন।

আচ্ছা। তুমি কি পেইনটিংটা নষ্ট করে দিয়েছ? না। ছবিটা আমি সারাজীবন আমার শোবার ঘরে টানিয়ে রাখব। আমি ঠিক করেছি জীবনে আর কোনদিনই নাচব না। এক সময় নাচন্তাম সেই স্মৃতিটি ছবিতে থাকুক।

লীলাবতী, পেইনটিংটা কি সুন্দর হয়েছে?

লীলাবতী কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যাঁ।

লীলাবতী, তোমাকে আমি ভালবাসি।

না।

না বলছ কেন? আমার মনের কথা তোমার জানার কথা না।

আপনি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালবাসেন না। এবং অন্য কারো ভালবাসাও বুঝতে পারেন না। আপনাকে আল্লাহ অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু ভালবাসার এবং ভালবাসা বোকার ক্ষমতা দেন না।

হতে পারে।

টেলিফোন রেখে দিচ্ছি সাজ্জাদ ভাই।

আচ্ছা রেখে দাও। হ্যালো শোন, টেলিফোন রেখে দেবার আগে কি দু লাইন কবিতা শুনবে?

না।

মাত্ৰ দুটা লাইন। বেশী সময় লাগবে না।

আচ্ছা বলুন।

সাজ্জাদ হাসতে হাসতে বলল,

তুমি থাক জলে আর আমি থাকি স্থলে
আমাদের দেখা হবে মরণের কালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *