ভবিষ্যতের বাংলা ভাষা-সাহিত্য
বাংলা ভাষার বয়স প্রায় হাজার বছর, কারো কারো মতে, তার চেয়েও বেশি। নানা বাঁক ঘুরে, নানা রকমের প্রভাব স্বীকার করে প্রায় সবার অলক্ষে এ ভাষা বর্তমান রূপ নিয়েছে। কিন্তু গত আড়াই শো বছরে দুটি রাজনৈতিক ঘটনা এই ভাষাকে যতো বদলে দিয়েছে, তেমন দ্রুত অথবা ব্যাপক পরিবর্তন একটা ভাষার ইতিহাসে বড়ো একটা দেখা যায় না। প্রথম ঘটনাটি হলো: ইংরেজ শাসনের রাজধানী হিশেবে কলকাতা নগরীর উদ্ভব আর দ্বিতীয় ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিশেবে ঢাকার অভিষেক। কলকাতা রাজধানী হওয়ার ফলে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের যে-পরিবর্তন হয়েছিলো, সে ইতিহাস আমাদের কমবেশি জানা। কিন্তু ঢাকা একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ায় বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ওপর যেপ্রভাব পড়তে পারে, তা এখনো জল্পনাকল্পনার বিষয়। তবে কলকাতায় যা ঘটেছিলো এবং গত তিন দশকে ঢাকায় যা ঘটেছে, তা থেকে খানিকটা অনুমান করা যেতে পারে, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য কোন পথে যাচ্ছে, অথবা ভবিষ্যতে কোন চেহারা পেতে পারে।
জীবিকার অন্বেষণে এবং ভাগ্যের উন্নতি করার আশায় আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ কলকাতায় আসতে আরম্ভ করেন। ঐরা আসেন কলকাতার আশেপাশের এলাকা থেকে। যতো সময় যেতে থাকে, এই সংখ্যাও ততো বাড়তে থাকে। তা ছাড়া, যেসব জায়গা থেকে লোকেরা আসেন, তার পরিধিও দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। সবারই একই উদ্দেশ্য–কলকাতায় বিত্ত এবং বিদ্যার যেভোজ হচ্ছে, তার শরিক হওয়া। মফস্বল থেকে আসা এই লোকেরা কলকাতায় ভিড় করেছিলেন বিচিত্র আঞ্চলিক ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে। একদিকে এসব ভাষা এবং সংস্কৃতি কলকাতার লোকেদের প্রভাবিত করেছিলো, অন্যদিকে কলকাতার ভাষা এবং সংস্কৃতিও প্রভাবিত করেছিলো এই বহিরাগতদের। কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রভাবও পড়েছিলো ক্ষেত্রবিশেষে। যেমন, বাংলা গদ্যকে গড়ে তোলার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন জোনাথান ডানকান এবং হেনরি পিটস ফরস্টারের মুনশিরা আর উইলিয়াম কেরীর পরিচালনায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কয়েকজন পণ্ডিত। এই পণ্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। সরকারী বৃত্তের বাইরে কয়েক বছর পরে বাংলা গদ্যের দিক নিদের্শনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রামমোহন রায়। সর্বোপরি, বাংলা ভাষা ওপর ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রভাবও পড়েছিলো। তারপর ধীরে ধীরে সমন্বয়ও ঘটেছিলো এসব বিচিত্র উপাদানের।
উনিশ শতকের গোড়ায় যে-প্রামাণ্য বাংলা সাধু ভাষার জন্ম হয়, সে ভাষা এই কলকাতার ফসল। সে ছিলো আগের শতাব্দীর বাংলা থেকে রীতিমতো ভিন্ন ধরনের। আঠারো শতকের যে-বাংলা গদ্যের নমুনা আমরা দেখতে পাই, তাতে একদিকে যেমন আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার ছিলো, তেমনি সে গদ্য লেখা হতো ছোটো ছোটো বাক্য দিয়ে। কিন্তু ১৭৮০-র দশক থেকে ইংরেজ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে আইনের বই এবং সরকারী কাগজপত্র অনুবাদ করাতে দিয়ে যে-বাংলা লেখা হয়, তাতে আরবি-ফারসি উপাদান কমে যায় এবং বাক্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। সরল বাক্য পরিণত হয় জটিল এবং যৌগিক বাক্যে। বিশেষ করে হেনরি পিটস ফরস্টার এবং উইলিয়াম কেরী এই রীতির বাংলাকে খুব উৎসাহিত করেন। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্যে দ্রষ্টব্য আমার লেখা বই কালান্তরে বাংলা গদ্য।) কেরীর অধীনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা যেসব পাঠ্যবই লেখেন, তা লেখেন এই নতুন ধরনের এবং অনেকটা কৃত্রিম ভাষায়। সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে এসব রচনা বেশি লোক পড়েননি, কিন্তু রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অন্য যাঁরা পরবর্তী বিশ বছরে বাংলা লিখতে এগিয়ে আসেন, তারা গদ্যের এই রীতিকে অস্বীকার করতে পারেননি। কমবেশি এই রীতির ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের নিজেদের গদ্যরীতি।
এভাবে যে-বাংলা গদ্যের জন্ম হলো, তা ছিলো মুখের ভাষা থেকে যথেষ্ট আলাদা। রামমোহন রায় এই গদ্যকে খানিকটা সাবলীলতা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। আর, ১৮২০-এর দশকে খবরের কাগজগুলো এই ভাষাকে প্রতিদিনের ব্যবহারের উপযোগিতা দিয়েছিলো। কিন্তু মাধুর্যবর্জিত এবং আড়ষ্ট এই ভাষা সাহিত্য সৃষ্টির উপযোগী ছিলো না। ১৮৪০-এর দশকের শেষে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর এই ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ আবিষ্কার করেন এবং তাতে সাহিত্যিক গুণাবলী আরোপ করেন। ফলে এক কালের আড়ষ্ট সাধু বাংলাই বেতাল পঞ্চবিংশতি অথবা সীতার বনবাস লেখার মতো সুললিল হয়ে ওঠে। তাঁর ভাষা পড়তে হোঁচটি খেতে হয় না। তা ছাড়া, তিনি অনুপ্রাস এবং লঘুগুরু শব্দের এমন চমৎকার সমন্বয় ঘটান, যা তার ভাষাকে একটা সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্যও দান করেছিলো। তা সত্ত্বেও এ ভাষাও ছিলো মুখের ভাষা থেকে অনেক দূরে, তার ভিত্তি ছিলো তার আগেকার অর্ধশতাব্দীর সাধু ভাষা। তিনি তাকে কেবল মাধুর্যমণ্ডিত করেছিলেন। তা ছাড়া, এ ভাষা সব বিষয় লেখার উপযোগী ছিলো না।
বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন প্রাচীন ভারতের গল্প অথবা পৌরাণিক কাহিনী। অপর পক্ষে, প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৫৪ সালে আলালের ঘরের দুলাল নামে যে-কাহিনী লিখতে আরম্ভ করেন, তার বিষয়বস্তু নয়, যে-ভঙ্গিতে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন, তার জন্যেও বিদ্যাসাগরের ভাষা উপযোগী ছিলো না। এ জন্যে তিনি বহু জায়গায় চলতি ক্রিয়াপদ, সর্বনাম এবং ধ্বন্যাত্মিক শব্দ ব্যবহার করে মুখের ভাষার কাছাকাছি নতুন এক রীতির গদ্য উদ্ভাবন করেন। তার চেয়েও বড়ো কথা, তিনি বাংলা ভাষার অন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেন। সে সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে দেয় কয়েক বছর পরে প্রকাশিত হতোম প্যাঁচার নকশা। এই বইয়ের লেখক কথ্য বাংলার অসাধারণ ক্ষমতাকে তুলে ধরেন। কিন্তু এ ভাষাও সবকিছু লেখার উপযোগী ছিলো না। এমন কি, এ রকমের ভাষা প্রচলনের জন্যে সময়ও তখনো পর্যন্ত অনুকূল হয়নি। এ জন্যেই বোধ হয় এই অসাধারণ রীতির কোনো অনুকারক আমরা দেখতে পাইনে।
১৮৬০-এর দশকে এসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাধু রীতিকে অবলম্বন করে ংলা ভাষাকে সৃজনশীল সাহিত্যের উপযোগিতা দান করেন। বিষয়বস্তু অনুযায়ী তিনি কোথাও ব্যবহার করেন লঘু ভাষা, কোথাও গুরুগম্ভীর ভাষা। তবে ক্রিয়াবিভক্তি অথবা সর্বনামে তিনি কথ্যভাষাকে অনুসরণ করেননি। তাঁর ঝোঁকও ছিলো প্রধানত তৎসম শব্দ এবং সমাসবদ্ধ পদের ওপর। এ কথায় বলা যায় যে, তাঁর গদ্য কোথাও কোথাও মুখের ভাষার শক্তিকে প্রকাশ করলেও, তা ছিলো মূলত সাধু ভাষা। তখনো কৃত্রিমতা কাটিয়ে মুখের ভাষাকেই সাহিত্যের ভাষার মর্যাদা দেওয়ার মতো লেখকের আবির্ভাব ঘটেনি। ১৮৭৮-৭৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে কতোগুলো চিঠি লিখেছিলেন তার ইউরোপ প্রবাসের অভিজ্ঞতা জানিয়ে। সে চিঠিগুলো ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। কথ্যভাষায় লেখা এই চিঠিগুলো প্রমাণ করে যে, সেই আঠারো বছর বয়সেই তিনি কথ্যভাষার সম্ভাবনার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর কয়েক বছর পরে তিনি যখন গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন, তখন তিনি আর কথ্যভাষায় লিখতে সাহস পাননি, পাঠকরা সে ভাষাকে মেনে নেবেন কিনা, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই সেসব তিনি সাধু ভাষাতেই লেখেন, যদিও ১৮৯০-এর দশকে তিনি গল্পগুচ্ছের ভাষায় সর্বনামে কথ্যভাষার রীতি কোথাও কোথাও ব্যবহার করেছিলেন।
প্ৰবন্ধ–সব কিছুই লেখা সম্ভব মুখের ভাষায়। তারপর থেকে গত নকবুই বছর ধরে বেশির ভাগ লেখকই চলতি বাংলায় তাদের সাহিত্য রচনা করেছেন। এমন কি, কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা অথবা ঢাকায় ইত্তেফাকের মতো পত্রিকা সাধুভাষাকে জোর করে ধরে রাখার যে-প্ৰয়াস চালায়, তাও অনেক আগেই ভেঙে পড়ে। এভাবে এককালে যে-গদ্য মুখের ভাষার কাছাকাছি ছিলো, সেই গদ্য আবার মুখের ভাষার কাছাকাছি ফিরে এলো। কিন্তু তার জন্যে এক শো বছরেরও বেশি সময় তাকে উজানপথে চলতে হয়েছে।
উনিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতায় যে-ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশ লক্ষ্য করি, তার আরও কতোগুলো বৈশিষ্ট্য ছিলো। এই নগরীতে তখন প্ৰায় একতৃতীয়াংশ লোক ছিলেন মুসলমান। কিন্তু তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন অবাঙালি। তাঁরা লেখাপড়ার দিকে এগিয়ে আসেননি। সে জন্যে, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশে তাদের কোনো ভূমিকা পালন করার প্রশ্নই ওঠে না। বস্তুত, তাঁরা বঙ্গদেশে বাস। করলেও, বাঙালি বলে নিজেদের পরিচয় দিতেন না; প্রতিবেশী বাংলাভাষী হিন্দুরাও তাদের বাঙালি বলে গণ্য করতেন না। উনিশ শতকের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য তাই পনেরো আনাই হিন্দুদের গড়া। এমন কি, শতাব্দীর শেষেও খুব কম মুসলমানই বাংলায় লিখতেন। খুব কম মুসলমানই স্বীকার করতেন যে, তাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই পরিবেশে যে-সাহিত্য রচিত হয়, সেও বাংলা গদ্যের মতো হিন্দু লেখকদের তৈরি। তাতে মুসলমানদের অবদান যেমন খুব সামান্যই ছিলো, তেমনি তাতে মুসলিম জীবনও প্রায় অনুপস্থিত। এক কথায়, কলকাতাকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকে যে-নতুন সংস্কৃতি দানা বাঁধে, সেই সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদান ছিলো নিতান্তই নগণ্য, এবং তার প্রধান কারণ বাংলা ভাষার দিকে তাদের মুখ ফিরিয়ে থাকা এবং আধুনিক শিক্ষার দিকে এগিয়ে না-আসা।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ এবং তারপর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর অবশ্য অবস্থা বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে গেছে। দেশবিভাগের পর কলকাতা পরিণত হয়। ভারতের একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে। শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমিত বিকাশ এবং বামপন্থী ও উগ্ৰবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে কলকাতা প্রাদেশিক রাজধানী হিশেবেও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। তদুপরি, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দী এবং ইংরেজি হওয়ায় বাংলার গুরুত্বও অনেক কমে যায়। এর ফলে উনিশ এবং বিশ শতকের কলকাতায় বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে অগ্ন্যুৎপাতের মতো সৃজনশীলতার যে-স্ফুরণ লক্ষ্য করেছিলাম, সেই ধারা বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে আর বজায় থাকেনি। তার অবক্ষয় লক্ষ্য করা যায় সর্বত্র। একুশ শতকের গোড়ায় এখন দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় হিন্দীর চর্চা ক্রমবর্ধমান, কিন্তু বাংলার চর্চা সে অনুপাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হয় না। এমন কি, সন্দেহ হয়, পঞ্চাশ বছর পরে বাংলার চর্চা এখন যেটুকু আছে, তাও থাকবে কিনা।
অপর পক্ষে, বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা অন্য ছবি দেখতে পাই। বিশ শতকের গোড়া থেকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বাংলা তাদের মাতৃভাষা কিনা তাই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু ১৯৩০ সালের মধ্যে এই বিতর্কের অবসান ঘটে। দেশবিভাগের পরে মুসলমানপ্রধান পূর্বপাকিস্তানে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা সত্যিকার প্রবল হয়ে ওঠে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। বস্তুত, এই আন্দোলনকে ঘিরেই শেষ পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তান ভেঙে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষাও বাংলা। সেদিক দিয়ে এই দেশে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য বিকাশ লাভ করার অসাধারণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অবদান ছিলো খুবই কম। বাংলা ভাষা চর্চায়ও তাঁরা অনেক পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই শতাব্দীর শেষে এসে, এখন মনে হয়, মানের দিক দিয়ে না-হলেও বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য চর্চায় পরিমাণের দিক দিয়ে পশ্চিম বাংলাকে বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং মানবিক বিদ্যা চর্চার জন্যে যতো বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে কি তার একাংশও প্রকাশিত হয়েছে? অথবা এখন বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো বই এবং পত্রপত্রিকা প্ৰকাশিত হয়, পশ্চিমবঙ্গে কি তা হয়? কেবল তাই নয়, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য যে-সরকারী পৃষ্ঠপোষণা পাচ্ছে, পশ্চিম বাংলায় তা পাওয়া যাচ্ছে না, অথবা তা প্ৰত্যাশা করাও ঠিক নয়। এমন কি, সেখানে এখন যেটুকু সরকারী আনুকূল্য পাওয়া যাচ্চে, ভবিষ্যতে তাও অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের চর্চা তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কমে যাবে। অন্য দিকে, সরকারী ভাষা হিশেবে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। এমন কি, গান, নাটক এবং সিনেমার ব্যাপারেও এ কথা বলা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে এসব এখনো বাংলাদেশের তুলনায় বিস্তর এগিয়ে আছে, কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে সে অবস্থা তেমন থাকবে বলে মনে হয় না।
কেবল তাই নয়, একদিন কলকাতা নগরীতে যে-বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করেছিলো এবং যে-ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের আদর্শ ভাষায় পরিণত হয়েছিলো, সেই ভাষা আর সমগ্র বাংলাভাষীদের প্রামাণ্য বাংলা বলে বিবেচিত হবে কিনা, সে নিয়ে এখন সন্দেহ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক; প্ৰথম যৌবনে প্ৰবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বরিশালের গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসে প্রথমেই যা শিখতে চেষ্টা করেছিলাম, তা হলো “শুদ্ধ ভাষা”য় কথা বলা। এই প্রবণতা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত কমবেশি বজায় ছিলো। কিন্তু এখন ঢাকার তরুণ-তরুণীরা প্রামাণ্য বাংলায় কথা বলেন না। এখন বরং এক ধরনের ঢাকাই বাংলায় কথা বলাই ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। এমন কি, যারা যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া, রাজশাহী-দিনাজপুর–এসব অঞ্চলের এবং ইচ্ছে করলেই “শুদ্ধ বাংলা” অথবা “শুদ্ধ ভাষা’র কাছাকাছি একটা ভাষায় কথা বলতে পারেন, তারাও সে বাংলা না-বলে ঢাকাই বাংলা বলেন। বাংলাদেশের গণ্যমান্য লোক থেকে আরম্ভ করে সাধারণ মানুষ যখন কথা বলেন, এমন কি একটা সভায় বক্তৃতা করেন, তখনো তারা পুরোটা অথবা আংশিকভাবে এই ঢাকাই বাংলাই ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্যে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বহু বছর আগে থেকেই লক্ষ্য করা গেছে, সে কেবল যশোর-খুলনার ভাষা নয়, নোয়াখালির ভাষারও মতো দুর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষাও সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। ষাটের দশকের গোড়ায়। “মুসলমানী” শব্দের আধিক্যও দেখা দেয় দেশবিভাগের পরে থেকে। এখন ঢাকার টেলিভিশন-নাটকে আঞ্চলিক ভাষা। এতো বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, কোনো চরিত্র প্রামাণ্য কথ্য ভাষায় কথা বললে তাকে প্রায় কৃত্রিম বলে মনে হয়। সৃজনশীল সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার এই ব্যবহার অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু যা আশঙ্কার সঙ্গে এখন লক্ষ্য করছি, তা হলো, ইতিমধ্যে তরুণদের কেউ কেউ ঢাকাই ভাষায় প্ৰবন্ধও লিখতে চেষ্টা করছেন। এমন কি, ঢাকার ভাষায় কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান এবং, কেবল সংলাপ নয়, পুরো গল্প লিখেছেন ইমদালুল হক মিলন।
এই ঢাকাই বাংলা বিশেষ করে ঢাকা অঞ্চলের বাংলা নয়। এ হলো কয়েকটি জিলার এক ধরনের মিশ্র বাংলা। এ ভাষায় মুসলমানদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় অনুষঙ্গের বহু আরবি-ফারসি শব্দও আছে। যেমনটা, ধরা যাক, সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকে লক্ষ্য করি। বলা শক্ত, এ ভাষা ঠিক কোন জিলার ভাষা, কিন্তু এ যে কলকাতার প্রামাণ্য বাংলা নয়, এ যে পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক ভাষা–এটা পরিষ্কার। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রামাণ্য বাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত কথ্য ভাষার পার্থক্য মার্কিন এবং ব্রিটিশ ইংরেজির মতো প্রধানত কেবল উচ্চারণের নয়, তার চেয়ে বড়ো পার্থক্য শব্দাবলীর। আঞ্চলিক এবং আরবি-ফারসি শব্দ তাতে অনেক বেশি। এমন অনেক শব্দ আছে, যা লেখার মতো হরফও আমাদের বাংলা ভাষায় নেই। তা ছাড়া, যে-ইসলামী শুদ্ধবাদী চেতনা থেকে ‘খোদা” “আল্লায় পরিণত হয়েছেন, সেই চেতনার প্রভাবে বহু আরবি-ফারসি শব্দ এখন এমনভাবে লেখা হচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে তা আর তাবৎ বাঙালির কাছে বোধগম্য থাকবে না। পূর্ববঙ্গীয় ভাষার ব্যাকরণও যথেষ্ট পরিমাণে ভিন্ন ধরনের। বিশেষ করে ক্রিয়াবিভক্তি এবং সর্বনামে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের ভাষায় ইংরেজির প্রভাবে “ফোন দেওয়া”র অথবা “ধরা খাওয়া”র মতো এমন অনেক প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে, যার সঙ্গে প্রামাণ্য বাংলার মিলন ঘটানো শক্ত। এমন কি, ঢাকার ভাষায় পারিভাষিক ও আভিধানিক শব্দের সঙ্গে আঞ্চলিক শব্দের মিলন ঘটিয়ে যেসব বাক্য তৈরি করা হচ্ছে, তা এতোকাল অভাবনীয় ছিলো। (যেমন, তুমি আজীবন সদস্য হইবা? আমারে রেজিস্ট্রি কইরা বিয়ে করব? তোমারে খুব সুন্দর লাগে। আপনের নাম কয়েন। কী কইলা? আয়েন, বসেন ইত্যাদি ) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়া ছাড়া, কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই দেখতে পাচ্ছি না।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের ভাষায়ও আঞ্চলিকতার ছাপ পড়া খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত, সে লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। সেখানকার সৃজনশীল সাহিত্যে এখন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে— বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, ভাগলপুর, শিলিগুড়ি–দূরদূরান্তের ভাষা এখন সংলাপে আসতে আরম্ভ করেছে। তার ফলে এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের লোকেরা পুরো বুঝতে পারবে কিনা, তাতেও সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জাহান্নাম থেকে বিদায় নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন শওকত ওসমান। সে উপন্যাসে আরবিফারসি উপাদান সহ বেশকিছু আঞ্চলিক শব্দ ছিলো। পাছে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা সে ভাষা বুঝতে না-পারেন, তার জন্যে তিনি সেসব শব্দের অর্থ বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে দিয়েছিলেন। এ রকমের আর-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে ব্রিটিশ ইংরেজি এবং মার্কিন ইংরেজির পার্থক্য থেকে। কয়েক বছর আগে একটি মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ব্রিটিশ টেলিভিশনের একটি জনপ্ৰিয় সোপ অপেরা–ঈষ্ট এন্ডার্সদেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই সোপ অপেরার ভাষা এতো লন্ডনভিত্তিক এবং বহু শব্দের অর্থ এবং উচ্চারণ প্রামাণ্য ইংরেজি থেকে এতো আলাদা যে, মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সেই ধারাবাহিক দেখানোর আগে এই সব শব্দের অর্থ দিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে এবং সেই তালিকা দর্শকদের মধ্যে বিতরণ করে। কালে কালে দুই বাংলার মধ্যে তাই হবে কিনা, আমার প্রশ্ন এবং আশঙ্কা সেটাই।
এমন কি, ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয়, ওড়িষা এবং বিহারে যে-বাঙালিরা বাস করেন, বিশেষ করে ত্রিপুরা এবং অসমে, তার সঙ্গেও কলকাতার ভাষার পার্থক্য দেখা দেবে বলে মনে করাই সঙ্গত। ভারতের এসব রাজ্যের ভাষায় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দূরে অবস্থিত ত্রিপুরা এবং অসমের ভাষায় বাংলাদেশের ভাষার প্রভাবও যথেষ্ট মাত্রায় পড়তে পারে। তা ছাড়া, এসব জায়গায় যে-সাহিত্য গড়ে উঠবে, তাতে সেখানকার জীবনযাত্রা ক্রমবর্ধমান মাত্রায় স্থান পাবে।
ভাষার পার্থক্য কতোটা হবে, তা নিয়ে আমরা আপাতত কেবল আন্দাজ-অনুমান করতে পারি। কিন্তু সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে যে পার্থক্য দেখা দেবে, সে সম্পর্কে জল্পনাকল্পনা না-করেই বলতে পারি, তা হবে ব্যাপক। কলকাতায় গত দু শো বছরে যে-সাহিত্য রচিত হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্য করি প্রধানত হিন্দু-জীবনের প্রতিফলন। অপর পক্ষে, এখন বাংলাদেশে যে-সাহিত্য রচিত হচ্ছে, তার মধ্যে মুসলিম-জীবন প্রাধান্য পাবে, বলাই বাহুল্য। দেশবিভাগের ঠিক পরে পূর্ববাংলায় হিন্দুদের সংখ্যা ছিলো মোট জনসংখ্যার শতকরা প্ৰায় তিরিশ ভাগ। কিন্তু এখন সে সংখ্যা দশ ভাগের এক ভাগ। কেবল তাই নয়, ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ফলে দেশ থেকে যেভাবে হিন্দুরা চলে যাচ্ছেন, তাতে এখনকার তুলনায় হিন্দুদের অনুপাত আরও কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। এবং তা হলে, বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যে যেটুকু হিন্দুমুসলমানের মিলিত জীবন প্রতিফলিত হচ্ছে, তার পরিমাণ আরও কমে যাবে বলে মনে হয়। মোট কথা, আগামী পঞ্চাশ-একশো বছরে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের দুটি স্বতন্ত্র ধারা প্রবাহিত হবে বলেই ধারণা করি। এবং এই দুই ধারার মধ্যে বাংলাদেশের ধারাই যদি তখন বেশি জোরদার হয়, তা হলেও অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না।
এক শো বছর আগে যখন প্রথম বারের মতো বঙ্গদেশ বিভক্ত হয়, তখন রবীন্দ্রনাথ আশঙ্কা করেছিলেন যে, বঙ্গদেশকে একটি হিন্দু-প্রধান এবং একটি মুসলমান-প্রধান অংশে বিভক্ত করলে কালে কালে দুই বাংলায় অখণ্ড বাংলাভাষা নাও থাকতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীন পূর্ববঙ্গের নাম দেন বাংলাদেশ, তখন তিনি ঠিক কী ভেবেছিলেন, জানা যায় না। তবে তাঁর মনে হয়তো এমন ক্ষীণ আশা ছিলো যে, কালে কালে সে দেশ হবে তাবৎ বাংলাভাষীদের দেশ। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ যে এক কালে কেবল বাঙালি মুসলমানদের দেশে পরিণত হবে অথবা সেখানে একটা ভিন্ন ধরনের বাংলা ভাষা তৈরি হবে এবং তার ফলে দুই বাংলা স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যেতে পারে–এটা তিনি নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারেননি।
আপাতত বাংলাদেশের অনেকে এই সম্ভাবনার কথা ভেবে আশঙ্কিত না-ও হতে পারেন। তারা ভাবতে পারেন, ভালোই তো, বাংলাদেশে একটা বাংলাদেশী ভাষা তৈরি হবে! কিন্তু এর ফলে যে-অপূরণীয় ক্ষতি হবে, দূরদৃষ্টির অভাবে সেটা তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। তারা হয়তো ভাবতে পারছেন না যে, বাংলাদেশের ভাষা যদি মূল ভাষা থেকে যথেষ্ট মাত্রায় বদলে যায়, তা হলে এ দেশের লোকেরা তাদের ঐশ্বর্যমণ্ডিত সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবেন। পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর নানাভাবে পূর্ব বাংলার ভাষাকে মূলধারার বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। তার মধ্যে দুটি প্রয়াসের কথা এখানে বলা যেতে পারে–এক, আরবি হরফে বাংলা লেখা এবং দুই প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ জোর করে বাংলা ভাষায় নিয়ে আসা। পাকিস্তানের নেতারা আশা করেছিলেন যে, এই দুই উদ্যোগ সফল হলে ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার ভাষা পশ্চিম বাংলার ভাষা থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এবং কালে কালে পূর্ব বাংলার লোকেরা আর মূল বাংলা সাহিত্য পড়তে পারবেন না অথবা পড়বেন না।
পূর্ব বাংলার লোকেরা অবশ্য এই ষড়যন্ত্রকে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ব্যৰ্থ করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের পরে তাদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি যে-গভীর ভালোবাসা এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, তা সব ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলো। গোটা বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁরা নিজেদের শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে এখন বাংলাদেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আবার বাংলা ভাষার পায়ে কুডুল মারতে উদ্যত হয়েছেন। এর মধ্যে যারা ইসলামী সক্রিয়বাদী এবং ইসলামী ফাউন্ডেশন অথবা কোনো ইসলামী এনজিও-র অর্থ সহায়তায় নতুন করে আরবিফারসি প্রভাবিত বাংলা চালু করতে চেষ্টা করছেন, তাদের উদ্দেশ্যটা বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু একদল তথাকথিত “প্রগতিশীল” বুদ্ধিজীবীও আছেন, যারা সজ্ঞানে মূলধারার বাংলা থেকে ভিন্ন চেহারার বাংলা প্রবর্তনের পক্ষে ওকালতি করছেন। এঁদের কেউ কেউ আবার মার্কসবাদী বলেও নিজেদের শনাক্ত করেন। কিন্তু একটু ঠাহর করলেই বোঝা যায়, আসলে এঁরা মার্কসবাদী নন। অন্তরের অন্তস্তলে এঁরা একটা “বাদে”ই বিশ্বাস করেন, সেটা ইসলামী জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদকে এই সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখেন। নিজেদের বাঙালি পরিচয় নিয়ে এঁরা তাই বিব্রত বোধ করেন। প্রকৃত পক্ষে, তাদের বাংলাদেশীত্বকেই জোরদার করার জন্যেই তারা বাংলা ভাষার সংস্কার করতে চান।
বাংলাদেশের ভাষায় যদি কালে কালে স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন আসে, তা হলে সে সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। সেটা কারো পক্ষে ঠেকিয়ে রাখাও সম্ভব হবে না। কিন্তু কোনো সচেষ্ট ষড়যন্ত্রের ফলে যদি বাংলা ভাষার চরিত্র কৃত্রিমভাবে বদলে দেওয়া হয়, তা হলে তা হবে স্বেচ্ছায় আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার সামিল। সত্য বটে, স্বতন্ত্র চেহারার বাংলা চালু হলে কয়েক দশকের মধ্যেই আমরা আমাদের ঐতিহ্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবো না। কিন্তু, ধরা যাক, এক শতাব্দী পরে তখনো কি অখণ্ড বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য চালু থাকবে? অথবা রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র অথবা জীবনানন্দ, এমন কি নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন অথবা শামসুর রাহমানের সাহিত্য কেউ পড়বে? অথবা পড়লে তার অর্থ সবটা বুঝতে পারবে?
(প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬)