২৫. পরিশিষ্ট

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পরিশিষ্ট

শীতের অপরাহ্ণে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা আগ্রা দুর্গের অনতিদূরে শ্যামল তৃণক্ষেত্রের সম্মুখে আসিয়া লাগিল। নৌকায় একজন নাবিক ও দুইজন আরোহী ছিল, তাহা্রা অবতরণ করিল। আরোহিদ্বয়ের একজন পুরুষ ও অপর জন রমণী। পুরুষ নাবিককে জিজ্ঞাসা করিল, “ভুবন, সমাধি কোথায়?”

নাবিক যমুনাতীরে হরিদ্বর্ণ দূর্ব্বাক্ষেত্র দেখাইয়া দিল, আরোহিদ্বয় সেই দিকে চলিল।

তখন অস্তগমনোন্মুখ প্রৌঢ় তপনের হীনপ্রভ কিরণে রক্তবর্ণ পাষাণনির্ম্মিত আগ্রার দুর্গের শীর্ষে শুভ্র মতি মস্‌জিদের শুভ্রতর মিনার সুবর্ণবর্ণে রঞ্জিত হইতেছিল। উচ্চ ভূখণ্ডে শ্যামল তৃণক্ষেত্রের মধ্যভাগে একটি ক্ষুদ্র নির্ম্মল শ্বেতমর্ম্মরনির্ম্মিত সমাধি, কালিন্দীর নীলাম্বুরাশি আকুল হইয়া সেই সমাধির পাদমূলে আছাড়িয়া পড়িতেছিল। সমাধি আলিঙ্গন করিয়া শুভ্রবসনপরিহিত একজন প্রৌঢ় মুসলমান স্থির হইয়া বসিয়াছিল এবং তাহার পদতলে শীর্ণদেহা মলিনবেশা এক অন্ধ রমণী নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতেছিল। নৌকার আরোহিদ্বয় ও নাবিক তাঁহাদিগকে দেখিয়া দূরে দাঁড়াইল।;

পুরুষ জিজ্ঞাসা করিল, “ও কে ভূবন?” ভূবন অতি ধীরে কহিল, “বলিতে পারি না মহারাজ!”

রমণী অস্ফুট স্বরে কহিল, “কাছে গিয়া কাজ নাই, দূর হইতে দেখিয়া ফিরিয়া যাই।”

পুরুষ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ললিতা?”

“উনি কে বুঝিতে পারিতেছ না?”

“না।”

“আমি দেখিয়াই বুঝিয়াছি।”

“কে ললিতা?”

“আর কে? স্বয়ং বাদশাহ।”

এই সময়ে সেই প্রৌঢ় মুসলমান সমাধিবক্ষ হইতে মুখ তুলিল। ময়ুখ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন যে হিন্দুস্থানের একচ্ছত্র সম্রাট বাদশাহ্‌ শাহ্‌জহান জনশূন্য প্রান্তরমধ্যে শূন্য মস্তকে সমাধিপার্শ্বে উপবিষ্ট আছেন।

তখন ললিতা কহিলেন, “চোখে দেখি নাই কেবল তোমার মুখে শুনিয়াছি। যখন আসিয়াছি তখন একবার স্পর্শ করিয়া যাইব। আমরা এই খানে দাঁড়াইয়া থাকি বাদশাহ্‌ চলিয়া গেলে নিকটে যাইব।”

সহসা স্তব্ধ প্রাস্তরের জড়তা ভঙ্গ করিয়া করুণ কোমল কণ্ঠে সুমধুর সঙ্গীতধ্বনি উত্থিত হইল। দূর্ব্বাক্ষেত্রের অপর প্রান্তে কে গাহিয়া উঠিল,—

অতি মনোহর বাজয়ে সুসর
শুনিয়া পরাণ যা এ।
কিরূপ বাঁশী বোল বরায়ি
কেমনে তাক বাজা এ॥
বাঁশীর বিন্দত মুখ সংযোজিয়া
সপত সর বাজা এ।
নাগর শেখর নান্দের সুন্দর
বড়ু চণ্ডীদাস গাএ॥

সঙ্গীতধ্বনি শুনিয়া বাদশাহ্‌ চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তখন ময়ূখ বাদশাহকে অভিবাদন করিলেন। বাদশাহ্‌ বিষণ্ণ বদনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি গান গাহিতেছিলে?” ময়ূখ কহিলেন “না জহাঁপনা।”

“তবে কে গাহিল?”

“তাহাত বলিতে পারি না, প্রান্তরের অপর পারে কেহ গাহিয়া থাকিবে।”

“মন্‌সবদার, এ কোন্‌ ভাষার গান?”

“জনাব আলী, ইহা বাঙ্গালা গান।”

“আওয়াজ বড়ই মিঠা, তুমি উহাকে ডাকিয়া আনিতে পার?”

ময়ূখ ললিতার দিকে চাহিলেন, বাদশাহ্‌ তাহা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার সঙ্গে কে?”

ময়ূখ অবনত বদনে কহিলেন “শাহান শাহ্‌ আমার স্ত্রী।

বাদশাহ কহিলেন, “তোমার স্ত্রী আসিয়াছেন কেন?”

“হজরৎ বাদশাহ্‌ বেগমের সমাধির ধূলা লইয়া যাইতে।”

“নিকটে আসিতে বল, উঁহাকে গুলরুখের কাছে রাখিয়া তুমি গায়ককে ডাকিয়া আন।”

তখন ময়ূখের দৃষ্টি জীর্ণ শীর্ণ মলিনবসনাচ্ছাদিতা দৃষ্টিশক্তিহীনা রমণীর দিকে আকৃষ্ট হইল। তিনি দেখিলেন যে, রমণী উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে; মণিহারা কোটরগত নয়নদ্বয় বিস্ফারিত হইয়াছে; ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস বহিতেছে। সে কখন উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহা তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই। তিনি যখন বাদশাহের সহিত কথা কহিতেছিলেন, তখন অন্ধের শ্রবণপথে তাঁহার কণ্ঠস্বর প্রবিষ্ট হইয়া তাহাকে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল। বাদশাহের সহিত বাক্যালাপ করিতেছিলেন বলিয়া, গুলরুখ্‌ এতক্ষণ কথা কহেন নাই। সে কি বলিবার জন্য উৎকণ্ঠিতা হইয়াছিল। বাদশাহের উক্তি শেষ হইলে, গুলরুখ্‌ বলিয়া উঠিল, “দেবতা, তোমার রূপরাশির মধ্যে এত কঠোরতা লুক্কাইয়া ছিল, তাহা জানিতাম না। তুমি আবার কেন আমার নিকটে আসিয়াছ?”

ময়ূখ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। গুলরুখের মস্তকের আবরণ খসিয়া পড়িল, রুক্ষ তৈলহীন কেশরাশি, রক্তহীন, জ্যোতিহীন, পাণ্ডুবর্ণ মুখমণ্ডলের চারিপার্শ্বে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। দৃষ্টিশক্তিহীনা পুনরায় বলিয়া উঠিল, “দেবতা, আমার অন্ধকারময় জগতে তুমি একমাত্র আলোক, তোমার মূর্ত্তি সর্ব্বদা আমার দৃষ্টিশক্তিহীন নয়নের সম্মুখে চিত্রিত রহিয়াছে, কিন্তু তুমি নিকটে আসিও না, দূরে থাকিও। তোমার কণ্ঠস্বর বা পদশব্দ শুনিলে আমি উন্মাদ হইব।”

বাদশাহ্‌ অস্ফুট স্বরে তাহার কর্ণমূলে কি কহিলেন। তাহা শুনিয়া গুলরুখ্‌ শিহরিয়া উঠিল, সে কহিল, “কই? কোথায় তুমি? কোন্‌ দিকে?”

গুলরুখ্‌ উভয় হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিল, “তোমাকে একবার দেখিব, নয়ন থাকিতে দেখি নাই, একবার স্পর্শ করিব। বহিন্‌ তাহাতে কি তুমি অপবিত্র হইবে?”

বাদশাহ্‌ কহিলেন, “মন্‌সবদার, গুলরুখ্‌ তোমার পত্নীকে স্পর্শ করিতে চাহে।”

ময়ূখের অনুমতিপ্রাপ্তির পূর্ব্বেই ললিতা গুলরুখের দিকে অগ্রসর হইলেন। তাহার পদশব্দ শুনিয়া গুলরুখ্‌ দুইপদ অগ্রসর হইল এবং ললিতাকে স্পর্শমাত্র নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিল। বাদশাহ্‌ মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইলেন।

বহুক্ষণ পরে আত্মসম্বরণ করিয়া ময়ূখ গায়কের সন্ধানে চলিলেন। এখন যে স্থানে তাজগঞ্জের বাজার তখন সেখানে বিস্তৃত তৃণক্ষেত্র ছিল। ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে প্রান্তরের সীমায় এক কৃশকায় বিকলাঙ্গ অসিতবরণ বৃদ্ধ ধূলায় বসিয়া আছে। ময়ূখ তাহার নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমিই কি গীত গাহিতেছিলে?”

বৃদ্ধ পরিষ্কার বাঙ্গালায় কহিল, “হাঁ বাবা; চলিবার শক্তি নাই, মনে করিলাম গীত গাহিলে যদি কেহ অনুগ্রহ করিয়া আসিয়া লইয়া যায়।”

“তুমি কোথায় যাইবে?”

“ঐ সমাধির নিকটে।”

“আমি তোমাকে ঐখানে লইয়া যাইতেই আসিয়াছি।”

ময়ূখ বৃদ্ধকে ক্রোড়ে উঠাইয়া সমাধির নিকটে লইয়া গেলেন। বৃদ্ধ বস্ত্রমধ্য হইতে একটি বহুমূল্য হীরকাঙ্গুরীয়ক বাহির করিয়া ময়ূখের হস্তে দিল। ময়ূখ তাহা বাদশাহের হস্তে দিলেন। বাদশাহ্‌ অঙ্গুরীয়ক দেখিয়া চমকিত হইলেন। তিনি কহিলেন, “ফকির, তুমি সপ্তগ্রামের সেই বৈষ্ণব?”

বৃদ্ধ কহিল, “হাঁ মহারাজ, আমার কিছু প্রার্থনা ছিল।”

“প্রাসাদে গেলে না কেন?” “মহারাজ, আমার মন বলিয়া দিল যে ইহাই উপযুক্ত স্থান।”

“ফকির, তুমি কি চাহ?”

“আমার গুরু বন্দী হইয়া আছেন, মহারাজ দয়া করিয়া তাহাকে মুক্তি প্রদান করুন।”

তখন মমতাজ-ই-মহল আরজ মন্দ বাণুবেগমের জগদ্বিখ্যাত সমাধির ভিত্তি নির্ম্মিত হইতেছিল। কতিপয় ফিরিঙ্গি বন্দী দূরে মৃত্তিকা বহন করিতেছিল, বৃদ্ধ অঙ্গুলি চালন করিয়া তাহাদিগের একজনকে দেখাইয়া দিল। বাদশাহের আদেশে ময়ুখ তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন। বিকলাঙ্গ বৃদ্ধকে দেখিয়া ফিরিঙ্গি শিহরিয়া উঠিল। বৃদ্ধ সস্মিত বদনে তাহাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “একদিন পথভ্রান্তকে পথপ্রদর্শন করিয়াছিলে, অতএব তুমি আমার গুরু, বাদশাহের আদেশে তুমি মুক্ত।”

বাদশাহ ময়ুখকে ইঙ্গিত করিলেন, ময়ুখ ফিরিঙ্গির বন্ধন মোচন করিলেন। ফিরিঙ্গি স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

সহসা যমুনাতীর হইতে প্রবল বেগে বায়ু বহিল, সৈকতের রাশি রাশি কাশগুচ্ছ সমাধির শুভ্র মর্ম্মরের উপরে ছড়াইয়া পড়িল, বাদশাহ্‌ কঠিন শীতল শ্বেত মর্ম্মর আলিঙ্গন করিয়া বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার পশ্চাতে গুলরুখ্‌ ও ললিতা নতজানু হইয়া উপবেশন করিলেন। তাহা দেখিয়া ময়ূখও সমাধির পশ্চাতে জানু নত করিয়া মস্তক অবনত করিলেন। এতক্ষণে ফিরিঙ্গির নয়নে অশ্রু দেখা দিল, সে স্বদেশের প্রথানুসারে নতজানু হইল।

সেই ফিরিঙ্গি বন্দী হুগলীর পাদ্রী আলভারেজ।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *