বেতাল কহিল, মহারাজ!
দাক্ষিণাত্য দেশে ধর্মপুর নামে নগর আছে। তথায়, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত মহীপতি ছিলেন। এক প্রবল প্রতিপক্ষ রাজা, চতুরঙ্গিণী সেনা লইয়া, তদীয় রাজধানীর অবরোধ করিলে, রাজা মহাবল, স্বীয় সমস্ত সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে, সমরসাগরে অবগাহন করিয়া, অশেষপ্রকার প্রতীকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু, দৈবদুর্বিপাকবশতঃ, ক্ৰমে ক্রমে, স্বপক্ষীয় সমস্ত সৈন্য ক্ষয়প্রাপ্ত হইলে, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, প্রাণরক্ষার্থে, মহিষী ও তনয়া সমভিব্যাহারে, অরণ্যপ্ৰস্থান করিলেন। পদব্ৰজে ভ্ৰমণ করিয়া, তিন জনেই অতিশয় ক্ষুধার্ত হইলেন। তখন রাজা, মহিষী ও তনয়াকে তরুতলে অবস্থিতি করিতে বলিয়া, আহারোপযোগী দ্রব্যের আহরণার্থে গমন করিলেন।
সায়ংকাল উপস্থিত হইল। রাজা প্রত্যাগত হইলেন না। রাজমহিষী ও রাজকুমারী, রাজার অনাগমনে, নানা অনিষ্টের আশঙ্কা কবিয়া, যৎপরোনাস্তি বিষন্ন হইয়া, অশেষবিধ চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঐ দিনে, কুণ্ডিনের অধিপতি রাজা চন্দ্ৰসেন, আপন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সঙ্গে লইয়া, ঐ অরণ্যে মৃগয়া করিতে গিয়া ছিলেন। তাহারা, তাদৃশ নিবিড় অরণ্যমধ্যে, অসম্ভাবনীয় নরচরণচিহ্ন দেখিয়া, বিস্ময়ান্বিত চিত্তে, নানাপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে, পুংবিলক্ষণ লক্ষণ দ্বারা, উহা স্ত্রীলোকের পদচিহ্ন বলিয়া স্থিরীকৃত হইল। রাজা কহিলেন, চরণচিহ্ন দর্শনে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, দুই নারী, অচিরে, এই স্থান দিয়া, গমন করিয়াছে। চল, চারিদিকে অন্বেষণ করি।
পিতা-পুত্রে, অন্বেষণ করিতে করিতে, সায়ংসময়ে দেখিতে পাইলেন, দুই পরম সুন্দরী রমণী, তরুতলে উপবিষ্ট হইয়া, বাষ্পাকুল লোচনে, পরস্পর বদননিরীক্ষণ করত, যুথবিরহিত কুররীযুগলের ন্যায়, প্রগাঢ় উৎকণ্ঠায় কালযাপন করিতেছে। অবলোকনমাত্র, উভয়েরই অন্তঃকরণে অতিপ্রভূত কারুণ্যরস আবির্ভূত হইল। তখন তাঁহারা, স্নেহগর্ভ সম্ভাষণ পুরঃসর, অশেষপ্রকারে সান্ত্বনা ও অভয়প্রদান করিয়া, তাহাদিগকে রাজধানীতে লইয়া গেলেন। কিছুদিন পরে, রাজা রাজকন্যার, রাজকুমার রাজমহিষীর, পাণিগ্রহণ করিলেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই দুই নারীর সন্তান জন্মিলে, তাহাদের পরস্পর কি সম্বন্ধ হইবেক, বল। রাজা বিক্রমাদিত্য, ঈষৎ হাসিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।