২৫. নিশু ব্যাগ গোছাচ্ছে

নিশু ব্যাগ গোছাচ্ছে। একটি গোছানো হয়েছে। অন্যটিতে বই তোলা হচ্ছে। গাদা গাদা বই সে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, একটাও পড়া হয় নি। মনে হয় ইহজীবনে আর পড়া হবে না। একটু দূরে খাটে পা ঝুলিয়ে তৌহিদা বসে আছে। সে নিশুর ব্যাগ গোছানো দেখে অবাক হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। কোনো কারণ ছাড়াই সে নিশুকে ভয় পায়। একটি প্রচ্ছন্ন কারণ অবশ্যি আছে। নিশু ধমক দিয়ে তৌহিদাকে ওষুধ খাওয়ায়।

তৌহিদা ক্ষীণ গলায় বলল, ব্যাগ গোছান কী জন্যে?

নিশু বলল, আমি চলে যাচ্ছি এইজন্যে।

কোথায় যাবেন?

মহিলা হোস্টেলে সিট পেয়েছি। সেখানে চলে যাব।

আর আসবেন না?

দেখা সাক্ষাতের জন্যে আসতে পারি। থাকার জন্যে আসব না। এখন থেকে তুমি হাত-পা ছড়িয়ে একা তোমার ঘরে ঘুমাবে।

আপনার মামলা কি শেষ?

মামলা শেষ না। মামলা চলছে। চলতেই থাকবে। একদিন সব আসামি খালাস পাবে। হাসিমুখে বাড়ি চলে যাবে। আরেকটা মেয়েকে রেপ করবে।

তৌহিদা বলল, সেই মেয়েটার নাম কী?

নিশু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। তৌহিদা কয়েক দিন হলো মন দিয়ে কিছুই। শুনছে না। তার রোগটা কি আরো বেড়েছে? নিশু বলল, পরের মেয়েটার নাম তো আমি জানি না। যে-কেউ হতে পারে। তুমিও হতে পার।

তৌহিদা উঠে দাঁড়াল। নিশুর চলে যাওয়ার খবরটা বুবুকে দিতে হবে। নিশু বলল, তৌহিদা, তুমি কি আমাকে এককাপ চা খাওয়াতে পারবে?

দুধ চা?

হুঁ, দুধ চা। কড়া হয় যেন। চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গেও কিছু কড়া কড়া কথা বলব।

সালেহা গম্ভীর মুখে তৌহিদার কাছ থেকে নিশুর চলে যাবার খবর শুনলেন। বিরক্তমুখে বললেন, কাউকে কিছু না বলে চলে যাচ্ছে। বিরাট নিমকহারাম মেয়ে। যাবার আগে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়। তার ব্যাগ চেকিং হবে। টাকাপয়সা গয়না-টয়না নিয়ে চলে যেতে পারে। এই ধরনের মেয়েদের কোনো বিশ্বাস নাই।

তৌহিদা ক্ষীণ স্বরে বলল, নিশু আপা সেইরকম মেয়ে না।

সালেহা ধমক দিলেন, যা জানো না তা নিয়ে কথা বলবে না। এই মাগি কেমন মেয়ে সবাই জানে। এরকম একটা মেয়ে ঘরে এনে তুলেছে! মতিনকে আমি তার জন্যে একদিন ধরব। জন্মের শিক্ষা দিয়ে দিব।

 

নিশু চা খাচ্ছে। তৌহিদা তার সামনে বসেছে। তার সামান্য ভয় ভয় লাগছে। নিশু আপা না-কি কড়া কড়া কথা বলবে। না-জানি সেইসব কড়া কথায় কী আছে! জটিল কিছু আছে নিশ্চয়ই। ইদানীং সে জটিল কথা বুঝতে পারে না। জটিল কথা শুনলেই মাথা ঝিমঝিম করে।

তৌহিদা!

জি আপা।

আমি যে হোস্টেলে যাচ্ছি তুমিও ইচ্ছা করলে সেখানে যেতে পার। আমার সঙ্গেই যেতে পার। প্রথম কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকবে। তারপর সিট খালি হলে তুমি তোমার মতো থাকবে। এ বাড়িতে থাকা তোমার জন্যে ঠিক না।

কেন ঠিক না?

কারণ এই বাড়ির মানুষগুলো অসুস্থ। তোমার বুবু একজন মানসিক রোগী। তোমার ভাইজান ভ্যাবদা মানুষ। কিছু দেখেও দেখে না। কিছু বুঝেও বুঝে না। এটাও এক ধরনের রোগ। রোগীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকলে রোগ সংক্রমণ হবেই। তুমি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাও না?

চাই।

এখানে থেকে সেটা সম্ভব হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বুঝতে পারছ?

হুঁ।

এই বিষয়ে কিছু বলতে চাইলে বলতে পার। কোনো কিছু গোপন করতে হবে না। তোমার যা মনে আসে তুমি বলো।

তৌহিদা ক্ষীণ গলায় বলল, আমরা তো আলাদা সংসার করবই, তখন নতুন বাসা নিব।

নিশু বলল, তোমরা আলাদা বাসা করবে মানে কী? তুমি আর কে? মতিন?

হুঁ।

তৌহিদা শোন, তোমাকে আগেও কয়েকবার বলেছি, এখনো বলছি মতিনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয় নি। তোমার বিয়ে হয়েছে হাবিবুর রহমান নামের লোকটার সঙ্গে। ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় হয়েছে। সব অন্যায়ের প্রতিকার আছে। এই অন্যায়েরও আছে। প্রথমে আইনের মাধ্যমে এই বিয়ে ভাঙতে হবে, তারপর যদি তুমি মতিনকে বিয়ে করতে চাও এবং মতিন যদি রাজি থাকে তোমরা বিয়ে করবে। আলাদা বাসা করে থাকবে। বুঝতে পারছ?

জি। তবে আমরা একটা কাজের মেয়ে রাখব। সব কাজ আমি একা করতে পারব না। ও যেমন মানুষ সংসারের কিছুই দেখবে না।

কে এরকম মানুষ? তুমি কি মতিনের কথা বলছ?

হুঁ।

আমার মনে হয় না তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ।

আপা, মন দিয়ে শুনছি।

ঠিক করে বলো তো, মতিনের সঙ্গে কি তোমার বিয়ে হয়েছে?

না।

তোমার সঙ্গে কার বিয়ে হয়েছে?

তৌহিদা ফোঁপাতে শুরু করল। নিশু বলল, কাঁদবে না প্লিজ। নাকি কান্না আমার অসহ্য। আমি আমার হোস্টেলের ঠিকানা লিখে রেখে যাচ্ছি। যদি কখনো মনে কর এই বাড়ি ছেড়ে দেবে–ঠিকানা থাকল। ঠিক আছে?

জি।

তোমার চা ভালো হয়েছে। আরেক কাপ চা খাওয়াও।

জি আচ্ছা।

খাটের উপর দেয়ালটার দিকে তাকাও। একটা কাগজ দেয়ালে সেঁটে দিয়েছি। কোন ওষুধ কখন খাবে সব লেখা। ওষুধ খেতে যেন ভুল না হয়। ভুল হবে না তো?

জি-না, হবে না।

নিশু বলল, তৌহিদা, তুমি আমাকে ভয় পাও এটা আমি জানি। কিন্তু তোমাকে আমি খুবই আদর করি। আমার কোনো ছোট বোন থাকলে তাকে তোমার চেয়ে বেশি আদর করতাম না। আমি তোমার ভালো চাই। এতে কোনো ভুল নেই। Plese believe me.

 

হাবিবুর রহমান রাত করে বাড়ি ফিরলেন। সালেহা হাসিমুখে বললেন, অ্যাই শোন, চিড়িয়া উড়ে গেছে।

হাবিবুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, চিড়িয়া উড়ে গেছে মানে?

মহাজ্ঞানী নিশু ম্যাডাম চলে গেছে।

কোথায় গেছে?

কোথায় গেছে আমি কী জানি! যেখানে ইচ্ছা যাক। আমাদের কী! না-কি তোমার কোনো বিষয় আছে?

আমার কী বিষয় থাকবে?

পুরুষ মানুষদের তলে তলে অনেক বিষয় থাকে। মেয়েদের হলো ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ আর পুরুষদের হলো পাঞ্জাবির নিচে ঝামটা নাচ। বুঝেছ?

হুঁ।

নিশু ম্যাডাম যাবার সময় আমার কাছ থেকে ছোট একটা ট্রিটমেন্ট পেয়েছে। এরকম ট্রিটমেন্ট পাবে চিন্তাই করে নাই। চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে নাই।

কী ট্রিটমেন্ট দিয়েছ?

সালেহা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছে, আমি বললাম, তোমার ব্যাগ খুলে আমাকে দেখাও, চেকিং হবে। আমার অনেক জিনিস মিসিং। ইচ্ছা করে যে কিছু নিয়েছ তা বলছি না। ভুলেও তো নিতে পার। ভালো ট্রিটমেন্ট না?

হাবিবুর রহমান হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। সালেহা বললেন, আজ তো তোমার ঈদ। রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

ঈদ কী জন্যে?

ছোট বউয়ের ঘর খালি। ছোট বউয়ের সঙ্গে থাকতে পারবে। আজ তোমাকে পারমিশান দিলাম। এতদিন বিয়ে হয়েছে, এখনো তুমি এক জায়গায় বউ আরেক জায়গায়, এটা ঠিক না।

বাদ দেও তো এইসব।

সালেহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, বাদ দিব কেন? বিয়ে করেছ স্ত্রীর সঙ্গে থাকবে, এতে সমস্যা কী? অবশ্যই আজ রাতে তুমি ঐ ঘরে থাকবে। অবশ্যই অবশ্যই।

হাবিবুর রহমান বিড়বিড় করে বললেন, মেয়েটা অসুস্থ।

সালেহা বললেন, এইজন্যেই তো একসঙ্গে থাকবে। কয়েক মত এক বিছানায় ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।

রাত সাড়ে দশটার দিকে হাবিবুর রহমান শুকনা মুখে তৌহিদার ঘরে ঢুকলেন। তৌহিদা বলল, ভাইজান কী?

হাবিবুর রহমান জবাব না দিয়ে খাটের একপাশে শুয়ে পড়লেন।

 

তৌহিদা ভোরবেলা ঘর থেকে বের হলো। ঘড়ি দেখল। ঘড়িতে তিনটা বাজে। ঘড়ি নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে আছে। জানালা দিয়ে দিনের হালকা আলো আসছে। রাত তিনটায় নিশ্চয়ই ভোর হয় না। সে সাবধানে দরজা খুলেছে। সালেহার ঘুম পাতলা, একটু শব্দ হলেই জেগে উঠতে পারেন। তিনি জেগে উঠলে তৌহিদার কোথাও যাওয়া হবে না। তৌহিদার একটা জায়গায় যেতে হবে। এক্ষুনি যেতে হবে।

রাস্তাঘাটে লোকজন নেই, তবে কিছু রিকশা চলছে। ইয়েলো ক্যাব দেখা যাচ্ছে। একটা খালি রিকশা এগিয়ে আসছে।

আফা কই যাবেন?

তৌহিদা কোথায় যাবে না বলেই রিকশায় উঠে পড়ল। রিকশা চলতে শুরু করুক, তারপর সে চিন্তা করবে কোথায় যাবে। মতিনের মেসে যাওয়া যায়। মতিনকে ঘুম থেকে তুলে বলতে পারে, অ্যাই, তোমার সঙ্গে নাশতা খেতে এসেছি। কিংবা সে নিশুর হোস্টেলেও যেতে পারে। নিশুর ঠিকানা তার সঙ্গে আছে। নিশুকে সে বলবে, আপা, আপনি যে কোন ওষুধ কখন খেতে হবে তালিকাটা করেছেন, সেখানে ভুল আছে। আপনি লিখেছেন–নীল ট্যাবলেট রাতে একটা করে। রাতে ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে দুটা। একটা করে খাচ্ছি বলেই আমার রোগ সারছে না।

রিকশাওয়ালা বলল, আফা যাইবেন কই?

তৌহিদা জবাব দিল না। সে এখনো ঠিক করতে পারছে না কোথায় যাবে। তার গ্রামের বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে। কীভাবে যেতে হয় কিছুই মনে নেই। তবে লঞ্চে যেতে হয় এটা মনে আছে। সে কি সদরঘাটে চলে যাবে? সেখান থেকে লঞ্চে উঠবে?

কে কথা কয় উপন্যাসে তৌহিদার প্রসঙ্গ এখানেই শেষ। তাকে পরে আর কোথাও পাওয়া যায় নি। ঢাকা শহরে একবার কেউ হারিয়ে গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না।

যে নেই তার গল্প ও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *